#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩৪তম_পর্ব
১৯.
স্নানঘরের বেসিনে দাঁড়িয়ে গরগর করে বমি করে যাচ্ছে উমা। জল অবধি সহ্য হচ্ছে না তার। বমির দাপটে ছোট মুখখানা আরো বেশি ছোটো হয়ে গিয়েছে। ফর্সা মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। শরীরটা দুর্বল লাগছে, মাথার পেছনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বেসিনকে ভর করে খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিলো সে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বখানা মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষন করে নিলো সে। কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনা একই সাথে নাস্তা করছিলো উমা, রুদ্র, রাজশ্বী এবং গোপাল। দুধের গন্ধেই গা গুলিয়ে এলো উমার। অহেতুক সবাইকে বিরক্ত না করে জল খেয়ে নিলো সে। কিন্তু তাতে লাভ হলো না। মুখ চেপে ছুটে আসতে হলো স্নানঘরের দিকে। এই শরীর খারাপটা বেশ কদিন ধরেই হচ্ছে, এতোদিন আমলে নেয় নি। ভেবেছে হয়তো ভাজাপোড়া, অসময় করে খাবার জন্য পেট সহ্য করে নি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে ব্যাপারটা সেটা নয়। বিগত দুমাস যাবৎ মাসিক হচ্ছে না তার। উমার মনে তীব্র সন্দেহ বাসা বেধেছে। তার মধ্যে কি নতুন জীবের সঞ্চার হয়েছে? চিন্তার ঘোর কাটলো রুদ্রের আতংকিত কন্ঠে,
“তুমি ঠিক আছো তো উমা? দ্রুত গতিতে উঠে এলে কেনো? উমা, আমার কিন্তু চিন্তা হচ্ছে”
“আমি ঠিক আছি”
ধীর স্বরে উমা কথাটা বললো। তারপর মুখ ধুয়ে বেড়িয়ে এলো সে। উমার শুকনো মুখখানা দেখে আলতো হাতে তার গাল স্পর্শ করলো রুদ্র। চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“মনে হচ্ছে না তুমি ঠিক আছো। বলো তো ডাক্তার ডাকি”
“সামান্য পেট খারাপ হয়েছে, এতে এতো ব্যস্ত হবার কিছুই হয় নি।“
“কোনো কিছুই সামান্য হয় না উমা, সব কিছুর কিছু না কিছু প্রভাব আছে”
রুদ্রের জিদের কাছে হার মানতে হলো উমার। মাথা নাড়িয়ে বললো,
“বেশ, বাবুর যা ইচ্ছে”
“আমি মিনুকে বলছি চিরা ভিজিয়ে দই দিয়ে দিতে।“
“মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে না, আর দুধেল জিনিস তো না, গন্ধেই গা গুলোয়”
“তাহলে কলা, চিরা দিতে বলসি, এবার বাহানা দিও না।“
উমা স্মিত হাসলো। তারপর ধীর পায়ে নেমে এলো নিচ তালায়। গোপাল তখন পেট পুজোতে ব্যাস্ত। রাজশ্বীর চোখ উমার দিকে। চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“দিদি, তুই ঠিক আছিস?”
“হু, তোর খাওয়া শেষ?”
“হ্যা, আমার খাওয়া শেষ। তুই কি কলেজে যাবি?”
“আজ উমা যাবে না রাজী, তুমি একাই চলে যাও। আমি গোপালকে স্কুলে দিয়ে আসবো।“
কথার মাঝেই রুদ্র কথাটা বলে উঠে। উমা কিছু বলে না, শরীরটা সত্যি ই চলছে না। আজ কলেজ যাবে না সে। খাওয়া শেষে উমার কপালে উষ্ণ পরশ দেয় রুদ্র, ধীর স্বরে বলে,
“ব্যস্ততা না থাকলে যেতাম না, কিন্তু যেতে হবে কাজ আছে জানোই। তুমি নিজের খেয়াল রেখো।“
“মিনু আছে তো, চিন্তা করবেন না”
রুদ্র, গোপাল এবং রাজশ্বী একত্রে বেরিয়ে পড়লো। উমা মিনুকে ডেকে বললো,
“টেবিলটা গুছিয়ে দাও মিনু”
“খাবার কি এখন ই দিবো দিদি?”
“একটু পরে দিও, খেতে ইচ্ছে করছে না। তোমার পড়াশোনা কতদূর?”
“পড়াশোনা তো ভালো মতোই চলছে দিদি, শুধু অক্ষরে গন্ডগোল খানা বাধছে। স্বর অ আর স্বর আ গুলিয়ে ফেলছি।“
“বাহ গোড়াতেই গলদ বানিয়ে বলছো ভালো চলছে। এ মাসে অক্ষর পার হওয়া হবে না। বিকেলে বই নিয়ে বসো। সারাক্ষন টিভি দেখলে হবে? ডিশলাইন কেটে দিবো ভাবছি।“
মিনু মাথানিচু করে নিলো। সত্যি সে টিভি দেখতে খুব ভালোবাসে। নতুন ডিশলাইন নেবার কারণে তার টিভি দেখার মাত্রাটা বেড়ে গেছে। উমা গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“যাও কাজগুলো করে নাও। আমি উপরে গেলাম”
উমা নিজের রুমের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। শীতল বাতাসে চুল উড়ছে সে। সালটি ২০০৮, পৌষের প্রথম দিন। দেখতে দেখতে চারটি বছর কেটে গেছে। তার এবং রুদ্রের বিয়ের ও চারটি বছর কেটে গেছে। চার বছরে অনেক কিছু বদলেছে, বদলেছে উমাও; প্রতিদিন, প্রতিমূহুর্তে সে আরোও শক্ত হয়েছে, হয়েছে আরোও আত্নবিশ্বাসী। বর্তমানে সাতক্ষীরা কলেজে প্রানীবিজ্ঞানে অনার্স করছে সে। তার ডাক্তার হওয়াটি আর হলো না। ইচ্ছে তো ছিলো, কিন্তু ভাগ্য হাল ছেড়ে দিলো। অবশ্য এতে উমার আফসোসটি নেই। কারণ সে দৃঢ় প্রকল্প নিয়েছে জ্ঞানের অন্ধকার এই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সরাবেই। একটি কল্যান সংঘঠন নির্মান করে গতবছর সিডরের পর। মানুষের কাছে সাহায্য, শিক্ষা, কর্মস্থলের খোঁজ নিয়ে সে যায়। নাম “ধরনী কল্যান সংঘঠন” অবশ্য এই বুদ্ধিটা রুদ্রের ই ছিলো। রুদ্রের সাহায্য উমা এগিয়ে যাচ্ছে। আজ তার সংঘঠনের সাথে অনেক নারী, পুরুষ, বাচ্চা জড়িত। মিনুও তাদের ই একজন। সিডরের প্রকোপে তার বাবা মারা যায়, লোকটি একজন কাঠুরে ছিলো। মা তো আগ থেকে যমের কাছে ছিলো। এগারো বছরের মেয়েটিকে উমা পায় সংঘঠনের মাধ্যমে। তার যাবার জায়গা ছিলো না বলে সে নিজ গৃহে আশ্রয় দেয়। রাজশ্বী এবং গোপাল উমার সাথেই আছে। রতী গত হয়েছে তিন বছর হয়েছে। কেউ তাকে হত্যা করেছে, কিন্তু খুনীর খোজ মিলে নি। রুদ্র রাজশ্বী এবং গোপাল কে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে। রুদ্রের ব্যাবসা বড় হয়েছে। তত্ত্ববধায়ক সরকার আসার রাজনীতির অবস্থা পালটে গেছে। অহেতুক কারণে রকিবুল মাষ্টারকে জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অভিনব সিংহ ও কয়েকবার জেলে গিয়েছেন, কিন্তু তার পরিচিতির কারণে তাকে আটকে রাখতে পারে নি। রুদ্র এর রাজনৈতিক কোনো ছাপ না থাকায় সে বেঁচে গেছে। তবে সামনের বছরের মাঝামাঝিতে পুনরায় আবারো নির্বাচন হবে, রুদ্র সেটার জন্য প্রস্তুত। এবার অদ্ভুত ভাবে বাপ বেটার মধ্যে যুদ্ধ হবে, অভিনব সিংহ পৌরসভার মেয়র পদের জন্য দাঁড়াবেন। এবং তার বিপরীতে রুদ্র দাঁড়াবে। এই চার বছরে অনেক কিছুই জানতে পেরেছে উমা। বাবা ছেলের ভেতরের যুদ্ধ ও তার জানা, রুদ্র ও বাড়িতে যায় না তেমন। যদি দরকার হয় লক্ষী দেবীকে এ বাড়ি নিয়ে আসে। গোপিনাথপুর আর আগের মতো নেই। অনেক বদলেছে। কালীগঞ্জ ও বলদেছে অনেক। উমা অতীতের খেয়ালে ডুবে ছিলো ঠিক তখন ই তার মোবাইলটি বেজে উঠে। এখন মোবাইল ফোন সকলের হাতে চলে এসেছে। বেকার যন্ত্রটি এখন কাজ করে। উমার কাছেও একটি আছে। উমা মোবাইল ধরতেই শিউলী বলে উঠে,
“উমা, আজ আসবি অফিসে?”
