ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_৬
.
অনিক ওর প্লেট সরিয়ে, গ্লাস হাতে এনে বললো, ‘থাকুক সমস্যা নেই, তুমি ওই চেয়ারে চলে যাও। আমি আরেকটা প্লেট দিচ্ছি।’
ইভা হাত ধুয়ে উঠতে উঠতে বললো, ‘না ভাইয়া আমি খাব না। আমার একটু শরীর খারাপ লাগছে।’
কথাটি বলেই রুমে চলে আসে ইভা। বিছানায় বসে বুক ভরে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে ছাড়ে। কেমন প্রচণ্ড নার্ভাস লাগছে। মানুষটার মধ্যে কিছু একটা আছে। শুরু থেকেই সে সামনে গেলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। হয় বেশি কথা বলছে, অথবা অতিরিক্ত বিব্রত, বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। কারণ কি? উনার চাহনিতে কিছু কি আছে? বুঝতে পারছে না। তাছাড়া এখন খাওয়ার টেবিলে এটা কি করে এলো। প্লেটে পানি-টানি ফেলে কি একটা বিচ্ছিরি অবস্থা করেছে। লোকটা কি ভাবছে কে জানে! লজ্জায় শরীরে কেমন একটা গরম স্রোত বয়ে গেল। কান দিয়ে গরম ভাপ বেরুচ্ছে। বুকে হৃৎস্পন্দন এখনও কিছুটা অস্বাভাবিক। বিছানায় শুয়ে পড়লো সে।
অনিকের ঠোঁটে এখনও হাসি লেগে আছে। যেকোনো খেলাই মানুষকে আনন্দ দেয়। তাকেও দিচ্ছে। তবুও মেয়েটি খেতে পারেনি দেখে কিছুটা খারাপ লাগছে। টেবিল পরিষ্কার করে রুমে গিয়ে সে রেডি হয়ে এসে ডাক দিল, ‘ইভা, বের হও, যেতে হবে তো।’
কোনো সাড়া পেল না। মেয়েটি ঘুমের বা অসুস্থতার ভান ধরতে পারে। তাই সে দরজায় নক দিয়ে বললো, ‘আসো তালতো বোন, দেইখো আবার বইলো না শরীর খারাপ।’
ইভা বিছানা থেকে উঠে এসে পর্দা সরালো। মিষ্টি একটা ঘ্রাণ এলো নাকে। জিন্সের প্যান্টের সঙ্গে নেভি ব্লু গেঞ্জি পরে উনি দাঁড়িয়ে আছেন। চোখের দিকে তাকায় সে। চোখ দু’টা কেমন যেন। সে আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘কি ভাইয়া?’
– ‘কই চলো।’
– ‘কোথায় যাব?’
– ‘আমার সঙ্গে ঘুরতে।’
আমতা-আমতা করে বললো,
– ‘আপু দুলাভাই বাসায় নেই। ওদের না বলে চলে যাব?’
অনিক চৌকাঠে হাত রেখে খানিক ঝুঁকে এসে রহস্য করে মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘না বলেই তো যাবে। এসব লুকিয়ে ভালো। আমাদের দু’জনেরই ব্যাপার।’
ইভা বিস্ফোরিত নয়নে মাথা তুলে তাকায়। একটু ঝুঁকে এসে উনি কথা বলছেন। লোকটাকে এত লম্বা লাগছে কেন? সে কি খুব খাঁটো? কেউ তো কোনোদিন বলেনি।
এত শঙ্কায় থেকেও কেমন যেন ভেতরের কোনো এক অচেনা, অনাবিষ্কৃত গলিতে অন্যরকম অনুভূতি হলো।
এই যে লোকটার অসভ্যের মতো আচরণ। এগুলো খুব একটা খারাপ লাগছে না কেন? ব্যক্তিত্বহীন মনে হচ্ছে না কেন?
একটা মিষ্টি ঘ্রাণ, উনার চাহনি, মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফ, লম্বা চুল, দাঁড়ানোর ভঙ্গি। এই সবকিছু মিলিয়েই উনি যে একজন মূর্তিমান সুপুরুষ। এখন যেন যাই করবেন সেটা শৈল্পিক, নান্দনিক হয়ে যাবে। ব্যক্তিত্বে এটুকুও টান পড়বে না৷ ইভার ‘ধুকপুকানি’ প্রচণ্ড বেড়ে যাচ্ছে। বসে বসে কেউ কি বুকের ভেতর ইট ভাঙছে? উনি আবার শুনে ফেলছেন না তো? শুকনো ঢোক গিলে ইভা বললো, ‘ভাইয়া আমি না হয় আপুকে কল দিয়ে বলে যাই?’
– ‘কেন আমার প্রতি বিশ্বাস, আস্থা নেই?’
কি আশ্চর্য লোক। উনার কিসের এত অধিকার? কেন সে এত আস্থা রাখবে। তালতো বোন তো আর প্রেমিকা বা স্ত্রী নয়।
– ‘কি হলো জবাব দাও, বিশ্বাস নেই?’
– ‘না সে আছে ভাইয়া।’
– ‘তাহলে চলুন।’
একা বাসাতেই তো সে। না গেলে হয়তো এভাবে বিরক্ত করবে। এরচেয়ে যাবে, রাস্তাঘাটে তো মানুষ আছে। গিয়ে দেখবে চায়টা কি উনি। সে স্বাভাবিক গলায় বললো,
– ‘আচ্ছা ভাইয়া, আপনি যান, আমি হিজাব পরে আসি।’
– ‘ওকে ঠিক আছে। আমি বাইরে আছি, দরজা লাগিয়ে তাড়াতাড়ি আসো। দেইখো এখন আবার লুকিয়ে বোনকে কল দিয়ে দিয়ো না।’
ইভার মুখ দিয়ে চলে আসছিল ‘আপনি একটা বাচাল, বেশি কথা বলেন’ তবুও নিজেকে সামলে নিল। এমনিতেই শুরু থেকে বেশি কথা বলে ফেলছে। নিজের নিয়ন্ত্রণ আর হারাতে চায় না সে।
অনিক গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। একটা রিকশা দেখে ডেকে দাঁড় করায় সে৷ ইভা চলে এলো খানিক পরই।
– ‘দরজা লাগিয়ে এসেছো তালতো বোন?’
