তোমায় ছোঁয়ার ইচ্ছে পর্ব -২৪+২৫

#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_২৪
#সুমাইয়া_মনি

আকাশে নানা ধরনের পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। সূর্যের রং লাল থেকে কমলা রং ধারণ করেছে। কিছুক্ষণ বাদে সূর্য ডুবলো বলে। ঘনিয়ে আসছে রাত। দু বান্ধবী বেঞ্চের দু প্রান্তে বসে গালে হাত রেখে গভীর ভাবনায় মসগুল। কী করা যায় কী করা যায়! ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। পরিশেষে ইসানা বলল,
‘গেলাম। আর ভাবতে হবে না।’
‘তাহলে কি করবি ভাবলি?’
‘কি করব? সহ্য করতে হবে।’
‘তাই কর। চল উঠি এলা।’
‘আয়।’
পার্ক থেকে বেরিয়ে মেইন রাস্তায় এসে রিকশায় চড়ে দু’জনে। পাঁচটার দিকে দু বান্ধবী দেখা করতে রমনাপার্কে এসেছে।
এখন ফিরে যাচ্ছে নিজ নিজ নিড়ে। প্রথমে সোহানাকে নামিয়ে তবেই বাড়িতে ফিরে সে। রাদ এখনো ফ্যাক্টরিতে। তিনদিন বন্ধ দেওয়ায় কাজের চাপ অনেকটা বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই আসতেও লেট হবে। ইসানা বাড়ি ফিরে টাইসনকে খাবার দিয়ে রান্নার কাজ শেষ করে। তখন ঘড়িয়ে দশটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। খাবার খেয়ে রাদের জন্য খাবার টেবিলে রেখে দেয়। সঙ্গে ছোট্ট চিরকুটও রাখল। টাইসনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে যায়। বারোটা নাগাদ রাদ বাড়ি ফিরে। ডুবলিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। ইসানার রুমের দিকে একবার তাকিয়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো।
ফ্রেস হয়ে ড্রইংরুমে এসে টেবিলের ওপর নজর পড়ে।
চিরকুটটি তুলে নিয়ে পড়ল,’খাবার বেড়ে রেখেছি। নিজ দায়িত্বে খেয়ে নিবেন।’
‘তার মানে আপনার সঙ্গে এখন আর দেখা হচ্ছে না।’ বিড়বিড় করে আওড়াল রাদ।
_
সকালে ইসানাকে সঙ্গে নিয়ে ডংবং নামের একটি ফ্যাক্টরিতে আসে রাদ। দূরে দাঁড়িয়ে গাড়ি থেকে রাদ ও ইসানাকে নামতে দেখে ইভান মুখে মাস্ক পড়ে নেয়। কাল ইভানের ইমেইল পেয়ে রাদ কাপড় সচক্ষে দেখতে এসেছে। পুরো ফ্যাক্টরি ইসানাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরেফিরে দেখে। ছোটখাটোর মধ্যে হলেও ফ্যাক্টরির পরিবেশ রাদের মনে ধরে। কাপড়ের মানও যথেষ্ট ভালো ছিল। তাই রাদ ডিল কনফার্ম করে সেখান থেকে বিদায় নেয়। ম্যানেজার ইভানের ওপর খুশি হয়ে সহকারী এসিস্ট্যান্ট বানায়। স্যালারিও বাড়িয়ে ধরেন। ইভান এতে খুশি হয়। এবং কাপড় ডেলিভারি হওয়ার আগ পর্যন্ত নিজেকে লুকিয়ে রাখবেন বলে সিদ্ধান্ত নেয়। ফ্যাক্টরিতে ফিরার পথে মাঝ রাস্তায় রেড সিগনালের জন্য গাড়ি থামে। ফুটপাতে একটি ছোট্ট ছেলেকে গোলাপ ফুল বিক্রি করতে দেখে রাদ ইশারায় ডাক দেয়। ছেলেটি রাদের গাড়ির কাছে আসতেই হাতের সব গোলাপ গুলো কিনে নেয়। পুরো দৃশ্য ইসানা আড়চোখে দেখেছে। রাদ গোলাপের সুগন্ধ নিয়ে ইসানার দিকে এগিয়ে ধরে বলল,
‘ফর ইউ!’
