অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব -৩৯

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_৩৯
#তাশরিন_মোহেরা

আব্বা এখন অনেকটাই সুস্থ। হাঁটতে পারছেন, খেতে পারছেন! তবে তিনি খুবই চুপচাপ হয়ে গেছেন। আব্বাকে এখন কেন যেন চেনা-ই যায় না। হুটহাট চা খাওয়ার অভ্যাসটাও চলে গেছে আব্বার। সবসময় কেমন মনমরা হয়ে থাকেন। আমি কোথায় গেলাম, কার সাথে ঘুরলাম কিংবা বাসায় আসতে বেশি দেরি হলো কিনা এসবে আব্বার কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। তিনি খুব ভাবুকও হয়ে গেছেন। প্রায় সময়ই জানালার বাইরে তাকিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেন। আব্বার এই অবস্থা দেখে আমার বিন্দুমাত্র ভালো লাগছে না! হুট করে আব্বার এমন মিইয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। তিনি বেশ গভীরভাবে কিছু নিয়ে চিন্তা করছেন। যার কারণে কপালে কিছু সুক্ষ্ম ভাঁজ ধরা দিয়েছে।
এই কারণে অন্য কোনো দিকে আমি খুব একটা মনোযোগ দিতে পারছি না। ভার্সিটিটাও ঠিকমতো যাওয়া হচ্ছে না! রূপক ভাই ফোন করছেন বারংবার। আমি প্রত্যেকবারই তাকে এটা ওটা বলে এড়িয়ে চলছি। আব্বার অসুস্থতা আমাকে খেয়ালি করে ফেলেছে। বাইরে কোথাও যেতেই আমার কেমন একটা ভয় করে। না জানি আব্বার কি হয়ে যায়! মুখরকেও বেশ এড়িয়ে চলছি আমি! মুখরের ব্যাপারে আব্বা নিজ থেকে এখনো কিছুই বলেননি। আমি নিজেও ঘটা করে জিজ্ঞেস করিনি। জিজ্ঞেস করার সাহসটাই মূলত পাচ্ছি না। যখন থেকেই আব্বার অস্বাভাবিকতা টের পেয়েছি আমার আর কিছুতেই মন বসছে না! মুখরের সাথে এ মুহুর্তে কথা বলাটাও যে বিলাসিতা! বেশ কিছুদিন ধরেই তার মেসেজের রিপ্লাই আমি দেইনি। আন্টিও বেশ কয়েকবার ফোন করে জিজ্ঞেস করেছেন আব্বার কথা। তবে আমি আন্টির সাথে কথা বলেই ফোন রেখে দিয়েছি। মুখরকে এড়িয়ে চলছি বিষয়টা সে বেশ বুঝতে পেরেছে। তাই সেও উল্টো আমাকে মেসেজ দেওয়াটা কমিয়ে দিয়েছে! ব্যাপারটা আমার খুব খারাপ লাগছে তবে আমি এতে কিছু করতে পারছি না। কেননা আমি নিজেই তাকে প্রথম দিকে এড়িয়ে চলছিলাম। কিন্তু সে তো আমায় একটাবার জিজ্ঞেস করতে পারতো আমি কেন তাকে এড়িয়ে চলছি, তাই না? কেন সে উল্টো আমাকেই এড়িয়ে চলছে? মনে মনে খানিকটা অভিমান হলো আমার! মুখর থেকে দূরে আমি থাকতে চাইনা! তবে বাধ্য হয়ে আমায় দূরে থাকতে হচ্ছে! তাই বলে কি ছেলেটাও দূরে থাকবে?

চায়ে চুমুক দিয়ে এসব ভেবেই চলেছি আমি। কষ্টে আমার মুখের রুচিটাও চলে গেছে। ক্ষিধের জ্বালায় তবু খেয়ে চলেছি। ফোনে একটা দুঃখের গান চলছে। আমিও গুনগুন করে গাইছি, ‘কষ্টগুলো শিকড় ছড়িয়ে, ঐ ভয়ানক একা চাঁদটার সাথে!’
এ মুহুর্তে কলিংবেল বেজে উঠলো হঠাৎ। সাথে দরজাটাও সশব্দে ধাকাচ্ছে ওপাশের মানুষটা। আমি চরম বিরক্ত হলাম। এ অসময়ে আবার এলোটা কে! তারউপর কলিংবেল দেওয়ার পরও মানুষটা দরজায় আঘাত করে যাচ্ছে! বাসায় যে একটা রোগী মানুষ আছে তা কি তিনি জানেন? বিরক্তিতে মুখটা বাংলা পাঁচের মতো করে দরজাটা খুললাম। খুলতেই দেখি হুড়মুড় করে আমার সম্মুখে এগিয়ে এলো মানুষটা। সে এগোচ্ছে আর পিছিয়েই যাচ্ছি। পেছাতে পেছাতে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লাম আমি! সোফার দিকে ঝুঁকে লোকটা ভ্রুকুটি করে বললো আমায়,

‘কি? ভয় পেয়েছেন, মিস.তিথিয়া?’

