#এক্সিডেন্টলি_প্রেম♥
#পার্ট-২৯♥
#Ayanaa_Jahan(Nusraat)♥
সিটি হসপিটালের ১০৩ নং কেবিনে ভীড় জমিয়েছে ডক্টর-নার্স সাথে নিশান্ত এবং সানি-রিভান। মূলত বেডে নিথর হয়ে শুয়ে থাকা অন্বিতাকেই কেন্দ্র করে ঘুরেফিরে চলছে সকলের দৃষ্টি। প্রত্যেকের মুখেই চরম হতাশার ছাপ। নিশান্তের হৃদপিন্ডের ডিবডিবে আওয়াজ তার টেনশনের মূখ্য প্রতীক। অন্বিতার এভাবে অচেতন হয়ে পড়ে থাকায় বুকটা ভীষণ খা খা করছে তার। বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যাথানুভূতি হয়ে চলেছে অন্বিতার শুকনো মুখখানি নজরে পড়তেই।
অন্বিতা যখন সেন্সলেস হয়ে রাস্তায় পড়ে রয়েছিলো এমন সময় বাইকে তেল উঠিয়ে ফিরছিলো নিশান্ত। নিজের থেকে কয়েক হাত দূরে হঠাৎ চোখ পড়তেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে তার। বাইক ফেলে হন্তদন্ত হয়ে অন্বিতার নিকটে পৌঁছে সে। তার মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বার কয়েক গালে হাল্কাভাবে থাপ্পড় মেরে কম্পিত গলায় বলে,
—– অ..অন্বিতা কি হয়েছে আপনার? উঠুন! অ..অন্বিতা….উঠুন প্লিজ!
এভাবে বহুবার ডাকার পরও হুশ ফেরেনা অন্বিতার। ততক্ষণে সানি-রিভানও অন্বিতাকে স্টল থেকে বের হতে দেখে ছুটে বেরিয়ে আসে। নিশান্তের কোলে মাথা রেখে অন্বিতাকে রাস্তার ধারে পড়ে থাকতে দেখে চমকে ওঠে দুজনেই। তাড়াহুড়ো করে তাদের নিকটে পৌঁছে সানি বলে,
—– ওহ শিট! ভাবি সেন্সলেস হলো কী করে? আর মামা তুই এখানে কখন এলি?
রিভান ধমকে উঠে সাথেসাথেই বলে,
—– শাট আপ সানি, এখন এসব কথার টাইম নয়, ট্যাক্সি দাঁড় করা ফাস্ট! অন্বিতাকে হসপিটালে নিতে হবে।
সানি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে চটজলদি ট্যাক্সি দাঁড় করাতে ছুট লাগায়। নিশান্ত অন্বিতাকে চোখের পলকে কোলে উঠিয়ে যতো দ্রুত সম্ভব সানির দাঁড় করানো ট্যাক্সিতে উঠে পড়ে। ড্রাইভারের পাশের সিটে চটজলদি উঠে পড়ে সানি-রিভানও। নিশান্ত অন্বিতাকে বুকে আগলে ধরে রাখে খুবই সযত্নে। অস্ফুটস্বরে অন্বিতার নাম আওড়ে চলে ক্রমাগত। তার অস্থিরতাতেই অন্বিতার প্রতি ভালোবাসাটা কতোটা স্পষ্ট দেখে মুচকি হাসে রিভান। ড্রাইভারকে “সিটি হসপিটাল” নিয়ে যেতে বলতেই তার কথানুযায়ী ড্রাইভার রওনা হয় সেই পথেই।
বর্তমানে নিশান্ত মাথা নিচু করে অন্বিতার ডান হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে নিঃশব্দে৷ অন্বিতার হাতে সেলাইন চলছে! ডক্টরের কথামতো গত একমাস যাবৎ অন্বিতা না ঠিকমতো ঘুমিয়েছে আর না ঠিকমতো খেয়েছে। তারওপর একনাগাড়ে ঘন্টাখানিক বৃষ্টিতে ভেজার ফলে মারাত্মক জ্বর বাঁধিয়ে ফেলেছে সে। শরীরে বিন্দুমাত্রও শক্তি অবশিষ্ট নেই তার। যার দরুন এই রৌদ্রময় বেলায় দূর্বল শরীর নিয়েই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে সে।
