#এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৪৩(অন্তিমপাতা)
শ্রাবণের বিধ্বংসী ঝড়ো হাওয়ায় উত্তাল হয়ে উঠেছে প্রকৃতি।তীব্র বাতাসে বন্ধ জানালার কাঁচ পর্যন্ত কম্পিত হচ্ছে বারংবার।সমগ্র ছেঁয়ে যাচ্ছে ধুলোয়।এখন শুধু ‘প্রেমবর্ষণ’ নেমে আলোড়িত পরিবেশ মধুর হয়ে ওঠার অপেক্ষা।কাঁচের জানালার পর্দা সরানো।তিহান দাড়িয়ে আছে জানালার কাছে।চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ আবছা অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে থাকা তোহার মাঝে।বজ্রপাত হওয়ার আগমূহুর্তে ঝলকে ওঠা আলোতে মেয়েটার অপার্থিব শোভা চিকচিক করে উঠছে।ক্ষণে ক্ষণে সেই রুপে মোহিত হচ্ছে তিহান।
অনন্ত তার মা-বাবার সাথে চলে গেছে ঘন্টাখানেক আগে।অনন্তর মা তিহানের পায়ে পড়ে তাকে নিয়ে গেছে।শুধু নিশা আর সৌহার্দ্য আছে।আর কোন রসালো ঘটনার ঘটেনি সেজন্য প্রতিবেশিরাও আর এদিকে পা মাড়ায়নি।পরিস্থিতি অনেকটা শিথিল,স্বাভাবিক।সারাদিন একটার পর একটা ধাক্কার আক্রমণে সবাই এখন ক্লান্ত,শ্রান্ত।এর মধ্যই কাজী ডাকতে বলেছে তিহান।আজ রাতেই তাদের বিয়ে পড়াতে হবে।সে যেভাবেই হোক না কেনো।পরিশেষে তিহানের অদম্য জেদের তাছে হেরে গেছে আরমান সাহেব।এই ঝড় বাদলের মধ্যেই কাজী আনার ব্যবস্থা করছেন তিনি।
তখন অজ্ঞান হবার পর তোহার মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়েছিলো তিহান।কিন্তু শরীর দূর্বল হওয়ার দরুন মিনিটদশেকের মধ্য আবারো ঘুমে বিভোর হয়ে পরেছিলো তোহা।এরপর আর জাগায়নি।
অন্যকাউকে জাগাতেও দেয়নি।তোহাকে নিরিবিলিতে শান্তিমত ঘুমানোর ব্যবস্থা করার জন্য এ ঘরে কাউকে আসতেও মানা করেছে।তিহানের যে প্রলয়ংকারী রূপ আজকে সবাই দেখেছে তাতে ওর উপর আর কোনো কথা বলার সাহস পায়নি কেউ।
লালরঙা মেহেদি মাখানো তোহার ছোট্ট হাতটা।তিহান পাশে যেয়ে বসলো।কত যত্ন করেই না মেহেদি লাগিয়েছে মেয়েটা।কতশত শুভ্রসপ্ন নিয়ে গায়ে লাল বেনারসি জড়িয়েছে।এত প্রতীক্ষার পর আজ সে তিহানের হবে বলে।কিন্তু কি হলো?সবচেয়ে সুখের মূহুর্তটা আসার আগেই এই ছোট্ট জীবনের সবচেয়ে অসহায়,হৃদয় রক্তাত্ব করা মূহুর্তটা তার দরজায় এসে হানা দিলো।
চোখের পলকে ধূলিসাৎ হয়ে গেলো এতদিনের সুধাময় আকাঙ্ক্ষাগুলো।
চোখ বুজে ফেললো তিহান।সেই যুবক বয়স থেকে মেয়েটাকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসে সে।কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনো তার শরীর ঘনিষ্ঠ স্পর্শে ছুঁয়ে দেয়ার কথা মনেও আনেনি।উল্টো সবসময় সব বিপদ-আপদ থেকে বাঁচিয়ে আগলে রেখেছে।অথচ আজ এমন একটা দিনে সে প্রথমবারের মতো ব্যর্থ হয়ে গেলো।মেয়েটাকে তার আগেই অন্যকেউ ছুঁয়ে ফেললো।