মুখরের কথায় আমি চোখ বড় বড় করে তার দিকে চেয়ে আছি। সে যে হুট করে আমায় এভাবে চমকে দেবে আমি ভাবতেই পারিনি। তাই তার এমন প্রশ্নে আমি অজান্তে উপর নিচ মাথা দুলাই। সে আমার উত্তরে কিছুটা চটলো মনে হলো। সটান হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়েই হাত ভাঁজ করলো বুকের নিচ বরাবর। এরপর দৃষ্টিটা অসম্ভব রকমের শীতল করে বললো,

‘কেন ভয় পেয়েছেন? আমি কি ভয় পাওয়ার মতো কিছু করেছি আপনাকে?’

আমি ছেলেটার কথায় অবাক হয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছি তার দিকে। তার দৃষ্টি এখনো শীতলই রয়ে গেছে। আমি সোফা থেকে দাঁড়িয়ে বললাম,

‘ভয় তো পাবোই, মুখর সাহেব। হুট করে এভাবে উদয় হয়ে সামনে এগোচ্ছিলেন যে!’

মুখর তার দৃষ্টিটা স্থির রেখেই শান্ত গলায় বললো,

‘এতোই যখন ভয় পান আমায় তবে এতোদিন এভাবে এড়িয়ে চলছিলেন কেন? এড়িয়ে গেলে তো হুটহাট এভাবে উদয় হবোই, তাই না?’

নিজের কথায় নিজেই আটকে গেলাম আমি। তার এই শীতল দৃষ্টিটা আমার মোটেও ভালো লাগছে না। হাসিখুশি মুখরকে আবারো তার আগের রূপে দেখতে পেয়ে আমার ভয়টা বাড়লো। আমি চোখটা নামিয়ে হালকা ঢোক গিললাম। গলাটা শুকিয়ে গেল বোধহয়। দৃষ্টি নামিয়েই আমি ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম। একগ্লাস পানি ঢেলে তা ঢকঢক করে পান করলাম। আড়চোখে মুখরের দিকে তাকিয়ে দেখি সে তার জায়গায়ই আগের মতো হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে গভীরভাবে। তার ভ্রুটা এখনো কুঁচকানো। আমি কাঁচুমাচু হয়ে তার দিকে চেয়ে আছি। আমাকে এভাবে দেখতে পেয়ে সে হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে। আমিও তাকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে দু’কদম দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেও বেশ স্বাভাবিকভাবে গ্লাসে পানি ঢেলে তা পান করলো। এবার সরাসরি আমার দিকে তাকালো। দু’কদম এগিয়ে আমার সামনে এসেই সে বললো,

‘এই যে এখন! আমি যে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আপনার কি ভালো লাগছে না? হৃদয়টা ধুকপুক করছে না আপনার? আমাকে দেখতে পেয়ে চোখটা ছলছল করছে না খুশিতে, মিস.তিথিয়া?’

মুখরের স্বরটা এবার নেশালো শোনালো। তার দৃষ্টিটা এবার শীতল থেকে কোমল হয়েছে। যে দৃষ্টির প্রতিটি কোণায় আবেগ জড়ানো। তার এমন নেশালো কণ্ঠ আমার হৃদয় আহত করলো। মুখরের বলা প্রতিটি কথা-ই সত্য। আমি তাকে এড়িয়ে চললেও কখনো একেবারের জন্য দূরে পাঠানোর সাহস পাইনি। এই যে হুট করে তার এভাবে চলে আসাটা আমার জন্য আশ্চর্যের হলেও আমি বেশ খুশি হয়েছি তাতে। ছেলেটাকে দেখার সাধ আমার কখনোই ফুরাবে না বলেই হয়তো এতো খুশি হয়েছি আমি। আর তার কাছে আসাটা আমার হৃদস্পন্দন বাড়ায় এ কথাও শতভাগ সত্য। তবে মুখরের এমন সরাসরি প্রশ্নতে কি উত্তর আমার দেওয়া উচিৎ তা বুঝে উঠছি না। আব্বার মেয়ে হয়ে কি বলবো, ‘না, এসব কিছুই মিথ্যে!’
না ভালোবাসার একজন কাঙাল হয়ে বলবো, ‘হ্যাঁ, এসব কিছুই সত্য!’

