#অস্তিত্বে_তুমি
#পর্ব_১০
#সুলতানা_পারভীন
-হোয়াদ্দা হেল ইজ দিস পাপা? এখানে কার্ডে আমার আর শিহাব! শিহাবের! শিহাবের নাম কেন? আর আমি তো বলেছি আমি বিয়ে করবো না। হোয়াই ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? আমি বিয়ে করবো না, করবো না, করবো না। আর এই লোকটা! আপনি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছেন? জাস্ট গেট আউট, গেট আউট, গেট আউট।
হাতে ধরা কার্ডগুলো ফ্লোরে পড়ে বিক্ষিপ্তভাবে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়তেই নীলাও নিজের সোফা থেকে ছিটকে পিছিয়ে আসলো। আবরার আর নিহার এগিয়ে এসে কার্ডে কার নাম লেখা আছে দেখার চেষ্টা করতেই নীলা সোফা ছেড়ে আফসান খন্দকারের সামনে এসে দাঁড়ালো। বিয়ের কার্ডে নিজের নামের পাশে শিহাবের নাম কেন সেটা নিয়ে যতটা না প্রশ্ন নীলার তারচেয়েও বেশি বোধ হয় রাগ জমা হয়েছে শিহাবকে আফসান সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। আফসান খন্দকার এগিয়ে এসে নীলার মাথায় হাত রাখতেই নীলা কোনোমতে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বাবার দিকে ফিরলো।
-নীলামা? পাপার কথাটা আগে শোনো একবার। তারপর তুমি যা ঠিক মনে করবে তাই হবে।
-পাপা প্লিজ? আমি এই মূহুর্তে কিছু বলার বা শোনার মতো অবস্থাতেই নেই। যাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছি, তাকে তুমি বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছ। তোমার বিজনেসের এন্টিপার্টি লোকটা, তবু একটাও কথা বলো নি শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু ওই লোকটা ধোঁকা দিয়েছে শেষ পর্যন্ত। এটা তো তোমার দোষ নয় পাপা। আর এমনও না যে আমি ওই লোকটাকে ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারবো না। নো। আমি ওইলোকটাকে চিরদিনের জন্য নিজের জীবন থেকে, নিজের ব্রেইন থেকে, শরীরের প্রত্যেকটা লোপকূপ থেকেও মুছে ফেলবো। ইয়েস আই উইল। বাট আই নিড সাম টাইম মামা। প্লিজ?
-নীলামা। আমি তোমার কথাটা বুঝতে পারছি। জিহান ছেলেটা কত জেদী তার কোনো ধারণাই নেই মা তোমার। আমাদের বিজনেস বরবাদ করতে ও ইচ্ছে করেই তোমার সাথে ভালোবাসার এই নাটকটা করেছে। আর শেষ মূহুর্তে এসে নিজেই তোমার সামনে এমন সিচুয়েশন ক্রিয়েট করেছে যাতে তুমি নিজেই বিয়েটা থেকে পিছিয়ে আসো। ওর প্ল্যান সাকসেসফুল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ইগো স্যাটিসফাইড হয় নি। হয়তো ভেবেছিল সবার অপমানের ভয়ে আমরা ওর হাতে পায়ে ধরবো যেন জিহান তোমাকে বিয়ে করে। গত কয়টা দিন নানা মানুষের নানা অপমান, প্ররচনা শোনার পরও আমরা যখন ওর বা ওর মামার কাছে মাথানত করিনি, তখন ওরা নতুন প্ল্যান করছে মা। আবার নতুন নাটক করে তোমার লাইফে ফিরতে চায় ওই জিহান চৌধূরী।
-কক্খনো না পাপা। এইটুকু ভরসা নেই তোমাদের আমার উপরে? আমি বলছি তো পাপা। আমার লাইফে ওই লোকটার আর কোনো জায়গা নেই।
-আমাদের একজন স্পাই আছে ওদের অফিসে। সে খবর দিলো ওরা ফেইক ম্যারেজ সার্টিফিকেট, ফেইক বিয়ের ফটো, সাক্ষী এরেঞ্জ করছে যাতে সোসাইটিতে আমরা মুখ দেখাতে না পারি। নিজেদের সম্মানের কথা ভেবে তোমাকে বিয়ে করতে বলছি এমনটা ভেবো না মা। আমি বা তোমার ভাইয়া, কেউই চাই না জিহান আমাদের সাথে বিজনেস কম্পিটিশনের শত্রুতার জের ধরে তোমার জীবনটা নষ্ট করুক।
-পাপা? প্লিজ? ওই লোকটার ভয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবো? জীবনটা কি ছেলেখেলা নাকি? একজন ধোঁকা দিল বলে অন্য কাউকে তার রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে জীবনে জায়গা দিবো? তাও আবার এই লোকটাকে? যাকে চিনি না, জানি না, যার আবেগশূন্য মুখটা দেখলেই আমার কেমন জানি অস্বস্তি লাগে, মনে হয় কিসের এক রহস্য নিয়ে ঘুরছে লোকটা, তাকে বিয়ে করবো? নো ওয়ে পাপা।
-নীলা? শিহাব আমাদের অফিসে জব করছে ছয় সাত বছর হয়ে গেছে মা। ছেলেটার বাবা মা কেউ নেই। ছোটোবেলা থেকে দাদা দাদীর কাছে মানুষ। এখন উনারাও আর নেই। অফিসে কেউ আজ পর্যন্ত একটা কমপ্লেইনও করে নি।
-পাপা?