কষ্ট হচ্ছে।খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু তা মনের ভেতরেই চেপে রেখেছে তিহান।তোহার মধ্যে যে যন্ত্রনাটা হচ্ছে সেটার কাছে তার এই ক্ষুদ্র ব্যাথা খুবই তুচ্ছ।সহজেই উপেক্ষা করার মতো।
তোহার কোমল হাতটা নিজের শক্তপোক্ত হাতের মাঝে টেনে নিলো তিহান।গালের সাথে চেপে ধরে কিছুক্ষণ নির্নিমেষ চেয়ে রইলো তোহার মুখপানে।খুব গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায় ফর্সা মুখটা কেমন করে বিষাদ,ব্যাথার আচ্ছাদনে ঢেকে গেছে।
তিহান আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল সেই মেহেদিরাঙা হাতের তালুতে।অষ্পষ্ট স্বরে বললো,”তোমাকে সেই সময়টায় রক্ষা করতে পারিনি।ক্ষমা করে দিও এই ব্যর্থ প্রেমিককে”।
কাজি এসেছে।আরমান সাহেবের জরুরি তলব শুনে বেশ হন্তদন্ত হয়ে এই ধুলোঝড়ের মধ্যেই রওনা দিয়েছিলো সে।এখনো বৃষ্টি নামেনি।তাই তাড়াতাড়িই পৌঁছে গিয়েছে।
আফিয়া আস্তে করে দরজা খুললো।ঘাড় ফিরিয়ে মাকে দেখেই চট করে তোহার হাত টা নামিয়ে রাখলো তিহান।
উঠে দাড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,”কিছু বলবে মা?”
আফিয়া হাসলো।প্রসন্ন কন্ঠে বললো,
—“তোর অপেক্ষার পালা শেষ হলো বলে।কাজী এসে পরেছে।”
আফিয়া বেরোতেই ঘরের লাইট জ্বেলে দিলো তিহান।সেই কৃত্রিম আলোতে ঘুমের মাঝেই হাল্কা করে চোখ কুঁচকালো তোহা।
তিহান কাছে গেলো।মাথায় হাত রেখে নরম স্বরে ডাকলো,”তিহু?”এক ডাকেই তন্দ্রা কেটে গেলো তোহার।
পিটপিট করে চোখ খুলে একটু আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পরলো সে।হুড়মুড় করে উঠে বসতে বসতে এদিকে ওদিক দেখলো।।এলোমেলো কন্ঠে বললো,
—“কিছু হয়েছে?”
তিহান মনোযোগ দিয়ে তাকালো।মেয়েটার চুল অগোছালো,শাড়ি অগোছালো,গলায় পরানো গহনাগুলোও এঁকেবেঁকে আছে,নাকের টানা নথটা সেই প্রথম থেকেই খুলে কানের পাশে ঝুলছে,চোখের পাপড়ি গুলো মনে হচ্ছে ঘুমের কারণে একটার সাথে আরেকটা লেগে আছে,মুখে সাজ নেই।
কিন্তু এতেও যেনো অপ্রতিম,নিরুপম লাগছে।বউরা থাকে পরিপাটি,সাজসজ্জায় মোড়ানো।তবে তার বউটা একটু অন্যরকম।অগোছালো বউ।এতে অবশ্য কোন আফসোস হচ্ছেনা তিহানের।মেয়েটাকে সাধারণেরই অসাধারণ লাগে সবসময়।তাদের বিয়েটাও তো একেবারেই অন্যরকম।নতুবা কোন মেয়ের ভাগ্য হয় স্বামীর ঘরে বসে বিয়ে করার।
তোহা উওরের আশায় ফ্যালফ্যাল বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রয়েছে তিহানের দিকে।কি নিষ্পাপ ই না দেখাচ্ছে তাকে!
ঠোঁট এলিয়ে হাসলো তিহান।বিছানার কুঁচকানো চাদরটা টেনে সোজা করতে করতে বললো,
—“মাথায় ঘোমটা টেনে বসো।কাজী সাহেব ঘরে আসবেন বিয়ে পড়াতে।”
প্রথমবারেই কথাটা ধরতে পারলোনা তোহা।মনে হলো সে হয়তো কিছু ভুল শুনেছে।তবুও তিহান তো ঘোমটা দিতে বললো।মাথায় শাড়ির আচঁল টেনে নিতে নিতে সে ক্ষীণ স্বরে প্রশ্ন করলো,
—“বিয়ে?”