“শরীরটা ভালো লাগছে না শিউলী আপা। আজ বাসায় ই থাকবো ভাবছি”
“তুই আসলে ভালো হতো, জরুরী দরকার ছিলো”
“কেনো কি হয়েছে?”
শিউলির ব্যাকুল কন্ঠে ভ্রু কুচকে আসে উমার। এক রাশ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্নটি করে সে। শিউলি তখন ধীর স্বরে বলে,
“শিল্পীর জামাই আবার ওকে মেরেছে”
কথাটি শুনতেই চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে যায় উমার। শিল্পী নামক মেয়েটি তাদের সংঘঠনেই কাজ করে। বেশ ভালো কাথা সেলাই করে সে। সেগুলো রুদ্র শহরে পাঠায়। মেয়েটির বর কিছুদিন পর পর প্রহার করে তার উপর। উমা অনেকবার মেয়েটির বরকে বুঝিয়েছে কিন্তু শোনার ইচ্ছে ই রাখে না সে। উমা ধীর স্বরে বলে,
“আমি বিকেলের দিকে আসছি”
“ঠিক আছে”
শিউলি ফোনটি রেখে দিলো। শিউলী রকিবুল মাস্টারের মেয়ে। এখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। সে এই সংঘঠনের সেক্রেটারি। উমার সাথে সেও “ধরনী কল্যান সংঘঠন” তৈরিতে সাহায্য করে। তাই এই সংঘটনের সেক্রেটারী হিসেবে সে কর্মরত। উমা ফোন রেখে আকাশের দিকে তাকালো। মিহি বাতাসে তার চুল ঊড়ছে। চোখে দৃঢ় প্রতীক্ষা। আজ একটা শেষ দেখেই ছাড়বে সে।
শাশ্বত সংবাদপত্রের অফিসে বসে রয়েছে। তার প্রমোশন হয়েছে, এখন সে সিনিয়ার রিপোর্টার। কিন্তু ঢাকায় তার যাওয়া হয়। এই সাতক্ষীরার অফিসেই তার কাজ। মামামশাইকে একেবারে বসিয়ে দেবার পরিকল্পনায় ছিলো সে। কিন্তু পারে নি, মামার পরিচিতির কারণে। উলটো সে এবার পৌর মেয়রের পদে দাঁড়াচ্ছে। রুদ্র তার প্রতিপক্ষ। এই চারবছরে বাপ ছেলের বেশ কবার দ্বন্দ ই হয়েছে। অভিনব সিংহের চোরাকারবারি প্রায় ধরা পড়েই গেছিলো। কিন্তু একটুর জন্য বেচে গেছেন তিনি। সময় থাকতে থাকতে সব ব্লাক মানি সরিয়ে ফেলে অভিনব সিংহ। মজার ব্যাপার, শাশ্বতের কাছে এখনো বেনামি খাম আসে। খামে অভিনব সিংহের অপকীর্তির সব প্রমাণ থাকে। কিছু কিছু ধরতে পারে, কিন্তু কিছু কিছু থেকে মুক্তি পেয়ে যায় সে। আজও একটি খাম এসেছে শাশ্ব্তের কাছে। খামটি টেবিলেই আছে। শাশ্বত এখনো জানে না খামগুলো কে পাঠায়। এর কারণ উমার সংগঠন। তাই সবাই চাইছে যেনো এবার রুদ্র পৌর মেয়র হোক। রুদ্রের বৈভব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাপারটা সন্দেহ জাগাচ্ছে শাশ্বতের মনে। কিন্তু প্রমান পাচ্ছে না। শাশ্বত চিন্তা ছেড়ে খাদি খামটি হাতে নিলো। খামটি খুলতেই তার চোখ কুচকে আসলো, বেশ কিছু পেপার কাটিং। কাটিং গুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলো শাশ্বত। তাতে লেখা,
“দারোগা উত্তম চ্যাটার্জির কাটা দেহ পাওয়া গেলো রেললাইনের ধারে……………
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩৫তম_পর্ব
শাশ্বত চিন্তা ছেড়ে খাদি খামটি হাতে নিলো। খামটি খুলতেই তার চোখ কুচকে আসলো, বেশ কিছু পেপার কাটিং। কাটিং গুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলো শাশ্বত। তাতে লেখা,
“দারোগা উত্তম চ্যাটার্জির কাটা দেহ পাওয়া গেলো রেললাইনের ধারে”
শিরোনামটি দেখতে হতচকিত হয় শাশ্বত। উত্তম চ্যাটার্জি তার বাবার নাম, শাশ্বত তখন খুব ছোট যখন তার বাবাকে হত্যা করা হয়। স্মৃতিগুলো ঝাপসা, কিন্তু জীবন্ত। এই ছোট ছোট হাতে মুখাগ্নি করেছিলো সে। প্রায় ত্রিশ বছর কেটে গেছে সেই ঘটনার। উত্তম বাবুর মৃত্যুকে প্রতিশোধ বলেই ফাইল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। একজন ন্যায়পরায়ন মানুষের শত্রুর অভাব নেই—– এই কথাটি ছিলো পুলিশের মুখ বক্তব্য। সে সময় টেকনলজি, কিংবা সংবাদমাধ্যমের প্রসার ততোটা ছিলো না, তাই এই কেসটা বেশি ঘাটানো ও হয় নি। উপরন্তু মালিনীর মতো ভীতু নারীর কাছে স্বামীর খুনীকে শাস্তি দেবার থেকে নিজের বাচ্চাকে সুরক্ষিত রাখাটাই বেশি প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। শাশ্বত পেপার কাটিং গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। বুকের বা পাশে এক অসহ্য চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো তার। বাবার স্মৃতিটুকুর মাঝে একটাই মনের গহীনে গেঁথে আছে শাশ্বতের, পাঁচ বছরের জন্মদিনে বাবা তাকে একটি কলম দিয়েছিলো, মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,
“পৃথিবীর সর্বশক্তিশালী অস্ত্র দিচ্ছি, এই অস্ত্রের শক্তি সবচেয়ে বেশি। এখন তোর সিদ্ধান্ত, এটাকে অন্যায়ের জন্য ব্যাবহার করবি নাকি এর বিরুদ্ধে।“
বাবার কথাগুলো বোধগম্য হয় নি শাশ্বতের। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে কথাগুলোর ভার বুঝতে পারে। কলমটা কোথায় যেনো হারিয়ে ফেলেছে। এতো বছরের জমা মোটা ধুলোর পরদ মূহুর্তেই সরে গেলো। শাশ্বতের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো সেই ধুলোর জন্য, শাশ্বত চোখ মুছে নিলো। শাশ্বত মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো বাবার কেসতা পুনরায় ওপেন করবে সে। দেখা যাক এবার কোনো কূল বের হয় কি না!
