#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২১
নিচতলায় পুলিশ এসেছে। মেয়েরা সব আতংকিত চেহারা নিয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যদিও ইতোপূর্বে আরো একবার এই ব্রোথেলে পুলিশ এসেছিলো। কিন্তু নতুনদের কাছে এবারই প্রথম। তাই একটু বেশিই ভয় পাচ্ছে তাঁরা। পুলিশ এসেছিলো, প্রায় তিনচার বছর আগের ঘটনা। একটা নারীবাদী সংগঠন থেকে মামলা করা হয়েছিলো আরমানের বিরুদ্ধে। এরেস্ট ওয়ারেন্টও জারি হয়েছিলো কিন্তু শেষপর্যন্ত কোন লাভই হয় নি। পুলিশ আসার আগেই পালিয়েছিলো আরমান। এসব অপরাধীদের ইনফরমেশন দেওয়ার লোকের অভাব নেই। জায়গায় জায়গায় লোক ফিট করা থাকে তাদের। সময় মতন ফোন করে পুলিশ আসার খবরটা জানিয়ে দিয়েছিলো। এবারেও তাঁর ব্যতিক্রম হয় নি। পুলিশ আসার আগেই গোপন সূত্রে খবরটা পৌছে যায় আরমানের কানে। এবং আবারো পালায় সে। হাতে সময় খুব কম থাকায় মেয়েদের কাউকে সঙ্গে নিতে পারে নি। অবশ্য নেওয়ার বিশেষ প্রয়োজনও মনে করে নি। কি দরকার? শুধুশুধু সময় নষ্ট!
আপাতত কয়দিন গা ঢাকা দেওয়াটাই উত্তম। তারপর মোটা অংকের একটা অ্যামাউন্ট খরচ করতে পারলেই এসব পুলিশি ঝামেলা মেটানো তাঁর বাঁ হাতের খেল। এর আগেরবারও তাই করেছিলো। অবশ্য এবার যদিও শুরুতে মেয়েদেকে সাথে নিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছিলো কিন্তু সময় স্বল্পতার জন্য সেটা আর হয়ে উঠে নি।
এদিকে তাঁর খোঁজ না পেয়ে মেয়েদেরকে জেরা শুরু করে দিয়েছে পুলিশ। ঠিক জেরা অবশ্য নয়, ওদের নিজেদের সম্পর্কে টুকটাক কিছু প্রশ্ন। এই যেমনঃ কি করে ওরা এখানে এসেছে, কতবছর ধরে এখানে আছে, কতজন আছে এইসব টুকটাক প্রশ্ন।
মধুর ইনকয়্যারি শেষ হতেই বিরক্তমুখে উপরে উঠে গেলো সে। মনে মনে আশরাফির ওপর খুব রাগ হলো। এত অল্প সময়ে আরমানকে ধরার জন্য পুলিশ পাঠাবে আশরাফি একথা স্বপ্নেও ভাবে নি মধু! তারওপর নিজেও আসে নি। একটা ফোনও করে নি! রাগে, দুশ্চিন্তায় মুখ কালো হয়ে গেলো মধুর। যাওয়ার সময় আরমান বারবার করে শাসিয়ে গেছে আশরাফিকে সে ছাড়বে না। এর শেষে দেখে নেবে।
কিন্তু মধু তো জানে আশরাফি হাল ছাড়ার পাত্র নয়। একবার যখন স্থির করে নিয়েছে আরমানকে জেলে পাঠাবে তখন পাঠিয়েই ছাড়বে। কিন্তু এই চক্করে যে তাঁর নিজের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে সে কথাটা একবারও ভাবছে না। উপরন্তু মধুর নিষেদগুলোকেও হালকাভাবে নিচ্ছে।
তাই এতকিছুর পর টেনশনে আর নিজেক স্থির রাখতে পারলো না মধু! তাঁর জন্য আশরাফির কোন ক্ষতি হলে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করবে সে। এই কথাটা আশরাফি কেন বুঝতে চায় না? কেন নিজের বিপদের কথাটা একবারও ভাবছে না সে? পাশের পানির জগ থেকে ঢকঢক করে পানি খেলো মধু। তাড়াহুড়া করে আশরাফির নাম্বারে ডায়াল করলো।
★
মধুর ফোনে অপেক্ষাতেই ছিলো আশরাফি। রিং হতেই মুখ হাসি ফুটে উঠলো তাঁর। রিসিভ করে হাসিমুখে টেনে টেনে বললো,’হানিইই? সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম?’