তিহান হাসলো,আরো একবার।তোহা জানেনা যে তিহান কাজী ডাকতে বলেছে।ও তখন ঘুমাচ্ছিলো।মেয়েটা ভেবেছে কি তাকে?এতোই ঢিলেঢালা তার প্রেমিক?অনেক অপেক্ষা হয়েছে।আর না।
চাদর টা ঠি ক করে দিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো তিহান।তোহার চোখে চোখ রেখে বললো,
—“তো তুমি কি ভেবেছো?তুমি বিয়ের শাড়ি পরে বধুবেশে বসে থাকবে?আর আমি তোমাকে বিয়ে না করেই ছেড়ে দিবো?অসম্ভব।”
______________
আতিয়া বসেছে তোহার একপাশে।অপরপাশে বসেছে আফিয়া।তোহার মাথায় এখন শাড়ির আঁচলের বদলে স্হান পেয়েছে আতিয়ার সেই বিয়ের ওড়নাটা।নাকের নথটা আবারো পরিয়ে দেয়া হয়েছে।বিছানার অপরপাশে বসেছে তিহান আর আরমান সাহেব আর আমজাদ সাহেব।।কাজি বসেছে চেয়ারে।ছোটখালা,ছোটখালু,কাজিনরা,সৌহার্দ্য-নিশা,তূর্য সবাই-ই আছে ঘরে।
তোহার দৃষ্টি নামানো বিছানার চাদরের দিকে।চোখে মুখে হতভম্ব-লাজুক ভাবের মিশেল রং।তিহানের পরণে সেই সাদা পান্জাবি আর সাদা টুপি।তিহানের হাত ধরা আরমান সাহেবের হাতে।কাজী সাহেব কিছু বলছেন।তোহা অন্যচোখে একনজর তাকালো।লোকটার সারা মুখে অদ্ভুত একটা আত্নতৃপ্তি।খানিকবাদেই তিহান তার সেই ভারি পুরুষালি কন্ঠে বললো,”আমি এই মোহরানা মেনে নিয়ে কবুল করলাম।”কবুল করলাম”।কবুল করলাম”।
শিঁউরে উঠলো তোহা।মনে হলো কেউ যেনো বিদ্যুৎপিষ্ট করে দিয়েছে তাকে।লাজুক মুখটা আরো একটু ঝুঁকে গেলো।এই মুখটা সে তুলবে কি করে?বাইরে থেকে একটা বজ্রপাতের শব্দ হলো।তিহান সাইন করলো কাবিননামায়।কাজী সাহেব আবারো বলতে শুরু করলেন।কথাগুলো তোহার উদ্দেশ্যে।তোহা শুনছে।খুব মন দিয়ে।খানিকবাদে কাজী তাকেও প্রশ্ন করলেন।তোহা সময় নিলো।টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো কোলের উপর রাখা হাতে।এত সুখ কি তার সহ্য হবে?খানিকবাদে সে নিচু স্বর উওর দিলো,”আলহামদুলিল্লাহ,কবুল করলাম,”কবুল করলাম”,কবুল করলাম”।তিনবার উওর দিয়ে সাইন করলো তোহা।
বৃষ্টি নামলো তখনই।প্রবল ঝুম বৃষ্টি।তীব্র জলপাতের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।সমস্ত পরিবেশ মধুর হয়ে উঠছে।ধুয়ে মুছে যেতে শুরু করেছে সকল বিষাদ।প্রকৃতি প্রেমময় হয়ে উঠছে।শ্রাবণের অঝরধারার “প্রেমবর্ষণে” বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা যেনো প্রেমপত্রের ন্যায় অনুপম রুপে নেমে আসছে পৃথিবীর গায়ে।
তিহানকে দেখে মনে হচ্ছে তার থেকে সুখী মানুষটি এ পৃথিবীতে আর নেই।জগতের বিদ্যমান সমস্ত সুখ যেনো সৃষ্টিকর্তা তার এই ঘরটায় ঢেলে দিয়েছেন।এই যে সামনে বসা মেয়েটা।এই মেয়েটা বাস্তবিকই তার হয়ে গেছে।পবিত্র পূর্ণতার ছেঁয়ে গেছে তার এত প্রতীক্ষার ভালবাসা।এতদিনের প্রেমকাহনের পরিসমাপ্তিটা ঘটে গিয়েছে অবশেষে।