উমা পৌছালো সংগঠনের অফিসে। শরীরটা ভালো লাগছিলো না, মিনু মানাও করছিলো। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারলো না। শিল্পীর কথাটা শোনার পরো শান্তিতে বাসায় কিভাবে থাকবে সে, রুদ্র জানতে পারলে চোটপাট করবে। কিন্তু উমা নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। অফিসঘরের একটা চেয়ারে বসে আসে শিল্পী। শিউলি তার সামনে বসে আছে। মুখ ফুলে আছে, ঠোঁট ফেটে রক জমে কালো হয়ে আছে। হাতের জায়গায় জায়গায় কালো কালো ছোপ স্পষ্ট। গলায় আঙ্গুলের দাগ বোঝা যাচ্ছে। হাতের কিছু কিছু স্থানে মাংস দেখা যাচ্ছে। ভয়ার্ত চোখগুলো শুকিয়ে এসেছে। শিউলী তাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো, সে অপেক্ষারত উমার জন্য। তখন ই উমা প্রবেশ করে রুমে। সে শিল্পীর কাছে গিয়ে বসে। শিল্পীর গায়ে হাত দিতেই কেঁপে উঠে সে, উমা তার হাতখানা চেপে ধরে ধীর কন্ঠে বলে,
“শিল্পী আপা আমি, উমা”
উমাকে দেখে শিল্পীর চোখ ভিজে এলো। হুমড়ি খেয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। চাপা আর্তনাদ করে উঠলো মেয়েটি। শিল্পীর পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো উমা, তাকে খুব কষ্টে শান্ত করলো সে। শিল্পী শান্ত হলে তাকে অন্য মেয়েদের কাছে রেখে শিউলী এবং উমা আলাদা ঘরে যায়। শিউলী ধীর স্বরে বলে,
“তোর শরীর ঠিক আছে?”
“কেনো বলতো?”
“কেমন যেনো শুকনো, অসুস্থ লাগছে তোকে।“
“আমি ঠিক আছি, আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আচ্ছা এবার শিল্পী আপার উপর অত্যাচারের কারণ কি? কিছুদিন পুর্বে তো সব ঠিক ছিলো। মকবুল মিয়া নাকি ভালো হয়েছে। আপার প্রতি তার ভালোবাসা নাকি উপসে উঠছিলো।“
“সব নাটক, ওই জানোয়ার কোনো ভালো হয় নি। কুকুরের লেজ কি সোজা হয়? মকবুল মিয়ার চাকরি চলে গিয়েছিলো, স্বাভাবিক ঘরের আয়ের উৎস শুধুমাত্র আমাদের শিল্পী। তাই এতোদিন তার জন্য ভালোবাসা উথলে উঠেছিলো। এখন আবার কাজ পেয়েছে। দাপট বেড়েছে। জুয়ার নেশা মাথা চারা দিলো। নিজের টাকা ডোবালো, শিল্পীর কাছে টাকা চাইলো। শিল্পী মানা করতে গিয়েছে তাই মেরেছে। এই পুরুষগুলো কবে মানুষ হবে তার ঠিক নেই। শিল্পীকে মেরে কি অবস্থা করেছে দেখেছিস। আমিতো বলে দিয়েছি আমার কাছেই থাকবে শিল্পী। ও বাড়ি যাওয়া লাগবে না।“
“শিল্পী আপার মেয়েটা কোথায় গো?”
“বাইরে খেলছে?”
“মকবুল ভাই এসেছিলো?”
“এসেছিলো আমি খেদিয়ে দিয়েছি, এখানে আহসান ভাই, করিম ভাই আছে। তারা তো মারতে গিয়েছিলো।“
উমা কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো। তারপর ধীর স্বরে বললো,
“এভাবে হবে না আপা, এবার একটা নারী অত্যাচারের মামলা করতেই হবে। এভাবে চলতে থাকলে তো ওরা মাথা চারা দিয়ে উঠবে। শাস্তি পাবে না। যদি ছাড়াছাড়ি হয় ভালোভাবে হবে। দেনমোহর দিবে, অন্তত মেয়েটির খরচ দিবে। এরকম চলতে পারে না। নারীর দেহে শক্তি নেই বলে তাদের দূর্বল ভাবা বন্ধ করতে হবে। যারা জীবের সঞ্চা্র করে তারা দূর্বল নয়।“
শিউলী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। তখন ই মানুষের গোল শুনতে পেলো তারা। অফিসের বাহিরে চেচামেচি করছে কিছু মানুষ। কৌতুহলের বসে শিউলী এবং উমা বেড়িয়ে এলো। মকবুল মিয়া, দশ বারোজন পুরুষ নিয়ে জড়ো হয়েছে। মকবুল মিয়া উমাকে দেখতে পেয়ে বাজখাই কন্ঠে বললো,
“দেখো, এই ভন্ড নারীবাদিরা আমার ঘর ভাঙ্গতে উদ্ধত হয়েছে। জোর করে আমার মেয়ে বউ কে আটকে রেখেছে। শুধু তাই নয় এরা চায় আমি যেনো আমার বউ তালাক দেই। এসব নষ্টামি নয়, এরা আমার ঘর ভাঙ্গতে চায়। কার না ঘরে ঝগড়া হয়, আমাদের ঝগড়ার মধ্যে এরা কেনো আসবে? আমার বিচার চাই“
মকবুলের কথায় কান ঝা ঝা করে উঠলো উমার। চোখজোড়া ঘৃণায় ঢেকে আসে। তীব্র কন্ঠে বলে উঠে,
“মকবুল ভাই, স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া হলে আমরা কখনোই এর ভেতরে আসতাম না। কিন্তু তুমি যেভাবে জানোয়ারের মতো শিল্পী আপাকে মেরেছো সেটাকে কিভাবে এড়িয়ে যাই বলো। আপা তোমার সাথে যাবে না। এখানেই থাকবে সে। তুমি যদি কিছু মানুষের সাথে জড়ো করে আমাদের ভয় দেখাতে চাও, তবে বলবো ফিরে যাও।“
“আমার বউ আমি মারবো, তোরা বলার কে?”
“তুমি কি মানুষ? একটুর জন্য জানে বেঁচে গেছে শিল্পী আপা”
“ও আমার কথার অমান্য করেছে, স্বামী আমি ওর। ওকে শাসন করার অধিকার আমার আছে।“
“ভুলে যেও না সেও মানুষ, দেশে আইন আছে তুমিও ভুলে যেও না। শিউলি আপা পুলিশে ফোন দাও”
মকবুলের আতে ঘা লাগে, ছোট একটি মেয়ে তাকে দমিয়ে দিচ্ছে নিজের কড়া বক্তব্যে। মকবুলের সহ্য হলো না, রোষাগ্নি কন্ঠে বলে উঠো,
“নষ্টতামি দেখেছো? এরা আমাদের মেয়ে-বউদের নষ্ট করে দিবে। এই অফিস ই ভেঙ্গে দাও। না থাকবে সংগঠন না থাকবে নষ্টামি।“
তার লোকজন নিয়ে ভাঙ্গচুর করার জন্য উৎসুক হয়ে উঠে। শিউলি উমার হাত চেপে ধরে। আহসান, করিম ঠেকাতে পারে না হিংস্র মানুষদের। টেবিল, চেয়ার ভাঙ্গচুর করে তারা। জানালার কাঁচগুলোও ভেঙ্গে দেয় রোষের প্রকটে। মকবুল এক পর্যায়ে উমার উপর আক্রমণ করার জন্য তেড়ে আসলে উমা নিজের হাতজোড়া সম্মুখে নিয়ে তাকে প্রতিরোধ করতে চায়। কিন্তু মকবুলের জোরের কাছে সে একজন দূর্বল নারী। মকবুলের হাতে অবস্থিত লাঠির প্রবল আঘাতে ধপ করে বসে পড়ে উমা। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে আসে হাত থেকে। বা হাত দিয়ে ডান হাত চেপে ধরে উমা। তখনই…………
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩৬তম_পর্ব
মকবুলের হাতে অবস্থিত লাঠির প্রবল আঘাতে ধপ করে বসে পড়ে উমা। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে আসে হাত থেকে। বা হাত দিয়ে ডান হাত চেপে ধরে উমা। তখনই এক জোড়া হাত মকবুলের কলার টেনে ধরে তাকে ছিটকে ফেলে। ঘটনার আকস্মিকতায় মকবুল হতবিহ্বল হয়ে যায়। মেঝে বসে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে তাকে সামনে দাঁড়ানো হৃষ্টপুষ্ট মানবের পানে। রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। ললাটের শিরা উঁচিয়ে আছে। তীব্র চাহনীতে গলা শুকিয়ে আসে মকবুলের। শুকনো ঢোক গিলে শুকনো গলায় বলে,
“রুদ্র বাবু, আপনি?”