নিশান্ত ভাবছে শুধুমাত্র তার জন্যেই অন্বিতার আজ এই অবস্থা হয়েছে। তার অসুস্থতার মূখ্য কারণ নিশান্ত নিজেই! তবে রিভান নিশান্তের এই ভাবনার প্রতি সমর্থন না জানালেও সানি একটু আগ বাড়িয়েই বলে চলেছে সেই তখন থেকেই। তার দৃঢ় মতামত নিশান্ত ইচ্ছাকৃতভাবে অন্বিতাকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলেছে। সে চাইলেই পারতো তাকে স্বচ্ছলতা দিতে, বুক ভরা বেদনার বদলে খিলখিল করে হাসতে দিতে অথচ সে তা করেনি। অন্বিতাকে অন্ধকারে ফেলে দূর্বলতা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ! সানির এইরকম লাগামহীন অভিযোগের ছড়াছড়িতে ক্ষুণ্ণ মনটা ক্রমান্বয়ে দূর্বিষহ হয়ে পড়েছে নিশান্তের। নিজের প্রতি অসম্ভব বিরক্ত লাগছে তার। মাঝেমাঝে ইচ্ছে হচ্ছে নিজেকে শতশত ছুড়ির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলতে, পরক্ষণেই অন্বিতার শুকনো মুখটা ভেসে আসছে দু-চোখের কোঠায়। নাহ তাকে নিজের কোনো ক্ষতি হতে দেওয়া চলবে না, তাকে শক্ত থাকতে হবে, আর কারো জন্যে না হোক অন্তত এই মেয়েটার জন্যে হলেও তাকে সুস্থ থাকতে হবেই!
ক্লান্ত দুপুরের মাঝে আবারও ডক্টর কবির এলেন কেবিনে। তাকে দেখেই আগ্রহী চোখে তাকালো প্রত্যেকেই। উনি নিশান্তের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। সেই যে দেড় ঘন্টা পূর্বে অন্বিতার হাত নিজের দুহাতের মাঝে আগলে রেখেছে ছেলেটা, এখন পর্যন্ত সেই অবস্থার নড়চড় না হওয়ায় অবাক হতে বাধ্য হলেন। ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন,
—– অনেক ভালোবাসেন বুঝি উনাকে?
নিশান্ত টলমলে চোখে তাকালো। প্রশ্নটার বিপরীতে কি উত্তর দেওয়া উচিত জানা নেই তার। সে চাইছে “না” শব্দটা উচ্চারণ করতে কিন্তু হৃদয়ের গহীন থেকে কোনো না কোনোভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে চলেছে তার ভোকাল কর্ড! যার দরুন ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দীর্ঘশ্বাস ফেলেই চুপ করে রইলো সে। “নীরবতাই সম্মতির পরিচায়ক!” ভেবে নিয়েই মুচকি হাসলেন ড. কবির। অন্বিতার হাত থেকে সেলাইনের নলটা খুলে নিয়ে বললেন,
—– আপনারা চিন্তা করবেন না। উনাকে একেবারে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। ঘুমটা বড্ড প্রয়োজন ছিল উনার। যদিও কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে, তবু বলছি একটা দিন উনাকে বাড়িতে না নিয়ে গিয়ে কেবিনেই রাখুন। উনার প্রোপার ট্রিটমেন্টের জন্য রেস্ট নেওয়াটা ভীষণ প্রয়োজন।
—– ওকে ডক্টর! থ্যাংক ইউ সো মাচ!
—– ইটস মাই প্লেজার!
ডক্টরের সাথে কুশল বিনিময় হলে নিশান্তের পাশ এসে দাঁড়ালো রিভান। কাঁধে হাত রেখে ক্ষীণ গলায় বললো,
—– অন্বিতার বাসায় জানিয়ে দিয়েছি, উনারা আসছেন।
নিশান্ত মৃদু হাসলো। নিজের লাল রঙা রক্তিম চোখদুটো লুকিয়ে বলল,
—– তোরা বাড়ি যা। তোদের না বাজারে কাজ ছিলো? যা তবে, আমি আছি অন্বিতার সাথে।
সানি হয়তো বিপরীতে কোনো দ্বিমত পোষণ করতে চেয়েছিল তবে তাকে কথা পাড়ার আগেই হাত খামচে থামিয়ে দিয়ে রিভান বলল,
—– আচ্ছা থাক তুই আমরা গেলাম। ফোনে আপডেট জানাস কিন্তু!
