#মধুবালা [১৪]
#ফারজানা_আক্তার
শুভ্র রেগে যাওয়ার আগেই নাজমা বেগম বলে উঠেন আবার “আমার ছেলের বউকে আমি নিজ হাতে বউ সাজাবো আজ। ছোঁয়া আয়তো মা আমার সাথে। বউ না সাজলে কি বিয়ের অনুভূতি আসে? বিয়ে যখন হবে তবে আমার বিয়ের শাড়ি দিয়েই আমার ছেলের বউ বধু সাঁজবে।”
এটা বলেই ছোঁয়াকে নিজের সাথে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন নাজমা বেগম। বেলাল মির্জা বাঁধা দিলেও উনি আজ কারো কথা শোনেননি। আনজুমা খাতুন তো রাগে দুঃখে নিজের রুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বড়দের কথা যদি কেউ না শোনে তবে বড়দের আর সেখানে থাকার কোনো প্রয়োজনই নেই তা আনজুমা খাতুন মনে করেন। বেলাল মির্জা গিয়ে কয়েকবার দরজায় শব্দ করতেই আনজুমা খাতুন দরজা খুলে দেন। নাজমা বেগমের সব রাগ তিনি এখন বেলাল মির্জার উপরই বের করবেন। বেলাল মির্জাও এবার বুঝেছে ছেলের কথা আজ না শুনলে চিরদিনের জন্য ছেলেকে হারাতে হবে তাই তিনি আনজুমা খাতুনকে বুঝাতে এসেছে। অনেক বুঝিয়ে বেলাল মির্জা আনজুমা খাতুনকে হলরুমে নিয়ে আসে।
লিলিও মায়ের সাথে ছোঁয়াকে তৈরি করতেছে। সোহা বাড়ির অন্য ছোট সদস্যদের সাথে বসে আছে। মান্নান মির্জা জীবন মির্জা সোফায় বসে আছেন কাজি সাহেবের সাথে। জায়েদা বেগম নিজের গলার গহনা এনেছেন ছোঁয়াকে পরানোর জন্য।
ছোঁয়া বারবার বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করছে সবাইকে কিন্তু কেউই ওর কথা শুনছেনা। ছোঁয়ার মনে ওর মায়ের কথাগুলো ঘুরছে। ওর মা যে বলেছে ওই বালাগুলো না ছোঁয়ার জন্য আর কিন্তু আজ বিয়ে হলে তো ওকে এগুলো পরতে হবে তাই সে কাচুমাচু করতেছে।
অবশেষে ছোঁয়াকে আনা হলো। শুভ্রর পাশে বসানো হলো ছোঁয়াকে। ছোঁয়া মাথা নিচু করে রেখেছে। কাজিকে বিয়ে পড়ানো শুরু করতে বলা হয়েছে তার মাঝেই ছোঁয়া বলে উঠলো ও শুভ্রর সাথে কিছু কথা বলতে চাই। সবাই অনুমতি দিলেন। কিন্তু বেলাল মির্জার একটাই কথা সবার সামনেই বলতে হবে যা বলার। শুভ্র কিছু বলতে চাইলেও ছোঁয়া দিলোনা ওকে ঝামেলা করতে আর। ছোঁয়া কয়েকটা ঢুক গিলে বলে “আম্মু আমাকে প্রমিজ করিয়েছে আমি যেনো ওই বালাজোড়া কখনোই স্পর্শ না করি তবে এটা লিলিকে বলার পর লিলি বলছে আম্মুর সাথে নাকি তোমার কথা হয়েছে। কি বলেছে আম্মু তোমায় বলবে প্লিজ?”
“তুই ছোট মেয়ে এতোকিছু জেনে কি করবি তুই?”
“ছোট হলে বিয়ে করছো কেনো?”