রুদ্র এখনো তীর্যক ভয়ংকর চাহনীতে তাকিয়ে আছে। উমা নিজের সামনে রুদ্রকে দেখে কিছুটা চমকে গেলো। রুদ্রের এখানে আসার কথা নয়, মানুষটি এতোটাই ব্যাস্ত থাকে যে তার সময়টা পাওয়াটা আকাশে চাঁদ পাবার মতো হয়েছে। এই ঢাকা যাচ্ছে, এই মংলা যাচ্ছে। সরকারী বিভিন্ন প্রজেক্টের সাথে সে জড়িয়ে আছে। শুধু তাই নয়, ধরনী কল্যান সংগঠনের বিভিন্ন কাজেও সে ব্যাস্ত থাকে। বিভিন্ন ঋণ এবং বৈদেশিক সাহায্যের ব্যাপারে তাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থাকতে হয়। অতিসদ্য, ডা.ইউনুস নোবেল পাবার পর এই ক্ষুদ্র ব্যাংকের প্রচার সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সিডরের জন্য সাতক্ষীরার সকল বৈদেশিক ত্রাণ এবং যাবতীয় সাহায্য এর জন্য রুদ্র অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলো। তাই রুদ্রের ফাঁকা সময় রাত দশটার পর। কিন্তু এই সময়ে তাকে সংগঠনের অফিসে দেখবে কল্পনাও করে নি উমা। রুদ্র দৃষ্টি সরিয়ে উমার দিকে চাইলো। উমা সাথে সাথে মাথা নত করে নিলো। রুদ্র তাকে বারংবার মানা করেছিলো বাড়ি থেকে বের হতে। কিন্তু উমা কথা শুনে নি। অসুস্থ শরীরে এখানে এসে বসে রয়েছে। রুদ্র তাকে আলতো হাতের বেষ্টনীতে নিলো। মাটিতে থেকে তুলে শান্ত নজরে তাকালো তার ফুলে উঠা হাতের দিকে। চামড়া চিরে গেছে লাঠির সজোরে আঘাতে। হাতের চারপাশটা কালো হয়ে গিয়েছে। ফুলে উঠেছে কনুই এর অংশটি। রুদ্রের মুখোভাব বদলালো না। সে এখনো শান্ত নজরেই তাকিয়ে আছে। মকবুল কাঁপা স্বরে নিজের সাফাই গাইতে উদ্ধত হলো,
“রুদ্র দা, আমি ইচ্ছে করে করি নি। দোষ খানা উমার ছিলো। ওই আমার বউ বাচ্চারে আটকায়ে রাখছে। আমি তো অফিস ভাঙ্গবার চাইছি। কে বলছে ওকে সামনে আসতে।”
মকবুলের কথায় মুখ খিঁচে এলো রুদ্রের তড়িৎ গতিতে মকবুলের কাছে গিয়ে তার গলা টিপে দেয়ালে ঠেসে ধরলো সে। হাতের শিরা ফুলে উঠেছে তার। রোষাগ্নির আচে ঝলসে যাবে হয়তো মকবুল। রুদ্রের এমন কাজে সবাই থেমে গেলো। রুদ্রের লোকেরা ঘেরাও দিলো সংগঠন। পুলিশে খবর ও দিলো করিম। মকবুলের শ্বাসরোধ হয়ে আসছে৷ দাঁতে দাঁত চেপে রুদ্র বললো,
“অতিরিক্ত কথা বলা মানুষকে আমার অপছন্দ। চোরের মার বড় গলা—-কথাটা শুনেছিস? একেই তো তুই আমার অফিস ভাঙ্গতে এসেছিস, শুধু তাতে থেমে থাকিস না৷ আমার বউকে আহত করেছিস। আমি যদি তোকে মেরে কবর দিয়ে দেই, এখানে কেউ আমার কিচ্ছু করতে পারবে না। আর যে পুরুষ বউ পেটায় সে হয় কাপুরুষ। কাপুরুষের শাস্তি মৃত্যু শুধু মৃত্যু।”
রুদ্রের বল বাড়লো। ক্ষোভে তার চোখ লাল হয়ে আছে, মাথা ঝিমঝিম করছে, শরীর ঈষৎ কাঁপছে। মকবুলের মুখ নীলচে হয়ে এলো, চোখ উল্টিয়ে ফেললো। এদিকে কেউ রুদ্রকে কিছু বলতেও পারছে না। তার সাথে অন্তত বিশজন এসেছে। পুলিশ ও এসে পড়বে এখনি। উমা পরিস্থিতির অধপতনে ঘাবড়ে যায়। সত্যি যদি মকবুলের কিছু হয়ে যায়। লোকটির অবস্থা সূচনীয়। উমা ছুটে এসে রুদ্রকে থামাতে চায়। ব্যাগ্র কন্ঠে বলে,
“উনাকে ছেড়ে দেন, মানুষটা মারা যাবে ছেড়ে দেন। কথাটা শুনুন আমার। ছাড়ুন উনাকে।”
রুদ্র অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো উমার পানে। উমা ঈষৎ কেঁপে উঠলো রুদ্রের রৌদ্রবতারে। কিন্তু পিছিয়ে পড়লো না। নিজের স্বামীর হাতে কোনো অন্যায় হতে দিবে না সে। কাতর চোখে বললো,
“ছেড়ে দিন, মরে যাবে৷ চুছো মেরে হাত নষ্ট কেনো করছেন?”