বিয়ে পড়ানো শেষ হতেই গলা ঝাড়লো তিহান।আরমান সাহেবের দিকে চেয়ে সবার সামনেই বললো,”খালু আমার কিছু কথা ছিলো।”
আরমান সাহেব হাসলেন।বললেন,”খালু না বাবা বলো।”
হাসলো তিহানও।বললো,”আমি আর কোনো অনুষ্ঠান করতে চাচ্ছিনা বাবা।যারা একটা ঘটনার কোনোকিছু বাছবিচার না করেই নির্দ্বিধায় বাজে কথা বলতে পারো,তাদের পিছে টাকা নষ্ট করে খাওয়া দাওয়া করানোতে আমার মত নেই।বিয়ে হয়ে গেছে,ব্যস।আজ থেকে আমার বউ আমার সাথে থাকবে।”
আরমান সাহেব শব্দ করে হাসলেন।তিহানের কথায় কোনরকম আপত্তি প্রকাশ করলেন না।সবার মুখেই মিটিমিটি হাসি।তোহা কিংকর্তব্যবিমূড়।লোকটা কিসব বলছে সবার সামনে।
মিষ্টিমুখ করা হলো।অল্প অল্প করে সবার সাথেই কথা হলো তোহার।নিশা তো কেঁদেই ফেলেছিলো।সে তখন তোহাকে একা রেখে গিয়েছিলো বলেই ঘটনাটা ঘটেছে।তিহান অবশ্য তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়েছে।বলেছে এ বিষয়ে যেনো আর কেউ কোন কথা না বলে।
রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বোনকে অনেকক্ষণ বুকে জড়িয়ে রাখলো তূর্য।বোনটা তার খুব আদরের,খুব বেশি স্নেহের।
একে একে সবাই-ই চলে গেলো রুম থেকে।রুম ফাঁকা হলো।থাকলে শুধু আফিয়া আর তোহা।আফিয়া খাবার নিয়ে আসলো।তিহান খালুদের সাথে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তোহাকে খাইয়ে দেয়ার কথা বলে গিয়েছিলো।
তোহাকে পেটভরে খাইয়ে দিয়ে অনেকক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দরজা ভিড়িয়ে বেরোলো আফিয়া।
তোহা চুপচাপ বসে রইলো বিছানায়।তার নিজের মানুষটায় অপেক্ষায়।
____________
রাত সাড়ে দশটার দিকে রুমে আসলো তিহান।বাইরের প্রবল বৃষ্টির শব্দে মুখরিত,উজ্জীবিত চারিপাশ।প্রেমের পবিত্র সুগন্ধে সারাঘর মৌ মৌ করছে।
তিহান জানলার কাঁচ সরিয়ে দিলো।হু হু করে বাতাস ঢুকে পরলো রুমে।ঠান্ডা থেকে ঠান্ডাতর হয়ে উঠছে পরিবেশ।
তিহান আলমারির খুললো।একটা খাম বের করে এগোলো খাটের দিকে।তোহা বসে আছে মধ্যিখানটায়।সে প্রবেশ করা মাত্র সেই যে মাথা নামিয়েছে তো নামিয়েছেই।তিহানের মুখে চাপা হাসি।তোহার কাছাকাছি যেয়ে বসতেই আরো একটু নতজানু হলো তোহা।তিহান আলতো করে তার হাতে খামটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,”মোহরানার টাকা পরিশোধ করে দিলাম।”
মোটা খামটা একবার পরখ করে নিলো তোহা।অসস্তি নিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বললো,”আমি কি করবো টাকা দিয়ে?”
—“এটা তোমার অধিকার।”বলে তোহার থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করলো তিহান।কিছুক্ষণ লজ্জারাঙা রক্তিম চেহারাটা তৃপ্তিভরে দেখে নিয়ে আচমকাই তোহার দু’গালে হাত রেখে কপালে ঠোঁট ছোয়াঁলো।কি পবিত্র সেই স্পর্শ!
