#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩৮তম_পর্ব
সেদিনের পর আজ এসেছে শাশ্বত। শ্রাবণ লাঠিটা টেবিলে রেখে লজ্জিত কন্ঠে বললো,
“অনেক সময় কি চলে গিয়েছে?”
“না না আমি কেবল ই আসলাম”
বসতে বসতে শ্রাবণ বলল,
“যেকারণে তোমাকে ডেকেছি, একটা সুতো পেয়েছি বন্ধু। আমার মনে হয় কাকার মৃত্যুতে এই সুতোর হাত আছে”
“কি সুতো?”
“উত্তম কাকু শেষ যে কেসখানা নিয়ে কাজ করছিলেন, সেটি একটি তদন্ত। মাদকদ্রব্য পাচার তদন্ত, প্রতিবছর বর্ডার থেকে প্রচুর পরিমানে মাদকদ্রব্য, ঔষধ, গরু পাঁচার হয় আমাদের দেশে। বেনাপোল বর্ডারটা অন্যতম। যদিও কড়া প্রহরী থাকে বিডিআর (তখন বিজিবি বিডিআর ছিলো) বাহিনীর, তবুও এই অমানুষ গুলো তাদের কাজ ঠিক ই করে। লাস্ট এই কেসটাই কাকুর আন্ডারে ছিলো। কিন্তু কাকু কোনো রিপোর্ট করেন নি। তার পূর্বেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এখন তিনি কি সেই গোষ্ঠীকে আদৌও পাকরাউ করেছিলেন কি না জানা নেই।”
শাশ্বত মনোযোগ দিয়ে ফাইলটা দেখতে থাকে। সুতোটা খুব ই সরু। যে কোনো মূহুর্তে ছিড়ে যাবার ভয় রয়েছে। শ্রাবণ হাত জোড়ো করে থুতনি ঠেকায়, ধীর স্বরে বলে,
“বন্ধু আমি তোকে কখনোই হতাশ করতে চাই না। কিন্তু সত্যি বলতে সময়টা অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে। এখন পুরোনো কঙ্কাল চেটেও কিছু বের হবে না।”
শ্রাবণের কথা যৌক্তিক। কিন্তু শাশ্বতের মনে এক দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে এই রহস্যের শেষবিন্দুতে সে পৌছাতে পারবে। শাশ্বত স্মিত হাসি দিয়ে বললো,
“দেশে এখন সব সম্ভব। বিদ্যুতের খাম্বাচুরি যদি ধরা পরে, এই রহস্যের জট ও খুলবে। এই ফাইলটা নিয়ে যেতে চাই পারবো?”
“হ্যা, এগুলো তোর জন্যই আমি প্রস্তুত রেখেছি। তুই নিতে পারিস। কিন্তু বন্ধু, কেউ যেনো এই ব্যাপারটা না জানে। আমার চাকরি মিয়ে টানাটানি হবে।”
“নিশ্চিন্তে থাক বন্ধু, কিচ্ছু হবে না।”
শাশ্বত বেড়িয়ে গেলো থানা থেকে। ব্যাগে মোটা ফাইল। যেখানে উত্তম বাবুর আন্ডারে থাকা সকল কেসের কুষ্ঠি আছে। শাশ্বত পিচের রাস্তায় হাটতে লাগলো। কড়া রোদে তার চামড়া ঝলসে যাচ্ছে। কিন্তু এই প্রকোপের মাঝেও পৌষের হিম বাতাস বইছে। উড়ছে এলোমেলো চুলগুলো শাশ্বতের। শাশ্বতের মনে হাজারো প্রশ্নের দলা জমেছে। উত্তর গুলো নিকষকৃষ্ণ আধারে হাতড়াতে হচ্ছে। যে তাকে আড়ালে থেকে এতো কিছুর খোঁজ দিচ্ছে সে জানে এই রহস্যের বীজ কোথায়! সেই মানুষটাকে যদি খুজে বের করা যেতো। হয়তো তখন এই জটগুলো এক এক করে খুলে যেতো।
অফিসে পৌছাতেই শাশ্বতের জুনিয়র সুমন ছুটে এলো তার কাছে। সুমন হাফাচ্ছে, শাশ্বত তার ব্যগ্রতা দেখে বাকা হেসে বললো,
“কি গো সুমন বাবু? কিছু না করেই হাফাচ্ছো দেখি? খুব কঠিন খবর রিপোর্ট করতে দিলাম কি?”
