প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব ৩৭ ও শেষ

#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা

৩৭.

ইমারজেন্সির বেডে নিশ্চুপভাবে শুয়ে আছে ইচ্ছে। ওর নাকে অক্সিজেন পাইপ, হাতে স্যালাইন, মাথায় কিছু সেন্সর লাগানো। দরজা খুলে আস্তেধীরে ভেতরে ঢুকলো প্রাপ্ত। কলিজা যেনো কেউ টুকরো টুকরো করে কাটছে ওর। ডক্টর বলে দিয়েছে, ইচ্ছে নিজেই রেসপন্স করছে না। আর এমন চলতে থাকলে চাইলেও অপারেশন করা তাদের পক্ষে সম্ভব না। নওশাদ সাহেব, নাফিজা বেগম, রাকীন একেএকে সবাই এসে দেখে গেছে ইচ্ছেকে। ইচ্ছে সাড়া দেয়নি। মনে সাহস সঞ্চার করে কেবিনে ঢুকলো প্রাপ্ত। এগিয়ে এসে ঝুকলো ইচ্ছের দিকে। অসহায়ের চোখে মনভরে দেখে নিলো ওকে। তারপর মৃদ্যুভাবে ইচ্ছের কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,

-কেনো এমন করছো ইচ্ছে? আর কতো শাস্তি দেবে আমায়?

-ডক্টর বলছে তুমিই নাকি রেসপন্স করছো না? কিন্তু তা কি করে হয় ইচ্ছে? সবেই তো নতুন করে শুরু করবো আমরা। তুমি তো পিছিয়ে যাওয়ার মেয়ে নও ইচ্ছে। সাহস করে তুমিই তো প্রথমে এগিয়েছিলে। সবকিছু ছেড়েছুড়ে। এখন ওরা বললে আমি কি করে বিশ্বাস করি বলো?

-তোমার বাবা, মা, বোন, বন্ধু সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ইচ্ছে। একটাবার চোখ মেলো? একটাবার তাকাও?

ইচ্ছের সাড়া নেই। প্রাপ্ত ওর দুহাত মুঠো করে চুমো দিলো। ওর চোখের জলে সিক্ত হলো ইচ্ছের হাত। প্রাপ্ত কাদতে কাদতে বললো,

-তোমার ভালোবাসা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ইচ্ছে। তোমার পাগলামীর স্রোতে গা ভাসাবে বলে। তাকে আর একটাবার সুযোগ দাও ইচ্ছে? একটাবার?

মৃদ্যু নড়েচড়ে উঠলো ইচ্ছের হাত। কিঞ্চিত শক্তিতে প্রাপ্তর হাত চেপে ধরলো ইচ্ছে। চমকে উঠে উচ্ছ্বাসে ওর দিকে তাকালো প্রাপ্ত। ইচ্ছে চোখ খুললো আস্তেধীরে। নিজচোখে দেখে নিলো উন্মাদপ্রায় প্রাপ্তর চেহারার হাল। মৃদ্যুস্বরে বললো,

-আমি বরই নির্লজ্জ প্রাপ্ত। জীবনে খুব কম ভালোবাসা পেয়েছি তো! তাই ভালোবাসার ডাক শুনলে আটকাতে পারি না নিজেকে।

প্রাপ্ত ইচ্ছেকে তুলে জরিয়ে ধরলো। পাগলের মতো একাধারে চুমোতে ভরিয়ে দিলো ইচ্ছের চোখমুখ। ইচ্ছে বাধা দিলো না। প্রাপ্ত একটু থামলে বললো,

-কি হয়েছে আমার? বাচবো না আমি আর?

-কিছুই হয়নি তোমার। সব ঠিক হয়ে যাবে ইচ্ছে।

প্রাপ্তর শীতল স্বর। ইচ্ছে মৃদ্যু হাসলো। অনেকটা সময় পর প্রাপ্ত ওকে বেডে শুইয়ে দিলো আবারো। নাক টেনে ঠোটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বললো,

-আজ আমাদের বিয়ে ইচ্ছে।

থমকে গেলো ইচ্ছে। কম্পিতকন্ঠে বললো,

-ক্ কি বলছো তুমি এসব?

-ঠিকই বলছি। আমি আজ এই মুহুর্তে বিয়ে করতে চাই তোমাকে।

-পাগল হয়ে গেছো তুমি? এসব…

-প্রাপ্ত ঠিকই‌ বলছে ইচ্ছে। আজই‌ বিয়ে হবে তোদের।

ইচ্ছে চোখ সরিয়ে দরজায় তাকালো। খেয়া এসেছে। ওর হুইলচেয়ারের পেছনে রাকীন দাড়িয়ে। নওশাদ সাহেব, নাফিজা বেগমও আছেন। ইচ্ছে বললো,

-কিসব বলছিস তুই খেয়া? এখন এভাবে…

-আমরা সবাই এমনটাই চাই ইচ্ছে। প্রেসমিডিয়া জানুক, তোমার আজ বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো, বিয়েটা হয়েছে।

-কিন্তু বাবা…

প্রাপ্ত পাশ থেকে একটা কাগজ তুলে দিলো ইচ্ছের কোলে। ওর একহাতে কলম ধরিয়ে দিয়ে, আরেকহাতে চুমো দিয়ে বললো,

-ভালোবাসি তোমাকে মিস রকস্টার। আমার ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দাও?

