তোলপাড়💓 পর্ব ৪৯+৫০

#তোলপাড়💓
#সিজন২
#পর্বঃ৪৯
#শান্তনা_আক্তার(Writer)
(কোনো ক্রমেই কপি করবেন না)

টেবিলের উপর তিনটি কফির মগ থেকে ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে সোফায় বসে তিনজন ব্যক্তি প্রাণখুলে হাসছে। তাদের হাসি থামার নাম-গন্ধই নিচ্ছে না যেন। হাসির এক পর্যায়ে রিমি বলে ওঠে,

‘তোমরা কফি নিচ্ছো না কেন? ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।’

রেজওয়ান হাতে মগ তুলে নিয়ে বলল, ‘হাসতে হাসতে আমার পেট ব্যথা হয়ে গিয়েছে ভাবি। আর পারছি না।’

‘আমারও একই অবস্থা।’ রিমি বলল।

নিমিষেই আহসানের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সে বলল,
‘কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমরা যা করেছি ঠিক করিনি। এভাবে ভালবাসা হয়না।’

রিমি ছ্যাঁত করে ওঠে বলে, ‘কি ঠিক হয়নি? আমাদের জন্য জিসান আর জান্নাতের সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে। আর তুমি বলছো ঠিক হয়নি?’

‘হ্যাঁ তা হয়েছে। তবে রিয়েল লাভ কি এতই সোজা? জিসান হয়তো রেজওয়ানকে হিংসে করে জান্নাতের সাথে কিছুটা হলেও ক্লোজ হয়েছে। তবে এটা তো নিশ্চিত নয় যে ও জান্নাতকে ভালবাসে।’

‘সেটাও হয়ে যাবে। হিংসা জিনিস সব ক্ষেত্রেই উপকারী৷ উল্টোনোর ক্ষেত্রেও, আবার শুধরানোর ক্ষেত্রেও। রেজওয়ান আরেকটু অভিনয় করলেই পুরোপুরিভাবে প্ল্যান কার্যকর হয়ে যেত। কিন্তু তুমি আটকে নিলে। শুধু আজকের দিনটাই যথেষ্ট ছিল ফাইনাল রাউন্ডের জন্য। তা আর হতে দিলে না!’

‘একদমই না। আজও যদি রেজওয়ান জিসানের জেলাসিং এর কারণ হতো, তাহলে আমি নিশ্চিত জিসান হয় রেজওয়ানকে পিটাতো, আর নাহয় খুব বড়সড় কিছু ঘটে যেত। তাছাড়া আজ ওদের মিষ্টি মুহুর্তগুলোর উপর কুফা লেগে যেত। তাই যা হয়েছে, যতটুকু হয়েছে, ততটুকুর মধ্যেই ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ থাক। আমি চাই এখন জিসান নিজে থেকে জান্নাতকে অনুভব করুক।’

‘আচ্ছা তাই হবে নাহয়। কিন্তু ভাবির প্ল্যানটা কিন্তু আসলেই অত্যন্ত ভালো ছিল। আমারতো জিসানকে জ্বালাতে বেশ লেগেছে। তুই কি বলিস আহসান?’

‘তোর ভাবির প্ল্যান ভালোই। তবে মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারতো। এখন আর কোনো অভিনয় নয়। তুই আর বাড়াবাড়ি করতে যাসনা। এখন কিন্তু জিসান আর জান্নাতের মধ্যে ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাই এখানেই সকল পরিকল্পনার সমাপ্তি টানলে ভালো হয়। কারণ আমি চাচ্ছি বাকীটা ওদের উপর ছেড়ে দিতে। যেহেতু সামনের পথ চলা ওদের নিজেদেরকেই চলতে হবে।’

‘ঠিক আছে ব্রো। আমাকে ভাবি যতটা,যেভাবে বলেছে, আমি ঠিক ততটাই করেছি। তার থেকে বেশিও না, আবার কমও না। যাই হোক, আমার কাজ তাহলে শেষ। এখন তোদের কাল সুন্দরভাবে বিদায় দিতে পারলেই আমার দায়িত্ব সম্পূর্ণ শেষ হবে। আমি তাহলে উঠলাম।’

