নিবেদিতা (চতুর্থ পর্ব)

0
377

নিবেদিতা (চতুর্থ পর্ব)

উপযুক্ত তাপমাত্রায় জল জমে বরফ হয়। তাহলে, জলবৎ তরলং হৃদয়ের বেলাতেও সেটি হবে না কেন?

গয়া-কাশী নয়, শশীভূষণ আবার ফেরত গেল খোদ কলকাতাতেই। ‘অনুপমা-নিরূপমা’দের মাকড়জাল আর সমুদয় জাগতিক সংস্রব এড়িয়ে টানা তিনটে বছর কেবল বইপুস্তক আঁকড়েই পড়ে রইল। কাননবালা ছেলের কাছ থেকে মাসে একটি করে চিঠি পেতেন, তাই বুকে করে বসে রইলেন চাতক পাখির মতন।

আহা, বেচারা!

পলকের দেখায় আর দু’ছড়া কথায় কেউ এতখানি যাদু করে ফেলতে পারে?

কে জানে! পারে বোধহয়!

বছর তিনেক বাদে মায়ের আশীর্বাদকে পূর্ণ করে গ্রামে ফিরে এল শশীভূষণ। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল- ‘তুমি না কাশী যেতে চেয়েছিলে? চলো এবারে!’

পুণ্যধাম কাশীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবার ইচ্ছা কাননবালার বহুদিনের। ছেলের এই প্রস্তাবে খুশিমনে সম্মত হলেন। দিন সাতেকের ভেতর এদিককার বিষয় সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের সমস্ত বন্দোবস্ত করে নিল শশীভূষণ। তারপর কাশীতে একটা পুরনো দোতলা বাড়ি ভাড়া করে উঠে পড়লো মা’কে নিয়ে।

পায়ে পায়ে সময় কম গড়ায়নি। আমাদের মাতৃস্নেহ লালিত শশীর সেই বালকসুলভ, আদুরে চেহারাখানা এখন আর নেই। স্বাস্থ্যটা খানিক বেড়েছে, চোখে বসেছে মোটা ফ্রেমের চশমা, মাথায় কমেছে চুল। শশীভূষণ বলে সেই হাবাগোবা গ্রাম্য ছেলেটি এবারে শশী ডাক্তার হয়েছে।

কাশীর বাড়ির নিচতলায় ছোট্ট চেম্বার মতো তৈরি করে, ধ্যান-মনের সমস্তটা উজার করে দিয়ে লোকেদের চিকিৎসা করতে আরম্ভ করল শশী ডাক্তার। অচিরেই কাশীর আনাচে-কানাচে এই নব অভ্যাগত ডাক্তারটির যাদুকরী হাতযশের কথা ছড়িয়ে গেল। ডাক্তারি ছাড়াও আরো একটি বিশেষ কাজে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করল সে। সেই শরৎবালিকাটির সন্ধানলাভের নিত্য নতুন প্রচেষ্টা করে যাওয়া। চিরকুটে নাকি লিখা ছিল, কাশীর উদ্দেশ্যেই বাড়ি ছেড়েছে সে। বৃদ্ধার জন্য যে কাশী পুণ্যধাম, তরুণীর জন্যে তাই-ই যে নরক- সেটা শশী এতদিনে জেনে গেছে। কিন্তু, শেষ বিকেলের আলোয় দেখা ঐ পবিত্র সরল মুখখানি, ডাগর চোখের সেই সত্যভাষিণীকে দিয়ে সজ্ঞানে, স্ব-বুদ্ধিতে কোনো পাপ হবে না এও তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। সে বিশ্বাসে ভর করেই মন্দিরে মন্দিরে, তীর্থে-তীর্থে নিবেদিতাকে খুঁজে বেড়াতে লাগল শশীভূষণ। খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজার থেকেও কঠিন কাজ… তবু শশী হাল ছাড়ল না!

