প্রহর শেষে আলোয় রাঙা পর্ব -০৩

#পর্ব_৩
#প্রহর_শেষে_আলোয়_রাঙা
লেখিকাঃ #নুুরুন্নাহার_তিথী
আলোর চোখের উপর লাল রেশমি কাপড় বেঁধে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে প্রহর। আলো জানেনা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। বারবার প্রহরকে জিজ্ঞেস করছে কিন্তু প্রহরের কোনো জবাব নেই। ছেলেটার মৌনতা আলোর শরীরে হিম ধরিয়ে দেয়। অতঃপর থামলো প্রহর। ভঙ্গ করল নিজের মৌনতা! আলোকে পেছোন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,

“কিছু অনুভব করতে পারছ?

আলো চুপ করে বোঝার চেষ্টা করল। আশেপাশে থেকে ফুলের তীব্র ঘ্রাণ আসছে। কিন্তু এতো ফুলের মাঝে আলো লিলি ফুলের মিষ্টি সুঘ্রাণটা চিনতে ভুল করল না। আলোর ঠোঁটকোলে মিষ্টি হাসি ফুটলো। বাড়ির বাগানে অনেক রকমের ফুল গাছ থাকলেও লিলি ফুলের গাছ নেই। লিলি ফুল আলোর অতিমাত্রায় পছন্দ। আলো উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে,

“লিলি! প্রহর তুমি লিলি ফুল এনেছ?”

প্রহর নিরব হাসে অতঃপর আলোর ঘারের কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে,
“আমার মুনলাইট কুইনের পছন্দ। না এনে পারি?”

“চোখটা খুলে দেও না। আমি ছুঁয়ে দেখব ওদের।”

আলোর অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশে প্রহর নিজের হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় করল।
“আর কিছু সময়। তারপর স্বচক্ষে সবকিছুকে উপভোগ করবে আর আমি তোমাকে!”

আলোর শুভ্রকায়াতে হিমশীতলতা বয়ে গেল। প্রহরের হাত খা*ম*চে ধরল। প্রহর নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসে। আলোর চোখের বাঁধন খুলে দিল। আলো পিটপিট করে আঁখিযুগল খুলে অতঃপর সম্মুখের সাঁজসজ্জা দৃষ্টিগোচর হলে অবাক হয়ে যায়। মরিচবাতি ও প্রদীপ দিয়ে গার্ডেনের অর্ধখোলা চা হাউসটা সাঁজানো। চা হাউসের সেন্টার টেবিলে হরেক রঙের লিলি ফুল ও সেই সাথে গোলাপ, জারবেরা, রজনীগন্ধা ফুল। ফুলগুলোর আড়ালে লুকিয়ে আছে একটা রেড ভালবেট কেক ও প্রহরের আনা স্পেশাল গিফট। ওরা এখন দাঁড়িয়ে আছে বাগানের বাঁধানো রাস্তাটাতে। আলো খুশিতে প্রহরের হাত ধরে চা হাউসটায় যায়। আলো চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখতে দেখতে বলে,

“ইটস রিয়ালি স্পেশাল ফর মি প্রহর।”

আলো ফুলগুলো হাতে নিয়ে ঘ্রাণ নিতে থাকে। লাল ও নীল রঙা লিলি ফুল দেখে অবাক হয়ে সুধায়,
“লাল ও নীল রঙের লিলি আমি আমেরিকাতে থাকতে লাস্ট দেখেছিলাম। এগুলো তো বাংলাদেশে চাষ হয়না বলে জানি। পেলে কোথায়? লিলির প্রতিটা ভেরিয়ান্ট এখানে আছে দেখছি।”

প্রহর আলোর পেছোনে দাঁড়িয়ে ওর জন্য আনা উপহারটা ওর গলায় পড়িয়ে দিতে দিতে বলে,
“এভরিথিং ইজ ফর মাই লাভ।”

আলো নিজের গলায় ঠান্ডা কিছু অনুভব করে সেখানে হাত দিয়ে দেখে একটা মারমে*ইড পেন্ডেন্ট। অবাক হয়ে প্রহরের দিকে ঘুরলে প্রহর নিজের ওষ্ঠকোণে চমৎকার হাসির রেখা ফুটিয়ে বলে,

“হ্যাপি ফোর ইয়ারস এনিভার্সিরি মাই মুনলাইট কুইন।”

অবাক হওয়া যেনো বাকিই ছিল আলোর।
“এইজন্য এতো আয়োজন? আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। পেন্ডেন্টটা এতো নজরকারা যে আমার নিজেকে মা*রমে*ইড মনে হচ্ছে। সরি ভুলে যাওয়ার জন্য।”

“ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। সারাদিন তোমার উপর দিয়ে কম তো ধকল যায়নি! তারউপর বিকেলের ইন্সিডেন্টটা।”

প্রহর দেখল আলোর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গটা বদলাতে বলে,
“ওসব ভুলে যাও। আমাদের চার বছরের ভালোবাসায় পূর্ণ বিবাহবার্ষিকী সেলিব্রেট করতে হবে তো। তোমার পছন্দের সবকিছু এখানে।”

আলোর মুখে হাসি ফোটে। দুজনের মিলে কেক কে*টে খায় সাথে রিও ও পিকুকেও খেতে দেয়। ওরা দুজনও এতক্ষণ জেগে ছিল। আলো রিও ও পিকুকে কেক খাওয়ানোর মাঝেই প্রহর চা হাউসটার সেন্টার টেবিল সাইড করে সরিয়ে আগে থেকে এনে রাখা কম্ফর্টার ও ছোটো তোষক বিছিয়ে সেখানে রাতে থাকার ব্যাবস্থা করল। সব ঠিক করে আলোর কাছে গিয়ে দেখে আলো অন্যমনা হয়ে রিওর গায়ে হাত বুলাচ্ছে। প্রহর জিজ্ঞেস করে,

“কী হয়েছে? এতো অন্যমনস্ক কেনো?”

আলো মলিন হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“বাবা কি এবারও আসবে না প্রহর? চার বছর হয়ে গেলো। বাবা কোথায় আছে? কেমন আছে? কিছু জানিনা। আমার গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়া মাত্র দেশে ডেকে আনলো অতঃপর সাতদিনের মা*থায় তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলো।”

প্রহর আলোকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলে,
“সব ঠিক হয়ে যাবে। স্যার জলদি ফিরে আসবেন।”

“কবে আসবে সে? কোথায় গেছে কিছু বলে যায়নি। হারানো মানুষকে খোঁজা গেলেও স্বেচ্ছায় হারানো মানুষকে খোঁজা যায় না। হয়তো সে আমাকে কখনও ভালোই বাসেনি!”

প্রহর অসহায় কণ্ঠে বলে,
“স্যার তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসেন আলো। উনার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ অন্যরকম হলেও সেটার অনুমান নেই তোমার।”

আলো মলিন হাসে। বলে,
“তাই তো আমাকে ছোটো থেকে নিজের কাছে রাখেননি! দূরে দূরে রেখেছেন। তাও নিজের থেকে বহুদূরে। মায়ের মৃ*ত্যুর পর কেমন বদলে গেলো সে। শুরু হলো আমার প্রতি সময় না দেওয়া নামক অবহেলা। দশ বছরের আমাকে পাঠিয়ে দিলো আমেরিকা আমার খালামনির কাছে। বড্ড বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম হয়তো!”

প্রহর নিরব রইল। কথাগুলো সব সে জানে তাও প্রতিবারের মতো আলোকে নিজের মনের আক্ষেপ প্রকাশ করতে বাধা দেয়না। আলো নিঃশ্বাস ফেলে বলতে থাকে,
“সে আমাকে দূরে পাঠিয়ে দিলেও আমি কিন্তু তাকে মন থেকে দূর করতে পারিনি। বাবা তো আমার। মায়ের মৃ*ত্যুর পর এই ইহজগতে সে ছিল আমার একমাত্র আপনজন। আমেরিকায় যাওয়ার পর কতো রাতে ভয়ে ঘুম ভেঙে যেতো। চিৎকার করে উঠতাম, ‘বাবা আমাকে ছেড়ে যেও না!’ বলে। সারারাত আর ঘুম হতো না। রাত পেরিয়ে যেতো নিরবে কেঁদে কেঁদে। দশ বছরের আমি শিখে গিয়েছিলাম দুঃখ লুকাতে। আহ! আর খালামনি ও খালুজান আমাকে অনেক আদর করতেন ও করেন একদম নিজের সন্তানের মতো কিন্তু আমার তো আমার বাবার ভালোবাসার আক্ষেপ ছিল। জানো? দেশে এসে আমি যে বাবাকে তুমি সম্বোধন থেকে আপনি সম্বোধন করে ডেকেছি সেটাও তার খেয়ালে ছিল না। তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে নিজের দায়িত্ব থেকে রেহাই পেতে চাইলো বলেই বিয়ের পরদিনই তিনি লাপাত্তা হয়ে গেলো। তখন ভেবেছিলাম, এবার বুঝি আমি নিজের বাবার ভালোবাসা পাবো। বারো বছর পর যে দেশে ফিরেছিলাম বাবা আমাকে দেখতে ওই বারো বছরে তিনবার গিয়েছিলো তাও সেখানে তার কাজ ছিল বলে। হ্যাঁ আমার নিজের ইনকাম হওয়া পর্যন্ত সব খরচ বাবা পাঠতো। সে আমাকে এতো ইগনোর করলেও আমি কিন্তু তার জন্য মনে ঘৃণা রাখিনি। এখনও চাই সে ফিরে আসুক। আমরা তিনজন একসাথে থাকব। জানিনা সেই আশা পূরণ হবে কীনা!”

