তুমি এলে তাই পর্ব ২০

#তুমি এলে তাই ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ২০
.
গুঞ্জন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পন্দনের দিকে। হঠাৎ যে স্পন্দন এমন কিছু বলবে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি ও। কথা নেই বার্তা নেই আচমকাই এমন অদ্ভুত কথাই বা কেনো? কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর গুঞ্জনের ভ্রু কুচকে গেলো। গুঞ্জনের চেহারা দেখে স্পন্দন বুঝতে পারছেনা যে গুঞ্জনের মনে কী চলছে? গুঞ্জন ভ্রু কুচকে থেকেই স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” আর ইউ সিরিয়াস?”

স্পন্দন গুঞ্জনের প্রশ্নে বেশ বিরক্ত হলো। এটা কেমধ প্রশ্ন হলো? ও এভাবে এতোগুলো কথা বলল অথচ গুঞ্জন এখনও জানতে চাইছে ও সিরিয়াস কী না? তবুও নিজের বিরক্তিকে দমিয়ে রেখে বলল,

— ” দেখে মনে হচ্ছে আমি মজা করছি?”

গুঞ্জন একটু ভাবুক হয়ে বলল,

— ” নাহ তা না কিন্তু হঠাৎ করে এরকম কেনো মনে হলো যে ইউ লাভ মি?”

স্পন্দন জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে রেলিং এ হেলান দিয়ে মুচকি হেসে বলল,

— ” ঠিক হঠাৎ বলা যায় না। যেদিন গ্রামে তোমার সাথে একরাত কাটিয়েছিলাম সেদিন থেকেই তোমার প্রতি দুর্বল হতে শুরু করি কিন্তু সেটা বুঝতে পারিনি।”

গুঞ্জন মুচকি হেসে বলল,

— ” ঐ ঘটনার পর তো প্রায় তিন মাস পার হয়ে গেছে। এরমধ্যে কী এমন হলো?”

স্পন্দন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

— ” সেটাই তো বুঝতে পারছিনা। তোমার সাথে বন্ধুত্বের এই তিন মাস। একটু একটু করে তোমাকে চিনেছি। আমার ভুলটা কী ছিলো জানো?”

গুঞ্জন জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলল,

— ” কী?”

স্পন্দন একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল,

— ” তোমার মধ্যে অন্যরকম কিছু দেখেছিলাম আমি। সবার থেকে আলাদা এক পারসোনালিটি । যদিও এই পারসোনালিটির বাইরের দিকটা আমার পছন্দের ছিলোনা। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ তোমার কিছু কাজ আর তোমার সাথে বন্ধুত্ব করার পর পারসোনালিটির গভীরে যেতে ইচ্ছে করলো। আর সেটা করতে গিয়েও ফেঁসে গেলাম। এই তিনমাসে তোমাকে খুব গভীরভাবে দেখেছে, চিনেছি, বুঝেছি। তোমাকে ফোটন কণার সাথে তুলনা করে ভুল করিনি আমি। বরং ঠিক করেছি। কখনো বুঝতে পারিনি তোমাকে বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে তোমার প্রেমেই পরে যাবো। যেটা নিয়ে আমি কোনোদিন ভাবিও নি। আমি নিজেও অবাক হয়েছি? বারবার অবাক হয়েছি কিন্তু কিছু করার ছিলোনা আমার। কী হলো, কখন হলো, কীভাবে হলো নিজেই বুঝতে পারলাম না।”

গুঞ্জন হাত ভাজ করে বলল,

— “যেই লোকটার ছোট্ট একটা সরি বলতে এতোটা ইগোতে লাগছিলো সে আই লাভ ইউ টা এতোটা সহজে বলে দিল?”

স্পন্দন এবার ছোট্ট একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো জেনো তাচ্ছিল্যটা সে নিজেই নিজেকে করছে। তারপর বলল,

— ” কাউকে সরি বলা মানে তার কাছে কিছুটা হলেও নিচু হওয়া। আর ভালোবাসার কথা বলতে নিচু হতে হয়না শুধু সৎ সাহস লাগে। হয়তো তাই এতো সহজে বলতে পারলাম। হয়তো ভালোবাসি বলে। শুনেছি ভালোবাসায় ইগো বলতে কিছু থাকেনা হয়তো সেকারণেই।”

গুঞ্জন এবার রেলিং এর ওপর উঠে বসে বলল,

— ” কিন্তু আমার প্রতি তোমার যেই অনুভূতি আছে সেটা লাভ নাকি অ‍্যাট্রাকশন বুঝবো কীকরে?”

স্পন্দন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়েই বলল,

— ” আমার কাছে তো লাভ। তোমার কাছে কী? ইউ নো বেটার আই থিংক।”

গুঞ্জন কিছুক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

— ” আমার কাছে কীরকম উত্তর এক্সপেক্ট করছো তুমি?”

স্পন্দন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

— ” কোনটার? আই লাভ ইউ? নাকি বিয়ের ব্যাপারটা?”