বাবা, মা, বোনের দিকে একপলক তাকিয়ে সবার চোখমুখে পড়ে নিলো ইচ্ছে। অতঃপর নির্দ্বিধায় রেজেস্ট্রি পেপারে সাইন করে দিলো । ওর সব কারন, প্রশ্ন এসে প্রাপ্তর কথাতেই শেষ হয়ে যায়। প্রাপ্ত ওর দুর্বলতা। আর যাই হোক, কোনোদিনও ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা যে ওর নেই, তা ভালোমতোই জানে ইচ্ছে। সাইনটা পেয়ে প্রাপ্ত শ্বাস ফেললো। কপালে চুমো একে দিলো ইচ্ছের। বললো,

-ওয়েলকাম টু মাই লাইফ ইচ্ছে। তোমার একান্ত গ্যাংস্টারের মিসেস গ্যাংস্টার হয়ে।

কেবিনে নাফিজা বেগম ইচ্ছের ঔষুধপত্র গোছাচ্ছেন। থরথর করে সমানে হাত কাপছে তার। ইচ্ছের অপারেশনের সময় ঘনিয়ে আসছে ক্রমশ। স্বামী হিসেবে ইচ্ছের সব সিদ্ধান্ত প্রাপ্তই নিয়েছে। নওশাদ সাহেবকে এখনো কিছু জানায়নি প্রাপ্ত বা রাকীন। কি হবে সে চিন্তায় নাফিজা বেগম অস্থির হয়ে পরেছেন। ইচ্ছে আধশোয়া হয়ে বসেবসে মাকে দেখে চলেছে। বিয়েটা হয়ে যাওয়ার পর, আর একবারের জন্যও খেয়া আসেনি ওর কেবিনে। নাফিজা বেগমের অবস্থাও স্বাভাবিক না। কিছু বলতে যাবে, তখনই গিটারের ব্যাগ কাধে কেবিনে ঢুকলো প্রাপ্ত। পেছনে আরেকটি মেয়ে। নাফিজা বেগম জলভরা চোখে তাকালেন মেয়েটার দিকে। ব্রেইন অপারেশনের জন্য চুল কাটা হবে ইচ্ছের। এজন্যই মেয়েটিকে নিয়ে এসেছে প্রাপ্ত। প্রাপ্তকে দেখলেন শক্ত হয়ে দাড়িয়ে থাকতে। তার সব কাজে শুধু একটাই প্রতিত্তর, ইচ্ছের অপারেশন হবে, ঠিক হয়ে যাবে ইচ্ছে। ঠোট চেপে ধরে কান্না আটকে, নাফিজা বেগম বেরিয়ে গেলেন কেবিন থেকে। ইচ্ছে ইশারায় প্রাপ্তকে জিজ্ঞাসা করলো, মেয়েটা কে। প্রাপ্ত একটা টুল টেনে গিটার কোলে নিয়ে বসতে বসতে বললো,

-তোমার চুলের অবস্থা ভালো না। নতুন বউকে এতো এলোমেলো‌ চুলে ভালো দেখায় না। তাই ভাবলাম একটু কেটে ছোট করে‌ দেই।

ইচ্ছে ঠোট টিপে হেসে বললো,

-আসল ঘটনা বলুন মশাই। বাচ্চাদের কাহিনী কাকে শোনাচ্ছেন?

প্রাপ্ত একশ্বাসে বললো,

-তোমার চুল আমার পছন্দ না ইচ্ছে।

ইচ্ছে শব্দ করে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললো,

-একদম ন্যাড়া করে দাও।

তারপর প্রাপ্তর দিকে তাকিয়ে বললো,

-আর এইযে! গিটার এনেছো যখন, গান গেয়ে শোনাও! জলদি!

অবাকচোখে তাকিয়ে রইলো প্রাপ্ত। ওর কাজগুলোকে এতো সহজতর করে কেনো দিচ্ছে ইচ্ছে? এতোটা বাচ্চামো কেনো করছে? ইচ্ছে ভ্রু নাচিয়ে আবারো গাইতে বললো ওকে। প্রাপ্ত গিটারে সুর তুলে ওর দিকে তাকিয়ে গাইতে লাগলো,

” হতে পারে রুপকথার এক দেশের
রাতের আকাশের একফালি চাঁদ
তোমার আমার চিরকাল…
তুমি আমি হাতে রেখে হাত
ছুয়ে দিয়ে আঙুলে আঙুল
দেখতে পারো কিছু আদুরে সকাল।
হতে পারে এ পথের শুরু
নিয়ে যাবে আমাদের অজানায়
তুমি আমি আমাদের পৃথিবী
সাজিয়ে নেবো ভালোবাসায়…

ভালোবাসি বলে দাও এবার
বলে দাও হ্যাঁ সব কবুল
তুমি শুধু আমারই হবে
যদি করো মিষ্টি এ ভুল।
হাতে হাত রাখতে পারো
সন্ধি আঙুলে আঙুল
ভালোবাসা বাড়াতে আরো
হৃদয় ভীষন ব্যাকুল…”