সুমন নিজেকে সামলে বললো,
“স্যার, আপনাকেই খুজছিলাম। আমি রিপোর্টটা প্রায় তৈরি করে ফেলেছি। শুধু আপনার একটু গাইড পেলে জব্বর হতো।”
“বাহ, সুমন বাবু দেখি খুব ফাস্ট হয়ে গেছে। আমি ভাবলুম, এক কোনে বসে মাথা চাপড়াচ্ছে।”
“কি যে বলেন স্যার, আপনি ই তো বলেন, “when life gives you a lemon, make it lemonade””
শাশ্বত হাসে, কিন্তু সুমনের কথাটি তার মনের কর্ণিশে জমা হতাশার কালো বাদলকে সরিয়ে আশার নতুন প্রভা উজ্জ্বলিত করে। শাশ্বতের হাসি প্রসারিত হয়। যতই আধার থাকুক এবার তদন্তের শেষ অবধি যাবেই সে। এর মাঝেই পিয়ন মন্সুর মিয়ার আগমন হয়। ধীর স্বরে বলে,
“স্যার একখানা মেয়ে এসেছে। বলছেন আপনার সাথে দেখা করতে চায়।”
শাশ্বত খানিকটা অবাক হয়। অবাক হবার ই কথা, যে পুরুষ ইহজীবনে নারী প্রলভনে আকৃষ্ট হয় নি সেই পুরুষের কাছে নারী আসবে ব্যাপারখানা বেশ অবাক করেছে তাকে। মালিনী মুখে ফেনা তুলে ফেললো,
“বাবু, বিয়েটা কর”
কিন্তু কে শুনে কার কথা, সে বিয়ে করবেই না। কোনো মেয়েকেই তার মনে ধরে না। আর যার ক্ষণিকের মায়া মনে উঁকি দিয়েছিলো সেই নারী তার ধরা ছোয়ার বাহিরে। শাশ্বতের অবাক হবার আরো একটি কারণ হলো, এই সংবাদপত্র অফিসে নারীর আনাগোনা বড্ড বিরল। সংবাদ পত্র অফিস তো কোনো কফি শপ না, সে মেয়েরা আসবে আড্ডা দিতে। শাশ্বত গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“আমার অফিসে পাঠিয়ে দাও।”
মন্সুর মিয়া ঘাড় কাত করলো। মানে সে বুঝতে পেরেছে। শাশ্বত সুমনের উদ্দেশ্যে বললো,
“প্রতিবেদন টা পাঠিয়ে দিও। আমি কারেকশন করে দিবো ক্ষণ”
“জ্বী স্যার”
শাশ্বত ব্যাগটা খুব যত্নে আগলে রাখলো তার আলমারীতে। তারপর চোখের চশমাটা ঠিকে করে বসলো কম্পিউটারের সামনে। কম্পিউটারের প্রচলন এখন বেশ বেড়েছে। প্রায় সকল অফিসেই একটা কম্পিউটার থাকবে। এখন প্রিণ্ট বের করে কালকের মধ্যে কিছু প্রতিবেদন ফ্যাক্স করতে হবে। ক্রাইম রিপোর্টার হবার এই এক ফয়দাও। যেকোনো ক্রাইম হলেই বড় একখানা প্রতিবেদন করতে হয়। এই যে গত পরশু, দেবহাটা উপজেলায় এক স্কুল যাত্রী মেয়েকে এক গোষ্ঠী মিলে ধর্ষন করেছে। শুধু তাই নয়, তাকে ধর্ষণ করে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে। মেয়েটির লাশ ভোরের দিকে ড্রেনের পাশে নগ্ন অবস্থায় পায় পুলিশ। তদন্ত চলছে, তবে মেয়েটির মা-বাবার মতে এই কাজটি ইউনিয়নের এক নামী নেতার দলবলের কাজ। তদন্ত চলছে। দেখা যাক, দোষীটি ধরা পরে নাকি? উপরন্তু নতুন এক মৎস চাষের জন্য বেশ কিছু বেনামী জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু গ্রামের দরিদ্র কৃষকেরা বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রাম ছেড়ে। রাতারাতি তারা খুলনা, যশোর পাড়ি দিচ্ছে। এই বিষয়টাও ভাবাচ্ছে শাশ্বতকে। ভাবছে এই বিষয়ের তদন্ত ও করবে সে। এর মাঝেই নরম মেয়েলী কন্ঠটি কানে এলো তার,
“আসতে পারি? ”
কি বোর্ড থেকে মুখ তুললো শাশ্বত। চোখ জোড়া কুচকে এলো তার। এক কৌতুহল জমলো মনে, অবাক কন্ঠে বললো,
“তুমি? এখানে?”
মেয়েটি আর কেউ নয়, রাজশ্বী। চটের ব্যাগটা সামনে ফ্যাকাশে মুখে আবারো সে জিজ্ঞেস করলো,
“আসবো”
“এসো”
রাজশ্বী ধীর পায়ে এসে বসলো। তার কপালে ঘামের সরু মতি, ঠোঁট জোড়া ঈষৎ কাঁপছে। বেশ স্নায়ুবিক লাগছে তাকে। শাশ্বত চশমাটা খুলে রাখলো। হাত জড়ো করে থুতনি ঠেকিয়ে এক রাশ বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“পেয়ারা গাছের পেত্নী আজ এখানে?”
“আপনাদের একখানা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। ইন্টার্ণ রিপোর্টার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি”
ঈষৎ কাঁপা কন্ঠে কথাটা বললো রাজশ্বী। শাশ্বতের বিস্ময় আসমান ছুলো। বলে কি এই মেয়ে, সে সাংবাদিকতায় আসতে চায়? অবাক স্বরে বলে,
“তুমি সাংবাদিক হতে চাও।”
“জ্বী, পার্টটাইম জব হিসেবে করতে চাই। বর্তমানে আমি প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি সাতক্ষীরা কলেজে। ওখানে কিছু বলা ছিলো না। তাই এসেছি।”
শাশ্বত কিছু বললো না। বরং মনোযোগ দিয়ে সামনে বসা মেয়েটিকে দেখতে লাগলো। চার বছরে কতটা বদলেছে মেয়েটি। কে বলবে এই সেই মেয়ে যে বট গাছে বসে সবাইকে পেয়ারা ছুড়তো আর ভয় দেখাতো।
ক্লাস শেষ হয়েছে দুপুর গড়িয়ে গেছে। এখন বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এসেছে উমার। চাদরটা ভালো করে মুড়িয়ে নিলো। বেশ ঠান্ডা লাগছে। অফিস গেলে মন্দ হতো না। কিন্তু রুদ্রের কড়া বারণের পর আর অবাধ্য হতে মন চাইলো না উমার। হাতটাও সাড়ে নি এখনো। এক সপ্তাহ হয়ে গেলো এখনো ব্যাথা কমে নি। হাতের ব্যাথাটা শীতের কারণে ব্যাথা বাড়ছে। এর মাঝেই তার ফোনটা বেজে উঠলো উমার। অচেনা নম্বরটি দেখে কৌতুহল জাগলো উমার। ফোন ধরতেই অপাশ থেকে একখানা তীক্ষ্ণ বৃদ্ধ কন্ঠে কানে এলো,
“উমা রায় বলছেন?”
“জ্বী, আপনি কে বলছেন?”
“আমি মহানগর ডায়াগনস্টিক থেকে বলছি। আপনার রিপোর্ট খানা নিয়ে যাবেন।”
রিপোর্টের কথাটা শুনেই অনুভূতিশুন্য হয়ে গেলো উমা। বিগত সপ্তাহেই রক্ত এবং প্রসাব পরীক্ষা করতে দিয়েছিলো উমা। সেই রিপোর্টটাই হয়তো এসেছে। বুকটা ধরফর করছে উমার। কৌতুহল হচ্ছে ফলাফলের আসায়। উমা ধীর স্বরে বললো,
“রিপোর্টে কি এসেছে জানতে পারি?”
মহিলা কিছুক্ষন থেমে বললো,
……….