– ‘হ্যাঁ।’
অনিক হাত দিয়ে ইশারা করে বললো, ‘উঠো।’
ইভা উঠতে গিয়ে ইতি-উতি করে। এখন কি রিকশায় একসঙ্গে বসে যেতে হবে?
অনিক নিজে আগে উঠে বললো, ‘কি হলো আসো?’
ইভা শুকনো ঢোক গিলে আস্তে আস্তে উঠে বসে। যতটুকু সম্ভব দূরত্ব রাখতে চাচ্ছে। তবুও উরুর সঙ্গে উরু, বাহুর সঙ্গে বাহু লেগে যাচ্ছে। রাতে সে গুগলে উনার নামে সার্চ দেয়ার আগেই এক বান্ধবী কল দিয়ে দেয়। সেখানে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। তাই আর জানা হয়নি। জানাটা দরকার। খুবই অদ্ভুত লাগছে লোকটাকে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কেন নিয়ে যাচ্ছে কে জানে৷ রিকশা খানিক এগোতেই অনিক একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। ইভা বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইল। অনিক ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কি কোনো অসুবিধা?’
ইভার এবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। সে যতটুকু সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো, ‘এটা কি আপনি ঠিক করেছেন? আপনি জানেন আমি ধোঁয়া সহ্য করতে পারি না।’
– ‘না পারলে এটা তোমার সমস্যা, তুমি কেন আশা করবে রাস্তাঘাটে সবকিছু তোমার সহ্যসীমার ভেতরে ঘটবে? পৃথিবী হলো মানিয়ে নেয়ার জায়গা বুঝলে?’
– ‘লেকচার দিবেন না। আপনার মুখে লেকচার মানায় না। একটা মেয়েকে পাশে রেখে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেন আপনি কেমন লোক বুঝা হয়ে গেছে।’
– ‘না, সে আমি ভালো করে জানি মেয়েরা এই কর্ম পছন্দ করবে না। কিন্তু আমি তো তোমাকে পটানোর ধান্ধা নিয়ে ঘুরছি না।’
– ‘আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন। এই রিকশা রাখুন, আমি নেমে যাব।’
অনিক সিগারেট ফেলে হাসতে হাসতে বললো, ‘আরে বসো ইভা। এই রিকশাওয়ালা ভাই আপনি যান।’
– ‘কি হয়েছে? সিগারেট ফেলে দিলেই কি শেষ? আমাকে নামিয়ে দেন।’
– ‘এবার ঠিক আছে৷ তুমি আসল রূপে ফিরে এসেছো। ওইদিনের মতো।’
– ‘এটা আমার আসল রূপ না, এটা ধৈর্যের সীমা অতিক্রম হওয়ার পরের রূপ। আমাকে নামিয়ে দিন। আপনার সঙ্গে কোথাও যাব না।’
অনিক মুচকি হেঁসে তাকিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ, তোমার মুখ লাল হয়ে গেছে। খুব রেগে আছো তাই না?’
– ‘আপনি যা করছেন তা না রাগার মতো?’
অনিক রাস্তার পাশের বড়ো ওই রেইনট্রি গাছের দিকে তাকায়। একটা কাক, কা-কা করে ডাকছে, সে আনমনে বললো,
– ‘না, যথেষ্ট রাগার মতো। শান্ত হয়ে বসো।’
ইভার রাগ কেন যেন পড়ে গেছে। তবুও রেগে আছে এমন ভঙ্গিতেই চুপচাপ বসে রইল। মিনিট তিরিশেক পর একটা বাসার সামনে এসে রিকশা থামে। নেমে পড়ে তারা। ভাড়া চুকিয়ে অনিক তাকে নিয়ে একটা বাসার কলিংবেল চাপলো। ইভা বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করলো এটা কার বাসা। কেন যাচ্ছে তারা কোনো জবাব পেল না সে। জুঁই এসে দরজা খুলে অবাক হয়ে সালাম দিয়ে বললো, ‘আসুন স্যার, আম্মু বলেছিলেন আপনি আসবেন।’
– ‘কেমন আছো তুমি?’
– ‘ভালো।’
– ‘তোমার আম্মুকে ডাক দাও।’
জুঁই মা’কে গিয়ে ডেকে নিয়ে এলো। ইভা সবার মুখের দিকে শুধু “হা” করে তাকিয়ে আছে। একজন ভদ্রমহিলা এলেন। ইভা সালাম দিল। উনি জবাব দিয়ে সোফায় বসতে বসতে বললেন, ‘কিসে পড়েন আপনি?’
– ‘অনার্স প্রথমবর্ষ।’
– ‘সন্ধ্যায় এসে পড়াতে পারবেন তো?’
– ‘জি?’
অনিক ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘উনার মেয়ে ক্লাস এইটে পড়ে। নাম জুঁই। এই যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নক কামড়াচ্ছে এই মেয়েটা। আগে ছেলে টিচার ছিল। পড়ানো রেখে গল্প-গুজব বেশি করে তাই বিদায় করে দিয়েছেন। তুমি কি তাকে সন্ধ্যায় পড়াতে পারবে এসে?’
