#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৬ষ্ঠ পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
বাসন্তী শয্যাশায়ী। নায়িমের আদেশ আজ থেকে দশদিন সে ঘর থেকে বেড়ুবে না। তার যা দরকার সব চৈতালি এনে দিবে। হয়তো তাকে দ্রুত সুস্থ করতেই এই ব্যবস্থা।
“এই যে নেও তোমার খাবার। খেয়ে নেও, নাহলে আবার তোমার বর আমাকে ধরবে।”
অদ্ভুৎ চোখে তাকাল মেয়েটির দিকে বাসন্তী। এই মেয়েই সুযোগ পেলে অভিযোগ জানাত, স্বামীর সংসারে খাটতে খাটতে না কি শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ, অন্যের সংসারে ঠিকই খাটছে। এত কী প্রাপ্তির আকুতি, কী সুখ এই দুনায়াবি লাভে!
বাসন্তীও মাঝে মাঝে জানতে চায় তা। তবে সে পারেনি, একজন খ্যাতনামা, ধনী গায়কের স্ত্রী হয়েও তাকে প্রাচুর্য, অর্থের বিছানা দেয়নি, এমন কী একটা মোবাইলও নেই, না কাজের বুয়া। বড়লোকী জীবন তাকে দেয়নি নায়িম।
“কী হলো কী এত ভাবছো? খাও খাবারটা… আসলে সুখে আছো তো বুঝো না।”
বলতে বলতেই পাশে বসে আঁচলে কপালের ঘাম মুছে নেয় চৈতালি। বাসন্তী অকস্মাৎ প্রশ্ন করে উঠল,
“তোমার কি মনে হয় আমি সুখে আছি?”
“অবশ্যই। নায়িম খ্যাতনামা গায়ক, সুদর্শন, সম্পত্তিশালী, আগলে রাখতে জানে। আর কী দরকার! তুমি তোমার অতীতের কথা ভাবো, আর আজকের কথা ভাবো। আকাশ-পাতাল পার্থক্য।”
বাসন্তীর মুখে হাসি খেলা করে যায়। চৈতালি জানে এটা শুধুই বিদ্রূপার্থে। তার মতোন চতুর নারী অন্য নারীর ভঙ্গির ভাষা বুঝবে না, এ অসম্ভব। সে টাইলসে চোখ রেখেই বলে,
“যা কারো কাছে পৃথিবীর সুখ, তা কারো কাছে হয়তো আবার ধোঁয়াশা। এ এক মহাসত্য।”
বাসন্তী কোনো কথা না বলেই খাবার খেয়ে নেয়। চৈতালি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে নীরবে বেড়িয়ে যায়।
বাসন্তী আনমনেই ভেবে উঠে তার মামা বাড়ির কথা। তার অতীত জীবনের কথা।
বয়সটা তখন কতই হবে এই এগারো কী বারো বছর। মামাতো বোনের নতুন জামা দেখে তার সে কী কান্না নতুন জামার জন্য। বাবা যে প্রতি বছর নিজে পোশাক না নিলেও আদরের রাজকন্যার জন্য জামা কিনতে ভুলতেন না। বদরুন্নেসা শত বলেও থামাতে পারলেন না।
তখন অত শত বুঝত না। সে যে এতিম হয়েছে, বাবা হারা, ছায়াহীন হয়েছে এও জানত না। মামী মিথ্যে মায়া দেখাতে মামাতো বোনের একটা অতি পুরানো সেলাই খুলবে খুলবে ভাব ফ্রক এনে দিলেন। বাসন্তী সেসময় বড্ড চঞ্জলা আর জেদি ছিল বটে। জামা খানা ছুঁড়ে ফেলে বলেছিল,
“ছিঃ! এইটা তো পুরান জামা। আমার আব্বা আমার জন্য নতুন জামা আনে।”
নানা তেড়ে এসে হাতের লাঠি দিয়ে ঠাশ করে এক আঘাত দেয় বাসন্তীর পিঠে। বাসন্তীর চেঁচামেচিতে তার মেজাজ গরম হয়ে উঠেছে, অথচ অন্য নাতি-নাতনিদের আবদার পূরণে একটুও রাগ বা কৃপণাতে লাগে না তার।
“ঐ ছেড়ি তর কী বাপ আছেনি যে কাপড় পাবি? চালচুলোহীন একখান মেয়ে আবার নতুন-পুরাতন দেখাইতে আসে। তুই হইল কী না বাড়ির চাকর, আশ্রিতা। তোর আবার এত কীসের দেমাগ?”
