ছন্দহীন পদ্য পর্ব -৩০+৩১

ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_৩০
.
সময়টা বিকেল। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। সূর্যের আলো মেঘে পড়ায় অদ্ভুত ছায়াময় লাগছে পৃথিবী। আজকাল আবহাওয়াও যেন ভীষণ বিগড়ে গেছে। শীতের ঋতুতে বৃষ্টির পসরা সাজিয়ে।
খেয়াঘাটের সেই তাল গাছের নিচে অনিক দাঁড়িয়ে আছে। সারাক্ষণ বাইক নিয়ে ঘুরলেও এখন সঙ্গে নেই। খেয়া নদীর মাঝখানে। পদ্যরা গ্রামে ফিরে আসছে আজ। সঙ্গে আসছে নাঈম এবং আফরা। পদ্যের গায়ে একটা বেগুনি রঙের শাল। পুরোপুরি কী বেগুনি? খানিকটা কালচে যেন। রঙটা কেনার সময়ও ঠিক ধরতে পারেনি সে৷ পদ্য নৌকায় দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে তাকাচ্ছে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। শালটা অনিক কিনে দিয়ে এসেছিল। শুধু শাল নয়৷ একটা ড্রেসও। সেদিন পদ্য আর অনিক ফেরার পথে মিরাজুল সাহেব হঠাৎ তাকে কল দেন। অবাক হয় দু’জন। অনেক্ষণ এটা-ওটা নিয়ে কথা বলার একপর্যায়ে বললেন সে কবে বাড়ি ফিরবে। অনিক জানায় আজই। মিরাজুল সাহেব তখন বললেন তুমি থাকো আজ। আমি কাল আসবো, দরকার আছে। পদ্য বুঝতে পারছিল না কী হবে। খানিকটা ভয় করছিল। কিন্তু অনিক দুশ্চিন্তাকে এড়িয়ে গিয়ে বললো শপিংমলে চলো। সেখানে গিয়ে ড্রেস কিনলো। পদ্য নিষেধ করেও আঁটকে রাখতে পারলো না। কিন্তু শাল কেনার সময় নিষেধের পাশাপাশি হাসাহাসিও করলো। অনিকের কেন যেন মনে হচ্ছিল পদ্যকে শালে ভীষণ সুন্দর লাগবে। পছন্দসই পাচ্ছিল না। তবুও এই শালটা কেনা। অবশেষে পদ্যের গায়ে উঠেছে। ভীষণ ভালো লাগছে তার। শালে পদ্যের মাঝে কেমন আভিজাত্য ভাব ফুটিয়ে তুলেছে। নাঈম এবং আফরা গ্রামে আসার পেছনে একটা কারণ আছে। সেদিন মিরাজুল সাহেব যাওয়ার পর সন্ধ্যায় সিটিং রুমে সবাইকে ডেকে এনে বসেছিলেন। উপস্থিত ছিলেন না শুধু মনিসা আর মতিন সাহেব৷ কিন্তু কথা বেশিদূর এগুতে পারেনি৷ মতিন সাহেব অস্পষ্ট গলায় মনিসাকে বললেন, ‘ওরা কোথায় এত কথা বলে?’

মনিসা বললো, ‘সিটিং রুমে সবাই।’

– ‘কেন?’

– ‘অনিক ভাই আর পদ্য আপুকে নিয়ে কী যেন কথা হচ্ছে। আমাকে সরিয়ে দিয়েছে ওরা।’

– ‘আমাকে নিয়ে চল।’

মনিসা ইতস্তত করছিল। তবুও বাবাকে পিঠের দিকে ঠেলে তুলে বসিয়ে ধরে ধরে নিয়ে এলো৷ সবাই তখন বসা। তাকে দেখে তখন চুপ হয়ে গেল৷ মনিরা বেগম চেঁচিয়ে উঠলেন মনিসার দিকে, ‘এই মেয়ে, মাথায় কি গোবর ভরা? তোর বাপকে এখানে নিয়ে আসছিস কেন?’

মতিন সাহেব সচল হাতটি তুলে থামতে বলে সোফায় বসলেন, তারপর অস্পষ্ট গলায় মিরাজুল সাহেবকে বললেন, ‘কী নিয়ে কথা হচ্ছে।’

– ‘মাস্টার ভাই আপনি অসুস্থ মানুষ। আপনি যান, ভাবি তো আছেন।’

তিনি পুনরায় বললেন, ‘পদ্য আর অনিকের বিষয়ে?’

মনিরা বেগম বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই বইলা তোমার চিন্তা করতে হবে না। বিয়ে যেটা ঠিক আছে তুমি সুস্থ হইলে সেটাই হইব। সমাজ নিয়া চলা লাগবে আমাদের।’

মতিন সাহেব পুনরায় তাকে হাত তুলে থামিয়ে মিরাজুল সাহেবকে বললেন, ‘আল্লাহর রহমতে ভালোর দিকে আছে শরীর। আমি সুস্থ হয়ে বাড়িতে যাই। তারপর কথা বলবো। আর তুমি ঘটকের সাথে দেখা হলে বলবে আমি অসুস্থ। বিয়ের ব্যাপারে বাড়িতে গিয়ে কথা বলবো।’

কেউ তখন আর কোনো কথা বলতে যায়নি৷ তবুও মনিরা বেগম বললেন, ‘তুমি সুস্থ হয়ে গেলেই বিয়ে করবে বলছে তো পদ্য। তাহলে বাড়িতে গিয়ে নতুন করে কী কথা?’