ইচ্ছে চোখ সরালোই না প্রাপ্তর থেকে। মুগ্ধচোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো ওকে। ভুলে গেলো পারিপার্শ্বিক। যে মেয়েটা ইচ্ছের চুল কাটতে এসেছিলো, অজান্তেই কখন ওর চোখ থেকে জল গরিয়েছে, নিজেও জানেনা। এমন ভালোবাসা চোখের সামনে দেখাটাও‌ সৌভাগ্যের বিষয়। তরিঘড়ি করে চোখের পানিটুক মুছে নিজের কাজে মন দিলো ও। ইচ্ছের মাথার ঝলোমলো চুলগুলো দেখে আরেকদফায় কান্না আসছিলো ওর। এইতো সেদিনের এক কনসার্টে, ছাড়া চুলে, জিনস্ টপস্ পরে স্টেজে উঠেছিলো ইচ্ছে। প্রতিবার গান গাওয়ার সময় যখন চুলগুলো চোখেমুখে এসে লাগতো, কতো সুন্দরভাবে তাতে আঙুল চালিয়ে সরিয়ে দিতো ইচ্ছে। ঠোট কামড়ে ধরে নিজেকে শক্ত রেখে মেয়েটা সবগুলো চুল কেটে দিলো ইচ্ছের। ঠিকঠাকমতো সবকিছু গুছিয়ে পেছন থেকে মৃদ্যু ইশারা করলো প্রাপ্তকে। ইচ্ছে তখনো প্রাপ্তর গানের মোহে আছে যেনো। প্রাপ্তও ইশারায় মেয়েটাকে বুঝালো চলে যেতে। মেয়েটা চলে গেলে, শেষ করলো গান। ধ্যান ভাঙলো ইচ্ছের। ঠোটে মুগ্ধতার হাসি বহাল রেখে বললো,

-অনেকভালো গাও মিস্টার গ্যাংস্টার। সিঙিংয়ে আসলে না কেনো?

প্রাপ্ত গিটার পাশের দেয়ালে ঠেস দিয়ে রেখে বললো,

-আমি সিঙিংয়ে গেলে, তুমি মিস রকস্টার থেকে মিসেস গ্যাংস্টার কিভাবে হতে শুনি?

ইচ্ছে হাসলো। প্রাপ্ত একধ্যানে ওর হাসিটার দিকে তাকিয়ে রইলো। ওই হাসি দেখে ইচ্ছের একদম কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করছে ওর। আদর করতে ইচ্ছে করছে। পরিস্থিতি ঘোরাতে উঠে দাড়িয়ে শেলফের কাছে চলে গেলো। ইচ্ছের ঔষুধপত্র দেখতে দেখতে বললো,

-মেডিসিন নিয়েছো? আমি আসার আগেই আন্টি দিয়ে দিয়েছে মেডিসিন?

ইচ্ছে যেনো পুরোটাই বুঝলো। হাতের স্যালাইন খুলে ফেললো আস্তেধীরে। প্রাপ্ত উল্টোপাশ হয়ে ফিরে তখন। বেড থেকে নেমে, প্রাপ্তর পিঠে মাথা ঠেকিয়ে ওকে জরিয়ে ধরলো। প্রাপ্ত চমকে উঠে পেছন ফিরতে যাচ্ছিলো। ইচ্ছে ওর বুকের শার্ট খামচে ধরে বললো,

-রিল্যাক্স। নিজে উত্তেজিত হয়ে আমাকেও উত্তেজিত করো না প্লিজ!

-ইচ্ছে?

-আই লাভ ইউ।

-তোমার রেস্টের দরকার ইচ্ছে। তুমি…

ইচ্ছে প্রাপ্তর সামনে এসে দাড়ালো। প্রাপ্তর হাত দু গালে রেখে বললো,

-আমি তোমার বউ প্রাপ্ত। ভালোবাসো আমাকে। আদর করে দাও মন ভরে।

-এসব…চলো বেডে চলো।

প্রাপ্ত সরিয়ে আনছিলো ইচ্ছেকে। ঠায় হয়ে দাড়িয়ে রইলো ইচ্ছে। একচুলও নড়লো না। প্রাপ্ত দীর্ঘশ্বাস মিনতির স্বরে ফেলে বললো,

-তুমি কেনো জেদ করো ইচ্ছে? এটা জেদের সময়?

-তোমায় বলেছি আমাকে ভালোবাসতে। আগে জানলে বিয়েটা কোনোভাবেই করতাম না আমি। কিছুক্ষন আগে চুপিচুপি আমার রিপোর্টস্ দেখে জানলাম, কাল ওটি থেকে আমার রিকভারির পসিবিলিটি খুব কম। বেশ বুঝতে পারছি, এখনো অবদি বেচে আছি, তোমাকে ভালোবাসি বলে। সে ভালোবাসাকে আরো গভীরভাবে অনুধাবন করার আগে, তোমার কাছে আসার আগেই যদি এভাবে মর্…

ইচ্ছের মুখ চেপে ধরলো প্রাপ্ত। একহাতে ওর কোমড় জরিয়ে রেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

-হুশ! চুপ! এভাবে বলো না ইচ্ছে! প্লিজ এভাবে বলো না! ভালোবাসা তো ভালোবাসাই হয়। গভীরভাবে, মৃদ্যুভাবে অনুভবের কিছুই নেই এতে। আমি সবরক‌ পরিস্থিতিতে শুধু তোমাকে চাই। তুমি কেনো ভুল বুঝছো আমাকে? কেনো আমাকে বারবার অপরাধী করে দিচ্ছো তোমার কাছে? কিছুই হবে না তোমার। কিছুই হবে না!

