#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(26)
আতঙ্কের মাঝে হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে চমকে ওঠে অরুনিকা। ভয়ে গুটিসুটি মেরে রুমের এক কোণে বসে আছে। চারপাঁচ জন লোককে একসাথে প্রবেশ করতে দেখে আত্মা যায় যায় অবস্থা তার। মনের মাঝে উঁকি দিয়ে বেড়াচ্ছে উল্টোপাল্টা নানা চিন্তাভাবনা।
নিশুতি রাতের গভীরতা ক্রমে বেড়েই চলেছে। চারিদিকের থমথমে আবহাওয়ার মাঝে কানে ভেসে আসছে শুধু শা শা শব্দ। অরুনিকার পাঠানো ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছাতে আরও মিনিট ত্রিশ লাগবে। মনের মাঝে উঠতে থাকা ঝড়ের বেগ কোনমতে কমার নয়। দুপুর থেকে খাওয়া তো দূর একটু পানিও স্পর্শ করেনি আদাভান। গলাটা কেমন যেনো শুষ্ক কাঠের মতো মনে হচ্ছে। অপেক্ষায় প্রবাহমান সময়ের সাথে বাড়ছে উত্তেজনা। অরুনিকার সাথে খারাপ কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবেনা আদাভান।
ঝড়ের বেগে বাইক চালিয়ে পনেরো মিনিটে পৌঁছেছে আদাভান। উত্তেজনায় হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার। পুলিশ ফোর্স আসতে আরও দশ মিনিট লাগবে, তাই নিজের জানের পরোয়া না করেই সামনে থাকা বাড়ীটার দিকে এগিয়ে যায়। জায়গাটা একেবারে শহরের মাঝবরাবর। বিশাল এক বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক পর্যবেক্ষণ করতেই হুডি পড়া কাউকে পাশ থেকে বেরোতে দেখে সরে যায়। লোকটা বেরিয়ে যেতেই ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বড়ো বাড়ীর পাশের সেই জায়গাটাতে। ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা ছাড়া কিছুই চোখে পড়লোনা সেদিকে। পিছন ঘুরে চলে যেতে নিলেই দূরে চিকচিক করা কিছুর উপর চোখ আটকে যায় তার। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে দৌড়ে যায় সেদিকে। ফোনের লাইট জ্বালিয়ে জিনিসটা দেখার চেষ্টা করতেই চমকে ওঠে আদাভান। কাঁপা কাঁপা হাতে ওঠায় সামনে পড়ে থাকা আংটিটা।
“এটা তো সেই আংটি, যেটা আমি অরুর জন্য বানিয়েছিলাম। এটা এখানে! তার মানে এদিকেই কোথাও আছে অরু।” ছলছল চোখে তাকিয়ে আংটিটা পকেটে ভরে নিলো আদাভান।
কিছুদূর এগোতেই কাউকে এদিকে আস্তে দেখে পাশে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে আদাভান। এদিকে অরুনিকা অনেক কষ্টে সেই রুম থেকে বের হতে সক্ষম হয়েছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনরকমে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দৌড় দেয়। আশেপাশের রাস্তা সম্পূর্ণই অচেনা তার কাছে। কোথায় আছে সেটাও জানেনা। কোনদিক দিয়ে বের হবে কোনো কুলকিনারা না পেয়ে সোজা দৌড়াতে থাকে। কিছু লোককে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে তাদের বিভ্রান্ত করে অন্ধকারে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে অরুনিকা। এতোক্ষণে আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটাই লক্ষ্য করেছে আদাভান। অরুনিকাকে এদিকে আসতে দেখে টান দিয়ে লুকিয়ে ফেলে ঝোপের মাঝে।
