জঠর পর্ব ১৭+১৮

#জঠর
#পর্বঃ১৭
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

রাগে মস্তিষ্কের দু’পাশের রগরগ দপদপ করছে নায়েলের। এত বড়ো একটা অঘটন ঘটিয়ে নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে বসে আছে হৃতি। টিমেটিমে চোখে তাকিয়ে মেঝেতে পায়ের আঙুল ঘষে যাচ্ছে। নওশাদ সাহেব গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সহজ-সরল মেয়েটা এমন একটা চিন্তাতীত কাজ করে ফেলবে তা তিনি ভাবতেই পারেন নি। সায়েরাও নির্লিপ্ত। নায়েল বিক্ষিপ্ত গলায় বলে উঠে—

“বিয়ে কী ছেলে খেলা! বললেই হয়ে গেল? এইটা কী ধরনের বিয়ে?”

হৃতির মুখে রা এলো না। ওড়নার দুইপাশ কোলের মধ্যে নিয়ে শুধু চেপে যাচ্ছে। তার হা,পা কাঁপছে অনবরত। ভয়, শঙ্কায় আর লজ্জার বলয়ে আবিষ্ট হৃতি চোখ তুলেও তাকাচ্ছে না। নায়েল প্রশস্ত গলায় ঘোষণা করল—

“এই বিয়ে আমি মানি না।”

পাশে থাকা সুঠাম দেহের পুরুষটি অধরের কোণ প্রশস্ত করল। হেয়ালি চোখে তাকাল। কালো শার্ট-প্যান্টে তার উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ ধূসর আকাশে একফালি রোদ হয়ে ধরা দিচ্ছে চোখে। বাদামী বর্ণের চোখে ঘন পক্ষ্মচ্ছায়ায় নিবিড় মোহ। প্রশস্ত ললাটে পুরু ভ্রু জোড়া সুদীর্ঘ। ভরাট চোয়াল। পুরুষটি ওঠে দাঁড়াল। তার এক হাত হৃতির হাতে। হৃতিকে নিয়ে দু’কদম সামনে এগোতেই নায়েল প্রতিবাদ করে বলল—

“ওকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?”

পুরুষটি তার পুরু অধরে স্নিগ্ধ হাসির ফোয়ারা ঝরালো। তেজবিহীন স্বরে বলল—

“আমার বউ, আমি যেখানে খুশি নিয়ে যাব। যদিও রাজপ্রাসাদ নেই। গাছতলা, ব্রীজতলা কিছু তো একটা উপায় হবেই।”

নায়েল কটমটিয়ে বলল—

“ও কোথাও যাবে না।”

পুরুষটি মিষ্টি করে হাসল। প্যান্টের পকেট থেকে হাত বের করে নাকের ডগায় ঘষা মারল। স্নিগ্ধস্বরে বলল—

” বউকে ছেড়ে তো আমি কোথাও যাচ্ছি না বড়ো ভাই। আসি।”

“দাঁড়ান।”

মেয়েলি মিহি কণ্ঠে থমকে যায় পুরুষটি। অর্হিতা এসেছে। পিউলীকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছে সে। পিউলীর সামনে এমন ঘটনা ঘটুক তা কেউ চায় না। সেই সকালে বেরেয়েছিল হৃতি। ফিরেছে রাত আটটার পর। একা ফেরেনি। কাজী অফিস থেকে এক আগন্তুককে নিয়ে ফিরেছে। হৃতি তাকে চিনলেও বাড়ির আর কেউ তাকে এ জীবনে দেখেনি। অর্হিতা শান্তকণ্ঠে বলল—

“কোথাও যেতে হবে না আপনাকে। হৃতি, তোমার হাজবেন্ডকে নিয়ে ঘরে যাও।”

হৃতি চোরা চোখে নায়েলের দিকে তাকায়। ক্ষিপ্ত নায়েলের দুই চোখ দিয়ে অগ্নিনালা নির্গত হচ্ছে। হৃতি কুণ্ঠিত হয়। চলে যায় নিজের কক্ষে। বিতৃষ্ণ নওশাদ সাহেব ওঠে চলে গেলেন। সায়েরাও দাঁড়ালেন না। রণলীলা সাঙ্গ হলো। নায়েলের মেজাজ বিগড়ে গিয়েছে। অর্হিতা সান্ত্বনার সুরে বলল—

“প্লিজ, শান্ত হোন। ছোটো মানুষ ভুল করে ফেলেছে। কোথায় যাবে ও আমাদের ছেড়ে? আর ছেলেটারও তো কেউ নেই।”

নায়েল দগ্ধ গলায় বলল—

“এটাই তো। ও এত বড়ো ভুল করল কী করে? ছেলেটার কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, তার ওপর বেকার। এমন ছেলেকে ও বিয়ে করল কী করে? নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু চিন্তা হলো না ওর?”

