অনুভূতির_সুপ্ত_কোণে পর্ব ১৫+১৬

#অনুভূতির_সুপ্ত_কোণে🍂
#কায়ানাত_আফরিন (মাইশা)
#পর্ব :১৫
.
সারাঘরে বিরাজ করছে কেমন যেন এক নিস্তব্দ্ধতা। দুজনের নিঃশ্বাস একে অপরের সাথে খেলা করতে মগ্ন। আদ্রাফ চোখ বন্ধ করে উদাসীন গলায় বলে ওঠে………
.
—–আজ তুমি হারিয়ে গেলে আমি নিজেও হারিয়ে যেতাম মেহু। এই মেহেরহীন আদ্রাফ একেবারে বিলীন হয়ে যেতাম। I can’t live anymore Mehu without you……Because you are my lifeline……
.
.
আদ্রাফের কথা শুনে মেহেরের শ্বাস ক্রমাগতই ঘন থেকে ঘন হয়ে আসছে। বুকে চলছে অজানা এক ঝড়। আদ্রাফ তাকে ভালোবাসে এটা ভাবতেই প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোলে। আবেশে স্যালাইনের ক্যানোলা লাগানো হাতটি দিয়েই খামচে ধরে সে আদ্রাফের বাহু। আদ্রাফ এখন শুধু পারছে না তার মেহুকে একেবারে বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলতে। তবেই তো তার অস্তিত্বটা মেহের ক্ষণে ক্ষণে অনুভব করতে পারবে।
মেহেরের শুষ্ক ঠোঁটে আলতো করে নিজের ঠোঁটের স্পর্শ দিয়েই আদ্রাফ সরে আসে মেহেরের কাছ থেকে। মেহেরকে বেডে আধশোয়া অবস্থায় রেখে নরম কন্ঠে বলে ওঠে……….
.
——এখন সম্পূর্ণ রেস্টের প্রয়োজন তোমার। ক্যানোলা লাগানো হাতটি বেশি নাড়াচাড়া করবে না। আমি নাদিয়াকে পাঠিয়ে দিচ্ছি । কোনো প্রয়োজন হলে ওকে বলবে। আমি একটু রিসিপশন থেকে চেক করে আছি তোমার সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি-না। ঠিকাছে?
.
—-হুম।
মেহের মলিন কন্ঠে প্রতিউত্তর দেয়। আদ্রাফ তা দেখে মেহেরের কাছে গিয়ে বসে। মেহেরের গালে আলতো করে হাত রেখে বলে……
.
—-কিছু বলবে মেহু?
.
—-এখনও রাগ করে থাকবে আমার ওপর?
.
মেহের ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে। আদ্রাফ এটা শুনে একটা মুচকি হাসি দেয়। মেহেরের কপালে দীর্ঘক্ষণ একটা চুমু দিয়ে প্রতিউত্তর দেয়…….
.
—–রাগ না ; অভিমান হয়েছিলো তোমার ওপর। যেদিকে একদিন তোমায় না দেখে আমার দমবন্ধ হয়ে আসতো সেদিকে তিনদিন আমি তোমাকে ছাড়া ছিলাম। তবে এখন আর অভিমান নেই। কারন তোমাকে next time নিজের থেকে দূরে থাকার আর সুযোগই দেবো না !
এখন এসব কথা থাক । তুমি rest নাও। আমি নাদিয়াকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
.
আদ্রাফের প্রতিটা কথার জালেই মেহেরের মনে হয় সে যেন অন্য কোনো এক জগতে চলে গিয়েছে। একটা মানুষ কিভাবে তার কথার মায়ায় মানুষকে নিঃস্ব করতে পারে এর উত্তরটা মেহেরের কাছে সবসময়ই যেন অজানা রয়ে গেলো। আদ্রাফ কেবিনের বাইরে চলে যাওয়ার পর আধশোয়া হয়ে বাইরের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে মনোনিবেশ করায় নিজেকে। আদ্রাফকে একটা প্রশ্ন বারবার করতে চেয়েও করতে পারেনি যে, শাওন কোথায়?