নীলা আরো কিছু বলার আগেই শিহাব নিজেই এগিয়ে এসে আফসান খন্দকারের পাশে এসে দাঁড়ালো এবার।
-স্যার ম্যামকে বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে প্রেশার ক্রিয়েট করবেন না প্লিজ। আপনি আমার সাথে প্রবলেমটা শেয়ার করে আমাকে ম্যামকে বিয়ে করতে অর্ডার করলেন, আমিও মেনো নিলাম। বাট ম্যাডাম জানেনই না সিচুয়েশনটা কোনদিকে টার্ন করছে। জিহান আর উনার মামা আমাদের বিরুদ্ধে কত বড় ষড়যন্ত্র করছে সেটা ম্যাম জানেনই না বা জানলেও বিশ্বাসও করবেন না। তাই প্লিজ স্যার, ম্যাম না চাইলে উনাকে জোর করবেন না। আমি এতো বছর এই কোম্পানিতে জব করছি বাকি বছরগুলোও করবো। আজীবন আপনার অর্ডার মেনে নিবো। বাট ম্যামকে প্লিজ জোর করবেন না।
নীলা কিছু বলার আগেই আফসান খন্দকার শিহাবের কাঁধে হাত রেখে নীলার দিকে তাকালো।
-নীলামা শিহাবকে বিয়ে করলে তোমাকে আমাদের চোখের আড়ালে যাওয়ার ভয়টা আর হবে না। জিহানের আর ওর মামার আসল রূপটা কতো ভয়াবহ সেটা নিজের চোখে দেখলেও হয়তো তুমি মানতে পারবে না। ওই লোকটা আবার নতুন করে তোমার জীবনে আসার ভয়টা আমি নিজের মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারি না এক সেকেন্ডের জন্যেও। পাপার এই ছোট্টো আবদারটা, এই প্রথম আর শেষ বারের মতো পাপার কথাটা মেনে নাও প্লিজ?
-পাপা!?
-এর বেশি আমার কিছু বলার নেই নীলামা। ওই ছেলে তোমার লাইফে আবার ফিরে আসার আগে ব্যাপারটা এখানেই শেষ করতে চাই। এবার তুমি নিজেই ঠিক করো কার্ডগুলো পরিচিত কয়জনের সাথে শেয়ার করবো কি না।
-তোমার যা ভালো মনে হয় করে দাও পাপা।
-নীলা?
নীলা একছুটে ড্রইংরুম থেকে নীলার রুমে এসে বিছানায় মুখ ডুবিয়ে ফুঁপিয় উঠলো। নিজের পরিবারের সম্মানের কথাটা ভাববে নাকি জিহানের কথা সেটা নিজেও বুঝতে পারছে না নীলা। নীলা রুমে যাওয়ার পরপরই আবরার আর নিহারও নীলার রুমে চলে এসেছে। নিহার নীলার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত ছুঁইয়ে দিয়ে আবরারের দিকে তাকালো। পুরো ব্যাপারটা আবরারের নিজেরও মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বাবা কি মনে করে শিহাবের সাথে নীলার বিয়ে ফিক্সজড করলো, বিয়ের ডেইট ফিক্সজড করলো কিছুই বুঝতে পারছে না আবরার নিজেও।
-তোমরা সবাই মিলে কি শুরু করেছ বলো তো আবরার? একবার জিহান, একবার তুমি, একবার বাবা, যে যার ইচ্ছেমতো নিজের ডিসিশান এই ছোট্টো মেয়েটার উপরে চাপিয়ে দিচ্ছ। কেন? জিহান ভাইয়া নিজের সাফাইয়ে কিছু বলছে না, তুমি কি করেছ সেটা তুমি নিজেও ভালো করে জানো। আর এবার বাবা? উনি আর যার সাথে ইচ্ছে বিয়ে ফিক্সজড করতো, বাট ওই শিহাব! ওই লোকটাই যত ভেজালের মূল কারণ।
-নিহার? রিল্যাক্স। আমি বাবার সাথে কথা বলছি। শিহাব ছেলেটা ভালোই বাট এভাবে হুট করে এভাবে বিয়ের ডিসিশান নিয়ে ফেললো বাবা।
