অঙ্গারের নেশা, পর্ব:১৯+২০

0
1016

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~১৯

‘এমন হাসছিস কেনো তুই? ‘

প্রানেশার মা মিসেস আরা খাবার বাড়তে বাড়তে প্রশ্ন করলো প্রানেশাকে ৷ প্রানেশা তখন মগ্ন তার মনের মানুষের চিন্তায়। আজ ছয়মাস যাবৎ সেই অজানা লোকটার সাথে কথা বলছে সে৷ কিছুক্ষণ আগেই ফোন দিয়ে পাগলামো কথাবার্তা বলে প্রানেশাকে হাসালো৷ প্রাণেশার এখন একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে যেনো। এই বয়সটাই হলো ফ্যান্টাসির৷ যা দেখে সবই রঙিন। একটু কিছুতেই অনেক বড় স্বপ্ন সাজিয়ে ফেলে এরা৷ প্রানেশাও ব্যাতিক্রম নয়। ঐ মুগ্ধ করা কন্ঠ শুনলে প্রানেশার মন ফুরফুরে হয়ে আসে৷ খাওয়ার টেবিলে বসে ভাত নাড়তে নাড়তে ফিক করে হেসে উঠতেই মিসেস আরা ভ্রু কুচকে বললেন কথাটি। প্রানেশা স্বাভাবিক মুখ করে বললো ‘কিছু না মম’

‘ গভীর প্রেম মনে হচ্ছে! ‘

ইভানানের কথায় কিঞ্চিৎ হাঁসলো সুফিয়ান। লাইব্রেরিতে বসে কিছু নোটস তৈরি করছিলো৷ সামনে পরীক্ষা, তাই কিছু সময় হলেও পড়তে হবে। কিন্তু মনটা প্রানেশার কাছেই পড়ে আছে। মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলো তাই ইভানান টিটকারি স্বরে কথাটা বললো। সুফিয়ান সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে বললো- ‘প্রেম নয় নেশা! গভীর নেশায় পড়ে গেছি। এবার পরীক্ষাটা হোক তারপর আমার গানকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবো। আমার প্রাণকেও আমার কাছে নিয়ে আসবো ‘

কথাগুলো বলার সময় চোখ মুখে উজ্জ্বল আভা ফুটে উঠলো সুফিয়ানের। ইভানান সেই আভায় নিজের নীল চোখদ্বয় নিক্ষেপ করে তাকিয়ে রইলো। সেই দৃষ্টি সুফিয়ান বুঝতে পারলো না। ইভানান গম্ভীর গলায় বললো – ‘ ছোট চাচার তো ব্যবসা আছে, এত নামীদামী ব্যবসা থাকতে তুই কিনা গানকে পেশা হিসেবে নিবি!’

সুফিয়ানের হাস্যজ্জল মুখ শক্ত হয়ে এলো৷ খসখসে গলায় বললো -‘ ঐ লোকের ব্যবসায় বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আমার। তার ব্যবসা নিয়ে সে যা ইচ্ছে করুক। আমার রেয়ু ভালো পড়াশোনা করছে , তাই ও নিজে কাজ করে খাবে আর আমিও আমার ক্যারিয়ার নিজ হাতে গড়বো। তার নাম আমার সামনে নিবি না! আই জাস্ট হেট হিম’

‘সে তো বাবা হয় সুফি,একটা ভুল নাহয়.. ‘

সুফিয়ান উঠে দাড়িয়ে চেয়ারে লাথি মেরে রাগে ফুঁসতে
লাগলো৷ মুখ লাল হয়ে গেছে। হিংস্র রুপে বললো-