.
.
.
.
হসপিটালের পাশেই রয়েছে একটা পার্ক। সন্ধ্যা হওয়ার সুবাদে এখানে এখন মানুষজন নেই বললেই চলে। আর এই পার্কের কোণে ছোট এক বেঞ্চে বসে একের পর এক সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে চলছে শাওন। নিজেক এই সিগারেটের অনুভূতিহীন ধোঁয়ার মতোই মনে করে সে। নিশা , রাতুল সবাই ওর সাথে থাকতে চেয়েছিলো কিন্ত শাওন রাজি হয়নি। কিছুক্ষণ সে একা থাকতে চেয়েছিলো তাই বৃষ্টিময় হাওয়ার সাথেই আনমনে সিগারেটের ধোঁয়ার খেলা চালিয়ে যাচ্ছে সে।
.
—-অন্যের জীবন বাঁচালে বাট নিজের জীবনেরই খেয়াল রাখো না ; মিঃ শাওন চৌধুরি?
.
কারও পুরুষালি কন্ঠ শুনে সিগারেটেটটা ঠোঁটের ভাঁজ থেকে হাতে নিয়ে নেয়। তার চোখের সামনে আদ্রাফ স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে।শাওন সেদিকে পরোক্ষ না করে আবার সিগারেটের ধোয়া উড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
.
—–বড্ড আজব মানুষ তুমি , যেদিকে তোমার জন্যই আজ মেহের বেঁচে আছে সেদিকে তুমিই কাউকে না বলে সেখান থেকে চলে গেলে without any reaction? এখনও সেম অবস্থা। আমায় দেখে তোমায় react করা উচিত ছিলো আর তুমি বরাবরই তোমার কাজে মগ্ন।
.
শাওন তা শুনে তাচ্ছিলের হাসি হাসে। প্রতিউত্তরে সে বলে ওঠে…….
.
—–এই শাওন চৌধুরি মানুষটাই এমন। তবুও formality’র জন্য জিজ্ঞেস করছি……তুমি এখানে কেন?
.
—–ধন্যবাদ জানাতে।
.
শাওনের কাছে বিষয়টি যেন বোধগম্যে এলো না। আবারো প্রশ্ন করে ওঠে…….
.
—-What?
.
—-বললাম তো ! ধন্যবাদ জানাতে।
.
—-কিসের জন্য?
.
—-মেহেরকে বাঁচানোর জন্য ।
.
শাওনের কাছে এবার বিষয়টা কৌতুকের মতো লাগছে। এই প্রথম হয়তো কেউ ওকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে যেখানে সবাই ওকে ঘৃণা করে। সিগারেটটা পায়ের নিচে পিষে দিয়ে বলে ওঠে…….
.
—–ধন্যবাদ দেয়ার মতো তেমন কোনো মহান কাজ করিনি আমি। ওকে বাঁচানো আমি প্রয়োজন মনে করেছি তাই আমি……..
.
এতটুকু বলেই শাওন থামে। আসলেই তো? মেহেরের কাছ থেকে তো সে revenge নিতে চেয়েছিলো। তাহলে মেহেরকে বাঁচালো কেন?
.
আদ্রাফ এবার শাওনের পাশে বসে। শাওনের দৃষ্টি তখন নিচে পড়ে থাকা নিভু নিভু সিগারেটটার দিকে।
.
—–নিজেকে যতটাই খারাপই তুমি প্রমাণ করতে চাও না কেন………ততটা খারাপ প্রমাণ করতে তুমি ব্যর্থ। জানিনা কোন বিভৎস কারনের জন্য তুমি এত নির্দয় তবে আমার কথা শুনো………নিজেকে এত খারাপ বানিও না।
.
শাওন নিশ্চুপ।
.
—–আর এই সিগারেটের নেশাটাও কমিয়ে আনো। এটাই তোমার জন্য ভালো।
.