প্রাপ্ত চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো। ইচ্ছে তাকিয়ে তাকিয়ে ওকে দেখে চলেছে। কিছুটা সময় পর পাশের শেলফে থাকা মোবাইলটা নিলো একহাতে। “লাগ যা গালে” গানটা বাজিয়ে দিলো ওতে। প্রাপ্ত গানের কথাগুলো শুনতেই চোখ মেললো। বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিলো ও গানটা। ইচ্ছে বাধা দিয়ে বললো,

-আমরা কতোদিন বাচি, কতোক্ষন বাচি, সেটা কিন্তু গুরুত্বপুর্ন না। গুরুত্বপুর্ন বিষয় হলো, বেচে থাকার মুহুর্তগুলোতে আমরা কতোটুকো বাচি, কতোটুকো উপভোগ করি আমাদের জীবন। মেয়ে, বোন হিসেবে জীবন দেখে নিয়েছি আমি প্রাপ্ত। কাল ওটিতে ঢোকার আগ অবদি আমি তোমার স্ত্রী হিসেবে বাচতে চাই! ওটিতে যাওয়ার আগ অবদি, তোমার কাছে থেকে তোমার শরীরের ঘ্রান নেবো, তোমায় ভালোবাসবো, আমার থেকে এই সৌভাগ্যটা কেড়ে নিও না প্রাপ্ত! প্লিজ!

-ইচ্ছে…

প্রাপ্তকে বলার সুযোগ দেয় নি ইচ্ছে। গোড়ালি উচিয়ে, একহাতে প্রাপ্তর গলা জরিয়ে ধরে, ঠোটের স্পর্শে আটকে দিলো ওর ঠোট। আটকে ছিলো প্রাপ্তও। আস্তেধীরে নেমে ওর বুকে মুখ গুজলো ইচ্ছে। জোরেজোরে শ্বাস নিয়ে প্রাপ্তর গায়ের ঘ্রান অনুভবের চেষ্টা করলো। তবে নাকের পাইপের জন্য পারলো না কিছু অনুভব করতে। অশ্রুবিসর্জন দিতে লাগলো নিরবে। প্রাপ্ত পাথর হয়ে গেছে। টপটপ করে জল গরাতে লাগলো ওর চোখ বেয়েও। জানালা দিয়ে বাইরের রুপালী থালার মতো চাঁদটা দেখা যায়। প্রেমানুরাগের এ মুহুর্ত শুধু ওদের দুজনেরই হওয়ার কথা। কিন্তু মিলনের মহৌৎসবের পরিবর্তে বরং আজ সুর উঠেছে, “ফির আপকে নাসিব মে, ইয়ে বাত, হো না হো…শায়েদ ফির ইস জানামমে, মুলাকাত হো না হো….”
#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা

অন্তিম পর্ব.

সময়ের অতিবাহন এক চিরন্তন সত্য। আর সে অতিবাহনে জীবনের প্রবাহ বয়ে চলে, এটাও জীবনের আরেক অনবদ্য নিয়ম। ভালোবাসা, মান-অভিমান, উত্থান-পতন, কাছে আসা-দুরে‌ যাওয়া, সন্ধি-বিচ্ছেদ সব সমার্থক বিপরীতার্থক মিলিয়ে তৈরী হয় সে জীবনের ছন্দ। ব্যতিক্রম হয়নি খেয়া-রাকীনের জীবনেও। ওরাও এগিয়েছে। জীবনের সকল ঝড়ঝঞ্চা পেরিয়ে এগিয়েছে। পুর্নতা দিয়েছে নিজেদের ভালোবাসাকে। প্রেমময় প্রহরের তেমনি এক পুর্নিমায় শুকমরার ঘাটে পানিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে খেয়া। পরনে গাঢ় নীল শাড়ি। কোমড়ের নিচ অবদি খোলা চুল, ছুইছুই করছে পানিতে। মাঝরাতের চাঁদটা কখনো মেঘের আড়াল হচ্ছে, তো কখনো বেরিয়ে এসে উজ্জ্বল আলো বিলাচ্ছে। শুকমরার পরিষ্কার পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে চাঁদের আলো। খানিকটা পেছনে তালগাছের সাথে হেলান দিয়ে, বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে আছে রাকীন। ওর চাওনি খেয়ার দিকে স্থির। বেশ কিছুটা সময় পর খেয়া পেছন ফিরে রাকীনকে ইশারা করলো ওর পাশে বসার জন্য। তারপর নিজের মতো করে ব্যস্ত হয়ে গেলো পানিতে হাত নাড়াতে। একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে রাকীন এগোলো। দাড়িয়ে থেকে প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

-মানুষ হানিমুনে ফরেইন যায়, নয়তো দেশের মধ্যেই দর্শনীয় জায়গাগুলোতে যায়। সাজেক ভ্যালি, কক্সবাজার আরো কতো জায়গা! আর আমাকে কিনা আসতে হলো এই ভাদুলগাঁয়ে। শুকমরার তীরে। একেই বলে, কপাল!

খেয়া চোখ তুলে তাকালো রাকীনের দিকে। মোটেও আফসোস ছিলো না ওর কথায়। বরং উপেক্ষিত হওয়ার অভিমান ছিলো। এই অভিমান বরাবরই মানায় রাকীনকে। হসপিটালে আংটিবদল থেকে‌ শুরু করে, তার দু মাস পর বিয়ে, আর আজ বিয়ের চারমাস পর‌ ঢাকার বাইরে‌ বেরোনো, সেটাও‌ আবার ভাদুলগাঁয়ে। সে মানুষটা অভিমান করবে না তো কে‌ করবে? বিষয়টা বুঝে মুচকি হেসে উঠে দাড়ালো খেয়া। ঘাড় কাত করে রাকীনের দিকে তাকিয়ে বললো,

-শুকমরার তীরে আসতে হয়েছে বলে আফসোস হচ্ছে?

-হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু? নেহাত তুই বললি সাহেরা মায়ের এখানে আসবি বলেই আসা। নইলে কোন নিউলি ম্যারেড বিয়ের পর ঘুরতে গ্রামে আসে? এখানে রোমান্স হয়?

