৪+৫
#কোন_আলো_লাগলো_চোখে
লেখা: রোজ
#পর্ব -৪
.
এরমধ্যে কয়েকমাস কেটে গেল।রেহানা বেগম ছোট ছেলের বিয়ে দিয়ে সংসারী করতে চাইছেন। কিন্তু সমস্যা হলো উনার পছন্দ করা পাত্রী মিনুকে রাহাত মেনে নিতে পারছেনা।
এ নিয়ে মা ছেলের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়।
– তোমার কথা শুনবো না তা তো বলিনি।বিয়ে করবো, তবে এই মেয়েকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।
– কেন?মেয়ে লেখাপড়া জানে,ভালো পরিবারের কোন দিকে সমস্যা তোর?
– মানছি ভালো, লেখাপড়া জানে। কিন্তু মা, মেয়েটি আমার সাথে যায় না! আমার বন্ধু বান্ধবরা সবাই হাসাহাসি করবে! তাছাড়া মেয়েটি আহামরি সুন্দরী নয়!
– কেন হাসাহাসি করবে?
আর এই তোদের এই ‘ যায়’ ‘ যায়না ‘ বিষয় টা আমি ঠিক বুঝি না। মেয়েটি যদি ভদ্র, শান্ত না হয়ে তোদের মতো বন্ধু- বান্ধব,আড্ডা, ক্লাব এই সব নিয়ে মেতে থাকতো তবে খুব ‘ যেতো ‘! তাই না?
আর সুন্দর কি চিনিস?চেনার চোখ নেই তোর।
রাহাতের সব আপত্তি বৃথা করে মিনুর সাথে বিয়ে ঠিক করা হলো।
বিয়ের কিছুদিন আগে রেহানা বেগম মিনুকে ডেকে পাঠান, উদ্দেশ্য মিনুকে নিয়ে বিয়ের শপিং শেষ করবেন। মিনু আসলেও বেশ জড়োসড়ো হয়ে আছে। রেহানা বেগম চাইছিলেন রাহাত মিনুকে সময় দিক আর রাহাতও সুযোগটা লুফে নিলো।
রাহাত মিনুকে নিয়ে বের হলো। একটা রেস্টুরেন্টে বসার পরে রাহাতের কয়েকজন বন্ধু সেখানে উপস্থিত হয়।
তাদের সাথে মিনুকে পরিচয় করিয়ে দেয়।
কিন্তু পরিচয় টা এতোটা অপমানের হবে সেটা মিনু বুঝতে পারেনি।
রাহাতের বান্ধবী লিজা বললো – একে আন্টি পছন্দ করেছে তোমার জন্য! My God!
– ” দুস্ত, যায় না! ”
– ” আসলেই সুন্দর ছেলেরা নাকি কালো বউ পায়! যে তোমার পিছনে সুন্দরী মেয়েদের লাইন আর শেষে কিনা….!”
লজ্জায় নিমুর মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিলো। তাকে অপমান করছে সে জন্য নয়!
বরং একজন মানুষকে কিভাবে তারা ছোট করছে, সেটা দেখেই লজ্জা হচ্ছে!
পাশের দুজন নিচুস্বরে বলাবলি করছে যাতে মিনু শুনতে না পায় এমন ভান করে যদিও তারা তাকে শুনাতেই বলছে – ” বড়লোক ছেলে পেয়ে… গলায় ঝুলতে পারলেই! ব্যস।”
– ” আরে কি বলছিস তোরা এসব!? প্লিজ স্টপ ইট! দুর্বল গলায় রাহাত প্রতিবাদ করলো।।
– ” এই কেমন বাবা – মা ? লজ্জা শরম কি কিছু নেই, নাকি? বিয়ের কথা হয়েছে, বিয়ে হয়নি এখনি ছেলের বাড়ি পাঠিয়ে দিলো মেয়েকে !! মেয়েদের বড়লোক ছেলেদের পিছনে লেলিয়ে দেয়! ”
– Enough is enough! যথেষ্ট বলে ফেলেছেন আপনার! আমি কিছুই বলিনি। কিন্তু আমার বাবা মাকে নিয়ে আপনাদের মুখে একটা কথাও শুনতে চাই না। Not a Single Word!
