চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব -০৫

#চড়ুইপাখির_অভিমান🕊️
#পর্ব_৫
#লেখনীতে-নন্দিনী নীলা

কাব্য রেগে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আর আমার কাঁধের কাছে খামচে ধরলো। আমি ব্যাথায় ককিয়ে উঠলাম। একহাত দিয়ে সেফটি পিন কোমরের কাছ থেকে খুলে তা কাব্যের হাতে আঁচড় কেটে দিলাম। তখন তীব্র আলোর ঝামটা এসে পরলো আমাদের গাড়ির দিকে। আমি চিৎকার করে উঠলাম। যাতে কেউ আমাকে হেল্প করতে আসে। আল্লাহ সহায় ছিল গাড়ি থেকে কেউ নেমে এগিয়ে আসতে আসতে জোরে জিজ্ঞেস করল,

‘ ওখানে কি হচ্ছে?’

আমি কন্ঠ টা সেকেন্ডে চিনে ফেললাম এটা তো স্পর্শের কন্ঠ। আমি স্পর্শকে ডেকে উঠলাম, ‘ স্পর্শ আমাকে বাঁচান। আমি মারিয়া।’

কাব্য শয়তানটা কারো আসার শব্দ পেয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দৌড় দিল। আমি গাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পরে গেলাম। আর হাঁটুতে ও হাতে ব্যাথা পেলাম। মনে হচ্ছে চামড়া ছুলে উঠে গেছে। আমি উঠার চেষ্টা করেও পারলাম না। ড্রাইভার কাব্যকে গাড়িতে তুলে শো করে গাড়ি ছেড়ে চলে গেল। আমি রাস্তায় পরে তা দেখলাম।
স্পর্শ অপর পাশ থেকে দৌড়ে আসলো আমার কাছে। অন্ধকারে তিনি আমার কাছে বসে পরলো। নিজের ফোন বের করে লাইট জ্বালিয়ে আমার মুখে ধরলো। আমার চোখে আলো লাগতেই চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললাম। স্পর্শ আমাকে এই অবস্থায় দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। ব্যস্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ তুমি? এই অবস্থা কি‌ করে হলো। এই ভাবে বসে আছো কেন উঠে!’

আমি লজ্জায় বলতে পারছি না। হাঁটুতে আঘাত পাওয়ায় আমি উঠতে পারছি না।
স্পর্শ আমার থুতনিতে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করলো। আমি ব্যাথা চোখ মুখ কুঁচকে নিলাম।
কাব্যের ধাক্কা খেয়ে আমি থুতনিতে ও আঘাত পেয়েছি।

স্পর্শ আবার জিজ্ঞেস করতে আমায় সব বলতেই হলো। আমি কান্না করে দিলাম। স্পর্শ কে এক এক করে সব বললাম। অন্ধকারে তার রিয়াকশণ টা আমি বুঝতে পারলাম না। স্পর্শ আমার কথা শেষ হতেই দাঁড়িয়ে পরলো। আর আচমকা আমাকে কোলে তুলে নিল। আমি চমকে উঠে তার গলা জড়িয়ে ধরলাম।

স্পর্শ আমাকে নিয়ে সামনের সিটে বসিয়ে দিল। এবার আমি তার মুখ দেখলাম। খুব গম্ভীর লাগছে‌ তাকে। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি স্পর্শ। আমার শাড়ি খুলে বিচ্ছিরি অবস্থা। আমি কাচুমাচু মুখ করে শাড়ি পেঁচিয়ে বসে আছি। স্পর্শ নিজের সিটে বসে পরলো। তারপর পেছন থেকে ফার্স্ট এইড বক্স এনে আমার থুতনি ও হাতের ব্যান্ডেজ করে দিল। আমি ধুকপুক বুক নিয়ে তাকিয়ে আছি তার দিকে। আর ব্যাথায় কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম।

‘ আর কোথায় আঘাত পেয়েছো বের কর।’

আমি লজ্জায় হাঁটুর কথা বললাম না।

‘ আর পাইনি।’

স্পর্শ আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, ‘সিউর?