প্রহর আলোর কপালে চুমু দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। দুজনেই এখন আঁকাশে থাকা পূর্ণ চাঁদ দেখছে। চাঁদের জোৎসনায় ওদের মুহূর্তটা আরও হৃদয় ছোঁয়ানো। দুটি মনের অতৃপ্ততা একে অপরকে দিয়ে পুষিয়ে নিচ্ছে।

____________

“তুমি কবে প্রহরকে নিজের বশে করবে?”

“আমি তো চেষ্টা করছি। ওই আলোটাকে পথ থেকে সরাতে পারলে সব সমাধান হয়ে যাবে। তারপর প্রহর আমার বশে! প্রহর আলোকে একটু বেশিই ভালোবাসে। এই ভালোবাসাটাই ভাঙতে পারছিনা। কালও ব্যার্থ হয়েছি।”

“তোমাকে দিয়ে কিছু হবেনা মনে হয়। আমাকে অন্য ব্যাবস্থা নিতে হবে। আর কতো সময় নিবে? তিন বছর ধরে কিছুতেই পারছ না ওদের আলাদা করতে। এবার আমিই যা করার করব। তোমাকে আমার আর প্রয়োজন পরবে না।”

বুকটা ধক করে উঠলো চয়নিকার। সে তার ভালোবাসার মানুষকে হারাতে পারবে না। ফোনের অপর পাশে থাকা ব্যাক্তিটাকে বলে ওঠে,

“প্লিজ এভাবে বলো না। আমিই পারব। আমি প্রহরকে যতোটা জানি অন্যকেউ ততোটা জানবে না। আমি এরপর থেকে অন্যভাবে চেষ্টা করব প্রমিস।”

ফোনের অপরপাশে থাকা লোকটা বলে,
“সরাসরি মে*রে কেনো দিচ্ছ না?”

চয়নিকা হতাশ কণ্ঠে বলে,
“চারমাস আগে ওর খাবারে ইঁদুরের বি*ষ দিয়েছিলাম কিন্তু খাবারটা আমার হাত থেকেই পরে গেলো! ফ্লোরে পানি পরেছিল আর তাতে আমি পিছলে গিয়েছিলাম!”

লোকটা বলল,
“এসব তোমার এখনও কোইন্সিডেন্স লাগে? আমার তো তোমার গতকালকের ঘটনা জানার পরেই বিশ্বাস হতে শুরু হয়েছে এসবে প্রহর জড়িত। প্রহর হয়তো জেনেও গেছে তুমি আলোর ক্ষতি চাও। তাই তোমার এইসব ছোটোমোটো স্টেপে কিচ্ছু হবে না। সরাসরি শু*ট করে দেও। এক গু*লিতেই সব খ*তম।”

চয়নিকা ঘাবড়ে বলে,
“আমি পার..ব না। গু..গু*লি আমি করতে পারব না। আমি আবারও ওকে বি*ষ দিবো দরকার হলে। এমনভাবে দিবো যাতে প্রহর জানবেও না। এবার ওকে বুঝতেই দিবো না।

“তবে সেই কথাই রইল। যেকোনো মূল্যে প্রহরকে হাতের মুঠোয় চাই।”

লোকটা খট করে কল কে*টে দিলো। কলটাও করেছিল প্রাইভেট নাম্বার থেকে যাতে কেউ ট্রেস করতে না পারে। চয়নিকা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে আগামী পরিকল্পনা ভাবতে লাগল।

চলবে ইনশাআল্লাহ্‌,
কালকে সকাল ভোরে বাসা থেকে বের হয়েছিলাম ভার্সিটির জন্য আর সন্ধ্যার পর বাসায় এসেছিলাম। বিকেল ৫টা পর্যন্ত ক্লাস ছিল। তারপর এসাইনমেন্টের ডে*ডলাইন! ফার্মেসি স্টুডেন্টের লাইফটাই এমন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here