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩৯তম_পর্ব
এর মাঝেই তার ফোনটা বেজে উঠলো উমার। অচেনা নম্বরটি দেখে কৌতুহল জাগলো উমার। ফোন ধরতেই অপাশ থেকে একখানা তীক্ষ্ণ বৃদ্ধ কন্ঠে কানে এলো,
“উমা রায় বলছেন?”
“জ্বী, আপনি কে বলছেন?”
“আমি মহানগর ডায়াগনস্টিক থেকে বলছি। আপনার রিপোর্ট খানা নিয়ে যাবেন।”
রিপোর্টের কথাটা শুনেই অনুভূতিশুন্য হয়ে গেলো উমা। বিগত সপ্তাহেই রক্ত এবং প্রসাব পরীক্ষা করতে দিয়েছিলো উমা। সেই রিপোর্টটাই হয়তো এসেছে। বুকটা ধরফর করছে উমার। কৌতুহল হচ্ছে ফলাফলের আসায়। উমা ধীর স্বরে বললো,
“রিপোর্টে কি এসেছে জানতে পারি?”
মহিলা কিছুক্ষন থেমে বললো,
“রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে। আপনি মা হতে চলেছেন। রিপোর্টটা নিয়ে যাবার সময় ডা. শারমিনের সাথে দেখা করে যাবেন।”
মহিলাটির কথাটা কর্নকুহরে ঝংকার তুললো উমার। সে স্তদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অপাশ থেকে নীরবতা মহিলাটিকে চিন্তায় ফেলে দিলো। প্রশ্ন করে উঠলো সে,
“হ্যালো, শুনতে কি পাচ্ছেন?”
“জ্বী।”
“রিপোর্টটা নিয়ে যাবেন।”
বলেই মহিলাটি ফোন রেখে দিলো। উমা চোখ বুঝে নিলো। ক্ষুদ্র জীবনের হাসি কান্নার অজস্র মূহুর্তগুলো জড়ো হতে লাগলো। মনের আঙ্গিনার মেঘের আড়ালের এক চিলতে কুসুমপ্রভা তার ঠোঁটের কোনায় ঠায় নিলো। চোখের ভেতরে এক অজানা ভবিষ্যতের আগাম প্রশান্তির ঢেউ উঁকি দিলো৷ উমার আবেগ জলে রুপান্তরিত হলো। বান্ধবী শিপ্রা কাঁধে হাত রেখে বললো,
“কাঁদছিস কেনো?”
“কিছু না”
নিজেকে নিপুন ভাবে সামলে উত্তরটি দিলো উমা। বাড়ি যাবার তাড়া হচ্ছে। এক অদ্ভুত কৌতুহল জাগছে, রুদ্রের মনোস্থিতি জানার এক অদ্ভুত কৌতুহল।
পার্টির সভাপতির অফিসে বসে রয়েছে অভিনব সিংহ। চার বছরে তার বয়স যেনো এক দিন ও বাড়ে নি। মুখশ্রীতে সেই দাপট, সেই অহমিকা। শুধু চুলের পাকটা বেড়েছে। চোখে এখন সোনালী বর্ডারের চশমা পরিধান করেন তিনি। শালটা সেই ভাবে ইস্ত্রী করে ভাজ করে দেওয়া। কে বলবে লোকটির উপরে এই চারবছরে ঝড় ঝাপটা গিয়েছে। তাকে বাড়ে বাড়ে দুদকের কাছে প্রশ্নোত্তরের খেলা খেলতে হয়েছে। সামনে বসে থাকা পার্টির সাতক্ষীরা জেলার সভাপতি শিকদার সাহেব বসে আছেন। তার পুরোনাম এস.এম.শিকদার। তিনি সিগারেটে সুখটান দিয়ে কড়া চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। শ্লেষ্মাজরিত কন্ঠে বললো,
“অভিনব, এই পৌরমেয়র হবার জিদটা ছেড়ে দাও। পার্টির যা অবস্থা, পরাজিত হবার চান্স বেশি। আর এই চারবছরে কম ঝড় তো গেলো না। ব্রীজের টাকা, বেআইনি অস্ত্র পাচার, সরকারের বাজেট টাকা মেরে দেওয়া, বৈদ্যুতিক খাম্বা চুরি কম কেস তো হয় নি তোমার উপর। পনেরো বছর ধরে তুমি চেয়ারম্যান ছিলে, এই পনেরো বছরে তোমার উপর ১৯ টা কেস দিয়েছে। তোমার মনে হয় তুমি জিততে পারবে এই নির্বাচন? তাও আবার রুদ্রের বিরুদ্ধে! তাই বলছি, এবার ভোটে দাঁড়িও না।”
শিকদারের কথাটা কানে তুললেন না অভিনব বাবু। তিনি গোঁফে তা দিয়ে বললেন,
“ও ছোকরা রাজনীতির কি বুঝে? আমি পনেরো বছর ধরে এই রাজনীতিতে। গতবছর তো পৌরমেয়রের পদে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। আপনারা দেন নি। এখন আমাকে বাধা দিচ্ছেন কেনো? আর কেস হয়েছে প্রমাণ তো হয়নি। আরে এ দেশের দাগী বেতারা জেল খেটেছে সেখানে আমি তো সামান্য অভিনব সিংহ। আমার হাটুতে হোচট লেগেছে, খোড়া আমি হই নি। আমার দূর্বলতার সুযোগ নিতে চাইলে তো হবে শিকদার মশাই”
“তুমি ভুল বুঝছো অভিনব। আচ্ছা দেখো এক সাথে উনিশখানা কেস হয় নি। এক এক করে হয়েছে। তাও আবার তোমার ভগিনী পুত্র শাশ্বত ই পত্রিকার হেডলাইন বানিয়েছে। একটা ধামাচাপা দেই আর পরেই আরেকটা। এখন নির্বাচনের সময়। সামনের বছর পৌরমেয়রের নির্বাচন। এতোদিনে কখন কি হয় তার ঠিক নেই। আমাদের পার্টির এখন অবস্থা খুব সূচনীয়। রুদ্রের এখন ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বাড়ছে। মানুষ ওকে ভরসা করতে শুরু করছে। তুমি ব্যাপারটা ভেবে দেখো।”
শিকদারের যৌক্তিক যুক্তিতে খানিকটা দমে অভিনব সিংহ। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে,
” তাহলে কি করা উচিত?”