রাগে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না মধু। সব ব্যপারে আশরাফির গোয়ার্তমি তাঁর একদমই পছন্দ নয়। মিনিট খানেক চুপ থেকেই তিক্ত কণ্ঠে বললো,’তুমি পুলিশ পাঠিয়েছো কেন?’
-‘সেটা তো তুমি ভালো করেই জানো!’
-‘এর ফলাফল কি হতে পারে একবারও ভেবে দেখেছো? আরমান তোমাকে ছেড়ে দেবে?’
-‘ওর কথা কে ভাবে? আমার বয়েই গেছে ওর কথা ভাবতে। আমি তো শুধু তোমার কথা ভাবছি। কবে তোমাকে ঐ নরক থেকে বের করে আনতে পারবো সেই কথা।’
-‘আমি তোমাকে কতবার বলেছি আমি ফিরবো না?’
-‘পাগলের কথা আমি কানে নেই না।’
-‘আমি পাগল?’ তেঁতে উঠলো মধু। আশরাফি ফোনের ওপাশ থেকে মিটিমিটি হাসলো। মধু না থেমেই বললো,’আমি মোটেও পাগল নই। আমি যা বলেছি একদম ঠিক বলেছি। পাগল তুমি! তুমি আমার কথাগুলো বুঝতে পারো নি।’
-‘বুঝতে যখন পারি নি, তখন ছেড়ে দাও না। কেন বারবার কানের কাছে একই কথা ঘ্যানঘ্যান করছো? নিজের ওপর বিশ্বাস নেই? না থাকলে এত বড়বড় কথা কিসের? কেন বাধা দিচ্ছো আমাকে? আমার যা মন চায় আমি তাই করবো।’
-‘ঠিক আছে। করো, তোমার যা মন চায় তাই করো। কিন্তু আমি যখন বলেছি আমি ফিরবো না তারমানে আমি ফিরবো না।’
-‘দেখাই যাক। কার দম কতদূর!’, খোঁচাটা হাসিমুখেই দিলো আশরাফির। মধু রাগে, অভিমানে দাঁতেদাঁত খিঁচে বললো,’তুমি প্রচন্ড নির্লজ্জ, বেহায়া, আত্মসম্মানহীন একজন মানুষ! তোমার মানসম্মান বলতে কিচ্ছু নেই। নতুবা এতবার করে বলার পরে আঠার মতন পেছনে লেগে থাকতে না! কি চাও টা কি তুমি? আমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাই?’
-‘যাওয়ার সময় আমাকে সঙ্গে নিলেই হবে।’, ওপাশ থেকে চাপা হাসির শব্দ শোনা গেলো আশরাফির!
-‘তোমার কি মনে হয় আমি তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করার জন্য ফোন করেছি?’
চুপ করে গেলো আশরাফি। ভদ্র ছেলের মত ফোনের ওপাশ থেকে মাথা দোলালো সে। মধু কিন্তু থেমে রইলো না। ফোনের ওপাশ থেকে রীতিমত ঝড় বইয়ে দিয়েছে সে। আশরাফি ফের হাসলো। এত অধিকার নিয়ে ঝাড়ি দেওয়ার ক্ষমতা তো কেবল মধুরই আছে! তাকে নিরুত্তর দেখে মেজাজ আরো চটে গেলো মধুর। ধমক দিয়ে বললো,’কথা বলছো না কেন?’
