দ্বাবিংশতি পর্ব -০৬

#দ্বাবিংশতি
#লিখনে_মৃত্তিকা_চৌধুরী
#পর্ব_৬

১০.

শুদ্ধ বাড়ি থেকে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেছে, রাইয়ের খবর শোনার পর।সে একজন হার্ট সার্জন তাই সে তার সাথে থাকা সব সার্জন ফ্রেন্ডদের রিকোয়েস্ট করলো যেন যত দ্রুত সম্ভব রাইয়ের অপারেশন করা হয়, তারাও যেন সাহায্য করে যথাসম্ভব ।শুদ্ধ হেল্প চাওয়ার মানুষ না।কিন্তু যখন ব্যাপারটা রাইয়ের হয় তখন সে রিস্ক নিতে চায়না।

ফাইজার শরীর থেকে নেওয়া রক্ত দিয়ে রাইয়ের অপারেশন শুরু হয়ে গেছে।থিয়েটারে সবার মুভমেন্ট অবজারভেশন করছে শুদ্ধ।আবার,একদৃষ্টে রাইয়ের দিকে তাকিয়েও আছে।এই মানুষটাকে সে কীভাবে পারলো আঘাত করতে?

“আচ্ছা,শুদ্ধ কি রাইয়ের মায়ায় জড়িয়ে পড়েছে?না,না এটা কীভাবে সম্ভব!তাদের তো কিছুদিনের পরিচয়।”

দুই ঘন্টা পর রাইয়ের অপারেশন থিয়েটারের ওপরের লাল লাইট বন্ধ হয়ে গেল।সবার মুখে হাসি।রাইয়ের মেমোরি সেল গুলোই শুধু আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে।আশা করা যায় টাইমের সাথে ওগুলো রেস্ট আর এনাফ ওষুধ নিলে ঠিক হয়ে যাবে।রাইয়ের পাশে কাউকে যেতে না করা হয়েছে।কিন্তু শুদ্ধ রাইয়ের রুমেই তার হাত ধরে বসে আছে।রাই এর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে।তাও যে সে বেচে আছে এটাই অনেক।

তিনদিনের দিন রাই চোখ খুলে তাকালো।রাইয়ের সামনে তার বাবা-মা আর ফাইজা দাঁড়িয়ে আছে।কিন্তু সে যে আছে আরেকজোড়া চোখের খোঁজে।

“তুই ঠিক আছিস,রাই?”(রিজভী সাহেব)

রাই কথা বলতে পারছিলোনা। তাও সে ফিসফিসিয়ে বললো,

“আমার ফোনটা?আমার মিটিং।”

ফাইজা এবার রাইকে আশ্বস্ত করলো যে সে সব সামলে নিয়েছে।ফাইজার কথার অর্থ রাই বুঝতে পারলোনা।
সেদিন এক্সিডেন্টের পর থেকে অনেক সময় ধরে রাইয়ের ফোন বারবার বেজেই যাচ্ছিলো।তাই বিরক্ত হয়ে ফাইজা কল রিসিভ করার পর দেখলো একজন বয়োবৃদ্ধ লোক তার দিকে তাকিয়ে বলছে,

“রাই কোথায়,আম্মু?”

“রাই অপারেশন থিয়েটারে।”

কথাটা শুনেই লোকটা ফাইজার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয় রইলো।এরপর সে বললো,যে সে আসছে।আর নয় ঘন্টা পর লোকটা এসেও পড়েছিলো।এতক্ষণে বসু সাহেব রাইয়ের রুমের ভেতরও চলে আসলো।কিন্তু তার সাথে আরেকজন আছে।আর সে হলো আরাভ।আরাভ রাইকে দেখেই তাকে জরিয়ে ধরে মেকি কান্না শুরু করে দিলো।তখনি রাইয়ের জ্ঞান ফিরেছে শুনে শুদ্ধ দৌড়ে তার কেবিনে প্রবেশ করলো।এই দৃশ্য দেখে সে বুঝতে পারলোনা তার কি উচিত।

শুদ্ধ দ্রুত গিয়ে আরাভকে ধাক্কা দিয়ে রাইয়ের কাছ থেকে সরিয়ে দিলো।

“গেট অফ ফ্রম মাই ওয়াইফ,ইউ চিটার!”

