তোমার পরিনীতা – ১২
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
“সুমো এটা কিরে? ”
“খোঁপার কাটা। ”
“খোঁপার আবার কাটাও হয় নাকি, দেখিস বিড়াল যেনো ভুল করে খেয়ে না ফেলে।”
“এটা রূপোর তৈরী, বিড়াল খাবে কি করে?”
“আসল বিড়াল না খাক মানুষ বিড়াল তো খেতে পারে।”
“মানে? ”
“মানে এটা কার খোঁপার কাটা?” শ্রাবণ আঙ্গুল দিয়ে নাড়িয়ে দিতেই কাটার মাথায় সরু চেইনের শেষে ঝুলে থাকা বলগুলো রুমঝুম করে বেজে উঠলো।
“মনোরমা মাসির। ”
“মানে তোর ওই বান্ধবীর… কি যেন নাম? ”
“চারু কিন্তু এগুলো ওর নয়, মাসিরই।”
“কালই এটা ফেরত দিয়ে দিবি আর নিজে গিয়ে অল্প কিছু টাকা জমা দিয়ে বানাতে দিয়ে আসবি। বাকিটা আমি নিয়ে আসার সময় দিয়ে দিবো।”
“তার কোন দরকার নেই, আমি কালই দিয়ে আসবো কাটাগুলো।”
“হমম… কিন্তু দোকানে যেয়ে বানাতেও দিয়ে আসবি। খোঁপায় কাটা গুলো দেখতে ভালো লাগছে, “বলেই পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে সেখান থেকে উঠে গেল শ্রাবণ।
সুমন স্থির হয়ে বসে রইলো। এই একটা কথায় ওর ভিতরে জলোচ্ছ্বাস শুরু হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে নড়লেই ও সোফা থেকে পড়ে যাবে,কিন্তু খোঁপায় কাটা পড়ায় ওকে ভালো লাগছে না শুধু কাটাগুলোই সুন্দর! আর… আর কাটাগুলো কার জন্য বানাতে বললো শ্রাবনদা… সুমনের জন্য না নতুন বউয়ের জন্য !!!
…………………………
“এতো কি ভাবছো বলতো…… ”
মঞ্জু মাথার বালিশটা ঝাড়তে ঝাড়তে সমীরের দিকে তাকাল। সমীর সেই তখন থেকে চুপ মেরে আছে। কি এতে ভাবে আজকাল মঞ্জু বোঝে না। এদিকে মঞ্জু, অনুজের বিয়ের জন্য একটা মেয়ে দেখেছে প্রিয়তি নাম, কিন্তু ও সেই কথাটা তোলার কোন সুযোগ পাচ্ছে না। প্রিয়তি মঞ্জুর বান্ধবী শোভার বড় মেয়ে। মেয়েটা বেশ সুন্দরী আর ভদ্র। অনুজের সাথে মানাবে বেশ।
মঞ্জুর কথায় কপাল থেকে হাত সরাল সমীর। রামনাথ চৌধুরী যদিও সরাসরি কিছু বলেননি তবু উনার সামনে গেলেই ভীষন একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরে সমীরকে। মনে করেছিল বড় ছেলে অনুজ স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশে গেছে, পাশ করে বের হলে সে নিজেই লোনের টাকাটা শোধ করে দিবে। কিন্তু এখনও অনুজের ভালো কোন চাকরি হয়নি। আপাতত একটা বইয়ের দোকানে কাজ করছে সে টেম্পোরারি , ভালো চাকরি কবে পাবে জানা নেই, এর মধ্যে যদি রামনাথ চৌধুরী হুট করে টাকাটা চেয়ে বসেন… লজ্জার সীমা থাকবনা।
“কি হলো… কথা বলছোনা কেন? ”
“কিছু না.. ভাবছি রামনাথদার টাকাগুলো শোধ করতে পারবো কবে। ”
মঞ্জুকেও চিন্তত দেখালো।
“আচ্ছা এ ব্যাপারে শ্রাবনের সাথে একটু আলাপ করলে হতো না? ওতো বাবার সাথে প্রায়ই কি সব নিয়ে আলাপ আলোচনা করে।”
“সে তো করবেই , দুজনেই একই প্রফেশনের লোক। বাবার একসময় কত জনপ্রিয়তা ছিলো,”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সমীর। সে নিজে ছেলে হয়ে বাবার সেই নামটাকে উজ্জ্বল করতে পারেনি, সারাজীবন ছোট চাকরি করে গেল। তাই নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়েও ছেলেকে বাইরে পড়তে যাওয়ার টাকা জোগাড় করে দিয়েছে।
“আহা আমি তা বলছি না। আরও অন্য বিষয় নিয়েও ওদের আলোচনা হয়, যেমন সুমনের বিয়ে নিয়ে বাবা একদিন শ্রাবণকে পাত্র দেখার কথা বলেছিলেন। শ্রাবণও বলছিলো ওসব নিয়ে বাবাকে ভাবতে হবে না।”
“কি বলো তুমি… সুমনের বিয়ে? ” সমীর বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেন। ” সুমনের বয়স কত হলো… বিয়ের বয়স কি হয়েছে ওর?”