অর্হিতা মৃদু গলায় বলল—

“সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাবা- মাকে ভাবতে হয়। না কি তারা নিজেরা চিন্তা করে তাদের কৈশোর নষ্ট করবে। সন্তান ভুল করলে বাবা-মা শুধরে দেবে, বিপদে পড়লে আশ্রয় দেবে। এই জন্যই তো পরিবার। হৃতি অজ্ঞতাবশত হোক আর প্রেমের টানেই হোক ভুল করে ফেলেছে। আমরা তো আছি। ওর পরিবার। আপনি আর এ নিয়ে চিন্তা করে নিজের শরীর খারাপ করবেন না। বাবা, খালামনি তারাও উদ্বিগ্ন এ নিয়ে। আপনি হাল ছাড়লে তাদের কী হবে?”

নায়েল শান্ত হয়। তবুও সে ক্ষুব্ধ।

বিছানার কোণে বসে আছে হৃতি। তার উরুর উপর পা তুলে সটান হয়ে শুয়ে আছে পুরুষটি। হৃতি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল—

“তুমি নায়েলের সাথে এভাবে কথা বললে কেন?”

পুরুষটি পা নামায়। ওঠে বসে। হৃতির কাছে এসে শ্বাস ফেলতেই তার নিঃসৃত উষ্ণতায় কেঁপে ওঠে হৃতি। দাঁতের সাথে দাঁত লাগিয়ে বলল—

“তোর আশিকের সাথে কথা বলেছি বলে তোর রাগ হচ্ছে?”

হৃতি তাপিত গলায় বলে উঠে—

“সুহাস! এসব কী বলছ?”

সুহাস একটানে নিজের বুকে নিয়ে নেয়ে হৃতিকে।
,
,
,
ডিভানে শরীরে এলিয়ে বসে আছে নায়েল। তার গম্ভীর, চিন্তিত, নিমগ্ন চিত্ত। স্বামীর এহেন দশায় অর্হিতার মন ক্ষুণ্ণ হয়। নায়েলের পাশে বসে তার বুকে মাথা রাখে অর্হিতা। আদুরে গলায় বলল—

“আপনি কেন এত ভাবছেন?”

অর্হিতার মাথার উপর চিবুক রাখে নায়েল। এক হাতে তাকে বুকের সাথে আলতো করে চেপে ধরে। অবিন্যস্ত চুলে হাত গলিয়ে বলল—

“ভয় হয় আমার। আর কাউকে হারাতে ইচ্ছে হয় না। হৃতি আর নিহিতার মধ্যে কোনো তফাৎ নেই আমার কাছে। ও তো আমার পিউর মতো। পুতুলের মতো কোমল। মেয়েটা কী করে এত বড়ো ভুল করল?”

“আপনি শুধু শুধু ভাবছেন। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“নিহিতাও এই ভুল করেছে। ইন্টারমিডিয়েট অব্দি দুই ভাইবোন এক ঘরে থাকতাম আমরা। অনার্সে ভর্তি হতেই আমাদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা হয়ে গেল, সাথে আমাদের ঘরও। একই কলেজে পড়া সত্ত্বেও আমার নাকের নিচেই মাহিমের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে গেল। আমি টেরও পেলাম না। তারপর বিয়ে, ডিবোর্স, পিউ! সবকিছু এত দ্রুত হলো আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। হৃতির সাথে যেন এমন কিছু না হয়। আই হোপ!”

মাথাটা কিঞ্চিৎ আলগা করে অর্হিতা। নায়েলের হৃৎকম্পন বাড়ছে। অর্হিতা বিচলিত গলায় বলল—

“শান্ত হোন নায়েল। আপনার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে।”

নায়েল নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে। অর্হিতা দুই হাতে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে।
,
,
,
খাবার টেবিলে অনুপস্থিত হৃতি। তার দরজার দিকে বারংবার তাকাচ্ছে নায়েল। হৃতি আসছে না। অর্হিতা নায়েলের উদ্বেলতা বুঝতে পেরে নিজেই এগিয়ে যায় হৃতির কক্ষের দিকে। দরজায় কড়া নেড়ে বলল—