-তো রোমান্স আসছে না বুঝি তোর?

-একদমই না!

খেয়া হাত ধরে বসালো রাকীনকে। নিজে হাতে ওর প্যান্ট ভাজ দিতে যাচ্ছিলো। রাকীন তৎক্ষনাৎ পা সরিয়ে‌ নিয়ে কপালে ভাজ ফেলে নিজে নিজেই প্যান্ট ভাজ দিলো। তারপর পানিতে পা ডুবিয়ে বসলো খেয়ার মতোন করেই। হেসে দিয়ে ওর হাত জরিয়ে ওর কাধে মাথা রাখলো খেয়া। বললো,

-মনে পরে রাকীন? কয়েকমাস আগে এমনই এক রাতে এই ভাদুলগায়ে দেখা হয়েছিলো তোর সাথে খইয়ের।

-মনে পরবে না আবার? যা তান্ডব ঘটিয়েছিলেন আপনি! আমাকে জ্বী’নটিন ভেবে তো জ্ঞানই হারিয়েছিলেন। কি যে বিপদে পরেছিলাম ওই রাতে, আমিই জানি! কনফিউশনে পরে গিয়েছিলাম তোকে জ্ঞান হারাতে দেখে সত্যিই ঘাড়টার মটকে দিলাম নাকি?

খেয়া ফিক করে হেসে‌ দিলো। তারপর হঠাৎই মন খারাপ করে বললো,

-তান্ডব তো তার পরে শুরু হয়েছিলো রাকীন। সাহেরা মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। সাদিক কাকা আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলো। তোর কথা বারবার মনে পরতো। তার পরেও প্রাপ্তর সাথে আংটিবদল আর ইচ্ছের…

রাকীন এতোক্ষনে‌ খেয়ার দিকে ফিরলো। একহাতে ওর হাত শক্তকরে ধরে আরেকহাত ওর গালে রেখে বললো,

-হুশ! তুই আমার এতোগুলো বছরের অপেক্ষার ফল খেয়া। যদি আমি জানতাম আমার সেই ঝাসির রানী খইই আমার খেয়া, প্রাপ্তর সাথে তোর বিয়েটা হতে দিতাম না আমি। কোনোদিনও‌ না! আগে হোক বা পরে, তোকে তো আমারই হতে হতো। এর জন্য যেকোনো সীমা পার করতে পারতাম আমি। যেকোনো!

রাকীনের কথায় শুধুই জেদ আর অধিকারবোধ। চাঁদের আলোতে মানুষটাকে দেখতে দেখতে বাকিসব ভুলে বসলো খেয়া। মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থেকে বললো,

-নিজামকে পুলিশের হাতে দেওয়ার আগে‌ খুব মেরেছিলি না তুই?

রাকীন হেসে দিয়ে‌ বললো,

-ও নেশায় পরে তোর দিকে হাত বাড়িয়েছিলো। খালি হাতটাই‌ ভেছে দিয়েছি।

-নিজাম তোর চাচাতো ভাই হয় রাকীন।

-অন্যায় কাউকে ছাড়ে না। ওকে কি করে ছাড় দিতো? পাপের ফল ভোগ করতে এখনো পুলিশ কাস্টাডিতে আছে। সবদিক ঠিকই আছে খেয়া। হাউজিং, মিষ্টিঘরের স্কুলবিল্ডিং দুটোই বাবা সামলে নিয়েছে। তোকে ফিরে পেয়ে আমার মতো তারাও অনেক খুশি। আসলে তুই মানুষটাই এমন। মায়ায় ফেলে‌ দিস সবাইকে।

খেয়া কিছুক্ষন নিরবে চেয়ে রইলো শুধু। তারপ নিরবতা ভেঙে বললো,

-একটা কথা বলতো রাকীন? কাকে ভালোবাসিস তুই? খইকে? নাকি খেয়াকে?

রাকীন আবারো হেসে দিলো। হুট করেই খেয়ার কোমড় জরিয়ে অনেকটা কাছে টেনে নিলো ও। কিঞ্চিত চমকে উঠলো খেয়া। রাকীন ওর নাকে নাক ঘষে দিয়ে বললো,

-তোকে ভালোবাসি।

-কেনো?

-তোকে ভালোবাসার কারন লাগবে না আমার খেয়া। অথবা বলতে পারিস, কারনগুলো এতো বেশি যে তাদেরকে ভাষায় সঙ্গায়িত করতে পারি না। আমার কাছে ভালোবাসার মানুষটা মানে তুই। সে তুই খই রুপেই থাক, বা খেয়া হয়ে। এই শ্যামসুন্দরীর মায়াবী মুখের দিকে তাকালে আর কিছুই লাগে না আমার। আজীবন শুধু একটাই চাওয়া! এভাবেই থেমে রই, তোর প্রেমনোঙরে। এভাবেই খেয়া থাকুক, আমার হৃদসাগরের সম্রাজ্ঞী হয়ে। প্রেমনোঙর ফেলে…

কথা শেষ করে খেয়ার কপালে আলতো করে ঠোট ছোয়ালো রাকীন। লাজুক হাসিতে খেয়া মুখ লুকালো রাকীনের বুকে। আর চাঁদ লুকালো মেঘের আড়ালে। লজ্জাঘেরা এই রজনীর সাক্ষ্য দেওয়ার মতো নির্লজ্জ নাইবা হলো সে!