মতিন সাহেব বললেন, ‘বিয়ে তো ভেঙে দিচ্ছি না। সুস্থ হয়ে বাড়ি যাই। ওদের সাথে আগে কথা বলবো। এখন বাদ দাও।’

মিরাজুল সাহেব তখন মেনে নিয়ে বললেন, ‘এ কী! মাস্টার ভাই দেখছি জানেন এসব। তাহলে উনি সুস্থ হওয়ার পর কথা হবে। অনিক শুনলে তো। পাগলামি করো না। উনি তোমার স্যারও হন বুঝলে? সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলে উনিই কথা বলবেন। এখন বাড়ি যাও, কোনো রকম ঝামেলা যেন না হয়। এগুলো লজ্জার বিষয়।’

অনিক মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিল।
এখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা। পরেরদিন বাবার সঙ্গে বাড়িতে চলে আসে। পদ্যের সাথে রোজই কথা হয়। আজ সপ্তাহ খানেক পর ওরা বাড়ি ফিরছে। তার বাবা খেয়াঘাটে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে কেউ আসতে বলেনি। তবুও সে এসেছে। আসাটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ শুধু তো পদ্য আসছে না। তার ভাই ভাবিও আসছে। তবুও কেমন ইতস্তত করছে। তাই তাল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। নৌকা ঘাটে ভিড়েছে। আফরা ভাবি আর মনিসা নেমে পড়েছে। ব্যাগ-প্যাক আছে৷ সে কী যাবে? না যাওয়ার তো আসলে কিছু নেই। সে জানে ওরা আসবে তাই নিতে এসেছে। অনিক ধীরে ধীরে গেল সেদিকে৷ নাঈমকে বললো, ‘ভাইয়া ব্যাগগুলো দাও আমার কাছে।’
নাঈম ব্যাগ নিজে নিয়ে বললো, ‘তুই স্যারকে ধরে নামা। ব্যাগ আমি আর আব্বা নিতে পারবো।’

অনিক নৌকায় উঠে গিয়ে মতিন সাহেবকে সালাম করে বললো, ‘আসুন স্যার।’

মনিরা বেগম তার আগে হাত ধরে বললেন, ‘লাগবে না অনিক। আমি নামাতে পারব।’

অনিক নেমে এলো। দেখা গেল তার কোনো কিছুই করা লাগছে না। মনিসা মিটমিট হাসছে শুধু তার দিকে চেয়ে৷ মেয়েটা সবকিছু জেনে গেছে৷ জানার পর তার মতামত কী আসলে? ছোটদের সবকিছু নিয়ে যে একটা নিজস্ব মতামত বা ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকে বড়রা আসলে জানে না। সে পিছু পিছু এসে রাস্তায় উঠলো। পদ্য আর আফরা গল্প করতে করতে যাচ্ছে। তাকে বিশেষ খেয়াল করছে বলে মনে হচ্ছে না। স্বস্তির ব্যাপার হলো মতিন সাহেবকে পুরোপুরি সুস্থ দেখা যাচ্ছে। মনিরা বেগমকে ধরে হাঁটছেন। কথা বলছেন। খানিক পর সে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ টিউন শুনলো৷ মোবাইল বের করে দেখে পদ্যের মেসেজ, ‘এই তুমি খেয়াঘাটে না এলে হত না? এখন তো সবাই জানে আমাদের ব্যাপারটা। একটুও লজ্জা লাগে না?’

– ‘তোমরা আসবে জানি, তবুও আমি নিতে আসবো না?’

– ‘আফরা ভাবি যে তোমার উপর রেগে আছে তুমি কী বুঝতে পারছো?’

– ‘না তো, কেন?’

– ‘তুমি বাড়ি ফিরে একদিনও উনাকে কল মেসেজ দাওনি৷ সকল খবর শুধু আমার কাছ থেকে নিয়েছো।’

– ‘তাইতো, আমি তো সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলার ধান্ধায় ছিলাম।’

– ‘আর নৌকা থেকে নামার পর নাকি সারাক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে?’

– ‘কে বলছে?’

– ‘আফরা ভাবি।’

– ‘কী যে বলো। আমি স্যারকে নামিয়ে আনতে চলে গেলাম। নাঈম ভাইকে বললাম ব্যাগ-প্যাক দিতে।’

– ‘মিথ্যে বলবে না। আমিও খেয়াল করেছি। বারবার তাকাচ্ছিলে।’

– ‘আমি তো সবার দিকেই তাকাচ্ছিলাম, কী জানি।’

– ‘ছেলে মানুষ আসলেই প্রেমে পড়লে বোকা বোকা হয়ে যায়।’

– ‘তাই না-কি? আর আমি তো নতুন তোমার প্রেমে পড়িনি।’

– ‘নতুন না পড়লেও নতুন প্রেম পেয়েছো।’

– ‘তা ঠিক।’

– ‘পিছু পিছু হাঁটছো কেন। সামনের দিকে যাও। নাঈম ভাইয়ের হাত থেকে ব্যাগ নাও। এরকম বোকা বোকা লাগছে কেন তোমাকে? এরকম হলে সবার সঙ্গে আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে যুক্তি-তর্ক করবে কীভাবে?’

– ‘আরে না চিন্তা করো না। তোমার ভালোবাসা পেয়ে শান্ত হয়ে গেছি। ছিনিয়ে নিতে চাইলে কেউ। আবার অশান্ত হয়ে যাব।’

– ‘তুমি ভালোবাসা পেয়েছো বুঝি?’

– ‘হ্যাঁ, তুমি যেদিন থেকে বলেছো ভালোবাসো সেদিন থেকেই পেয়ে গেছি।’

– ‘এটাকে ভালোবাসা বলে?’