‘নাহ, কোনো যোগ্যতা নেই ঐ লোকের আমার বাবা হওয়ার। আমার সহজ সরল মাকে ঠকিয়েছে সে।সুখেই তো ছিলাম আমরা! টাকা নাহয় একটু কমই ছিলো। তাতে কী? সুখের কমতি তো ছিলো না ৷ কত সুখী ছিলাম আমরা। ছোট দুই রুমের একটা ঘর ছিলো, একটা টিভি ছিলো। আমি বাবার কোলে বসতাম আর রেয়ু মায়ের কোলে৷ বাবা মার প্লেটে খাবার না খেলে পেটই ভরতো না। মা সবসময় হাসিখুশি থাকতো। বাবা মায়ের খুনসুটি ঝগড়া, ভালোবাসা দেখতাম। সব তো ঠিকই ছিলো। কিন্তু , কেনো ঐ লোকটা আমার মাকে ঠকিয়ে বসের মেয়েকে বিয়ে করলো তাও কিনা টাকা পয়সার জন্য!
যেদিন লোকটা ঐ মহিলাকে বিয়ে করে অন্য বাড়ি চলে গেলো সেদিন মা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিলো, রেয়ুর পাঁচ আর আমার সাত বছর। লোকটা একবারও ভাবেনি আমার সহজ সরল মায়ের কী হবে! প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়ে দিতো। মা আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব অন্যায় মুখ বুজে সয়ে গেলো। রেয়ু চুপচাপ হয়ে গেলো, শান্ত, স্থির। আর আমি সারাদিন বাহিরে থাকা শুরু করলাম। ঘরে গেলেই মায়ের বিষন্ন মুখটা দেখে ভেতরটা খানখান হয়ে যেতো। চার বছর আগে যেই দ্বিতীয় বউ মারা গেলো, আবার ইনিয়ে বিনিয়ে আমার মায়ের কাছে মাফ চেয়ে আমাদের সঙ্গে থাকতে এলো। টাকা পয়সা তো তখন সব ঐ লোকটারই। কারণ, দ্বিতীয় ঘরে কোনো সন্তান হয়নি, মহিলাটি সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম হওয়ার জন্যই এত বড়লোকের মেয়ে হয়েও সাধারণ কর্মচারীকে বিয়ে করলো৷ মায়ের থেকে দূরে যেতে পারিনা বলেই তো এখনও ঐ বাড়ি পড়ে আছি। নাহলে, লোকটার মুখ দেখতেও আমার জাস্ট ঘেন্না হয়! ‘

বলতে বলতে সুফিয়ানের চোখে পানি এসে গেলো প্রায়। লম্বা শ্বাস ফেলে ব্যাগটা কাঁধে তুলে শান্ত ভেজা গলায় বললো -‘ ছন্নছাড়া পরিবারে সন্তানরা ঠিক কতটা কষ্টে বড় হয়, তা বলে প্রকাশ করা যায় নারে, আজ আসি ‘

বাড়িতে ঢুকতেই দেখলো মিস্টার রাহাত টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছেন। সুফিয়ান বিরক্তিতে চোখ সরিয়ে এগোতেই মিস্টার রাহাত নরম কন্ঠে বললো-
‘সুফিয়ান বাবা, এসো খাবার খেয়ে নাও’

সুফিয়ান উত্তর না দিয়ে ফিল্টার থেকে পানি নিয়ে ঢকঢক করে পান করে চুলে হাত বুলিয়ে নিঃশব্দে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো। মিস্টার রাহাত আবারও বললেন –
‘কী হলো এসো! কিছু তো খাওনি নিশ্চয়ই ‘

সুফিয়ান তাচ্ছিল্য হেঁসে বললো –

‘এত ভাবতে হবে না আপনাকে, পুট ওয়েল অন ইয়োর হুইল’