মুখর আমায় চুপ থাকতে দেখেই বললো,

‘বি অনেস্ট, মিস.তিথিয়া! সত্যি করে বলুন।’

দুরুদুরু বুকে কিছুটা সাহস জমলো। যে কথাটুকু আমি এতোদিন ধরে মনের মাঝে দেবে রেখেছি তা যে উতলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ওড়নাটা চেপে মুখরের চোখে চোখ রেখে বললাম,

‘সত্যি বলতে বলছেন তো! তবে শুনুন, মুখর সাহেব। আপনি যে এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, এতে আমি খুশি নই। খুশি নই কারণ, আমার যে চোখের সামনে আপনাকে সারাদিন চাই! আপনাকে দেখার আকাঙ্খাটা দিনের পর দিন তীব্র হচ্ছে বলেই বোধহয় আমি খুশি নই।’

মুখর হঠাৎ করে কেমন অগোছালো হয়ে পড়লো। সে দৃষ্টি নামিয়ে মুচকি হেসে উঠলো। মেয়েদের মতো লজ্জায় ঠোঁটে হাত গুঁজে বসে পড়লো পাশের চেয়ারে। আমি ফিক করে হেসে দিলাম। আমার হাসিতে সে চোখ ঘুরিয়ে আমায় দেখলো। খানিকক্ষণ দেখার পর সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আব্বার রুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে রুমে উঁকি দিলো সে। আমি তার কান্ড বুঝলাম না। সে জোরে বলে উঠলো,

‘আপনার মেয়েকে নিয়ে গেলাম, শ্বশুর আব্বা।’

এরপর আচমকা আমার সামনে এসেই সে পাজাকোলে তুলে নিলো আমায়। দরজার কাছে এগিয়ে গেল সে। সবকিছুই কেমন হঠাৎ হঠাৎ ঘটছে আজ। মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে আমি মুখরকে বারবার বলছি,

‘কি করছেন, মুখর সাহেব। কি হচ্ছে এসব?’

পেছন ফিরে একবার আব্বার রুমের দিকে তাকালাম। আব্বাকে ‘শ্বশুর আব্বা’ বলার কারণটা কি মুখরের? আব্বা তো মুখরকে মেনে নেয়নি, তাই না! তাহলে ছেলেটা এমন করলো কেন? আব্বা রুম থেকে বেরিয়েই আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। এরপর আমাকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। আমি চোখ ছোট করে একবার আব্বার দিকে তো একবার মুখরের দিকে দেখছি। আব্বা হাসলো কেন? আশ্চর্য তো! বিস্ময়ে আমার চোখের কোটর থেকে যেন চোখটাই বেরিয়ে আসবে। মুখরের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই সে চোখ টিপ মেরে আমায় জানালো,

‘শ্বশুর আব্বাকে পটিয়ে ফেলেছি, মিস.তিথিয়া!’

অবাকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে আমি বোবা হয়ে গেছি। এতোটাই বোবা হয়ে গেলাম যে মুখর কবে পাজাকোলে আমায় তার বাড়ি নিয়ে এলো টেরই পেলাম না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখি আন্টি আর মুগ্ধ দাঁড়িয়ে আছে হাসি হাসি মুখ নিয়ে। আন্টি আমার মুখে হাত বুলিয়ে মুখরের উদ্দেশ্যে বললো,

‘আমার বউমাকে এনেছিস তবে!’

বউমা? আন্টি আমাকে বউমা ডাকছেন! মুখরের দিকে তাকিয়ে দেখি সেও লজ্জায় মুচকি মুচকি হাসছে। আমাকে আড়চোখে দেখে সে মুখ নেড়ে ইশারায় কিছু একটা বললো। আমি বুঝলাম না। কেননা অবাকের রেশটা এখনো কাটাতে পারিনি আমি। আন্টি আমাকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে একটা শাড়ি বেশ সুন্দরভাবে পড়িয়ে আমায় সাজিয়ে দিলেন। মাথায় ঘোমটা টেনে আমায় বললেন,

‘আমার ছেলের সাথে তোমাকে খুব মানিয়েছে, মা!’

আমি মাথা নিচু করে মেঝেতে তাকিয়ে আছি। মুখরের সাথে আমার বিয়েটা আজই পড়ানো হবে। আকদ পড়িয়ে আমাকে তার ঘরে তোলা হবে। তবে হুট করে মুখরের সাথে বিয়ে হওয়ার সিদ্ধান্তে আমার কেমন একটা ভয় করছে! আব্বাও তো সাথে নেই। আমাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আন্টি বললেন,

‘কি হয়েছে, মা? তোমার কি বিয়েতে মত নেই? কোনো সমস্যা হলে আমায় বলতে পারো। তোমার সমস্যা হলে বিয়েটা আমি ক্যানসেল করে দেবো এক্ষুণি। আমি তো ভেবেছি আমার বোকা ছেলেটা তোমার মত নিয়েই এখানে এসেছে। দেখো কান্ড!’

আমি আন্টির হাত ধরে করে তাকে বললাম,

‘আপনি ভুল বুঝছেন, আন্টি। আমার এ বিয়েতে সম্পূর্ণ মত আছে। কিন্তু আব্বা ছাড়া আমার বিয়েটা করতে মন সায় দিচ্ছে না!’