– ‘কী জানি?’

– ‘তুমি না লেখক? জানো না কেন?’

– ‘তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় প্রেমিক হয়ে যাই।’

– ‘মোবাইল রাখো। নাঈম ভাইয়ের কাছ থেকে ব্যাগ নিয়ে যাও।’

– ‘ব্যাগ হাতে নিয়ে আমি আবার পেছনে চলে আসবো।’

– ‘কেন?’

– ‘পিছু থেকে তোমাকে দেখা যায়। শালের উপর দিয়ে চুল পিঠে এসে পড়েছে। কী যে সুন্দর লাগছে।’

– ‘লজ্জা করে না? লোকে দেখলে কী বলবে।’

– ‘রাখো তোমার লজ্জা-শরম। অনিক লোকের বলাবলিকে গোনায় ধরে না।’

– ‘এইতো ফর্মে ফিরেছো। তোমার এই ডোন্ট কেয়ার ভাবটা কেমন চলে গেছে মনে হচ্ছিল।’

– ‘সারাক্ষণ তুমি তুমি পায়। তাই কেমন শান্ত হয়ে যাচ্ছি।’

– ‘আচ্ছা যাও ব্যাগটা নাও।’

– ‘ও হ্যাঁ যাচ্ছি।’

অনিক তাড়াতাড়ি সামনে গিয়ে ‘আমার কাছে একটা দাও ভাইয়া’ বলে নাঈমের হাতে থেকে ব্যাগ নিয়ে পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে রইল। পদ্য চোখ দিয়ে ইশারা করছে চলে যেতে। সে উলটো এসে আফরার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বললো, ‘ভাবি তুমি গ্রামে আসছো কি যে খুশি লাগছে।’

– ‘আমি এসেছি বলে? না-কি অন্যকেউ? আমার মুখ খারাপ করবে না অনিক। এখনই ভুলে গেছো। বউ পেলে তো একেবারে শেষ।’

– ‘মুখ খারাপ করলেও সমস্যা নেই ভাবি। তোমার মুখে খারাপও ভালো লাগবে। একটু খারাপ করো প্লিজ।’

– ‘পাম্প দিয়ো না।’

– ‘আচ্ছা কোনো কারণে রাগ করেছো তো? সেটার শাস্তি যা ইচ্ছা দিয়ো, শাস্তির জায়গা এবং সময় বলবো?’

– ‘বলো।’

– ‘যেদিন চাঁদনি রাত হবে ওই যে দেখছো। ওই নদীর পাড়ে। রাতে তোমাকে নিয়ে আসবো। বাইকে আসতে পারো অথবা হেঁটে।’

– ‘ওখানে কী?’

– ‘অদ্ভুত একটা জায়গা। চাঁদের আলোয় সবুজ ধানক্ষেত চিকচিক করে। আর উপরে জোনাক পোকায় ভরে যায়। একেবারে নদী থেকে জমি পর্যন্ত। কী যে সুন্দর লাগে।’

পদ্য ফিক করে হেঁসে বললো, ‘বিশ্বাস করো না ভাবি।’

– ‘কী বিশ্বাস করবো না।’

অনিক সঙ্গে সঙ্গে কথা ঘুরিয়ে বললো, ‘ওই নিয়ে আসবো যে বলেছি সেটা বিশ্বাস না করতে বলছে। সত্যিই নিয়ে আসবো।’

পদ্য আবার হাসলো। কিন্তু কিছু আর বললো না৷ আফরা মুচকি হেঁসে বললো, ‘তাহলে তোমার শাস্তি মাফ। আমাকে গ্রামে নিয়ে এভাবে ঘুরে-বেড়াতে হবে।’

– ‘আচ্ছা এবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দাও।’

– ‘আরে কী বলো মানুষ দেখবে।’

– ‘মানুষের দেখাকে অনিক পাত্তা দেয় না, তুমি দিলে দিতে পারো।’

আফরা মুচকি হেঁসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বাড়িতে এলো তারা তিনজন গল্প করতে করতেই। ব্যাপারটা সবার কাছে দৃষ্টিকটু লাগবে বুঝতে পারলেও অনিক কোনো পাত্তা দিল না। তবে বাড়ির রাস্তায় এসে সবাই পদ্যদের ঘরের দিকে গেলেও সে চলে গেল তাদের বাড়িতে। আফরা আর নাঈম এলো খানিক পর। দুই বাড়িতে কেমন প্রাণ ফিরে এসেছে যেন। একটা উৎসব উৎসব ভাব। রাতটা এভাবেই চলে গেল৷ রাতে পদ্যের সঙ্গে চ্যাটে টুকটাক কথা হলো। তার রুমটা দোতলার দক্ষিণে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে এক অদ্ভুত অনুভূতি হলো। পদ্য বাড়িতে আছে৷ তাদের এখন সম্পর্ক স্বাভাবিক। কেমন যেন ছোটবেলায় ফিরে গেল সে। জানালা খুলে দিল। আকাশ দেখা যাচ্ছে। কুয়াশা তেমন নেই৷ একটা কোলো ফিঙে পদ্যদের টিনে বসে আছে।
পদ্য ঘুম থেকে উঠে চাপাকলে মুখ ধুতে আসবে। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাবে ওকে৷ এমন অদ্ভুত সুন্দর কেন পৃথিবী?
কিন্তু কখন মুখ ধুতে আসবে কে জানে।
সকাল সাতটা অবধি সে বারবার জানালার কাছে গিয়ে উঁকি দিল। এখনও উঠেনি ঘুম থেকে? মোরগের ডাক শোনা যাচ্ছে। হাওরে মেশিনের ডাক। সে অধৈর্য হয়ে মেসেজ দিল, ‘এই আমি জানালার সঙ্গে কী লেপটে থাকবো এখন? বারবার উঁকি দিচ্ছি৷ তুমি কখন মুখ ধুতে বের হবে? এভাবে তাকিয়ে থাকতে পারবো না। বের হওয়ার আগে মিসকল দিয়ো। দেইখো আবার পুকুরে চলে যেও না। চাপাকলে মুখ ধুতে এসো।’