মিস্টার রাহাত আহত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো এক তপ্ত নিঃশ্বাস। মিসেস অদিতি পাশেই বসে ছিলেন এতক্ষণ। এসব নতুন নয়। প্রতি দিনই মিস্টার রাহাত নিজ থেকে কথা বলার চেষ্টা করেন কিন্তু সুফিয়ান খুব বেশি হলে হ্যা, না মতো কথা বলে চলে যায়। মিসেস অদিতি এ নিয়ে উচ্চ্যবাচ্য করেন না। কারণ, সুফিয়ান আগেই বলে দিয়েছে যদি কোনো রকম মানিয়ে নেয়ার কথা বলা হয় সে বাড়ি ছাড়তে এক মিনিটও ভাববে না। মিসেস অদিতি খাবার খাওয়ার পর চুপচাপ বিনাবাক্যে চলে গেলেন। রাহাত সাহেব অসহায়ের মতো বসে রইলেন, এখন তার ভুল সে বুঝতে পেরেছেন। বুঝেছিলেন, দ্বিতীয় বিয়ের কয়েক বছর পরই। দুই সন্তান, প্রথম ভালোবাসার বউকে ছাড়া যে থাকা সম্ভব না তা ঠিকই বুঝেছিলেন কিন্তু দ্বিতীয় বউ কাগজ পত্রে সই করিয়ে নিয়েছিলো। দ্বিতীয় স্ত্রী মারা যাওয়ার আগে যদি কোনো প্রকার সন্তানদের সঙ্গে দেখা করে তাহলে জেলে যেতে হবে। তখন কিছুই করার ছিলো না৷ অদিতি যতই বলুক ক্ষমা করে দিয়েছে, কিন্তু সে জানে অদিতি সেই আঘাত এখনো ভোলেনি। তা-ই তো এখন তার সাথে প্রয়োজনীয় কিছু ছাড়া কথা বলেনা। এ যেনো বিনা আঘাতে রক্তাক্ত করা৷ অপরাধবোধ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ শাস্তি। এর চেয়ে বেশি শাস্তি দেয়া পৃথিবীর বুকে সম্ভব নয়।

বেলকনিতে বেছানো মেট্রেসের উপর নিথর হয়ে শুয়ে আছে সুফিয়ান। চোখ মুখ শুকনো। প্রায় রাতেই এভাবে বসে থাকে সে। একাকীত্ব কুড়ে কুড়ে খায় তখন। এ যেনো নিত্যদিনের সঙ্গী সুফিয়ানের। সেও চায় স্বাভাবিক একটা জীবন। যেখানে এই বিষন্নতা আর দীর্ঘশ্বাসের কোনো স্থান থাকবে না। কিন্তু সবার কপালে যে এই সুখ লেখা থাকে না। রাতের নিস্তব্ধতায় মোড়া শহরের দিকে এলোমেলো দৃষ্টি দিয়ে আছে। মুখে শব্দ নেই। চারদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়ে স্মার্টফোনের ঝকঝকে স্কিৃনে ‘নেশা ‘ ইজ কলিং লেখা দেখা যাচ্ছে। ঠোঁট আপনাআপনি প্রসারিত হয়ে হাসির ভঙ্গিমা হয়ে এলো৷ এই একটা মানুষের কন্ঠে ভেতরের সকল বিষন্নতা দূর হয়ে যায় তার৷ দ্রুত রিসিভ করে কানে দিতেই ভেসে এলো অভিমানী সুর -‘আমায় আপনি ভুলে গেছেন তাইনা? ‘

সুফিয়ান হেঁসে উঠে দাড়িয়ে দোলনায় বসে পড়লো। দোল খেতে খেতে বললো-
‘ আমি ভুলে গেলে কী তোমার কিছু এসে যাবে প্রানেশা? আমি কী খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ?’