রেজওয়ান চলে গেলে রিমি বলে ওঠে, ‘আজ কিন্তু জিসান আর জান্নাতের জুটিটা সত্যিই খুব ভালো লেগেছিল। কারো নজর যেন না লাগে ওদের উপর এই দোয়াই করি।’

আহসান কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,
‘আমিও তাই চাই। কিন্তু তোমার বোন কোথায়? রিসোর্টে আসার পর থেকে দেখিনি ওকে।’

‘রুম থেকে বের হলে তো দেখবে। তিসু খুব ক্লান্ত। তাই ঘুমিয়ে পড়েছে।’

‘ওও ভালো করেছে। কিন্তু এখনতো ডিনারের সময় হয়ে এসেছে। ওকে ডেকে তোলো গিয়ে। যেকোনো সময় খাবার দিয়ে যেতে পারে।’

‘ডাক দিতে মানা করেছে। বলেছে ঘুম ভাঙলে একাই এসে খেয়ে যাবে। ঘুমাকনা মন ভরে। যা বুঝলাম, মন ভালো না ওর। গতকাল থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে।’

‘তোমরা বোনেরাও না কেমন জানি! এখানে আসার সময় পাগল করে ফেলছিলে আমায়। এখন আবার ফিরে যাওয়ার জন্য পাগল বানাচ্ছো। কি একটা অবস্থা!’

বালিশের সাথে মুখ গুজে অবিরত চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে তিয়াসা। কিছুক্ষণ পর কান্না থামিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বারান্দার দরজা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে হিম শীতল এক দখিনা বাতাস বয়ে গেল তিয়াসার গা ঘেঁষে। ঝুঁটি করা চুলগুলো বাতাসের তোড়ে উড়ছে অবলীলায়। এমন এক পরিবেশের সান্নিধ্যে এসে ভারাক্রান্ত মন কিছুটা হলেও উচ্ছ্বসিত হলো তার। তিয়াসা বারান্দার রেলিং ধরে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে অস্ফুটে বলল, ‘আপু তুই না একদম ঠিক বলেছিলি। মানুষের মন বদলাতে সময় নেয়না। আজ আমি নিজেই সেই মন বদলের ভুক্তভোগী হয়ে গেলাম। একদিন না বুঝে জিসানকে ফিরিয়ে দিয়ছিলাম অপমান করে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! আজ আমি নিজেই জিসানের কাছে অবহেলিত! এটা কেন হলো? হলোই যখন আগে কেন হলো না? কেন এই অদ্ভুত অনুভূতির জাগরণ আগে হয়নি আমার মধ্যে? তখনই যদি বুঝতাম,তাহলে আজ এত কষ্ট পেতাম না আমি। সময় আসলেই পরিবর্তনশীল। আজ আমরা যাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবো, একদিন সেই তার কাছেই ভাগ্য টেনে নিয়ে যাবে। সেটা যেভাবেই হোক। আমরা যতই মুখে অস্বীকার করি না কেন, ভাগ্যের লিখন পাল্টে যাবে না। আমি আপুকে জোর গলায় বলেছিলাম যে আমি আর যাই করি না কেন জিসানকে মনে জায়গা দেব না। হয়তো অহংকার নতুবা ওভার কনফিডেন্স নিয়ে বলে ফেলেছিলাম। তাই হয়তো আজ এই পরিনতির স্বীকার হতে হলো আমাকে। বুঝলাম, এটাই তবে “Revenge Of Nature” কিন্তু তবুও আমি ভেঙে পড়বো না। যেখানে জিসান তার ওয়াইফকে নিয়ে ভালো আছে, সেখানে আমি থার্ড পারসন হয়ে ওদের মধ্যে বাঁধার সৃষ্টি করতে চাইনা। এতে লাভ কি? স্রুতি আপুকে তো নিজের চোখেই দেখলাম ধ্বংস হয়ে যেতে। তাকে দিয়ে এটা শিক্ষা নিলাম যে জোর করে ভালবাসা পাওয়া যায়না। জোরজবরদস্তি করে ভালবাসা পাওয়া তো যায়-ই না, সাথে মরণযন্ত্রণা ভোগ করে যেতে হয় চিরকাল। এভাবে সুখী হওয়া যায়না। তাই আমি বাস্তবতা মেনে আপন গতিতে এগিয়ে যাব। পিছুটানের বশে ঘায়েল হবো না। হ্যাঁ, আমি পারবোই।
________________