ডোরবেল বাজতেই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো পিয়ালী। দরজায় হাসিমুখ করে ইচ্ছে দাড়িয়ে। সেই আগের ইচ্ছে। কোমড়ের উপরে ছাড়া সোজা চুল, জিনস টপস, কাধে গিটারের ব্যাগ আর ঠোটের সেই উজ্জল হাসি। এক্সিডেন্টের ছ মাস পর আজ প্রথম কনসার্টে গিয়েছিলো ইচ্ছে। অলৌকিকভাবে সেদিন ওর অপারেশনটা মিটেছিলো‌ ভালোভাবে। প্রাপ্তর ভালোবাসার কাছে হার মেনেছিলো ওর মৃত্যুসম্ভবনা। অপারেশনের সময় এ বিষয়ে জানতে পেরে নওশাদ সাহেব অনেকবেশি রিয়্যাক্ট করেছিলেন। পরে অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পারেন তিনি। হসপিটাল থেকে প্রাপ্ত ওকে সরাসরি ওদের বাসায়ই নিয়ে এসেছিলো। প্রেস মিডিয়া সবাইকে ওদের বিয়ের বিষয়ে জানিয়ে। এ বাসায় প্রাপ্ত, পিয়ালী আর সাদিক সাহেব মিলে আদরযত্মের কোনো কমতি রাখেনি ইচ্ছের। বরং যে ভালোবাসা থেকে এতোদিন বঞ্চিত ছিলো, সে ভালোবাসার পুরোটাই যেনো উশুল করে নিয়েছে ইচ্ছে।

এভাবেই দেখতে দেখতেই পার হয়ে গেছে ছ মাস। ইচ্ছে ভেতরে ঢোকার আগে টমি বাসার ভেতরে ঢুকলো। পিয়ালীকে ইশারা করে রুমে চলে গেলো ইচ্ছে। প্রাপ্তকে খুজলো পুরো ঘরে। কিন্তু প্রাপ্ত নেই সেখানে। ফ্রেশ হয়ে ধুতি আর শর্টকামিজ পরে ডাইনিংয়ে বসে গেলো ইচ্ছে। উকিঝুকি দিয়ে তখনো প্রাপ্তকে খুজছে ও। কোনো কথা ছাড়াই ইচ্ছেকে‌ খাইয়ে দিতে লাগলেন সাদিক সাহেব। পিয়ালী পাশে বসে নিজে হাত দিয়ে খেতে শুরু করলো। ইচ্ছে এ বাসায় আসার পর থেকে কখনো নিজ হাতে খেয়েছি কিনা সন্দেহ। সাদিক সাহেবের যেনো ইচ্ছেকে নিজ হাতে না খাইয়ে তৃপ্তি মেলে না। তাই মানা করলো না ইচ্ছে। উনি ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন,

-এতোদিন পর কনসার্টে গিয়েছিলি। সবকিছু কেমন ছিলো রে মা?

ইচ্ছে হাসিমুখে বললো,

-ভালোই‌ ছিলো। ইনফ্যাক্ট খুব বেশি ভালো ছিলো বাবা। ছ মাসের এবসেন্সে অডিয়েন্সে যেনো নতুন করে আমার প্রতি ভালোবাসাটা বেড়েছে।

-তোর প্রতি ভালোবাসা তো আগে থেকেই ছিলো সবার। আছে আর থাকবেও। নতুন করে বাড়ার কিছু নেই।

মৃদ্যু হাসলো ইচ্ছে। সাদিক সাহেব বললেন,

-ভালো কথা! সাফোয়ান কল করেছিলো। বললো কাল পরশুর মধ্যে মিষ্টিকে নিয়ে যেতে চায় ও ওর ওখানে। বিয়ের প্রায় দু মাস হতে চললো। বলছে এখন নাকি মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছে ওখানকার সবদিক। তোর কনসার্ট বা নেক্সট রেকর্ডিং কবে? সে অনুযায়ী টাইম বলে দেই ওকে? কি বলিস?

মিষ্টি চলে যাবে শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো ইচ্ছের। এতোগুলো দিনে ওউ কম যত্ম নেয়নি ওর। সাফোয়ানের সেটলমেন্টের জন্য মেয়েটাকে একাকী থাকতে হয়েছে এতোগুলো দিন। তবে মিষ্টি, পিয়ালী, অরিত্রা, রাকা, মাহীম সবার সাথে সময়গুলো বেশ ভালো কেটেছে ইচ্ছের। খেয়া, রাকীনও এসে দেখা করে যেতো প্রায়ই। ইচ্ছে বললো,

-মিউজিক ডিরেক্টর বলছিলো কল করে জানাবে। মেবি পরশু আছে রেকর্ডিং। তবে আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো।

-পরশু আমার আইটেলে জয়েনিং ডেইট।

প্রাপ্ত বেখেয়ালিভাবে চেয়ারে বসতে বসতে বললো। বড়বড় চোখে ওর দিকে তাকালো উপস্থিত সবাই। প্রাপ্ত ওর নিজের হাতে বানানো কন্টিনেন্টাল আলাদা আলাদা বাটিতে বাড়তে মনোযোগী। ইচ্ছে বুঝলো, কিচেনে ছিলো প্রাপ্ত। ওর হাতের রান্না খেতে ভালোবাসে বলে বেশিরভাগ সময়ই‌প্রাপ্ত রান্না করে। অবশ্য এ ছ মাসে ওউ সাথেসাথে থেকে শিখেছে টুকটাক। পুরোটা না করলেও, কিচেনে হেল্প করে প্রাপ্তকে, সাদিক সাহেবকে। প্রাপ্তর কথা শুনে পিয়ালী বিস্ময়ে বললো,

-ভাইয়া? তুই আইটেলে জয়েন করছিস?