আমি ঢোক গিলে মাথা নাড়ালাম। স্পর্শ আমার চোখের দিকে চোখ রেখেই বলল,

‘ মিথ্যা কথা আমি পছন্দ করিনা। নেক্সট টাইম আমাকে মিথ্যা বলার সাহস করবে না।’

বলেই স্পর্শ আমার পা টেনে ধরলো। আর আমি কিছু বলার আগেই শাড়ি তুলে ফেলল। আমি লজ্জায় নিচের দিকে তাকিয়ে আছি। স্পর্শ আমার আঘাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
চামড়া ছুলে গেছে সত্যি। স্পর্শ সেখানেও মলম লাগিয়ে দিল।
তারপর একবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সরে এলো। আমি জরোসরো হয়ে বসে আছি। স্পর্শ এক মনে ড্রাইভ করছে। হঠাৎ আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। এটা তো বাড়ি যাওয়ার রাস্তা না। এটা কোথায় যাচ্ছে। এটা তো আমার শশুর বাড়ির রাস্তা।

আমি আমতা আমতা করে স্পর্শকে জিজ্ঞেস করেই বসলাম, ‘ আপনাদের বাসায় যাচ্ছেন কেন?’

স্পর্শ সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই উওর দিল, ‘ কারণ আমরা সেখানেই যাব এখন।’

‘ আমি তাহলে বাসায় যাব কখন?’

‘ আজ আর বাসায় যাওয়া হবে না তোমার। কাল আমি তোমাকে ওই বাসায় রেখে আসবো। এই অবস্থায় তোমাকে বাড়ি পাঠাচ্ছি না।’

‘ কিন্তু আব্বু আম্মু তো টেনশন করবে। আর ওই বাসায় থাকলে আব্বু রাগ করতে পারে।’

‘ সেসব আমি দেখে নেব। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।’

আমি আর বলার মতো কিছু পেলাম না। নিরবতা বিরাজ করলো আমাদের মাঝে। স্পর্শ গাড়ি পার্ক করে আমাকে কোলে তুলেই ভেতরে গেল। আমি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ছিলাম। আমাকে নামানো হলো সীফার রুমে। আমাদের পেছনে পেছনে বাসার সবাই চলে এসেছে।
আমার শরীরে ব্যান্ডেজ দেখে জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে। স্পর্শ কাউকে কিছু বলছে না। শুধু বলেছে ছোট এক্সিডেন্ট।
সবাই ব্যস্ত হয়ে পরলো আমাকে নিয়ে। আমি বিছানায় বসে আছি। স্পর্শ আমাকে সবার কাছে সীফার বিছানায় রেখে চলে গেছে। আমি চুপ করে বসে আছি। একটু পর আমার জন্য এক সেট পোশাক নিয়ে এলো স্পর্শ। সেটা এনে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘ শাড়ি পাল্টে এটা পরে নাও। আম্মু ওর খাবার টা রুমেই পাঠিয়ে দাও। পায়ে আঘাত আছে হাঁটতে পারবে না।’

‘ আচ্ছা তুই চিন্তা করিস না। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।’ স্পর্শের মা বলল।

স্পর্শ চলে গেল। স্পর্শের বড় ভাইয়ের ব‌উ মোহিনী ভাবি খাবার আনতে চলে গেল। বাকিরা ও চলে গেল আমি আস্তে আস্তে ড্রেস চেঞ্জ করে নিলাম। একদম ফিটিং হয়েছে ড্রেসটা। নীল ও সাদা রঙের থ্রি পিস টি। আমার থেকে অনেক মোটা সীফা ওর পোশাক আমার এতো ফিটিং হ‌ওয়ার কথা না। এটা তো আমার মাপের আমার জন্য কিনেছিল নাকি?
খোড়াতে খোড়াতে বাথরুমে থেকে হাত মুখ ধুয়ে এলাম। দরজা খুলতেই ফোন এনে কানে দিল শাশুড়ি মা। আব্বু লাইনে আছে। তিনি আমাকে সাবধানে থাকতে বলল। কিন্তু কন্ঠ শুনে বুঝলাম আব্বু নারাজ এখানে এসে থাকার সিদ্ধান্তে। আব্বু আমাকে বিয়ের আগে এই বাসায় আসার অনুমতি ই দিতে চাইছিল না। তবু সবার জরাজরিতে আসতে দেয় কিন্তু থাকা যাবে না বলেছে। আজ থাকতেও হচ্ছে এজন্য আব্বু রাগান্বিত কিন্তু এখন চলে এসেছি তাই কিছু বলতে পারছে না। কাল আমার খবর আছে। আমি ঢোক গিলে ফোন ফিরিয়ে দিলাম।