আস্তে আস্তে বাতাসের বেগ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। জানালা ও বারান্দা দিয়ে গাছের পাতা উড়ে ঘরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে৷ তা দেখে জিসান গিয়ে বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিল। আর জান্নাত রুমের সমস্ত জানালা লাগাতে লাগলো। জিসান পুনরায় নিজের জায়গায় এসে জান্নাতকে কেন্দ্র করে বলল,

‘বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে। বাহিরের কন্ডিশন খুব একটা ভালো না।’

জান্নাত আনন্দ-ফুর্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, ‘ভিজবে?’

জিসান ভ্রু দ্বয় কিঞ্চিৎ ঘুচিয়ে বলল, ‘রাত কটা বাজে জানিস?’

পরক্ষণেই জান্নাত মাথা নিঁচু করে নিল। তা দেখে জিসান আবারও বলল, ‘অন্য এক সময় ভিজবো। আজ শুধু হাত দিয়েই পুষাতে হবে। পারবি?’

জান্নাতের মন পুনরায় উচ্ছলতায় ভরে ওঠে। ও বিস্মিত চাহনির সাথে বলে, ‘সত্যি!’

‘হুম সত্যি।’ বলে একটা জানালা খুলে দিয়ে জান্নাতকে ওর কাছে যাওয়ার জন্য ইশারা করলো। জান্নাত তরান্বিত গতিতে জিসানের নিকট চলে যায়। জিসান তৎক্ষনাৎ জান্নাতের হাত নিজের হাতে নিয়ে জানালার বাহিরে ঠেলে হাত মেলে দেয় বৃষ্টির ফোঁটা ছুঁতে। জিসানের হাতের উপর জান্নাতের হাত রাখা। খুব কাছাকাছি দুজন। দুজনের মধ্য সামান্য পরিমাণ দূরুত্ব। হবে ২-৩ ইঞ্চি। জিসান বিস্ময়ের বাঁধ ভেঙে জান্নাতকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। জান্নাত মারাত্মক ভাবে অবাক হলো জিসানের এমন কাজে। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে জান্নাত গাঢ় হলায় বলল, ‘তুমি কি এখনো তিয়াসাকে পেতে চাও? এখনো কি ওর জন্য তোমার মনে ভালবাসা রয়েছে?’

জিসান জবাব দেয়না। দৃষ্টি সামনের দিকেই নিক্ষেপ করে রাখে। খানিক বাদে জান্নাত আবারও একই প্রশ্ন করে। এবার জিসান উত্তর দেয়, ‘জানি না আমি।’ বলে জান্নাতকে ছেড়ে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসে পড়ে মুখ ভাড় করে। জান্নাত বুঝলো জিসান রাগ করেছে। জান্নাত ধীরে ধীরে জিসানের কাছে চলে যায়। পাশে গিয়ে বসে। তারপর বলল, ‘একটা অতি মূল্যবান জিনিস চাইবো। দিবে?’

জিসান গম্ভীর কণ্ঠে বলে, ‘জানি না পারবো কিনা। শুনে দেখি।’

জান্নাত আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘একটু ভালবাসবে আমায়? তোমার থেকে একটু ভালবাসার পাওয়ার বিতৃষ্ণা সর্বক্ষণ আমাকে খুব বিরক্ত করে। ইচ্ছেটা কি পূরণ করা যায়না আমার?’

জিসান সম্মোহনী চোখে তাকাল জান্নাতের দিকে। নেশাক্ত চোখে হাত বাড়িয়ে জান্নাতের কাঁপা ঠোঁট ছুঁয়ে দিতেই কম্পন উঠে গেল জান্নাতের সারা শরীরে। সাথে সাথে চোখ ঠেসে বন্ধ করে নিল জান্নাত। তা দেখে জিসান আরও ঘোরের মধ্যে চলে যায়। সে এক টানে কাছে টেনে নেয় জান্নাতকে। দুজনের ইচ্ছেতেই পূর্ণতা পায় অতৃপ্ত দুটো হৃদয়।
#তোলপাড়💓
#সিজন২
#পর্বঃ৫০
#শান্তনা_আক্তার(Writer)
(কোনো ক্রমেই কপি করবেন না)