“ওমা…. এতে এতো চমকানোর কি হলো, মেয়ে তলে তলে কত বড় হয়ে গিয়েছে… বিয়ে দিবেনা কি ঘরে বসিয়ে পূজো করবে? যতো সব আদিখ্যেতা। আর কোথ থেকে এসব ফালতু নিয়ম চালু হয়েছে কে জানে, আঠারোর আগে বলে বিয়ে দেয়া যাবেনা… হুহ। আমাকে বিয়ে করার সময় এসব নিয়ম কানুনগুলো কোন চুলোয় ছিলো শুনি… ষোল বছর তো তখন কোন সমস্যা মনে হয়নি তোমার।”
মঞ্জুর বিরক্ত মুখ দেখে চুপসে গেলেন সমীর। ষোল বছর কেন, বাবা বললে সে সময় দশ বছরের মেয়েকেই বিয়ে করতেন তিনি। মেরুদন্ডী প্রানী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দেয়ার কথা ভাবতেও লজ্জা করে তার।
সমীর আসলে সারাটা জীবন ঝামেলা ভয় পান। আর তার কপালেই এই মুখরা মহিলাটির আাবির্ভাব হয়েছে। এই মঞ্জুর ভয়েই সুমনের জন্য কিছু করতে পারেন না তিনি কখনও, আর সুমনের জন্য করেন না বলে প্রীতিটাও বাদ পড়ে
যায়।
…………………………………….
“বল কি বলবি ” শ্রাবণ চেয়ার টেনে বসলো।
“বলবো তোর আন্ডা ”
মৌমিতার কথায় বিপদের গন্ধ পেল শ্রাবণ। আবার অমীয়র সাথে নির্ঘাত কিছু বাজিয়েছে।
” আচ্ছা কথা তোর পেটেই থাক আমাকে বরং একটা মোগলাই খাওয়া… অনেক খিদে লেগেছে।”
“শ্রাবণ, আমি কিন্তু সিরিয়াস।”
“আমিও সিরিয়াস ”
মৌমিতা রেগে গিয়ে মুখ ফোলাল।
“আচ্ছা বল….”
“তুই লাবণ্যকে পছন্দ করিস?”
অতর্কিত প্রশ্ন, তবে কথাটা একটু প্যাঁচালো শ্রাবণ।
“অপছন্দের কারন… না মানে আমাদের ইয়ারের ছেলেদের ক্রাশ ছিলো তো লাবণ্য।”
“তার মানে তোরও ছিলো ”
শ্রাবণ উত্তর না দিয়ে হাসলো।
“হাসবি না… আমি লাবণ্যর হয়ে তোকে একটা কথা বলতে চাই। ”
“মানে, লাবণ্য কি কথা বলা ভুলে গেছে? ”
“কি মানে… তুই কি অন্ধ শ্রাবণ? মেয়েটা তোর বাড়ি আসলো, তুই স্নেহ করিস বলে তোর সিক নেইবারকে ও দেখতে পর্যন্ত গেলো। আর তুই তার সাথে কি বিহেভ করছিস। তোর কি বোঝা উচিত না যে মেয়েটা কেন এগুলো করছে।
শ্রাবণ এবার সত্যি মৌমিতার দিকে অনিশ্চয়তার দৃষ্টিতে তাকাল। ওর নিজের কাছেও যে লাবণ্যর আচরন অন্যরকম লাগেনি তা নয় কিন্তু সেটা কি আসলেই সিরিয়াস কিছু? সেদিন ওর দিদির বিয়েতেও কিসব বলছিলো।
“কি হলো…। দেখ, শ্রাবণ তুই যথেষ্ট বুদ্ধিমান একটা মানুষ। আমার মনে হয়না লাবণ্যর চোখমুখ দেখে তুই কিছু আঁচ করিসনি।”
শ্রাবণের মনে হলো এর পরের কথাগুলো আসলে লাবণ্যর সাথেই হওয়া উচিত।
” তুই সবটা ঠিক ঠিক জানিস তো মৌমি।”
“অবশ্যই। কোন কনফিউশান থাকলে কি আমি তোকে কথাটা এভাবে বলতাম, আর আমি তোদের দুজনকেই খুব ভালোবাসি। এখন তুই বল তুই কি চাস।”