আর আপনি, মি. রাহাত! বিয়ে করতে চাইছে না ভালো কথা, কিন্তু এভাবে অপমান না করলেও পারতেন! আমি কিন্তু আপনাকে পছন্দ করে বিয়েতে রাজি হইনি। হয়েছি মা- বাবার কথা রাখতে। কারণ আপনার মায়ের অনুরোধ উনারা ফেলতে পারেননি।”
বলেই মিনু চলে যাচ্ছে। কিছু একটা মনে পড়তেই ফিরে আসলো –
” প্ল্যানিং টা কিন্ত ভালোই ছিলো!
আর এই নিন’ –
বলে রিং টা খুলে রাহাতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে হনহন করে চলে গেল।
রাত প্রায় দশটা। রাহাত একা বাসায় ফিরে আসে। রেহানা বেগম কোনো কথা বলেননি।।
রাহাত ভাবলো মা সব জেনে গেছে, তাই রেগে আছেন।
– ‘খালাম্মা, সব রেডি।’ কাজের মেয়েটি বললো
– ঠিক আছে গাড়িতে উঠিয়ে রাখ আর জামালকে বল গাড়ি বের করতে। ‘ বলেই রেহানা বেগম উঠে পড়লেন।
রাহাত নিজের রুমে চলে যাচ্ছিলো, কথাগুলো কানে যেতেই থেমে গেল।এতো রাতে মা কোথায় যাচ্ছে?
চলবে….#কোন_আলো_লাগলো_চোখে
লেখা: রোজ
পর্ব- ৫
.
রাহাত নিচে আসার আগেই রেহানা বেগম বের হয়ে গেলেন।
– মা কই গেলরে কুসুম?
– কই যাইবো! হাসপাতালে!
– হাসপাতালে? কেন? কি হয়েছে?
– ওমা! ভাইজান আপনে জানেন না?
– জানলে তোকে জিজ্ঞেস করতাম? বলবি তো কি হয়েছে!!
কুসুম তখন বিস্তারিত বর্ননা দেয়।ঘটনা টা ঘটে দুপুরের দিকে। কিছু একটা জিগ্যেস করতে মিনুকে ফোন দিয়েছিলেন রেহানা বেগম। মিনু তখন জানায় সে চলে যাচ্ছে বাসায়, এখন আসবে না। জোড়াজুড়ি করতে মিনু সব খুলে বলে। কিন্তু হঠাৎ ফোন অফ হয়ে যায় আধ ঘন্টা পরে উনার মোবাইলে কেউ একজন জানায় একটা মেয়ের এক্সিডেন্ট হইছে, অবস্থা সিরিয়াস।
মেয়েটির ফোনের লাস্ট এই নাম্বার থেকে কথা বলেছে।
রেহানা বেগমের বুঝতে বাকি রইলো না মেয়েটি মিনু।ঠিকানা নিয়ে ছুটে গেলেন। ঘন্টা খানেক আগে ফিরে এসে ফ্রেস হয়ে কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে আবার চলে গেছেন।
রাহাত কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেছে। কিছুক্ষন পর খেয়াল হতেই মাকে ফোন করলো
– মা, কোন হসপিটালে আছে?
– সেটা তোর জানার কোনো প্রয়োজন দেখছিনা।তোর তো বিয়ে হচ্ছে না, প্রব্লেম সলভড!