সবুজ কন্যা সাজেককে বিদায় জানিয়ে সকলে রওনা দিল যার যার বাড়ির উদ্দেশ্যে। এরপর পুনরায় ব্যস্ত হয়ে যায় পুরাতন সেই রোজকার রুটিনের তালিকায়।

°°°°৫ মাস পর°°°°

রিমির ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা চলছে। সে তার পরীক্ষা নিয়ে খুব সিরিয়াস ও মনোযোগী। পড়াশোনা ছাড়া অযথা অন্য কোনো কাজে সময় নষ্ট করেনা সে। আর মোটে তিনটে পরীক্ষা বাকী রিমির। আগামীকাল তার ম্যানেজমেন্ট পরীক্ষা। দুপুরের খাবার শেষ করতে না করতেই বই নিয়ে বসে পড়ে রিমি। প্রায় আধ ঘন্টা পর আহসান হসপিটাল থেকে বাড়ি ফেরে। আহসানের মুখে প্রশস্ত হাসি। হাতে মিষ্টির প্যাকেট ও চকলেট। আহসান রিমির স্টাডি টেবিলের কাছে গিয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘তুমি যদি ডিস্টার্ব না হও তাহলে আমি তোমাকে মিষ্টি মুখ করাতে পারি?’

আচমকাই আহসানের কন্ঠ শুনে চকিত হয়ে ভ্রু সামান্য কুঁচকে আহসানের দিকে তাকাল রিমি। অসময়ে আহসানকে বাড়িতে দেখে, তার উপর হাতে প্যাকেট জাতীয় জিনিস দেখে কিছুটা অবাক হলো রিমি। সে আশ্চর্যান্বিত মুখে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি এখন এখানে? বুঝলাম না ঠিক!’

‘আগে মিষ্টিমুখ করিয়ে নেই তারপর বলছি।’

আহসান মিষ্টির প্যাকেট খুলে এক পিস সন্দেশ রিমির মুখে পুরে দিল। রিমি সন্দেশ খেতে খেতে বলল, ‘মানে কি?’

রিমির কথাটা অস্পষ্ট হলেও আহসান ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে। আহসান মুখের হাসিটা আরও গভীর করল। তারপর বলল, ‘আমি মামা আর তুমি মামি হচ্ছো। এই খুশিতে মিষ্টিমুখ করালাম বুঝলে?’

এত বড় একটা সুসংবাদ শুনে রিমি আর চেয়ারে বসে থাকতে পারলো না। বিদ্যুৎ গতিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আর বলল, ‘কিহ! সত্যি নাকি?’

‘হুম সত্যি। ফোন দিয়ে বলেছে আমাকে। কেন তোমাকে বলেনি?’

‘না, বলেনি তো!’ এরই মাঝে রিমির ফোন ক্রিং ক্রিং শব্দে বেজে উঠল। স্ক্রিনে জান্নাতের নাম। তা দেখামাত্র রিমি হাস্যমুখে কল রিসিভ করে নিল। জান্নাতের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে রিমি একমুহূর্ত দেড়ি না করে আহসানের হাত থেকে মিষ্টি নিয়ে আহসানকে খাইয়ে দিল। তারপর বলল, ‘মামা ভাগ্নে যেখানে, আপদ নেই সেখানে। আমরা কত শুনেছি এই প্রবাদটা। এখন তুমিও তোমার আগত ভাগ্নেকে এটাই বলবে।’

‘ভুল!’ স্পষ্ট ভঙ্গিতে বলল আহসান।’

‘কেন ভুল?’

‘কথাটা হবে মামা ভাগ্নে-ভাগ্নী যেখানে, আপদ নেই সেখানে। কারণ আমরা তো জানি না জান্নাতের ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে।’

‘তাইতো! হ্যাঁ তো সেটাই। আমার তো খুব আনন্দ লাগছে নতুন সদস্যদের কথা শুনে। কবে যে দেখবো?’