শ্রাবণ কি চায়? শ্রাবণ বেশ অনেকটা সময় নিয়ে রেস্টুরেন্টের জানালার ওপাশে হাটাতে থাকা মানুষগুলোকে দেখলো। লাবণ্যকে ভালো লাগেনা এটা বললে মিথ্যা হবে, কলেজের নবীন বরনের দিনে গাঢ় সবুজ রঙের জামদানী পড়া মেয়েটি মনে ভীষন দাগ কেটেছিলো, মুগ্ধতায় ছেয়ে গিয়েছিলো চারপাশটা। পরে জানতে পেরেছিলো মেয়েটি ওদের সাথেই পড়ে। মাঝামাঝে টুকটাক কথা হতো, ব্যাস। কিন্তু সেটুকুর গন্ডী পেরিয়ে আরও বিশেষ হবার সময় বা সুযোগ কোনটাই ওর বা লাবণ্যর হয়ে উঠোনি। কিন্তু এখন এতোদিন পর সেই মেয়েটি নিজে যেচে ওকে কিছু বলতে চায়, সুযোগটা কি শ্রাবণের হারান উচিত?
“লাবণ্যকে তুই বল যে , কাল আমি বিকেলের পরে
নিউমার্কেটের প্রথম গেইটে ওর জন্য অপেক্ষা করবো।”
“তুই শিওর তো যে আসবি?”
“শিওর ”
“আর আই লাভ ইউটা…… ”
“এটাও তোর কাছেই কনফার্ম করতে হবে?”
“হি হি হি.. না না ঠিক আছে ওটা ঠিক মানুষটাকে বললেই হবে।”
………………………………..
“সুমন কি কখনও দেশের বাইরে গিয়েছো? ”
আদিত্যর প্রশ্নে সুমন মাথা নেড়ে না করলো।
“কখনো যেতে ইচ্ছে করেনা?”
“খুব করে… কিন্তু বেড়াতে যেতে, থাকার জন্য একটুও ভালো লাগে না।”
“বারে না থেকেই কি করে বলছো যে ভালো লাগবে না, লাগতেও তো পারে।”
“লাগবেনা কারন আমি আমার দাদুকে ছাড়া থাকতে পারিনা। ”
“তাহলে তো একসময় এ দেশেও থাকতে পারবেনা।”
আদিত্য কথাটা বলার সাথে সাথে সুমন ভ্রু কুঁচকে তাকালো। লোকটা এমন কথা কি করে বললো…
“রাগ হলে? আমি কিন্তু জাস্ট ব্যাপারটা বোঝানোর জন্য উল্লেখ করলাম,” আদিত্য বললো।
“দাদু ছাড়া আমার সত্যিকার অর্থে কেউ নেই। এসব কথা শুনলে আমার তাই খুব মন খারাপ হয়। আর কখনো এই কথা না বললে খুশি হবো।”
আদিত্য, সুমনের কথায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সুমন তো ভীষন আবেগপ্রবন… মেয়েটার চোখ দুটো ছলছল করছে।
“আরে.. তুমি তো সিরিয়াসলি মাইন্ড করেছ দেখছি। আই অ্যাম সরি… আর কখনো বলবো না,” আদিত্য সাথে সাথে দু’হাত দিয়ে কান ধরলো।
সুমনের কিন্তু আসলেও খুব রাগ হয়েছিলো। তবে আদিত্য লোকটা মোটেও খারাপ না, সুমন নিজেও সেটা জানে। তা না হলে একেবারে বিনে পয়সায় সময় নষ্ট করে এতোগুলো মানুষকে পড়াতো না। কথাটা মনে হতেই লজ্জা লাগলো সুমনের।
আদিত্যর সাথে এই আচরন করা আসলে ওর মানায় না। আসলে…সব দোষ শ্রাবনদার। খাতা ভরে কি সব ছাইপাঁশ লিখতে দিয়েছে ওকে, তাই নিয়ে প্রীতি হেসেই বাঁচছে না। সুমনের খুব রাগ হচ্ছে এই নিয়ে।
“আ..আমাকে মাফ করবেন প্লিজ, আমি দুঃখিত।”
