#ও আমায় ভালোবাসেনি
১১.
রাত বারোটায় আমরা রংপুর পৌঁছাই ।
দশ ঘন্টা জার্নির ফলে শরীরের অবস্থা নাস্তানাবুদ ।
সিমি তো পুরো রাস্তাই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এসেছে ।
তিনজনেরই কোমরে ব্যাথা হয়ে গেছে । রাইদ ভাই তো ড্রাইভ করছিলেন , বেচারার কষ্ট হয়েছে আরো বেশী ।
বাড়িতে কয়েক পক্ষ আত্মীয় এসে গেছেন ।
আমার ভাইয়াও আজই এসেছেন রাজশাহী থেকে তবে বাবা-মা আসেননি ।
গাড়ি থেকে নেমে আমার চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু করছিলো ।
কোনো রকমে ভাইয়ার বুকে আঁচড়ে পড়ে বলেছিলাম আমার ঘুম পায় ভাইয়া রুমে নিয়ে চলো ।
ভাইয়া হেসে আমাকে আর সিমিকে রুম দেখিয়ে দিলো আর লাগেজ গুলোও এনে দিলো ।
রাস্তায় ধুলোবালি সারা গায়ে মেখে অবস্থা খারাপ করে দিয়েছিলো ।
ডাস্টে আ্যালার্জি সিমির তাই সে আগে শাওয়ার নিতে গেছে এবং আমাকেও ঠেলে ফ্রেশ হতে পাঠিয়েছে ।
শাওয়ার নিয়ে সত্যিই খুব আরাম লাগছিলো ।
আমি কোনোদিকে খেয়াল না করে একদম বিছানায় গড়িয়ে পড়েছিলাম ।
এক ঘুমে সকাল আটটা ।
বাইরে অনেক মানুষের শোরগোল আর পেঁয়াজ মরিচের ঝাঁঝালো গন্ধে আমার ঘুম ভেঙে যায় ।
আমি উঠে সিমিকেও টেনে তুলি ।
তারপর দুটি তে মিলে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হই ।
সিমি ক্যামেরা এনেছিল গ্রামাঞ্চলের ছবি তুলবে বলে ।
ওর ঢাকাতেই জন্ম এবং ওরা ঢাকারই স্থানীয় তাই গ্রাম ব্যাপারটা সম্পর্কে সে অনভিজ্ঞ ছিলো ।
ফুপিদের গেরস্ত বাড়ি দেখে তার খুশির সীমা ছিলো না ।
ফুপির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যৌথ ফ্যামিলির মতো থাকতেন , বিশাল জায়গা জুড়ে এক তলা বাড়িটা ।
ওনারা অনেক স্বনামধন্য মানুষ , অনেক মান্যিগন্যি তাদের ।
ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের সাইডটায় আসার পর দেখা যায় প্রকান্ড বারান্দায় নানাবয়সী মহিলারা পেঁয়াজ মরিচ , সবজি কাটাকুটি করছেন ।
তাদের গল্পেরও শেষ নেই ।
বাইরে উঁকি মারতেই দেখা গেলো বাগানের সাইডটায় রাইদ ভাই কিছু লোককে রান্নাবান্নার ডিরেকশন দিচ্ছেন , ফুপ্পিও পাশেই মাটির চুলো বানানো দেখিয়ে দিচ্ছে ।
রাইদ ভাই ধূসর একটা পাঞ্জাবি পরেছেন , গলার কাছে এমব্রয়ডারি করা । ইশশ কি সুন্দর লাগছে মানুষটাকে , ট্রিম করা দাড়িতে নায়ক নায়ক ভাব আসছে ।
আমরাও বাগানের সাইডটাতে আসলাম , হাতের ডান সাইডে খুব সুন্দর সাজানো একটা রুম , সেখানে থেকে মধুর কুরআন তিলাওয়াত ভেসে আসছে ।
আমরা উৎসাহিত হয়ে ওখানে গিয়ে দেখি অনেকগুলি বোরখা পরা মেয়ে বসে কুরআন পড়ছেন ।
দেখে খুব ভালো লাগলো , আমিও কুরআন শরীফ পড়তে জানি । সিমিকে জিজ্ঞেস করলাম_ কি কুরআন পড়বি?