ইসানা সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
‘নো নিড!’
‘তাহলে আর কি করার লিসাকে দিয়ে দেবো।’ দু কাঁধ নাচিয়ে বলল রাদ। ইসানা তার কথায় পাত্তা দেয় না। ফ্যাক্টরিতে এসে ইসানার সামনেই লিসাকে ফুলগুলো দেয়। লিসা খুশি হয়ে নেয়। তবে টেরা চোখে তাকিয়ে বলে,
‘মনে হচ্ছে কারো রিজেক্ট করা ফুল আমাকে দিয়েছো, রাইট?’
রাদ আহাম্মক হয়ে যায়। ইসানা ঠোঁট উল্টে হেসে ফেলে।
রাদ সেটা দেখে রাগান্বিত স্বরে বলল,
‘রিজেক্ট করা জিনিসের মূল্য অনেক। আর সেটা আমি কেঁড়ে নিতে একটু বেশিই পছন্দ করি।’
‘নিও! তবে দেখিও। কাঁটা যেন না লাগে হাতে।’
‘বলার জন্য থ্যাংকস!’
লিসা প্রতিত্তোরে মৃদু হাসি প্রধান করে চলে যায়। পাশ থেকে ইসানাও চলে যেতে নিলে রাদ ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলে উঠে,
‘মিস.সানা, সত্যিই আমি রিজেক্ট করা জিনিস কেঁড়ে নিতে অনেক বেশি পছন্দ করি।’
ইসানা পিছনে ফিরে কাঠ কণ্ঠে বলল,
‘রিজেক্ট করা জিনিস সব সময় ভালো হয় না।’
‘ভালো-খারাপ দুইটাই আমার পছন্দ। নজর যখন পড়েছে তখন সেটাই চাই আমার।’
তর্কবিতর্ক পছন্দ নয় দেখে ইসানা পাল্টা কথা বলল না। প্রস্থান করল। নিজের কেবিনে এসে দু’হাত দিয়ে কপাল চেপে ধরে। রাদ চেয়ার দুলিয়ে মনিটরে ইসানাকে দেখছে। ক্ষণে ক্ষণে তাকে পাবার আক্ষেপ তীব্রভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার। জিদ্দি হয়ে উঠছে হৃদয়ে।
__
পরদিন…
‘কি ব্যাপার হঠাৎ জরুরি তলব দিলে যে।’ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল মুরাদ।
‘কী হচ্ছে এসব? তোমরা কি শুরু করলে?’ সোহানা বিরক্ত হয়ে মুরাদকে প্রশ্ন করল।
‘আমি কি করেছি? সব তো রাদেই করছে।’
‘এমন ফালতু কাজ করা বন্ধ করতে বলো তাকে।’
‘কী করা যায় বলো তো?’
‘আমি তোমার বিষয়টি সহজে মেনে নেইনি। তেমনি ইসানাও মানবে না। ওঁকে বাঁধ্য করতে হবে।’
‘মানে বলতে চাইছো জো’র’জ’ব’র’দ’স্তি?’
‘তেমনই বলা যায়। কেননা ইসানা রাদের চালচলন, ব্যবহারে বুঝতে পেরেছে সব। ও কিছুতেই মেনে নিবে না রাদকে।’
‘হেই! কি বলছো? ও তো আজ ইসানাকে প্রপোজ করবে ভাবছে।’
‘হোয়াট?’ অবাক হয়ে যায় সোহানা।
‘হ্যাঁ! বুফে কিনেছে গোলাপের।’
‘দ্রুত কল দিয়ে না করো মুরাদ। ইসানা এবার সত্যি সত্যি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে একেবারের জন্য।’ উত্তেজিত হয়ে বলল। মুরাদ ফোন পকেট থেকে বের করে রাদকে কল দেয়। কিন্তু ফোন পীক করে না। আরো দু’বার দেয়। এবারও ফোন রিসিভ করে না। সোহানা উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলো,
‘কোথায় প্রপোজ করবে?’