-‘কি বলবো?’,
‘আমার মাথা তোমার মুন্ডু!’ হাল ছেড়ে দিলো মেহের। আশরাফি কৃত্রিম অবাক হওয়ার ভান করে বললো,’তোমার মাথা আমার মুন্ডু হতে যাবে কেন? তোমার মাথা তোমার, আমার মাথা আমার! তোমার সিদ্ধান্ত তোমার, আমার ভালোবাসা আমার।’ মেহের হতাশ কন্ঠে বললো,’এমন নির্লজ্জ মানুষ আমি জীবনে দেখিনি!’
-‘দেখবে কি করে? আমাকে ছাড়া অন্যকারো দিকে নজর পড়ে নাকি তোমার? বুঝি, বুঝি আমি সবই বুঝি।’
-‘লজ্জা শরম সত্যিই নেই তোমার তাই না?’
-‘এভাবে কেন বলছো মেহের? একেবারেই যে লজ্জা নেই তা কিন্তু নয়। একটু হলেও বোধহয় আছে! ‘..
-‘চুপ! একদম চুপ।’ সজোরে ধমক দিলো মধু।
আশরাফি হাসলো। বললো,’সুযোগ পেয়ে খুব ধমকানো হচ্ছো আমাকে! যাকে ভালোবাসো না তাঁকে ধমকানোর অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে হ্যাঁ?’
থমকে গেলো মধু। এই কথাটা কি করে বলতে পারলো আশরাফি? মধু তাঁকে ভালো বাসে না? অতঃপর হতাশভাবে কিছুক্ষণ হাসলো। বললো,’যে তোমাকে ভালোবাসে না তাঁকে নিয়েই বা কিসের এত মাথাব্যথা তোমার?’
কথাটা অভিমানের। আশরাফি বুঝলো। মনে মনে হাসলো সে। ফিসফিস করে বলতে ইচ্ছে হলো,ভালো তুমি আমাকে বাসো মেহের! কিন্তু মুখে বলতে পারো না।’ বললো না। মুচকি হেসে বললো,’এতকিছু আমি জানি না। আমি
শুধু সুযোগের অপেক্ষায় আছি। কবে আমি সুযোগটা পাবো আর ভালো মতন তোমাকে একটা শিক্ষা দিতে পারবো যাতে তুমি দিনরাত চব্বিশঘন্টা, উঠতে বসতে কেবল আমার নাম জপ করবে!’
-‘সেই সুযোগ তোমার জীবনেও আসবে না। আরমানের ভাড়া করা গুন্ডারা যখন ধড় থেকে মুন্ডুটা আলাদা করে দেবে তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল!’
-‘কি বললে তুমি?’, ঠাট্টার সুরেই প্রশ্নটা করলো।
-‘কি বললাম?’, বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো মধু। আশরাফিকে কোনভাবেই সিরিয়াস করতে না পেরে মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে গিয়েছিলো তাঁর। শ্রুতিগোচর হতেই বুকটা ধক করে উঠলো। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। ঝোঁকের বশে ভয়ঙ্কর একটা অলক্ষুণে কথা বলে ফেলেছে সে! হতাশা, গ্লানিতে নিজের মাথার চুল টেনে ধরলো। চোখবন্ধ করে মিনতি ভরা কন্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো সে,’ইয়া আল্লাহ! কেন তুমি আমার মুখ দিয়ে এমন কথা বের করলে?’ অতঃপর চাপা কান্নায় ডুঁকরে উঠলো সে।
আশরাফি হো হো করে হেসে উঠে বললো,’মধুবালার হলোটা কি? সে কেন একটা আত্মসম্মানহীন, নির্লজ্জ, বেহায়া পুরুষ মানুষের জন্য কাঁদছে? হায়! অধমের বুঝি এত ক্ষমতা?’ মনে মনে বললো,’ঠিক হয়েছে। অনেক কষ্ট দিয়েছো আমাকে। এবার আমার জন্য একটু কাঁদো।’
মধুর ফোন ফেলে বালিশে মাথা ঠেকিয়ে হাউমাউ করে কান্নাজুড়ে দিলো। তাঁর মুখ থেকে কি করে এই অলক্ষুণে কথাটা বেরোলো? মনে মনে হাজার বার সৃষ্টিকর্তা কাছে মাফ চাইলো সে। অভিসম্পাত করলো নিজেকে। কিন্তু কান্না কিছুতেই থামলো না। আশরাফি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফোন কেটে দিলো। তারপর আবার কল ব্যাক করলো। ধরলো না মধু। যেমনি বসে ছিলো তেমনিভাবে চোখের জলে বিছানায় বালিশ ভিজিয়ে ফেললো। আবার ফোন দিলো আশরাফি। বেশ কিছুক্ষণ পর রিসিভ করলো মধু।
-‘কি ব্যপার? কথা বলছো না কেন?’