“হৃতি, সবাই বসে আছে। খাবে এসো।”

সমাহিত হৃতির কোমল দেহের উপর থেকে সরে আসে ক্লান্ত সুহাস। তার ঘর্মাক্ত শরীর এলিয়ে দেয় বিছানার অপর পাশে। হৃতি চটপট ওঠে বসে। পড়ে থাকা জামাটা গায়ে পরে নেয় চটজলদি। এলোথেলো চুলগুলো হাত দিয়ে কোনোমতে ঠিক করে দরজা খুলে দাঁড়ায়। হৃতির ছোট্ট মুখটাই শুধু দেখতে পাচ্ছে অর্হিতা। ছোট্ট শ্বাসে বলল—

“খেতে এসো হৃতি।”

“তুমি যাও অামি আসছি।”

“হু। দেরি করো না।”

অর্হিতার টানটান ললাটে ভাঁজ পড়ে। মেয়েটাকে কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে! প্রায় মিনিট পনেরো পরেও হৃতি এলো না। রাগে টনটন করছে নায়েলের শিড়দাঁড়া। অর্হিতা রয়ে সয়ে বলল—

“হয়তো ওর হাজবেন্ড আসতে চাচ্ছে না। আপনারা খেয়ে নিন। আমি ওদের খাবারটা ঘরেই দিয়ে আসি।”

নায়েল খেঁকিয়ে ওঠে।

“ঘরে কেন খাবার দিয়ে আসবেন?”

“নায়েল, সব বিষয় নিয়ে এত ঝামেলা করলে চলে? আপনি খেয়ে নিন তো।”

নায়েল আর বসল না। খাবার ছেড়ে ওঠে চলে যায়। অর্হিতা নীরাস হয়।

কলরবকে দিয়ে হৃতির কক্ষে খাবার পাঠানো হয়। বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে আছে সুহাস।

“সুহাস উঠো। খেয়ে নাও।”

“তোকে লাইট অফ করতে বলেছি আমি।”

“খেয়ে নাও আগে। সারারাত না খেয়ে থাকবে না কি?”

খিচতি মেরে ওঠে বসে সুহাস। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হৃতির হাতের খাবারগুলো ধাক্কা মেরে ফেলে বলল—

“শালি, তোকে খেয়েছি না তাতেই পেট ভরেছে আমার! লাইট বন্ধ কর।”

হৃতি দ্রুত হাতে লাইট অফ করে দেয়। বুক ভেঙে কান্না আসে তার। এই মানুষটাকে চিনতে সে অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছে। সম্পর্কের শুরুতে এত কেয়ার, এত লাভিং আর পারফেক্ট মানুষটা হঠাৎ করেই কেমন অচেনা আগন্তুক হয়ে গেল। হৃতির কোমল মন বিষিয়ে তুলেছে তাদের প্রথম ঘনিষ্ঠতার পরেই। বান্ধবীদের প্ররোচনায় পড়ে সুহাসের সাথে তার বাসায় গিয়েছিল। আর সেদিনই অঘটন ঘটে। হৃতি বুঝতেই পারেনি সুহাস একজন চেইন স্মোকার আর সাথে ড্রাগ অ্যাডিক্টেড। শারীরিক নির্যাতনের সাথে মানসিক নির্যাতন। তাই কাউকে কিছু না বলে সে বিয়ে করে নিল। এতকিছুর পরেও সে সুহাসকে ভালোবাসে। নায়েলের প্রতি তার আবেগ এতটা ছিল না। তবে তার আদর্শ ছিল নায়েল আর সেই সাথে ভালোলাগা। কিন্তু সুহাসকে সে ভালোবেসেছে। তার সবকিছু দিয়েই ভালোবেসেছে। বিনিময়ে পেয়েছে ধোঁকা।

কার্পেট থাকার কারণে নিক্ষিপ্ত খাবারের বাটি, প্লেটের কোনো শব্দ সৃষ্টি হলো না। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে সেই খাবার কুড়াতে থাকে হৃতি। অনবরত তার চোখের কোণ হতে ঝরছে অথৈ জল।
#জঠর
#পর্বঃ১৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে পিউলী। কাউচে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে আছে সুহাস। অর্হিতা নিচে নেমে আসতেই তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল পিউলী। নরম গলায় বলল—

“মামুনি ওই আঙ্কল হৃতির আনটির ঘরে কেন থাকে?”