কোনো কামুকতা নেই।আছে শুধুই নরম কোমল একজোড়া ঠোঁটের পবিত্র ভালবাসার স্নিগ্ধতম বহি:প্রকাশ।
খুব সময় নিয়ে গাঢ় চুমু খেলো তিহান।
এই প্রথম…হ্যাঁ এই প্রথমবার তোহার সজ্ঞানে তিহান তাকে কপালে চুমু খেলো।এর আগে অবশ্য ঘুমের মাঝে এক দু’বার ঠোঁট ছুঁইয়েছে কিন্তু এতটা তীব্রতা,প্রগাঢ়তা নিয়ে কখনোই নয়।বা তোহাও তা উপভোগ করেনি কখনো।
তোহার চোখ বন্ধ।তার নিজের মানুষটার প্রথম ঘনিষ্ট ছোঁয়া।তার উষ্ণ অধরের স্পর্শ তার ছোট্ট কপালটায়।
সুখে নাকি অজানা কোনো পিছুটানে হঠাৎই মুখের চোয়াল ভারি হয়ে উঠলো।আটকানোর চেষ্টা করেও লাভ হলোনা।ডুকরে কেঁদে উঠলো তোহা।তিহান ঠোঁট সরালো।চোখের পানিগুলো গাল গড়িয়ে যাওয়ার আগেই মুছে ফেললো হাত দিয়ে।অত:পর কপালে কপাল ঠেকিয়ে ধীরকন্ঠে বললো,””ওই স্বৃতিগুলো মুছে ফেলো।শুধু এটুকু মনে রাখো,আমি সবসময় আছি।সে যাই হয়ে যাক না কেনো।এই “আমি” টার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তুমি প্রতিটা মূহুর্তে তাকে তোমার পাশে পাবে।”
তোহা কাঁদলো।খুব করে কাঁদলো।মন উজার করে কষ্ট গুলা তিহানের বুকের উপর নিংড়ে দিলো।তিহান তাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো আষ্টেপৃষ্ঠে।খুব শক্ত করে।একসময় কান্না থামলো তোহার।বুক থেকে মাথা তুলে তিহানের বাহুর দিকে চোখ পড়লো।রক্তের ছাপগুলো শুকিয়ে গেছে।সাদা পান্জাবিতে স্পষ্ট সেই রক্তগুলো দেখে মনটা ভেতরে ভেতরে আবারো হু হু করে উঠলো।চোখেমুখে অদ্ভুত আকুলতা নিয়ে জায়গাটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলো। তোহা।ব্যাথাতুর কন্ঠে বললো,
—“আপনার খুব লেগেছে তাইনা?”
—“নাহ্।”
—“মিথ্যা বলছেন।”
তিহান উওর দিলোনা।অমায়িক হেসে উঠে দাড়ালো।বোতামগুলো খুলে পান্জাবিটা গা থেকে ছাড়িয়ে নিলো।সোফার উপর তা মেলে দিতেই খট করে পকেট থেকে কিছু একটা পড়লো ফ্লোরে।উবু হয়ে জিনিসটা হাতের মুঠোয় নিলো তিহান।এটা আনতেই সকালে বেরিয়েছিলো।এটার জন্যই ওই সময়টায় তোহার পাশে থাকতে পারেনি।
দীর্ঘ:শ্বাস ফেললো তিহান।জিনিসটা পাজামার পকেটে ভরে নিয়ে কোমলকন্ঠে বললো,
—“মা খাইয়ে দিয়েছিলো?”
—“হু”
—“পেট ভরেছে?”