আন্টি আমার কথায় মুচকি হাসলেন। তিনি আমাকে বিছানায় বসিয়ে বললেন,

‘কে বলেছে জহির ভাই ছাড়া বিয়েটা হবে? তিনি তো এখানে আসছেন, তাও আবার এতোগুলো মিষ্টি নিয়ে। তার একমাত্র মেয়ের বিয়েতে তিনি থাকবেন না তা হয় নাকি!’

মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল আব্বার আসার কথা শুনে। আব্বা ছাড়া আমার বিয়েটা যে অসম্পূর্ণ! তবে মনে অনেক প্রশ্ন জমে আছে আমার। তাই আন্টিকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আব্বা কি সত্যিই মুখর সাহেবকে মেনে নিয়েছেন, আন্টি?’

আন্টি আমাকে গয়না পড়াতে পড়াতে বললেন,

‘আমার ছেলেটা তোমার আব্বাকে রাজি করিয়েই ছেড়েছে। যা নাছোড়বান্দা হয়েছে না! তাছাড়া জহির ভাইও হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। তিনি হয়তো তার ভুলটা বুঝতে পেরেছেন। তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই মুখর জহির ভাইকে চুপ থাকতে বলেছিলেন।’

আমার কেন যেন খুব লজ্জা লাগলো। মুখর আমার জন্য এতোকিছু করেছে! ছেলেটা এতো ভালো কেন? আমাকে বারবার তার প্রেমে না ফেললে কি হয় না?
ভাবনার মাঝপথে আন্টি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন পরম আদরে। এরপর বললেন,

‘এখন থেকে আমায় মা বলে ডাকবে, মেয়ে। মনে থাকবে?’

খুশিতে কান্না পেয়ে গেল আমার। মা মা গন্ধ পেলাম আন্টির শরীর থেকে। প্রায় বিশ বছর আমি মায়ের আদর পাইনি। কিন্তু আজ যেন বছরগুলো সার্থকতা লাভ করলো আন্টির ছোঁয়ায়। আমি কৃতজ্ঞ, খুব কৃতজ্ঞ সৃষ্টিকর্তার প্রতি!

মুখরের আকদ মসজিদে পড়ানো হয়েছে। আমার আকদটা পড়ানো হয়েছে মুখরের ঘরেই। দুজনের আকদ পড়ানো শেষ হলে আমাদের ড্রয়িংরুমে বসানো হয় মুখোমুখি। তবে আমার নাক অবধি ঘোমটা টেনে দেওয়া। মুখরের সম্মুখে বসতেই আমার বুকের স্পন্দন যেন আরো বেড়ে গেল। বুকটা রীতিমতো লাফাচ্ছে! হাতটাও কাঁপছে ক্ষীণ। মুখর ধীরগতিতে আমার ঘোমটাটা উপরে তুললো। আমি লজ্জায় আর ভয়ে মেঝেতে তাকিয়ে আছি। মুখর আমার থুতনি ধরে উপরে তুললো আমার মুখটা। তার চোখের দিকে তাকাতেই আমার ভয়খানা হুট করেই কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। ভয়টা বোধকরি পরিণত হয়েছে একরাশ ভালোলাগায়। আমার সামনের সুপুরুষটা আজ পাঞ্জাবি পড়েছে। তাকে প্রথমবার আমি পাঞ্জাবিতে দেখলাম। আমার স্বপ্নের পুরুষটা আমার সামনেই হা করে চেয়ে আছে আমার দিকে। তবে অন্যদিনের মতো শুধুমাত্র মুখর সাহেব হয়ে নয়, আজ সে আমার সম্মুখে বসে আছে আমার স্বামী হয়ে! স্বামী? এই শব্দটাই কেমন যেন ভারী ভারী। এর ভার কি তার পক্ষে বহন করা সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব, তিথি! তা না হলে কি সে আর তোর মুখর সাহেব হলো!

মুখর আমার দিকে মোহাবিষ্ট হয়ে চেয়ে আছে। মুগ্ধ তা দেখতে পেয়ে মুচকি হেসে বলে উঠলো,

‘ভাইয়া, ম্যামের দিকে এভাবে হা করে তাকিয়ে আছো কেন? গেম খেলছো নাকি, হ্যাঁ?’

তার কথায় আমি আর মুখর নড়েচড়ে বসলাম। আব্বা, আন্টি আর মুখরের বন্ধুরা হেসে উঠলো হো হো করে। মুখর বেশ লজ্জা পেয়েছে কথাটায়। আমারও কেমন হাসি পেয়ে গেল।
মুখর থেকে চোখ সরে হঠাৎ আমার চোখটা গেল পাশের সোফায়। সেখানে আব্বা আমার দিকে চেয়ে আছেন ছলছল দৃষ্টিতে। আমার চোখটাও জলে টইটম্বুর হয়ে গেল মুহুর্তেই। আব্বাকে দেখে মনটা কেঁদে উঠলো। মানুষটা একা থাকবে কি করে এখন? আমার সুপারম্যানটা দিনশেষে একেবারে একা হয়ে গেল এখন!

