#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০৬
__’বাবাই, আজ তুমি আমাদের সাথে ঘুমাবে।আমরা তিনজন একসাথে ঘুমাবো।কি মজা!কি মজা!’
নির্ঝর,খেয়া একত্রে চিল্লিয়ে বলল,
__’কি!’
দুজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করে।খেয়ার চোখে স্পষ্ট ভয় ফুটে উঠেছে।নির্ঝর নুহাকে বুঝানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
__’নুহা মা!পাগলামি করে না।তুমি যেকোনো একজনের সাথে ঘুমাবে আজ।হয় আমার সাথে, না হয় ভালো আন্টির সাথে!বলো কার সাথে ঘুমাবে?’
__’আমি দুজনের সাথেই ঘুমাব।’
__’সেটা তো সম্ভব না মা।বোঝার চেষ্টা করো।আচ্ছা,আজ তুমি আমার সাথে আমার রুমে ঘুমাবে।চলো!তোমাকে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াব।চলো!’
নির্ঝর উঠে দাঁড়াতেই নুহা চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয়।দুজন চমকে উঠে।
খেয়া অস্বস্তি নিয়ে নুহার মাথায় হাত রেখে বলল,
__’এই পিচ্চি! একদম কান্না করে না।শোনো!আমার বিছানায় তো দুটো মাত্র বালিশ।একটা আমার,আরেকটা তোমার।তাহলে তোমার বাবাই কোথায় ঘুমাবে?তার চেয়ে তোমার বাবাই তার রুমে ঘুমাক।কেমন?’
নুহা এক গাল হেসে বলে,
__’তুমি দাঁড়াও আমি বাবাইয়ের রুম থেকে এক্ষুনি বালিশ নিয়ে আসছি।’
বলেই ভোঁ দৌঁড়।নির্ঝর বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে।খেয়ার দিকে তাকায়।এখনো আড়ষ্ট হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
__’না মানে বলছিলাম কি তোমার বেডটা তো বেশ বড়।একপাশে না হয় একটু শুয়ে পড়ি।দেন নুহা ঘুমালেই চলে যাবো।বাচ্চা মানুষ।বুঝাতে বেগ পেতে হবে।কি বলো?’
খেয়া একটু ভেবে মাথা নেড়ে সায় জানায়।
কিছুক্ষণ পর নুহাকে মাঝখানে দিয়ে দুজন দুপাশে শুয়ে পড়ে।নুহা সে কি খুশি!
নির্ঝর নুহার দিকে ঘুরে বলল,
__’এখন ঘুমানোর চেষ্টা করো।আলো বন্ধ করবো?’
নুহা জবাব দেয়ার আগেই খেয়া দ্রুত বলে,
__’না,আলো থাক।’
নির্ঝর একপলক খেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
__’অকে,অকে।প্যানিক হওয়ার মতো কিছু নেই।’
__’আন্টি,আজকের মতো একটা শেষ গল্প বলো।নইলে ঘুম আসবে না।ঘুমিয়ে পড়বো।’
খেয়া নিজের সাথে একপ্রকার ক্ষণস্থায়ী যুদ্ধ করে গল্প বলা শুরু করে।নুহা দুপাশ থেকে দুহাতে দুজনের হাত একত্রে করে নিজের পেটের উপর রাখে।নির্ঝরের হাতের স্পর্শ পেয়েই খেয়া হাত সরাতে চায়।কিন্তু পারে না!নির্ঝর তার হাতটা চেপে ধরে!
নুহা চোখ বন্ধ করে।নির্ঝর তার মেয়েটার উপর বড্ড কৃতজ্ঞতা অনুভব করল।যাক,নুহার জন্য হলেও সে যদি খেয়ার কাছাকাছি যেতে পারে,তাতে মন্দ কি!