রুদ্র এবার খানিকটা দমলো। ছেড়ে দিলো মকবুলের গলা। মকবুল জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকলো। গলা ধরে কাশতে থাকলো। নিজেকে স্বাভাবিক করতে সময় লাগলো তার৷ গলায় রুদ্রের হাতের ছাপ পড়ে গেছে। রুদ্র কড়া কন্ঠে বললো,
“এবার জানে মারলাম না৷ নিজের দলবল নিয়ে চলে যা। যদি মানুষের মতো মানুষ হতে পারিস তবেই শিল্পীর দিকে হাত বাড়াবি। যা”
লোকেরা মকবুলকে বহু কষ্টে দাঁড় করালো। নিয়ে গেলো ধরাধরি করে। মকবুল চলে গেলে, উমার দিকে তাকায় রুদ্র। শীতল কন্ঠে বলে,
“বাড়ি কি যাবে? নাকি এখানে থাকবে”
উমা মাথা নাড়ালো, সে বাড়ি যাবে। রুদ্র তাকে জিপে উঠতে বললো৷ উমা বাধ্য মেয়ের মতো জিপে উঠে। রুদ্র শাবীব এবং রক্তিমকে ডেকে বলে,
“মকবুল যেনো কাল ভোরের আলো না দেখতে পারে”
রুদ্রের শীতল বক্তব্যে অবাক দৃষ্টিতে তাকায় তারা। তারা ভেবেছিল রুদ্র মকবুলকে ক্ষমা করে দিয়েছে। কিন্তু এখন বলে হচ্ছে সেটা হয় নি। রুদ্র যেতে ধরলে একটু থামে, হিনহিনে স্বরে বলে,
“যমের দোয়ারে পাঠাবি না, তাহলেই হবে।”
বলেই হনহন করে জিপের দিকে চলে যায় রুদ্র। শাবীব এবং রক্তিম মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। রুদ্র যেনো এই চারবছরে আরোও বেশি হিংস্র হয়ে উঠেছে। কাউকে ক্ষমাও করা যায় এটা যেনো তার মস্তিষ্ক জানেই না।
বাসায় পৌছাতে পৌছাতে রাত আটটা বেজে যায়। সারাটা রাস্তা একটি কথাও বলে নি রুদ্র। উমা মনে মনে ভগবানকে ডাকতে লাগলো। যেনো কোনো ভাবে রুদ্রের রোষানল থেকে মুক্তি পায় সে৷ এই লোকটা যত দিন যাচ্ছে তত যেনো রাগী হয়ে উঠছে। আর এখন রাগটি অন্যভাবে দেখায় সে। কোনো ভাঙ্গচুর নেই, কোনো শোরগোল নেই৷ শুধু গম্ভীর মুখে, শিরা ফুলিয়ে চোয়াল শক্ত করে বসে থাকবে। একটি বাক্য উচ্চারণ করবে না। এতে উমার চিন্তা দ্বিগুন হয়। জিপ থামতেই উমাকে ব্যাতীত নেমে যায় রুদ্র। হনহন করে চলে যায় বাড়ির ভেতরে। ভেতরে যেয়ে তীব্র স্বরে হাক দেয়,
“মিনু? মিনু? ঔষধের বাক্স খানা আনো দেখি”
উমার হাজারো সাহস যেনো নিমিষেই উড়ে যায়। রুদ্রের সামনে তার সাহসের পাখিটা উড়াল দেয় আকাশপানে। রুদ্র শীতল স্বরে বলে,
“সোফায় বসো”
“আসলে, শিউলি আপা ফোন করেছিলো। শিল্পী আপার অবস্থা শুনে বসে থাকার জো ছিলো না”
“আমি কি সাফাই চেয়েছি?”
রুদ্রের শীতল কন্ঠে দমে যায় উমা। ততক্ষনে বাক্স নিয়ে আসে মিনু। রুদ্র উমার পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে হাতটায় মলম লাগিয়ে দেয়। সে বাসায় ফোন করেছিলো উমার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে। মিনু ফোন টি ধরে। সেই তাকে বলে উমার অফিসে যাবার কথাটা। রুদ্রের মেজাজ তখন থেকেই বিগড়েছে। মেয়েটা তার কথা শুনতে চায় না। শুধু ছুট ছুট স্বভাব। এতো অবাধ্য হয়েছে মেয়েটি বলার মতো না। রুদ্র মনোযোগ দিয়ে উমার হাতে মলম লাগিয়ে দেয়। উমা কিছু বলার আগেই সে উঠে নিজের কাজের ঘরে চলে যায়। রুদ্রের এমন আচারণ এই প্রথম নয়। রুদ্র উমার উপর রাগ দেখাতে পারে না। তাই সে চুপ হয়ে থাকে। এখন কাজের ঘরে একের পর এক সিগারেট টানবে সে। এটাই তার স্বভাব হয়ে গিয়েছে। উমার মন খানিকটা খারাপ হয়ে যায় রুদ্রের উঠে চলে যাওয়াতে।
হাতের ফাঁকে সিগারেট জ্বালালো রুদ্র। সুখটান দিতে যাবে তখন ই ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের নাম্বারটা অচেনা। অচেনা নাম্বার দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হয় তার। ফোনটি রিসিভ করতেই মুখোভাব বদলে যায় রুদ্রের। হিনহিনে স্বরে বলে,
………….
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩৭তম_পর্ব
হাতের ফাঁকে সিগারেট জ্বালালো রুদ্র। সুখটান দিতে যাবে তখন ই ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের নাম্বারটা অচেনা। অচেনা নাম্বার দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হয় তার। ফোনটি রিসিভ করতেই মুখোভাব বদলে যায় রুদ্রের। হিনহিনে স্বরে বলে,
“আমি এখন বাড়ি চলে এসেছি, এই ব্যাপারে আগামীকাল কথা বলবো। যে কাজ দেওয়া হয়েছে সেটা হয়ে গিয়েছে?”
“……”
“ভালো, শুনেছি আগামী মাসে বাবার সম্মেলন। সম্মেলনের আগেই আমাদের সব করতে হবে। মনে থাকে যেনো, রাখছি”
বলেই ফোনটা রেখে দিলো রুদ্র। এগিয়ে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালো সে। প্যান্টে হাত গুজে দৃষ্টি দিলো আকাশের পানে। জানালা দিয়ে পূর্ণ চন্দ্রমার স্নিগ্ধ কিরণ গলিয়ে পরছে ঘরে। আলো জ্বালায় নি রুদ্র। মাঝে মাঝে অন্ধকারে থাকতে খুব ভালো লাগে তার। নিজের ভেতরটায় উঁকি দিতে পারে। অন্তরাত্মার সাথে মাঝে মাঝে পরিচিত হতে হয়, গল্প করতে হয়। লুকানো মাটির ব্যাংকটা ভেঙ্গে দেখতে হয় কি পেয়েছে কি হারিয়েছে। রুদ্র সেটাই করে। মনের আঙ্গিনায় লুকিয়ে রাখা মাটির ঘড়াটা ভাঙ্গে, বিশ্লেষণ করে নিজের দেনা পাওয়া। তারপর আবার নতুন ঘড়া মাটিতে লুকায়। আঙ্গুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেটটা ছাই হচ্ছে ক্রমশ। সে জানে না কতকাল লড়বে। একটা সময় লড়তে লড়তে অস্ত্র ফুরিয়ে যাবে। তখন ক্রমশ তেড়ে আসা তীরগুলো বুকে নিতে হবে। রক্তক্ষরণ হবে, সেই রক্তক্ষরণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে কিছু স্বপ্ন। এতো ঝড়ের মাঝে একটি জায়গা আছে সেখানে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্র। সেই মানুষটাকে যদি কেউ আঘাত করে মাথা ঠিক থাকে না। হয়তো সেজন্য হাজারো ভুল করে, ভুলগুলো মাঝে মাঝে ভয়ংকর হয়। সেই ভুলগুলোকে পাপ বলে। রুদ্রের আইনের ভয় নেই। ভয় উমাকে হারাবার, উমার চোখে নিজের প্রতি ঘৃণার ঝলক দেখার। যেমনটা চারবছর আগে ছিলো। রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তখন ই দরজা ঠেলে উমার প্রবেশ হয়। এসেই সুইচ অন করে বাতি জ্বালালো উমা। রুদ্র পেছনে ফিরে তাকালো। উমা ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো। ধীর কন্ঠে বললো,
“খাবেন না?”
“গোপাল, রাজশ্বী খেয়েছে?”
নিজের টেবিলে বসতে বসতে রুদ্র জিজ্ঞেস করলো। হাতের সিগারেটের ফিল্টারটি ফেললো ছাইদানিতে৷ উমা তার কাছে এগিয়ে আসলো। এলোমেলো ফাইলগুলো গুছাতে গুছাতে বললো,
“ওদের খাওয়া শেষ, গোপাল ঘুমিয়ে পড়েছে। রাজশ্বী পড়ছে। মিনু ঘুমিয়ে পড়েছে শুধু আমি আর আপনি বাকি”
“ওহ”
“আপনি এখনো রেগে থাকবেন?”