‘ফ্যাক্টরির ছাদে ডেকোরেশন করা হয়েছে।’
‘কখন করবে?’
‘লাঞ্চ টাইমে।’
‘চলো তাড়াতাড়ি ফ্যাক্টরিতে।’
‘করুক না প্রপোজ। কতদিন আর চাপিয়ে রাখবে।’
‘তুমি বুঝতে পারছো না কেন মুরাদ। ইসানা মেনে নিবে না ওঁকে বাঁধ্য করাতে হবে।’
‘সেটা কীভাবে?’
‘আগে তুমি চলো।’ ঠেলতে ঠেলতে মুরাদকে গাড়িয়ে উঠায় সোহানা। একত্রে ফ্যাক্টরিতে পৌঁছে লিফট বেয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করে।

হঠাৎ রাদ ইসানাকে ছাদে ডাকার কারণে সে বেশ বিরক্ত হয়। পা রাখতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। এত সুন্দর ডেকোরেশন দেখে মুগ্ধ হয় ইসানা। তবে সে অবাকও হয়। বলাকওয়া বিহীন এত সুন্দর করে কেনোই বা ডেকোরেশন করা হলো? আশেপাশে ফুলের সুভাষ এতটাই তীব্র ছিল যেন মনে হচ্ছে সে কোনো ফুলের বাগানে ভ্রমণ করতে এসেছে। আরো কয়েক পা এগোতেই মুখোমুখি হলো প্রত্যাশিত এক মুখশ্রীর।
কপালে ভাজ এলো কিঞ্চিৎ। রাদের ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক থেকেও অনেক বেশি অস্বাভাবিক লাগছে। চেহারা দেখে সুবিধাজনক ঠেকছে না। দু’হাত পিছনে রাখা। নিশ্চয় হাতে কিছু রয়েছে তীব্র অনুমান ইসানার। রাদ দু’কদম সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পিছন থেকে বুফে ও আংটির রিং এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘আমি কবি নই, নই কোনো পূরানো প্রেমিক। ভূমিকা করে বলার যোগ্যতাও আমার নেই। শুধু ছোট্ট তিনটি শব্দ বলব, আই লাভ ইউ! আই লাভ ইউ এ লট! ইউ লাভ মি?’
ইসানার হৃদয় জুড়ে এক তীব্র কাঁপুনি অনুভব হয়। আকস্মিকতায় সে বিস্ময় কিঃকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে। আংটি ও বুফের দিকে তাকাল। পরপরই নজর রাদের চোখের পানে নিক্ষেপ করে। নিজেকে স্বাভাবিক করে তেজি স্বরে বলল,
‘অসম্ভব! আমি আপনাকে ভালোবাসি না। না কক্ষণো ভালোবাসবো! নেক্সট টাইম ভালোবাসা প্রকাশ করলে জব ছাড়তে বাঁধ্য হবো।’ চলে যাওয়া ধরলে রাদ উঠে দাঁড়িয়ে কণ্ঠে প্রখরতা এনে বলল,
‘দাঁড়ান! আপনাকে আমি কাল বলেছি রিজেক্ট করা জিনিসের ওপর ঝোঁক আমার তীব্র! আপনাকে পাওয়ার আক্ষেপ আরো দশগুণ বেড়ে গেলো। প্রস্তুত থাকবেন আমার হবার জন্য।’ লাস্টের বাক্যাটুকু মুরাদ ও সোহানা এসে শুনতে পায়। ইসানা ওদের দেখে এক প্রকার ছাদ থেকে ছুটে পালায়। সোহানা ইসানার পিছু নেয়। মুরাদ রাদের নিকট এগিয়ে আসতে নিলে রাদ বুকে ফেলে তীব্র ক্রোধে শক্ত হাতে আংটির বাক্স মুঠোবন্দি করে হাঁটা ধরে। মুরাদ থেমে যায়।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।#তোমায়_ছোঁয়ার_ইচ্ছে