“আরে এই মেয়ে.. তুমি কি পাগল নাকি। আমার কাছে মাফ চাইছো কেন? ”
“আপনার সাথে এভাবে কথা বলা আমার ঠিক হয়নি। আমি খুবই দুঃখিত, আমায় মাফ করবেন প্লিজ। ”
“উমম… এক শর্তে মাফ করবো।”
“কি সেটা? ”
“তোমাদের বাড়িতে গিয়ে তোমার দাদুর সাথে পরিচিত হতে চাই, সাথে তোমার হাতের এক কাপ চা যদি হয়.. বেটার।”
“আচ্ছা… কিন্তু আপনি সত্যি আমাদের বাসায় যাবেন? ”
“হ্যা, তোমার দাদুর সাথে পরিচিত হতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।”
“আমরা কিন্তু আপনাদের মতো অতো বড়লোক নই। ”
“কিন্তু আমিতো তোমার দাদুর কাছে গিয়ে আমার কাজের পারিশ্রমিক চাইবো।”
“মানে? আপনি না বলেছিলেন কোন টাকা- পয়সা নেবেন না।”
“টাকা নিবো সেটা কখন বললাম, চাইলাম তো পারিশ্রমিক।”
“কি পারিশ্রমিক চাইবেন? ” কৌতূহল হলো ভীষন সুমনের।
“সে যার কাছে চাইবো তার কাছেই বলবো, আপাতত আমি কবে তোমাদের বাড়ি যাবো সেটা বলো।”
“আপনি আসুন যখন আপনার মন চায়। ”
“তাহলে পরশু বিকেলে… কেমন? ”
সুমন সম্মতি জানিয়ে দ্রুত হাটতে লাগলো। এসেছিলো কাল সকালে পড়তে আসতে পারবেনা সেটা জানাতে। কাল মাঞ্জু মামীর আত্মীয় আসবে গ্রামের বাড়ি থেকে। কিন্তু এখন দ্রুত বাসায় যেতে হবে।এখন আবার নতুন আইন জারি হয়েছে ওর উপরে, প্রতিদিন সকালের বদলে ওকে এখন রাত সাতটার পরে বইখাতা নিয়ে হাজির হতে হয় শ্রাবণের দরবারে। সুমনের দশ মিনিট দেরী হলে তার সাজা চলে অতিরিক্ত বিশ মিনিট। পনের হলে ত্রিশ মিনিট… পারলে সুমন এখন এক দৌড়ে শ্রাবণের ঘরে পৌছাত।
…………………………………….
লাবণ্য আজ চুলটা বেশ অনেক সময় নিয়ে বেঁধেছে। হালকার উপর মেকাপও দিয়েছে। কিন্তু বুকের ঢিপঢিপটা কেন যেন কিছুতেই কমাতে পারছেনা।
“আর কিছু দিতে বলবো?” হালকা স্বরে জিজ্ঞেস করলো শ্রাবণ।
“নাহ…”
“তাহলে শুধু কফিটাই থাক। ”
লাবণ্য স্মিত হাসে। শ্রাবণ এখনও কফি খাবে কিনা এই নিয়ে পড়ে আছে, ওকি এতো সেজেগুজে এসেছে এই কফি খাবার জন্য।
“উহহ..,” শ্রাবণ নিজেও খুব অদ্ভুত ফিল করছে। আসলে লাবণ্যকে দেখলে একটা অদ্ভুত জড়তা ওকে ছেয়ে ধরে। মনে হয় অতিরিক্ত নার্ভাসনেসে ওর সব উল্টেপাল্টে যাচ্ছে। কিন্তু কোথাও থেকে শুরুটা করা দরকার আর আজ প্রথম পদক্ষেপটা বোধহয় ওকেই নিতেই হবে। ” মৌমি বলছিলো….”
“আমিই বলতে বলেছিলাম ”
লাবণ্যর কথাটা খুব স্পষ্ট, শ্রাবণের অদ্ভুত লাগলো, একদম খাপ খোলা তলোয়ার। কোন রাখ ঢাক নেই।
“আসলে বাসায় বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে… দিদির বিয়েটা হয়ে গেলোতো। তুমি কি একবার বাবার সাথে দেখা করবে?”