প্রানেশা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো৷ সারাদিন শুধু মোবাইল হাতে নিয়ে ফোনের অপেক্ষা করেছে সে। কিন্তু নিষ্ঠুর মানুষটা কী তা বোঝে! একটুও বোঝে না। এই যে প্রানেশা লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে নিজে থেকে প্রথম বার কল করলো অথচ তাকে কী লজ্জাটাই না দিচ্ছে। প্রানেশা হালকা লজ্জা আর রাগ মেশানো কন্ঠে বললো- ‘আচ্ছা ঠিক আছে, ফোন রেখে দিচ্ছি। খুব ডিস্টার্ব করে ফেলেছি আপনাকে ‘

রাগে গলার স্বর ডেবে গেছে প্রানেশার। সুফিয়ান বুঝলো এই রাগ সহজে ভাঙার নয়, সারাদিন যে প্রানেশা তার অপেক্ষা করেছে ভাবতেই ভালো লাগায় শরীর জুড়িয়ে গেলো। আদুরে কন্ঠে বললো-

‘খুব ভুল হয়ে গেছে। আর কখনো এমন হবে না রাণী’

প্রানেশা নাক টেনে টেনে বললো-
‘আর যদি হয়?’

‘তাহলে, এই আমিটাকে আপনাতে সপে দেবো। পুড়িয়ে অঙ্গার বানিয়ে নিয়েন ‘

প্রানেশা লজ্জামিশ্রিত হেঁসে বললো –

‘ তা না হয় ঠিক আছে। কিন্তু একটা জিনিস যে আপনি এখনো বললেন না!’

‘কী বলিনি? ‘

‘আপনার নাম! ছয় মাস হয়েছে অথচ আপনার নামটাই বললেন না ‘

‘ আমি ঠিক করে রেখেছি যেদিন আমাদের দেখা হবে সেদিন আপনাকে আমার নাম বলবো। তার আগ পর্যন্ত আপনি নাহয় আমায় ‘অঙ্গার ‘ বলেই ডাকুন ‘

‘অঙ্গার! অদ্ভুত তো! ‘

‘ অদ্ভুত হলেও এটাই ডাকবেন। যেদিন আমাদের দেখা হবে এর অর্থ আপনাকে ব্যাখ্যা করবো, এই শব্দে যে কতটা মায়া লেগে আছে তা দেখাবো৷ ‘

‘আচ্ছা ‘

সুফিয়ান মৃদু হেঁসে বললো –

‘ রাণী শাস্তি মওকুফ করেছেন তো? নাকি আরও বাকি!’

প্রানেশা চাপা হেঁসে বললো –

‘নাহ, আরও বাকি। অঙ্গার সাহেব যদি নিজের অতীব সুন্দর কন্ঠে একখানা কবিতা শোনায় তাহলে রাণী ভেবে দেখবেন ‘

সুফিয়ান দোলনায় হেলান দিয়ে হাসিমুখে বললো-

একটা হলুদ বিকেল হবো
একপশলা হাসি হবো
তোর বাঁকা ঠোঁটে রাখবি আমায়?
তোর জেগে থাকা রাত্রি হবো
পূর্ণিমার ঐ চাঁদ হবো
জানালাতে দেখবি আমায়?
তোর পায়ের আলতা হবো
একটা লাল টিপ হবো
তোর কপালে রাখবি আমায়?
তোর খোঁপার ফুল হবো
রেশমি কাচের চুড়ি হবো
তোর হাতে পড়বি আমায়।
তোর লেখা চিঠি হবো
একটা প্রেমের গল্প হবো
লিখবি আমায়?

– কাব্য আহমেদ

চলবে…

অঙ্গারের নেশা
নাঈমা হোসেন রোদসী
পর্ব~২০

লাইব্রেরির একটা কোণায় বই হাতে বসেছিলো রেয়ান। মন দিয়ে প্রতিটা লাইনে ডুবে আছে। টেবিলের সামনে দুই জোড়া জুতোআলা পা দাঁড়াতেই উপরে মাথা তুললো রেয়ান। দেখা গেলো নীল চোখের পুরুষকে, অর্থাৎ ইভানান। চোখে প্রতিদিনের মতোন চশমা নেই। গায়ে একটা জার্সি দেখা যাচ্ছে লাল রঙের। রেয়ান নিষ্পাপ হাসলো। ইভানানও হালকা হেসে পাশের প্লাস্টিকের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে রেয়ান বললো-

‘কিছু বলবে ইভ ভাই?’