নিশান্ত মুচকি হেসে সম্মতি জানালো। সানি-রিভান বেরিয়ে যেতেই অন্বিতার শুকনো মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালো। অন্বিতার হাত নিজের হাতের মুঠোয় রেখেই ধরা গলায় বলল,
—– আমায় ক্ষমা করবেন মিস অন্বিতা! যে যাই বলুক না কেনো, আজ যা কিছু হলো তাতে যে আমার হাতই যে ষোল আনা তা নিশ্চিত আমি। হ্যাঁ এটা ঠিক আমি হয়তো আপনাকে ফিরিয়ে দিয়েছি তবে বিশ্বাস করুন, আপনার ক্ষতি হোক তা কোনোকালেও চাইনি আমি। আমি চাই আপনি ভালো থাকুন, আমার নামটা নিজের মন থেকে মুছেই হাসুন! আমি যে নিরুপায় অন্বিতা। আপনাকে চেয়েও আপন করতে পারবো না যে আমি!
এরকম আরো হাজারও হৃদয়ভার বুলি আওড়ে চললো নিশান্ত। একটা সময় গিয়ে অন্বিতার কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজের সৃষ্টি হলো। হাতের অবস্থানের সামান্য বিচ্যুতি অনুভব করতেই তৎক্ষণাৎ হাত ছেড়ে দিয়ে উদ্বিগ্ন চোখে তাকালো নিশান্ত। অন্বিতা নিজের ঝিম ধরা মাথাটায় বা হাত চেপে পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাবার চেষ্টা চালালো। ঘোলাটে অবয়ব বদলে নিশান্তের ফর্সা মুখে রক্তলাল বর্ণের বিচরণ দৃষ্টিগোচর হতেই চটজলদি উঠে বসতে নিলো। তবে সটান হয়ে বসবার পূর্বেই তার বাহু চেপে ধরে থামিয়ে দিলো নিশান্ত। মাথার নিচে থাকা বালিশটা বেডের সাথে হেলান দিয়ে রেখে বললো,
—– উত্তেজিত হবেন না মিস অন্বিতা। ধীরেসুস্থে বসুন। আপনি এখনোও পুরোপুরি সুস্থ নন।
অন্বিতা চোখ নামিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে কোনোরকমে বসলো। অক্ষিগোলক ঘুরিয়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে নিতেই ভ্রু কুঁচকালো। এতো কোনো নার্সিংহোমের মতো লাগছে! কিন্তু সে তো সমিতি থেকে বাড়ি ফিরছিলো তবে এখানে এলো কী করে? আর নিশান্ত! সেই বা কী করছে তার পাশে?
অন্বিতার মস্তিষ্কে ঘূর্ণায়মান প্রশ্নের ঝড় থামাবার উদ্দেশ্যে নিশান্ত হাল্কা স্বরে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো। কপালে বা হাতের দুটো আঙুল ঠেকিয়ে স্লাইড করতে করতে বললো,
—– ব্রেইনে চাপ দিবেন না অন্বিতা। আপনি আজ রাস্তায় সেন্সলেস হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। তারপরের ঘটনা আপনার না জানলেও চলবে!
অন্বিতা একরাশ বিস্ময় ভরা চোখে তাকালো। মানা করার সত্ত্বেও নিজের ঝিম ধরা মাথায় চাপ প্রয়োগ করে পূর্বের স্মৃতি আওড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সমিতি থেকে ফেরার সময় স্টলে সানি-রিভানের কথোপকথনের ভয়াবহ দৃশ্যটা মেমোরাইজ হতেই বুকটা ধক করে উঠলো তার। নিশান্তের থেকে ছিটকে দু-হাত সরে গিয়ে বেডের সাইড চেপে বসলো সে। নিশান্ত অন্বিতার কর্মকান্ডে চমকে ফিরে তাকালো। চিন্তিত চোখে চেয়ে হাত বাড়িয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,
—– আরে আরে একি করছেন পড়ে যাবেন তো!