অর্হিতা চকচকে চোখে চেয়ে বলল—

“কারণ ওই আঙ্কলের সাথে তোমার হৃতি আনটির বিয়ে হয়েছে তাই।”

পিউলী উৎফুল্ল গলায় বলল—

“সত্যি?”

“হুম।”

“বিয়ে হলে বুঝি একসাথে থাকতে হয়?”

অর্হিতা ভ্যাবাচাকা খেয়ে যায়। হতভম্ব গলায় বলল—

“হ্যাঁ।”

“তাহলে তুমি কেন পাপার ঘরে থাকো না?”

অর্হিতা চাপা হাসে। মেয়ের গালে চুমু বসিয়ে বলল—

“কারণ আমাদের তো ছোট্ট পিউ সোনা আছে তাই। চলো, চলো স্কুলের জন্য দেরি হচ্ছে।”

অর্হিতার হাত ধরে হাঁটতে থাকে পিউলী। কিন্তু তার কৌতূহলী চাহনি সুহাসের দিকে। পিউলীর মনে হচ্ছে সে সুহাসকে এর আগে কোথাও দেখেছে। গাড়িতে বসায় পিউলীকে। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসল অর্হিতা। খানিক সময় পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে নায়েল। তার চোখে-মুখে রাগের আবছায়া। অর্হিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে কপালে ভাঁজ তুলল। নায়েল ঠাস শব্দ করে গাড়ির দরজা বন্ধ করে ভেতরে বসল।

গাড়ি চলছে স্বাভাবিক গতিতে। নায়েলের গম্ভীর, স্থির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে অর্হিতা—

“কিছু হয়েছে নায়েল?”

নায়েল বিক্ষিপ্ত গলায় বলল—

“কাল থেকে আপনার আর শাড়ি পড়ার দরকার নেই।”

অর্হিতা মুচকি হাসল। তার স্বামী জেলাসও হয়! অর্হিতা ঘাড় ঘুরিয়ে সুদূর আকাশে তাকাল। জীবন কত অদ্ভুত সুন্দর! কে জানত তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে, বিছিয়ে থাকা জীবন এত সুন্দর করে গুছানো হবে! কে জানত, মুছড়ে যাওয়া ফুলকেও কেউ তার দামি ফুলদানিতে এনে সাজাবে? অর্হিতা মনে মনে বলে, “জীবন সুন্দর! আসলেই সুন্দর। প্রয়োজন শুধু সঠিক সময় আর মানুষের। যার আগমনে জীবন তার আসল মানে খুঁজে পায়।”
,
,
,
ঘুটঘুটে আঁধারে ছেয়ে আছে নীলাভ্র। থালার মতো উঠেছে চাঁদ। তার উদ্ভাসিত আলোয় ধরণীতে নেমেছে জ্যোৎস্না। ছাদের বাউন্ডারি দেয়ালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সুহাস। আকাশ পানে চেয়ে মুখভর্তি ধোঁয়ার কুন্ডলি নির্গত করল মুখ থেকে। ঠোঁটের ভাঁজের সিগারেট তখন শোভা পাচ্ছে হাতের আঙুলের ভাঁজে। রঞ্জিত চোখ জোড়ায় তীব্র আক্রোশ। জ্বলন্ত সিগারেটের শেষাংশ নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে ধরে সুহাস। তার পেছনে এসে দাঁড়ায় সায়েরা। আবেগমাখা অসহায় গলায় বলল—

“এসব কেন করছিস সুহাস? কেন জীবনটাকে এভাবে শেষ করে ফেলছিস?”

সুহাস উপহাসমিশ্রিত হাসল। দুই হাত প্যান্টের পকেটে পুরে দৃঢ় গলায় বলল—

“কেন এসেছ? যাও এখান থেকে। কারো কোনো উপদেশের প্রয়োজন নেই আমার।”

“কেন এমন পাগলামি করছিস?

সুহাস চেঁচিয়ে ওঠে। গরগর করে বলল—

“এত চিন্তা কেন তোমার এখন? কোথায় ছিল এই চিন্তা যখন মা-বাবা জীবিত থাকতেও আমাকে এতিমখানায় কাটাতে হয়েছে? কোথায় ছিল তখন, যখন তিন বেলার জায়গায় আমাকে একবেলা খেয়ে থাকতে হয়েছে? শীতের রাতে মায়ের উষ্ণতার জন্য কাতরাতে হয়েছে। শুধু নিজের সুখের কথা ভেবেছ তোমরা। আমার কথা ভাবনি? জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। সুখের সাগরে ভাসতে টাকাওয়ালা লোককে বিয়ে করে বসলে। তোমার স্বামীও তোমার জায়গায় অন্য কাউকে নিয়ে আসলো। আর আমার জায়গা কোথায় হলো? এতিমখানায়!”