বিদায়ের পালা আসতেই আব্বাকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরলাম আমি। কান্নারা ঝেঁকে বসেছে আমাদের আশেপাশে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলছি আমি। আব্বা নিঃশব্দে অশ্রুপাত করে আমার মাথায় সাদরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কালই তিনি কুমিল্লায় চলে যাবেন নিজ বাড়ি। দাদাবাড়ি থাকবেন ভাইদের সাথে। তাই আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললেন,

‘থাক মা, আর কাঁদিস না। আমি তো একা হয়ে যাইনি, তাই না! তোর এই আব্বাটাকে ক্ষমা করে দিস পারলে। অনেক কষ্ট দিয়েছি তোকে এতোদিন!’

আব্বাকে ছাড়তেই আমার মন চাইছে না। আরো জোরে আঁকড়ে ধরে রইলাম। যেন হাত ফসকালেই আব্বা হারিয়ে যাবেন। আরো খানিকক্ষণ কাঁদার পর আমি বহু কষ্টে নিজেকে সামলালাম। আব্বাকে যেতে দিলাম। নিজেকে বোঝালাম, এই কষ্টের মুহুর্তটা সকল মেয়েকেই যে ভোগ করতে হয়। কেননা সৃষ্টিকর্তা বিষয়টা এভাবেই লিখে দিয়েছেন।

(চলবে)#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#অন্তিম_পর্ব (প্রথমাংশ)
#তাশরিন_মোহেরা

আজ বাতাসটা একটু বেড়েছে। আর রাতের বাতাস সচরাচর বেশ ঠান্ডা হয়। তুলনামূলক ভারী একটা শাড়ি আর একগুচ্ছ গহনা পড়েও রাতের ঠান্ডা বাতাসে আংশিক কেঁপে উঠলাম। আমাকে ক্ষীণ শিউরে উঠতে দেখে মুখর বললো,

‘ঠান্ডা লাগছে? জানালা বন্ধ করে দেবো?’

কিন্তু জানালা বন্ধ করলে যে রাতের আকাশটা আর দেখা হবে না। আজ আমাদের বিবাহ পরবর্তী প্রথম রাত। মুখর রুমে প্রবেশ করার আগেই আমি তার বিছানার উপর বসে ভয়ে কাঁপছিলাম। ভয় করাটা নিতান্তই স্বাভাবিক। কেননা বিয়ে নামক বন্ধনটা আমায় এমন একজনের সাথে শক্তভাবে বেঁধে দিয়েছে যাকে পাওয়ার আশা করাটাও একসময় কিনা আমার জন্য অসম্ভব ছিলো। আজ তারই ঘরে, তারই বিছানায় বসে তারই আসার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলাম। দরজার ছিটকিনি আটকানোর শব্দ শুনে রীতিমতো ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসি। মুখর এই মুহুর্তে আমার পাশ ঘেঁষে বসলে আমি কি করবো? আচ্ছা? আমার ভয়টা কি একটু বেশিই দৃশ্যমান হয়ে আমায় পেতনির মতো দেখাচ্ছে? মুখরের যদি আমায় পছন্দ না হয়? তবে কি বিয়ের দিনই তালাক দিয়ে আমায় ঘরছাড়া করবে? আয় হায়! আব্বাটাও যে আজ রাতে কুমিল্লার ট্রেনে উঠবে। মুখর যদি আমায় রাস্তায় বের করে দেয় তবে তো ফুটপাতেই আমার রাতটা কাটাতে হবে!

হঠাৎ মুখরের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। আমি তার দিকে তাকাতেই দেখলাম তাকে কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তবে তার এই শ্রান্ত মুখশ্রীতেও ঝরছে ভীষণ মায়া। হায়, আমার স্বামীটার প্রেমে আরো একবার ডুবে গেলাম। স্বামী? সামনে দাঁড়ানো সুঠামদেহী সুদর্শন পুরুষটা আমার স্বামী? এটুকু ভাবতেই চোখটা নামিয়ে ফেললাম সাথে সাথে। লজ্জা লাগছে আমার খুব! এ লজ্জাটা ঢেকে রাখবো কই!
মুখর আমার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে পাশে থাকা চেয়ারটা টেনে বসলো আমার মুখোমুখি। আমার খানিক অদ্ভুত লাগলো। বেডরুমে এমন একটা খালি চেয়ার থাকাটা কেমন বেমানান। আমাকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে মুখর যেন আমার প্রশ্নটা বুঝলো। বললো,

‘চেয়ারটা ঝামেলা লাগছে, তাই তো?’