কান পেতে মন দিয়ে সে খেয়ার কন্ঠের গল্প শোনে।কি মিষ্টি কন্ঠ!নির্ঝর কেমন ঘোরের মধ্যে চলে যায়।সারাদিনের ক্লান্তির পর দ্রুত হাই তুলে ঘুমিয়ে যায় সে।
আধঘন্টার মধ্যে খেয়া ঘুরে দুজনের দিকে তাকায়।দুজনেই ঘুমিয়ে অতলে চলে গেছে।সে একটু উঁচু হয়ে নির্ঝরকে ডেকে অন্য রুমে পাঠাতে চায়।
তাকে ডাকতে নিতেও সে ডাক দেয় না।কত শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।এমন ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে কষ্ট দিতে মন চায় না।সে দুজনের গায়ে ভালো মতো কম্বল পেঁচিয়ে দেয়।
নিজে উঠে বেলকনিতে যায়।ঘড়িতে একটা ছুঁই ছুঁই।
বেলকনির ঠান্ডা ফ্লোরে বসে পড়ে সে।হঠাৎ করেই জাহিদের কথা খুব মনে পড়ে।সে নিঃশব্দে কান্না করে।
জাহিদের সাথে তার প্রথম দেখা হয় কলেজে।তখন তার বয়স সতেরো -আঠারো হবে হয়তো।ইয়াতীম খানায় বড় হওয়ার দরুন নিজের সঠিক বয়স বা জন্মতারিখ তার জানা নেই।
তাদের ইয়াতীম খানার মাদরাসা থেকেই সে এইচএসসি পাস করে।এইচএসসি পাসের পর সেখান থেকে তাদের কিছু টাকা দিয়ে নিজেদের মতো স্বাবলম্বী হয়ে বাঁচতে বলে।
সেই টাকা থেকেই সে থাকার একটা জায়গা যোগাড় করে।কাছাকাছি একটা কলেজে অনার্সের জন্য ভর্তি হতে যায়।
ভর্তির কোনো কিছু বুঝতে না পারায় সে মুশকিলে পরে যায়।এক পর্যায়ে চোখ দিয়ে যখন ঝরঝর করে জল ঝরে!
তখনই লম্বা মতন একটা ছেলে এসে জিজ্ঞেস করে,
__’এই মেয়ে, কান্না করছো কেন?কোনো সমস্যা? ‘
__’এমনিই কান্না করছি।’
__’কোনো হেল্প লাগতে বলতে পারো।নতুন ভর্তি হবে?’
__’জ্বি!’
হঠাৎ করে মানুষটাকে তার বড্ড আপন মনে হয়।সে কান্না করতে করতে সব বলে।এভাবেই তার জাহিদের সাথে পরিচয়।
জাহিদ তখন ওই কলেজেরই ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট।ওইদিন জাহিদ সব বুঝে তাকে একটা ধমক দেয়।তারপর নিজে সাথে থেকে ভর্তির সব ফরমালিটিজ পূরণ করে।
সেদিন জাহিদকে পাশে পেয়ে তার কি যে ভালো লেগেছিল!সে ভালো লাগাই পরবর্তীতে ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়।
দুই বছর পর জাহিদ মাস্টার্স কমপ্লিট করে জব খুঁজে পায়।তখন নিজে থেকে বিয়ের কথা বলে।
জাহিদের বাবা মা গ্রামে থাকতো।ছেলের কথা মতো শহরে এসে তাকে একবার দেখে যায়।তাকে দেখে পছন্দ হলেও ইয়াতীম বলে প্রথম দিকে রাজি হয় না।পরবর্তীতে জাহিদ তাদের বুঝিয়ে রাজি করায়।যখন সে অনার্স থার্ড ইয়ারে উঠে তখন জাহিদের সাথে বিয়ে হয়ে যায়।
বিয়ের পরপরই শ্বশুর শাশুড়ী গ্রামে চলে যায়।
প্রথম দিকে সবকিছু ঠিকঠাক ছিল।বিয়ের এক বছরের মাথায় জাহিদের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসে।তবুও সে তাতে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।সে জানতো যে তার যাওয়ার জায়গা নেই।
সংসারের সাথে সাথে সে কলেজে যা-ওয়া শুরু করে।কিন্তু তাতে বাঁধ সাধে জাহিদ।তাদের মধ্যে তখন বেশ কথা কাটাকাটি হয়।
কিন্তু তারপরও জাহিদের থেকে একপ্রকার লুকিয়ে সে পরীক্ষা গুলো দিয়েছে।জাহিদের সাথে বিচ্ছেদের পর নির্ঝরের এখান থেকে সে ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম দিয়েছে।তখন সে মানসিক ভাবে একদম বিপর্যস্ত ছিল।জানা নেই, রেজাল্ট কি হবে!কোনো রকমে পাস করবে তো?
প্রচন্ড শীত শীত লাগতেই সে রুমে আসলো।নুহা,নির্ঝর দুজনেই এখনো গভীর ঘুমে।সে কম্বলের ভেতর ঢুকে নুহাকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো।প্রচন্ড শীত লাগছে!
৮.