—“ভরেছে”।
তিহানের পরণে সাদা চিকন হাতার গেন্জি।শক্ত সামর্থ্য পুরুষালি শরীরটা এই ঠান্ডার মধ্যেও ঘামে ভিজে গেছে।বেহায়া দৃষ্টিতে মানুষটাকে দেখতে দেখতে হঠাৎ বাহুতে চোখ আটকে যেতেই আৎকে উঠলো তোহা।তিহান তখন তারই দিকে এগিয়ে আসছে।সে কাছাকাছি এসে বসতেই সেই বাহু পুনরায় আঁকড়ে ধরলো তোহা।নিদারুণ কষ্ট নিয়ে বললো,”কিভাবে খামছেছি আমি?আল্লাহ!আপনি কি পাগল নাকি?আমাকে থামাবেন না তখন।”
“তুমি যন্ত্রনায় কাতর হয়ে খামছাচ্ছিলে আর আমি থামিয়ে দিবো?এও সম্ভব?”শীতল কন্ঠে বললো তিহান।তারপর আস্তে করে তোহার নাকের নথটা খুলে কানের কাছে ক্লিপ দিয়ে আটকানো অংশটা খুলতে খুলতে বললো,”দেখেছো,সেই কখন থেকে এসব ভারি জিনিস পরে আছো তুমি।আমার খেয়ালই হয়নি খুলে দেয়ার।কতটা অধম আমি।”বলে নিজ হাতে একে একে সব গহনা খুলে পাশে রাখলো সে।এরপর নির্বিকার ভঙ্গিতে সাইড টেবিলের ড্রয়ের থেকে একটা লাল বক্স করলো।সেখান থেকে বেরিয়ে এলো একজোড়া স্বর্ণের ছোট্ট কানের দুল,একটা চিকন চেইন আর দুটো চুড়ি।
তোহা অসহায় চোখে চেয়ে রইলো।লোকটার পাগলামি কোনদিনও কমার নয়।স্বামী হোক বা প্রেমিক,সে পাগলামি করেই যাবে।
তোহার অসহায় মুখের চাহনী সহজেই বুঝতে পারলো তিহান।গলায় আগের পরানো নীল লকেটটার উপরই এই চেইনটাও পরিয়ে দিতে দিতে সে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
—“নতুন বউকে এমন খালি রাখতে হয়না।আমি নিরুপায়।”কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই তোহা চোখ বুজে ফেললো।লোকটার এই ভয়ংকর ভালবাসা সে ধারণ করে পারছে না।হৃদপিন্ডটা কাঁপছে।তিরতির করে।
জিনিসগুলো পরিয়ে দিয়ে সরে গেলো তিহান।তোহা চুপচাপ বসে আছে।
তিহান কিছুক্ষণ একধ্যানে বসে থেকে পকেট থেকে কাজল বের করলো।বললো,”বলেছিলাম না একদিন,তোমার চোখে কাজল পরানোর খুব শখ আমার।একয়দিন নানা ব্যস্ততায় আনতে পারিনি।সকালে মার্কেটে গেলাম কাজল আনতে।নিয়েও আসলাম।কিন্তু আসার পরে তোমাকে দেখে আর সেটার কথা আমার মনেই ছিলোনা।এখন যখন পকেট থেকে পড়লো তখন মনে আসলো।”এটুকু বলে থামলো তিহান।কাজলের পেন্সিলটাকে পরখ করে নিয়ে তোহার চোখে চেয়ে আবদার জড়ানো কন্ঠে বললো,”এখন পরাই একটু?বিশ্বাস করো,আমি ব্যাথা দিবোনা।খুব সাবধানে পরাবো।”
তোহা আচমকাই হেসে ফেললো।কতক্ষণ পর সে হাসলো।মন খুলে।প্রাণ খুলে।তিহান মুগ্ধ হয়ে দেখলো সেই হাসি।
খানিক পরে হাসি থামালো তোহা।মুখ এগিয়ে বললো,”পরান”।
তিহান পরালো।অনেকটা সময় নিয়ে।একটু আধটু ছড়িয়ে গেছে তবুও যেন অগাধ শান্তি হচ্ছে কোথাও।
তোহা পিটপিট করে তাকালো।তিহানকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে মিষ্টি স্বরে বললো,
—“শখ মিটেছে আপনার?”