মিসকল পেল সে সাড়ে সাতটার দিকে৷ তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে পর্দা ফাঁক করে তাকায়। কিন্তু অবাক হওয়ার পাশাপাশি, আশাহত হলো। রোদ নেই, বৃষ্টি নেই, পদ্য ছাতা হাতে নিয়ে উত্তরদিকে রেখে বের হয়েছে। পা ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পদ্যের নির্মম এই রসিকতায় তার রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। নিজেকে আড়াল রেখে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে চলে গেল। অনিক রাগে পায়চারি করে খানিক পর মেসেজ দিল হোয়াটসঅ্যাপে, ‘পদ্য এটা কী হলো? আমি ভোর থেকে জানালা দিয়ে তাকাচ্ছি। তুমি আসবে, তখন দেখবো৷ অথচ বৃষ্টি নাই রোদ নাই ছাতা হাতে বের হয়েছো!’

পদ্য বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে খিলখিল করে একা একা হাসছে। অনিককে মিসকল দেয়ার পর হঠাৎ ছাতা নিয়ে যাওয়ার এই দুষ্টুমিটা মাথায় এসেছিল। সপ্তাহ খানেক থেকে ক্রমশই কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে সে। নিজেকে কেমন খুকি খুকি লাগছে আজকাল। বয়স কী হুট করে কমে গেছে অনেক? সে নিজেই নিজের মতি-গতি বুঝতে পারছে না৷ তার দুশ্চিন্তা হওয়ার কথা। বাবা মেনে নিবেন কি-না এখনও শিওর জানে না। তবুও কেন যেন সেটা নিয়ে তেমন ভাবে না। মানুষ হয়তো একটা বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন দুশ্চিন্তা করতে পারে না৷ সেটাকে এক সময় পাশ কাটিয়ে চলতে শুরু করে। অবশ্য অনিকও একটা কারণ থাকতে পারে। সপ্তাহ খানেক থেকে তাদের চ্যাটে কথা হয়। তাদের প্রণয়কাল বলতে এই সপ্তাহ খানেক হলো৷ এতদিন দু’জনের কথা হয়নি। অনিক সব সময় বলে চিন্তা করো না। ওরা আসুক বাড়িতে। দেখি কী বলে। আমার পদ্মফুলকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না৷ দেখবে ঠিকই তোমাকে আমার করে নিব। পদ্য এই কথাগুলো বিশ্বাস করে নিয়েছে হয়তো, অথবা বিশ্বাস করতে চায়। অবশ্য সে তো একবার পরিবারকে বলেই দিয়েছিল অনিকের কথা। তারপর বাবা হঠাৎ স্ট্রোক করায় দূর্বল হয়ে গিয়েছিল। উনার সুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কী সেই ভয় ক্রমশই কেটে গেছে? জানা নেই। পদ্য নিজেও ঠিক জানে না। মানব মন নিয়ে ঠিকঠাক কিছুই জানা যায় না।
অনিক পুনরায় মেসেজ দিল, ‘তুমি আসলেই একটা নির্দয় মেয়ে৷ নিজে মিসকল দিয়ে জানান দিলে বের হচ্ছ। অথচ দেখা দাওনি।’
পদ্য মেসেজগুলো দেখে হাসি আঁটকে রাখতে পারছে না। সে চুল ঠিক করে প্রসঙ্গ পালটে বললো, ‘তোমার জানালা থেকে আমার ফুল গাছগুলো দেখা যায়, তাই না? আমি লাগিয়েছিলাম। এতদিন যত্ন করাও হয়নি।’

– ‘দেখেছি, কিন্তু তুমি আবার ফুলের যত্ন কী করবে? তুমি একটা রোবট মানবী। ফুল গাছের যত্ন করার আগে মানুষকে যত্ন করা শিখতে হয়।’

পদ্য আবার হাসলো। তখনই মনিরা বেগম এসে বললেন, ‘একা একা হাসতাছিস কেন। নাশতা কর আইসা।’

‘পরে কথা হবে’ বলে পদ্য মোবাইল রেখে উঠে চলে এলো। মতিন সাহেব বিছানায় বসে আছেন। পদ্য রুটি ডালভাজি নিয়ে বাবার পাশে এসে বসে বললো, ‘আব্বা বাইরে গিয়েছিলে?’

– ‘না মা।’

– ‘আমি নাশতা করে নিয়ে যাব। হাঁটাচলায় থাকলে ভালো।’

মনিরা বেগম চা এনে দিয়ে বললেন, ‘তোমার আর আহ্লাদ দেখানো লাগবে না। গোসল-টোসল কইরা স্কুলে যাও।’

মতিন সাহেব ধমক দিয়ে বললেন, ‘তুমি মেয়েটার সঙ্গে সারাক্ষণ ক্যাটক্যাট করো কেন বলো তো?’

