#নীল_শূন্যতা
লেখনীতে: মাহমুদা
|৩|
মিমদের প্রথম ক্লাস জনাব নাহিদের ছিল। ক্লাস শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে মিম উঠে দাঁড়ায়। জনাব নাহিদ বললেন,
‘একটু পর বেল বাজবে, তখন বাহিরে যেও।’
‘স্যার, একটু এদিকে আসবেন?’ মিম বিনয়ী হয়ে বলল।
কৌতূহল নিয়ে জনাব নাহিদ মিমের কাছে যায়। মিম তার ব্যাগ থেকে প্লাস্টিক অথবা পলথিনের একটি ব্যাগ বের করে দেয়, যাতে পাউডার জাতীয় কিছু ছিল। ব্যাগটি সে জনাব নাহিদের হাতে দেয়। জনাব নাহিদ কোন প্রশ্ন করার আগে মিম বলে,
‘যখন আব্বু আমায় দিয়ে যাচ্ছিল, তখন ভাইয়াকে একটি ছেলে এক ব্যাগটি ভয়ে ভয়ে দিচ্ছিল। আমার মনে হয়েছে এটি খারাপ কিছু। তাই আমি ভাইয়াকে মাটি থেকে উঠানোর সময় এটা লুকিয়ে নিয়েছিলাম আপনাকে দিব বলে।’
জনাব নাহিদ মুচকি হেসে মিমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
‘আমি দেখছি এটা কি।’
ইতোমধ্যে প্রথম পিরিয়ড শেষ হয়। জনাব নাহিদ নিজেও ক্লাসরুম থেকে চলে যায়। মিম নিজের আসনে বসে তার খাতা ব্যাগে ঢুকাতে থাকে।
বাড়ি ফিরে তুষার নিজের শার্ট ও প্যান্টের পকেটে অনেক খুঁজতে থাকে। কিন্তু সে তার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পায় না। সে বিছানায় বসে মনে করতে থাকে সে কোথায় হারাতে পারে। সেই মুহুর্তে জনাব নাহিদ তার কক্ষে প্রবেশ করে এবং প্রশ্ন করেন,
‘কী খুঁজছিস, তুষার?’
‘কিছু না।’
‘কিছু না! এটা নয়তো?’ জনাব নাহিদ প্লাস্টিকের সেই ব্যাগটি টেবিলের উপর রেখে বললেন।
‘তুমি এটা কোথায় পেলে?’ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তুষারের প্রশ্ন।
‘আমায় তো মিম দিয়েছে৷ তোর কোন বন্ধু তার ভাইকে নিয়ে আমার স্কুলে যায়?’
জনাব নাহিদের প্রশ্নের উত্তরে তুষার মাথা নীচু করে রাখে। জনাব নাহিদ পুনরায় বলেন,
‘এটাই কি তোর বন্ধুর ভাই? তুষার এখনও সময় আছে। এসব বাদ দে। অন্য কোন পিতা বয়সের আগে মেয়ে খুঁজে দিবে না। এমন অবস্থায় হয় ঘর থেকে বের করে দিবে, নয়তো চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। দুটোর একটিও করার মতো অবস্থা তোর হয়নি। শক্ত কোন পদক্ষেপ গ্রহণের আগে বাদ দে এসব।’
রাগান্বিত হয়ে জনাব নাহিদ ব্যাগটি নিয়ে চলে যায়। ক্ষিপ্ত তুষার বিছানায় বারি দিয়ে বলে,
‘এই মেয়ে একদিনেই আমার দৈনন্দিন জীবনের ব্যাঘাত ঘটালো!’
পরদিন বিকালে,
বিদ্যালয় ছুটির পর সকল স্কুল-কলেজে কমবেশি প্রাইভেট পড়ানো হয়। মিমের মা এবং জনাব নাহিদও বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়ায়। সেজন্য মিমকে বিকাল অব্দি অপেক্ষা করতে হয় বাড়ি ফেরার। কিন্তু যেহেতু আজ মিমের পিতা বাড়িতে আছেন, তাই জনাবা বেলি মিমকে তার বন্ধুদের সাথে বাড়ি ফেরার জন্য অনুমতি দিয়ে দেয়। নিহারের সাথে মিম গল্প করতে করতে রাস্তার একপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। বেশ কিছুটা দূরে তুষার মিমের জন্যই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল। মিম নিচের দিকে তাকিয়ে তার বান্ধবীর সাথে গল্প করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। তুষার মিমকে দেখামাত্র রাস্তার পাশ থেকে সরে মিমের সামনে তার পথ আটকে দাঁড়ায়। কপাল কুঁচকে মিম মাথা তুলে তাকিয়ে তুষারকে দেখতে পায়। মিম মিষ্টি এক হাসি হেসে তুষারের উদ্দেশ্যে বলে,
‘ভাইয়া, আপনি! কেমন আছেন?’
‘এ-ই পিচ্চি, আমার জিনিস চুরি করেছ কেন?’ তুষার প্রশ্নেত উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করে। মিম বেশ বুঝতে পারে তুষার কোন জিনিসের কথা বলছিল। সে তুষারকে বলে,
‘ভাইয়া, আপনি ছেলেটার থেকে ভয়ে ভয়ে প্যাকেটটি নিচ্ছিলেন। তাই মনে হয়েছে ওটা খারাপ কিছু।’
মিমের সাহস দেখে তুষার আরো বিস্মিত হয়। সে মিমকে বলে,
‘অন্যের জিনিস চুরি করা অপরাধ, তা জানো না?’
‘খারাপ কিছু চুরি করায় যদি অন্যের ভালো হয়, তবে তা অপরাধ না।’
‘বাহ! তর্ক করছ দেখা যায় ! ভয় করছে না?’