—-Who the hell are you? এতক্ষণ কিছু বলছিনা বলে এটা মনে করো না যে আমায় উপদেশ দেয়া শুরু করবে। Thanks বলেছো না , এবার চলে যাও। আর কি যেন বললে?
হ্যাঁ , আমি নাকি নিজেকে খারাপ প্রমাণ করতে ব্যর্থ । You’re absolutely right………কারন এর থেকেও বেশি জঘণ্য আমি। এমনকি আমার so called dad হায়াৎ চৌধুরী থেকেও।
.
শাওনের এমন বিষাক্ত কথাগুলো আদ্রাফের মুখে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেললো না। আদ্রাফের ধারনাই ছিলো যে শাওন এমন কিছু করবে। আর কিছু না বলে শাওনকে একা রেখে নীরবে চলে যায় সে।
.
.
শাওন একটা লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আধশোয়া হয়ে পড়ে বেঞ্চটিতে। না চাওয়া সত্বেও আদ্রাফের কথাগুলো বারবার কানে বেজে উঠছে । তার জীবনটাতো এমন নাও হতে পারতো। কেন এমন হলো? এর উত্তর শাওনের কাছে নেই।
.
.
.
.
আদ্রাফের অপেক্ষার অঙ্ক যেন আর পারই হচ্ছে না মেহেরের কাছে এখন এমন মনে হচ্ছে। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে অথচ সবাই দেখা সাক্ষাত করে গেল কিন্ত আদ্রাফের আসার কোনো নামগন্ধ নেই। এদিকে নাদিয়াও সোফায় হেলান দিয়ে পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।
অবসর জিনিসটা মেহেরের কাছে বড়ই বিষাক্ত। একজন চঞ্চল মেয়ের কাছে দীর্ঘক্ষণ স্থির থাকা যেন আগুনে ভস্ম হয়ে যাওয়ার সমান। আনমনে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে সে বলে……
.
—-সবাই আমারে ভুলে গেসে।
.
তখনই আগমন ঘটে আদ্রাফের। হাতে নানারকম ফলফলাদির বাহার। মেহের বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,
,
—-এই তোমার কাউন্টারে যাওয়া? সেখানে ফল বিক্রি করছিলো বুঝি?
.
—–মোটেও না। তোমার জন্যই ফল আনতে গিয়েছিলাম। ডাক্তার বলেছে তোমায় বেশি করে ভিটামিন খাওয়াতে।
.
—-ফফফল? মোটেও না। আমি ফল খাবো না।
.
—-আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি যে তুমি খাবে নাকি খাবে না? আমি জাস্ট বলেছি ডাক্তার তোমায় ভিটামিন খাওয়াতে বলেছে। আমি এগুলো কাটবো আর আমার লক্ষী বউয়ের মতো তুমি খাবে।
.
নির্লিপ্ত গলায় প্রতিউত্তর দেয় আদ্রাফ। মেহেরের মুখ যেন শুকিয়ে গিয়েছে এত্তগুলো প্যাকেট দেখে। আদ্রাফ একে একে আপেল, কমলা, আঙ্গুর সব ধুয়ে কেটে মেহেরের সামনে রাখে। মেহের তবুও শেষ প্রচেষ্টা চালিয়ে প্রশ্ন করে……..
.
——না খেলে হবেনা?
.
—–মোটেও না।
.
অগত্যাই চোখ-মুখ খিচে মেহের বাধ্য মেয়ের মতো পুরো প্লেট সাফ করতে হয়।আদ্রাফ প্রশ্ন করে……
.
—–আরও নিয়ে আসবো?
.
মেহেরের এবার যেন কাদো কাদো অবস্থা। এমনিতেও এই আদ্রাফ তাকে ফল জোড়া করে খাওয়ালো আবার কি সুন্দর করে প্রশ্ন করছে আরও খাবে নাকি।
.
—–ফল খাইয়ে আমায় শহিদ করার পরিকল্পনা আছে নাকি তোমার ?এমনিতেও এতটুকু খেয়ে নিলাম কত্ত কষ্ট করে।
.