” শত্রুকে যদি হারাতেই চাও। তাহলে নিজের ক্ষমতা বাড়ানোর সাথে সাথে শত্রুর ক্ষমতা কমানোর কথাও চিন্তা করো। যদিও তোমার পুত্র সে। তবুও, শত্রু তো শত্রু। ক্ষমতা যার, হুকুম তার। তুমি মানুষটি বুদ্ধিমান। চিন্তা করো।”
অভিনব সিংহ সামনে টেবিলে থাকা দাবার গুটিগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়। রুদ্রের দূর্বলতা উমা। কিন্তু উমাকে দিয়ে রুদ্রকে পরাজিত করবার কোনো বুদ্ধি মাথায় খেলছে না অভিনব সিংহের। তার চিন্তিত মুখখানা দেখে শিকদার ধীর স্বরে বলে,
“অদেখা শত্রুর থেকে চেনা শত্রু কম ভয়ংকর। তোমার অজানা শত্রুটি কে।আগে খুজে বের কর। যে তোমার সকল খবর দুদকের কাছে দিচ্ছে। আমার ভেতরে সিপাহী না থাকলে প্রমাণ কিন্তু হাতে নাতে পেয়ে যেতো সবাই। তাই আগে অগোচরের শত্রুটিকে খুজে বের করো।”
শিকদারের ইঙ্গিত বুঝতে বাকি রইলো না অভিনব সিংহের। সত্যি কেউ পেছন থেকে কল কাঠি নাড়াচ্ছে। যে যে খবর দুদকের কানে যাওয়া অসম্ভব সেই খবর গুলো দুদক পর্যন্ত যাচ্ছে। কেউ তো আছে সে পেছন থেকে তার হাটু ভাঙ্গার প্রচেষ্টায় আছে। মানুষটি কে! অভিনব সিংহের সন্দেহ দুজনের উপর স্থির রুদ্র এবং শাশ্বত। শাশ্বত সবার প্রথম তাকে নিয়ে পত্রিকায় লিখে। যাতে তার রাজনৈতিক কর্মজীবনে আঘাত এসেছে। অন্যদিকে তার ব্যাবসার উপর ফন তুলেছে রুদ্র। সেদিন থেকে তার ব্যাবসা থেকে পৃথক হয়েছে রুদ্র। সেদিন থেকে রুদ্র তার সকল কার্যে বাধা দিচ্ছে। তাই অভিনব সিংহের দৃঢ় বিশ্বাস এই দুজনের একজন ই তার জীবনে ঝড় তুলছে। অভিনব বাবুর কপাল কুচকে আসলো। চোখে আগুন জ্বললো। এই আগুন যে সে আগুন নয়, প্রতিহিংসার লিকলিকে গাঢ় অগ্নি।
২১.
রুদ্রের বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বাজলো। গাড়ি থেকে থেমে হাত পায় টান টান করলো সে। বেশ ধকল গয়েছে আজ। মংলার ওদিক যাওয়া আসাতে পাঁচঘন্টা লেগে গিয়েছে। রুদ্র মংলাতে জমি খরিদ করেছে কিছু। যদিও সেগুলো এখন কেবল ই পানি তে ডুবন্ত ডোবার ন্যায় জমি। তবুও খরিদ করেছে রুদ্র। খুলনার অদিকে চলে যাবার ইচ্ছে আছে তার। যদি মন মতো সরকার আসে তবে এই দক্ষিণাঞ্চলের উন্নতি নিশ্চিত। রুদ্রের ইচ্ছে ওখানে মৎস ফার্ম করা। তাই তিনবিঘা জমি খরিদ করেছে সে। বিশ্বস্ত লোকের নিয়োগ হলেই বেশ লাভবান হয়ে পারবে। এই চার বছরে মৎস ব্যাবসায় বেশ মন দিয়েছে সে। লাভ ও হচ্ছে। একারণে রুদ্রের মনটা আজ বেজায় ভালো। আসার সময় উমার জন্য একখানা বেলীফুলের মালাও কিনে নিয়েছে। মেয়েটিকে বেলীফুল খুব ভালো লাগে। আর উমার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা তার প্রচন্ড ভালো লাগে। রুদ্র হাসি মনেই ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো। কিন্তু প্রবেশ করতেই মনে হলো সে কোনো অন্ধকার নগরীতে চলে এসেছে। হয়তো বিদ্যুৎ গিয়েছে এই ভেবে মিনুকে ডাক দিলো রুদ্র। একটা ছোট হারিকেন নিয়ে মিনু উপস্থিত হলো, তারপর বললো,
“দাদা এসেছেন?”
“হু, উমা কোথায়? আর ঘরে অন্ধকার কেনো?”
“কারেন্ট নাই, সেই সন্ধ্যায় গেছে। মোম ফুরায় গেছে তাই আন্ধার। দিদিমনি আমারে এই হারিকেন দিছে পড়ার জন্য। উনি আন্ধআরে বারান্দায় বইয়ে আছে। কইলাম দোকানে যাইয়া মোম নিয়ে আছি। মানা করে দিলো”
“আচ্ছা আমি দেখছি”
“অন্ধকারে উপরে যাইতে পারবেন?”
“পারবো সমস্যা নেই।”
বলে উপরের দিকে হাটা দিলো রুদ্র। কোনোমতে রেলিং ধরে নিজের ঘরের কাছে আসলো। অন্ধকারে নিজের গায়ের পশম ও দেখা যাচ্ছে না। ঘরে প্রবেশ করতেই বারান্দায় অবয়বের দেখা মিললো রুদ্রের। পূর্ণ চন্দ্রমায় অবয়ব খানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার ঘরে বাহিরের চন্দ্রের আলো গলিয়ে পড়ছে। হাতের ব্যাগখানা রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় রুদ্র। উমা তখন চোখ বুঝে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্রের উপস্থিতি টের পেয়েও সে নড়লো না। রুদ্র তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আঁধারে ডুবে থাকতে বুঝি ভালো লাগে?”
“মাঝে মাঝে মন্দ লাগে না”
“কি ভাবছো?”