সিমি বললো_ পড়া যায় , ভালো হবে । চল গোসল করে আসি?
আমরা এবারে গোসল করে এসে ফুপ্পিকে বললাম জায়নামাজ আর কুরআন শরীফ এনে দিতে ।
ফুপ্পি তো প্রচন্ড খুশি , ভাইয়া শুনেও প্রশংসা করলেন অনেক , তার নাকি প্রাউড ফিল হচ্ছে আমাকে বোন হিসেবে পেয়ে ।
ভাইয়ার কথা শুনে আমি খুব লজ্জা পেলাম । কিন্তু আমি সবকিছুর উর্ধ্বে একজনার কমেন্টস আশা করছিলাম , চোরা চোখে একবার তার দিকে তাকিয়েওছিলাম । তার দৃষ্টি অন্যরকম , সে খুব সারপ্রাইজড হয়েছে এবং খুশিও । উচ্ছলতা তার চোখে মুখে উঁকি দিচ্ছিলো ।
আমারও খুব ভালো লাগছিল , মানুষটাকে তো আমি খুশিই দেখতে চাই! তার খুশির জন্য সবকিছু..
,
আমাদের কুরআন শরীফ পড়তে পড়তে দুপুর একটা বেজে গেলো , জোহরের নামাজের পর মিলাদ হলো , মসজিদ থেকে ফেরবার পর আরো তিনজন নতুন অতিথি আসতে দেখা গেলো ।
একটা মার্সিডিজে করে তারা এসেছিলেন , তাদেরকে দেখে রাইদ ভাই প্রচন্ড খুশি হয়েছিলেন । বুঝতে পেরেছিলাম এনারাই তার সেই বিশ্বস্ত বন্ধুগুলি যাদের ছাড়া সে অচল ।
ভাইয়া তিনজনের চোখেমুখে আভিজাত্যের ছোঁয়া এবং ওনারা বেশ মিশুক ছিলেন ।
,
আমি আর সিমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওনাদের সাক্ষাৎ দেখছিলাম তখন আমাদের প্রথমে ওনারাই দেখেন ।
একজন ভাইয়া আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলেন_ মিথি রাইট? ওহ্ মাই আল্লাহ্ ইয়ূ আর রিয়্যালি ভেরি প্রিটি ।
এ্যাই ফয়সাল , শব্দ দেখে যা আসল মানুষ তো এখানেই ।
ওনার এরকম কথা শুনে আমি যারপরনাই লজ্জা পেয়ে গেছিলাম ।
রাইদ ভাই এগিয়ে এসে ওনাদের সাথে আমাকে আর সিমিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ।
যিনি সবার আগে আমাদের দিকে এসেছিলেন উনি রামিম ইশতিয়াক ভাই , পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার ।
একজন সরফরাজ আহমেদ শব্দ , সেনাবাহিনীতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আর আরেকজন ফয়সাল মাহমুদ বিশিষ্ট শিল্পপতির একমাত্র ছেলে যার ইচ্ছে গায়ক হওয়া কিন্তু আপাতত বাবার ব্যবসায় হাত লাগিয়েছেন ।
সবার সাথে পরিচিত হবার পর ওনাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়া হলো ।
তানভীর ভাইয়ার সাথে বেশ সখ্যতা ওদের ।
ওনারা যতই রিচ হোক না কেনো মন মানসিকতা মোটেই ডাল ছিলো না ।
খুব সুন্দর রাইদ ভাইয়ের সাথে হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিচ্ছিলেন ।
অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের , মিসকিনদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল মূলত ।
সব দিকটা খুব সুন্দরভাবে সামলেছেন ভাইয়ারা ।
আত্মীয় স্বজনের খেয়াল রাখার জন্য তো আমরা ছিলামই ।
আম্মুও আমাদের সাথে ছিলেন কিন্তু আম্মু একটাবারেও আমার দিকে ফিরে তাকায় নি ।
খুব ইচ্ছে করছিল আমার আম্মুকে একবার জড়িয়ে ধরতে ।
মোটামোটি আত্মীয় স্বজনরা বিদায় নেবার পর একবার সুযোগ এসেছিলো , আমি সুযোগটা কাজেও লাগিয়েছিলাম । বাড়ি ফাঁকা ছিলো মোটামুটিভাবে , আম্মু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন ।
আমি হাসিমুখে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম_ কেমন আছো আম্মু?