আমিও মাথা দুলিয়ে বুঝিয়েছি আসলেই চেয়ারটা একটা উটকো ঝামেলা। মুখর মুচকি হাসলো। এরপর খোলা জানালার পর্দাটা সরিয়ে বললো,

‘এই চেয়ারটা আমি রেখেছি প্রতিরাতে এভাবে জোৎস্নাবিলাস করার জন্যে। দেখুন, কি সুন্দর আলো পড়েছে চাঁদের।’

আমি একটু এগিয়ে জানালার বাইরে উঁকি দেই আকাশে। আসলেই অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যটি! চাঁদটা তার সম্পূর্ণ আলোটুকুই ছড়িয়ে দিচ্ছে রাতের পৃথিবীতে। কি অমায়িক লাগছে পরিবেশটা। আমার চোখটা চিকচিক করে উঠলো। অস্ফুট স্বরে বললাম,

‘অদ্ভুত সুন্দর!’

পাছে মুখরের ধরা গলা শোনা গেল। সে বলছে,

‘হ্যাঁ সত্যিই! অপরূপা যাকে বলে।’

আমি পাশ ফিরে দেখলাম ছেলেটা গালে এক হাত দিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। একেবারে পলকহীন হয়ে! আমার সে কি ভীষণ লজ্জা লাগলো। আর তখনই আমার ঠান্ডা লেগে যাওয়ায় মুখর জানালা বন্ধ করতে উদ্যত হলো। আমি মুখরের হাতটা খপ করে ধরে অনুরোধের সুরে বললাম,

‘বন্ধ করবেন না, মুখর সাহেব। চাঁদ দেখবো!’

মুখর আবারো হাসলো। আর এই হাসিটা যেন বুকে তীরের মতো বিঁধে প্রতিবার! আমি হৃদপিণ্ডের ধ্বক ধ্বক করাটা থামাতে আবারো চোখ দিলাম আকাশে। তখনই পেছন হতে গরম কিছু অনুভব করলাম। মুখর পেছন হতে একটা চাদর বিছিয়ে দিলো আমার গায়ে। আমিও ঠান্ডায় জমে যাওয়ায় চাদরটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলাম গায়ে। এরপর দুজনেই খানিকক্ষণ পরিষ্কার আকাশটার দিকে চেয়ে রইলাম। চাঁদের আলোটা যেন মোহিত করে ফেললো দুজনকেই। আমি আড়চোখে একবার আমার পাশে বসা মুখরকে দেখলাম। এতোদিন ভাবতাম চাঁদের আলোয় শুধুমাত্র মেয়েদের সুন্দর লাগে। কিন্তু এখন তো দেখছি চাঁদের আলোয় মুখরকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছে আমার। সে বারবার হাত দুটো জোর করে তাতে ফুঁ দিচ্ছে খানিক পর পর। আমি বুঝতে পারলাম ছেলেটারও ঠান্ডা লাগছে। আমি চাঁদটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম,

‘আমাকে সাহস দিও, চাঁদমামা!’

সাতপাঁচ না ভেবে আমি মুখরের বাহুতে হালকা চিমটি কেটে তাকে আমার দিকে ফেরালাম। ইশারায় বললাম একটু কাছে আসতে। সেও চেয়ারটা আমার কাছাকাছি নিয়ে এলো। তখনই আমি চাদরের অর্ধেকটা তার পিঠেও জড়িয়ে দিলাম। সে প্রথমদিকে হালকা অবাক হলেও পরে আমার কান্ডে মিটিমিটি হাসলো। আমিও লজ্জা পেয়ে মুচকি হেসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি। মুখরের বাহুর সাথে আমার বাহুটা হালকা স্পর্শ করছে। আমাদের হাতগুলো স্পর্শ করছে ক্ষীণ। মুখর যেন এ সুযোগটাকেই কাজে লাগালো। তার বাম হাতটা গলিয়ে আমার ডান হাতের আঙুলে জড়িয়ে হাতটা চেপে ধরলো আলতো করে। আমি একটু শিউরে উঠলেও তার সাথে তাল মিলিয়ে চেপে ধরি তার হাতখানা। দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। মুখরের হাত ধরাটা আজ প্রথম নয়। কিন্তু তারপরও যেন লজ্জায় চোখ মেলাতে পারছিলাম না তার দিকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি, মনটা আমার ঐ খোলা আকাশটাতে উড়োউড়ি করছে। এই আকাশ, এই চাঁদ, এই পরিবেশকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাতে জানাতে খেই হারিয়ে ফেলি আমি। অজান্তে ঠোঁটদ্বয় জুড়ে চওড়া হাসি ফুটলো আমার। অবাক হয়ে উপভোগ করছি চারপাশটা। তখনই মুখর হঠাৎ হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। তার দিকে তাকাতেই দেখলাম সে ওপাশে ফিরে বসে আমায় বলছে,

‘মিস.তিথিয়া! ওভাবে হাসবেন না যে!’