“সময়ের গতিকে নিয়ে চিন্তা করছি”
“তোমার হেয়ালি বোঝার সাধ্য আমার নেই।”
উমা স্মিত হাসলো। তারপর ধীর স্বরে বললো,
“একখানা বলার আছে”
“তোমার কথা শোনার জন্যই তো আমি কান পেতে আছি। বলো”
উমা রুদ্রের পানে ফিরলো। আধার আলোর মায়ায় রুদ্রের মুখোভঙ্গি আবছা হয়ে আছে। তবুও উমার ইচ্ছে হলো এই মূহুর্তে কথাটা বলতে। রুদ্রের হাতখানা নিয়ে নিজের উদর ছুলো সে। ধীর স্বরে বললো,
“আমাদের ছোট পরিবারে একজনের আবির্ভাব হতে চলেছে……..
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪০তম_পর্ব
উমা রুদ্রের পানে ফিরলো। আধার আলোর মায়ায় রুদ্রের মুখোভঙ্গি আবছা হয়ে আছে। তবুও উমার ইচ্ছে হলো এই মূহুর্তে কথাটা বলতে। রুদ্রের হাতখানা নিয়ে নিজের উদর ছুলো সে। ধীর স্বরে বললো,
“আমাদের ছোট পরিবারে একজনের আবির্ভাব হতে চলেছে, একজন ছোট মানুষ। তার ছোট্ট দুটো হাত আলতো করে ছুয়ে যাবে আপনাকে। তার কোমল স্পর্শে ক্লান্তি গুলো হাওয়াই মিঠাই এর মতো উড়ে যাবে। ছোট ছোট পায়ে বিচরণ করবে আমাদের জীবনে। সুমধুর কন্ঠে আপনাকে ডাকবে, ” বাবা”। ব্যাস্ততার মাঝে এক শীতল দীর্ঘশ্বাস। এতোবড় ধরনীতে আমাদের ছোট পৃথিবী। আমাদের উষ্ণ ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি।”
রুদ্র দাঁড়িয়ে রইলো। তার হৃদস্পন্দনের গতি বেসামাল হয়ে গিয়েছে। উমার হাতটা শক্ত করে নিজ হাতের ভেতরে নিলো সে। কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি সত্যি বাবা হতে চলেছি?”
“হু”
ছোট করে “হু” বললো উমা। রুদ্রের ক্লান্ত শরীরটা ধরে রাখতে পারলো না। শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো সে উমাকে। মুখ গুজলো উমার কাঁধে। রুদ্রের চোখে জল আসার ঘটনাটি বডফ বিরল। সে নিজের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করতে নারাজ। কিন্তু আজ নির্লজ্জের মতো নিজের আনন্দকে প্রকাশ করছে সে। তপ্ত আঁখিজোড়া জল ছেড়ে দিলো। উমার কাঁধটা ভিজে গেলো সেই জলে। বাবা হবার সুখটা কি এতোটাই প্রশান্তির! এতোটা স্নিগ্ধ! রুদ্রের জানা নেই। তবে নিজের কলিজার একটা টুকরো উমার গর্ভে বেড়ে উঠছে, বেড়ে উঠছে ক্রমশ। একটা সময় পর সেই সুখের টুকরোটা হাতে পারে রুদ্র। সত্যি কেউ তার জীবনে বিচরণ করবে। ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরলে হয়তো কেউ ছুটে আসবে তার বুকে। হয়তো কেউ আলতো স্বরে তার নিকট হাজারো আবদারের ঝুলি খুলবে। তবুও প্রচন্ড আনন্দের মাঝেও এক টলমলে ভয় উঁকি দিলো রুদ্রের বুকে। উমাহীন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের টলমলে ভয়। আরোও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরলো উমাকে সে। উমা রুদ্রের ভয়ের আভাস পেলো। পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে বললো,
“তার আগমনে খুশি হন নি?”
“খুশির মাঝেও নিকষকৃষ্ণ ভয় ডানা মিলেছে”
“কিসের ভয়”
“ছোট বউটিকে হারিয়ে ফেলার ভয়”
তখন বারান্দার হলুদ বালবটা জ্বলে উঠলো। আলোকিত হলো আধারে লিপ্ত বাড়িটি। উমা চাইলো রুদ্রের মুখপানে। তার চিন্তিত মুখখানা দেখে স্মিত হাসে সে। চোখে উষ্ণ পরশ দিয়ে বলে,
“ভগবান চাইলে কিচ্ছু হবে না। দেখবেন”
রুদ্র কিছু বলে না। শুধু কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জুমার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“এখন থেকে সাবধানে থাকতে হবে তোমায়, লাফালাফি করবে না, ছোটাছুটি করবে না। কোনো ঝামেলায় জড়াবে না।”
উমা খিলখিল করে হেসে উঠে। রুদ্রের অবস্থা দেখে বেশ হাসি পেলো তার। তার জন্য চিন্তিত রুদ্রকে দেখে কে বলবে এই সেই রুদ্র যাকে কি না লোকে ভয় পায়। উমা হাসি থামিয়ে বললো,
“কাল ছুটি নিবেন?”
“তুমি বললে নয়মাস আমি বাড়িতে থাকতে রাজী, তোমার জন্য। তোমাকে চোখের সামনে বসিয়ে রাখবো। কিছু করবে না, শুধু আমার কাছে থাকবে।”
“ধুর, সেজন্য না।”
“তাহলে?”
“ও বাড়ি যেতাম। বাবা-মা, ফুলির মা খবরটা জানলে খুশি হবেন।”
ও বাড়ি যাবার কথা শুনতেই রুদ্রের মুখোভাব বদলে গেলো। খানিকটা স্থির হয়ে গেলো তার স্নায়ু। রুদ্রের বেষ্টনী হালকা হয়ে গেলো। তাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে উমা বললো,
“কি হলো? কি চিন্তা করছেন”
“ও বাড়ি যাবার কি খুব দরকার?”
“এতো বড় একখানা খবর তাদের জানাবো না?”
“ফোনেও জানানো যায়!”
উমার ভ্রু কুঞ্চিত হলো। অবাক কন্ঠে বললো,
“পাগল হয়ে গেলেন নাকি? তারা দাদু ঠাম্মা হতে চলেছে। এই সুখবর টা ফোনে দিবো। আমি কিছু জানি না, আমরা ও বাড়ি যাবো।”
“এই অবস্থায় জার্নি করাটা কি ঠিক হবে?”