ওদিকে, এইসব নানাবিধ ঘাত প্রতিঘাতের পর ছেলের বিয়ের আশা আপাতত ছেড়ে দিয়ে কাননবালা ধর্মকর্মে মনোনিবেশ করলেন। দু’একবার প্রস্তাব তোলার ইচ্ছে হয়নি- তা নয়। কিন্তু, গলার কাছে ভয় জমে আটকে দিয়েছে কথা। বজ্র আঁটুনিতে গেরো ফস্কে গেলে শেষে এই সবেধন নীলমণি পুত্ররত্নটিকেও হিমালয়ের পাদদেশে বিসর্জন দিতে হতে পারে। বলা তো যায় না, আবার কখন সন্ন্যাসের ভূত চাপে ছেলের মাথায়! নাহ, বৌ দরকার নেই, ছেলেটা ঘরে থাকুক বরং!

নিবেদিতা একমনে সুঁচে সুতো পরাচ্ছিল, আচমকা ঘাড়ের ওপর একটা জোর আন্দোলন অনুভব করল। এক চিলতে প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটল তার ঠোঁটের ডগায়। দস্যুপ্রবৃত্তি একজোড়া হাত পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে নিবেদিতার ঘাড়ে বাদুরঝোলা হয়ে ঝুলছে।

‘কীরে টেঁপি? ঘুম ভেঙে গেল?’

‘ভাঙবে না! বিকালটা যে শেষ হয়ে যাচ্চে! একটি বেলাতেই ছেলেমেয়েগুলিকে খেতে দিই, তাও তো তোমাদের যন্তনায় হবার জো নেই দেখছি!’- টেঁপি সেরকম ঝুলতে ঝুলতেই উত্তর দিল। তার গলায় অসন্তোষের সুর। নানারকম ছল চাতুরি করে রোজ দুপুরবেলাতেই নিবেদিতা তাকে ঘুম পারিয়ে দেয়। ওদিকে সাত বছুরে টেঁপির বিশাল সংসারটির চলৎক্ষমতাহীন সদস্যেরা ছাদের ওপর তার আগমনের অপেক্ষায় বসে রয়। অতএব, ঘুম ভাঙতেই নিবেদিতার ওপর এহেন অতর্কিত হামলা।

‘তা যা না, এখন যেয়ে দুটো খেতে দিয়ে আয়!’

‘তার কি আর জো আচে? মা তো আমায় একলা ছাড়বে না। ললিপিসিও বাড়িতে নেই, তার আবার সুরেশকাকুর সঙ্গে ইয়ে আছে কিনা!’

‘ঠাম্মার সাথে থেকে থেকে বড্ড পাকা হয়ে গেছিস, টেঁপি!’- নিবেদিতা শাসনের সুরে বলে।

‘চোখ-কান খুলে চললে লোকে তাকে পাকামোই বলে বৈকি! তাই বলে তো আর চোখ বুজে চলতে পারিনে!’

‘কে বলবে, তোর বয়স সবে সাত? সত্তর বছরের বুড়ির মত পাকা পাকা কথা কেবল দিনরাত!’

‘সাত তো গেল বচর ছিলুম, এবারে আটে পড়লাম যে!’- টেঁপি চোখ পাকিয়ে বলে। তারপর আলোচনার বিষয়বস্তু ঘুরে যাচ্ছে দেখে ঘাড় থেকে নেমে সোজা নিবেদিতার সামনে এসে দাঁড়ায়। ওর হাত থেকে সেলাইয়ের জিনিসগুলি টেনে নিতে নিতে বলে- ‘আহ! তুমি এবারে দেরি করিয়ে দিচ্চ বললুম! ছেলেমেয়েগুলি না খেতে পেয়ে মরবার দশা হচ্চে, চলো দিকি আমার সাথে ছাদে। এই সেলাই-ফোঁড়াই এসব রাখো এখন!’

‘তোর জামাটাই সেলাচ্ছি টেঁপি। আজকেই ফুল-তোলা শেষ হয়ে যাবে, কাল থেকে গায়ে দিতে পারবি-‘

‘সে কাল শেষ করোখন। আগে আমার সঙ্গে চল তো! বললুম-ই তো সুরেশকাকু এখন বাড়ি নেই, ললিপিসিকে নিয়ে গঙ্গার ধারে কেত্তন গাইতে গেছে। তোমার তবে ছাদে উঠতে বাধা কীসের?