#পর্ব_২৫
#সুমাইয়া_মনি

ইসানা ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে সোজা বাড়ি চলে আসে। সোহানা পিছু নিলে কঁড়া গলায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
বাড়িতে এসে কাপড়চোপড় গুছিয়ে মামা বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়। ক্ষণে ক্ষণে রাদের প্রপোজাল তার চোখ জলে ঘোলা করে দিচ্ছে। নিজেকে সামলে বাড়ি থেকে বের হবার সময় টাইসনকে দেখে থামে। চোখেরজল গুলো মুছে কোলে তুলে নেয়। রাদের জন্য ছোট একটি চিরকুট লিখে টাইসনের গলায় বেঁধে দেয়। চলে আসে মামাবাড়ি। এগ্রিমেন্টে সাইন না করলে জবটা আজ ইসানা ছেড়ে দিতো। কিন্তু মামাতো বোনের বিয়ের জন্য তাকে বাধ্যতামূলক জবটি করতে হবে। কাল স্যালারি পেয়েছে। স্যালারির টাকা দিয়েই হলুদের অনুষ্ঠান হবে।
কাল বাদে পরশু গায়ে হলুদ। মামা-মামি, ভাই-বোন’রা খুশি হয় ইসানাকে দেখে। তাদের সঙ্গে আলাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ইসানা। এ-প্রান্ত রাদ তার কেবিনে এসে চেয়ারে চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসল। মাথায় তার বিক্ষিপ্ত রাগ চওড়া হয়ে রয়েছে। মুরাদ কেবিনে প্রবেশ করার পর লিসা আসে।
রাদকে জিদ্দিভাবে বসে থাকতে দেখে মুরাদকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? প্রপোজালের বিষয়টি লিসাও জানতো। এতে তার আপত্তি ছিল না। মুরাদ লিসাকে কাছে ডেকে কানে কানে ওপরের ঘটনাটি জানায়। লিসা চোখ পিটপিট করে রাদের পানে তাকায়। এখন সে নিজেও নিরবতা পালন করছে মুরাদের ন্যায়। মুরাদের ফোনে কল আসে। সোহানার কল দেখে পীক করে কেবিন ত্যাগ করে,
‘ইসানা আপু কোথায় গিয়েছে?’
‘বাড়ি গেছে।’
‘ওহ!’
‘রাদের কি খবর?’
‘প্রচণ্ড রেগে আছে।’
‘একা ছেড়ে দেও তাকে। আপনাআপনি ঠিক হয়ে যাবে।’
‘মনে তো হচ্ছে না।’
‘এখন কী করবে? আমার তো মনে হয় না ইসানা রাদের প্রপোজাল কখনো মেনে নিবে।’
‘তাহলে তোমার বলা পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।’
‘কী?’
‘জ’ব’র’দ’স্তি!’
সোহানা শুনে চুপ হয়ে রয়। পরক্ষণে মুখ খুলে,
‘আন্টিকে জানাবে না?
_
রাত একটা নাগাদ বাড়ি ফিরে রাদ। রাদকে দেখে টাইসন ছুড়ে আসলে ইগনোর করে রুমের দিকে এগোয়। টাইসন কিছুটা হতাশ হয়। রাদ বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে চোখ বুঁজল।
টাইসন মাথার পাশে বসে। রাদ চোখ খুলে তাকায়৷ টাইসনের গলায় কাগজের টুকরো দেখে হাতে নেয়। সেখানে লিখা ছিল,
‘আমি মামা বাড়ি গেলাম। একদিন আগে যাওয়ার জন্য দুঃখিত!’