আমার খুব অপমানবোধ হলো। ছেলেটা এই নিয়ে তিন তিনবার আমায় হাসতে বারণ করেছে। হাসার কি অধিকার নেই আমার? আমার হাসিটা কি এতোটাই বাজে? ফোনটা হাতে নিয়ে ক্রিনে তাকিয়ে পরপর কিছুক্ষণ হাসলাম। হাসিটা আসলেই বাজে আমার! মনটা খারাপ করে মুখরকে বললাম,

‘আমি যে খুব বাজে হাসি, তা আমি জানি মুখর সাহেব। তাই বারবার হাসতে নিষেধ করে আমায় লজ্জা দেবেন না, প্লিজ।’

মুখর ডাগরডাগর চোখ নিয়ে আমার দিকে ফিরলো। আমিও কষ্ট পাওয়ার ভান করে মুখটা নিচু করে ফেললাম। ভালোবাসার মানুষের কাছে অপমান হওয়ার চাইতে কষ্টের আর কিছুই নেই! মুখর হঠাৎ আমার কাছে এসে আমার মুখটা দু’হাতে তুলে ধরলো। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে সে ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,

‘আমি ওভাবে বলিনি তো, মিস.তিথিয়া। আপনার হাসিটা আমার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে তোলে, আমার ভেতরের সবটা এলোমেলো করে দেয়। এই অসম্ভব সুন্দর হাসিটা আমি বেশিক্ষণ দেখে থাকতে পারি না বলেই এমনটা বলেছি।’

আমার মনটা এখনো ভরলো না। আমি বললাম,

‘তার মানে আমি খারাপ ভাবে হাসি বলেই আপনি বেশিক্ষণ আমার হাসি দেখতে পারেননা, তাই তো!’

মুখর হঠাৎই কেমন অস্থির হয়ে উঠলো। তড়িৎ দাঁড়িয়ে তার দু’হাত নেড়ে আমায় বোঝাতে শুরু করলো,

‘ব্যাপারটা তেমন নয়, মিস.তিথিয়া! আসলে আপনার হাসিটা ঠিক…ঠিক কিসের সাথে তুলনা করা যায়? উমম..হ্যাঁ, আপনি হাসলেই আপনার ঠোঁট দুটো থেকে মুক্তো ঝরে! যা আমি সচোক্ষে দেখে থাকতে পারি না। এ কারণেই আমি কথাগুলো বলেছি! খুব জটিল বানিয়ে ফেলেছি, তাই না?’

তার এমন অস্থিরতা দেখে আমার খুব হাসি পেয়ে গেল। তাই ফিক করে হেসে দিলাম আমি। মুখর মুচকি হেসে কপাল চুলকে নিলো। আমার সামনে বসে বললো,

‘আপনি মন খারাপ করেননি তো, মিস.তিথিয়া?’

আমি মজা নেওয়ার উদ্দেশ্যে বললাম,

‘হ্যাঁ, করেছি। খুব মন খারাপ করেছি।’

সে প্রশ্নাত্মক চোখে চেয়ে আছে আমার দিকে। আমি তার দিকে ঝুঁকে বললাম,

‘আমায় এতো মিস. মিস. করেছেন কেন বলুন তো! আমি তো এখন মিসেস. হয়ে গেছি। মিসেস. মুখর!’

মুখর আচমকা হতবাক হয়ে গেল। এরপর থুতনিতে ডান হাতটা রেখে চিন্তিত হওয়ার ভাব করে বললো,

‘তাই তো! আপনি তো এখন বিবাহিত। ইশ! আপনাকে দেখতে যা পিচ্চি পিচ্চি লাগছে, কেউ বলবেই না আপনার বিয়ে হয়ে গেছে!’

তার কথায় আমি নিজের দিকে একটাবার তাকালাম। ছেলেটা কথাচ্ছলে আমায় উপহাস করছে তা আমি বেশ বুঝেছি। তাই কিছুটা রাগ হলো আমার। বিয়ের প্রথম দিনই এমন অপমান? ঈষৎ রাগ নিয়ে বললাম,

‘হ্যাঁ, অন্তত আপনার মতো জিরাফ নই!’

মুখর আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো,

‘জ্বি, জ্বি? কি বললেন, মিস.তিথিয়া?’

আমি তার চোখের দিকে চোখ মিলিয়ে বললাম,

‘জিরাফ বলেছি, জি-রা-ফ!’

এটুকু বলার পর দেখলাম মুখর পাশে থাকা জগ থেকে পানি ঢাললো। আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে শয়তানি হাসি হাসলো। আমার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। আমিও দু’হাত ভাঁজ করে বলে উঠলাম,

‘কি? পানি মারবেন তো? মারুন দেখি!’

এই বলে চোখ বন্ধ করে মুখটা এগিয়ে দিলাম। ঠিক তখনই কপালে নরম কিছুর স্পর্শ পেলাম। চোখ দুটো ছোট ছোট করে তাকিয়ে দেখলাম মুখর আবারো মিটমিট করে হাসছে। আমি হালকা কপাল ঢলে তার দিকে চেয়ে রইলাম। সে মুহূর্তে আবারো মুখর আমার কপালের কাছে এসে একটা চুমু খেল। আমি চোখ ছানাবড়া করে তাকিয়ে আছি মুখরের পানে। সে এবার আমার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো,

‘এখন থেকে আমার কাছে সাবধানে মুখ এগিয়ে দেবেন, বুঝলেন?’