ইভার বিস্ময়ের সীমা রইল না। কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে খুঁজে পেল না। কি আজব একটা লোক। তাকে এভাবে নিয়ে এসেছে বুঝি টিউশনির জন্য। নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে ইভা মুচকি হেঁসে বললো, ‘হ্যাঁ আন্টি পারবো।’
– ‘আমাদের এই গলিতে যাওয়ার সময় রিকশা পাওয়া যায় না। আসার সময় মিলে৷ রাতে এদিকটা হেঁটে যেতে হবে।’
কি বলবে ভেবে পেল না ইভা। রাতে কি একা যেতে আসতে অসুবিধা হবে তাও বুঝতে পারছে না। সে অনিকের মুখের দিকে তাকায়। অনিক ঘাড়ের চুলে হাত বুলিয়ে কিছু একটা ভেবে বললো, ‘পারবে সমস্যা নেই। তবে তাকে টাকা একটু বাড়িয়ে দিবেন। কারণ মেয়ে মানুষ। হেঁটে যেতে আসতে পারবে না। রিকশা ভাড়া যাবে।’
– ‘আচ্ছা সেটা দেখা যাবে।’
– ‘তাহলে এখন উঠি।’
– ‘বসুন চা-নাশতা কিছু দেই।’
– ‘না এখন উঠবো, দরকার আছে, চলো ইভা।’
দু’জন রাস্তায় এলো। রিকশা নেই। হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। ছায়াময় রাস্তা। দুইপাশে রেইনট্রি গাছ। ইভা অনিকের দিকে তাকায়। কি যেন ভাবছে লোকটা। সে আমতা-আমতা করে বললো, ‘এ কথা আগে বলতে পারতেন।’
– ‘কি কথা?’
– ‘টিউশনির জন্য নিয়ে এসেছেন।’
– ‘একটু মজা করলাম। দুই দিনের দুনিয়ায়, মজাই আসল, বাকি সব ভুয়া।’
– ‘বাকি সব ভুয়া?’
– ‘মাঝে মাঝে মনে হয় ভুয়া। একেক সময় একেকটা মাথায় আসে। মানুষের মাথা হচ্ছে আরেকটা বাজার।’
– ‘অদ্ভুত।’
হেঁটে হেঁটে গলি পেরিয়ে মেইন রাস্তায় চলে এসেছে। একটা রিকশা দেখে অনিক দাঁড় করিয়ে বললো, ‘সামনে একটা ফার্নিচারের দোকান আছে না? সেখানে যান।’
ইভা ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘ফার্নিচারের দোকানে কেন?’
– ‘কথা না বলে উঠো।’
উঠে বসলো সে পাশে। রিকশা চলছে। ইভা চোরা চাহনিতে তাকায়। লোকটা যখন কথা বলে, বলতেই থাকে, আর না বললে বিষণ্ণ দেখায়। কেমন ডুবে থাকে কি একটা ভাবনায়। সরাসরি যখন তাকায় মনে হয় ভেতর দেখে ফেলছে। অস্বস্তির সীমা থাকে না তখন। রিকশা এসে থামলো দোকানের সামনে। দু’জন নেমে পড়ে। অনিক রিকশাওয়ালাকে বললো, ‘মামা আপনি থাকেন আসছি।’
ফার্নিচারের দোকানে ঢুকে অনিক বললো, ‘একটা পড়ার টেবিল চয়েজ করো ইভা।’
ইভা তখনই বুঝতে পারলো মূল ঘটনা। তার রুমে টেবিল নেই। নিশ্চয় উনি সেজন্য এসেছে৷ কি অদ্ভুত একটা লোক। মনেই হয় না এসব ছোটখাটো বিষয় খেয়াল করেন। সে আমতা-আমতা করে বললো, ‘আপনিই দেখুন আমি এসব বুঝি না।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
অনিক একটা টেবিল দাম-দর করে নিয়ে নেয়।। ভ্যানে তুলে দিল ওরা। ভ্যান যাচ্ছে সামনে। তাদের রিকশা পিছু পিছু। অনিক ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তুমি তো বাসায় খেতে পারোনি। সামনে রেস্টুরেন্ট আছে রিকশা থামাই?’
– ‘না, বাসায় চলে যাব।’
রিকশা তবুও থামালো অনিক। তাকে বসিয়ে রেখে বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে এলো। আবার রিকশা চলতে শুরু করেছে। বাসার সামনে এসে ওর কাছে প্যাকেট আর চাবি দিয়ে বললো, ‘দরজা খুলে যাও তুমি। আমরা টেবিল নিয়ে আসছি।’
সে ভেতরে চলে গেল। ওরা টেবিল নিয়ে এলো ভেতরে৷ ইভার রুমে ফিটিং করার পর অনিক বিদায় করে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। আর বেরই হলো না। ইভা বিরিয়ানির প্যাকেট রুমে নিয়ে বসে আছে। লোকটা কিছুই বললো না। এটা কার জন্য? তার জন্য হলে তো বলে যাবে যে, ‘ইভা এটা খেয়ে নিয়ো, তোমার জন্য এনেছি’ সেরকম কিছুই বললো না। তাহলে খাবেই বা কি করে? যেরকম মানুষ হঠাৎ বলেও ফেলতে পারে, ‘কি হলো তালতো বোন, বিরিয়ানি খাওনি কোনোদিন?’
সে নিজেই প্যাকেট নিয়ে গেল অনিকের রুমের দিকে। দরজায় নক দিল। ভেতর থেকে অনিক বললো, ‘ইভা না-কি, আসো।’
ইভা ভেতরে গেল। অন্ধকার রুম। দরজা খোলায় ধার করা আলোয় কিছুটা আলোকিত হয়েছে৷ জানালাটাও বন্ধ। বদ্ধ ঘরের একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে আসছে৷ ল্যাপটপের সামনে বসে আছেন উনি। ইভা তাকিয়ে দেখে কিছু একটা লেখা হচ্ছে। তবুও বললো, কি করেন?’