– মা! প্লিজ বলো।
রেহানা বেগম ফোন কেটে দিলেন।
নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। শুধু শুধু মেয়েটাকে এভাবে অপমানিত হতে হলো। মেয়েটা হয়ত কোনো দিন এমন পরিস্থিতিতে পড়েনি।আজকের ঘটনা তাকে ডিপ্রেসড করে দিয়েছে।মেয়েটা নিশ্চয়ই অন্যমনস্ক হয়ে এক্সিডেন্ট করে বসছে!.
ঘুরেফিরে সেই সব কিছু তো রাহাতের জন্যই!
যদি সে মিনুকে আজ সেখানে না নিয়ে যেত তবে এমন টা হতো না!
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে রাহাত উঠে দাঁড়ালো।
দেরি করা ঠিক হবে না। জামালকে ফোন করে,
– জামাল ভাই! কোন হসপিটালে যাচ্ছেন?
জামাল ঠিকানা বলতেই রাহাত দ্রুত বেরিয়ে গেল।
হাসপাতালে পৌঁছে দেখে মিনুর মা- বাবা,বোন সবাই সেখানে। পরিস্থিতি দেখে বুঝলো উনারা এই সব ঘটনার কিছুই জানেন না!
মিনুর অবস্থা খুব ক্রিটিকাল। জ্ঞান ফিরেনি তখনো। সবাই সারারাত হাসপাতালে কাটালো।
ভোর রাতে জ্ঞান ফিরে। তবে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
মেয়েটি নাকি ফোনে কথা বলে বলে হাঁটছিলো রাস্তার পাশদিয়ে। কিন্তু কখন যে হঠাৎ অনেকটা রাস্তায় চলে আসছে খেয়াল করেনি।পেছন থেকে একটা বাসের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে রাস্তায়!..
মিনু সুস্থ হতে মোটামুটি ৩-৪ মাস কেটে গেছে। মিনু এখন সুস্থ।রেহানা বেগম নিজেকে ক্ষমা করতে পারছেন না। উনার জন্য মেয়েটা এতো কষ্ট পেল!
রাহাত এই ৩-৪ মাসে নিজের ভেতরে নিজে গুমরে মরেছে। প্রায় দেড় মাস মিনু হসপিটালে ছিল। রাহাত প্রতিদিন মিনুকে দেখতে গিয়েছে। পরে রেহানা বেগমে নিজের বাসায় নিয়ে আসেন মিনুকে।এখানেই চিকিৎসা চলে।
কিন্তু মিনু একটা কথাও বলেনি রাহাতের সাথে।
মিনু এখন সুস্থ, ফিরে যেতে চাইছে। অফিস জয়েন করা দরকার। রেহানা বেগমকে এসব বলতেই উনি কেঁদে ফেললেন –
– মা রে আমাকে ক্ষমা করে দিস।আমার জন্য আর তোর এই অবস্থা! আমি কোন মুখে তোকে আটকাবো? তোর বাবা – মাকে এখনো কিছু বলার সাহসটুকু পাইনি!
তোর মা এতো দিন সব ফেলে তোর সাথে ছিলো। তুই এখানে থাকায় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে ছিল।।
– এভাবে বলছেন কেন আন্টি! আপনি যা করেছেন আমার জন্য,কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা আমার জানা নেই। মা- বাবা নিশ্চিন্তে আছেন, কারণ আপনি থাকতে আমার কোনো সমস্যা হবে সেটা উনারা জানেন।
আরও একজন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছিলো।
রাতে রাহাত মায়ের ঘরে যায়।মা তাকে কিছুই বলেনি মিনুর বিষয়ে, এটা রাহাতকে আরও আঘাত দিচ্ছে। কেন মা ওকে কিছু বলল না!!
– মা।।
– আয়। কিছু বলবি?
রাহাত মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।
– মা,না চাইতে তো সারাজীবন অনেক কিছুই দিয়ে এসেছো আমাদেরকে। আজ একটা জিনিস চাইবো।দেবে আমাকে?
– কি চাইছিস? তোকে দেবার মতো আমার কাছে এখন কি আছে বাবা?