এতক্ষনেও কান্না থামে নি মধুর। উপরন্তু চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো বুক চিরে। ফুঁপিয়ে উঠলো সে। আশরাফি ইচ্ছাকৃত ভাবে তাঁকে ভয় দেখিয়ে বললো,’হায়! হায়! এবার কি হবে মেহের? তোমার কথাটা যদি সত্যি হয়ে যায়? সত্যি সত্যি যদি আমি মরে যাই?’
মধু জবাব না দিয়ে অসহায়ের মত ডুঁকরে উঠলো। আজ আর আশরাফির ঠাট্টা সইলো না! যত কঠিনই হোক, নারীহৃদয় বলে কথা। আকস্মিক ভয়টা কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারলো না সে। আশরাফির কথা শুনে কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো। কাঁদতেই বললো,’কক্ষনো না।’
আশরাফি কন্ঠস্বরে কৃত্রিম দুঃখভাব নিয়ে বললো,’হতেও তো পারে মেহের। মানুষের মৃত্যুর তো কোন বিশ্বাস নেই। এইজন্যে বলি চলো দুজনে সংসার করি। তারপর আর মরে গেলেও আফসোস থাকবে না!’
মধু কাঁদতে কাঁদতেই অনুনয় করে বললো,’দোহাই তোমার! আমার ভুল হয়ে গেছে। এমন কথা আমি আর কোনদিন বলবো না। এবার আমাকে একটু শান্তি দাও প্লিজ! আমি আর পারছি না!’
-‘শান্তি? শান্তি আশা তুমি ছেড়ে দাও । আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি শান্তিতে থাকবে এটা আমি কি করে মেনে নেবো? যত যাই করো না কেন আমার হাত থেকে তোমার নিস্তার নেই। এত সহজে তোমাকে আমি ছাড়ছি না।’ তারপর মধুর কিছু বলার অপেক্ষা না করেই ফোন রেখে দিলো সে। মধু ফোন রেখে আবারো বিছানায় লুটিয়ে পড়লো। অবরুদ্ধ ক্রন্দনে বুক ভেসে গেলো তাঁর। অদূরে দাঁড়িয়ে সবই দেখছিলো সুলেখা। সেও নিরবে অশ্রু বিসর্জন করে আড়ালে সরে গেলো।
★
দুদিন বাদের ঘটনা, দরজায় টোকার আওয়াজ শুনে ভেতর থেকে সাড়া দিলো মধু,’কে? ‘সদ্য গোসল সেরে নিজের ঘরে শাড়ি পরছিলো সে। মাথায় তোয়ালে প্যাঁচানো।
-‘আমি!’ হাসিমুখে জবাব দিলো আশরাফি।
ভেতরে ঢুকার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলো সে, মধু তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললো,’খবরদার এখন ভেতরে ঢুকবে না! আমি ব্যস্ত আছি।’
আশরাফি ভাবলো তার ওপর রাগ করে ‘না’ বলেছে মধু। তাই নিষেধ উপেক্ষা করে ভেতরে ঢুকে গেলো সে। কিন্তু ভেতরে ঢুকতেই হতবুদ্ধি! আকস্মিক লজ্জায় শরীরটা শিরশির করে উঠলো। উল্টোদিকে ঘুরে শাড়ি পরছে মধু। তাঁর শাড়ির আঁচল নিচে অবিন্যস্ত। তারওপর সবকিছু ছাপিয়ে আশরাফির নজর গিয়ে সোজা মধুর উন্মুক্ত ফর্সা কটিতে। মনোহারি এবং প্রচন্ড নেশাদায়ক! দ্রুত গলা খাঁকারি দিলো সে। ভূতগ্রস্তের ন্যায় চমকে উঠে পেছনে চাইলো মধু। অবাক হয়ে চেয়ে থেকে শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে এলোমেলো ভাবে গায়ে জড়ালো। মুখ ঘুরিয়ে নিলো আশরাফি। খাটের ওপর বসে গম্ভীরমুখে বললো,’এই অবেলায় গোসল করলে যে?’