-কেনো? আমার এজুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন কি খুব খারাপ? ওই ফার্স্টক্লাস ফার্স্টের সার্টিফিকেটসগুলো দিয়ে আইটেলে জয়েন করা পসিবল না?

পিয়ালী থামলো। ইচ্ছে খাবার চিবানো বাদ দিয়ে প্রাপ্তর দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে। সাদিক সাহেব ওর মুখের সামনে খাবার তুলে ধরলেন। ইচ্ছের বিস্ময় কাটছেই না। ওকে খাবার খেতে বললেন ইশারায়। ইচ্ছে মুখে তুললো খাবার। সাদিক সাহেব আবারো খাবার মাখাতে মাখাতে বললেন,

-তোমার কোয়ালিফিকেশনের কথা বলে নি ও। হুট করে জবে ঢুকতে চাইছো, তাই বলেছে। তা হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত?

-দুদিন পর এক ডজন নাতি নাতনির দাদুভাই হবে, তখন বুঝবে কেনো জবে ঢুকতে চাইছি।

প্রাপ্তর কথা শুনে কাশি উঠে গেলো ইচ্ছের। তরিঘরি করে ওকে পানি এগিয়ে দিলো প্রাপ্ত। পানি খেয়ে ইচ্ছের কাশি কমে এলে প্রাপ্ত কন্টিনেন্টাল ওর মুখের সামনে তুলে ধরে বললো,

-এই লোকের বয়স হয়েছে। কিভাবে খাইয়ে দিতে হয়, ভুলে গেছে। তুমি আমার হাতেই খাও!

ড্যাবড্যাব করে বাবা ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলো ইচ্ছে। সাদিক সাহেব মুচকি হেসে ইচ্ছের জন্য মাখানো প্লেটেই খাবার খেতে লাগলেন। খেতে খেতে বললেন,

-আজ অনেকদিন পর অনেক ধকল গেছে মেয়েটার উপর দিয়ে। আর অনেক রাতও হয়েছে। খাওয়া শেষ করে ঘুমোও গিয়ে।

প্রাপ্ত খাবার তুলে ধরলো ইচ্ছের মুখের সামনে। ইচ্ছে কিছুটা মুখে নিয়ে বললো,

-শুনলাম মাহীমের প্রমোশন হয়েছে? রাকার বাসায় বিয়ের প্রোপোজাল পাঠাচ্ছে না কেনো?

-ওই ব্যাটা আমার জন্যই আটকে আছে। তোমার বান্ধবীর আম্মু আবার আমার হাতে মানুষ কিনা!

-মানে? তার বাসায়ও গুন্ডামো করে এসেছিলে নাকি?

-ওরকমই বটে। তাও তোমার জন্য!

বড়বড় চোখে তাকালো ইচ্ছে। প্রাপ্ত ভাবলেশহীন। আর কথা বাড়ানোটা উচিত বলে মনে হলো না ইচ্ছের। বললো,

-আর খাবো না। বাবা অনেক খাইয়ে দিয়েছে।

প্রাপ্ত শীতল চোখে চেয়ে বুঝালো, আমি এতো কষ্টে রান্না করেছি, পুরোটা না খেলে তোমাকেই খেয়ে নেবো রকস্টার ম্যাডাম। বিষয়টা বুঝে ভয়ের বদলে মজা পেলো ইচ্ছে। গলা ঝেড়ে ভাব নিয়ে বললো,

-সত্যিই‌ খিদে নেই মিস্টার গ্যাংস্টার। আজ বরং…

ইচ্ছেকে শেষ করতে না দিয়ে উঠে দাড়ালো প্রাপ্ত। হুট করেই সবার সামনে ও কোলে তুলে নিলো ও ইচ্ছেকে। ইচ্ছের বিস্ফোরিত‌ চাওনি। পাশে তাকিয়ে দেখে, পিয়ালী কপালে হাত রেখে চোখ আড়াল‌ করেছে নিজের। সাদিক সাহেব যেনো জীবনে প্রথমবার থেসিস ছেড়ে খাবার খেতে এতো মনোযোগী। কিছু বলে ওঠার আগেই প্রাপ্ত বললো,

-হ্যাঁ। আজ বরং নাইবা খেলে আমার বানানো খাবার। তোমাকে পানিশ করার অজুহাতের দরকার ছিলো আমার। আসছি বাবা। গুড নাইট।

প্রাপ্ত ওকে কোলে নিয়েই হাটা লাগালো। ওর গলা জরিয়ে রেখে চোখ খিচে বন্ধ করে‌ রইলো ইচ্ছে। ও এ বাসায় আসার পর থেকে এই ছেলে একটু বেশিই নির্লজ্জ হয়ে গেছে। নাকি বাবা-ছেলের সম্পর্ক এমনও হয়? সম্ভব? প্রাপ্ত রুমে এনে বিছানায় বসিয়ে দিলো ইচ্ছেকে। ইচ্ছে বললো,

-এটা কি হলো?

-পানিশমেন্টের ট্রেইলর। এবার পুরো পিকচার দেখাবো! আর ই‌উ‌ রেডি?

-আর ইউ ম্যাড? এভাবে বাবার সামনে…

-বাবাও এমনই ছিলো। তারও প্রেমের বিয়ে ছিলো!

-কিন্তু…

ইচ্ছে কিছু বলার আগেই আঙুল ছুইয়ের ওর ঠোট আটকে‌ দিলো। ঘোর লাগা চাওনি স্থির রেখে বললো,

-সারাদিন পর দেখছি তোমাকে রকস্টার ম্যাডাম। কোনো কথা হবে না!