আরাভ সন্দেহের দৃষ্টিতে রাইয়ের দিকে তাকাতে সে মাথা নেড়ে বললো,

“ইগ্নোর হিম,আরাভ।”(ধীরকন্ঠে)

কথাটা শুনে শুদ্ধ রাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে রাইয়ের জন্য আনা খাবারের বক্সটা তার পাশে থাকা টেবিলে রেখে চুপচাপ কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।এরপর সবাই আবারো রাইয়ের সাথে কথা বলায় মনোযোগ দিলো।সাতদিন রেস্ট করার পর আজ রাই চলে যাবে।এই সাতদিনে রাই শুদ্ধকে বহুবার দেখেছে।কিন্তু প্রতিবারই সে তাকে অপমান অপদস্ত করে বিদায় করে দিয়েছে।কারণ সে চায়নি আরাভ শুদ্ধের ক্ষতি করুক।এখন রাইয়ের নিজের শরীরেরই ঠিক নেই।এখন শুদ্ধের কিছু হলে রাই শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখতেই পারবে,আটকাতে নয়।

রাইয়ের এই ব্যবহারে শুদ্ধ যতটা না কষ্ট পেয়েছে তার থেকে বেশি কষ্ট রাই পেয়েছে।আজ রাইয়ের চলে যেতে হবে ইতালিতে।ওখানে তার অনেক কাজ বাকি আছে।যাবার আগে সে সবার দৃষ্টিগোচর থেকে আড়াল হয়ে প্রায় হন্তদন্ত হয়ে শুদ্ধের চেম্বার খুজতে লাগলো।শুদ্ধ তখন তার চেম্বারে থাকা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রাইয়ের কথাই ভাবছিলো।আচমকা কেউ আসায় সে ঘুরে দাড়াতেই তার চোখ ছানা বড়া হয়ে গেল।রাই তার চেম্বারে হাপাতে হাপাতে প্রবেশ করেছে।

“রাই?”শুদ্ধের কথা শেষ হওয়ার আগেই রাই তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।এতদিনে রাই বুঝতে পারলো সে শুদ্ধের কাধের সমান।শুদ্ধের ছোট ছোট চোখগুলোও বেশ সুন্দর আর নজরকাড়া।জানালা দিয়ে আসা রোদে
শুদ্ধের ফর্সা গালগুলো টমেটোর মত লাল হয়ে আছে।
রাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

শুদ্ধ এতক্ষণ ভয় পেলেও সে এবার নিজের ভয় কাটিয়ে রাইকে জড়িয়ে ধরলো।কিছুক্ষণ পর সে রাইকে ছেড়েও দিলো।রাইও শুদ্ধকে ছেড়ে দূরে এসে দাড়ালো।

“রাই?”

“লেটস গেট ম্যারিড?আমার রিভেঞ্জের জন্য এটার অনেক দরকার,শুদ্ধ।”

শুদ্ধ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে রাইয়ের সামনে।তার মানে কি রাই তাকে ভালোবাসে না?এসব সে শুধু রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্য করেছে?তাও শুদ্ধও রাজি হলো।রিভেঞ্জের এক্সকিউজ দিয়েও যদি সে রাইয়ের সাথে থাকতে পারে।তাই তার জন্য অনেক।আরাভকে আর বসু সাহেবকে এয়ারপোর্টের কাজগুলো সামলানোর দায়িত্ব দিয়ে রাই শুদ্ধকে নিয়ে সোজা কোর্টে চলে গেল।ওখানে তাদের বিয়ে রেজিষ্ট্রেশনের কাজ শেষ করে রাই আর শুদ্ধ কোর্টের বাহিরে এসে দাড়ালো।দুপুর দুইটা বাজে।

আশেপাশে কিছুটা দূরেই কিছু আইস্ক্রিমের স্টল দেখা যাচ্ছে।

“রাই,আইস্ক্রিম খাবে?”