রাদ কাগজটি পাশে ফেলে উঠে জামাকাপড় বদলে নেয়। টাইসনকে খাবার দিয়ে ইসানার ওড়নার টুকরোটি হাতে নেয়।
বালিশে মাথা রেখে হাজারটা অভিযোগ করতে থাকে ইসানার বিরুদ্ধে।
‘আমি কী দেখতে অসুন্দর? আমার কী অধিকার নেই ভালোবাসার? বয়সে ভেদাভেদ দেখে আপনি আমাকে রিজেক্ট করেছেন? শুনে রাখুন, এই রাদই আপনার জীবনের এক অংশ হবে। আপনি চাইলেও বাঁধা দিতে পারবেন না। পারবেন না।’ লাস্টেরটুকু আওড়াতে আওড়াতে ঘুমিয়ে যায়।
.
সকালে ঘুমহীন ফুলা ফুলা চোখ নিয়ে ইসানাকে ফুলের দোকানে অর্ডার কনফার্ম করতে আসতে হয়। সেখান থেকে ফিরার পথে রেহানা আনসারীর সঙ্গে দেখা হয়। তাকে দেখা মাত্রই ইসানার দম বন্ধ হবার উপক্রম। ইসানাকে অনুরোধ করে গাড়িতে বসতে বলেন তিনি। তৎক্ষনাৎ না করতে পারল না বিধায় অগ্যত গাড়িতে উঠতে হয় তাকে।
তার গাড়িতে করে ইসানা বাড়ি অব্ধি আসে। ইসানা পুরো রাস্তায় ভীতু হয়ে বসেছিল। কালকের ঘটনাটি তুলে না ধরে বসে এই ভয়ে চুপচাপ ছিল। কিন্তু এমনটি হয়নি। ইসানাকে এবিষয় নিয়ে তিনি কিছু বলেনি। তারমানে বিষয়টি এখনো তার কাছে অজানা! ভেবে ইসানা মৃদু নিশ্বাস নিলো।
ঘন্টাখানেক হলো বাড়ি পৌঁছেছে রেহানা আনসারী। রাদ দৃষ্টি নত রেখে বিছানার ওপর বসে রয়েছে। পাশে টাইসন সহ মুরাদও ছিল। কাল রাতের ঘটনাটি লিসা তাকে জানিয়েছে। এজন্যই হঠাৎ আজ তার ঢাকাতে আসা। তিনি বেশকিছুক্ষণ রাদকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখলো। আগের তুলনায় ছেলের স্বাস্থ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। আরো কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে শান্ত কণ্ঠে বলল,
‘ইসানাকে প্রপোজ করার সাহস কীভাবে হয় তোমার? মনে রাখা উচিত ছিল ইসানা তোমার চেয়ে বয়সে বড়ো এবং ডিভোর্সি!’
রাদ বিনাবাক্যে মায়ের কথা শুনছে। তিনি ফের বললেন,
‘তোমার এ প্রপোজালে আমি আপত্তি না করে পারছি না রাদ।’
রাদ এবার মুখ খুলে। দৃষ্টি অন্যদিকে ফেলে কাঠিন্য স্বরে বলল,
‘আপনার আপত্তিতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।’
‘আমার কথা বলা এখনো শেষ হয়নি।’ তেজি স্বরে শুধালেন তিনি।
_
সারাদিন ভাবনায় মসগুল থাকা অবস্থায় দিন কাটে ইসানার। পুরো ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল রেহানা আনসারীকে নিয়ে। তিনি বিষয়টি জেনেছেন কি-না এটা নিয়েই বেশ চিন্তিত। হঠাৎ ঢাকায় আসার পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ রয়েছে।
বাড়ি থেকে আশার পর থেকে রাদ একবারও কল দেয়নি।
নিজেও দেওয়ার সাহস দেখান না।
.