– ‘এইতো লেখি।’
– ‘অন্ধকারে লিখতে হয় বুঝি?’
– ‘না, যখন যেভাবে লিখতে মন চায় লেখি। এখন আলো সহ্য হয়নি তাই বন্ধ করেছি।’
– ‘লেখার মাঝে বিরক্ত করলাম মনে হয়।’
– ‘না না, তোমার সঙ্গে এমনিতেই ভাব জমানোর ইচ্ছা আছে।’
– ‘তাই না-কি?’
– ‘হ্যাঁ, বসো। আর হাতে কি? এটা খাওনি এখনও?’
– ‘ও হ্যাঁ, এটা দিতেই এসেছি।’
– ‘এটা দেবে কেন, এটা তো তোমার জন্য।’
– ‘ও আমি ভাবলাম, কার জন্য এনেছেন।’
– ‘ঠিকই বুঝেছো তোমার জন্য এনেছি। যাইহোক এখন বিছানার দিকে বসো। এক আবছা আলো ছায়ার অন্ধকার রুমে দু’জন মানব-মানবী বসে থাকি।’
ইভা এবার আর শঙ্কিত হলো না। সে বরং ঠোঁট টিপে হেঁসে অভিনব ভঙ্গিতে বললো, ‘তা বসে কি করতে হবে শুনি?’
অনিক ল্যাপটপ থেকে চোখ সরায়। চেয়ার ইভার দিকে ঘুরিয়ে নেয়৷ আসন পেতে বসে কনুই টেবিলে রেখে কপালে দুই আঙুল ঠেকায়। খানিকক্ষণ চলে যায় এভাবে,
– ‘বাতিটা জ্বালিয়ে নাও।’
– ‘জি?’
– ‘বাতিটার সুইচ দাও।’
ইভা উঠে সুইচ টিপে বাতি জ্বালিয়ে এসে দেখে অনিক সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে ধরাচ্ছে। অস্ফুটে বললো ‘অসভ্য একটা লোক’ সেই বলাটায় ভেতর থেকে রাগের জোর পেল না। উলটো কি যেন প্রকাশ পেল। অনিক ধোঁয়া ছেড়ে বললো, ‘বসো ইভা।’
ইভা বিছানায় বসে। তারপর অনিক খানিক ভেবে বললো, ‘ভাইয়াকে কিছু বিষয়ে সাহায্য করতে পারবে না?’
– ‘কি করতে হবে?’
‘এইতো প্রতিদিন লিখে অল্প অল্প তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপে দেবো পড়তে। তুমি বলবে কেমন হয়েছে৷ বানান ভুল হলেও জানাবে। আর আমার পেইজ, গ্রুপের এডমিন দেবো তোমাকে৷ এসবে একটু সময় দিতে হবে’ এটুকু বলে থেমে সিগারেটে টান দিয়ে বললো, ‘অবশ্য আমিও তোমাকে একটা সহযোগিতা করতে হবে, সেটা হলো প্রতিদিন নিজের টিউশনি থেকে সোজা জুঁইদের বাসার সামনে গিয়ে তোমাকে আনা।’
ইভা মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘আপনি আমাকে সাহায্যের লোভ না দেখালেও করবো।’
– ‘আরেকটা কাজ আছে।’
– ‘কি?’
– ‘বিশেষ কিছু অংশ থাকে লেখায়। সেগুলো আমার সামনে বসেই পড়তে হবে। এটা একটু কঠিন। তুমি শব্দ করে পড়বে আরেকজন তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা তোমার জন্য অস্বস্তিকর হবে।’
ইভা ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘লেখকরা এরকম করে বুঝি?’
– ‘সবার ব্যাপার আলাদা। একেকজন মানুষ যেমন একেক রকম। একেকজন লেখকদের ব্যাপারও আলাদা।’
– ‘ও আচ্ছা৷ তা ব্যাপারটা কি একটু বুঝিয়ে বলুন।’
– ‘যেমন ধরো অতি দুঃখের বা খুব হাসির কোনো অংশ। সেগুলো আমার সামনে পড়বে আমি তোমার প্রতিক্রিয়া দেখবো।’
ইভা পুনরায় হেঁসে বললো, ‘আচ্ছা, তাই বলে আমি কেঁদে ফেলবো না-কি আপনার সামনে।’
– ‘না কাঁদলেও কিছুটা চেহারা দেখে বুঝা যাবে। আর তোমাকে দিয়ে এই কাজগুলো ভালো হবে।’
– ‘কিভাবে বুঝলেন?’
– ‘তা জেনে লাভ নেই। আচ্ছা তোমার ইমাজিনের অবস্থাটা একটু বুঝি। দেখি তোমার ভুল ধরার ক্ষমতা কতটুকু।’
ইভা হেঁসে বললো, ‘আচ্ছা।’
অনিক ঘাড়ের চুলে হাত বুলিয়ে আঙুলের ফাঁকে সিগারেট সহ মাউস টিপে একটা পুরাতন ফাইল বের করে। তারপর একটা লেখার অংশ দেখিয়ে বললো, ‘এই পেইজটা পড়ে বলো কি ভুল আছে।’
ইভা খুব মনযোগ দিয়ে পড়ে বললো, ‘ভুল নেই তো, সবকিছুই ঠিক আছে।’
অনিক মুচকি হেঁসে সিগারেটে টান দিয়ে বললো, ‘আবার পড়ো। পুরো ব্যাপারটা ইমাজিন করো।’
আবার পড়ে বললো,
– ‘নেই তো কোনো ভুল।’
অনিক বিছানায় গিয়ে বসে বললো,
– ‘আসো আমার পাশে বসো।’
ইভা ইতস্তত করে পাশে বসে। অনিক এবার বললো, ‘ওই লেখায় একটা দৃশ্য আছে। বাস চলছে। নায়ক নায়িকা বসে আছে। নায়িকা একপর্যায়ে নায়কের বুকে মাথা রাখে। এরকম একটা দৃশ্য আছে না?’