“লাবণ্য আমি আসলে এক্ষুনি তোমাকে ফাইনাল কিছু বলতে পারছিনা, আমার সময় চাই।”
“কেন? তোমার কি আমাকে পছন্দ নয়? ”
“আসলে বাবা এক জায়গায় আমার জন্য পাত্রী দেখেছে। ওরা এখনও কিছু জানায়ইনি। আর বাবার মান- সম্মানকে আমি ছোট করতে পারবনা।”
“তারমানে কি ওদের হ্যা বা না এর উপর আমাদের ফিউচার নির্ভর করছে। ”
“শুনতে ভালো না লাগলেও আপাতত এটাই সত্যি।”
“কিন্তু তোমার পার্সোনাল পছন্দটা… আমার সাথে এই দেখা করতে আসাটা, এটাকে আমি ঠিক কি হিসেবে নিব? ”
“আসলে সত্যিটা কি জানো লাবণ্য, আমি…..”
কথাটা শেষ করার আগেই শ্রাবণের ফোনটা ভাইব্রেট করা শুরু করলো। লাবণ্য স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ছবিটা সুমনের। চট করে বিরক্তিটা আকাশে গিয়ে ঠেকল লাবণ্যর। আসলে গোল টেবিলে বসার জন্য খাবারের ট্রে সরাতে গিয়ে শ্রাবণের ফোনটা শ্রাবনের চেয়ে লাবণ্যর কাছে বেশি চলে গিয়েছে, তাই আড়চোখেও ‘ কলিং ফ্রম হোম ‘ শব্দটা পড়তে কোন বেগ পেতে হলোনা লাবণ্যর। এই মেয়ে সিসিটিভির মতো সব জায়গায় শ্রাবণকে ফলো করে নাকি? আগেও যখন কথা বলতে গিয়েছিলো তখন নিজে না পারলেও নিজের দূত পাঠিয়ে দিয়েছিলো আর এখন স্বয়ং নিজেই এসে হাজির হয়েছে।
……………..……………………..
“সুমো আজ তুই কি খেয়েছিস রে? ”
“কেন বলতো? ”
সুমন ভয়ে ভয়ে তাকালো। আবার কোন ভুল হলো ওর… হুসস এতো কষ্ট করে মুখস্থ করলো আর এখন আবার সেই ভুল। এরকম হলে পড়াশুনা ছেড়ে বিবাগী হবে সুমন।
“কি হয়নি তাই বল ”
“কোনটা হয়নি? ” সুমন কাঁদো কাঁদো স্বরে জানতে চাইলো।
“তুই তো আজ হান্ড্রেড পারসেন্ট কারেক্ট দেখছি… নাকি আমার চোখই গেলো।”
“সত্যি…. ”
“সত্যি, ভুল খুঁজে পাচ্ছিনা যে কোথাও।”
“আদি স্যার ইউ আর এ জিনিয়াস, থ্যাংকিউ থ্যাংকিউ থ্যাংকিউ,” সুমন নিজের অজান্তেই আঙ্গুলের মাথা ঠোঁটে ছুঁইয়ে ফ্লাইং কিস ছুড়লো।
ঠাস শব্দ করে কলমটা নিচে গড়িয়ে পড়ে গেল শ্রাবণের কাছ থেকে। আদি স্যার, তারমানে ওই চারুর মামা লাগে যে লোকটা তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে সুমো। অবশ্য সেই আজকাল সুমনকে সকাল বেলাটা পড়ায়। শ্রাবণ তাই কাজ শেষে সন্ধ্যায় এসে সুমনকে নিয়ে বসে। কিন্তু সুমনের এমন ঝলমলে চেহারায় ‘আদি স্যার’ শব্দটা শুনতেই শ্রাবণের মুখটা ঘোর অন্ধকার হয়ে আসলো, তার উপর আবার ফ্লাইং কিস।
সুমনের মুখে ওই নামটা শুনলেই চিরবির করে জ্বালা ধরে শ্রাবণের আর সুমোটা শুধু ওই নাম জপ করতে থাকে… অসহ্য।
কিন্তু সুমনের চোখমুখ তখন নতুন আলোয় উদ্ভাসিত।
চলবে…..