তিহান একইভাবে চেয়ে থেকে স্বগতোক্তি করলো,
—“খুব মিটেছে।”
প্রেমবর্ষনের তেজ বেরেছে।উল্টোদিকে বাতাস বইছে।ফলস্বরূপ বৃষ্টির ছাঁট বিছানা পর্যন্ত এসে যাচ্ছে।তিহান লাইট নিভিয়ে দিয়ে এলো।তোহা মাত্র শুয়েছে।চোখেমুখে পানির ফোঁটা লাগায় সে নরম গলায় বললো,”জানলাটা আটকে দিন।ওপাশে ঘুমালে আপনিতো ভিজে যাবেন।”
তিহান জানলাটা লাগলোনা।তোহার পাশে কাত হয়ে শুয়ে পরে একহাত মেলে বললো,”আসো।”
তোহা কাছে আসলো।বুকে মুখ গুঁজলো।পিঠে তিহানের হাতের ছোঁয়া পেতেই কেমন উষ্ণতার আবরণে মুড়িয়ে গেলো।ঠান্ডা পরিবেশটা হঠাৎই আবেগী হয়ে উঠলো।সেসময় বৃষ্টির ছাঁটগুলো গায়ে পরতেই মনে হলো,নাহ..আসলেই এই জলকণা গুলোর খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো।এই অতিরিক্ত উষ্ণ আবেশটা একটু উপশম করার জন্য হলেও প্রয়োজন ছিলো।
তোহার চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছুইয়ে তিহান প্রথমবারের মতো উচ্চারণ করলো,”ভালোবাসি।”
তোহা নিশ্চুপ নিবিড় হয়ে রইলো খানিকক্ষণ।তারপর মিহি স্বরে বলল,
—“আপনাকেও।”
—“আপনাকেও?”
তিহান কি শুনতে চাচ্ছে বুঝতে অসুবিধা হলোনা তোহার।তবুও কথাটা যেনো গলা পর্যন্ত এসে আটকে গিয়েছে।লজ্জাগুলো দলা পাকিয়ে কন্ঠনালির মধ্যেখানটায় ঠেকে গেছে।তিহান বলছেনা কিছুই।হয়তো উওরের অপেক্ষা করছে।খানিকক্ষণ লজ্জাখেলার পর তোহা বলেই দিলো,
—“ভালোবাসি।”কন্ঠ খাদে নামানো।খুব মন দিয়ে শুনলে তবেই কথাটা বোধগম্য হবে কারো।
হাসলো তিহান।হাতের বেষ্টনী আরো একটু দৃঢ় করে আদুরে গলায় বললো,”ঘুমাও”।
_______________
ভোর হলো।বৃষ্টির তান্ডব বিদায় নিয়েছে সেই মাঝরাতে।কালরাতের আবহাওয়ার লেশমাত্র নেই এই রংবদলের প্রকৃতিতে।জানালার ফাঁক গলিয়ে নিস্তেজ আলো আসবে আসবে করছে।সূর্য পুরোপুরি উঠেনি এখনো।গাছের পাতা চকচক করছে।মনে হচ্ছে কোন দূত এসে প্রকৃতিকে নরম ছোঁয়ায় ধুয়ে মুছে পবিত্র করে গেছে।
তিহানের ঘুম ভাঙলো।তার মেলে রাখা বাহুর উপর মাথা রেখে বুকের সাথে লেপ্টে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা।একটা হাত আলতো করে তার কোমড়ে রাখা আর আরেকটা হাত বুকের সাথে লেগে আছে।আনমনেই হাসলো তিহান।প্রসারিত,বিস্তৃত,পরিপূর্ণ হাসি।কত অপেক্ষাই না সে করেছে এমন একটা ভোরের জন্য।যখন এই মেয়েটা তার সাথে থাকবে।সর্বক্ষণ,আজীবন।মেয়েটাকে সে ছুঁয়ে দিতে পারবে কোনো বাঁধা ছাড়াই।
তোহা তখন গভীর ঘুমে।ভরসার মানুষটার বাহুডোরে সে নিশ্চিন্তের ঘুম দিয়েছে।সব দু:খ,কষ্ট নিভিয়ে তার ঘুমন্ত মুখে ভর করেছে একমুঠো সুখের কিরণ।
আলতো করে তোহার হাতটা সরিয়ে তাকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে উঠে বসলো তিহান।একপায়ের কাপড় হাঁটু অবধি উঠে গেছে।আঁচলের অবস্থা বর্ণনা মতো না।ছোট্ট করে একটা শ্বাস ছাড়লো তিহান।বিছানা থেকে নেমে খুব সন্তর্পণে পায়ের কাপড় নামিয়ে দিলো।আঁচলটা দিয়ে কোনরকমে তোহাকে আবৃত করে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।অত:পর এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে।