গুঞ্জন পা দোলাতে দোলাতে বলল,

— ” দুটোই গুরু।”

স্পন্দন এবার পকেটে হাত ঢুকিয়েই সরাসরি গুঞ্জনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

— ” আগে আসি বিয়ের কথায়। আমি চাইলে এইমুহূর্তে তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে পারি। কিন্তু এটা আমি মনে প্রাণে মানি আর বিশ্বাসও করি যে যতোক্ষণ একটা মেয়ে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেতে কবুল না বলে ততোক্ষণ বিয়ে হয়না। আর আমি সারাক্ষণ তোমার সাথেই থাকতে চাই তাই বিয়েটা জরুরী আর তার জন্যে তোমার মতামতও জরুরী।”

গুঞ্জন কিছুক্ষণ স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

— ” আর আই লাভ ইউ?”

স্পন্দন এবার গুঞ্জনের দিকে আরেকটু এগিয়ে দিয়ে বলল,

— ” আই লাভ ইউ কথাটার উত্তর আমি তোমার কাছে চাই ই নি। জাস্ট জানিয়ে দিয়েছি। কারণ আমি জানি তুমি জীবণে কোনোদিন যদি কাউকে ভালোবাসো তাহলে সেটা আমাকেই বাসবে। এন্ড ইয়েস সেটা আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি।”

গুঞ্জন অবাক হয়ে বলল,

— ” এতো কনফিডেন্স?”

— ” স্পন্দন চৌধুরী ফাঁকা আওয়াজ দেয়না।”

গুঞ্জন কিছু একটা ভেবে বলল,

— ” যদি আমার উত্তর না হয় তাহলে কী করবে বস?”

স্পন্দন এবার গুঞ্জনের দুপাশে রেলিং এ হাত রেখে একদম ওর কাছে গিয়ে বলল,

— ” আমার কোনো সমস্যা নেই। ওইযে বললাম ভালো তুমি আমাকেই বাসবে। বলা হয় যে ওপরওয়ালা জোরা ঠিক করে পাঠান। আর আমি জানি আল্লাহ তোমাকে আমার জন্যেই তৈরী করেছেন। সো আজ হোক বা কাল ঘুরে ফিরে গুঞ্জনকে এই স্পন্দনে এসেই থামতে হবে।”

গুঞ্জনের খুব অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। ও যতোই অন্যরকম হোক মেয়েতো? তাই স্পন্দনের এভাবে ওর কাছে আসাতে অন্যরকম লাগছে। কিন্তু গুঞ্জন অন্যসব মেয়েদের মতো নয়। যে এটুকুতেই লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে যাবে তাই সেই অনুভূতিকে পাত্তা না দিয়ে স্পন্দনের চোখের দিকে তাকিয়েই বলল,

— ” ওকে দেন লেটস সি? যদি আমি কখনো তোমার প্রেমে পরে তোমাকে নিজের মুখে ভালোবাসার কথা বলি। সেদিনই আমি তোমার বিয়েল প্রপোজাল টা এক্সেপ্ট করবো। রাজি আছো?”

স্পন্দন বাঁকা হাসলো তারপর গুঞ্জনের একদম কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

— ” ওয়েট করবো।”

গুঞ্জন না চাইতেও চোখ বন্ধ করে ফেলল। স্পন্দন সরে আসতেই গুঞ্জন রেলিং থেকে ঝট করে নেমে গিয়ে হাত দিয়ে চুল ঠিকই করে নিলো। তারপর বলল,

— ” তবে আমার জন্যে অনন্তকাল ওয়েট করার দরকার নেই যদি এরমধ্যেই কখনো মনে হয় যে আমার থেকে বেটার কাউকে পেয়েছো। বা অন্যকাউকে ভালোবেসে ফেলেন। দেন ইউ ক্যান স্টার্ট ইউর লাইফ উইথ হার ইজিলি।

স্পন্দন কোনো উত্তর দিলোনা শুধু হাসলো।মুহূর্তেই দুজনে ঠিক আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেলো। দুজনে রেলিং এর সাইড দিয়ে হাটছে আর দুজনেরই পকেটে হাত। হাটতে হাটতে স্পন্দন বলল,

— ” কিছু খাবে?”

গুঞ্জন এদিক ওদিক একটু তাকিয়ে বলল,

— ” কফি?

— ” ওকে চলো।”

এরপর দুজনে মিলেই কফিশপে চলে গেলো। কফি শপ থেকে কফি খাওয়া শেষ হতেই স্পন্দন বলল,

— ” কোথায় যাবে বাড়িতে নাকি ক্লাবে?”