ইভানান গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো। রেয়ান ইশারায় বললো-‘তো বলো ‘

ইভানান হাত ভাজ করে শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে বসে রইলো তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো –
‘তোর মনে হয় না? তুই নিজের অধিকার এখনো বুঝে উঠতে পারিসনি! ‘

রেয়ান অবাক হয়ে বললো-
‘কীসের অধিকারের কথা বলছো?’

‘আরে বোকা ছেলে! নিজের ব্যাক্তিগত অধিকারটাই তো পেলিনা তুই’

‘ব্যাক্তিগত অধিকার! ‘

‘হ্যা, এই যেমন দেখ ঘরেও তোর কোনো মর্যাদা নেই আবার বাহিরেও কোনো মূল্য নেই। সব জায়গায় তো সুফিয়ানেরই জয়গান চলে ‘

রেয়ান প্রতিবাদ স্বরে বললো-
‘এসব কী বলছো! সুফিয়ান ভাইয়ের তো কোনো দোষ নেই এতে’

‘আহা! উল্টো বুঝিস কেনো?আমি কী বলেছি নাকি, যে সুফিয়ানের কোনো দোষ আছে! সুফিয়ান তো প্রাণের বন্ধু, ভাই। কিন্তু তুইও তো আমার ভাই হোস। তোকেও আমি ভালোবাসি। তাই চাই তুইও ভালো থাক।’

‘আমি তো ভালো আছি ইভ ভাই ‘

‘সত্যিই ভালো আছিস? একটু ভেবে দেখ তো? ‘

রেয়ান স্মৃতির পাতা হালকা উল্টোতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সবার করা অপমান, তাচ্ছিল্য৷ তারপরও মুখে হেসে বললো –
‘এমন কিছুই নেই ইভ ভাই। ভালোই তো আছি আমি সুফিয়ান ভাই কত ভালোবাসে আমাকে, আমি খেতে পারছি, মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে। এইবা কয়জন পায় বলো?’

ইভানান বিরক্তিস্বরে বললো-

‘তোর এই বোকামির কারণেই তুই পিছিয়ে আছিস। দেখবি একদিন তুই কিছুই পাবিনা। ‘

‘মানে? ‘

‘ যেমন, তোর বাবার কথাই দেখ। তোর সাথে ঠিক মতো কথা বলে? সুফিয়ানের কটুবাক্য শুনেও চেষ্টা করে ওর সাথে কথা বলার। তোর মা? কখনো তোর আলাদাভাবে ভালো লাগা মন্দ লাগার খোঁজ নেয়? নেবে কী করে সুফিয়ান আছে না? আরে ভাই, ইউনিভার্সিটিতে যখন হরেক রকম প্রতিযোগিতা, রেস, অনুষ্ঠানে সবার প্রথমে কার ডাক পড়ে? ‘

রেয়ান সম্মহিতের মতোন বললো-
‘সুফি ভাই? ‘

‘এক্সাক্টলি! সুফিয়ানের রূপ, গুণের একটাও তোর মাঝে নেই বলেইতো তুই এখনো পিছিয়ে আছিস ‘

‘তাহলে এখন কী আমার সুফিয়ান ভাইয়ের গুণগুলো আমার মাঝে আনা উচিত? ‘

‘শুধু গুণই নয় রূপও খুব গুরুত্বপূর্ণ। দেখ, সুফিয়ানের জন্য কত মেয়ে পাগল। অথচ এই পর্যন্ত একটা মেয়েও তোর দিকে ভালো মতো তাকায়নি ‘

রেয়ান মন খারাপের সুরে বললো –

‘গুণগুলো নাহয় আমি আমার আয়ত্তে আনতে পারবো কিন্তু রূপ তো আল্লাহর দান। সুফি ভাই মায়ের মতোন হয়েছে। আমি তো বাবার মতোন ‘