উনি কথা বলতে বলতে চলে গেলেন।
সীফা আর ভাবি এলো খাবারের প্লেট নিয়ে। তাদের সামনে আমার খেতে হলো। এর মাঝে আর স্পর্শের দেখা পায়নি। তিনি আর আসেন নি। আমি আগেই ঘুমিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে উঠার পর সীফার থেকে জানতে পারলাম রাতে নাকি অনেক জ্বালিয়েছে স্পর্শ ওকে। একটু পর পর নাকি আমার জ্বর চেক করতে এসেছে। আমার নাকি জ্বর এসেছিল। কিন্তু আমি কিচ্ছু টি টের পাইনি।

‘ ভাইয়া আমাকে কতো জ্বালিয়েছে জানো। সারারাত নিজেও ঘুমায়নি আমাকেও ঘুমাতে দেয়নি। শেষে বিরক্ত হয়ে বলেছি তোমার ব‌উকে তোমার রুমে নিয়ে সেবা করো আমাকে ঘুমাতে দাও।’

‘ সরি আমাকে ডাকলে না কেন। আমার তো কিছুই মনে নেই!’

‘ তুমি তাকিয়ে ছিলে তো। আর খুব জ্বর ছিল। আমি তোমার টেক কেয়ার করবো বলেছিলাম। কিন্তু ভাইয়া আমার উপর ভরসা করতে পারিনি। নিজেই তোমার মাথার কাছে বসে ছিল।’

‘ ওহ। তোমাদের খুব কষ্ট হয়েছে তাই না। আমি কাল বাসায় গেলেই ভালো হতো কিন্তু

‘ আরে মন খারাপ করছো কেন! আমি বলছি ভাইয়া তোমার কতো কেয়ার করে ভাব। একটু তেই কেমন পাগলামি করছিল।’

‘ এইটা কি তোমার ড্রেস?’

আমার পরনের থ্রি পিচ দেখিয়ে বললাম। সীফা বলল, ‘ না তো এটা আমার হতে যাবে কেন? আর আমার হলে কি তোমার হতো নাকি। আমি কতো মোটা আর তুমি একদম চিকনা। এটা তোমার‌ই ভাইয়া এনেছে। তোমার জন্য কতো ড্রেস যে কিনে রেখেছে ভাইয়া হিসেব নাই।’

আমি অবাক হয়ে সব শুনলাম। তখন‌ই স্পর্শ এলো এই রুমে। আমি দেখলাম তিনি কলেজ যাওয়ার জন্য একদম প্রস্তুত হয়ে এসেছে। আমি বসে‌ই তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম তিনি সোজা আমার সামনে এসে আমার কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখলো বোধহয়। তখন আমি চোখ সরালাম। উনার এমন হুট করেই স্পর্শ করায় লজ্জা পেলাম। উনি সীফাকে বলল,

‘ তোর কলেজ নাই আজ?’

‘ আছে ভাইয়া।’

স্পর্শ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ বিকেলে আমি তোমাকে দিয়ে আসবো। অন্য কারো সাথে যাওয়ার দরকার নাই। আর আজ কলেজে যেতে হবে না।’

তখন আমার মিষ্টি কথা মনে পরলো আমি স্পর্শ কেই বললাম, ‘ আমার এক জায়গায় যেতে হবে।’

স্পর্শ ভ্রু কুটি করে বলল, ‘ কোথায়?’

আমি মিষ্টির বাবার কথা বললাম। স্পর্শ মিষ্টির বাবার নাম্বারে কল করে আমার কথা বলালো। তিনি সুস্থ আছেন কিছুই হয়নি। ওই শয়তান কাব্য মিথ্যা বলেছিল কাল‌। মিষ্টির সাথেও কথা বললাম ও জিজ্ঞেস করলো কাব্য আমার কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করেছে নাকি ‌। আমি পরে বলবো বলে রেখে দিলাম। স্পর্শ আমাকে তার সে না আশা পযন্ত থাকার কথা বলে চলে গেল।

যাওয়ার আগে আমার দিকে তাকিয়েছিল। আর তখন আমাদের চোখাচোখি হয়ে যায়।

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here