তোমার পরিনীতা – ১৩
( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)
লেখিকা- ফায়জা করিম
( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)
“খুব খুশি হলাম ভাই. … এই বয়সে তোমার মতো প্রানোচ্ছল একজন মানুষের সাথে পরিচিত হতে পেরে। সুমন বার বার তোমার নাম করছিলো।”
বীরেন বাবু নিজের মাথার চকচকে টাকটাতে হাত বুলালেন।
“আমিও, ইনফ্যাক্ট আমি সুমনের মুখে আপনার কথা এতো শুনেছি যে আপনার সাথে পরিচয় হওয়ার খুবই শখ ছিলো।”
বীরেন বাবু হাসলেন, আদিত্য ছেলেটাকে এই এক ঘন্টায় ভীষন পছন্দ করে ফেলেছেন তিনি। খুবই খোলামনের আর হাসিখুশি একটা ছেলে। তার মধ্যে আবার বিদেশে যাচ্ছে উচ্চতর ডিগ্রীর শিক্ষায় শিক্ষিত হবার জন্য, বিদ্বান লোকের কদর করতে কোন কার্পন্য নেই বীরেন বাবুর।
এদিকে আসার পর থেকে এই এক ঘন্টায় রাজ্যের সব খবর নিজের থলিতে মজুদ করেছে আদিত্য। বীরেন বাবু সুমনকে চোখ দিয়ে ইশারা করতেই, সুমন ছুটলো নাস্তার ব্যবস্থা করতে।
ডাব্বুকে সাথে নিয়ে আগেই মোড়ের রাজকুমার মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে আধা কেজি মিষ্টি এনে রেখেছে সুমন। কিন্তু ঘরে নাস্তা নিয়ে ঢুকতে গিয়ে দেখলো বড় বিপদ, আষাঢ় মাসের বৃষ্টির মতো হুট করেই শ্রাবণ মহারাজের আগমন ঘটেছে বীরেন বাবুর ঘরে। সুমন তাড়াতাড়ি আর এক কাপ চায়ের বন্দোবস্ত করলো। সাথে একটা বাটিতে খানিকটা বুন্দিয়া নিলো।
শ্রাবণ খুব পছন্দ করে বলে নির্মলা মাঝে মাঝেই এই জিনিসটা বাড়িতে নিজ হাতে বানান। সাথে সুমন থাকলে সুমনও অনেক সময় এটা তৈরী করতে সাহায্য করে। কিন্তু আজ মিষ্টির দোকানে এতো রঙের বুন্দিয়া দেখে আর লোভ সামলাতে পারেনি সুমন, কিনে নিয়ে এসেছে খানিকটা। এটা সুমন আসলে শ্রাবণের জন্যই এনেছে, সেদিন পড়া পেরেছিলো বলে খুশিতে।
শ্রাবণ একমাস আগের একটা সংবাদপত্রের কাটিং হাতে নিয়ে জটিল একটা কেসের বিষয়ে শলাপরামর্শ করার জন্য বীরেন বাবুর ঘরে ঢুকেই থমকে গেল। সাধারনত বীরেন বাবুর রুমে বাইরের লোক এখন আর সহজে ঢোকে না, বাসার সদস্য বাদে শ্রাবণই সবচেয়ে বেশি যাতায়াত করে। সেখানে একেবারেই অপরিচিত একজন মানুষ বীরেন বাবুর একেবার পাশে বসে গল্প করছে, শ্রাবণ দাড়াবে না চলে আসবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না।
“আরে আরে শ্রাবন…. এদিকে এসো, তোমার সাথে এনার পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি হচ্ছেন আদিত্য নারায়ন , সুমনের বান্ধবী চারুর মামা।”
দপ করে কিছু একটা জ্বলে উঠে পুড়তে লাগলো… সেই পোড়ার গন্ধে আশে ওাশের প্রতিবেশি কম বেশি সজাগ হলেও বাড়ির মালিক যেমন নাক শুঁকে বলে কার বাড়ি আগুন লাগলো…. শ্রাবণের অবস্থাও কিছুটা তেমন।
আদিত্য নামটা শোনার সাথে সাথেই সামনে বসা ভদ্রলোকের সম্মন্ধে বাকি কিছু শোনার আগ্রহটা পুরোপুরি উবে গেছে শ্রাবণের। এমনকি এক ঝলক দেখার পর কাজ আছে বলে বাসায় যাবার উদ্দেশ্যে পাও বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু বাঁধ সাধলো সুমন, হাতে ট্রে আর তাতে তিন কাপ চা। ঈর্ষা, অহং সব মিলিয়ে .…. নিজে তাতে বেশ জ্বলে পুড়ে তেতে উঠতে লাগলো শ্রাবণ। বাহ, বেশ চা খাওয়া হয় তারমানে আজকাল, অবশ্য হবেই বা না কেন…. বান্ধবীর মামার কাছে পড়তে তো আর সারাবেলা লাগে না, বাকি সময়ে আড্ডাবাজিটা তো করাই যায়।
“ওই দেখো.. সুমন তোমার চা টাও নিয়ে এসেছে, কথা না বাড়িয়ে বরং সেটা খেয়েই যাও।”
বীরেন বাবুর অনুরোধে অনিচ্ছাকৃত ভাবেই বসতে হলো শ্রাবণকে।