– ‘হ্যাঁ আছে।’
– ‘এবার আমরা দু’জন বিছানায় বসে আছি। ধরো এটা বাসের সিট। তুমি কি পারবে আমার বুকে মাথা রাখতে? বাসের সিটে যেভাবে বসা থাকে মানুষ। আমি সেভাবে বসে থাকবো।’
ইভা বিস্মিত হয়ে বললো, ‘কী বলেন এগুলো? আমি বুকে মাথা রাখবো মানে কি?’ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_৭
.
অনিক মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘আহা যা বলছি করো না, কেবল মাথাটা রাখার চেষ্টা করো।’
ইভা রাখতে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে রাখা যাচ্ছে না। সে লজ্জায় লাল হয়ে মুখে দিয়ে হেঁসে বললো, ‘আপনি হাত না বাড়িয়ে ধরলে তো হবে না।’
– ‘হাত বাড়ালেও হবে না। বাসের সিটে পাশাপাশি বসে কাঁধে বা বাহুতে মাথা রাখা যাবে, বুকে না। বুকে রাখতে গেলে কোলে মাথা পড়ে যাবে। এটাই হলো ইমাজিনের বিষয়। কোনো জায়গায় এরকম ভুল হলেও তুমি আমাকে ধরে দিতে হবে। পারবে না?’
– ‘কিভাবে পারব, আমি তো এগুলো কখনও করিনি।’
অনিক বিছানা থেকে উঠে চেয়ারে গিয়ে বললো, ‘বাদ দাও, তোমার এগুলোর ভুল ধরা লাগবে না৷ তুমি শুধু অনুভূতি জানাবে আর বানান ভুল হয় কি-না বলবে। আর গ্রুপে একটু সময় দিতে হবে।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তা যে উপন্যাস লিখছেন সেটা কিসের?’
– ‘এটা ত্রিভুজ প্রেমের। উপন্যাসের নাম “ছন্দহীন কবিতা” তোমার হোয়াটসঅ্যাপের নাম্বার দাও আমি অল্প অল্প করে লিখে পাঠাবো তোমাকে। প্রতিদিন পড়ে জানাবে আমায়।’
ইভা নাম্বার দিল। অনিক নাম্বার নিয়ে বললো, ‘আচ্ছা এখন তুমি যেতে পারো, আর এই বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে যাও।’
– ‘না থাক, আপনি খান।’
– ‘আহা ইভা, নাও এটা৷ তুমি খেতে পারোনি আগে, নিয়ে যাও।’
ইভা ইতস্তত করে প্যাকেট নিয়ে বাইরে গিয়ে আবার ফিরে এসে বললো, ‘না ভাইয়া, বাসের সিটে বসে বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে প্রায় নাটক-মুভিতেই দেখি। আপনার ভুল হচ্ছে৷ আর আমাকেও কনফিউজড করে ফেলেছেন।’
অনিক মাথা তুলে তাকিয়ে বললো, ‘কিভাবে? পাশাপাশি বসে বুকে কিভাবে মাথা রাখবে?’
– ‘সিটে দু’জন আগ-পিছ হয়ে বসবে। ধরুন মেয়েটা একটু সমানে আর ছেলেটা সিটে হেলান দিয়ে বসে মেয়েটির পিঠের দিকে হাত নিয়ে বসলে বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে পারবে।’
অনিক চোখবুজে দুই আঙুলে কপাল ঘষে বললো, ‘ব্যাপারটা মাথায় তালগোল পাকিয়ে গেছে। আসলেই তো মনে হচ্ছে বসা যায়। কিন্তু কিভাবে হবে। মাথা ছেলেটার বুকে না রেখে, হাতে রাখা লাগবে হয়তো।’
– ‘না না বুকে হেলান দিয়েই ঘুমানো যায় এরকম।’
– ‘কনফিউজড করে দিয়েছো আমায়। এবার প্র্যাক্টিকালি পরীক্ষা করার জন্য মানুষ কোথায় পাই বলো তো?’
ইভা মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেঁসে ফেলে। ক’গোছা দলছুট চুল চলে আসে ওর কপালে।
.
পদ্য উঠানে জলচৌকিতে বসে বাবার পায়ের নখ কেটে দিচ্ছে। মতিন মাস্টার খালি গায়ে চেয়ারে বসে আছেন। বয়স হয়েছে বেশ। শরীরে বাতও আছে বোধহয়। ভোরে পা ফেলতে গেলে ব্যথা টের পান৷ প্রায়ই ফুলে থাকে পাতা। পদ্য আজ ভোরে বাবাকে গোসল করিয়ে এনে রোদে চেয়ারে বসিয়ে গায়ে তেল দিয়েছে। তখন খেয়াল হলো উনার হাত-পায়ের নখ বেশ লম্বা হয়েছে৷ কেটে দেয়া দরকার। মতিন মাস্টার বারংবার নিষেধ করলেন, ‘গোসলের পর নখ কাটতে হয় নারে মা।’ কে শুনে কার কথা। মেয়েরা এমনিতেই বুড়ো বাবাদের জন্য মাস্টারনি হয়ে যায়৷ এই মেয়ে তো আবার সত্যিকারের মাস্টারনি। তাই চুপ করে বসে আছেন। পায়ের নখ কাটার পর তিনি বললেন, ‘মা এবার হাতের নখ আমিই পারবো। তোর স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে, তুই চলে যা।’
– ‘হ্যাঁ বাবা, আমি যাচ্ছি। তুমিও ঘরে যাও। রোদ বেড়েছে বেশ।’
তখনই রাস্তা দিয়ে বের হলেন অনিকের বাবা মিরাজুল চৌধুরী। চুল-দাড়ি সব সাদা। ফতোয়ার সঙ্গে লুঙ্গি পরনে। মতিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি অবস্থা মাস্টার ভাই, পদ্য মা’র সেবাযত্নে ভালোই আছো মনে হচ্ছে।’
– ‘হ্যাঁ, কোথায় যাচ্ছ?’