“আমি তো রেগে নেই”
বেশ নির্লিপ্ত কন্ঠে কথাটা বলে রুদ্র। নতুন প্রজেক্টের ফাইল খুলে বসে সে। উমার রাগ হয়। লোকটার এমন গা ছাড়াভাব তার মোটেই ভালো লাগে নি। বকাঝকা করতে ইচ্ছে করলে করো না বাপু! অহেতুক মুখ ফুলিয়ে রাখার কি মানে? উমা এগিয়ে যেয়ে ফাইলটা রুদ্রের হাত থেকে নিয়ে নেয়। উমার কান্ডে এক রাশ বিরক্তি ভরা চাহনীতে তাকায় রুদ্র। উমা তখন রাগান্বিত স্বরে বলে,
“বলেছি তো আর হবে না, শিল্পী আপার কথাটা না শুনলে সত্যি যেতাম না৷ আর আমার শরীর এখন ভালো আছে। দুপুরে খুব লম্বা ঘুমিয়েছি। বিশ্বাস না হলে মিনুকে জিজ্ঞেস করেন”
উমার দিকে কিছুসময় স্থির চাহনীতে তাকিয়ে থাকে রুদ্র। তারপর তর্জনী দিয়ে কিছুক্ষন কপাল ঘষে উমার হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। তার কোমড় জড়িয়ে ধরে মুখ গুজে রুদ্র। রুদ্রের তপ্ত নিঃশ্বাসে কেঁপে উঠে উমা। কাঁপা হাত বুলিয়ে দেয় রুদ্রের কালো চুলের মাঝে। নিঃশব্দ মূহুর্তগুলো ঘন হতে থাকে। উমা সেভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। রুদ্রের বেষ্টনী খুব শক্ত না, আবার হালকাও না। উমা স্মিত হেসে বলে,
“ভয় পেয়েছিলেন?”
“খুব”
“আর হবে না।”
রুদ্র কথা বলে না। নিঝুম ঘরে নিঃস্তব্ধতার মেলা বসে। রুদ্রের এমন আচারণগুলো আরো মোহে ডুবায় উমাকে। প্রায় নিজেকে একটি প্রশ্ন করে,
“কেনো ভালোবাসে সে রুদ্রকে?”
মন উত্তর দেয়,
“কারণ সে রুদ্র”
উমা স্মিত হাসে। রুদ্র আরো নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরে উমাকে। উমাও পরম যত্নে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
২০.
পড়ার টেবিলের ল্যাম্পখানা জ্বলছে। রুদ্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। উমার এই সময়টা পড়তে ভালো লাগে। নিবিড় শান্ত পরিবেশে পড়াটা ভালো হয়। সারাদিন নানা কাজে থাকলেও পড়াশোনার ব্যাপারে বেশ দৃঢ় সে। তাই প্রতিরাতে নিজের পড়াখানা এগিয়ে রাখে। তার ইচ্ছে সরকারী চাকরি করার। জানানেই এই স্বপ্ন কি আদৌও সফল হবে কি না। উমা তার প্রানী বিজ্ঞানের মোটা বইটা খুলে বসে। পাতা উলটাতে উলটাতে হঠাৎ থেমে যায়। হলুদ রঙ্গের খামটা চোখে পড়ে তার। খামটিতে কি আছে সে ভালো করেই জানে। নিখিলের সেই চিঠিটা এখনো কাছে রেখেছে সে। উমা বুকের বা পাশের চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে। কাঁপা হাতে চিঠিটা খুলে সে। এলোমেলো হাতের লেখা। মাত্রাগুলো একটাও ঠিক নেই। বছর কেটে যাওয়ায় লেখাগুলো বসে গেছে। বলপয়েন্ট কলমের কালো রঙ্গ খয়েরি হয়ে গিয়েছে। সাদা কাগজটা হলদেটে বর্ণ নিয়েছে। উমা চোখ বুলায় কাগজে। সাধু চলিত মেশানো চিঠিটা পড়তে খুব ভালো লাগে উমার।
প্রিয় উমা,
কেমন আছো তুমি? এই চিঠিখানা যখন পাইবে তখন হয়তো আমি তোমার সম্মুখে উপস্থিত থাকিবো না। তবে স্মরণ রাখিও আমার আশীর্বাদ সর্বদা তোমার সাথেই থাকিবে। বাবা হিসেবে কর্তব্য পালন করার ক্ষেত্রে তোমার পিতা বহুঅংশে অপারগ। আমি তাহা জানি, কিন্তু সত্যি বলিতে তোমাকে আমি কখনো কম স্নেহ করি নি। প্রত্যেকে পিতার একটাই প্রার্থনা থাকে ভগবানের কাছে। তার পুত্র কন্যারা যেনো সুখে থাকে। আমিও সেটাই চাহিয়াছিলাম। তাই তোমার মায়ের মৃত্যুর পর রতীলে বিবাহ করি। বিয়েখানা করার উদ্দেশ্য তোমার জন্য একজন ভালো মা বাছাই। কিন্তু ভাগ্যের ফেরটাই বদলে যায়। রাজশ্বী হবার পর তোমার অবুঝ কাজে তার প্রান যাইবার উপক্রম হয়। রতী কন্যা শোকে তোমাকে ভালোমন্দ বলে। সেদিন প্রথমবার আমি তোমাকে শাসন করি৷ সেদিন থেকে তুমি আমার থেকে বহুক্রোশ দূর চলে যাও। কিন্তু তোমাকে কাছে টানার কিংবা এই কষ্টের থেকে মুক্তি দেবার কোনো উপায় পাই নাই। দোকানের কাছে সারাদিন মগ্ন থেকে জানিতেও পারি নাই বাড়তে তোমার সাথে কি কি হয়েছে! তুমিও এতো ভালো মেয়ে ছিলে কখনো নিজ থেকে আমাকে কিছুই বলিতে না। আমার ই দোষ ছিলো আমি তোমার অব্যক্ত কথা বুঝবার চেষ্টাও করি নি। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও উমা। কিন্তু আমি কখনোই নিজের বোঝা ভাবী নি। তোমার সাথে রুদ্রের বিয়ে খানা হয়তো তোমার জন্য অন্যায় ছিলো। তোমার মতের বিরুদ্ধে বিয়েখানা আমি ঠিক করি। কিন্তু তা এজন্য মোটেই নয় যে তোমাকে আমি বোঝা ভাবী। আমি বিয়েখানায় সম্মতি দেই কেবল তোমার মঙ্গল ভেবে। তোমার শ্বশুরটি মোটেই ভালো মানুষ নয়। আমার ভয় ছিলো তোমার কোনো ক্ষতি না করিয়ে দেয়। এই ভয়ে আমি সম্মতি দেই এই বিয়েতে।
আমি জানি এই কথাগুলোতে আমার পাপ ধুইয়া যাইবে না। আমি মানুষটা বরাবর ই কাপুরুষ। কখনো অন্যায়ের উপরে কথা বলার সাহস আমার হয় নি। নর্দমার কিটের মতো জীবন ব্যাহিত করেছি। তোমার মতো কন্যার পিতা হবার যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু ইহজীবনে তোমাকে রাজশ্বী এবং গোপালকে সমান ভালোবেসেছি৷ আমার এখনো স্মরণ আছে সেই মূহুর্ত যখন মা তোমাকে আমার কোলে দিয়েছিলো। সদ্য ফুটন্ত শিউলিকে যেনো আমার হাতে পেয়েছিলাম। দিনখানা সপ্তমী ছিলো। মায়ের ত্রিনয়নের সাথে তোমার জনম হইয়াছিলো। তাই তোমার নাম উমা রাখিয়াছিলাম। আমার মতে তুমি সর্বদা দেবীর অংশ ই রইবে। পারলে তোমার এই কাপুরুষ পিতাকে ক্ষমা করে দিও। আমি আশীর্বাদ করি যেনো তুমি খুব বড় মানুষ হতে পারো। কখনো অন্যায়ের সামনে মাথানত করবে না উমা। মা অন্নপূর্ণার মতো নিজেকে দয়ালু করবে। দরিদ্র মানুষের পীড়নকে অনুধাবন করার চেষ্টা করিও। মনে রাখিবে, ধরণীও নারী, তুমিও নারী। তোমাতেই জীবের সঞ্চার। নারী নরম হলে মায়াবতী, কঠিন হলে মা কালী। তুমি রক্তজবা হও। এই আশীর্বাদ রইল। আর একখানা কথা, পারলে ওই বাড়ি থেকে পালাবার প্রচেষ্টা করিও। ওরা ভালো না। তোমার পরান নেবার মূহুর্তে দুবার ভাববে না।
ইতি
তোমার বাবা
নিখিল
উমা তাকিয়ে রয়েছে চিঠিটির দিকে। খেয়াল করলো গালদুটো ভিজে এসেছে তার। এ যেনো নতুন নয়। চারবছর যাবৎ এই চিঠিটা আগলে রেখেছে উমা। কিন্তু এই যাবৎ চিঠির শেষ কথাগুলোর মর্মার্থ বুঝতে পারে নি সে। মৃত্যুর পূর্বেও তার পিতা কিছু বলবার প্রচেষ্টায় ছিলেন। চেয়ারম্যান বাড়ির কোনো রহস্যের কথাটা বলতে চেয়েছিলেন তিনি। উমা চিঠিটা বইয়ের ভাজে রেখে দিলো। পেছনে ফিরে রুদ্রের ঘুমন্ত মুখখানা দেখলো সে। বাবা জীবিত থাকতে তাকে বলতো,
“বাবা, তুমি চিন্তা করো না। যতক্ষণ আমার পাশে এই মানুষটা আছে আমার কিছু হবে না”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো উমা। ঠোটে এক চিলতে হাসি অঙ্কিত হলো।
কালীগঞ্জ থানায় বসে আছে শাশ্বত৷ অপেক্ষা তার বন্ধুর। এক কালে এই থানার দারোগা ছিলেন উত্তম বাবু। আবদুল্লাহ বদলি হয়ে অন্য থানায় গিয়েছে। নতুন অসি শ্রাবণ মুখোপাধ্যায় শাশ্বতের খুব ভালো বন্ধু। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে তারা। শাশ্বতের আগমনে প্রথম দিন অবাক হয় শ্রাবণ। শাশ্বত তাকে সবটা বললে সে চিন্তিত স্বরে বলে,
“এতোকাল আগের তথ্য কি পাওয়া যাবে? এ খানিকটা খড়ের গাদায় সুই খোজার মতো হবে না তো?”