—–বেশি কথা বলো না। আগে কিছু বলিনাই বলে এমন মনে করো না আজীবন তোমার পকর পকর শুনে যাবো। আমার কথার একটু হেলফেল করলে তার পরিণাম কিন্ত মোটেও ভালো হবে না। So আমি যা বলবো সবসময় তা মেনে চলবে।
আদ্রাফের কড়া গলা শুনে মেহের চুপসে যায়। মেহের বুঝে গিয়েছে যে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আদ্রআফের এই কেয়ারিং নামক যন্ত্রণা তাকে সইতে হবে।
.
.
.#অনুভূতির_সুপ্ত_কোণে🍂
#কায়ানাত_আফরিন (মাইশা)
পর্ব: ১৬ [ শাওনের অতীত উন্মোচন]
.
সকালে একটা মিষ্টি রোদের প্রতিফলনে আড়মুড়িয়ে মেহের ঘুম থেকে উঠে পড়ে। একপাশে সোফায় আধশোয়া অবস্থায় ঘুমন্ত আদ্রাফকে দেখে ঠোঁটে ফুটিয়ে তুলে একচিলতে হাসি।আদ্রাফের চুলগুলো জুবুথুবু হয়ে পড়ে আছে পেছনের দিকে। শার্টের উপরের বোতাম দুটো খুলে রাখার কারনে ওর লোমহীন বুকের আংশিক স্পষ্ট দেখতে পারছে । আর সে দৃশ্য দেখেই মেহের ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে। তার স্নায়ু কাজ করা যেন বন্ধ হয়ে গেছে। যদিও আদ্রাফের গায়ের রং ওর থেকে একটু চাপা তবুও মনেমনে সে হাসফাস করে যে , ”এই ছেলেটা এতো সুন্দর কেন?”
.
আদ্রাফকে মিহি কন্ঠে ডাক দিতেই সে উঠে যায়। চোখে ঘুমের রেশ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায়নি সে। মেহেরের কাছে গিয়ে সে নরম কন্ঠে বললো……..
.
—-রাতে ঘুম ঠিকমতো হয়েছে তো?
.
আদ্রাফের ঘুমুঘুমু মৃদু কন্ঠে যেন অন্য এক ভালোলাগা কাছ করছে মেহেরের । কেবিনের খাটে বসেই আনমনে আদ্রাফের দাঁড়ানো অবস্থাতেই ওর পেটের কাছে মুখ গুজে দেয়। কিঞ্চিত আদুরে কন্ঠে বলে……
.
—-হুম। মোটামোটি ভালো ঘুম হয়েছে। আমি এখানে আর কতদিন থাকবো আদ্রাফ? আমি এখন ঠিক আছি তো। বাসায় গেলে হবে না?
.
—–হ্যাঁ হবে। ডাক্তার বলেছে আজ চাইলে ডিসচার্জ করতে পারবো। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
.
শর্তের কথা শুনেই মুখ মলিন করে ফেলে মেহের। সামান্য আগ্রহের সাথে প্রশ্ন করে যে…..
.
—-কি শর্ত?
.
—-আমার সব কথা শুনতে হবে। যেমন: আমি যা খেতে বলবো তাই খাবে , সম্পূর্ণ রেস্টে থাকবে , ওষুধ নিয়ে কোনো হেলফেল করবে না and most important……..বাদরামি করবে না।তাহলেই বাসায় যাবো।
.
আদ্রাফের মুখের দিকে এবার মেহের তাকায়। ভ্রু কুচকে বলে ওঠে……….
.
—–আমি কি বাদরামি করার মতো মেয়ে? তুমি জানো না , আমি আদ্রাফ এহসানের একটা কিউট, ইনোসেন্ট, গুবলু-বুবলু বউ?
.
একথা শুনে আদ্রাফ সশব্দে হেসে দেয়। মাঝে মাঝে মেহেরের এসব বাচ্চামি আদ্রাফের কাছে অনেক ভালোলাগার কারন হয়ে দাঁড়ায়।
.
—–আদ্রাফ?
.
—-হুম !
.