অন্বিতা মুখ ফেরালো না। নিজের ধরা গলা বদলে কঠিনতম রূপে এনে বললো,
—– আমি ঠিক আছি মি. নিশান্ত। আমায় নিয়ে আপনার না ভাবলেও চলবে।
নিশান্ত আহত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। অন্বিতার কথাটা বিন্দুমাত্রও পছন্দ হলো না তার। বুকের ভেতরের চিনচিনে ব্যাথাটা যেনো আরো তীব্রতর হয়ে উঠলো। ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় নিয়ে বিপরীতে কিছু বলবে তার আগেই কেবিনে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে পড়লো আমজাদ হোসেন, আনন্দ সাথে নূহা এবং আফসানা বেগম। মেয়ের অসুস্থতায় চুপসে যাওয়া মুখটা দেখেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো আমজাদ হোসেনের। এক ছুটে গিয়ে অন্বিতাকে ঘিরে ধরলেন প্রত্যেকে। সকলের মুখেই শতশত প্রশ্নের ছড়াছড়ি। কী হলো, কেনো হলো, কখন হলো, কিভাবে হলো এতোসব প্রশ্নের বেড়াজালে ভড়কে গেলো অন্বিতা। নিস্তেজ শরীরটার সাথে ব্রেইনটাও যেনো নেতিয়ে পড়ছে তার। পরিস্থিতি অন্বিতার স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর বুঝে চটজলদি হাত উঠিয়ে সবাইকে শান্ত হতে বললো নিশান্ত। নূহা-আনন্দকে নিজের কাছে টেনে এনে বললো,
—– আম্মু-আব্বু-আংকেল শান্ত হন সবাই। অন্বিতার রেস্টের প্রয়োজন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর আমি দিচ্ছি। ওকে আপাতত একটু বিশ্রাম নিতে দিন।
নিশান্তের কথার পরিপ্রেক্ষিতে এক নিমিষেই চুপ করে গেলো সবাই। ডক্টরের বর্ণনামতে অন্বিতার অসুস্থতার বিবরণ শুনে আশাহত হলেন সবাই। আনন্দ ঠোঁট উল্টালো বোনের দিকে ঝাপসা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
—– আপু সবসময় পরে করবো, পরে ঘুমাবো, পরে খাবো বলেই দিন পাড় করতো। আমরা তেমন গুরুত্ব না দেওয়ার জন্যেই এমন হলো তাইনা আব্বু?
আমজাদ হোসেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনন্দর মাথায় হাত বুলালেন। মেয়ের পাশে বসে চিন্তিত গলায় ধীর কন্ঠে বললেন,
—– আমি তোমার কাছে আপাতত কোনোকিছুর কৈফিয়ত চাইবো না মা। বাসায় ফেরো তারপর ধীরেসুস্থে এসব কথা তোলা যাবে।
বাবার বিপরীতে অন্বিতাও কিছু বললো, তা হয়তো নিশান্তের কান অবধি স্পষ্টভাবে পৌঁছালোনা। সবার থেকে বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে উল্টো দিকে মুখ ফেরালো সে। আজ নিজেকে বড্ড বেশি অপরাধী বলে মনে হচ্ছে তার। পৃথিবীর নিকৃষ্টতম পাপীদের মাঝে একজন নিজেকে বলে মনে হচ্ছে! সে কি পারতো না অন্বিতাকে সুখে রাখতে। তার হাতটা শক্ত করে ধরে নরম গলায় বলতে, “ভয় পাবেন না মিস অন্বিতা, নিশান্ত শুধুই আপনার!” উত্তর অজানা নয় তার। তবু মানতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ! ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়টা বোধহয় কেউ ছুড়ির আঘাতে আঘাতে ক্রমাগত রক্তাক্ত করে চলেছে তার। ভালোবাসার অনুভূতিগুলো বুঝি এতোটাই তীব্র! এতোটাই যন্ত্রণাদায়ক!
______________________________
অন্বিতারা বাসায় ফিরেছে রাত ১০ টা নাগাদ। ডক্টর নার্সের করা অনুরোধের তোয়াক্কা না করে এক প্রকার জেদের বসেই বাসায় ফিরেছে সে। বাবা-ভাই, সাথে আফসানা বেগমের পুরো পরিবার বাঁধা দিয়েছিল তাকে তবু থামে নি অন্বিতা। তার একটাই কথা, “হসপিটাল যেমন অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তুলবার প্রাণকেন্দ্র তেমনই সুস্থ মানুষকে চুটকি বাজিয়ে অসুস্থ বানিয়ে ফেলতেও হসপিটালের কোনো জুড়ি নেই!” একজন সুস্থ মানুষ সামান্য কোনো সমস্যার দরুন হসপিটালে গেলে নিজেকে রোগী ভাবতে শুরু। তার মানসিকতা শরীরের ওপরও এফেক্ট করে তীব্রভাবে। আফটার অল ব্রেইন মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রতঙ্গের নিয়ন্ত্রক! ব্রেইন যদি নিজে থেকে বলে “আমি অসুস্থ!” তবে শরীরটা অটোম্যাটিকালি ভার ছেড়ে দেয়। শক্তপোক্ত শরীরটাও এক মুহুর্তের জন্য বড্ড দূর্বল মনে হয় নিজের কাছেই। অথচ সে দূর্বল নয়। নিজের এমন উদ্ভট ভাবনা-চিন্তার বেড়াজালে পিষ্ট ভিক্টিম মাত্র।
অন্বিতার এরকম বাস্তববাদী যুক্তির বিপরীতে সকলের যুক্তিই ফিকে হয়ে পড়েছিলো। তার জেদ সকলের ঊর্ধ্বে পৌঁছায় মুখ কালো করেই ফিরতে হলো প্রত্যেককে। আর তাছাড়া অন্বিতা তো অসুস্থ নয়! সামান্য একটু জ্বর আর উইকনেসের দরুন হসপিটালের বেডে পরে থাকার মতো গুরুতর কিছু হয়নি তো তার। তবে এতো দেখভাল কেনো? সে কি নিজের যত্ন নিজে থেকে নিতে পারবে না? আলবাত পারবে!