বারণ করার পরেও ভেতরে ঢুকায় রাগ হলো মধুর। আশরাফির প্রশ্নটার জবাব বাঁকাভাবে দিয়ে বললো,’আমাদের আবার বেলা অবেলা কি?’
-‘আমাদের? আমাদের মানে? তুমি ঠিক কি মিন করতে চাইছো?’
-‘আমাদের মানে বোঝোনি? এখানে আমরা যেকজন মেয়ে আছি আমরা সবাই।’
আশরাফি ক্ষুব্ধ চোখে চাইলো। তাঁকে আঘাত করার জন্য প্রতিবারই ইচ্ছে করে এই কথাগুলো বলে মধু। জানে এসব কথায় কষ্ট পায় আশরাফি তবুও তাকে এসবই বলতে হবে। এবং প্রতিবারই এইধরণের কথাবার্তা শোনার পর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে আশরাফি।
আজকে অতিরিক্ত রাগে কোন কথা বলতে পারলো না। চুপচাপ বসে রইলো। মধু আঁচলটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে চোখে কাজল দিলো। ঠোঁটে হালকা করে একটু লিপস্টিক দিতেই প্রতিবাদ করে বললো,’এত সাজগোজ কিসের জন্য?’
-‘তোমার জন্য!’ মুখ টিপে হাসলো মধু। তার কন্ঠে ঠাট্টার সুর। এবার আশরাফির রাগত মুখে গাঢ় অভিমানের ছায়া নামলো! সত্যিই যদি তাঁর আর মেহেরর বিয়েটা হতো তাহলে নিশ্চয়ই তাঁরজন্যেই এমন করে সাজতো মধু। বিষণ্ণ কন্ঠে বললো,’আমার জন্য যে নয় সে আমি জানি। কিন্তু আগে তো এত সাজগোজ করতে দেখি মি। আজকে হঠাৎ দেখছি তাই জিজ্ঞেস করলাম।’
-‘বললাম তো তোমার জন্য।’, আবার মুখটিপে হাসলো মধু। তার ঠাট্টা গায়ে মাখলো না আশরাফি। বরাবরই তাঁকে আঘাত করে সুখ পায় মধু। আজকে আর এই নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে মন চাইলো না। তারওপর চোখে কাজল দেওয়াতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে মধুকে। তার কাজল চোখের মনি যেন আশরাফিকে উদ্দেশ্য করে আছে। মন্ত্রমুগ্ধের মত সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আশরাফি অনুরোধের সুরে বললো,’আমি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরি মেহের?’
-‘আমাদের জড়িয়ে ধরার জন্য পারমিশন লাগে না।
মেজাজটা আবার বিগড়ে গেলো আশরাফির। যতই ভাবে মধুর সঙ্গে আর খারাপ ব্যবহার করবে না ততই তাঁকে রাগানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে মধু। আশরাফির মনের অবস্থাটা একবারও বোঝার চেষ্টাই করে না। রাগত কন্ঠে বললো,’বেছে বেছে তোমার খারাপ কথাগুলো কেবল আমাকেই শোনাতে হবে?’
-‘হ্যাঁ। কারণ বেছে বেছে একমাত্র তুমিই পেছনে পড়ে আছো।’
-‘কি বলেছি আমি? সামান্য একটু জড়িয়ে ধরতেই তো চেয়েছি?’