কাপড় ডেলিভারি করা হয় কিছুক্ষণ আগে। রাদ নিজের কেবিনে বসে ছিল। মুরাদ ছুটে এসে রাদকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা জানায়।
‘যে ফ্যাক্টরি থেকে কাপড় ডেলিভারি করা হয়েছে সে-ই ফ্যাক্টরিতে ইভান সিনিয়র এসিস্ট্যান্ট হিসাবে জব করছে তিনদিন হলো।’
রাদের আদলে রাগের আফা ফুটে উঠলো। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
‘তাকে আমার অফিসে ইনভাইট কর এক্ষুণি। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই সরাসরি।’
‘জাস্ট ওয়েট!’
আধাঘন্টা বাদে ইভান রাদের ফ্যাক্টরিতে হাজির হয়। কেবিনে পারমিশন নিয়ে প্রবেশ করে,
‘আসতে পারি স্যার?’
রাদ ইভানের গলার আওয়াজ শুনে গম্ভীর কণ্ঠে ভেতরে আসার নির্দেশ দেয়। ইভান এগিয়ে আসলে রাদ উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্কের এপ্রান্তে এসে টেবিলের ওপর বসে দাঁতমুখ খিঁচে বলল,
‘নতুনে কোন ছক এঁকেছেন জানতে পারি মি.ইভান আহমেদ?’
ইভান ক্ষীণ হেসে জবাব দিলো,
‘মানুষ যদি একবার ভুল করে। তাকে দ্বিতীয়বার কেউ সুযোগ দিতে চায় না। এতে ভালো হবার সুযোগ হয়ে উঠে না সে-ই ব্যাক্তির। আমি অন্যায় করেছি। অতীত ভুলে নতুন ভাবে জীবনযাপন করতে চাই। আপনারা যদি আমার অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, মনে হয় না আমি আপনাদের নিকট ভালো হতে পারব কখনো।’
‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন এখন ভালো হয়ে গেছেন?’ মুরাদ অকপটে বলে উঠলো।
‘জি, চেষ্টা করছি!’
রাদ এগিয়ে এলো তার নিকট। পকেটে এক হাত রেখে গুরুগম্ভীর গলায় বলল,
‘আপনি ভালো হন বা খারাপ থাকেন তার খবর তো আমি নিয়েই ছাড়বো। তবে, আমার প্রিয় জিনিসের ওপর নজর দিলে আপনাকে ছেড়ে দেওয়ার কোনো ওয়ে থাকবে না।’
‘ইসানার কথা বলছেন? সমস্যা নেই। আমি কোনো অধিকার নিয়ে ওর কাছে যাব না। শুধু আমাকে নিয়ে আগের ভুল ধারণা গুলো অন্তর থেকে মুছে ফেলুন। আর আশা করছি ডেলিভারি ক্যান্সেল করবেন না। আমার চেয়ে ফ্যাক্টরির বেশি লোকসান হবে।’
ইভানের শান্ত-ভদ্র ব্যবহার দেখে রাদ ও মুরাদ দু’জনে অবাক হয়। মানুষ যে এত দ্রুত পরিবর্তন হতে পারে তার চাক্ষুষ সাক্ষী ইভান নিজে! দু’জনের নিরবতা দেখে ইভান নিজ থেকে বলল,
‘আর কিছু বলবেন?’