“আমি কি এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাচ্ছি নাকি? সর্বোচ্চ আধ ঘন্টা লাগবে”
রুদ্র তার যুক্তি দাড় করাতে পারলো না। উমার বক্তব্য যৌক্তিক। কিন্তু সে তো জানে না, অভিনব এবং রুদ্রের সম্পর্কটা কতোটা তিক্ত। দাদু হবার সুখের মিষ্টিটাও অভিনব বাবুর কাছে এক নতুন সুযোগ মনে হবে। উমা স্মিত হেসে বললো,
“আপনি কাপড় ছেড়ে নিন। আমি খাবার দিচ্ছি। সকাল সকাল কাল বেড়িয়ে পড়বো।”
রুদ্র মাথা নাড়ালো। উমা চলে গেলো নিচে। রুদ্র আকাশ পানে চাইলো। কেনো যেনো ভয় হচ্ছে। শত্রুর মুখোমুখি হবার ভয়, উমাকে হারাবার ভয়, সর্বোপরি নিজের পাতা ফাঁদে জড়িয়ে পড়ার ভয়____________
রাজশ্বী শাশ্বতের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শাশ্বত বেশ মনোযোগ সহকারে দেখছে রাজশ্বীর প্রতিবেদন। অজস্র ভুল, মেয়েটিকে নিয়ে বেশ চিন্তিত সে। তাকে কাজগুলো হাতে ধরে শেখাতে হচ্ছে৷ একটা বাক্য ও ঠিক মতো লিখতে পারে না মেয়েটি। বাক্যগঠন ও যেনো শাশ্বতকে শেখাতে হচ্ছে। শাশ্বতের বিরক্তভরা মুখখানা দেখে আন্দাজ করতে পারছে আজও মন মতো কাজ হয় নি। সুমনের কাছ থেকে শুনেছে শাশ্বত মানুষ কাজের ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। একাগ্রতা তার পছন্দ। কিন্তু রাজশ্বীর মাঝে সেই একাগ্রতার বহুত অভাব। মনটা বড্ড উড়নচণ্ডী। দিদির মতো এক মনে কাজ করা যেনো তার সম্ভব নয়। শাশ্বত প্রতিবেদনটা দুমড়ে মুচড়ে ফেললো ঝুড়িতে। কড়া নজরে তাকালো রাজশ্বীর দিকে। রাজশ্বী মাথা নত করে ফেললো। শাশ্বত তার ভীতু মুখখানা উপেক্ষা করে, কড়া ধমকের স্বরে বললো,
“তোমার দ্বারা কি একটা প্রতিবেদন লেখা সম্ভব নয়?”
“………”
“আমি আমার ইহজীবনে এতোটা গবেট মহিলা মানুষ দেখি নি। এক সপ্তাহ হয়ে গেলো একটা প্রতিবেদন তুমি সঠিক করে আমাকে দিতে পারো নি। এক জায়গায় ভুল ধরি তো অন্য জায়গায় ভুল করো। সমস্যা কি? সাংবাদিকতা কি ছেলেমানুষী? যে একটা প্রতিবেদন লিখতে পাড়ে না সে কিসের সাংবাদিক হবে। প্রথমত তুমি তোমার কাজের প্রতি দৃঢ় নও। দ্বিতীয়ত তুমি কি নিয়ে চিন্তা করতে থাকো নিজেও জানো না। কিভাবে সাংবাদিক হবে তুমি?”
শাশ্বতের কথাটা বেশ গায়ে লাগলো রাজশ্বীর। এতোটা কঠোর অপমান এই জীবনে এই প্রথম হতে হলো তাকে৷ ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো সে। চোখগুলো জ্বলছে। শাশ্বত রাজশ্বীর নতমুখখানা দেখে আরোও রেগে গেলো। তীব্র স্বরে বললো,
“আহম্মকের ন্যায় দাঁড়িয়ে না থেকে কাজটা করো, যাও”
রাজশ্বী মাথা নাড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো। শাশ্বতের মাথায় আগুন জ্বলছে। কাজের প্রতি অনীহা তার মোটেই ভালো লাগে না। এদিকে হতাশা তাকে জর্জরিত করে রেখেছে। কোনোভাবেই উত্তম বাবুর কেসের গতি হচ্ছে না। সব রাস্তা যেনো বন্ধ। কোনো কুল কিনারা পাচ্ছে না সে। এর মাঝেই মন্সুর মিয়া চায়ের ট্রে নিয়ে হাজির হয়। দরজা কড়া নাড়লেই শাশ্বতের চোখ যায় তার দিকে। খিটখিটে মেজাজে বলে,
“কি হলো, এতো দেরী হলো যে?”
“স্যার, একখানা খাম আইসে।”
খামের কথা শুনতেই বেশ নড়েচড়ে বসে শাশ্বত। হাত বাড়ায় মন্সুর মিয়ার দিকে। মন্সুর মিয়া বদলে করে আনা খামটা দেয় শাশ্বতের হাতে। ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে খামটি খুলে শাশ্বত। খাম খুলতেই………
#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৪১তম_পর্ব
রাজশ্বী মাথা নাড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো। শাশ্বতের মাথায় আগুন জ্বলছে। কাজের প্রতি অনীহা তার মোটেই ভালো লাগে না। এদিকে হতাশা তাকে জর্জরিত করে রেখেছে। কোনোভাবেই উত্তম বাবুর কেসের গতি হচ্ছে না। সব রাস্তা যেনো বন্ধ। কোনো কুল কিনারা পাচ্ছে না সে। এর মাঝেই মন্সুর মিয়া চায়ের ট্রে নিয়ে হাজির হয়। দরজা কড়া নাড়লেই শাশ্বতের চোখ যায় তার দিকে। খিটখিটে মেজাজে বলে,
“কি হলো, এতো দেরী হলো যে?”