অচেনা জায়গায় এমন পরিবেশে হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনায় খেই হারিয়ে ফেলে অরুনিকা। কিছু বলতে উদ্যত হলেও আদাভান একহাতে তার মুখ চেপে ধরে অপরহাতে কোমড় জড়িয়ে আরোও কাছে নিয়ে আসে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ছটফট করতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে শান্ত হয়ে আদাভানের বুকে মাথা এলিয়ে দেয়। অচেনা পরিবেশে প্রিয় মানুষটাকে কাছে পেয়ে মুখে হাত চেপে ডুকরে কেঁদে ওঠে অরুনিকা।
লোকগুলো আলোর পথে এগিয়ে গেলো অরুনিকার খোঁজে। এদিকে সুযোগ বুঝেই অরুনিকার হাত ধরে কোনোরকম দৌড়ে বাইকের কাছে পৌঁছায় তারা।
“অরু তাড়াতাড়ি ওঠো, এখান থেকে আগে বেরোতে হবে। হারি আপ।”
বিনাবাক্যে বাইকের পিছনে উঠে পড়ে অরুনিকা। যতদ্রুত সম্ভব সেই জায়গা থেকে বেশ কিছুটা দূরে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অরুনিকার দিকে তাকায় আদাভান। ছলছল দুই চোখে পুরো মুখে আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে জাপ্টে ধরে কান্না করে দেয় স্ট্রং পার্সোনালিটির আদাভান।
“আ..আমাকে মাফ করো প্রাণপাখি, আমি সঠিক সময়ে তোমার কাছে পৌঁছাতে পারিনি। এই আঘাতের চিহ্নগুলো থেকে আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি। আমারই ভুল, আমার তোমাকে একা ছাড়া উচিত হয়নি। হু হু সব আমার জন্যই হয়েছে।”
“আদাভান শান্ত হন প্লীজ।”
“এই দেখো তোমার ঠোঁটের পাশে কতটা কেটে গেছে, ওরা তোমাকে অনেক মেরেছে তাইনা? ওরা তোমাকে কেনো মারলো? আমাকে মারলে তো আমি সেই আঘাত হাঁসিমুখে সহ্য করে নিতাম। এই দেখো তোমার কপালে কতোটা কেটে গেছে। আমি কিভাবে তোমাকে এভাবে সহ্য করবো প্রাণপাখি। আমার যে অনেক কষ্ট হচ্ছে। তুমি জানো আমার পাগল পাগল অবস্থা হয়েছিলো তোমাকে না পেয়ে। আমি মর……….”
আদাভানকে আর কিছু বলতে না দিয়ে অধরে অধর মিলিয়ে দেয় অরুনিকা। উষ্ণ আবেশে দুই চোখ বন্ধ করে সেই ভালোবাসা সাদরে গ্রহণ করে আদাভান। আদাভানকে কিছুটা শান্ত করে সরে আসতে নিলে ডান হাত অরুনিকার কোমরে রেখে বামহাতে মাথা আগলে ধরে আদাভান আবারো ডুব দেয় উষ্ণ আবেশে। বেশ কিছুক্ষন পর দুজনেই জোরে জোড়ে হাপাতে থাকে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে। আদাভানের চাহনিতে লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে চোখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকায় অরুনিকা।
“প্লীজ পাগলামি করিয়েন না। প্লীজ শান্ত হন।”
মেয়েকে পেয়ে তাহসান সাহেব কান্না করতে করতে বুকে জড়িয়ে নেন। রুবিনা বেগম অসুস্থ বলে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে।
“আঙ্কেল আমার মনে হয় অরুনিকার এবার রেস্ট নেওয়া দরকার। কাটা জায়গাগুলোতেও ওষুধ লাগাতে হবে। আপনার যা জিজ্ঞাসা করার কাল করবেন প্লীজ।”
“অরু মা ওকে নিয়ে নিজের রুমে যাও।”