“বুঝলে আদিত্য. … এই হলো আমাদের জেন্টলম্যান শ্রাবণ চৌধুরী, দুর্দান্ত একজন উকিল… যদি কোন মামলায় ফেঁসে যাও, সোজা ওর কাছে চলে আসবে, নিশ্চিত কেস জিতিয়ে দিবে।”
বীরেন বাবুকে, শ্রাবণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে দেখে আদিত্য নিজ থেকেই শ্রাবণের সাথে কথা বলার আগ্রহ দেখাল। কিন্তু টুকটাক প্রশ্ন করার ফাঁকেই আদিত্য খেয়াল করলো, শ্রাবণ লোকটা অত্যন্ত গম্ভীর প্রকৃতির এবং সে আদিত্যর সাথে আলাপ করতে তেমন আগ্রহী নয়, তাই আদিত্য চুপচাপ সুমনের দেয়া মিষ্টি খেতে লাগলো।
ওদিকে আদিত্যর সাধারন প্রশ্নেও শ্রাবণের কপাল কুঁচকে যাচ্ছে নিজের অজান্তেই। কিন্তু এতো জ্বলুনির কারনটা শ্রাবণ ধরতে পারছেনা কোনভাবেই।
তবে আচমকাই মেজাজটা হঠাৎ ছেচল্লিশ ডীগ্রী থেকে চার ডীগ্রীতে নেমে আসলো সুমনের হাতের বাটিটা দেখে। বাটি ভরা বুন্দিয়া। এটা শ্রাবণের ফেভারিট একটা খাবার। সুমো এটা জানে, তারমানে চা টা তাহলে ওর জন্যই এনেছে সুমো। মুখের উপর রাগের ছোপটা আসি আসি করে আবার পালিয়ে গেলো শ্রাবনের।
আদিত্য মিষ্টি খেতে খেতে খুব মনযোগ দিয়ে খেয়াল করলো সুমন, শ্রাবণের চায়ের কাপে পুরো দুই চা চামচ চিনি মেশালো।
দুই চা চামচ চিনি…!
আদিত্য সেটা দেখেই বাঁধা দেবার কথা ভাবছিলো। আদিত্য নিজে মিষ্টি সাধারণত এড়িয়ে চলে, চায়ে চিনি সে খুবই সামান্য খায়। কিন্তু আদিত্য বলার আগেই সুমন নিজেই আদিত্যকে কতটুকু চিনি দিবে জিজ্ঞেস করলো।
“এক চা চামচই এনাফ। দুই চা চামচ চিনি আমার সহ্য হবেনা।”
আদিত্যর কথায় সুমন হেসে ফেললো, ” আসলে শ্রাবণদা বরাবরই ওই দুই চা চামচ চিনি খায় চায়ে, ছোটবেলা থেকেই দেখছি।”
“বাহ… তাহলে তো শ্রাবণ বাবু সম্পর্কে কারও কিছু জানার থাকলে তাকে শুধু সুমনের কাছ পর্যন্ত আসলেই হবে।”
“হ্যা, তা বলতে পারো, নাতনির আমার চৌধুরী বাড়ির নাড়ি নক্ষত্র সব মুখস্থ। শ্রাবণের রুমাল থেকে শুরু করে ওদের বাড়ির বউ বন্দনার শাড়িও সুমন ঠিক করে দেয়। শ্রাবণের মা নির্মলা তো সুমন বলতে পাগল, মোটে চোখের আড়াল করতে দিতে চায় না। একদম নিজের মেয়ের মতন ভালোবাসে। ”
বীরেন বাবুর মুখে নিজের মায়ের কথা শুনে আস্তে আস্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো শ্রাবণের মুখটা। বাবা – মা দুজনকেই সে খুব ভালোবাসে তবে মায়ের প্রতি টানটা শ্রাবণের বরাবরই একটু বেশি। যে কোন কাজে মায়ের সাপোর্টাই ও সবচেয়ে বেশি পেয়েছে, এমনকি সুমোর জন্য টাকা -পয়সা দেয়ার ক্ষেত্রেও মা ওকে অনুমতি দিয়েছেন সবসময়।
কিন্তু আদিত্যর কাছে বীরেন বাবুর কথাগুলো একদমই সঠিক বলে মনে হলোনা, উল্টো শ্রাবণের উপর সন্দেহ জন্মাল। শ্রাবণ চৌধুরীর পরিবারের যে আর্থিক বিবরন আদিত্য, বীরেন বাবুর কাছে শুনেছে তাতে সুমনের মতো গরীবকে যতসামান্য সাহায্য করার বিনিময় চৌধুরীরা যে বিশাল আকারের মুনাফা লুটে নেয় এই সন্দেহ তার দৃঢ় হলো। তা না হলে সুমনের পড়াশোনার দায়িত্ব নিশ্চই চৌধুরী পরিবার বহন করতো,আর সেক্ষেত্রে নিশ্চই সুমনকে বিনি পয়সায় মাস্টার খুঁজে বেড়াতে হতো না।
“আমি উঠছি… সুমো তোর কাজ শেষ হলে একবার আমার সাথে দেখা করিস,” বলে শ্রাবন আর দাড়াল না। আগের বিরক্তিকর ভাবটা যদিও এই মুহুর্তে আর নেই তবু আদিত্যকে ওর পছন্দ হয়নি। কেমন গায়ে পড়া টাইপের লোক , শ্রাবণ দ্রুত ও বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলো।
আদিত্যও আর বেশি সময় থাকলো না। আবার একদিন আসবে বলে বীরেন বাবুর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
……………………….