-‘চাওয়াটাই তোমার ভুল হয়েছে। আমাদের কাছে কেউ চায় না। সবাই উশুল করে নেয়।’
রেগে গেলো আশরাফি। বললো,’বেশ পারমিশন যখন লাগে না। তাহলে আজকে আমার পাওনা আমি আদায় করে নেবো। অনেক সহ্য করেছি। এবার তোমার একটা শিক্ষা হওয়া দরকার।’ কথা শেষ করে সবেগে মধুর দিকে এগিয়ে গেলো সে। ক্ষিপ্তহস্তে শাড়ির আঁচল সমেত টান দিলো । ফলাফলস্বরুপ কাধের পিন আলগা হয়ে আঁচল খুলে গেলো। লজ্জা নিবারণের জন্য সঙ্গে সঙ্গেই আঁচল মুঠোয় চেপে ধরলো মধু। ভয়ার্ত বিস্ফোরিত নয়নে অবাক হয়ে বললো,’এসব কি ধরণের অসভ্যতা?’
আশরাফির রাগে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে হাতের মুঠোয় চেপে রাখা আঁচল পুনরায় টান দিয়ে মধুকে কাছে নিয়ে এলো। তাঁর ক্ষীণ কটিতে সজোরে বলপ্রয়োগ করে বললো,’সভ্যতা শেখাতে আমি এখানে আসি নি। অসভ্যতা করতে এসেছি। বলেছিলাম না আমি ভালোর সঙ্গে ভালো। খারাপের সঙ্গে খারাপ! তবুও কেন আমাকে রাগালে?’
মধুর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো সে। তাঁকে অবাক করে ফিক করে হেসে দিলো মধু। আশরাফি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। রাগে তাঁর গা দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে আর এইমুহূর্তে মধু হাসছে? কাঠ কাঠ গলা প্রশ্ন করলো সে,’হাসছো কেন?’
সহজে থামে না মধুর হাসি। হাসতে হাসতেই বললো,’তোমার ক্ষমতা আমার জানা আছে!’
ছেড়ে দিলো আশরাফি। ঠেলে সরিয়ে দিলো সামনে থেকে। আঘাত করলে যে কষ্ট পায় তাঁকে আঘাত করায় আনন্দ আছে,আত্মতৃপ্তি আছে কিন্তু যে নিজেই আঘাতকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায় তাঁকে কি করে আঘাত করা যায়? তথাপি নিজের ভাব বজায় রেখে বিড়বিড় করে বললো,’নির্লজ্জ! বেহায়া মেয়ে! ক্ষমতার কথা বলছে। ক্ষমতা যদি দেখাই তবে তোমার এই হাসি থাকবে?’
-‘সেকি তুমিই তো বললে? তোমার অধিকার, সরি পাওনা আদায় করে নেবে? তাহলে এখন কি হলো? সব রাগ ফুস হয়ে গেলো? ভীতু, হাদারাম!’
-‘ধ্যাৎ!’ রাগে মুখ বিকৃত করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো আশরাফি। তাঁর অক্ষমতা নিয়ে মধুর এমন নিষ্ঠুর পরিহাস সহ্য হলো না। সঙ্গে সঙ্গেই মধু দুহাত মেলে পথ আগলে দাঁড়ালো।’
পরিণাম তাঁর দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আশরাফি। সতর্ক করে দিয়ে বললো,’এবার কিন্তু মার খাবে মেহের! সরো সামনে থেকে!’
-‘সরবো না। দেখি কত সাহস তোমার? মারবে? মারো!’
আশরাফি হাতজোড় করে বললো,’ভুল হয়ে গেছে আমার। মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে আর কখনো এমন কথা বলবো না। তোমার কথাই ঠিক। আমি একটু ভীতু, হাদারাম। দয়া করে এবারেও মত রেহাই দাও!’
তাকে বেকায়দায় ফেলতে পেরে মধুর হাসি পূর্বের চাইতে প্রশস্ত হলো। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে দিয়ে বললো,’রাগের বহর দেখে হেসে বাঁচি না। পারলে তো এক্ষুনি আমাকে কাঁচা গিলে খাও সে কি আর আমি বুঝি না। মুখ দেখলেই সব বোঝা যায়!’