রুমের মাঝে পিনপতন নীরবতার বিরাজমান। বাইরে থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা বাতাসে অরুনিকা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। গভীর রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে আদাভানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে অরুনিকা।
“জানেন আদাভান, আমার কাছে যখন কল এসেছিলো যে আপনার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে আমার দুনিয়া পুরো থেমে গেছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি বোধহয় হারিয়ে ফেললাম আপনাকে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো আমার। সব অভিমান ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেছিলাম আমি।”
কথার মাঝে অরুনিকার ফুফানোর শব্দে দুহাতে আরো ভালোভাবে আগলে নেয় তাকে আদাভান।
” এমনিতেই আজকে আব্বু আমাকে বিয়ের কথা বলেন, তারপর আবার আপনার অ্যাক্সিডেন্টের খবরে আমার মাথা কাজ করছিলনা। পাগলের মতো এদিক ওদিক করে কোথাও একটা রিক্সা না পেয়ে পায়ে হেঁটেই এগিয়ে যাই। তারপর হঠাৎ করেই পিছন থেকে মুখে রুমাল চেপে ধরে কেউ। আর কিছুই মনে নেই আমার। যখন জ্ঞান ফেরে নিজেকে অন্ধকার এক রুমে আবিষ্কার করি। অনেক ধাক্কানোর পরেও কেউ এসে দরজা না খোলায় আশেপাশে তাকিয়ে একটা মাত্র জানলা দেখতে পাই। কিন্তু জানালাটার নীচে উঁচু পাঁচিল দেওয়া ছিলো। অনেক কষ্টে সেখান থেকে বেরোতে গেলেই পাঁচিলে থাকা কাঁচে হাত পা কেটে যেতো আমার। তাই ভয়ে ভয়ে সেখানেই অপেক্ষা করতে থাকি। দুপুরে একজন মাক্স পরা লোক এসে খাবার আর পানি দিয়ে যায়, অনেক রিকুয়েস্ট করার পরও কোথায় আছি বলতে রাজি হয়না সে। সারাদিন একটু পানিও মুখে দিয়নী, আপনার কথা অনেক মনে পড়ছিলো। আপনি কেমন আছেন ভাবতেই অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। তারপর রাতের খাবার দিতে যিনি আসেন আমাকে না খেয়ে থাকতে দেখে কাউকে কল করে আমাকে ফোনটা দিয়ে চলে যান বাইরে কিছুক্ষনের জন্য। আমিও সেই সুযোগটা কাজে লাগাই, আপনার নাম্বারে মেসেজটা দিয়ে সাথে সাথে ডিলেট করে দিয়।”
“ফোনের ওপারে কে ছিলো?”
“আমি কিছু জানিনা, আমিতো তার কথাও শুনিনি ঠিকমতো। শুধু এটুকু বুঝলাম আমাকে খাওয়ার জন্য বললেন, নাহলে অনেক খারাপ হয়ে যাবে নাকি। ”
“কিছুক্ষনের মধ্যে এক লোক এসে আমার সামনে একটা কাগজ দিয়ে সাইন করে দিতে বলেন। আমি কিছুতেই সেটা হাতে নিয়না, আমাকে অনেকবার থাপ্পর মারেন উনি। অনেক জিজ্ঞাসা করার পর জানতে পারলাম ওটা নাকি প্রপার্টি পেপার। আমার দাদুর গ্রামের কিছু প্রপার্টি যেটা দাদু আমার নামে করে দিয়েছিলেন। সেই প্রপার্টি তাদেরকে দিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক মারধর করলেন। একসময় আমি অজ্ঞান হয়ে যাই তাদের অত্যাচারে। যখন চোখ খুলি কাউকে আশেপাশে পাইনি, আর কোনো উপায় না পেয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে জানলা দিয়ে লাফ দিয়। হাত,পা ও অনেকটা কেটে যায় তাও কোনরকমে দৌড় দিয়।”
চলবে?
#Fiza_Siddique
রহস্যের জাল খোলা প্রায় শুরু হয়েছে। এবার থেকে প্রতি পর্বে থাকবে একটু একটু করে রহস্যের উন্মোচন।