রাদ উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়ায়। মুরাদ বলল,
‘আপনি আসতে পারেন।’
ইভান বিনাবাক্য ব্যয় করে কেবিন ত্যাগ করল। রাদ চেয়ারে বসে সংশয় বশে মুরাদের পানে চেয়ে বলল,
‘দু’জন লোক’কে নজর রাখতে বল তার ওপর।’
‘ওকে।’
__
রাত পেরিয়ে সকাল হলো। নতুন এক দিনের সূচনা হয়। ইসানার কাজকর্ম শুরু হয়ে যায়। সিমার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছাদে করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। সেখানে ডেকোরেশন করার দায়ভার তার। দশটা বাজে তাদের আসতে বলা হলেও ডেকোরেশনের লোকরা বারোটা নাগাদ উপস্থিত হয়। আপাতত প্লাস্টিকের ফুল দিয়ে ডেকোরেট করছে। বিকেলে তাজা ফুল লাগানো হবে। পরিপূর্ণ ভাবে সাজানো হলে ইসানা একটু স্বস্তি পায়। চেয়ার টেনে বসার পর টুং করে ফোনে মেসেজ আসে। সে ফোন হাতে নিয়ে চেক করল, মেসেজটি রাদের নাম্বার থেকে করা হয়েছে। সেখানে ছোট্ট করে লিখা ছিল ‘স্যরি’। ইসানার আদলে তেমন পরিবর্তন দেখা যায় না। মিনিট কয়েক পর আবার মেসেজ আসল। সে-ই বার্তাতে লিখা ছিল,’প্রপোজ করার জন্য নয়। রূঢ় ব্যবহারের জন্য স্যরি।’
রাগে নাকের পাটা ফুলে উঠে তার। ফোন আনলক করে চুপচাপ বসে রয়।
.
সন্ধ্যার দিকে মেহমানদের আনাগোনা শুরু হয়। ইতিমধ্যে সিমাও পার্লার থেকে চলে এসেছে। ওঁকে স্টেজে বসানো হয়। সুরভী খাতুন ইসানাকে স্টেজের বোগল থেকে টেনে রুমে নিয়ে এলো। তিনি কিঞ্চিৎ রাগী কণ্ঠে বললেন,
‘অবস্থা কি তোর? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ কি পড়ে আছিস তুই?’
‘মামি আমি ওর বড়ো বোন। তার কি সাজগোজ থাকে বলো?’
‘থাকে না কে বলেছে? এক্ষুণি তৈরি হয়ে নে। বাকি কাজ মানিক দেখবে।’
‘মামি আমি চাই না সিমাকে হলুদ দিতে।’
‘ডিভোর্সি তো কি হয়েছে? সমাজের ভণ্ড রেওয়াজ আমি মানি না। আমাদের পরে তুই ওঁকে হলুদ দিবি। দেখবো কে কি বলে।’
‘মামি..’
‘একটা কথাও শুনতে চাই না।’ বলতে বলতে ইসানাকে রুমের ভেতরে রেখে দরজা ভিড়িয়ে দেয়। ইসানা কিঞ্চিৎ বিপদে পড়ে। সরু নিশ্বাস টেনে মামির আদেশ পালন করে। লাল ও হলুদ রং মিশ্রণ একটি গাউন পরিধান করল। চোখে মোটা কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক পড়ে ফ্রিজ থেকে একটি গোলাপ খোপায় গেঁথে নেয়।
হঠাৎ সেখানে সোহানার আগমন ঘটে। ইসানাকে রেডি হতে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এসে বলল,
‘গলা খালি খালি লাগছে। রাদের নেকলেসটি কোথায়?’
‘পড়বো না।’ অভিমানী স্বরে বলল।
‘নিশ্চয় টলির ভেতরে?’ বলতে দেরি হলেও ইসানার টলি ঘাঁটতে সময় লাগে না। ওপরেই বাক্স সহ পেয়ে যায় নেকলেসটি। ইসানা নিষেধ করার পরও জোরপূর্বক নেকলেসটি গলায় পড়িয়ে দেয়। একটি ছবি ক্লিক করে লুকিয়ে রাদের হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ড করে সে।
রাদ তখন গাড়িতেই ছিল। মুরাদকে নিয়ে ইসানাদের মামাবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে তারা। ইসানার ছবিটি দেখে রাদ মৃদু হাসে। ছবিটি জুম করে অপলক নয়নে দেখে মন জুড়াচ্ছে। অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করে তার হৃদমাঝারে!
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here