– ‘আর আহ্লাদ কইরো না। ওর কারণেই এতকিছু হইল।’

– ‘মনিরা এসব কথা কেন বলো। আল্লাহ রোগ দিয়েছেন, আল্লাহ নিছেন, শেষ। তুমি আমার মা’টার দিকে তাকিয়ে দেখো। আমি সুস্থ হয়ে যাচ্ছি দেখে সে কত হাসি-খুশি থাকে এখন। কিছুদিন থেকে দেখছো ওর চেহারা-ছবি পালটে গেছে।’

‘এসব ঢং দেখলে গা জ্বলে’ বলে মনিরা বেগম রান্নাঘরে চলে গেলেন।
আফরা এলো তখনই। মনিসা উঠে গিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ভাবি এসেছে।’

মতিন সাহেব বসতে বললেন। আফরা আমতা-আমতা করে বললো, ‘আসছি চাচা’ তারপর পদ্যকে পাশের রুমে ডাকলো। পদ্য চা হাতে নিয়ে পিছু পিছু গেল।

আফরা ফিসফিস করে বললো, ‘এই চিঠি অনিক দিয়েছে।’

পদ্য ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘এটা কেমন ঢং! মোবাইল থাকতে চিঠি পাঠাতে হবে কেন।’

– ‘প্রেমপত্র না ম্যাডাম। চিঠি নাও আর হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাক করো। অনিক মেসেজে বিস্তারিত বলবে।’

পদ্য মাথা নাড়লো। আফরা মতিন সাহেবের পাশে গিয়ে বসে বললো, ‘চাচা শরীর কেমন লাগছে?’

– ‘ভালো মা। মনিরা ওকে নাশতা দাও।’

– ‘না না চাচা আমি খেয়ে এসেছি।’

– ‘তারপরও খাও মা। তোমাদের কত কষ্ট দিয়ে এলাম।’

– ‘এসব কিছু না চাচা। আপনি তো নাঈমদের আপন চাচার মতো।’

– ‘হ্যাঁ মা তা ঠিক বলেছো।’

– ‘আচ্চা আন্টি শুধু চা দিয়ে দেন। আর কিছু খাব না।’

মনিরা বেগম চা নিয়ে এলেন।

পদ্য হোয়াটসঅ্যাপে অনিকের মেসেজ চ্যাক করলো, ‘পদ্য তুমি হঠাৎ করে ‘পরে কথা বলছি’ বলে উধাও হয়ে গেলে কেন। জরুরি একটা বিষয় আছে। আমি তোমার হয়ে কিছু কথা লিখেছি স্যারের জন্য। এটা তুমি পড়ে নিজের হাতে আবার আরেকটা কাগজে লিখে নিয়ো। কোনো কিছু এড করতে চাইলে করতে পারো।’

পদ্য কাগজ না পড়েই মেসেজ দিল, ‘তা কেন?’

অনিকের হয়তো ফোন কাছেই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে টাইপিং দেখায়। মেসেজ আসে পলকেই, ‘দরকার আছে, তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো স্যারকে দাও। কারণ এখন যা বুঝেছি স্যারই আসল। স্যার মেনে নিলে তোমার দিকের বিপদ কেটে যাবে। আব্বাকে রাজি করিয়ে নিব। ওরা যখন আমাকে ডাকবে সবকিছু তো স্যারের সামনে আমি বলতে পারবো না। তাছাড়া উনি অসুস্থ৷ তাই চিঠিই ভালো৷ চিঠিটা তুমি দেবে। মানে তুমিই লিখেছো এমন আরকি।’

– ‘কিন্ত আমি তো বলেছি আব্বা যা বলে তাই।’

– ‘কাগজেও সেরকম লেখা। এটা পড়লে আমার ধারণা স্যার কিছুটা নরম হবেন। তুমি পড়ে দেখতে পারো।’

– ‘আচ্ছা স্কুল থেকে এসে আরেকটা কাগজে লেখার আগে পড়বো।’

– ‘ও হ্যাঁ, তুমি তো স্কুলে যাবে৷ তাহলে আমি ঘরে বসে আছি কেন। খেয়াঘাটের দিকে আগে গিয়ে বসে থাকি।’

– ‘কী বলো? লোকে দেখলে কী বলবে।’

– ‘আমি তো আগে চলে যাব।’

– ‘বেশি বাড়াবাড়ি করো না, শেষে লিটনের মতো গাল কে*টে দেবো।’

– ‘বুঝিনি, লিটনের মতো গাল কে*টে দেবো মানে কী?’

– ‘কেন গ্রামে আছো জানো না?’

– ‘গ্রামে কেউ আমার সাথে কথা বলে না-কি তেমন।’

– ‘তাহলে সত্যিই জানো না?’

– ‘না তো, কোন লিটন, কী হয়েছে?’

– ‘আমি বোরখা পরে কেন যেতাম স্কুলে?’