অন্বিতা কপালের ওপর বা হাত রেখে চুপটি করে শুয়ে নানান সব ভাবনায় মেতে উঠেছিল। এমন সময় তীব্র আর্তনাদে যেনো বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো তার মুঠোফোন। অন্বিতার কপালে বিরক্তির ভাঁজ প্রকট হলো। ভুলভাল সময়ে কল আসার বহুকালের রেকর্ড তার। যার দরুন ততোটা অবাক হলো না। কোনোরকমে চোখ না খুলেই ফোনটা হাতিয়ে রিসিভ করে কানের ওপর রাখলো সে। কল রিসিভ হওয়ায় চটজলদি ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় প্রশ্ন ছুড়ল কেউ,
—— আসসালামু আলাইকুম, এখন কেমন আছো অন্বিতা?
নম্বর অপরিচিত হলেও কন্ঠের মালিক কে তা বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না অন্বিতার। মৃদু হেসে প্রতি উত্তরে সে বলল,
—– ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাইয়া, আল্লাহর রহমতে এখন আগের তুলনায় সুস্থ আছি। তা আমার নম্বর পেলেন কোথায় থেকে?
রিভান সামান্য হলেও দুশ্চিন্তা মুক্ত হলো। মুচকি হেসে বলল,
—– ভার্চ্যুয়াল লাইফে কারো ফোন নম্বর ম্যানেজ করা ততোটা কঠিন না হলেও তোমার ভাইয়ের পেট থেকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়েই বের করেছিলাম অবশ্য!
অন্বিতা ঠোঁট বাঁকালো। নিজের খোপা করে রাখা চুলগুলোর মাঝে হাত চালিয়ে বলল,
—– বাহ দারুন বুদ্ধি তো! এই জন্যের কিন্তু ছোট ভাই-বোন থাকা বিপদজনক! এক কথায় মারাত্মক বিপদজনক। তা রিভান ভাইয়ার কী এমন বিশেষ কাজ পড়লো যার জন্য কল করতে হলো এই অন্বিতাকে?
অন্বিতার প্রতিউত্তরে নড়েচড়ে গলাটা ক্ষীণস্বরে খাঁকারি দিয়ে উঠলো রিভান। চোখে মুখে সিরিয়াসনেস ফুটিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
—– অন্বিতা, নিউজটা হয়তো এখনি পর্যন্ত তোমার কানে যায়নি। তবে আমি মনে করি নিউজটা শুনে তোমার খুব একটা ভালো লাগবে না।
অন্বিতা ভ্রু কুঁচকালো, ওপাশ থেকে রিভানের দীর্ঘশ্বাসের গাম্ভীর্যপুর্ণ শব্দ শ্রবণগোচর হবার পর আবারও রিভান বলল,
—– নিশান্ত দেশ ছেড়ে কানাডা চলে যাচ্ছে অন্বিতা।
রিভানের বলা এই একটা ছোট্ট বাক্যই যথেষ্ট ছিলো অন্বিতার হৃদয়ে হাতুড়ি পেটাবার জন্য। শতশত অভিমানের পাহাড় ধ্বসে পড়ে কপালে তীব্রতর ভাঁজ ফুটে উঠলো তার। অস্ফুটস্বরে কাঁপাকাঁপা গলায় সে বলল,
—– মা…মানে? নিশান্ত দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন মানেটা কী?