গুঞ্জন উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নিতে বলল,

— ” ক্লাবে যাবো আজ পার্টি আছে।”

স্পন্দনও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

— ” চলো তাহলে।”

এরপর স্পন্দন গুঞ্জনকে ক্লাবে ড্রপ করে দিয়ে নিজে বাড়ি চলে গেলো।

_______________________

অনেকটা রাত হয়েছে। স্পন্দন ফ্লোরে বসে টেবিল ল্যাম্প অন অফ করছে আর ভাবছে। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে ওর। নিচে একটা শোপিস ভেঙ্গে পরে আছে। খুব বেশি অস্হির লাগছে। প্রথম যেদিন গুঞ্জনকে দেখেছিলো সেদিন ওর মতো অভদ্র বেয়াদব কোনো মেয়ে পৃথিবীতে আছে বলে ওর মনে হয়নি। এরপর পরপর বেশ কয়েকবার গুঞ্জনকে নিয়ে ওর মনে এসব ভুলভাল ধারণা চলে এসছে প্রায় দু তিন সপ্তাহ যাবত। এরপর জানতে পারলো যে ও মেয়েটাকে নিয়ে যা যা ভেবেছিলো সবি ভুল শুধুশুধুই খারাপ ব্যবহার করেছে। মেয়েটার চালচলন ভালো লাগেনি ঠিকি কিন্তু তবুও ভুল করেছে বলে সরি বলতে চেয়েছিলো। আর সরি বলতে গিয়ে মেয়েটার ঐরকম রণমূর্তি দেখে নিজের অজান্তেই হালকা মুগ্ধ হয়েছিলো আর মন থেকে ঝাঁসির রাণী শব্দটাই বেড়িয়েছিলো। তারপর শুধু কফি আর কেক পেয়েই সরি এক্সেপ্ট করে নেওয়াটা ওকে অবাক করেছিলো। ভালোও লেগেছিলো সেই হাসিটা। এরপর ঐদিন মাঝরাস্তায় ওর গাড়ি ঠিক করতে দেখে আরেকদফা অবাক হয়েছিলো। সেদিন বুঝেছিলো এই মেয়েকে চিন্তে ওর এখনো অনেক বাকি। এরপর টুকিটাকি কথা আলাপে একটু একটু করে চিনেছে গুঞ্জনকে। পরে ঐ গ্রামে সারারাত গুঞ্জনের ঘুমন্ত মুখ দেখে অদ্ভুত এক মায়া পেয়েছিলো যার থেকে ও এখোনো বেড়োতে পারছেনা। ঘুমের ঘোরে ওর পেট জরিয়ে ধরে পরিবারের ভালোবাসা পাওয়ার আকুতি মিশ্রিত কিছু কথা বলেছিল গুঞ্জন যা আজও ওর কানে বাজে। পরের দিন গুঞ্জনের পরিবারের ব্যবহার দেখে কষ্টতো পেয়েছেই আর গুঞ্জনকে জানার আগ্রহও ততো বেড়েছে। নিজের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে আগের চেয়ে একটুখানি বেশি হাসা, মাঝেমাঝে গুঞ্জনের মতো কথা বলে ফেলা, ফ্রি মাইন্ডে থাকা। গুঞ্জন ওর জীবণে এসছে তাই তো এসব হয়েছে ।ওর প্রতি অনুভূতিও এতো চরমে পৌছে গেছে যে আজ কিছু না ভেবেই সোজা বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলেছে। আগে পরে কিছু ভাবেনি। এসব ভেবে স্পন্দন বিড়বিড় করে বলল,

— ” আমি সবসময় শান, নম্র, ক্যাসুয়াল টাইপ মেয়ে পছন্দ করতাম। কিন্তু তুমি তার সম্পূর্ণ অপজিট। তাই সিউর ছিলাম যে আর যাই হোক না কেনো কখনো তোমাকে ভালোবাসবো না। তাই তোমাকে জানতে চাইতে ভয় পায়নি। কিন্তু এরপরের দুইমাস যখন তোমাকে একটু একটু জেনেছি, বুঝেছি। ভেতরের তুমির সাথে বাইরের তুমির পার্থক্য করতে পেরেছি। তখন তোমার ওপর এক আজব অনুভূতি তৈরী হলো। শুতে খেতে ঘুমোতে তোমার কথাই মনে পরছে। সবসময় তোমাকে মিস করছি। না চাইতেও শুধু এবং শুধু তোমার কথাই ভাবছি, তোমার কষ্টে কষ্ট পাচ্ছি তোমার হাসিতে হাসছি। এটাকি ভালোবাসা না? নাকি এট্রাকশন? আমি হুট করে এভাবে তোমাকে প্রপোজ করে ভুল করিনি তো? আমার কী আরেকটু সময় নিয়ে ভাবা উচিত ছিলো?”

স্পন্দন একটু থেমে আবার বলল,

— ” কিন্তু আমিতো শুধু বিয়ের প্রপোজাল দেবো এটুকু ভেবেই ওকে নিয়ে গেছিলাম। পরে যেগুলো বললাম সেগুলো তো আমার ভাবা ছিলোনা? এমনিতেই আমার মনে যা ভেবেছি বলে দিয়েছি। তাহলে এসব অনুভূতি তো মিথ্যে নয় তাইনা। বাট আমি এতো ডেস্পারেট কেনো হচ্ছি? আমিতো এমন ছিলাম না? এতোটা হতকারিতা, অস্হিরতা তো আমার মধ্যে ছিলোনা।”

এসব ভেবে গ্লাসের পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিয়ে দুহাতে মাথা চেপে ধরলো স্পন্দন

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here