– ‘আমি কীভাবে জানবো।’

– ‘আচ্ছা থাক জানা লাগবে না।’

– ‘এই বলো।’

পদ্য মুচকি হেঁসে ডাটা অফ করে দিল। রাস্তায় গিয়ে শিওর দাঁড়িয়ে থাকবে পাগলটা। তখন বলা যাবে।
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলামছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_৩১
.
পদ্য উঠানে এসে আকাশের দিকে তাকায়। ঝকঝকে নীল আকাশ। শীতের সকাল, তবুও আজ তেমন কুয়াশা নেই। একটা চিল পালক না নেড়ে চক্রাকারে ঘুরছে। এই দৃশ্য কয়েক মাস আগে প্রথম খেয়াল করেছিল সে। এখন প্রায়ই দেখে। আগে দেখতে পায়নি কেন? না-কি দেখলেও খেয়াল করেনি? হেঁটে হেঁটে উঠানের মাথায় এসে মনে হলো শাল নেয়ার কোনো মানে হয় না। আজ তেমন শীত নেই। চনমনে রোদ উঠেছে। মনিসা তখন বুকে বই জড়িয়ে ধরে বের হয়ে, ‘আপু আমাকে রেখে চলে যাচ্ছ কেন।’ বলে তাড়াতাড়ি কাছাকাছি এলো।
পদ্য তখন শালটা খুলে ওর কাছে দিয়ে বললো, ‘রেখে আয়।’

মনিসা দাঁত কটমট করে তাকিয়ে শাল হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে রেখে এলো। পদ্য পুকুর পাড় পেরিয়ে রাস্তায় চলে এসেছে। মিনিট তিরিশেক আগে অনিকের বাইকের শব্দ শুনেছিল। কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে। মনিসা কাছাকাছি এসে বললো, ‘আপু অনিক ভাইয়ের আম্মু বলতো তুমি আর অনিক ভাই সারাক্ষণ এক সঙ্গে থাকতে। এখন দেখি আসেই না। তোমরাও কথা বলো না।’

– ‘কানমলা খেতে না চাইলে চুপ থাক।’

– ‘আমি কিন্তু সব জানি।’

ভ্রু কুঁচকে পদ্য বললো, ‘কী জানিস?’

– ‘কিছু না।’

পদ্য আর কিছু বললো না। মনিসা পুনরায় বললো, ‘তোমার যার সাথে বিয়ে ঠিক হইছে তার ছবি আমি দেখেছি। একটুও পছন্দ হয়নি।’

পদ্য এবারও চুপ। মনিসা পুনরায় বললো, ‘অনিক ভাইই ভালো। আব্বা-আম্মা কেন যে মানে না বুঝি না।’

পদ্য ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘অনিককে ভালো লাগে?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তুই তো দেখলাম সারাক্ষণ নাঈম ভাইয়ের সাথে গল্প করিস। অনিকের সাথে তো কথা বলতেই দেখিনি।’

– ‘উনাকে লজ্জা লাগে।’

পদ্য মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘লজ্জা?’

– ‘হ্যাঁ।’

হেঁটে হেঁটে তারা খেয়াঘাটের কাছাকাছি চলে আসে। মনিসা আঙুল তুলে বলে, ‘ওই দেখো অনিক ভাই দাঁড়িয়ে আছে।’
পদ্য ওর আগেই দেখেছে। তাল গাছের নিচে একটা বাইকে বসে আছে অনিক। জিন্স প্যান্ট, কেডস আর হাত লম্বা একটা কফি কালারের গেঞ্জি পরনে। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। পদ্যকেও হঠাৎ দেখে ফেলে সে৷ পলকে সিগারেট ফেলে পায়ের নিচে পিষে নিল। সঙ্গে মনিসা থাকায় হতাশ হলেও মাথায় বুদ্ধি এলো দ্রুত। ওরা কাছে আসতেই ফোন কানে লাগিয়ে বললো, ‘হ্যাঁ আসছি আসছি’ ফোন কানে নিয়েই বাইক রেখেই রাস্তায় উঠে এসে মনিসাকে বললো, ‘স্কুলে যাচ্ছ মনিসা?’

– ‘হ্যাঁ, ভাইয়া।’

অনিক আবার ফোনে, ‘হ্যাঁ এইতো আসছি’ বলে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসে খেয়াল হলো খেয়াঘাট থেকে আর দেখা যাচ্ছে না। পদ্য আস্তে-আস্তে হেঁটে আসছে৷ আজ বোরখা নেই। সেলোয়ার-কামিজ। মাথায় ওড়না। বয়স কেমন কম লাগছে। পদ্য কাছাকাছি এসে বললো, ‘নাটক করে আসলেও মনিসা ঠিকই বুঝবে।’

– ‘তা বুঝলে বুঝুক। হাঁটো তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।’

পদ্য কিছু না বলে শ্লথ পায়ে হাঁটছে। অনিক চারদিকে তাকিয়ে বললো, ‘এদিকটা অনেক নির্জন তাই না? দুইপাশে গাছ থাকায় ভালোও লাগে।’

– ‘হ্যাঁ, এখানেই গাল কেটে দিয়েছিলাম লিটনের। তুমি যেভাবে পিছু নিতে শুরু করেছো তোমাকেও কিছু একটা করতে হবে।’

– ‘হ্যাঁ এখন বলো তো৷ কোন লিটনের গাল কেটে দিয়েছো?’

– ‘চেয়ারম্যানের ছেলে লিটন।’

– ‘তাই না-কি? তাহলে তো আব্বা খুশি হয়েছিল মনে হয়। ঘটনা কী বলো তো।’

– ‘অন্যসময় বলা যাবে, এখন যাও। লোকে দেখবে।’

– ‘আরে দেখুক তাতে কী।’

– ‘যেতে বলছি যাও। না হলে সত্যিই দেবো কেটে।’

– ‘কীভাবে কাটবে?’

– ‘ব্লেড দিয়ে।’

আর আমি ব্লেড ছাড়াই কেটে দেবো। পদ্য ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘বাজে ইঙ্গিত করবে না একদম। যাও তো এখান থেকে।’

– ‘একা একা যাবে না-কি?’