—-একটু আমার স্যালাইনের পাইপটা খুলে দাও। আমি ওয়াশরুমে যাবো।
.
আদ্রাফ মেহেরের স্যালাইনের ক্যানোলা খুলে দেওয়ার পরই মেহের ওয়াশরুমে যেতে নিয় আর আদ্রাফ সাথে সাথে কোলে তুলে নেয় মেহেরকে। ঘটনার তৎক্ষণাৎ প্রবাহে মেহের কিছুটা হকচকিয়ে গিয়েছে। আদ্রাফের দিকে ডাগর ডাগর চাহিনী দিয়ে বললো.
.
—কি হলো? কোলে তুললে কেন?
.
— ভাবলাম তুমি অসুস্থ মেয়ে। একা ওয়াশরুমে যেতে পারবে কিনা তাই ভাবলাম একটু company দেই। (চোখ টিপ দিয়ে)
.
আদ্রাফের চোখ টিপ দেওয়াতে মেহেরের হার্টবিট যেন একটা মিস হয়ে গেল। এমনিতেও এই এলোমেলো চুলে আদ্রাফকে দেখতে পুরোই অন্যরকম লাগছে আবার এমন দুষ্টু চোখের চাহিনীতে মেহেরের এখন যেন অজ্ঞান হওয়ার মতো উপক্রম। আদ্রাফের বুকে হালকা একটা ধাক্কা দিয়ে আমতা আমতা করে সে বললো……..
.
—-মমমটোও না। আমি একাই যেতে পারবো?
.
—Sure?
.
আদ্রাফ ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে মেহেরকে। মেহেরের এবার সাথে সাথেই যেন আরেকটা হার্টবিট মিস হয়ে গেলো। এই ছেলেটার চোখে কি কোনো জাদু আছে যে না চাইতেও বারবার মাতাল হয়ে পড়ে এই চোখজোড়ার নজরকাড়া চাহিনীতে? মেহের শুকনো গলায় প্রতিউত্তরে বলে………
.
—-হুম।
.
আদ্রাফ এবার মেহেরকে নিচে নামিয়ে দিতেই মেহের দুর্বল পায়ে ওয়াশরুমে পা বাড়ায়। দরজাটা লাগিয়ে চোখ বন্ধ অবস্থায় ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে । আদ্রাফের চোখের চাহিনী, কথা প্রকাশের ভাবভঙ্গি সবকিছুই বুকে গিয়ে লাগে মেহেরের। এখন তো মনে হয় যেন সবসময়ই নিজের সাথে আদ্রাফ নামের এই মায়াবী অস্তিত্বটাকে মিশিয়ে রাখতে। সে জানে না এই অনুভূতির কোনো প্রত্যক্ষ নাম আছে কি না।
.
.
.
.
প্রায় সকাল সাড়ে আটটার দিকে শাওন হেলতে-দুলতে অবস্থায় চৌধুরী মেনশনে প্রবেশ করে। গতরাতের আ্যলকোহলের নেশাটা এখনও ঠিকমতো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। হায়াৎ সাহেব ডায়নিং টেবিলে ব্রেকফাস্ট করছিলেন। শাওনকে এভাবে হেলতে-দুলতে আসতে দেখে বুঝতে আপত্তি হলো না যে এই ছেলে সারারাত বারে আ্যলকোহলের নেশার সাথে ফূর্তি করেছে।
ক্রোধের গলায় তিনি বললেন………..
.
—–এসে পড়েছে নওয়াবের ছেলে? আমি তো ওয়েট করছিলাম কখন পুলিশ যেন তোমায় তুলে নিয়ে আসে। তো কয় বোতল খেয়ে আসলে?
.
এতটুকু শুনেই শাওনের মাথায় ধপ করে আগুন জ্বলে ওঠে। গর্জে সে বলে……
.
—-আ্যলকোহলের নেশাটাই just করেছি । আপনার মতো বউ-বাচ্চাকে ছেড়ে রাত বিরাতে মেয়েদের সাথে ফূর্তি করিনি।
.