আমি লজ্জায় মুখ ঢাকলাম তার বুকের মাঝে। ঠিক তখন পুরো শহর সাক্ষী হয়ে রইলো একটা নিঝুম এবং সুন্দরতম রাতের!
.

ক’দিন পর,

মুখরের বিয়ে হয়েছে শুনে বরিশাল থেকে আন্টির কিছু আত্নীয় এসেছে। আত্নীয় বলতে বেশিরভাগই মধ্যবয়সী মহিলারা এসেছে। এদের মতে, এরা মুখরকে খুব ছোটবেলায় দেখেছে। সেই ছোট্ট মুখর যে আজ বড় হয়ে বিয়ে করে নিয়েছে এ কথা তাদের ভাবনার বাইরে। মুখর আজ অফিস না গিয়ে তাদের আড্ডায় ফেঁসে গেছে। আমিও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে এলাম রান্নাঘরে। তাদের আড্ডার মূল বিষয়ই হলো মুখর। বাচ্চা ছেলেটা ছোট থেকে বেশ দুরন্ত আর দেখতে রাজপুত্রের মতো। তারউপর ছেলের ভালো চাকরি আছে দেখে মহিলারা আন্টিকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। আমি রান্নাঘরে এসেছি তাদের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে যেতে। তবে যাওয়ার মাঝপথে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কথোপকথন শুনে মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। কিছু মহিলা সেথায় বলছে,

‘কি গো আমেনা, তোমার এমন সোনার টুকরো ছেলেকে এ কেমন মেয়ের সাথে বিয়ে দিলে? এ ছেলের তো একটা পরীর মতো বউ হওয়ার কথা! নাহ, তোমাকে কতো বলছি আমার জান্নাতকে তোমার ছেলের বউ করে ঘরে তোলো। ঘরটা রাজপ্রাসাদ করে রাখতো এই মেয়ে! কি বাহার তার রূপের!’

এরপর এক মহিলা অন্য মহিলার অনুকরণ করে এমন হাজারটা মেয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিলো বিবাহিত এক পুরুষের জন্য! কথাগুলো শুনে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। ভাঙা একটা মন নিয়ে চুলোর ধারে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আসলেই যে আমি মুখরের যোগ্য নই! না আছে রূপের বাহার আর নাই বা কোনো যোগ্যতা! কি করে তবে আমি এই ঘরটাকে রাজপ্রাসাদ বানিয়ে রাখবো?
হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পেলাম। নিজেকে সংযত করে চুলোয় চায়ের পানি বসিয়ে দিলাম। পেছন ফিরে দেখলাম মুখর দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। তার ঠোঁট জুড়ে বিষদ হাসি। আজকাল সারাক্ষণই সে এমন চওড়া হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়েই রাখে। আমিও জোরপূর্বক হাসলাম কিছুটা। সে আমার কাছে এসে পেছন হতে আমার কাঁধে মাথা রাখলো আলতো করে। আমি তাড়া দিয়ে বললাম,

‘আহহা, এখন যদি কেউ দেখে ফেলে?’

মুখর আমার কথাটা উপেক্ষা করে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে। লজ্জায় আমি মিইয়ে গেলাম তড়িৎ। চায়ে চাপাতা দিয়ে আনমনে বললাম,

‘মুখর সাহেব!’

সেও ছোট করে বললো,

‘হুম?’

আমি চায়ের দিকে চেয়ে বললাম,

‘আমি আপনার জীবনে না এলে আপনি একটা ফুটফুটে মেয়েকে নিজের বউ করে আনতে পারতেন, তাই না?’

সে আমার কথার কোনো উত্তর দিলো না। এতে আমি আরেকটু বাড়িয়ে বললাম,

‘যে মেয়ে আপনার ঘরকে রাজপ্রাসাদ বানিয়ে রাখতো! আপনাদের দুজনকে বেশ মানাতো। আপনি খুব সুখী হতেন, ঠিক বলেছি না?’

মুখর তখন আমার কোমড় ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ঝটপট উত্তর দিলো,

‘না, আমি সুখী হতাম না।’

সে আমার পাশে এসে প্লেটে বিস্কিট সাজাতে সাজাতে বললো,

‘আমি শুধুমাত্র মিস.তিথিয়াকে পেলেই সুখী। অন্য কেউ তো আর মিস.তিথিয়া নয়, তাই না?’

আমার চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো। মনটা কি ভীষণ রকমের খুশি হয়ে উঠলো। মন, মস্তিষ্ক দুটোই বিড়বিড় করলো, ‘মানুষটা একান্তই আমার!’

(চলবে)

(দেরি করে দিয়েছি বলে আর রাগ করবেন না। রাগ না করার জন্যই বিয়ে দিলাম আপনাদের প্রিয় জুটিকে।তাদের শুভকামনা জানাতে ভুলবেন না।🍁)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here