“হুম চলো।”

রাই আর শুদ্ধ দুটো আইস্ক্রিম কিনে তা খেতে খেতে রাস্তা দিয়ে হাটতে শুরু করলো।শুদ্ধ আইস্ক্রিমের স্বাদে সেদিন ভালোবাসা খুজে পাচ্ছিলো।কিন্তু রাই নির্বিকার চিত্তে আইস্ক্রিমই খেয়েই যাচ্ছিলো।শুদ্ধ জানে মেয়েটার মস্তিষ্ক ভর্তি বেটার প্ল্যান তৈরি আছে তার রিভেঞ্জের জন্য।

১১.💜

শুদ্ধের ইতালির ভিসা আগের থেকেই ছিলো।এটার জন্যই মূলত রাই আর শুদ্ধের অনেক সুবিধা হয়েছিলো।শুদ্ধের এই বছর ইতালিতে একটা কোর্সের জন্য যাওয়ার কথা ছিলো।তাই শুধু প্লেনের টিকেট কিনে আরাভ আর সেক্রেটারি বসু চৌধুরী বাড়িতে ফিরলেন।সেখানে প্রবেশের পর তারা যা দেখল তা দেখে তারা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলোনা।

রাই একটা গোলাপি রঙের ফ্রক পড়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার মধ্যকার সৌন্দর্য বারবার জানান দিচ্ছে রাই একজন মেয়ে।তার পাশেই শুদ্ধ আর রাইয়ের বাবা গম্ভীরমুখে কথা বলছে।রাই বিয়ের পর সোজা শুদ্ধকে নিয়ে নিজের বাড়িতে এসেছে।হলরুমে প্রবেশ করে সে
তার বাবা-মা আর ফাইজাকে ডাকলে তারা সবাই নিচে নেমে দেখে রাই শুদ্ধের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

“রাই,এসব কি?”

“বাবা,আমরা বিয়ে করেছি।”

মেয়ের মুখে এই কথা শুনে রিজভী সাহেব চোয়াল শক্ত করে বললেন,

“আমাকে না নিয়েই?” বলেই হেসে দিলেন।

সে জানে তার মেয়ে কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নিবেনা।তাই সে তার মেয়ে আর তার মেয়ের জামাইকে সাদরে গ্রহণ করলেন।কিন্তু শুদ্ধের সাথে কথা বলার জন্য সে শুদ্ধকে এক কোণায় নিয়ে গেলেন।শুদ্ধ আর তার মধ্যকার কথাগুলো তাদের মধ্যেই থাকলো।এরপর তারা হাসতে হাসতে এসে সোফায় বসলো।আরাভ রাইকে এমনভাবে দেখে চোখ ফিরাতে পারছিলোনা।
সে তাই দৌড়ে এসে বললো,

” ইউ আর লুকিং সো গর্জিয়াস ,মাই লাভ।”

“আ,আ।শি ইজ মাইন নাও।” (শুদ্ধ)

শুদ্ধের কথায় আরাভ রাইয়ের দিকে তাকাতেই রাই তার বাম হাতে থাকা রিংটা আরাভকে দেখালো।যার অর্থ এখন রাইয়ের কোনো কারণে ডিভোর্স হলে রাইয়ের অর্ধেক সম্পত্তি শুদ্ধের হয়ে যাবে?

“নো,নো।রাই ইউ নো হোয়াট দ্যাট রিং মিন্স?”

“দ্যাট মিন্স,ইন মাই নিউ উইল দেয়ার উইল বি আ সেকেন্ড পারসন।হু কেন ইজিলি এক্সেস মাই প্রপার্টি।”

আরাভ আর কিছু না বলে বসু সাহেবের দিকে তাকালো।বসু সাহেব হাসলেন।কারণ সে দেখেছে রাই অসুস্থ হওয়ার পর শুদ্ধের অবস্থা কেমন হয়েছিলো।সে দিন রাত এক করে রাইয়ের হাত ধরে বসে থাকত।

রাই,শুদ্ধ,সেক্রেটারী বসু আর আরাভ সবাইকে বিদায় জানিয়ে ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।পুরো নয় ঘন্টা বত্রিশ মিনিটে যতক্ষণ আরাভের চোখ খোলা ছিলো ততক্ষণই সে শুদ্ধের দিকে তাকিয়ে ছিলো।