—–মুখ সামলে কথা বলো শাওন !
.
ক্রুব্ধ হয়ে বলে হায়াৎ চৌধুরি। আশেপাশের সার্ভেন্টও নীরবে যে যার জায়গা মতো দাঁড়িয়ে আছে। কেননা এ আর নতুন কোনো দৃশ্য না। শাওন এবার হায়াৎ সাহেবের কাছে গিয়ে বলে…….
.
—–ভুল বললাম নাকি মিঃ হায়াৎ চৌধুরি ওরফে আমার so called dad? আপনার জঘণ্য চরিত্র থেকে আমার চরিত্র লক্ষ গুণে ভালো। হ্যাঁ ! আমি হয়তো হৃদয়হীন মানুষ , বাট কেউ কখনও আমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলতে পারবে না। আর আমি যা-ই করি না কেন , আপনার কোনো রাইট নাই। You have no right to control me……
.
শেষের কথাটা শাওন চিল্লিয়ে বলে ওঠে । পুরো ডাইনিং রুমে বিরাজ করছে পিনপন নিস্তব্ধতা। হায়াৎ সাহেব নীরব গলায় বলে ওঠে……….
.
——কখনও কোনো কিছুর কমতি রাখিনি তোমার। তাহলে আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলার তুমি কে? বাবা হই আমি তোমায়।
.
শাওন এবার হো হো করে হেসে ওঠে। যেন দুনিয়ার সবচেয়ে মজার কৌতুক শুনলো সে। কিছুক্ষণ পর হায়াৎ সাহেবের দিকে ক্রোধের গলায় বলে ওঠে……..
.
——-সে right তুমি অনেক আগেই তুমি হারিয়ে ফেলেছো যখন তুমি রাইতা আর মাকে মেরে ফেলেছিলে। মা নাহয় তোমার ফূর্তিতে বাধা দিয়েছিলো কিন্ত রাইতা? ৭ বছরের বাচ্চা ছিলো সে। তোমার আপন মেয়ে হয়েও তুমি ওকে মেরে ফেলতে পারলে?
.
নিশ্চুপ হয়ে যায় হায়াৎ সাহেব। হ্যা শাওনের মাকে এক্সিডেন্ট করিয়ে সে মেরে ফেলেছিলো ঠিকই তবে তার সঙ্গে যে রাইতাও থাকবে এটা সে জানতো না। গাড়িটা সরাসরি খাদে পরে গেলে শাওনের মা আর রাইতা দুজনেই মারা যায়। দুদিন পর শাওনের মার বিভৎস লাশ পাওয়া যায় পাহাড়ের ঢালে । তবে রাইতার আর কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে সে যে বেঁচে নেই এ ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত ছিলো।
শাওনের বয়স তখন ছিলো মাত্র ১৪ বছর। এ ব্যাপারে যে ওর বাবার হাত ছিলো এটা সে জানতে পারে আরও দুইবছর পরে। তখন থেকেই পরিবর্তন হয়ে যায় শাওন। বাবা হয়ে ওঠে তার জীবনের সবচেয়ে ঘৃণিত বস্ত। এমনকি কিছু দুশ্চরিত্রা মেয়ের জন্য মেয়েজাতিকেও। সবাইকে না।
কারন শাওন জানে সবাই একরকম না। হয়তো পরোক্ষভাবে কিছু মেয়ের জন্যই তার মা-বোনকে হারাতে হয়েছে তবে সবাই তো এক না। ওর ফ্রেন্ডসার্কেলে রাতুল , রাহাতের সাথে তার শুভাকাঙ্খী হিসেবে নিশা আর শোভাও ছিলো।
.
হায়াৎ সাহেবকে চুপ থাকতে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে শাওন। টেবিলে থাকা গ্লাসটা সশব্দে ফেলে দিয়ে গজগজ করতে করতে চলে যায় সেখান থেকে।
.
.
.