‘সময় হলেই দেখবে। তবে আমি যে কবে বাবা হবো? জিসান আমার থেকেও ছোট হয়ে বাবা হতে চলেছে, আর আমি বড় হয়েও পারলাম না।’

‘সে হবে কোনো একদিন ইনশাআল্লাহ। তবে এখন আমাদের জান্নাতকে নিয়ে ভাবা উচিত। প্রথম বেবি, তাই একটু বেশিই কেয়ার প্রয়োজন ওর। আমার এক্সাম তো শেষ প্রায়। কটা দিন পর আমাদের এখানে চলে আসতে বলো। আমি নিজে দেখাশোনা করবো জান্নাতের।’

‘জিসান আসতে দেবে না বলে দিয়েছে। তার ওয়াইফ তার হেফাজতেই রাখতে চায়। তবুও বাপি আমাদের হসপিটালের বিশ্বস্ত প্রেগন্যান্সি ওয়ার্ডের সার্ভেন্ট মিসেস নীলাকে পাঠিয়েছেন ফুপিদের বাড়ি। সে জান্নাতের সাথেই থাকবে সবসময়। জান্নাতের যাবতীয় কাজ উনিই করবেন।’

‘তাহলে ঠিক আছে। বাড়ির সবাই জানে তো?’

‘হুম সবাই জানে।’

‘সবাই খুব খুশি হয়েছে তাইনা?’

‘হ্যাঁ তা তো অবশ্যই। সব ভাই-বোনদের মধ্যে জান্নাত আর জিসানই প্রথম বাবা-মা হচ্ছে, এটা তো অনেক বড় আনন্দের অনুভূতি। আমার সেই ছোট্ট বোনটা আজ মা হতে চলেছে। জান্নাত কত বড় হয়ে গেছে ভেবেছো রিমি?’

‘হুম আসলেই।’

_______________

জিসান খবরটা শোনার পর পরই অফিস থেকে বাড়ি চলে আসে। আসার পর থেকে জান্নাতকে কতবার যে ধন্যবাদ জানিয়েছে তা হিসাব ছাড়া। রাতের বেলা জান্নাত জিসানের বুকের উপর মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। আর জিসান জান্নাতের খোলা চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। নীরবতা ভেঙে জিসান বলল, ‘আমি অপেক্ষায় আছি সেই দিনের, যেদিন হসপিটালের বেডে আমার নবজাত সন্তান আর তোকে নিয়ে একটা ছবি তুলবো! আমাদের দুজনের মাঝে ফুটফুটে বেবিটা থাকবে। আর ওই ছবিটা বড় করে ফ্রেম করে দেয়ালে টাঙাবো। প্রথম বেবি বলে কথা।তখন আমার মনের অনূভুতি কেমন হবে তাই ভাবছি শুধু। আমারতো আজই কোলে নিয়ে চুমু খেতে মন চাচ্ছে আগত ছোট শরীরটাকে।’

‘তুমিও না? একটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে বেবি কোথ থেকে আসবে বলোতো? অপেক্ষার লম্বা সময়টা দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। একটু ধৈর্য ধরো শুধু।’

‘পারছি না তো! প্রথম বাবা হচ্ছি, একটু তো এক্সাইটেড হবোই।’

‘সত্যি বলতে আমিও খুব এক্সাইটেড। আজ একটা কথা বলবে আমায়? এতদিন এড়িয়ে গিয়েছো, তবে আজ কিন্তু পারবে না। তাছাড়া আজ আমি জেনেই ছাড়বো তোমার মনের কথা।’

জিসান ঠাউরে উঠতে পারলো জান্নাতের কথার উদ্দেশ্য। তাই নিমিষেই মুখ গম্ভীর করে ফেলল। সে স্থীর কন্ঠে বলল, ‘হুম আমি বলব আজ। তোর সব কনফিউশান দূর করবো। তুই বল।’

‘আমি শুধু জানতে চাই তুমি আমাকে ভালবাসো, নাকি তিয়াসাকে?’