– ‘আমি তো রোজই একা যাই। সত্যিই চলে যাও তুমি। বুঝতে পারছো না স্কুলে পড়াই আমি। বিয়ে হয়ে গেলে ভিন্ন বিষয়।’

অনিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আচ্ছা যাচ্ছি, আর চাপাকলে ছাতা নিয়ে গিয়েছিলে কেন?’

পদ্য মুচকি হেঁসে বললো, ‘হঠাৎ পর্দা করতে মন চাইছিল।’

– ‘ও হ্যাঁ, আর তুমি না বোরখা পরে স্কুলে আসতে। আজ বোরখা ছাড়া যে?’

– ‘এই তোমার পেটের ভেতরে এত কথা কেন? যাও তো। চ্যাটেও তো কথা বলা যাবে, যাও।’

অনিক মলিন মুখে বললো, ‘আচ্ছা যাচ্ছি, কিন্তু কেমন যেন শুকনো মুখে চলে যাচ্ছি মনে হচ্ছে।’

– ‘তোমার মতলবটা কী বলো তো?’

– ‘কমপক্ষে হাতটা তো একবার ধরতে দেবে।’

– ‘গ্রামের রাস্তাঘাটে এসব কী বলো। তাছাড়া ওইদিন গাড়িতে আমি অনেক ইমোশনাল ছিলাম। তাই বলে ভেবো না বিয়ের আগে আমি এখন শুধু এগুলো করে বেড়াবো। যাও তো এখন।’

অনিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘তাহলে একটা কাজ করবে?’

– ‘কী?’

অনিক অ্যাশ কালারের একটা রুমাল পকেট থেকে বের করে দিয়ে বললো, ‘এটা ধোয়ার পর আর ব্যবহার করা হয়নি। তুমি এখন নিয়ে হাত, মুখ, ঘাড় আর গলা মুছে দাও।’

– ‘আশ্চর্য! কেন?’

– ‘তাড়াতাড়ি দাও তো, বিয়ের আগপর্যন্ত তোমাকে আর স্পর্শও করবো না। শুধু এভাবে ডেইলি এই রুমাল ইউজ করে ফেরত দেবে। আমি রাতে আবার ধুয়ে রাখবো। আবার ভোরে ইউজ করে দেবে।’

– ‘পাগলামি করো না, যাও তো।’

– ‘এটুকুও দেবে না আমায়?’

পদ্য ওর দিকে তাকিয়ে রুমাল টান দিয়ে নিয়ে সত্যি সত্যিই মুখ, হাত আর গলা মুছে ফেরত দিল। অনিক রাস্তার মাঝখানে রুমাল মুখে রেখে দাঁড়ায়, তারপর দুই হাত পকেটে পুরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে খানিক্ষণ বুকভরে শ্বাস নেয়। পদ্য তাকিয়ে থাকে। আকাশের দিকে মুখ তুলে থাকায় ওর ফরসা গলা কেমন টানটান হয়ে আছে। পকেটে হাত রেখে দাঁড়িয়ে থাকায় ইচ্ছা করছে মানুষটাকে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখতে। পদ্যের বুকটা কেমন শিরশির করছে। চোখ নামিয়ে, নিজেকে সামলে নিয়ে ‘আমি যাচ্ছি’ বলে মাথা নীচু করে হাঁটতে থাকে। বিকেলে যখন স্কুল থেকে ফিরেছে। পুকুর পাড়ে এসে দেখে অনিক ছাদের রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁ হাতের কবজিতে সেই রুমালটা বাঁধা। তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই রুমালে চুমু খেল। পদ্য আঁতকে উঠে আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ আছে কি-না। তারপর দাঁত কটমট করে তাকিয়ে ঘরে চলে আসে।

হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়া-দাওয়ার শেষে হোয়াটসঅ্যাপে দেখে অনিক মেসেজ দিয়েছে, ‘পদ্য তুমি তাড়াতাড়ি স্যারকে কাগজ দাও। আব্বা আমাকে সন্ধ্যায় তোমাদের ঘরে যেতে বলেছে। আজ কথা বলবে ওরা।’

পদ্য রিপ্লাই না দিয়ে কাগজটা বের করে পড়লো। পড়ে মনে হলো মুখে হোক বা কাগজে। এরকম কিছু কথা তার বলতেই হবে। ভয় বা লজ্জা পেয়ে তো কাজ হবে না। অনিককে তো তার পেতেই হবে। পদ্য মনিসার খাতা এনে একটা পৃষ্ঠায় নিজের মতো লিখতে শুরু করে। লিখতে গিয়ে অনিকের লেখা থেকে অনেককিছু পরিবর্তন হয়ে আরও বড়ো হয়ে গেল। তারপর পৃষ্ঠা ছিঁড়ে মুঠোয় নেয়। গলা কেমন শুকিয়ে আসছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বারান্দায় গেল। মতিন সাহেব সেখানে চেয়ারে একা বসে আছেন। পদ্য কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, ‘কিছু বলবি মা?’