কিন্তু আম্মু আমার কথার জবাব দেননি উল্টো বিরক্ত হয়ে নিজের থেকে ছাড়িয়ে সরিয়ে দিয়েছেন ।
আমার খুব কান্না পেয়ে গেছিলো সাথেসাথেই , পেছনে যে রাইদ ভাই ছিলো এটা আমি খেয়াল করিনি ।
চোখভর্তি পানি নিয়ে মাথা নিচু করে ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সে আমার হাতটা টেনে ধরেছিল ।
মাথা উঁচু করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে কঠোরতা দেখতে পেয়েছিলাম ।
আম্মুকে উদ্দেশ্য করে সে বলেছিল_ মামী এসব কি? এতদিন পর মেয়েটাকে দেখলেন একটু ভালোভাবে কথাও কি বলা যায় না? কেনো একটা বিষয় নিয়েই পড়ে আছেন আপনি?
মা কোনো উত্তর করেনা শুধু মুখ কালো করে চলে যায় ।
রাইদ আমাকে বুকে জড়িয়ে বলে একদম কাঁদবিনা । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
,
সেদিন রাতে বাগানের পাশে ক্যাম্প ফায়ার করা হয় , ফয়সাল ভাই গান গেয়ে শোনান ।
ট্রুথ-ডেয়ার খেলা হয় । জানতে পারি ফয়সাল ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে , নাম চারুমতি ।
শব্দ ভাইয়া একবারও ট্রুথ নেননি উনি শুধু ডেয়ারই নিয়ে গেছেন ।
ডেয়ার গুলো মজার ছিলো , ওনাকে একবার আইটেম সং এ ডান্স করতে দেয়া হয়েছিল , একবার পাশের বাসার টিনের চালে ঢিল ছুঁড়তে বলা হয়েছিল আরেকবার ফয়সাল ভাইকে চুমু খেতে বলা হয়েছিল ।
সবগুলি পারলেও ফয়সাল ভাইকে চুমু খেতে পারেননি শব্দ ভাই ।
রাইদ অনেক গুলো সিক্রেট শেয়ার করেছিলেন ট্রুথ নিয়ে যেমন_ উনি আমাকে ছোট থেকেই পছন্দ করতেন , ফার্স্ট কিস আমার গালে , বিদেশে দু’টো প্রপোজাল পেয়েছিলেন একটা বাংলাদেশী মেয়ের থেকে আরেকটা বিদেশী ই কিন্তু বিদেশীটা ছিলো পাশের বাসার ভাবী টাইপ । বিবাহিত মহিলা । ব্যাপারটা নিয়ে আমার রাগ হওয়ার বদলে অনেক ফানি লেগেছিল ।
ডেয়ারে তাকে তার প্রিয় কাজ করতে বলা হয়েছিল এবং সে সরাসরি উঠে আমার গালে ফট করে একটা চুমু খেয়ে ভালোবাসি গাল্পুস, বলে চিৎকার করে বলেছিলেন এই গাল্পুস টাকে চুমু খেতে আর ভালোবাসতে আমার সবচাইতে বেশী ভালো লাগে ।
আমি খুব বেশীই লজ্জা পেয়েছিলাম ।
কিন্তু একটা জিনিস অবাক লেগেছে সিমি আর রামিম ভাই পুরোটা সময় ইনআ্যাক্টিভ ছিলেন ।
ফাঁকে সিমি একবার ট্রুথ নিয়েছিলো , ওকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ফার্স্ট লাভ?