-আহা! ওই ছেলের হয়ে এবার তুমি ওকালতি করা শুরু করে দাও। আমাদের বিয়ের সময় থেকে উনি আপনাদের কোম্পানিতে জব করছে বলে এর মানে এই নয় যে লোকটা একেবারে ফেরেশতা। আপনি, বাবা, কোম্পানির সবাই যে হারে ওই লোকের ওকালতি করছেন তাতে ওই লোকের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা দরকার।
-হোয়াট? এতোগুলো বছর ওর খারাপ কিছু দেখলাম না। আর আমি বুঝি না তুমি শিহাবকে সহ্য করতে পারো না কেন।
-সহ্য করতে পারি না কজ ওই লোকটাই সব ঝামেলার জড়। এখন পর্যন্ত জিহান ভাইয়া এই করেছে, সেই করেছে, এটা ষড়যন্ত্র করছে, ওখানে লোক লাগাচ্ছে সব কিছু তোমার শিহাবই খবর দেয়। জিহান ভাইয়াকে তোমাদের ভুল বোঝানোর পিছনের কলকাঠি নাড়ছেই ওই লোকটা। একদিন আমার কথা মিলিয়ে নিও তুমি।
-নিহার? সবাই মিলে আমাকে এতো কনফিউজড করছ কেন? আহহহহ! জিহানের ফ্যামেলি কি করেছে সেটা তুমি মানো বা না মানো সিচুয়েশন চেইঞ্জ হবে না। শিহাব, এতো বছর ধরে বিশ্বাসী কর্মচারী হয়ে ছিল। নীলাকে বিয়ে করতে রাজি হওয়ার পিছনে ওর নিজের কোনো স্বার্থ আছে কি না সেটাও জানতে হবে আমাকে। বাকিটা তারপর ভেবে দেখা যাবে।
-আবরার?
-তুমি নীলাকে দেখো। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। কে এই নাটকটার পিছনে আছে আমাকে জানতেই হবে।
-হুম।
আবরার কথাগুলো বলে নীলার রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই নীলা নিহারের কোলে মুখ ডুবিয়ে বাচ্চাদের মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে দেখে নিহারও নীলাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
-কেন বলো তো ভাবি? কেন এতোদিন ভালোবাসার মিথ্যে মায়ায় জড়িয়ে রাখার নাটক করে মাঝ রাস্তায় আমাকে ছেড়ে চলে গেল উনি? কখনো ফিরে এসে আমাকে নিজের দুই বাহুর বাঁধনে শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে চায়, কখনো আমার পরিবারটাকে তিলে তিলে শেষ করে দিতে চায়। কেন কেন কেন? কোনটা তার আসল রূপ? কোনটা বিশ্বাস করবো? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না ভাবি। এই শিহাব লোকটা? সেও যে নিজের স্বার্থে ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে বাবার মন জুগিয়ে চলছে না সেটাই বা কে বলতে পারে বলো? অথচ এই আমার দোষে আত্মীয় স্বজন, সমাজ সবার কাছেই বাবাকে বারবার ছোটো হতে হচ্ছে। এসব থেকে মুক্তির পথ কি শুধু ওই লোকটাকে বিয়ে করা? তখন কি কেউ কোনো প্রশ্ন তুলবে না? নাকি তখন জিহান নতুন কোনো নাটক করবে না?
-তোর সব দ্বিধা দ্বন্দ্বের জবাব একজনই দিতে পারে নীলু। আর সেটা জিহান নিজে। উনাকেই কল করে জিজ্ঞেস কর আসলে উনি চাইছেটা কি। দুটো পরিবারের শত্রুতার জের ধরে তোর জীবনটা আমি কিছুতেই নষ্ট হতে দিবো না। তুই জিহানকেই কল করে জিজ্ঞেস কর কি চাইছে উনি আর উনার মামা।
নিহার নিজের মোবাইলটা নীলার হাতে ধরিয়ে দিতেই নীলা মোবাইলের দিকে তাকিয়েই ভাবতে লাগলো জিহানকে কল করাটা উচিত হবে কি না। সবকিছু শেষ হওয়ার আগে একবার শেষবারের মতো চেষ্টা করবে কি নীলা? আরেকবার জিহানের মিথ্যে নাটকে জড়িয়ে পড়বে? নাকি আসল সত্যটূ জানতে পারবে এবার নীলা?
চলবে ইনশাআল্লাহ