সায়েরা ডুকরে উঠলেন। স্বামীর সাথে ডিবোর্স হলে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছেন তিনি। ভাবতে পারেননি তার প্রথম স্বামী তাদের একমাত্র সন্তানকে এতিমখানায় রেখে আসবেন।

সায়েরা শ্রান্ত গলায় বললেন—

“এখানে হৃতির কী দোষ? মেয়েটাকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস?”

সুহাস বাঁকা হাসল। ক্রুর গলায় বলল—

“ওর সাথে প্রেম করতে বলেছ করেছি, বিয়ে করতে বলেছ করেছি। এখন আমার বউয়ের সাথে আমি কী করব তা আমার ব্যাপার। তা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আর চিন্তা করো না, কেউ জানবে না তুমিই আমার মা। যাও এখান থেকে, যাও।”

সায়েরা আর দাঁড়ালেন না। নিজের প্রতি ক্ষুব্ধ তিনি। তার ভুলে তার ছেলের আজ এই অবস্থা।
,
,
,
পড়ার টেবিলে মাথা দিয়ে বসে আছে হৃতি। তার মাথায় হাত রাখে অর্হিতা। চট করেই মাথা তোলে হৃতি। অর্হিতা সরস গলায় বলল—

“ঘুম পাচ্ছে?”

হৃতি ক্লান্ত হাসে। মিহি গলায় বলল—

“উঁহু। ভালো লাগছে না। সামনে পরীক্ষা। চিন্তা হচ্ছে খুব।”

অর্হিতা সাহস যুগিয়ে বলল—

“এত ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে। একটা কথা বলব?”

“বলো।”

“নায়েলের সাথে কথা বলো। তিনি আসলে তোমাকে নিয়ে অনেক চিন্তিত। ”

হৃতি মাথা নিচু করে। চোখে টলটল করে তার জলকণা। অপরাধি গলায় বলল—

“নায়েল আমাকে ক্ষমা করবে? ”

অর্হিতা সহাস্য অধরে বলল—

“কেন করবে না। কাউকে ভালোবাসা অপরাধ নয় হৃতি। কিন্তু বিয়ে! বিয়ে শুধু দুটো মানুষের একসাথে থাকা নয়। তাদের বিশ্বাস, ভরসা, একে অন্যের উপর আস্থার প্রয়োজন। আর দুটো পরিবারের মিলবন্ধন বিয়ে। মানলাম সুহাসের কেউ নেই। কিন্তু তোমার তো আছে। আর বিয়ে নিয়ে প্রতিটি মেয়ের একটা স্বপ্ন থাকে, অভিলাষ থাকে। তুমি ইচ্ছে করলেই তোমার সেই ইচ্ছে পূরণ করতে পারতে। নায়েল তোমাকে নিহিতার মতোই ভালোবাসে। ভাবোতো, যে মানুষটা নেই তাকেও প্রতি মুহূর্তে মনে করে নায়েল, সেখানে তোমাকে কতটা ভালোবাসে সে।”

“আই এম সরি অর্হিতা।”

“থাক, আর দুঃখ পেতে হবে না। নায়েলের সাথে কথা বলো। তারও ভালো লাগবে।”

“হুম।”

অর্হিতা পরিবেশে চটপটে ভাব আনতে বলল—

“চা না কফি?”

হৃতির সমস্ত কষ্ট এক নিমিষে কর্পূরের মতো উবে গেল। হাসি হাসি মুখে বলল—

“তুমি বসো আমি নিয়ে আসি।”

অর্হিতা জোরালো গলায় আপত্তি করে বলল—

“নো ওয়ে। তুমি বসো আমি নিয়ে আসছি।”

অর্হিতা মনে সন্দেহ রেখে ফের বলল—

“তোমার হাজবেন্ড কোথায়?”

“আমাকেই খুঁজছেন, ভাবীজান?”