‘জমিতে লোক লাগিয়েছি একটু দেখতে যাব’ বলে তিনি চলে গেলেন।
মনিসা আর পদ্য স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হলো সাড়ে নয়টার দিকে। এলাকার ভেতরের রাস্তা পেরিয়ে আসতেই দুইপাশে জমি-জমা। চাষিরা ধান খেতে কাজ করছে। খানিকদূর যেতেই একটা জমি দেখিয়ে মনিসা বললো, ‘আপু এই জমিতে এত পাখি কেন?
পদ্য সেদিকে তাকায়। একটা জমিতে শালিক, কালো ফিঙে, আর কাক ঝাঁকে ঝাঁকে এসে বসেছে৷ কিছু কিছু উড়াউড়ি, মা*রামা*রিও করছে। পদ্য পরনের হালকা সবুজ সিল্কের শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে বললো, ‘পাখিগুলো পোকা-মাকড় খেতে এসেছে। জমিতে লাঙল চালানোর পর মাটি যে উঠে। তার সঙ্গে অনেক পোকা বের হয়।’
– ‘ও আচ্ছা বুঝতে পারছি।’
দু’জন গল্প করতে করতে খেয়াঘাটের কাছে চলে আসে৷ পদ্যের থেকে বিদায় নিয়ে মনিসা চলে গেল সেদিকে। সে একা একা হাঁটছে। খানিক দূর যেতেই দেখে বাইকে বসে আছে লিটন। ক’দিন থেকে ওর বাড়াবাড়ি সীমা ছাড়িয়ে গেছে। গতকাল কথা না বাড়িয়ে চলে যাচ্ছিল পদ্য। তখনই পেছন থেকে শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো। মানুষের হাতেরও একটা ভীতি ভাঙার ব্যাপার আছে। একবার ভেঙে গেলে হাত বারবার চলতে শুরু করে। পদ্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে লিটনকে একটা শিক্ষা দেবে। মোটামুটি প্রস্তুত নিয়েই সে এগিয়ে গেল। তাকে দেখেই লিটন বসা থেকে উঠেই বললো, ‘পইদ্য কি খবর তোমার। শরীর-গতর ভালানি? অবশ্য ভালা থাকার কথা না, তালা-চাবিও ব্যবহার না কইরা ফেলে রাখলে জং ধইরা যায়।’
বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো ছেলেটা গেইম খেলতে খেলতে ফিক করে হেঁসে বললো, ‘হ ভাই, একেবারে সত্য কথা কইছেন আপার জং ধরছে মনে অয়।’
পদ্য বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে লিটনকে বললো, ‘তা তুমি কি আমার শরীরের খোঁজ-খবর নেবার জন্য রোজ এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকো?’
– ‘কি যে কও পইদ্য। এইখানে বসে মোবাইলে গেইম খেলতেছিলাম। তুমি আইলা তাই ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতেছি।’
– ‘এই জায়গায়ই কেন? আর নেই?’
– ‘এই জায়গায় ছায়া আছে। আশেপাশে মানুষ নাই। আরামে খেলন যায়।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে, খেলো গিয়ে। এবার আমার পথ ছাড়ো।’
– ‘তোমার শরীরের অবস্থাটা কইলা না তো।’
‘সেটা তো তোমরাই বলে ফেলেছো। জং ধরছে’ বলেই পদ্য চলে যাচ্ছিল। লিটন বাঁ হাতটা ধরে ফেললো ওর। বিস্ফোরিত নয়নে পদ্য তাকিয়ে বললো, ‘হাত ছাড় লিটন।’
– ‘রাগ করলা নাকি পইদ্য। জং ধরলে আমি ছাড়িয়ে নিব৷ সমস্যা কি কও? নাম্বার দিয়া যাও। রাইতে তোমাদের বাড়ির পেছনে আইসা কল দিমু। একটা কাক-পক্ষীও জানবো না, কসম পইদ্য। যা হওয়ার আমাদের মাঝে হইব। বিয়ে-শাদি করো নাই…।’
লিটন কথা শেষ করতে পারলো না। আচমকা তার গালে তীব্র একটা ব্যথা অনুভব হলো। পদ্যকে ছেড়ে গালে হাত দিতেই মুঠো ভরে গেল তার লাল টকটকে উষ্ণ র*ক্তে। পদ্য মুচকি হেঁসে বললো, ‘নে আবার হাত ধর।’
লিটন দুই কদম পেছনে গিয়ে বললো, ‘পইদ্য তোমার সাহস দেইখা অবাক হইলাম। কাজটা কিন্তু ভালা করো নাই।’
বাইকের ছেলেটা বললো, ‘ভাই গালে রক্ত কেন? কি হইছে?’
পদ্য ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কিরে চ্যাংড়া, তুইও কি হাত ধরবি? আয়, ধর এসে।’
ছেলেটি তাকিয়ে দেখে পদ্যের আঙুলের ফাঁকে একটা ধারালো ব্লেড। সে তাকিয়ে লিটনকে বললো, ‘ব্লেড দিয়া টান দিছে না-কি ভাই?