আরাভ চেয়েছিলো নাতাশার সাথে কয়েকদিন মজা করতে।এরপর রাইয়ের কাছে মাফ চাইলে রাই সব ভুলে যাবে।কিন্তু আরাভ জানেনা রাইয়ের ডিকশিনারির ভেতর তার পরিবারের মানুষগুলো ছাড়া অন্যকারো ভুলের ক্ষমা নেই।

রাই আর শুদ্ধ এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার সময়ই দেখলো অনেক কালো কোর্ট পরিহিত ছেলে রাইকে আর তাকে অভিবাদন জানাচ্ছে।এরপর রাই আর শুদ্ধ রাইয়ের গাড়িতে উঠে রওনা হলো।রাই গাড়ি চালাচ্ছে আর শুদ্ধ বাহিরের পরিবেশ দেখছে।রাই সোজা তার কোম্পানির সামনে গিয়ে গাড়ি থামালো।রাইয়ের সেইফটির জন্য তার পেছনে থাকা বিশটি গাড়িরও থেমে গেল।

রাই শুদ্ধের হাত ধরে কোম্পানির ভেতর প্রবেশ করতেই সবাই দাঁড়িয়ে রাইকে সংবর্ধনা জানালো।

“বেন্তরনাতো!চেয়ারম্যান ম্যাম।(ওয়েলকাম ব্যাক)”

“গ্রেরাজি (ধন্যবাদ)।”

রাই এবার শুদ্ধকে নিয়ে তার রুমে গিয়ে বসলো।একটু পর মিটিং শুরু হবে।শুদ্ধকে রাই নিজের চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে।মিটিং শুরু হয়ে গেল সন্ধ্যার দিকে।রাই দাঁড়িয়ে থেকে ডিল কমপ্লিট করলো প্রায় একশো কোটি টাকার।রাইয়ের সিটে শুদ্ধকে দেখে আশেপাশের সবাই বেশ অবাক হলো।

মিটিং শেষে একজন তো দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেসই করলো রাইকে,

“রাই,হু ইজ হি?”

“মাই হাজবেন্ড!” কথাটা শুনে সবাই শুদ্ধের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।

রাই আরো বললো যে তার কিছু হয়ে গেলে শুদ্ধই কোম্পানির চেয়ারম্যান হবে।তাকে রাই সব বুঝিয়ে দিয়েছে।এবারের কথাটা শুনে শুদ্ধসহ সবাই রাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।মিটিং শেষে সবাই বের হয়ে গেলেও আরাভ বের হলোনা।রাইয়ের কোম্পানিতে আরাভের টেন% শেয়ার আছে।আরাভ মুখ দিয়ে কিছু বলার আগেই সেখানে নাতাশা এসে হাজির হলো।

নাতাশা বেশ এগ্রেসিভ হয়ে আছে।সে রাইকে এসেই বি* বলে গালি দিয়ে ধাক্কা দিতে এগিয়ে আসলো।কিন্তু সময় মত শুদ্ধ রাইকে সরিয়ে নেওয়ায় নাতাশা ধাক্কা না দিতে পারলো না, ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে গেল।ফ্লোরে পড়ে সে রাইয়ের পাশে শুদ্ধকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলো।

“শুদ্ধ?”

“ইয়াপ ,শুদ্ধ।”

নাতাশার মুখের ভঙ্গিমায়ই বোঝা যাচ্ছে নাতাশা বিষ্ময়ের চরম সীমায় পৌছে গেছে।রাই নাতাশাকে দেখে শুদ্ধকে রুমে রেখেই বের হয়ে গেল।রাইয়ের বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।সে জানে শুদ্ধের ভেতর তার প্রতি যেই অনুভূতিটা আছে তা শুরু গ্রেইটফুলনেস ছাড়া আর কিছুনা।কিন্তু রাই তো কৃতজ্ঞাবোধ চায় না।রাইকে বের হতে দেখে আরাভও তার পেছনে পেছনে বেরিয়ে আসলো।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here