“বাচ্চাদের মতো কথা বলিসনা ছোঁয়া। আমার পরিশ্রমে পানি ঢালিস না।”
“আগে আম্মু কি বলছে শুনবো তারপর বিয়ে।”
“সবার সমানে না হলে বুঝিয়ে দিতাম এই শুভ্রর সাথে তর্ক করার ফল কি ও কত প্রকার। ”
একটু মিনমিনিয়ে বলে শুভ্র কথাটি। ছোঁয়া মুখ ভেং’চি কে’টে বলে “সিরিয়াসলি বলছি আমি আমার মাকে করা ওয়াদা ভা’ঙ’তে কিছুতেই পারবোনা। বিয়ে ক্যানচেল।”
এটা বলেই ছোঁয়া ওটে যেতে নিলে শুভ্র বলে আচ্ছা শোন।
ছোঁয়া বসে আবার। এবার শুভ্র কথা বলা শুরু করার আগেই লিলি বলে উঠে “হুম ভাইয়া তুমি তো নাকি সব জেনেছো। মেজু আম্মু নাকি তোমাকে সব বলেছে। বলো সবাইকে সব সত্যি, বলো সবাইকে ছোঁয়ার জন্ম পরিচয়। সত্যি টা না জানলে সবাই ছোঁয়াকে কথা শুনিয়ে যাবে সারাজীবন।”
এবার ছোঁয়াও বলে আবার জায়েদা বেগমও বলেন শুভ্রকে সব বলার জন্য। কারণ উনি কিছু জানেননা। উনার বিয়ে হয়েছে ছোঁয়া জন্মের তিনবছর পর। ছোঁয়ার সেজু চাচা চাচি সব জানেন কিন্তু উনারা এসবে কোনো কথা বলেননা যা হয় তা দেখেন শুধু চুপচাপ।
সবার রিকুয়েষ্টে শুভ্র সবটা বলার সিদ্ধান্তঃ নিলো। কারণ ছোঁয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে সবটা জানার।
“আসলে আমি ওইদিন রাতে টিয়া আর ওর মা বাবার কথা শোনে জানতে পেরেছি ছোঁয়ার জন্ম পরিচয়ে রহস্য আছে। বাড়ির বড় রা কিছু লুকিয়েছে আমাদের থেকে। তারপর আমি মেজু আম্মুর কাছে যায়। মেজু আম্মুর কাছে গিয়ে জানতে পারি যে শুধু আমরা ছোট রা না বরং ছোট চাচিও অজানা এই রহস্য থেকে। আমি জানতে পারি যে ছোঁয়া এই বংশেরই মেয়ে কিন্তু আমার আব্বু আর দাদি এই কথা কখনোই বিশ্বাস করেনি।”
কথাগুলো শুনেই ছোঁয়ার চোখ জলে টলমল করে উঠলো, মুহুর্তেই গড়িয়ে পরলো গাল বেয়ে নোনাজল। ছোঁয়া মনে করতো সবসময়ই ওর জন্ম পরিচয়ে হয়তো রহস্য আছে কোনো কিন্তু এটা যে সত্যি হয়ে যাবে তা কখনোই ভাবেনি ছোঁয়া। ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত কষ্ট অনুভব করলো শুভ্র।
এবার জায়েদা বেগম খুব উত্তেজনার সাথে শুভ্র কে বললো “বলো শুভ্র সব বলো। আমি আর পারছিনা অপেক্ষা করতে। ছোঁয়ার জন্ম পরিচয়ে কি এমন সত্যি যে সবাই আমার থেকেও লুকিয়েছে?”