“স্যার, একখানা খাম আইসে।”
খামের কথা শুনতেই বেশ নড়েচড়ে বসে শাশ্বত। হাত বাড়ায় মন্সুর মিয়ার দিকে। মন্সুর মিয়া বদলে করে আনা খামটা দেয় শাশ্বতের হাতে। ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে খামটি খুলে শাশ্বত। খাম খুলতেই কিছু পত্রিকার কাটিং বেড়িয়ে আসে৷ তার সাথে বেড়িয়ে আসে কিছু লেখা, খসরা এবং কিছু কাগজপত্র। তার সাথে তখনকার তদন্তের কিছু প্রমাণ ও ছিলো। উত্তমবাবুর কেসটি যে পুলিশ অফিসারটির আন্ডারে ছিলো তার নাম শফিকুল ইসলাম, সে এখন খুব বড় পোস্টে রয়েছে। সে জানিয়েছিলো, সে এই তদন্তে মূখ্য কোনো প্রমাণ পায় নি। কিন্তু এখানে খুব পুরোনো কিছু কাগজ, জবানবন্দি রয়েছে যা প্রমাণ হিসেবে খুব সহজে পেশ করা যেতো। শাশ্বত বেশ মনোযোগ দিয়ে কাগজগুলো সাজাতে থাকে। তারপর উত্তমবাবুর সেই ফাইলটি খুলে সামনে রাখে। ক্রমশ কপাল কুঞ্চিত হয়ে আসছে তার। ললাটের বাপাশের শিরাটা ধপধপ করে লাফাচ্ছে। উত্তম বাবু শেষ যে অপরাধীকে পাকরাও করেছিলেন সেই নামটি খুব পরিচিত লাগছে শাশ্বতের কাছে। এই নামটা কোথাও তো দেখেছেছিলো সে। শাশ্বত নিজের আলমারি থেকে একটা ফাইল বের করলো। ফাইলটি অভিনব সিংহের। কাগজগুলোর মধ্যে “কমলাপট ব্রীজ” এর কাগজগুলো বের করে শাশ্বত। “আর এ কন্সট্রাকশন” পেয়েছিলো এই ব্রীজের টেন্ডর। যার বর্তমান মালিক মাহমুদ সরদার। মাহমুদ সরদারকেই পাচারকারী চক্রের জন্য পাকরাও করেছিলেন উত্তমবাবু।
মাহমুদ সরদার বর্তমানে আঠারো মাইল থাকে। অনেকবড় মৎস ব্যাবসায়ী সে। বিঘার পর বিঘা তার মাছের ক্ষামার৷ তার খুব বড় মোটরসাইকেলের শোরুম রয়েছে, সাথে রড, বালি, সিমেন্টের আঠারো মাইলে খুব বড় দোকান রয়েছে। এই দিকের বেশ কিছু সরকারি টেন্ডন তার “আর এ কন্সট্রাকশন” পেয়ে থাকে। তার দাপট অঞ্চল জুড়ে বেশ ভালোই। শাশ্বতের মনে খটকা লাগলো। তার বাবা ঠিক কেনো মাহমুদ সরদারকে পাকরাও করেছিলেন! তার পরেই উত্তমবাবুর খুন হয়। অথচ এই কেসের দারোগা শফিকুল ইসলাম এই প্রমাণ গুলোই গায়েব করে ফেলেন। প্রশ্নের ধোয়া গাঢ় হচ্ছে শাশ্বতের মনে। তার চেয়েও গভীর প্রশ্ন এই লোকটি কে যে তাকে আড়ালে এতো ভয়ংকর সত্যের বীজ শিকড়ের সন্ধান দিচ্ছে!
লক্ষীদেবীর খুশি বাধ মানছে না। কারণ তার বংশের প্রদীপ আসতে চলেছে। উমা যখন তাকে এই সুসংবাদটি জানায় তার চোখজোড়া আকুল আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে। তিনি উমাকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরে। ফুলির মাকে তীব্র উল্লাসে বলে আজ তার বউ মার জন্য যত প্রকার পিঠে আসে সব তৈরি করবে। লক্ষী দেবীর প্রসন্ন চেহারাটি উমাকে খানিকটা আবেগপ্রবণ করে তুলে। এতো বছর পর আজ সে শাশুড়ীর মনে কড়া নাড়তে পেরেছে। এতোকাল কেবল একজন খড়কুটোর ন্যায় নির্জীব প্রাণী ছিলো সে শাশুড়ীর দৃষ্টিতে। লক্ষীরাণী রুদ্রের নিকট আবদার করে বসে যেনো তারা আজ রাত্রী এই বাড়ি থেকে যায়। প্রথমে আবদারটি রুদ্র নাকোচ করে দিলেও মায়ের আবেগঘন আবদার ফেরাতে পারে নি সে। রুদ্রের মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তার মাকে তার কাছে নয়ে রাখতে। কিন্তু পারে না, পতিভক্ত তার মা কখনোই রুদ্রকে তার পিতাকে ছেড়ে যাবে না। অবশেষে রুদ্র এই বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্তে রাজী হলো। দীপঙ্করের বিয়ে হয়েছে। তার স্ত্রী মৌমিতা এবং লক্ষী উমার দেখভালের কোনো ত্রুটি রাখছে না। রুদ্রের পুরোনো ঘরের তালা খুলে ঘরটি সুন্দর করে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। দীপঙ্করের ছোট মেয়েটি উমাকে খুব পছন্দ করে, যতবার আসে তার কোলে চেপে বসে থাকে। এবারো তাই হলো, এই উৎসবের মাঝে শুধু একজনের মুখখানা বেরাজ হয়ে রয়েছে। তা হলো দীপঙ্কর। রুদ্রের বাড়ি থেকে যাবার পর থেকে সে জ্যেঠুর নিকটতম মানুষ হবার সুযোগটি কাজে লাগিয়েছিলো। তার মনের সুপ্ত লালসা ফন তুলেছিলো বহু আগে, বাবা ছেলের অন্তঃদ্বন্দে নিজের খুটি মজবুত করার চেষ্টায় ছিলো সে। কিন্তু রুদ্রের সুসংবাদে এখন ভয় লাগছে তার যদি তাদের মধ্যের বিবাদের অন্ত হয় তবে ক্ষতিখানা তার ই হবে। আমে দুধে মিলে আটি হয়ে থেকে যাবে সে। তাই রুদ্রের সন্তান আগমনের খবরে খুশি হতে পারছে না সে। মৌমিতার আদিক্ষেতা দেখেও বেশ মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। সুযোগ বুঝে তাকে টেনে আনে নিজ কক্ষে। হিনহিনে স্বরে বলে,
“এতো খুশির তো কিছু হয় নি, এতো লাফালাফি করছো কেনো? তোমার বর দুপুরে খায় নি কিছু সেদিকে খেয়াল আছে?”