‘হুম, তা ঠিক যদিও। কিন্তু এখন তো আর আগের যুগ নেই, চাইলেই কত কিছু করে চেহারা পাল্টানো যায়! নায়ক নায়িকারাও করে অনেক সময়। তবে তোর করার কোনো দরকার নেই। তুই যেভাবে আছিস, সেভাবেই থাক। কী দরকার এসবের! ‘

বলেই চেয়ার টেনে আগের জায়গায় রেখে শিশ বাজাতে বাজাতে বাহিরে চলে গেলো। পেছনে থম মেরে বসে রইলো রেয়ান, মাথায় বারবার ইভানানের কথাগুলো ক্রমাগত গর্জন করে উঠছে৷ নিজমনেই বিরবির করে বললো -‘ প্লাস্টিক সার্জারি করলেই কী আমি বদলে যাবো! ‘ আবার আরেকমনে বললো-
‘ নাহ, কী উল্টো পাল্টা ভাবছি! জমজ হলে আলাদা কথা ছিলো। আমি সুফি ভাইয়ের ছোট। তাছাড়া সুফি ভাইয়ের মতো হওয়ার কী দরকার ‘
বলেই নিজের হাতে আবার বইটা নিয়ে নিলো কিন্তু মনোযোগ দিতে পারলো না। কোনো খাবারের একটা পাশে যদি পোকা পড়ে তাহলে আমাদের পুরো খাবারটার উপর অরুচি ধরে যায় তেমন মস্তিষ্কে নেগেটিভিটি টাই সবচেয়ে বেশী ছড়িয়ে পড়ে।

একসপ্তাহ পরের কথা, রাহাত সাহেবের অনুরোধে আজ ডাইনিং টেবিলে বসেছে ৷ সাধারণত রেয়ান নিজের রুমে খায়, সুফিয়ান কখনো বাহিরে থেকে খেয়ে আসে তো কখনো না খেয়েই কাটিয়ে দেয়, বাকি থাকেন রাহাত সাহেব আর মিসেস অদিতি তারা একসঙ্গে বসে খান। কিন্তু, সবাইকে অনুরোধ করে বলেছেন, আজ যেনো সবাই একসঙ্গে বসে। কারণ তিনি একটি জরুরি কথা বলবেন। সুফিয়ান আসতে না চাইলেও মায়ের হাতজোর করায় না এসে পারলো না। রেয়ান একবার বলার পরই এসে পড়লো৷ সুফিয়ান মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বসে একটা স্যান্ডউইচ খাচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পরই রাহাত সাহেব গলা ঝেড়ে বললেন –

‘আমি তোমাদের সবাইকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য ডেকেছি ‘

সুফিয়ান অনাগ্রহ নিয়ে বললো-
‘তো বলুন দ্রুত। সেই কখন থেকে বসিয়ে রেখেছেন ‘

রাহাত সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন-
‘হুম বলছি। কথা হচ্ছে, তুমি বড় হয়েছো। আমার বয়স বেড়েছে। তাই আমি চাই তুমি ব্যবসার হাল ধরো। ব্যবসা তো তোমারই ‘

রেয়ানের কপালে হালকা ভাজ পড়লো। তার কারণ হলো ব্যবসা সুফিয়ানের বলায়। সুফিয়ান বললো –
‘ আমার থেকে এইসবের এক্সপেকটেশন না রাখাই রীতিমত বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমি আপনার ব্যবসাশ একরত্তিও হাত দেবো না। তাই নেক্সটে এসব বলে আমার টাইম ওয়েস্ট করবেন না ‘

রাহাত সাহেব আহত দৃষ্টি দিয়ে বললেন –

‘তুমি আমার বড় ছেলে। যদি এসবের দায়িত্ব তুমি না নাও তো কী করে হবে?’