শেষ রাতের দিকে নিজের উপর ভারী অনুভব হতেই চোখ খুলে নির্ঝর।তাকিয়ে দেখে তাকে দুজন মিলে জড়িয়ে আছে।
খেয়া,নুহা তার হাতের উপর মাথা রেখে গভীর ঘুমে।খেয়া এক পা তার পায়ের উপর উঠিয়ে দিয়েছে অলরেডি।বাম হাতটা তার পেটের উপর রেখেছে।নির্ঝর মুচকি হাসলো।
খেয়া যদি চোখ খুলে দেখতো যে তাকে এভাবে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে তাহলে তার এক্সপ্রেশন কেমন হতো ভাবতেই তার গলা ছেড়ে হাসতে ইচ্ছে করছে।
অতি সাবধানে নিজের দুজনকে ছাড়িয়ে মাথার নিচ থেকে বাম হাতটা বের করে নির্ঝর।সাবধানে বিছানা ছেড়ে উঠে বাম হাত বার কয়েক নাড়াচাড়া করে।প্রচন্ড ব্যথা হয়ে গেছে। ঘুমের ঘোরে সে বিন্দুমাত্র টের পায়নি!
দুজনের গায়ে কম্বল পেঁচিয়ে নুহার কপালে চুমু দেয় নির্ঝর।খেয়ার দিকে এক পলক চেয়ে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হয়।
দরজা অবধি যেতেই খেয়ার দিকে পিছন ঘুরে তাকায়।খেয়ার ঘুমন্ত মুখটা যেন তাকে চুম্বকের মতো টানছে।
ফের ঘুরে বিছানার কাছে আসে।উবু হয়ে খেয়ার দিকে ঝুঁকে জীবনে প্রথম বারের মতো তার গালে ঠোঁট ছোঁয়ায়।
তারপর দ্রুত পায়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়।
সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই নুহার পাশে তাকায় খেয়া।সে বড় করে শ্বাস নেয়।নাহ!নির্ঝর নেই।শুধু সে আর নুহা শুয়ে আছে।হয়তো রাতের বেলা নুহা ঘুমিয়ে পড়ার পরেই চলে গেছে।
কেন জানি নির্ঝরের প্রতি শ্রদ্ধা জেগে উঠে।
উঠে ওয়াশরুমে যায় সে।হাতে মুখে পানি দিয়ে আয়নার দিকে তাকায়।সেখানে তার ফ্যাকাশে প্রতিবিম্ব ভেসে উঠেছে। কতদিন হলো নিজের যত্ন নেয় না সে!
হঠাৎ করেই তার চোখের সামনে নির্ঝরের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা ভেসে উঠে।খেয়া কপাল কুঁচকায়। সকাল সকাল বেলা নির্ঝরের চেহারা কেন মনের মধ্যে ভেসে উঠছে?
দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতে দরজায় টোকা পড়ে।সে দরজার দিকে এগিয়ে নির্ঝরকে দেখে বলে,
__’ভেতরে আসুন।’
নির্ঝর এক নজর ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল,
__’নুহা উঠেছে কি না খোঁজ নিতে এলাম।এক কাজ করো।ওকে উঠিয়ে দুজন দ্রুত রেডি হয়ে নাও।আমি ডাইনিং এ অপেক্ষা করছি।’
__’হুঁ!’
নির্ঝর এখনো দাঁড়িয়ে আছে।খেয়া বুঝতে পারলো হয়তো আর কিছু বলবে।কিন্তু সংকোচ বোধ করছে।
__’আর কিছু বলবেন?’
__’হ্যাঁ,না মানে বলছিলাম কি আজ একটু ঘুরতে যেতে পারবে?মানে নুহাকে স্কুলে রেখে আমার অফিস হয়ে আর কি!’
নির্ঝরের বলার ভঙ্গি দেখে খেয়ার বড্ড হাসি পায়।সে নিজেকে সংযত করে বলল,
__’ঠিক আছে।’
নির্ঝর দ্রুত নিচে নামে।তার নাচতে ইচ্ছে করছে।খেয়া তার সাথে ঘুরতে যেতে রাজি হয়েছে!
(চলবে)
আসসালামু আলাইকুম।আজ একটু বেশি ছোট হয়েছে হয়তো।দুঃখীত।একবার লিখে রেখে সেভ করার আগেই ডিলিট হয়ে গেছিল।পরে আর বড় করে লেখার সময় পাইনি।
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো। 🖤