‘বর্তমানে তোকে। তাই বলে এটা ভাবিস না যে তিয়াসাকে আমি মন থেকে ভালবাসিনি বলে ওকে ভুলে তোকে ভালবাসতে পেরেছি। অন্যভাবে বলতে গেলে ওকে নিয়ে আমার মনে এখন কোনো স্বপ্ন নেই ঠিকই, তবে যতই হোক তিয়াসা আমার প্রথম ভালবাসা। আর সত্য কখনো পাল্টে যাবে না। আমি চাইলে মিথ্যা বলতে পারতাম। যেমনঃ- তিয়াসাকে আমি ভুলবশত ভালবেসেছি বা তুই আমার আসল ভালবাসা। আর নাহলে এভাবেও বলতে পারতাম যে তিয়াসা আমার আবেগ ছিল নতুবা স্রেফ ভাললাগা ছিল। তাই ওকে ভুলে গিয়েছি। কিন্তু আমি তা বলবো না। কারণ আমি সত্যিই ওকে ভালবেসে ছিলাম। খুব বেশি চাইতাম ওকে। তবে যখন বুঝলাম তুই আমার সাথে জড়িয়ে গিয়েছিস আর তোর সাথেই আমার নিয়তি নির্ধারিত, তখন থেকেই তোকে ভালবাসতে শুরু করি। তোকে নিয়ে বাঁচতে শিখি। তাছাড়া কোথাও তো লেখা নেই যে প্রথম ভালবাসাকে ত্যাগ করা যাবে না। আমি পরিস্থিতি বুঝে তিয়াসার জায়গায় তোকে বসিয়েছি মাত্র। তাই বলে তিয়াসার জন্য তৈরি হওয়া ফিলিংসগুলো অস্বীকার করতে পারবো না আমি। কারণ এতে বোঝা যাবে আমি ভালবাসতে নয়, খেলা করতে জানি। আমি সবার সামনে বলতে পারবো যে তিয়াসা আমার প্রথম ভালবাসা। সেই সাথে আমি চোখ বন্ধ করে এটাও বলতে পারবো যে আমি তোকে অনেক বেশি ভালবাসি। অ্যাট প্রেজেন্ট, আমার হৃদয়ে শুধুই তোর রাজত্ব। তুই কি আমাকে ভুল বুঝেছিস জান্নাত?’

‘একদমই না। কারণ ভুল আমি করেছি। তুমি তোমার ভালবাসাকে আমার জন্য পাওনি। তিয়াসা কয়েকবছর পর হয়তো তোমার প্রস্তাবে রাজী হয়ে যেত। কিন্তু সেই সময়টা আমি ওকে দেইনি। তিয়াসা তোমাকে বোঝার আগেই আমি জোর করে তোমাকে বিয়ে করে ফেলি। তাই দোষ আমার। তুমি তিয়াসাকে ভালবাসো, তা জানা সত্ত্বেও আমার তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করাটা অনুচিত হয়েছে। জানো, আমি ধীরে ধীরে সেটা অনুভব করতে পেরেছি। খুব গিল্টি ফিলও হয়েছে। এখনো হচ্ছে। আমি সত্যিই কাজটা ঠিক করিনি। তোমার সাথে খুব মারাত্মক একটা অন্যায় হয়েছে।’

‘হুশ! চুপ কর তো। যা হয় ভালোর জন্যই হয়। আমি কবে তিয়াসাকে মানিয়ে বিয়ে করতাম? আর কবেই বা বাবা হতাম? নিশ্চয়তা ছিলনা সেটার। হয়তো তিয়াসার আশায় বসে থাকতে থাকতে বুড়ো হয়ে যেতাম। কিন্তু তোকে বিয়ে করলাম বলে আজ আমি পিতৃত্বের স্বাদ পেতে চলেছি খুব শীঘ্রই। বাদ দে পুরনো কথা। আমি তোর সাথেই খুব ভালো আছি। আর আবারও তোকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি সত্যিই খুব খুব খুব হ্যাপি।’

‘তোমার খুশি দেখে আমিও খুব খুশি। এভাবেই ভালবেসো আমায়।’

জিসান জান্নাতের কপালে চুমু এঁকে বলল,
‘খুব ভালবাসি তোকে আর বাসবো। এই না, ভুল বলেছি আমি।’

জান্নাতের বুক মোচড় দিয়ে ওঠে জিসানের কথায়। ও ভয়ার্ত কন্ঠে বলল, ‘ভুল বলেছো!’

‘ভুল না গুরুতর ভুল। আমি তোকে ভালবাসি এটা ভুল। সঠিক হচ্ছে আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি আমার বউকে ভালবাসি। আমার জান্নাতকে ভালবাসি।’

জিসানের কথা শেষ হতেই জান্নাত একরাশ হাসি নিয়ে জিসানের চোখে মুখে অসংখ্য চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলো।

চলবে,
।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here