“জানি কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। এটুকু তো জানাই যাবে বাবার শেষ কেসখানা কি ছিলো।”
“কিন্তু সময় লাগবে বন্ধু। এতো সহজে কিছুই হয় না। টাকাও যাবে। তবে খানিকটা লুকিয়েও কাজ করতে হবে। বোঝোই তো সরকারী ব্যাপার স্যাপার।”
“তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।”
সেদিনের পর আজ এসেছে শাশ্বত। শ্রাবণ লাঠিটা টেবিলে রেখে লজ্জিত কন্ঠে বললো,
“অনেক সময় কি চলে গিয়েছে?”
“না না আমি কেবল ই আসলাম”
বসতে বসতে শ্রাবণ বলল,
“যেকারণে তোমাকে ডেকেছি, একটা সুতো পেয়েছি বন্ধু। আমার মনে হয় কাকার মৃত্যুতে এই সুতোর হাত আছে”
“কি সুতো?”
“উত্তম কাকু শেষ যে কেসখানা নিয়ে কাজ করছিলেন, সেটি একটি তদন্ত। মাদকদ্রব্য পাচার তদন্ত……….
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩৮তম_পর্ব
সেদিনের পর আজ এসেছে শাশ্বত। শ্রাবণ লাঠিটা টেবিলে রেখে লজ্জিত কন্ঠে বললো,
“অনেক সময় কি চলে গিয়েছে?”
“না না আমি কেবল ই আসলাম”
বসতে বসতে শ্রাবণ বলল,
“যেকারণে তোমাকে ডেকেছি, একটা সুতো পেয়েছি বন্ধু। আমার মনে হয় কাকার মৃত্যুতে এই সুতোর হাত আছে”
“কি সুতো?”
“উত্তম কাকু শেষ যে কেসখানা নিয়ে কাজ করছিলেন, সেটি একটি তদন্ত। মাদকদ্রব্য পাচার তদন্ত, প্রতিবছর বর্ডার থেকে প্রচুর পরিমানে মাদকদ্রব্য, ঔষধ, গরু পাঁচার হয় আমাদের দেশে। বেনাপোল বর্ডারটা অন্যতম। যদিও কড়া প্রহরী থাকে বিডিআর (তখন বিজিবি বিডিআর ছিলো) বাহিনীর, তবুও এই অমানুষ গুলো তাদের কাজ ঠিক ই করে। লাস্ট এই কেসটাই কাকুর আন্ডারে ছিলো। কিন্তু কাকু কোনো রিপোর্ট করেন নি। তার পূর্বেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এখন তিনি কি সেই গোষ্ঠীকে আদৌও পাকরাউ করেছিলেন কি না জানা নেই।”
শাশ্বত মনোযোগ দিয়ে ফাইলটা দেখতে থাকে। সুতোটা খুব ই সরু। যে কোনো মূহুর্তে ছিড়ে যাবার ভয় রয়েছে। শ্রাবণ হাত জোড়ো করে থুতনি ঠেকায়, ধীর স্বরে বলে,
“বন্ধু আমি তোকে কখনোই হতাশ করতে চাই না। কিন্তু সত্যি বলতে সময়টা অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে। এখন পুরোনো কঙ্কাল চেটেও কিছু বের হবে না।”
শ্রাবণের কথা যৌক্তিক। কিন্তু শাশ্বতের মনে এক দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে এই রহস্যের শেষবিন্দুতে সে পৌছাতে পারবে। শাশ্বত স্মিত হাসি দিয়ে বললো,
“দেশে এখন সব সম্ভব। বিদ্যুতের খাম্বাচুরি যদি ধরা পরে, এই রহস্যের জট ও খুলবে। এই ফাইলটা নিয়ে যেতে চাই পারবো?”
“হ্যা, এগুলো তোর জন্যই আমি প্রস্তুত রেখেছি। তুই নিতে পারিস। কিন্তু বন্ধু, কেউ যেনো এই ব্যাপারটা না জানে। আমার চাকরি মিয়ে টানাটানি হবে।”
“নিশ্চিন্তে থাক বন্ধু, কিচ্ছু হবে না।”
শাশ্বত বেড়িয়ে গেলো থানা থেকে। ব্যাগে মোটা ফাইল। যেখানে উত্তম বাবুর আন্ডারে থাকা সকল কেসের কুষ্ঠি আছে। শাশ্বত পিচের রাস্তায় হাটতে লাগলো। কড়া রোদে তার চামড়া ঝলসে যাচ্ছে। কিন্তু এই প্রকোপের মাঝেও পৌষের হিম বাতাস বইছে। উড়ছে এলোমেলো চুলগুলো শাশ্বতের। শাশ্বতের মনে হাজারো প্রশ্নের দলা জমেছে। উত্তর গুলো নিকষকৃষ্ণ আধারে হাতড়াতে হচ্ছে। যে তাকে আড়ালে থেকে এতো কিছুর খোঁজ দিচ্ছে সে জানে এই রহস্যের বীজ কোথায়! সেই মানুষটাকে যদি খুজে বের করা যেতো। হয়তো তখন এই জটগুলো এক এক করে খুলে যেতো।
অফিসে পৌছাতেই শাশ্বতের জুনিয়র সুমন ছুটে এলো তার কাছে। সুমন হাফাচ্ছে, শাশ্বত তার ব্যগ্রতা দেখে বাকা হেসে বললো,
“কি গো সুমন বাবু? কিছু না করেই হাফাচ্ছো দেখি? খুব কঠিন খবর রিপোর্ট করতে দিলাম কি?”