“শ্রাবনদা কই গো বড়মা? ”
“বাড়িতেই আছে, শান্তনুর ঘরে। দুটো মিলে কি যেন একটা পাকাচ্ছে। ”
“দেখো… মনে হচ্ছে নাড়ুতে পাক দিচ্ছে। চলো গিয়ে দেখি।”
“তুই যেয়ে দেখে আয় যা,আমার ওসব নাটক দেখার সময় নেই,” বলে নির্মলা একটা রান্নার ম্যাগাজিন নিয়ে বসলেন। এমনিতে তিনি খুব কম সময় বসে থাকেন, কিন্তু আজ সময় পেয়ে তিনি আর অন্যকিছু করতে রাজি নন।
“সত্যি যাব বড়মা? ”
“যা বললাম তো।”
সুমন, শান্তনুর ঘরের দরজায় দাড়াতেই শুনতে পেলো, শ্রাবণ কি নিয়ে যেন খুব বিরক্ত। দরজায় সুমনের ছায়া দেখতে পেয়েই ভরাট স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “কি চাই? ”
শ্রাবণের মুখ থমথম করছে। প্রশ্ন শুনেই সুমন আধমরা হয়ে গেলো।
“শ্রাবনদা তুমি আমায় আসতে বলেছিলে। ” সুমন মিনমিন করে উত্তর দিল।
“আসতে বলেছিলাম বলেই কি সব জায়গায় চলে আসতে হবে বুকটান করে ? এ বাড়িতে কোথাও যেয়ে যদি একটু শান্তি পাওয়া যায়, দফায় দফায় সবগুলো কাজেরলোক গোয়েন্দাগিরি করে বেড়ায়। প্রাইভেসি বলে এ বাড়িতে কোন জিনিসই নেই।”
শ্রাবণ, সুমনকে প্রচুর বকে বটে কিন্তু সেটা সুমন এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। শ্রাবণ ওকে বকবে এটা যেন একটা অলিখিত চুক্তি। কিন্তু আজ শ্রাবণের বলার ভঙ্গিতে কি একটা যেন ছিলো। সুমন উত্তর দেবার ভাষা হারিয়ে ফেললো। শ্রাবণদা কি তবে ওকে গরীব বলে ঘেন্না করে, না হলে ওকে কাজের মানুষদের সাথে তুলনা কেন করলো?
“আমার ভুল হয়ে গেছে, আমি যাই।”
সুমন আর এক সেকেন্ডও সেখানে দাড়াল না।
“আশ্চর্য তুই বাবার রাগ সুমনের উপর ঝাড়ছিস কেন? ও কি জেনে কিছু করেছে ? আর পাত্রীর বাবা-মাই বাবার কাছে বলেছে যে, তাদের মেয়ের বিয়ে তারা অনাত্র দিতে চান। এখন এটা শুনেই বাবা চটে আগুন হয়ে গেছেন,তাই তোকে বকেছেন। ”
“কেন আমি আবার সুমোকে কি বললাম ?
” কি বললাম মানে…. সুমনকি আমাদের বাড়ির কাজের বুয়া? ”
শান্তুনুর কথায় হুশ হলো শ্রাবনের।
শিট….. শিট।
প্রায় দৌড়ে ওঘর থেকে নিজের ঘরে আসলো শ্রাবণ। কিন্তু ঘর তো ফাঁকা, সুমন নামের মায়া হরিণের কোন অস্তিত্ব সেখানে নেই।
চলবে………