রেয়ানের মনে সৃষ্টি হলো একরাশ অভিমান। আর তা মস্তিষ্কে গিয়ে তৈরি হলো গভীর ক্রোধানল। মনে বারবার একটাই প্রশ্ন আসছে’ সে নাহয়, দেখতে একটু খারাপই, কিন্তু পড়াশোনা যোগ্যতায় তো কম নয়। তাহলে সব জায়গায় কেনো তাকে হেট করে নিচু দেখানো হয়! সুফি ভাইকেই কেনো চোখে পড়ে? সেও তো তার ছেলে তাহলে ব্যবসা কেনো সুফিয়ানের একারই হবে! ‘

কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না রেয়ানের ক্রুদ্ধ মন৷ হিংসা মানুষকে ঠিক কতটা খারাপ বানাতে পারে তা রেয়ান জানতো না। খাবার পুরোটা না খেয়েই হনহন নিজের রুমে চলে গেলো। সুফিয়ান সহ সবাই কথায় ব্যাস্ত ছিলো তাই সেদিকে খেয়াল করেনি কেউই। রেয়ানের মস্তিষ্কে শুধু চিন্তা এলো, যে সুফিয়ানকেই সবাই ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে আর তাকে মনে করে অযোগ্য তাই তো তাকে ব্যবসার কিছু বলা হলো না। কিন্তু সে এটা একবারও চিন্তা করেনি, যে সুফিয়ানের সঙ্গে তফাৎ কম হলেও সত্য এটাই যে সুফিয়ান বড়। তা-ই রাহাত সাহেব সুফিয়ানকে বলেছে। তার উদ্দেশ্য যে রেয়ানকে ব্যবসা না দেয়ার ছিলো না তা রেয়ানের বোকা মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারেনি।

সব কথা শেষে সুফিয়ান নিজেই বলে দিয়েছিলো যে সে কোনো দায়িত্ব নিতে পারবে না। তাই রেয়ানকে এসব বুঝিয়ে দেয়া হোক। রাহাত সাহেবও ভাবলেন জোর করে তো আর কিছু হয়না তাই দায়িত্বটা রেয়ানকেই দেয়া হবে। সুফিয়ান নির্লিপ্ত ভাবে নিজের রুমে চলে গেলো। তার একমাত্র মনোনিবেশ শুধুমাত্র গান। কয়েকদিন আগেই একজন প্রডিউসারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তার কয়েকটি গান জমা দিয়েছিলো সে। প্রডিউসার জানিয়েছে একটা কনসার্টে তাকে গান গাওয়ার সুযোগ দেয়া হবে। তারপরই তার প্রাণের সঙ্গে দেখা করবে। অর্থাৎ একদিকে কনসার্ট শেষ হবে তারপরই যাবে প্রাণের সঙ্গে দেখা করতে। ফোন করে জানাতেই প্রানেশাও হ্যা বললো। সেও খুব করে চায় মনের মানুষটাকে একবার দেখতে। যেখানে দুইজন মানব মানবী নিজেদের প্রেম নিবেদনের উচ্ছলতায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিলো। মত্ত ছিলো নিজেদের প্রথম দেখা, প্রথম হাতে হাত রাখা, একসঙ্গে প্রথমবারের মতোন চোখে চোখ রাখা নিয়ে। কিন্তু তারা কী জানতো? যে তাদের আলাদা করতে প্রকৃতি নতুন খেলায় মেতেছে?

চারদিন পরই রাস্তায় ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথে বড় একটা এক্সিডেন্ট হলো। সেই গাড়িতেই ছিলো সুফিয়ান। গাড়ি ট্রাকের সঙ্গে এক্সিডেন্ট হয়ে সুফিয়ানের মারাত্মক ভাবে আহত হয়ে গেলো।

চলবে…..
আজকের পর্বে কিছু বিষয় ক্লিয়ার করলাম। এই পর্বে কারো কোনো কনফিউশান??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here