সুহাসের অকস্মাৎ পুরুষালী কণ্ঠে অপ্রতিভ হয় অর্হিতা। দ্রুত বেরিয়ে আসে সেখান থেকে। কফি নিয়ে যখন পূণরায় হৃতির কক্ষের সামনে এসেছে তখন দরজা বন্ধ। কয়েকবার নক করেও কোনো সাড়া পেল না অর্হিতা। সায়েরা এসে দাঁড়ালেন। প্রশ্নাত্মক গলায় বললেন—

“সুহাস ভেতরে আছে?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে ওদের আর তোমাকে ডিস্টার্ব করতে হবে না।”

অর্হিতা ভ্রূ কুঞ্চন করে। সে ডিস্টার্ব করতে যাবে কেন?
কফির ট্রে টা সায়েরা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল—

“তাহলে এই কফি আপনি আর বাবা খেয়ে নিন।”

সায়েরা অপ্রস্তুত চোখে তাকাল।

স্থির হয়ে শুয়ে আছে হৃতি। তার চোখের কোণে জল। আঁধারের খেল চলছে। ঘুমন্ত সুহাস হৃতির কোমল শরীরটা কাছে টেনে নেয়। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ের তার গলায় মুখ গুঁজে। সুহাসের মোলায়েম স্পর্শে একটু আগের দেওয়া সব কষ্টই যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল হৃতির। সুহাসের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আশার আলো দেখল সে। সুহাস একদিন ঠিক বুঝতে পারবে, সে হৃতিকে সত্যিই ভালোবাসে। শুধু শরীর দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়েও।
,
,
,
জরুরি ফাইল খুঁজছে নায়েল। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অর্হিতা। অর্হিতার সতেজ দৃষ্টি। রহস্য করে বলল—

“আজ আমি আপনার ঘরে থাকতে পারি?”

নায়েল ফাইলের দিকে চোখ রেখে মৃদু গলায় বলল—

“মেয়ের মার আজ এত মেহেরবান?”

অর্হিতা কণ্ঠে মিষ্টতা রেখে ফিচেল হেসে বলল—

“কেন? মেয়ের বাবা কী আজ অনেক বেশি ব্যস্ত?”

“না। তবে আমিষ খাওয়ার মুড নেই আজ।”

অর্হিতা গাল ফোলায়। কপট অভিমান দেখিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই নায়েল হাত টেনে ধরে বলল—

“এই, কোথায় যাচ্ছেন?”

“নিরামিষ আনতে, ছাড়ুন।”

নায়েল পেছন থেকে অর্হিতার কোমর জড়িয়ে ধরে। তার কাঁধে চিবুক রেখে মোলায়েম গলায় বলল—

“আজ হঠাৎ মেঘ না চাইতেই আকাশ ফুঁড়ে বৃষ্টি! অকস্মাৎ বর্ষণে ডুবে যাব আমি। সয়লাব হৃৎপ্রকোষ্ঠে উত্তাল ঢেউ। ক্লান্ত নাবিকের ঠাঁয় কোথায়?”

অর্হিতা লাজুক হাসে। তার চুলে ঘ্রাণেন্দ্রিয় ডোবায় নায়েল। কাঁধে নাক ঘষে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল—

“পিউ ঘুমিয়েছে?”

“ও বাবার ঘরে।”

অর্হিতাকে চট করে নিজের দিকে ফেরায় নায়েল। তার অবিন্যস্ত চুল কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল—

“তাই বুঝি এত মেহেরবানি?”

অর্হিতা চোখের কোণ ক্ষীণ করে বলল—

“এত ঢঙ করতে হবে না। যেতে দিন।”

চকিতে অর্হিতাকে নিজের বুকে জড়িয়ে নেয় নায়েল। হট করেই বলল—

“ধন্যবাদ।”

অর্হিতা নায়েলে বুকে মাথা গুঁজে রেখেছে। ছোট্ট শ্বাসের সাথে আলতো গলায় বলল—

“কেন?”

“আমার পিউর মা হয়ে ওঠার জন্য।”

অর্হিতা এবার নিজের হাত কাজে লাগায়। সম্মোহিনীর মতো আঁকড়ে ধরে নায়েলকে। নায়েল ধীর গলায় ফের বলল—

“ধন্যবাদ।”

“কেন?”

“আমার পরিবারকে ভালোবাসার জন্য।”

“তারপর?”

“ধন্যবাদ।”

“কেন?”

“এই গিরগিটিকে স্বামী হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য।”

অর্হিতা লজ্জায় মিশে যায় নায়েলের বক্ষস্থলে। দুর্বল হাতে এক চাপড় বসায় নায়েলের বুকে। নায়েল তার দুই বাহু দিয়ে নিচ্ছিদ্রভাবে জড়িয়ে নিল অর্হিতাকে।

চলবে,,,
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here