লিটন পদ্যের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘দুই টাকার ব্লেড দিয়া ডাকাডাকি করতেছো? আসলে কি করমু জানো? বেশি সাহস ভালা না।’
– ‘আমি তো সাহস দেখাচ্ছি না। তোর হাতে তো আমি ধরিনি। আর ভয় পাব কিসের? মুখে এ*সিড মা*রবি? ধ*র্ষন করবি? একই বিষয়ের জন্য তুই ভয় পাচ্ছিস না কেন? ধর আমাকে তুই হাত ধরতে এসেছিস। আমি এ*সিড মে*রে দিলাম।’
– ‘এসব পাকনামি কথাবার্তা বাইর করে ফেলবো কিন্তু, ব্লেড দিয়া…।’ ( ব্যবহারে অযোগ্য)
– ‘পারবি না লিটন, এই যে গালে টান খেয়েছিস এটা বোনাস দিলাম। তুই আমাকে অন্য মেয়েদের মতো ভেবে ভুল করেছিস। তোর আরও শাস্তি বাকি আছে। ভালো হয়ে যা।’
লিটন তেড়ে আসবে পদ্য তখন মুচকি হেঁসে বললো, ‘জায়গাটা যতটা নির্জন ভাবিস ততটা এখন না লিটন। খেত-খামারের সময়। মানুষ আশেপাশে আছে। একটু চিল্লা-চিল্লি করলে সবাই ছুটে চলে আসবে।’
লিটন গালে হাত চেপে ধরে রাগে ফুঁসছে। সঙ্গে থাকা ছেলেটি লিটনকে টেনে বাইকে তুলে নিয়ে চলে গেল। পদ্য টিস্যু দিয়ে ব্লেড মুছে পুনরায় প্যাঁচিয়ে ভ্যানিটিব্যাগে রেখে দিয়ে হাঁটতে থাকে। খানিকটা ভয় করছে৷ গাল কি একটু বেশি কেটে গেল? ঘাড়ে টান দিতে গিয়ে হাতটা গালে লেগে গেছে৷ ইচ্ছা ছিল ধারালো ব্লেড আঙুলের ফাঁকে থাকবে৷ আজ হাত ধরলে আলগোছে ছুঁয়ে দেবে ঘাড়ে। এখন খেত-খামারের সময়। তাই শিক্ষাটা এখন দিলে লিটন কিছুই করতে পারবে না৷ লোকজন আশেপাশে আছে। গলা ছাড়লেই ছুটে আসবে মানুষ। কিন্তু আনাড়ি হাত গিয়ে লেগে গেল গালে। হাঁটতে হাঁটতে পদ্য স্কুলে এলো। অফিসে হেডস্যারের সামনে সভাপতি বসে আছেন। পদ্য বেশ খুশি হলো। এমনিতেই মনির সাহেবকে সে হেডস্যারের মাধ্যমে খবর দিতো। লিটনের গাল কাটায় ভয় হচ্ছে। ঝামেলা হতে পারে। সালাম দিয়ে অফিসে ঢুকলো পদ্য। তারপর চেয়ার টেনে বসে বললো,
– ‘মনির চাচা, আপনাকে আমি খবর দিতাম। এখন পেয়ে গেছি।’
– ‘কেন মা, কি দরকার?’
– ‘আসলে স্কুলে আসা যাওয়াই আমার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত একটা বছর থেকে চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে লিটন আমাকে রাস্তায় বিরক্ত করে। কিছুদিন থেকে তার বাড়াবাড়িটা অনেক বেড়ে গেছে৷ গতকাল শাড়ি টেনে ধরেছে। আজ আবার হাত ধরে আঁটকে দিয়েছিল। আর অশালীন কথাবার্তা তো আছেই।’
– ‘বলো কি মা, এগুলো আগে বলোনি কেন?’
– ‘হেডস্যারকে বলেছিলাম। উনি বললেন এগুলো নিয়ে কথা বললে আরও বাড়াবাড়ি করবে। এরচেয়ে এড়িয়ে যাও৷ বাড়িতেও বলিনি। বুঝেনই তো চিন্তা করবেন তারা।’
– ‘আচ্ছা আমি ওর বাবাকে জানাবো।’
– ‘আপনার নাম্বারটা দিন চাচা আমাকে। আমি যাওয়া-আসার রাস্তায় অসুবিধা দেখলে কল দেবো আপনাকে।’
– ‘আচ্ছা নাম্বার নাও, তবে রাস্তাঘাটে হাত ধরে টানাটানি করে ফেলে মগের মুল্লুক না-কি। তোমার আরও আগেই বলা দরকার ছিল। আমি দেখছি ব্যাপারটা। তোমার বাবার নাম্বারটাও দাও।’
পদ্য আমতা-আমতা করছে। বাবাকে জানাতে চাচ্ছে না সে। তবুও নাম্বারটা দিল। সভাপতি সাহেব বের হয়ে গেলেন।
স্বাভাবিকভাবেই ক্লাস করছে। আড়াইটার দিকে দেখে স্কুলের সামনে বেশ কয়েজন মানুষ জমে গেছেন। মিরাজুল ইসলাম এবং তার বাবাকেও দেখা যাচ্ছে। চেয়ারম্যান এবং সভাপতি সাহেব অফিসে ঢুকছেন৷ খানিক পর বাইকে লিটনও তার সঙ্গী আবিরকে নিয়ে এলো। পদ্যের বুকে “ধুকপুকানি” বেড়ে গেছে। বিষয়টা বড়ো হয়ে গেল কি-না কে জানে। স্কুল ছুটি দিয়ে দিলেন হেডস্যার৷ তাকে অফিসে ডাকা হলো। লিটন আর আবির দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে আছে৷ তাদের পেছনে বিশ্ব মানচিত্র। বাকিদের দপ্তরি এনে চেয়ার দিয়েছে৷ সে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো৷ সভাপতি মনির সাহেব বললেন, ‘পদ্য মা, আমি গিয়েছিলাম চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে৷ সবকিছু খুলে বলার পর উনি ছেলেকে কল দিয়ে বাড়িতে আনলেন। তারপর দেখি তার গালে বেন্ডেজ। জিজ্ঞেস করার পর বলে মুখ কামাতে গিয়ে কেটে গিয়েছিল। তারপর তোমার বিষয়টা যখন বলেছি। তখন আবির বললো ঘটনাটা। তুমি না-কি গালে ব্লেড দিয়ে টান দিয়েছো?’