-‘তুমি আমার সামনে থেকে সরো। আমি বেরোবো।’
-‘তুমি সরাও। তবে সরবো।’
আশরাফি এগিয়ে গেলো তাঁকে সরানোর জন্য। কিন্তু মধুর মাথাও তো দুষ্টুমি চেপেছে। আশরাফি তাঁকে যেপাশে সরাতে যায় তাঁর উল্টোদিকে সরে সে। এভাবে বেশ কয়েকবার এপাশ ওপাশ শেষে বাধ্য হয়ে তাঁকে কোলে তুলে নিলো আশরাফি। বিছানার ওপর বসাতে গেলে তাঁর গলা চেপে ঝুলে রইলো মধু। নামাতে গেলে নামলো না! আশরাফি হেসে ফেললো। বললো,’হঠাৎ করেই এত মাখামাখি কিসের জন্য বলতো? উদ্দেশ্যটা কি?’ জবাবে মধু রহস্যজনক ভাবে হেসে বললো,’আছে আছে, কারণ আছে। বসো তুমি। বলছি।’
.
.#মধুবালা
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২২
নীলার বাবা জনাব রায়হান সাহেব খুব রুক্ষ মেজাজ নিয়ে আশরাফির সামনে বসে আছেন। উনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, পারলে এইমুহূর্তেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন আশরাফিকে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। এইমুহূর্তে আশরাফিকে বের করে দেওয়া মানে অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলা। সেটা তিনি করতে চাইছেন না। আবার মেজাজও শান্ত রাখতে পারছেন না।
আশরাফির নতমুখে বসে আছে। তার যা বলার ছিলো ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছে সে। রায়হান সাহেব হুঙ্কার দিয়ে বললেন,’আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশী সবাই জানে তোমার সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে আর তুমি এখন বলছো বিয়েটা করতে পারবে না? এটা কোন ধরনের তামাশা? আমার মেয়েকে কি ফেলনা পেয়েছো? তোমাকে আমি পুলিশে দেবো!’
-‘আপনি চাইলে আমাকে পুলিশে দিতেই পারেন কিন্তু তাতে তো আর আপনার মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়ে যাবে না?’ নতমুখেই জবাবটা দিলো আশরাফি।
রায়হান সাহেব সপাটে চড় তুলে এগিয়ে এলেন তাঁর দিকে। ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললেন,’তুমি আমার মেয়ের শিক্ষক না হলে এইমুহূর্তে চড়িয়ে তোমার গাল লাল করে দিতাম। অসভ্য, ইতর, বেয়াদব ছেলে! বিয়ে কি মশকরা? যখন খুশি হলো রাজি হবে আবার যখন খুশি বারণ করে দেবে! আমার মেয়ের কোন মানসম্মান নেই?’
আশরাফি চুপচাপ বসে রইলো। বিন্দুমাত্রেও প্রতিবাদ করলো না। পেছন থেকে নীলার গলা শুনে চমকে উঠলেন রায়হান সাহেব। অশ্রুসজল চোখে করুণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর আদরের মেয়েটা। বাবা হয়ে এই দৃশ্য সহ্য করার মতন মানুষ তিনি নন। অতএব ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললেন,’জালিয়াত টা কি বলছে শোন? বলছে তোকে নাকি বিয়ে করতে পারবে না। এত সোজা? আমি ছেড়ে দেবো? আমিও দেখবো কি করে বিয়ে না করে? আমার মেয়ের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে আমি চুপ করে থাকবো এটা তো হতে পারে না!’
আড়াল থেকে আশরাফির কথাগুলো সবই শুনেছে নীলা। চোখের পানি মুছে মলিন কন্ঠে বললো,’তুমি একটু ভেতরে যাও বাবা। আমি উনার সঙ্গে একটু কথা বলবো!’