ও রিপ্লাই দিয়েছিলো ফার্স্ট লাভ ইকুয়াল ধোঁকা , একটা ধোকাবাজ আমার ফার্স্ট লাভ ।
ওহ্ বলে রাখা ভালো সিমি আমার চাইতে বয়সে দু বছরের বড় ছিলো এবং ক্লাসে এক ক্লাস সিনিয়র হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু শহরের স্কুল একাধিক বার পরীক্ষার দেয়ার কারণে ও আমাদের ক্লাসমেট হয়ে যায় ।
দ্যাট মিনস ও তখনই ১৮ বছর বয়সী । ক্লাস টেনে পড়ুয়া একটা মেয়ের কাছে এই রিপ্লাই পেলে যেকেউ ভাববে বয়ফ্রেন্ড এর সাথে অভিমান করে এটা বলেছে বাট সিমির যেহেতু ১৮ আর ওর ভাব গাম্ভীর্য্যতা ছিলো সেরকম তাই আমরা ভেবেই নিই ব্যাপারটা সিরিয়াস ।
আমি একটা জিনিস লক্ষ করি সিমি এটা বলবার সময় রামিম ভাইয়ের মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছিলো ।
কিছু একটা আন্দাজ করেও আমি চেপে যাই ।
আমার বেলায় ডেয়ার নিই আমি , আর সব্বাই খুব মজা নেয় । রাইদের গালে চুমু দিতে বলে , আমি তো কিছুতেই এ কাজ পারবো না । পারলে কেঁদেই ফেলি পরে অবশ্যি ডান্স করতে বলা হয় । রাইদের সাথে একটা গানে হালকা কাপল ডান্স করে ফেলি ।
রামিম ভাইয়ের টার্ন আসলে সে ডেয়ার নেয় , তাকে গান গাইতে বলা হয় ।
সে তুমি রবে নীরবে গানটা গাইতে শুরু করে ।
গানটার মাঝপথেই তার চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে আর সিমি দৌড়ে চলে যায় ঐ জায়গা থেকে ।
আমি এবার শিওর হয়ে যাই ঘটনা অন্য ।
সবাইকে বলে আমিও সিমির কাছে চলে আসি ।
বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদছিল সিমি ।
,
আমি গিয়ে ওর পাশে বসে জিজ্ঞেস করেছিলাম_ কি হয়েছে সিমু?
সিমি উঠে আমার কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে বললো_ ও আমাকে চায়না আর! ওর আম্মু নাকি মেনে নিবেনা , কারণ আমার চুলে কালার করা , আমার মম-ড্যাডের ডিভোর্স হয়ে গেছে । বল ওদের ডিভোর্সে আমার হাত ছিলো? আমি কি খারাপ হয়ে গেছি সেজন্য ?
ডুকরে কাঁদতে লাগলো সিমি । আমি কিছু বলার আগে চোখভর্তি জল নিয়ে রামিম ভাই আমার সামনে দাঁড়ালেন ।
ওনার অসহায় চাহনি দেখে আমি সিমিকে সোজা করে বসালাম ।
সিমি ওনাকে দেখে আমায় বললো_ ওকে চলে যাইতে বল?
— প্লিজ সিমু আমার একটা কথা শোনো?
রামিম ভাই সিমির পায়ের কাছে বসলেন । আমি উঠে চলো আসলাম । আমি জানি এখন সবটা ঠিক হয়ে যাবে ।
ভালোবাসাই এরকম!
,
বাইরে একা একা দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছিলাম ।
কিছুক্ষণ পর অনুভব করলাম একজোড়া হাত আমাকে আঁকড়ে ধরেছে ।
হেসে মাথাটা এলিয়ে দিলাম মানুষটার বুকে ।
সে মাথায় থুতনি ভর দিয়ে বললো_ কি হয়েছে আমার গাল্পুস বাচ্চাটার?
আমি বলি_ আপনি আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না রাইদ ।
— এই গাল্পুস বাচ্চাটাকে ছাড়ার ক্ষমতা কি রাইদের আছে??
আমি ঘুরে তার বুকে মুখ লুকাই ।
সেদিন মনে হয়েছিল আসলেই সে আমাকে ছেড়ে যাবেনা ।
কিন্তু মানুষ বদলায় , কিছু তিক্ত সময় আসে আর??
আর সম্পর্ক ভেঙে যায় ।
তখন একটা কথাই কানে বাজে “ও আমায় ভালোবাসেনি”
চলবে,