– মিনুকে তুমি যেতে দিও না।ওকে এখানেই থাকতে হবে।
– সেটা আর সম্ভব না। মিনুকে একটা ভালো ছেলে দেখে আমি নিজে দাঁড়িয়ে বিয়ে দিবো!
– মা! আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও।প্লিজ মা,একটা সুযোগ দাও আমাকে। আমি কিচ্ছু বুঝিনা তুমি মিনুকে আটকাবে। ‘ বলেই রাহাত চলে গেল।
ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রেহানা বেগম মিটিমিটি হাসলেন। এই দিনের অপেক্ষায় ছিলেন। উনি মা।
যে ছেলে অফিস শেষে বন্ধুদের আড্ডায় যোগ না দিয়ে কোনো দিন বাসায় ফেরেনি, সেই ছেলে কিসের টানে গত ২-৩ টা মাস অফিস শেষে সোজা বাসায় ফেরে।খুব জরুরী কাজ না থাকলে বের হয় না! সেটা উনাকে বুঝাতে হয় না।শুধু ছেলের মুখে শুনতে চেয়েছিলেন।
-” মিনু মা! তোর বাবা-মার কাছে আমাকে ছোট করে দিস না।আমার ছেলেটা এতো টা খারাপ না। তবুও তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করবো না।” বলেই রেহানা বেগম চলে গেলেন।
কাল সকালে মিনু চলে যাবে।তাই রেহানা বেগম মিনুর সাথে কথা বলছিলেন।মিনুকে অনুরোধ করেছেন বিয়ের ব্যাপারে আরেকটা বার ভেবে দেখতে।শেষ কথাগুলো মিনুর কানে বাজছে!
মা। মায়েদের জাতটাই এমন। কিছু মানুষের সাধ্য থাকে না মায়ের ডাক উপেক্ষা করার।মা বলতেই মাথার তাজ!
সেই মা যে কেবল গর্ভধারিণীই হয় না,জন্ম না দিয়েও অনেকে মায়ের স্থান নিতে পারেন।
রেহানা বেগম এমনই একজন মা।যাকে মিনু নিজের মায়ের মতো শ্রদ্ধা- ভক্তি করে।
এই মাকে উপেক্ষা করার সাধ্য হয়নি মিনুর!
– আসবো?
– আপনি এতো রাতে?!
– না এসে পারলাম না। কিছু কথা বলার ছিল।
– আসুন।ভিতরে আসুন।
রাহাত মিনুর পাশে রাখা চেয়ারটায় বসলো।
– তুমি কি সত্যিই কাল চলে যাবে?
– হুমম।
– ডিসিশান চেইঞ্জ করা যায় না?মিনু,I’m really sorry. একটা সুযোগ দাও আমাকে। প্লিজ তুমি চলে যেও না। তাহলে মা খুব কষ্ট পাবে আর আমি…
এটা ধরে নিতে পারো আমার অনুরোধ।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে মিনু বললো,
– দেখুন আমি সোজা কথা সোজা করে বলতেই পছন্দ করি। আমি এখানে থেকে গেলে আপনার বিশেষ লাভ কিছু হবে না।
আপনার সাথে যদি বিয়েটা হয় তবুও আপনাকে মেনে নেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।
রাহাত কি বলবে বুঝতে পারছেনা।
মিনু আবার বললো,
– এখন ডিসিশন আপনার। বিয়েটা করতে পারি তবে সেটা আন্টির জন্য।তবে আপনি কোনদিন স্বামীর অধিকার ফলাতে পারবেন না আর আমিও অধিকার চাইবো না।
চমকে উঠলো রাহাত।
– Are you crazy !! এটা আবার কি ধরনের শর্ত?আসলেই তোমার মাথায়.. কি যেন বলে কি থাকে?
সেটা আছে!
– আমার মাথায় যা- ই থাকুক, এটাই শেষ কথা।
আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি।
চলবে….