‘প্রশ্নের সঠিক জবাব দিলে তা তর্ক বলেই গণনা করা হয়। আমি আপনার মতো ভয়ের কিছু করিনি।’
মিম তুষারের প্রতিটি কথার এমনভাবে উত্তর দিচ্ছে যেন তার উত্তর প্রস্তুত করেই রাখা। তুষারকে আরো অবাক করে দিয়ে মিম বলে উঠে,
‘আপনার সাথে অযথা কথা বলে বেঁচে যাওয়া শক্তিটুকু শেষ করতে চাচ্ছি না। বাড়ি যেতে হবে আমায়। আল্লাহ হাফেজ। ‘
নিহার ও মিম তুষারকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। যেতে যেতে নিহার কিছু বললে মিম খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। তুষার পেছন ফিরে মিমের সেই হাসিটা দেখে। কিছু ভেবে তুষার নিজেও মুচকি হাসে।
এভাবে বেশ কয়েকমাস যাবত তুষার ও মিমের মাঝে কোন না কোন ব্যাপার নিয়ে তর্ক হবেই। তুষার অযথাই মিমকে রাগান্বিত করে দেয়, সে ইচ্ছাকৃতভাবে মিমের সাথে কথা বলতে শুরু করে। এখন তুষার আর নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে না। বিভিন্নভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে।
প্রতিদিন সন্ধ্যা হলে তুষার তার বাবা-মায়ের সাথে কোন বিষয়ে তর্ক করে বাহিরে যেত। কিন্তু আজ তার খবর নেই। সেই যে বিকালে বাড়ি ফিরে নিজ কক্ষে গিয়ে বসেছে। ব্যাপারটা জনাবা তাহমিনার নিকট বেশ সন্দেহজনক মনে হয়। তুষার কী করছে দেখার জন্য সে তুষারের কক্ষে যায়। টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে তুষার তার সামনে বই নিয়ে পড়ছে এবং একটু পরপর হাই তুলছে। পড়তে বসলে ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থীদের ঘুম পায়। জনাবা তাহমিনা বেশ অবাক হলেও সে বেশ খুশি হয়। তিনি তার স্বামীর নিকট ফিরে যায়। জনাব নাহিদ তাকে প্রশ্ন করে,
‘নিশ্চয়ই পরে পরে ঘুমাচ্ছে?’
‘না, সে পড়ছে।’
‘মিথ্যা কাকে বলছ?’
‘বিশ্বাস না হলে নিজেই দেখে আসো।’
জনাব নাহিদ তার আসন ছেড়ে উঠে তুষারের কক্ষের দিকে অগ্রসর হয়। দরজা অল্প ফাঁক করে সে ভেতরে উঁকি দিয়ে ঘটনা সত্য তার প্রমাণ পায়। সে নিজেও খুশি হয়ে ফিরে যায়।। খুশি মনে বলেন,
‘আলহামদুলিল্লাহ! তুষারের মাঝে তবে উন্নতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।’
‘হ্যাঁ, ছেলেটা পথভ্রষ্ট হয়েছিল বেশিদিন হয়নি। তাই হয়তো অতটাও সমস্যা হচ্ছে না ফিরতে।’
‘দেখা যাক, আল্লাহ তায়ালা কী করেন!’
জনাব নাহিদ ধোঁয়া উঠা চায়ে চুমুক দিলেন। রাতের খাবারের জন্য তুষারকে ডাকতে হয়নি। সে একাই এসে ভদ্রমতো খাবার খেয়েছে।
পরদিন ভোরে,
ফজরের আজান শেষ হওয়ামাত্র জনাব নাহিদ সালাত আদায়ের জন্য নিজ কক্ষ থেকে বের হয়ে ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। সেসময় তুষারকে হাতমুখ ধৌত করে মাথায় টুপি দিয়ে তার কক্ষের দিকে যেতে দেখেন। জনাব নাহিদ বেশ বুঝতে পারেন তুষার সালাত আদায়ের জন্য জাগ্রত হয়েছে। ঘটনাটিতে জনাব নাহিদ বেশ সন্তুষ্ট হয়। মোনাজাতে তিনি আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করতে ভুলেন না।
তার কয়েকদিন পর থেকে তুষার পুনরায় কলেজে যাওয়া শুরু করে। ২য় বর্ষে উত্তীর্ণ হবার পরীক্ষা দেওয়ার পর তুষার নেশাক্ত হয়ে উঠেছিল। এতদিন পর কলেজে গিয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তুষারকে। কিন্তু সে সবটা ঠান্ডা মাথায় সামলে নিতে পারে।
এখন তুষার বেশ স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। কলেজ শেষে প্রতিদিন তুষার তার পিতার বিদ্যালয়ে যায়। বিকাল অব্দি মিম যে থাকে। মিমের সাথে সময় কাটায় সে। কখনও মিমকে হোমওয়ার্কের কোন সমস্যা বুঝিয়ে দেয়, কখনও তার সাথে কাগজ কলমে বিভিন্ন খেলা খেলে, কখনও বা তুষারের পাঠ্যবই থেকে গদ্য, উপন্যাস পড়িয়ে শুনায়। তুষার ও মিমের মাঝে বয়সের পার্থক্য থাকলেও তাদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে। দেখতে দেখতে তুষারের এইচএসসি পরীক্ষাও এগিয়ে আসে। সে মিমের সাথে সময় কাটানো কমিয়ে দিয়ে পড়ালেখায় মন দেয়।
পরীক্ষা হয়, তার ফলাফলও জানানো হয়। সে এ প্লাসের ধারের কাছে গিয়েও তা পায়নি। তবু তার এতে আফসোস নেই। সে পুনরায় মিমের সাথে সময় কাটানো শুরু করে।
চলবে,,,,,