“আপনি চটছেন কেনো? আর খুশি হবো না। দিদিভাই মা হতে চলেছে। নতুন সদস্যের আগমনে মুখ গোমড়া করে রাখবো নাকি?”
“আদিক্ষেতা দেখলে গা জ্বলে যায়। এতো খুশি হবার কি আছে শুনি? একবার ভেবে দেখেছো ওই বাচ্চা আসলে আমাদের মেয়েকে কি আর নাতনীর চোখে দেখবে জ্যেঠু জ্যেঠী? তখন ওই বাচ্চাকেই বেশি মাথায় করে নাচবে। আর যদি ছেলে হয় তাহলে তো কথাই নেই।”
“কি বলছেন আপনি? যে আসেই নি তার সাথে কিসের হিংসা?”
“তুমি বুঝলে তো হতোই”
এক রাশ বিরক্তি নিয়ে স্নানঘরে চলে গেলো দীপঙ্কর। মৌমিতার মনে ঈষৎ ভয় উঁকি দিছে। স্বামীর জটিল মনোস্থিতির পরিণাম কোনো অশুভ ঘটনার সূত্রপাত না করে।
খাবারের পর লক্ষী দেবী উমার রুমে আসেন। ধীর স্বরে বলেন,
“আসবো?”
উমা তখন অবহেলিত ঘরটিকে নির্লিপ্ত চিত্তে বিচরণ করছিলো। লক্ষী দেবীকে দেখে স্মিত হেসে বললো,
“ছেলের ঘরে আসবেন, অনুমতি নেবার কি আছে মা!”
লক্ষী দেবী ঘরে প্রবেশ করতে করতে বললেন,
“ভেবেছি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছো”
“না না, ঘুম আসছে না। বিছানা বদল হবার খারাপ দিক। আর দুপুরে ঘুমাই না। তাই ঘুরে দেখছিলাম ঘরটা।”
লক্ষী দেবী বিছানাতে বসলেন। তার হাতে বেশ কিছু কাপড়। তিনি বসতে বসতে বললেন,
“এই কাপড়গুলো রুদ্রের। কাথা, টুপি, সোয়েটার। এই কাথাটা ওর শরীরে প্রথম জড়ানো হয়েছিলো। এইন্যে টুপিটা দেখছো আমি নিজ হাতে বুনেছিলাম। প্রচুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পুরোনো অনেক। কিন্তু মূল্যবান এই স্মৃতি। খুব যত্নে আগলে রেখেছিলাম। আমার নাতী এই পৃথিবীতে আসলে তুমি তাকে প্রথম এই কাপড়গুলো পড়াবে। তাই তোমাকে দিতে এসেছি।”
নাতী শব্দটি শুনতেই খানিকটা নড়ে উঠলো উমা। অবাক কন্ঠে বললো,
“সে তো নাতনীও হতে পারে মা। নাতী ই যে হবে এমনটা তো নিশ্চিত নয়।”
উমার কথা শুনে চোখ কুচকে আসে লক্ষীর। সে কথাটি শুনে প্রসন্ন হয় নি তা বুঝতে বাকি রইলো না উমার। খানিকটা বিরক্তিভরা কন্ঠে বললো,
“এ বাড়ির প্রথম সন্তান সর্বদা ছেলেই হয়েছে। এবার তার ব্যাতিক্রম হবে কেনো?”
“এতো আমাদের হাতে নেই। আর আমাদের প্রার্থনা করা উচিত ছেলে কিংবা মেয়ে যাই হোক, সে যেনো সুস্থ হয়।”
“তর্ক করো না তো, কাপড় গুলো সামলে রাখো”
মনোক্ষুণ্ণ হলো উমা। প্রগতিশীল দেশে আজ ও কন্যা আর পুত্রের মাঝে এতোটা তফাত। উমা মন থেকে চায় তার যেনো একটা কন্যাসন্তান হয়। কিন্তু শ্বাশুড়ির এরুপ প্রতিক্রিয়ায় সে আহত হয়। লক্ষী দেবী চলে গেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উমা। কন্যা হয়েও লক্ষী দেবীর মনে কন্যার অভিলাষা নেই। ভাবতেও বিরক্ত লাগছে উমার। মানুষের মনোভাবের এরুপ বিরুপ অবস্থা দেখে হতাশায় বুক ভরাক্রান্ত হয়ে উঠে তার।
বিকেল ৪.৩০,
অভিনব সিংহের পাশে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। বাবা ছেলে পাশাপাশি দাঁড়ানোর পর ও তাদের মাঝে যেনো কথা বলার কিছুই নেই। অভিনব সিংহ শাল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ঠান্ডা বেড়েছে এই প্রান্তে। বয়সটাও বেড়েছে, সেকারণেই হয়তো এখন তার ঠান্ডা সহ্য হয় না এখন। রুদ্র প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি সামনের বিলানটির দিকে। গ্রাম ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ শহরে কর্মের জন্য ছুটছে। নিস্তব্ধতা চিরে রুদ্রই কথার সূচনা করলো। নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“শুনলাম, এবার নাকি মেয়রের পদে দাঁড়াচ্ছেন, কখনো ভাবি নি আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবো”
“আমার বিরুদ্ধে তো এই প্রথম দাঁড়াও নি তুমি”
“আমি তো শুধু মুক্তি চেয়েছি, আপনি আমাকে জোর করে নিজের মুঠোতে রেখেছেন।”
“আমি তোমার বাবা, তোমার ভালো চাই।”
অভিনব সিংহের কথায় বিদ্রুপের হাসি হাসে রুদ্র। তার হাসির ঝংকার অভিনব সিংহের মুখোভাব বদলে দেয়। রুদ্র তখন ধীর স্বরে বলে,
“কোন বাবা নিজের ছেলের প্রগতিতে অখুশি হয় বলুন তো? কোন বাবা শুধু নিজের ছেলেকে নিজের মুঠোয় রাখার জন্য তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে?”
রুদ্রের প্রশ্নে থমকে যায় অভিনব সিংহ। পরমূহুর্তে……..
চলবে
[