সুমন নিজেকে সামলে বললো,
“স্যার, আপনাকেই খুজছিলাম। আমি রিপোর্টটা প্রায় তৈরি করে ফেলেছি। শুধু আপনার একটু গাইড পেলে জব্বর হতো।”
“বাহ, সুমন বাবু দেখি খুব ফাস্ট হয়ে গেছে। আমি ভাবলুম, এক কোনে বসে মাথা চাপড়াচ্ছে।”
“কি যে বলেন স্যার, আপনি ই তো বলেন, “when life gives you a lemon, make it lemonade””
শাশ্বত হাসে, কিন্তু সুমনের কথাটি তার মনের কর্ণিশে জমা হতাশার কালো বাদলকে সরিয়ে আশার নতুন প্রভা উজ্জ্বলিত করে। শাশ্বতের হাসি প্রসারিত হয়। যতই আধার থাকুক এবার তদন্তের শেষ অবধি যাবেই সে। এর মাঝেই পিয়ন মন্সুর মিয়ার আগমন হয়। ধীর স্বরে বলে,
“স্যার একখানা মেয়ে এসেছে। বলছেন আপনার সাথে দেখা করতে চায়।”
শাশ্বত খানিকটা অবাক হয়। অবাক হবার ই কথা, যে পুরুষ ইহজীবনে নারী প্রলভনে আকৃষ্ট হয় নি সেই পুরুষের কাছে নারী আসবে ব্যাপারখানা বেশ অবাক করেছে তাকে। মালিনী মুখে ফেনা তুলে ফেললো,
“বাবু, বিয়েটা কর”
কিন্তু কে শুনে কার কথা, সে বিয়ে করবেই না। কোনো মেয়েকেই তার মনে ধরে না। আর যার ক্ষণিকের মায়া মনে উঁকি দিয়েছিলো সেই নারী তার ধরা ছোয়ার বাহিরে। শাশ্বতের অবাক হবার আরো একটি কারণ হলো, এই সংবাদপত্র অফিসে নারীর আনাগোনা বড্ড বিরল। সংবাদ পত্র অফিস তো কোনো কফি শপ না, সে মেয়েরা আসবে আড্ডা দিতে। শাশ্বত গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“আমার অফিসে পাঠিয়ে দাও।”
মন্সুর মিয়া ঘাড় কাত করলো। মানে সে বুঝতে পেরেছে। শাশ্বত সুমনের উদ্দেশ্যে বললো,
“প্রতিবেদন টা পাঠিয়ে দিও। আমি কারেকশন করে দিবো ক্ষণ”
“জ্বী স্যার”
শাশ্বত ব্যাগটা খুব যত্নে আগলে রাখলো তার আলমারীতে। তারপর চোখের চশমাটা ঠিকে করে বসলো কম্পিউটারের সামনে। কম্পিউটারের প্রচলন এখন বেশ বেড়েছে। প্রায় সকল অফিসেই একটা কম্পিউটার থাকবে। এখন প্রিণ্ট বের করে কালকের মধ্যে কিছু প্রতিবেদন ফ্যাক্স করতে হবে। ক্রাইম রিপোর্টার হবার এই এক ফয়দাও। যেকোনো ক্রাইম হলেই বড় একখানা প্রতিবেদন করতে হয়। এই যে গত পরশু, দেবহাটা উপজেলায় এক স্কুল যাত্রী মেয়েকে এক গোষ্ঠী মিলে ধর্ষন করেছে। শুধু তাই নয়, তাকে ধর্ষণ করে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। মেয়েটির লাশ ভোরের দিকে ড্রেনের পাশে নগ্ন অবস্থায় পায় পুলিশ। তদন্ত চলছে, তবে মেয়েটির মা-বাবার মতে এই কাজটি ইউনিয়নের এক নামী নেতার দলবলের কাজ। তদন্ত চলছে। দেখা যাক, দোষীটি ধরা পরে নাকি? উপরন্তু নতুন এক মৎস চাষের জন্য বেশ কিছু বেনামী জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু গ্রামের দরিদ্র কৃষকেরা বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রাম ছেড়ে। রাতারাতি তারা খুলনা, যশোর পাড়ি দিচ্ছে। এই বিষয়টাও ভাবাচ্ছে শাশ্বতকে। ভাবছে এই বিষয়ের তদন্ত ও করবে সে। এর মাঝেই নরম মেয়েলী কন্ঠটি কানে এলো তার,
“আসতে পারি? ”
কি বোর্ড থেকে মুখ তুললো শাশ্বত। চোখ জোড়া কুচকে এলো তার। এক কৌতুহল জমলো মনে, অবাক কন্ঠে বললো,
“তুমি? এখানে?”
মেয়েটি আর কেউ নয়, রাজশ্বী। চটের ব্যাগটা সামনে ফ্যাকাশে মুখে আবারো সে জিজ্ঞেস করলো,
“আসবো”
“এসো”
রাজশ্বী ধীর পায়ে এসে বসলো। তার কপালে ঘামের সরু মতি, ঠোঁট জোড়া ঈষৎ কাঁপছে। বেশ স্নায়ুবিক লাগছে তাকে। শাশ্বত চশমাটা খুলে রাখলো। হাত জড়ো করে থুতনি ঠেকিয়ে এক রাশ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“পেয়ারা গাছের পেত্নী আজ এখানে?”
“আপনাদের একখানা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। ইন্টার্ণ রিপোর্টার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি”
ঈষৎ কাঁপা কন্ঠে কথাটা বললো রাজশ্বী। শাশ্বতের বিস্ময় আসমান ছুলো। বলে কি এই মেয়ে, সে সাংবাদিকতায় আসতে চায়? অবাক স্বরে বলে,
“তুমি সাংবাদিক হতে চাও।”
“জ্বী, পার্টটাইম জব হিসেবে করতে চাই। বর্তমানে আমি প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি সাতক্ষীরা কলেজে। ওখানে কিছু বলা ছিলো না। তাই এসেছি।”
শাশ্বত কিছু বললো না। বরং মনোযোগ দিয়ে সামনে বসা মেয়েটিকে দেখতে লাগলো। চার বছরে কতটা বদলেছে মেয়েটি। কে বলবে এই সেই মেয়ে যে বট গাছে বসে সবাইকে পেয়ারা ছুড়তো আর ভয় দেখাতো।
ক্লাস শেষ হয়েছে দুপুর গড়িয়ে গেছে। এখন বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এসেছে উমার। চাদরটা ভালো করে মুড়িয়ে নিলো। বেশ ঠান্ডা লাগছে। অফিস গেলে মন্দ হতো না। কিন্তু রুদ্রের কড়া বারণের পর আর অবাধ্য হতে মন চাইলো না উমার। হাতটাও সাড়ে নি এখনো। এক সপ্তাহ হয়ে গেলো এখনো ব্যাথা কমে নি। হাতের ব্যাথাটা শীতের কারণে ব্যাথা বাড়ছে। এর মাঝেই তার ফোনটা বেজে উঠলো উমার। অচেনা নম্বরটি দেখে কৌতুহল জাগলো উমার। ফোন ধরতেই অপাশ থেকে একখানা তীক্ষ্ণ বৃদ্ধ কন্ঠে কানে এলো,
“উমা রায় বলছেন?”
“জ্বী, আপনি কে বলছেন?”
“আমি মহানগর ডায়াগনস্টিক থেকে বলছি। আপনার রিপোর্ট খানা নিয়ে যাবেন।”
রিপোর্টের কথাটা শুনেই অনুভূতিশুন্য হয়ে গেলো উমা। বিগত সপ্তাহেই রক্ত এবং প্রসাব পরীক্ষা করতে দিয়েছিলো উমা। সেই রিপোর্টটাই হয়তো এসেছে। বুকটা ধরফর করছে উমার। কৌতুহল হচ্ছে ফলাফলের আসায়। উমা ধীর স্বরে বললো,
“রিপোর্টে কি এসেছে জানতে পারি?”
মহিলা কিছুক্ষন থেমে বললো,
……….
চলবে
[