নিচে হসপিটালের রিসেপশনের সামনে মেহের আড়চোখে একবার দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন মেডিকেল স্টুডেন্টের দিকে দেখছে তো একবার আদ্রাফের দিকে। আদ্রাফ রিসেপশনে থাকা লোকটির সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলাপনে ব্যস্ত। আর মেহের পাশের সোফাটিতে বসে ওই তিনটি মেয়েকে দেখে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। তার কাছে ওই মেয়ে তিনটিকে নিজের থেকেও চরম লেভেলের অসভ্য মনে হচ্ছে।
কেননা মেয়ে তিনটি শুধু পারছে না চোখ দিয়েই আদ্রাফকে গিলে খেয়ে ফেলতে। তাছাড়া আদ্রাফের প্রতিটা কাজই সবসময় হয় চোখ ধাধানোর মতো। পরনে গ্রে শার্ট , ব্ল্যাক প্যান্ট , পায়ে হোয়াইট কেডস সব মিলিয়ে শ্যামবর্ণের এই আদ্রাফকে বেশ চার্মিং লাগছে। শার্টের হাতাটি কিছুটা গুটিয়ে রাখার কারনে হাতের নীল রগগুলো বেশ সুন্দরভাবেই বোঝা যাচ্ছে। চুলগুলো হালকা স্পাইক করা আর ওর দুহাত ব্যস্ত হসপিটালের কাগজপত্র দেখতে।
মেহেরের ওই তিনটা বদ মেয়ের ফিসফিসানি দেখে মাথায় যেন রক্ত উঠে গিয়েছে। মনে মনে অসংখ্য গালাগাল করে যাচ্ছে মেয়ে তিনটিকে। আদ্রাফ সব কাজ শেষ করে এবার মেহেরের দিকে এগিয়ে আসতেই মেহের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। আদ্রাফকে আদুরে গলায় বলে ওঠে………..
.
—–আমায় কোলে নাও।
আদ্রাফ কিছুটা হতভম্ব। হঠাৎ মেহের কেনই বা ওর কোলে উঠতে চাচ্ছে বিষয়টা ওর মাথায় আসছে না। মেহেরের গাছে হাটু গেড়ে বসে সে। নিজের হালকা গোলাপি ঠোঁটজোড়া নাড়িয়ে বলে ওঠে………
.
—–বেশি খারাপ লাগছে মেহু?
.
আদ্রাফের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। মেহের তা দেখে ফিক করে হেসে দেয়। ওর সাজানো গোছানো চুলগুলোকে এলোমেলো করে বলে ওঠে……..
.
—-অন্য মেয়েরা আমার বরকে দেখবে এটা আমার ভালো লাগে না। তাই এখান থেকে গাড়ি পর্যন্ত আমায় কোলে নিয়ে যাবে।
.
আদ্রাফ এভার কিছু না বলে কোলে তুলে নেয় মেহেরকে। তা দেখে সবার মনে প্রশ্ন জাগলেও এগোনোর মতো মনমানসিকতা কারও নেই। একজন ওয়ার্ডবয় উদ্যত হয়ে বলে……..
.
—–স্যার……ম্যামের কি হুইল চেয়ার লাগবে?
.
—–না রে ভাই। ম্যামের জন্য তার হাজবেন্টই হুইলচেয়ার।
.
মেয়ে তিনটিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেহের মনে মনে যেন পৈশাচিক আনন্দ পায়। আদ্রাফের গলা জড়িয়ে ওই তিনটা মেয়েকে চোখ টিপ মারতেই মেয়ে তিনজন বিব্রত হয়ে পড়ে। মনে মনে মেহের বলে উঠে………
.
—-এই মেহের থাকতে তার কিউট বরের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকাতে পারবে না।🙂
.
.
.
.
.
~চলবে
গল্পে বোরিংনেস ধরেছে তাই না?সবাই শুধু শাওন শাওন করে বেড়াচ্ছে। আজ শাওনের অতীতের আংশিক তুলে ধরলাম। মেহরাদ্রাফের জুটিটা আপনাদের কেমন লাগে জানাবেন।
.
.
~চলবে
ভ্রুলক্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন।
.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here