তার লাঠির আঘাতের চেয়ে গায়ে লেগেছিল সেদিন বেশি কথার আঘাতগুলো। তিনি যে রুক্ষতার সহিত বাস্তবতার সাথে আঘাত করেছিলেন।
ধীরেধীরে বাসন্তী যতটা জীবনের বাস্তবতা জানছিল, তার মায়ের থেকে ততটাই দূরে সরে যাচ্ছিল। কারণ ঘুরেফিরে সত্য তো এটাই, তার মায়ের জন্যই বাবা ছাড়া এত বিভীষিকাময় তার জীবন হয়েছিল।
ঐ বাড়িতে বাসন্তী সবার চোখের বালি নয়, গলার কাটা ছিল। যাকে না নিগলে ফেলা যায়, না উপড়ে ফেলা। তাই সবার এই অবান্ঞ্ছিত মেয়েটির প্রতি ক্ষোভ একটু বেশিই ছিল। যা তারা কথাবার্তা, আচার-ব্যবহার, কাজকর্ম সহ সবকিছুতেই বুঝিয়ে দিত। সবচেয়ে অপমানজনক লাগত তখন যখন তারই মামাতো, খালাতো ভাই-বোনেরা তাকে তাচ্ছিল্য করতে, সবার সামনে কাজের লোক বলত।
যতটা বছর ঐবাড়িতে ছিল ততটা বছর বাসন্তীর জীবন তরীর সবচেয়ে করুণতম সময়। সেখানে মামী, খালা এমন কী ভাই-বোনরাও যখন খুশি তখন তাকে মারতে। সবসময় বোঝাতে এ কিছুই তার নয়, সে কত বড় বোঝাতো। বড় মামী তো তাকে সদাই মরার কথা বলত। অনেক বার সে চেয়েছে মরে যেতে, সাহসে কুলোয়নি, তখন বুঝত নিজেকে মারাও সহজকথা নয়।
সে খামখেয়ালি করে নায়িমের সাথে পালায়নি, বিয়ে করেনি। সবটাই হয়েছিল পরিমাপ করে। নায়িমের সাথে তাকে হয়তো কারো নাম মাত্র দ্বিতীয় স্ত্রী তথা রক্ষিতা হয়ে বেঁচে থাকতে হত। এখানে এসে সে খারাপ আছে। তবে আগের মতো নয়।
সেখানা না ভর পেট খাওয়া পাওয়া যেত, না স্বস্তিকর কোনো কথা, না কোনো যত্ন-আদর, মিথ্যে লোক দেখানো কিছুও তার প্রাপ্তির খাতায় ছিল না। প্রতিদিনকার মতোন যার তার মার আর অপমান সহ্য করতে হয় না৷
নায়িম আঘাত করলেও পরে মলমটা সে-ই লাগায়। ভালোবাসা দেখায় লোক দেখানো হলেও। এখানে নায়িমকে তার আপন লাগে কখনো কখনো, তো কখনো মায়ামমতাহীন এক রাক্ষস। সেখানে একমুহূর্তের জন্যও কাউকে আপন মনে হয়নি, নিজের মাকেও না। এসব ভেবেই কষ্টের মরুভূমিতে খাণিক স্বস্তির শীতলতা পায় সে। কারণ মুক্তির তো উপায় নেই, যাওয়ার জায়গা নেই যে।
“আমি মুক্ত পাখি হতে চাই। খাঁচা বন্দী জীবন আমার কাম্য নয়। তবে আমি উপায়হীন।”
অন্যমনস্ক হয়েই বিড়বিড়ায় সে।
___
ললিতা’স ইন্টারোগেশন অনুষ্ঠান থেকে ইনভাইট করা হয়েছে নায়িমকে। নায়িম খুব ভালো করেই জানে ললিতা সেন আর শবনমের ভাব কতটা! নির্ঘাত তাকে প্রশ্নের দ্বারা হেনেস্তা করেই কোনো ভাবে শবনমকে জনগণের নজরে উঠাতে চাওয়ার প্ররোচনা।
“ওকে, আমিও রাজি ইন্টারভিউয়ের জন্য। তবে ইন্টারভিউটা হবে আমার সময় মতো। সামনের মাস ছাড়া সময় হবে না আমার।”
সময়ের অভাব না ছাই, প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ চাই শুধু তার। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই বাসন্তীর কামরায় গা দুলাতে দুলাতে ঢুকে পড়ে সে। গতানুগতিক নাইটি পরিহিতা বাসন্তী সেই ক্ষণে ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় তেল দিচ্ছে। পাঁচমাসে পা দেওয়ার পর থেকেই মাথা গরম হয়ে প্রায়শয়ই ব্যথা করে তার।