পদ্যের হাতের আঙুলগুলো ঘেমে গেছে। ভয় পেলে তার এরকম হয়। আমতা-আমতা করে বললো, ‘হ্যাঁ চাচা আমি গাল কেটেছি ওর।’
সবাই বিস্মিত হয়ে তাকায় ওর দিকে। সভাপতি সাহেব আবার বললেন, ‘তাহলে সকালে সেটা আমাকে বললে না কেন?’
– ‘আসলে চাচা আমি ভেবেছিলাম এটা মানুষ শুনলে লিটনের জন্য অসুবিধা হবে। তাই গোপন রাখতে চেয়েছিলাম।’
পদ্য আসলেই সেটা ভেবেছিল। তার ধারণা ছিল ব্যাপারটা গোপন রাখবে লিটন। কারণ একটা মেয়ে গাল কেটে দিয়েছে, কেন দিয়েছে, কিভাবে দিয়েছে? এসব তার জন্যই লজ্জার। তাই কাউকে বলবে না। কিন্তু সামনে এসে গেল ব্যাপারটা। চেয়ারম্যান সাহেব ঝাঁঝালো কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘মানুষ শুনলে ওর অসুবিধা হবে এটা বুঝো, তাহলে মেয়ে মানুষ হয়ে এই কাজ করতে গেলে কেন? ব্লেড দিয়ে তার গালে টান মারলে কেন?’
– ‘আমি চেয়েছিলাম ঘাড়ের দিকে দেবো। গালে লেগে যাবে ভাবিনি। তাছাড়া আমার হাত ধরলে ছাড়াবো কিভাবে আমি?’
– ‘তুমি ব্লেড নিয়ে ঘুরেছো কেন তাহলে? নিশ্চয় তোমার আগেই প্লান ছিল।’
সভাপতি কথাটায় ধরলেন। তিনি প্রতিবাদ করে বললেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেব, সেদিকে গিয়ে লাভ নেই। আমি ব্যাপারটা এপর্যন্ত এনেছি কেন জানেন? কারণ মনে হয়েছে বিষয়টা হেলাফেলা করলে যদি মেয়েটির কোনো ক্ষতি হয়। যেহেতু সে লিটনকে আঘাত করেছে। তাই লিটন কোনো ঝামেলা করতে পারে। সেই আশংকা থেকে আমি ডেকেছি সবাইকে। এখন পদ্যের পিছে আমাদের লেগে লাভ নেই। তার শাড়ি ধরে একদিন টেনেছে। সে তার বুদ্ধিতে যা ধরছে সেটাই করছে। ব্লেড নিয়ে হয়তো বের হয়েছে৷ হাত ধরছে টান দিয়ে দিয়েছে৷ এখন আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন। ওই রাস্তায় তার কি? প্রতিদিন সেখানে কেন যায়, আরেকজনের মেয়ের শাড়ির আঁচল কেন ধরে, হাত কেন ধরে? এগুলো জিজ্ঞেস করুন।’
মিরাজুল ইসলামও সহমত জানিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ এসব নিয়ে কথা বলেন চেয়ারম্যান সাহেব। মেয়েটাকে যেন আর বিরক্ত না করে। গালে টান দিয়েছে বলে জেদ করে যদি সে আর কিছু করে তাহলে তো সমস্যা। আর আপনার ছেলে এসব করে বেড়ায় কেন?’
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,
– ‘আর গালে যে ব্লেড দিয়ে টান দিল সেটার কি বলবেন? সে আগে বিচার দিতে পারতো। গাল কেটে এসে সভাপতি বললো। এটা কেমন কাজ?’
পদ্যের বাবা ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেব, সেটার জন্য আমার মেয়ে ক্ষমা চাইবে, আমিও চাইব৷ অপরাধ কতটুকু খুঁজব না৷ আপনি আমার মেয়ের নিশ্চয়তার আলাপ করেন। যাতে তাকে আর বিরক্ত না করা হয়। আপনি বুঝতে পারছেন, আপনার ছেলে রাস্তাঘাটে হাত ধরে, শাড়ির আঁচল ধরে টানে। এসব কি?’
সভাপতি সায় দিয়ে বললেন, ‘আপনার ছেলেকে ওই রাস্তায় যাওয়াও নিষেধ করেন।’
লিটন গমগমে গলায় বললো, ‘ওই রাস্তা কারও বাপের না।’
চেয়ারম্যান সাহেব উঠে গিয়ে ছেলেকে চ*ড়-থা*প্পড় মারতে শুরু করলেন। ফিরিয়ে আনলেন মনির সাহেব। তারপর লিটনকে বললেন, ‘তুমি রাস্তায় থাকো বা যেখানেই থাকো। এই মেয়ের কোনো ক্ষতি হলে তোমার দোষ। তাছাড়া কোনো অশালীন কথা বললে এলাকার মুরব্বিদেরও জানিয়ে বসতে বাধ্য হব।’
চেয়ারম্যান সাহেব শান্ত হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে আমি ব্যাপারটা দেখবো। আর এখানেই শেষ করে দিন এই আলাপ।’
আরও খানিক্ষণ কথাবার্তা শেষে পদ্য বাড়িতে চলে আসে। এই ঘটনার মূল প্রভাবটা পড়লো অন্য জায়গায়৷ মনিরা বেগম চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। মতিন মাস্টারও। তারা পদ্যের বিয়ের জন্য আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অবিবাহিত মেয়ে ঘরে নিয়ে জীবন-যাপন যে আরও কঠিন। সেটা যেন এই ঘটনা তাদেরকে আবারও স্বরণ করিয়ে দিল।
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম