নীল_দিগন্তে
পর্ব-০৩
লেখা- নীলাদ্রি নীরা
মন মেজাজ বিগড়ে থাকলে কোনো কিছুই ঠিকমত হতে চায় না। পুষ্প “জীবিকার তাগিদে” সংঘটনের অফিসরুমের টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো। ক্লাস ছিল ৩টা থেকে। এখন বাজে তিনটা তেরো। আলিফ পুষ্পর মাথায় ঠোকা দিয়ে গলার স্বর চিকন করে বললো,
-” আফা গো, আফনে আইজকা কেলাস নিবেন না। আরা আফনের কেলাস করনেই লাই বইয়া রইছি।”
পুষ্প ঘুমের মধ্যেই বললো,
-” আজকে কোনো ক্লাস হবে না। আমি ঘুমাবো।”
-” আফা হুনেন না, আরা এত দূর থাইক্কা আইছি। আফনে এত নিষ্ঠুর হইবেন ক্যান! আজকেই আফনে কেলাস নিবেন। আফা গো ও আফা!”
-” বললাম না ক্লাস হবে না।”
-” আফা আফনার কি দিলে মায়া দয়া নাই। আফা ও আফা। আমাগো ভাড়ার টেহা দেন। চল্লিশ টেহা দিয়া আফনে ঘুমাইয়েন।
পুষ্প পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো এবং সাথে সাথেই ছোটোখাটো একটা শক খেলো। আলিফ দাত বের করে হাসছে।
-” ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা! এইগুলা কিসব ভাষারে!”
-” কেন সুন্দর নাহ?”
-” গাইয়া ভাষা!”
-” আসছে আমার শহুরে আফা গো! আফা কেলাসে ভাগেন। হুহ!
-“ঠিক করে কথা বল আলিফ। বিচ্ছিরি শুনাচ্ছে।”
-“হুহ! উঠ তো চেয়ার থেকে এটা আমার চেয়ার আই মীন ফিন্যান্স ডিরেক্টরের চেয়ার। এন্ড নাও ইটস ইওর ক্লাস টাইম ম্যাম। গো টু দ্যা ক্লাস নাও!”
-” আমার জুতোর চেয়ার৷ আজকে তুই ক্লাস নিবি ছাগল।”
পুষ্প হাই তুলতে তুলতে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো। ক্লাস নেয়ার মতো এনার্জি নেই আজকে সত্যিই ওর। নইলে ওর মতো মেয়ে চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়? বাসায় গিয়ে জব্বর একটা ঘুম দিতে হবে। আলিফ পুরো বোকা বনে গেলো। সে নিবে ব্লক বাটিকের ক্লাস? মানে মেয়েদের জামায় প্রিন্ট/কালার করার কাজ? ওহ মাই গড! চিন্তিতভাবে রুমাকে ফোন করলো আলিফ!
পুষ্প বাসায় গেলো না। গেলো ওর খুশবু ফুফুর বাসায়। ফুফুরা থাকেন উত্তরা। ফুফা ভূমি অফিসার। ঢাকা শহরে অনেকগুলো বড় বড় বিল্ডিং এর মালিক উনি। ফুফুদের বিল্ডিং এর সামনে এসে পুষ্প দেখলো নিউজপোর্টালের লোকেরা কি হাবিজাবি নিউজ করছে। কে জানে কি হয়েছে। পুষ্প ফুফুদের ফ্লাটের সামনে গিয়ে কলিংবেল চাপলো। অনেকক্ষণ পরেও কেউ দরজা খুললো না। ফুফুরা কি কেউ বাসায় নেই? বড়লোকদের বাসার একটা ব্যাপার হলো তাদের দরজা দেখে বুঝার উপায় নেই বাহির থেকে লক নাকি ভেতর থেকে। পুষ্প বিল্ডিং এর বাহিরে চলে এলো। এখনও নিউজের লোকগুলো আছে। ফুফুকে সে কি একটা ফোন করবে? বলবে যে, ফুফু আমি তোমার বাসায় এসেছি! তুমি কই?
প্রত্যুত্তরে ফুফু বলবেন, আম্মাজান গো, তুই পাঁচমিনিট দাড়াবি? আমি আসছি, গাড়িটা এই গলিতে ঢুকলো বলে।
পুষ্পর ঠোঁটে হাসি ফুটলো। ফুফু পুষ্পকে খুব স্নেহ করেন, একদম রাত্রির মতো। রাত্রি পুষ্পর ফুফাতো বোন। পুষ্পর মাঝেমধ্যে নিজের প্রতি হিংসে হয়, কেন সবাই তাকে এতো ভালোবাসে? কেন? এত ভালোবাসতে হবে কেন তাকে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুষ্প হাটা ধরলো। ওর ঘুম ঘুম ভাবটা পুরো কেটে গিয়েছে। আচ্ছা আজকে কি সে ভুলে একটা স্লিপিং পিল খেয়ে ফেলেছিলো? কিন্তু সে তো কোনো মেডিসিন খায় না। তাহলে এত ঘুম এসেছিলো কেন? টায়ার্ডনেসের কারনে হয়তো।
উত্তরা থেকে মিরপুর ২ এ আসতে সাড়ে তিনঘন্টা লাগলো পুষ্পর। আচ্ছা ঢাকা শহরে এত জ্যাম কেন? পুষ্প বাসায় না গিয়ে সোজা ছাদে গেলো। ব্যস্ততায় ইদানীং ছাদে যাওয়াই হয় না। পুষ্প ছাদে গিয়েই আবার সাথে সাথেই চলে আসলো। রাহাত ভাইয়া একহাতে সিগারেট ধরে আছেন অপর হাতে কানে ফোন ধরা। সেটা কথা না, কথা হলো ভাইয়া ফোনে কাউকে উউউউউউউউউম্মম্মম্মম্মাহ বলে দীর্ঘ চুমো দিয়েছেন। ছিঃ ছিঃ! কি একটা অবস্থা! পুষ্প নাক মুখ কুচকে নিজের রুমে গেলো। পুষ্পকে দেখে মনে হচ্ছে রাহাত অন্য কাউকে নয় যেন ওকেই চুমো দিয়ে ফেলেছে।
.
মায়ের কাছ থেকে এমন একটা কথা শুনবে কল্পনাই করতে পারে নি রাজীব। মা এর কি কান্ডজ্ঞান বলতে কিচ্ছু নেই? আশ্চর্য তো!
-” মা তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? তুমি এসব ভাবলে কিভাবে? পুষ্পকে আমি সবসময় নিজের আপন বোনের চেয়ে কম ভাবি নি। আমার নিজের কোনো বোন থাকলে আমি তাকে যেই নজরে দেখতাম পুষ্পকেও আমি ঠিক সে নজরেই দেখি।”
-” তাতে কি হয়েছে ও তোর আপন বোন না চাচাতো বোন। চাচাতো ভাই বোনদের মধ্যে বিয়ে হয়। আমার দুই কাজিনের ও তো হয়েছে। আরে ওই যে তোর নাসিমা খালা আর…”
-” তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে মা!”
রাজীব ভাতে পানি ঢেলে দিয়ে উঠে চলে গেলো। সোহেলী খাতুন ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে বাবা মাকে আর গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না। তাদের কাছে তখন বাবা মা হয়ে যায় বিরক্তিকর। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছোট ছেলে রাহাতের দিকে ফিরে তিনি বললেন,
-” তুই ও কি বলবি পুষ্পকে তুই আপন বোন মনে করিস?”
রাহাত বিপদের আঁচ পেয়ে বললো,
-” না মা পুষ্পকে আমি সৎ বোন মনে করি। সৎ বোনকে বিয়ে করা যায় না। ”
-” অমানুষ দুইটা জন্ম দিয়েছি আমি। অসভ্য, বেয়াদব।”
-” রেগে যাচ্ছ কেন মা? পুষ্প কি উড়ে চলে যাচ্ছে নাকি কোথাও যে তুমি ওর বিয়ের জন্য উতলা হয়ে উঠেছো! ”
সোহেলী কিছু বললেন না। এই ছেলেটা হয়েছে পুরো ফাজিলের বাচ্চা। শয়তান ছেলে!
-” বাবা কোথায় মা? সন্ধ্যা থেকে দেখছি না। বাবা ফেরেনি এখনও? ”
-” জানিনা”
-” মা! শোনো, পুষ্পর কি বয়স হয়েছে এমন বলো! ও পড়াশোনা করছে করুক! আবার ও নাকি কি একটা অর্গানাইজেশন খুলেছে। দ্যাটস আ গ্রেট ডিসিশন। আই সাপোর্ট হার! ও মন দিয়ে কাজ করুক। বিয়ের সময় আছে পরে ভাবা যাবে। আর বিয়ের ব্যাপারে ও সিদ্ধান্ত নিবে, ছোট চাচী সিদ্ধান্ত নিবে। তাছাড়া ওর ও তো পছন্দ থাকতে পারে।”
-” এক চড়ে সব দাত ফেলে দিব তোর ফাজিল। তুই বিয়ে করবি পুষ্পকে! ”
রাহাতের গলায় ভাত আটকে গিয়ে কাশতে শুরু করলো। কাশতে কাশতে একসময় প্লেটেই বমি করে দিলো সে। মাথাটা চক্কর দিচ্ছে রাহাতের।চক্করের মাঝে সে দেখতে পেলো, সে আর পুষ্প দুজনে বিয়ের সাজে। দুজনেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। চেয়ারে হেলান দিয়ে বিরবির করে রাহাত বললো,
-” মরে যা রাহাত মরে যা! এই জীবন রেখে লাভ নেই তোর। দেবদাস হওয়ার চেয়ে ভালো মরে যা! মরে যা!”
চলবে…..
পাঠকদের মতামত পাচ্ছি না। আফসোস😢