‘তোর সুরেশকাকুর ভয়ে আমি ছাদে উঠিনে- এই বুঝি তোকে ঠাকুর এসে কানে কানে বলে গেছেন?’

‘সে আমাকে কারুর কইতে হয়নে, আমি একলাই বুঝি! আর বকিও না তো আমাকে, আমার নাকি এবেলা বকবার সময় আছে! একটি বেলা খেতে দিই, তাতে বাছারা না খেয়ে আছে… চলো তো নিবিদি। এক্ষুনি চলো!’- নিবেদিতার হাতটাকে বিস্তর রকমে টানাটানি করে তাড়া দেয় টেঁপি। ছাদের ওপরে টিনের বেড়ি দেয়া ছোট ঘরটায় ওর পুতুল ছেলেমেয়েরা সব না খেয়ে আছে!

এ কথা ঠিক, যেদিন থেকে নিবেদিতা জেনেছে ললিতার সাথে সুরেশের একটা সম্পর্ক আছে, সেদিন থেকে সুরেশের চোখে পড়বার ভয়েই ছাদে যাতায়াতটুকু একপ্রকারের বন্ধই করে দিয়েছে। ঘরপোড়া গরু তো সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ডরায়! যে ‘দোষে’ পিসিমার আশ্রয় হারাতে হয়েছিল আর সেই ‘দোষ’-এর পুনরাবৃত্তি ঘটুক তা সে চায় না, সেজন্যেই এই বাড়তি সতর্কতাটুকু। মায়ের রেখে যাওয়া ক’গাছি স্বর্ণ আর বাপের দেওয়া গোটাকতক টাকা আঁচলে বেঁধে যখন রেণুপিসির বাড়ি ছেড়েছিল, বাস্তবিকই নিবেদিতার আর দ্বিতীয় কোনো জায়গা ছিল না যাবার। হাঁটতে হাঁটতে গ্রাম পেরিয়ে রেলস্টেশনে যেয়ে প্রথম যে রেলগাড়িটা পেয়েছে, তাতেই উঠে পড়েছিল। ফার্স্ট ক্লাস কি সেকেন্ড ক্লাস, স্ট্যান্ডিং কি সিটিং টিকিট- এতকিছু তার জানা ছিল না। সে কেবল জানত ট্রেনে চেপে যেখানে খুশি যাওয়া যায়, তাহলে নিশ্চয়ই কাশীতেও যাওয়া যাবে! ট্রেন ছাড়বার পর টিকিটবাবু এসে তার কাছে টিকিট চাইলে সে বড় বিপত্তিতে পড়ে গেল। সে কাশী যেতে চায় শুনে টিকিটবাবু যতই বলতে লাগলো ‘এ গাড়ি কাশীর নয়, পরের স্টেশনে নেমে উল্টো গাড়ি ধরতে হবে’, নিবেদিতা নতমুখ করে প্রত্যুত্তরে কেবল বলে চলল- ‘আমি অতসব জানিনে বাবু, আমায় কাশীতে নামিয়ে দিও। টাকা যত লাগে আমি দিচ্চি!’

‘এ গাড়ি তো কাশীর দিকে যাচ্চেনে মা, উল্টো পথে যাচ্চে! তোমার সাথে আর কেউ নেই বুঝি?’- দীনবন্ধু বাবু অনেকক্ষণ যাবত মেয়েটিকে দেখছিলেন। শেষমেশ আর না পারতে এগিয়ে এলেন।

এই মমতামাখা কথাটুকু যেন সোনার কাঠি- রূপোর কাঠি হয়ে একটা বদ্ধ অর্গলকে আচমকা মুক্ত করে দিল। মনে মনে যে সাহস আর শক্তিটুকু সঞ্চয় করে এই ঘরকুনো মেয়েটি অচেনা পথে পা বাড়িয়েছিল এই একটিমাত্র স্নেহপূর্ণ ‘মা’ সম্বোধনে সে সঞ্চয়বাষ্পের পুরোটা আকস্মিক জলে পরিণত হয়ে হতভাগীর সকরুণ চোখদুটি বেয়ে অকপটে ঝরতে আরম্ভ করল।


চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here