ইচ্ছে বড়বড় চোখে তাকালো। প্রাপ্ত ওর সামনে বসেই মুখ এগোচ্ছিলো ওর দিকে। হঠাৎই টমির আওয়াজ শুনে থেমে গেলো। চোখ বন্ধ করে প্রচন্ড বিরক্তিতে বললো,

-বর-বউ রুমে থাকলে দরজায় নক করে আসতে হয়। তোমার সো কলড্ এজুকেটেড পেটকে শেখাও নি এই আদব?

ইচ্ছে হেসে দিলো। পাশে তাকিয়ে দেখে দরজায় সত্যিসত্যিই টমি দাড়িয়ে। প্রাপ্তর গলা জড়িয়ে ধরে মজা নিয়ে বললো,

-বউকে আদর করার সময় রুমের দরজা লক করতে হয়। এই রুল আপনি শেখেন নি মিস্টার গ্যাংস্টার?

প্রাপ্ত চোখ মেললো। রাজ্যের বিরক্তি ওর চেহারায়। বিছানা ছেড়ে ও এগোতে যাচ্ছিলো দরজা লক করবে বলে। মনেমনে তার আগে টমিকেও গোটাকয়েক কথা শোনাবে বলেও প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। কিন্তু ওকে বাহুডোর থেকে সরতে দিলো না ইচ্ছে। প্রাপ্তর কলার একহাতে চেপে ধরে রাখলো। আরেকহাতে পাশের দেয়ালে ঠেকানো গিটারটা উপরে তুলে ধরলো। কিঞ্চিত বিস্ময়ে প্রাপ্ত দেখতে লাগলো ওর কর্মকান্ড। গিটারটা একহাতে একদম দরজা বরাবর ধরে, নিজেদের টমির আড়াল করে নিলো ইচ্ছে। আরেকহাতে প্রাপ্তর চুল মুঠো করে নিয়ে, ঠোটে ছুইয়ে দিলো প্রাপ্তর ঠোট। বড়বড় দৃষ্টিতে সেকেন্ডদুই তাকিয়ে থেকে বাকা হাসলো প্রাপ্ত। ইচ্ছে সরে যেতেই গিটারের আড়াল থেকে উকি দিয়ে টমির দিকে তাকালো সরু চোখে। আঙুল ঘুরিয়ে ইশারায় বোঝালো, “ইউ টার্ন নাও টমি মিয়া। এখানে তোমার উপস্থিতি নট এলাউড!”

টমি আর দাড়ালো না। অলসের মতো পা ছুড়ে পেছনে ঘুরে হাটা লাগালো। ওর প্রস্থানে যেনো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে, “জাগ সুনা সুনা লাগে” দুজনের কান্ড দেখে শব্দ করে হেসে দিলো ইচ্ছে। প্রাপ্ত মুগ্ধচোখে তাকিয়ে রইলো ওর হাসির দিকে। ওর দিকে তাকিয়েই ঠোট কামড়ে হাত থেকে গিটারটা নামালো ইচ্ছে। মাথা নামিয়ে নিলো লাজুক চাওনিতে। জানে প্রাপ্ত ওর হাসিটাতে বরাবর দুর্বল। অঘটন ঘটতে খুব বেশি দেরি নেই এখন আর। ওর হাত ধরে ওকে জানালার সামনে এনে দাড় করালো প্রাপ্ত। জরিয়ে ধরলো পেছন থেকে। ঘাড়ের সবগুলো চুল সামনে দিয়ে ঠোট ছোয়ালো ইচ্ছের উন্মুক্ত কাধে। মৃদ্যু কেপে উঠলো ইচ্ছে। প্রাপ্ত ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,

-আমার একান্ত ইচ্ছেনদী আজীবন এমন চঞ্চল থাকুক। আজীবন এমন উত্তল থাকুক তার প্রেমজোয়ার নিয়ে। আমি আজীবন এভাবে তোমার ভালোবাসার গহীনে বাধা পরে থাকতে চাই ইচ্ছে। প্রেমনোঙর ফেলে! ভালোবাসি তোমাকে।

স্বস্তিতে প্রাপ্তর বুকে মাথা ঠেকালো ইচ্ছে। নিজেকে বড্ড সৌভাগ্যবতী মনে হয় ওর। সেদিনের পর একবারও ওর জীবনমৃত্যুর সন্ধির সে ভয়ানক মুহুর্ত মনে করতে দেয়নি প্রাপ্ত। শুধুই ভালোবেসেছে। ওই বুকজুড়ে ওর নামে স্বস্তি লেখা, শান্তি আঁকা। এতোগুলো দিন সে অনুভবেই তৃপ্ত ইচ্ছে। প্রতিবারের মতো নিজেকে আজও উজার করে দেবে ও প্রাপ্তর ভালোবাসায়। লুফে নেবে ওর সমস্ত শিহরনী ভালোবাসা। এমন প্রতিটা মাঝরাতের চাঁদ সাক্ষী থাকুক ওদের ভালোবাসার। রাতজাগা ডাহুক সাক্ষ্য দিক ওদের খুনশুটির। বাগানের প্রতিটা ফুল গল্প লিখুক, ওদের কাছে আসার। ভালোবাসা এমনই সুন্দরতম হোক। আর প্রেমজোয়ারে বাধা পরুক প্রতিটা উত্তল হৃদয়, প্রেমনোঙর ফেলে…

~সমাপ্ত🌸
]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here