“ছোট চাচিম্মু সত্যি টা জানলে হয়তো তুমিও আমার মধুবালাকে আর আদর করবেনা। মায়ের স্নেহে বুকে টেনে নিবেনা।”
ছোঁয়ার হেঁচকি উঠে গেলো এবার কাঁদতে কাঁদতে। এতটুকুও তো সে পারছেনা সহ্য করতে তবে সবটা কীভাবে করবে সহ্য? খুব যে কষ্ট হচ্ছে ছোঁয়ার এসব শোনে। বুকটা যেনো ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে। কেউ যেনো বুকের ভেতর চু’ড়ি দিয়ে আঘাত করছে অনবরত। পারছেনা কারো দিকে তাকানোর সাহস। অ’প’মা’ন লাগছে খুব।
সব নিরবতা ঠেলে শুভ্র উচ্চারণ করলো “ছোঁয়া ছোট চাচ্চুর মেয়ে। মেজু আম্মুর ছোট বোনের সাথে ছোট চাচ্চুর প্রেম ছিলো, দুজন দুজনকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। কিন্তু দাদি এক ঘরে দুই বোনকে কিছুতেই মেনে নিবেনা বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। এর মাঝেই ছোট চাচ্চু জানতে পারে ছোঁয়ার মা এই বালা জোড়ার জন্যই উনার সাথে সম্পর্ক করেছে তাই চাচ্চুও উনাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। আর এসব চলাকালের মধ্যেই ছোঁয়া ওই ভদ্রমহিলার গর্ভে আসেন। ছোট চাচ্চুকে উনি সাথে সাথেই বলেন এটা কিন্তু ছোট চাচ্চু রাগের মাথায় অস্বীকার করেন সবটা। তবে ওই ভদ্রমহিলার বালা জোড়ার প্রতি লোভ থাকলেও ছোট চাচ্চুকে তিনি একটু বেশিই ভালোবাসতেন।
পরে ছোঁয়ার জন্ম হওয়ার সময় অনেক কষ্ট পেয়ে ভদ্র মহিলা মা’রা যান। মেজু আম্মু সদ্য জন্ম নেয়া ছোঁয়াকে এই বাসায় এনে সবাইকে বলে দেন সব সত্যি। ছোট চাচ্চুও তখন নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং ছোঁয়াকে চান কিন্তু মেজু আম্মু উনার কাছে ছোঁয়াকে দেননি কারণ ছোট চাচ্চু সত্যিই অপরাধী। উনার কারণেই ছোঁয়ার মাকে সমাজের অপবাদ পেয়ে ম’র’তে হয়েছে।
এর মাঝে একটা সত্যি ছোট চাচ্চু কখনোই প্রকাশ করেননি যেটা মেজু আব্বু আর মেজু আম্মু ছাড়া আর কেউই জানতোনা।
পুরো পরিবার জানে ছোঁয়া ছোট চাচ্চু আর ওই ভদ্রমহিলার অবৈধ সন্তান কিন্তু এটা সত্যি নয়। ছোট আব্বু ছোঁয়ার আম্মুকে গোপনে বিয়ে করেছিলেন। দাদির ভয়ে ছোট আব্বু এটা বলতে পারেনি কাউকে এবং মেজু আম্মুকেও কসম দিয়েছিলেন যেনো এই সত্যি কাউকে না বলে।
শুনে রাখো সবাই আমার মধুবালা পবিত্র বন্ধনে জন্ম নিয়েছে। কেউ যদি আর ওর সাথে খারাপ আচরণ করেছো তো ছা’ড়’বো’না কাউকে আমি।”
শুভ্রর কথা শেষ হতে না হতেই ছোঁয়া এক ছুটে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
এ কোন সত্যি জানলো সে? কেনো এমন করলেন জীবন মির্জা ওর মায়ের সাথে? কেনো জন্মের সাথে সাথে নিজের মাকে হারাতে হলো ওর? কেনো সেলিনা পারভীন এতবছর কিছু বলেনি ওকে? কেনো কেনো কেনো হলো ওর সাথে এমন?
কোন পাপের শাস্তি ওকে দিলেন খোদা?
হাজার প্রশ্ন ছোঁয়ার মনজুড়ে। শুভ্র সহ সবাই দরজায় শব্দ করছে কিন্তু ছোঁয়া দরজা খুলছেনা। ভয় পেয়ে যাচ্ছে সবাই যত সময় যাচ্ছে। শুভ্র অনেকক্ষণ ধরে নক করতে করতে বিরক্ত হয়ে যায়। ভয় বাসা বাঁধে প্রাণ জুড়ে।
প্রায়ই ৩০মিনিট পর শুভ্র ছোঁয়ার রুমের বেলকনি দিয়ে প্রবেশ করে ওর রুমে।
শুভ্র আরেক ধা’ক্কা খাই ছোঁয়ার রুমে প্রবেশ করে। পুরো রুম অগোছালো ছোঁয়ার। রুমের কোথাও ছোঁয়া নেই। শুভ্র ওর রুমের ওয়াশরুমও চেক করে, সেখানেও ছোঁয়া নেই। মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বসে পরে এবার শুভ্র।
ছোঁয়া চলে গেছে, কিন্তু কোথায়?”
এরমাঝে সবাই ভুলে গেলেন জায়েদা বেগমের কথা। জায়েদা বেগম এখনো পর্যন্ত সেখানেই বসে আছেন আনমনা হয়ে। এমন সত্যির জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেননা।
#চলবে_ইনশাআল্লাহ