– ‘হ্যাঁ আব্বা, তুমি অসুস্থ তাই বলতে পারছি না। লজ্জাও লাগে। না বলেও কোনো উপায় নেই। তাই একটা কাগজে লিখে আনলাম।’

তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘দে তো দেখি।’

পদ্য কাগজটা বাবার হাতে দিয়ে চলে গেল। মতিন সাহেব চেয়ারে বসে পৃষ্ঠা খুলে পড়তে লাগলেন,

“আব্বা আগেই বলে রাখছি। লেখাটি পড়ে তোমার উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ কোনোকিছুই তোমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে নয়। তুমি চাইলে আমি তোমার ঠিক করা পাত্রের কাছেই বিয়ে বসতে রাজি। সুতরাং তুমি শান্ত থাকো। সবকিছু তোমার বিবেচনার উপরেই আছে। আমি শুধু চাই, তুমি যাতে সিদ্ধান্তটা আরও ভেবে-চিন্তে নিতে পারো।
আব্বা, অনিক আর আমার ব্যাপারটা তুমি স্ট্রোক করার আগেরদিন শুনলেও মিরাজুল চাচা অনেক আগে থেকে জানেন। আমিও অনিককে কখনও প্রশ্রয় দেইনি। একপর্যায়ে সেও আর কখনও সামনে আসেনি।
আজ এত বছর পর বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে সে বিয়ে করতে চাচ্ছে। বিয়ে করতে চাওয়া তো অপরাধ নয়। তোমরা তো আমাকে একটা জায়গায় বিয়ে দেবেই। সেই বিয়েটা অনিকের সঙ্গে হলে আমি খুশিই হবো এবং মনে করি ভালো থাকবো। এখন নিশ্চয় ভাবছো অনিক আমার ছোটো। কিন্তু আব্বা বয়সে-ছোটো বড়ো কী আসলেই কোনো সমস্যা? আমাদের ধর্মে, রাষ্ট্রে কী অসম বিয়েতে কোনো বাঁধা আছে? যদি নাইই থাকে তাহলে কেন আমি আমার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করতে পারবো না? শুধুমাত্র সমাজের লোক হাসাহাসি করবে বলে কী তোমার মেয়েকে তুমি আজীবন কাঁদাতে চাও? অনিক আমাকে কত ভালোবাসে জানো আব্বা? বিয়ের খবর শুনে পাগল হয়ে গিয়েছিল। গ্রামে এসে একদিন দেখাও করেছিল। মিরাজুল চাচার পরামর্শে আমি তাড়িয়েও দিয়েছিলাম। এরপর আর আসেনি। কিন্তু একা একা ঠিকই কষ্ট পেয়েছে। জব ছেড়েছে। পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছে৷ আচ্ছা আব্বা, আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা বাদ দাও। অবিভাবকরা বিয়ে দিতে হলে কী দেখে? পাত্র মানুষ হিসাবে কেমন, তার চরিত্র কেমন, আর্থিক অবস্থা, শিক্ষা-দীক্ষা। এগুলোই তো? এসব বিবেচনা করলেও কী তোমাদের ঠিক করা পাত্রকে রেখে অনিকের কাছে বিয়ে দেয়া উচিত নয়? অনিক আমার কারণে জব ছেড়েছে, আবার চেষ্টা করলে পাবে। ওর প্রতি বছর ২-৩ টা করে বই বের হয়৷ সেগুলো ভালো সাড়াও পায়। তার ফিউচারও ব্রাইট। তাহলে কেন তোমরা বিয়ে দেবে না? সমাজের লোকের জন্য? শুধু মাত্র বয়সে ছোট বলে? আব্বা দুনিয়ায় আগে-পরে আসা কী আমাদের হাতে? বয়সে ছোটো হওয়া কী অনিকের অপরাধ? না-কি বড়ো হওয়া আমার অপরাধ? এই সমাজে কী ডিভোর্সি নারী বয়সে ছোটো ছেলেকে বিয়ে করে না? বড়ো ছেলে মারা গেলে বাপ কী ছোটো ছেলের কাছে তার ভাবিকে বিয়ে দেয় না? তখন তো সমস্যা হয় না। তাহলে অবিবাহিত অবস্থায় কেন সমস্যা হবে? হ্যাঁ অনিক আমাকে এক সময় আপু বলে ডাকতো। কিন্তু সেই ডাক তো শুধু একটা সম্মোধন। বয়সে ছোটো একটা অচেনা মেয়েকেও তো একটা ছেলে আপু ডাকতে পারে, পারে না আব্বা?
তাছাড়া আমাদের নবী মোহাম্মদ (সঃ) তো বয়সে বড়ো খাদিজা (রাঃ) কে বিয়ে করেছেন। ধর্মের দিক থেকেও কোনো বাঁধা নেই।
তাহলে আমাদের সঙ্গেই কেন এমন হবে আব্বা? আমি তোমার কাছে সবকিছু বিবেচনার দায়িত্ব দিয়ে দিলাম। আমি জানি আমার বাবা একজন শিক্ষক। তার বিচার-বিবেচনাও শিক্ষিত মানুষের মতো হবে। তোমার কোনো দুশ্চিন্তার কিছু নেই আব্বা। এই চিঠি পড়ার পরও যদি বলো অনিককে বিয়ে না করতে, আমি করবো না। তোমাদের ঠিক করা পাত্রকেই আমি বিয়ে করবো, সংসারও করবো। কিন্তু জেনে রেখো, আমি মন থেকে সুখী হব না। মনের সঙ্গে তো আর জোরাজুরি চলে না।এই একটা সিদ্ধান্ত তিনটা মানুষের জীবন একেবারে তছনছ করে দিতে পারে। তাই আমি চাই তুমি নিজের সিদ্ধান্তটা সবকিছু ভেবে-চিন্তে নাও আব্বা৷ চিঠির টপিকটা আমি জানি লজ্জার। কিন্তু যেখানে আমার জীবনের প্রশ্ন৷ যে বিষয়ের সঙ্গে আমার পুরো জীবন জড়িত। যেখানে আমার সবকিছু বুঝার যথেষ্ট বয়সও হয়েছে। তাই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমার কিছু কথা তোমাকে বলা দরকার বলে মনে করেছি। ভুল হলে ক্ষমা করবে।”

__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here