নায়িমের মাথায় আগুন জ্বলে যায়। এই পোশাক, সন্তানসম্ভবা দেহ যে তাকে খুব করে কারো কথা মনে করিয়ে দেয়। ঘৃণায়, রাগে তার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে গেলে।
“এই মেয়ে! তোমাকে কয়দিন না করসি এসব নাইটি-ফাইটি না পরতে? তাড়াতাড়ি খুলো এসব।”
তার ধমকের ঝংকারে যেন গোটা বাড়িই কম্পিত হয়। নায়িম মেয়েটাকে এখন আর কোনো পৈশাচিক আচারণে কাহিল করতে চাচ্ছে না, তাই দ্রুতোই বারান্দায় চলে আসে সে।
“মিস্টার এন্ড মিসেস খান, এতটা বিভীষিকাময় আমার জীবন না করলেও পারতেন। এতটাই বিষাক্ত আমি আজ যে আমার সাথে জুড়ে থাকা সবকিছুই বিষাক্ত। বিষাক্ত আমার আর বসন্ত কুমারীর সম্পর্কও। আমি মনে করি নারী জাতের মাঝে সবচেয়ে পবিত্র আমার বসন্ত কুমারী, তবুও সদাই সন্দিহান আমি, কোথায় একটা প্রশ্ন, দ্বিধা, সন্দেহ, ভীতি কার্যকর।”
___
একটা মাস পেড়িয়ে গেছে, বাসন্তীর গর্ভের সন্তানটা এখন আট মাসের। সে যামিনীর আঁধারে মিশে নিদ্রায় ডুবে। নিদ্রার ঘোর হয়তো গভীর ছিল না, তাই তো কথার অল্প শব্দেই ভেঙে গেল। কিন্তু সে যা শুনতে পেল তাতে তার লোমে লোমে ভীতি, হাহাকার নেমে এল।
“আরে বাবা বাচ্চা এবোর্ট করার সময়কাল যদি এখন শেষ হয়ে যায় তাহলে বাচ্চাটা কাউকে দিয়ে দিলেই হবে। হ্যাঁ, হওয়ার পরপর কাউকে না জানিয়ে কোনো এতিম খানায় রেখে আসলেই হবে।”
নায়িমের আর কোনো আওয়াজ পাওয়া গেল না। বরং, বাথরুমের দরজা লাগানোর শব্দ। বাসন্তী যেন শোকে বোবা বনে গেছে। সে সেভাবেই পড়ে থাকল, যেন কোনো অনুভূতিহীন যন্ত্রমানব।
সকালের আলোর আগমনে ঘুম ভাঙে নায়িমের। কিন্তু ঘুম থেকে জাগতেই কেন যেন তার ঘরটাকে অদ্ভুৎ রকমের নীরব লাগছে, নিস্তব্ধতা গ্রাস করছে চারিধারে। মনে হচ্ছে কী যেন নেই, কেমন একটা অভাব বোধ, হাহাকার।
সে এত ধ্যান না দিয়ে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। তারপরও বাসন্তীকে ডাকতেই কোনো সাড়া পেল না। সূক্ষ্ম ঘাম বেয়ে পড়ল, কপালে চিন্তার ভাজ। অজানা এক ভয়ে গ্রাসিত হচ্ছে সে।
দ্রুত পদে সারা ঘর তালাশ করল যুবক। বাসন্তীর ছোঁয়া পেল সবজায়গায়, কিন্তু সে নেই। মাস্ক, চশমা, হুডি পরে পাড়া-প্রতিবেশী, মৈত্রীর কাছেও খোঁজ করল। না মেয়েটি নেই, ঘরের সবকিছু ঠিক জায়গায়, বাসন্তীর পোশাক-আশাক, সব। তবে কি কর্পূরের মতোন মানুষও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়? বাসন্তী গেছে?
কী করবে ভেবে না পেয়ে অনিমেষকে কল করে সে। উন্মাদের মতোন বলে,
“দোস্ত আমার সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। তাড়াতাড়ি আয়, আমার সর্বনাশ দেখছি অতি নিকটে।”
___
বাসন্তী হুশ ফিরলেই নিজেকে অপরিচিত এক নোংরা বিছানায় আবিষ্কার করে। বাহির থেকে নোংরা নোংরা কথা শুনা যাচ্ছে পুরুষ ও নারী গলায়।
তবে কি মায়ের মতোই ভুল করে বসল সে? মায়ের চেয়েও নিষ্ঠুর একেবারে মৃত্যুকাম্য জীবন পেতে চলেছে সে?
চলবে…
নায়িম চরিত্রটা খুব অগোছালো, জটিলও বটে। তাকে ঠিক-ঠাক জানতে হলে তার অতীত-বর্তমান সব জানতে হবে। গল্পটাতে সেলেব্রিটি জীবনের কামড়াকামড়ি, খোলসময় জীবনও তুলা ধরার ইচ্ছে আছে।