রিভান চোখদুটো বুজে নিলো। বুক চিরে তীক্ষ্ণ শ্বাস নিসৃত করে আহত কন্ঠে বলল,
—– বুয়েট থেকে টপ রেজাল্ট পেয়ে বের হবার পর একটা স্টুডেন্টের কাছে প্রায় অনেক দেশ থেকেই অফার আসে, ব্যাপারটা তোমার অজানা নয়। তাছাড়া নিশান্তের মতো একজন ব্রিলিয়ান্ট আইকনকে যে কোনো দেশ এক চান্সে নিজেদের কাছে টানতে চাইবে। বাট ফ্যাক্ট সেটা নয় অন্বিতা, নিশান্ত যদি পিএইচডি করবার জন্য ফরেইন যেতো তবে তাতে কোনোকালেই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতাম না আমরা। প্রত্যেকেরই একটা এইম থাকে। আমাদেরও আছে, কে না চায় ফরেইন গিয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে? কিন্তু নিশান্ত জাস্ট ফর দিস যাচ্ছে না বাহিরে। ওর ইনটেশনটা আলাদা!
—– তাহলে কেনো যাচ্ছেন উনি?
—– শুধুমাত্র তোমার জন্য অন্বিতা। তোমার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতেই লেজ গুটিয়ে পালাতে চাইছে সে। নিশান্ত তোমায় রিজেক্ট করেছে বাট ও চায়না তোমার ক্ষতি হোক। তুমি যেনো ওকে ভুলে যেতে পারো তার জন্য চলে যাচ্ছে নিশান্ত! সব এখন তোমার হাতে অন্বিতা। তুমি আটকাও ওকে প্লিজ! বড় ভাইয়ের এইটুকুনি রিকুয়েষ্ট রেখো অন্বিতা!
রিভানের কথায় পাথরের মূর্তির ন্যায় কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো অন্বিতা। নির্বাক ভঙ্গিতে ফাঁকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রইলো স্রেফ! অন্বিতাকে চুপ থাকতে দেখে কপাল কুঁচকালো রিভান। ব্যস্তগলায় কয়েকবার “হ্যালো অন্বিতা? শুনতে পাচ্ছো?” বাক্যটা আওড়াতেই একটা সময় থেমে গেল সে। এপাশ থেকে ভারী গলায় বেশকিছুক্ষণ পর অন্বিতা বলল,
—– চিন্তা করবেন না ভাইয়া, আমি এমন ব্যবস্থা করবো তাতে উনাকে আর মায়ের কোল খালি করে দেশ ছেড়ে যেতে হবে না। রাখছি, আল্লাহ হাফেজ!
রিভানকে প্রতিউত্তরে কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনের লাইন কেটে থম মেরে বসে রইলো অন্বিতা। ভেতর থেকে তার হৃদপিন্ডটা জমে পাথর হয়ে পড়ে রইলো সামান্য আশ্বাসের অভাবে। কান্নাটাও ঠিক ধরা দিলোনা চোখে। কেমন রিয়াকশন দেওয়া উচিত তার? সে কী হাসবে নাকি কাঁদবে? নাকি রাগে-দুঃখে ভাঙচুর করবে? কোনটা? উত্তর জানা নেই অন্বিতার। নিজেকে বর্তমানে একটা অনুভূতি শুণ্য মূর্তির মতোই লাগছে তার।
খানিকবাদেই দরজাটা সামান্য আওয়াজে খুলে গেলো। বাহির থেলে মাথা ঢুকিয়ে মেয়েকে শুয়ে থাকার বদলে বসে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকালেন আমজাদ হোসেন। এতোক্ষণে যেখানে অন্বিতার ঘুমিয়ে পড়া উচিত ছিলো সেখানে এভাবে থম মেরে বসে থাকাটা মোটেই পছন্দ হলো না তার। ধীরপায়ে অন্বিতার বিছানার নিকটে এগোলেন তিনি। মেয়ের পাশে বসে তার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
—– এখনোও ঘুমোয়নি কেনো আমার “মা” টা?
আমজাদ হোসেনের প্রতিউত্তরে আশাজনক কোনো বাক্য পরিস্ফুটিত হলো না অন্বিতার মুখ থেকে। পাথরের ন্যায় বসে থেকেই বাবার মুখপানে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অন্বিতা বলল,
—– পাত্রপক্ষ এবার আমায় দেখতে চাইলে আর মানা করো না আব্বু, তোমার মেয়ে এবার সত্যিই বিয়ে করতে চায়!
#চলবে______________