আকাশে আজ আগুন লেগেছে।পূর্ব দিগন্ত যেনো দাবানলে পুড়ে ছারখার হচ্ছে।সেই দাবানলের রক্তিম লালাভ আভা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো আকাশজুড়ে।শিল্পির রংবাক্সের লাল-কমলা রংটা বোধহয় ভুলবশত ছিঁটকে পরে গিয়েছে আকাশের গায়ে।কমলার সাথে লাল রংটা খুব যত্নের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
আকাশে অগ্নিকান্ড ঘটানো সেই বিশাল অগ্নিবলয়টা খুব ধীরে ধীরে উদয় হচ্ছে।উষার আলো ছড়িয়ে পরছে সবখানে।বারান্দার রেলিংয়ে হাত রেখে একাধারে সেদিকে চেয়ে রয়েছে তিহান।তার ধূসর চোখের উপর লালাভ আকাশের প্রতিচ্ছবিতে অদ্ভুত একটা সংমিশ্রণ ঘটে গিয়েছে।
গুটিগুটি পায়ের আবির্ভাব।উপস্থিতি টের পেতেই ঘাড় ফিরালো তিহান।তোহা এসেছে।রেশমকালো চুলগুলো এলোমেলো সিঁথিতে ভাগ হয়ে পরে আছে দু’পাশে।সদ্য ঘুম ভাঙা মায়াবী চেহারার মায়া বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে চোখের নিচের ল্যাপ্টানো কাজলরঙটা।ঘুম থেকে উঠেই মনে হয় চোখ কঁচলেছে।শাড়ির আচঁল এবড়োথেবড়ো করে কাঁধে উঠানো।মসৃন কোমড় সম্পূর্ণ দৃশ্যমান।সেদিকে চোখ পরতেই এতোদিনের অভ্যাসবশত মূহুর্তেই দৃষ্টি সরালো তিহান।পরক্ষণেই নিজের কাজে নিজেই হেসে ফেললো ভেতরে ভেতরে।
তোহা পাশে এসে দাড়িয়েছে।তিহান তার দিকে ফিরে নিষ্পলক চেয়ে থাকলো কিছুক্ষন।অত:পর নির্দ্বিধায় উন্মুক্ত কোমড়ে হাত গলিয়ে খুব কাছে টেনে নিলো।চমকে উঠলো তোহা।গলা শুকিয়ে মরুভূমি।পরমূহুর্তেই মাথায় এলো এ লোকটা তো এখন তার স্বামী।তাকে ঘনিষ্ঠভাবে ছোঁয়ার সম্পূর্ণ অধিকারপ্রাপ্ত।কোনরকমে চেহারার উপচে পড়া লজ্জাটাকে সামলে নিলো সে।আলতো করে হাত রাখলো তিহানের বুকের উপর।সূর্যের আরক্তিম লালিমা ছেয়ে পরেছে দুজনের সর্বাঙ্গে।
তিহান ঠোঁট ছোঁয়াল তোহার কপালে।খুব যত্ন করে,আদর করে গভীর চুমু খেলো।।অত:পর বুকে জড়িয়ে নিয়ে আনমনেই বলে উঠলো,
“এক রক্তিম শ্রাবণে তুমি আমার হয়ে গেলে ‘প্রেমবতী’।”
~সমাপ্ত~
[আসসালামু আলাইকুম।অবশেষে শেষ হয়েই গেলো গল্পটা।আপনারা অনেকেই আরো অনেক পর্ব বাড়াতে বলেছিলেন কিন্তু তা সম্ভব নয়।আমি যা যা লিখতে চেয়েছিলাম সেগুলো সবই লিখা শেষ।পর্ব বাড়ানোর মতো আর কিছু আমার কাছে নেই।আরেকটা কথা হলো,এই গল্পটার জন্য একটা ভয়াবহ স্যাড এন্ডিং ভেবে রেখেছিলাম।তবে বাঁধ সাধলো আপনাদের ভালবাসাগুলো।গল্পটাকে আপনারা এত ভালোবেসেছেন যে আমার পক্ষে স্যাড এন্ডিং দেয়া সম্ভব হলোনা।কিন্তু হ্যাপি এন্ডিং দিয়েও আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি গল্পের নাম সার্থক করার।
পরিশেষে এটাই বলতে চাই,শেষদিনের কমেন্ট বক্সে শেষবারের মতো আপনাদের ভালবাসা গুলো পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।ভালবাসা সবাইকে❤️]