রায়হান সাহেব অবাক হয়ে মেয়ের দিকে চাইলেন। প্রতিবাদ করে উঠে বললেন,’কোন কথা বলার দরকার নেই। যা বলার আমি বলবো।’
-‘প্লিজ বাবা।’, অনুনয় করলো নীলা।
মেয়ের অনুরোধে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভেতরে চলে গেলেন রায়হান সাহেব। নীলা আশরাফির মুখোমুখি গিয়ে বসলো। তাঁর চোখের দিকে তাকানোর সাহস হলো না আশরাফির। অপরাধীর মত মাথা নিচু করে মেঝের দিকে চেয়ে রইলো সে। নীলা বৃথা হাসার চেষ্টা করে বললো,’কেমন আছেন আপনি?’
-‘ভালো।’
-‘মেহের? তিনি কেমন আছেন?’
মুখ তুলে চাইলো আশরাফি। তার চোখেমুখে বিস্ময়! ক্ষণকাল স্তব্ধ থেকে বললো,’ও ভালোই আছে।’
নীলা কান্না চাপতে নিচের ঠোঁটে কামড়ে ধরলো। কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বললো,’তিনি কি আপনার কাছে ফিরে আসতে রাজি হয়েছেন?’
-‘না।’
নীলা যেন এই উত্তরটার অপেক্ষাতেই ছিলো। তাড়াহুড়ো করে বললো,’তবে?’
-‘আমার ধারণা আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে বলেই মেহের রাজি হচ্ছে না। ও খুবই চাপা স্বভাবের। নিজের কষ্টের কথা কখনো মুখ ফুটে বলে না।’
নীলা অসহায়ের মত চেয়ে থেকে বললো,’সমস্তটাই তো আপনার অনুমান? এর বিপরীতটাও তো হতে পারে।’
★
দুদিন আগের ঘটনা, মধুর ওপর রাগ করে বেরিয়ে আসার সময় আশরাফির হাত চেপে ধরলো মধু। তাঁকে অবাক করে দিয়ে বললো,’আমাকে রেখেই যাবে?’
হতবিহ্বল হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে রইলো আশরাফি। মধুর মুখে মিটিমিটি হাসি। বললো,’কি হলো?’
আশরাফির ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলো না। মধু কি ঠাট্টা করছে নাকি সত্যি? বললো,’কি?’
-‘কি আবার? যাওয়ার কথা বলেছি?’
আশরাফি তখনো বিশ্বাস করতে পারছিলো না। ফ্যালফ্যাল করে মধুর দিকে চেয়ে রইলো সে।
মধু দুপা এগিয়ে গেলো তাঁর দিকে। দুহাতে আশরাফির গলা জড়িয়ে ধরে বললো,’সত্যি বলছি আমি যাবো। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে!’
-‘কি?’
-‘আমি একা যাবো না।’
-‘মানে?’
-‘মানে এখানকার যত মেয়ে আছে সবার একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ওরা আমাকে মা ডাকে। ওদের একা ফেলে আমি যাই কি করে?’
আশরাফি হাসলো। বললো,’আরমানের বিরুদ্ধে যেই মামলাটা করা হয়েছে তাতে আমার সাথে কিছু নারীবাদী সংগঠনও যুক্ত আছে। বাড়িটা সরকার সিল করে দেওয়ার পর এখানকার সব মেয়েদের কর্মসংস্থানের দায়িত্ব ওরাই নেবে বলেছে।’
-‘কিন্তু আমার আরো একটা শর্ত আছে।’
-‘বলো।’
-‘তুমি নীলাকে বিয়ে করবে। আমি আমার মত করে নিজের ব্যবস্থা করে নেবো।’
এতক্ষনে মধুর রাজি হওয়ার আসল কারণটা বুঝতে পারলো আশরাফি। হাসিহাসি মুখটা কালো হয়ে গেলো তাঁর। তাঁর গলা জড়িয়ে রাখা মধুর হাত দুখানা সরিয়ে দিলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,’সম্ভব না!’
-‘আমার জন্যেও নয়? তুমি তো বলছিলে আমি এখান থেকে বেরোলেই তোমার সমস্ত দুঃখ দূর হয়ে যাবে। সেজন্যই তো আমি রাজি হয়েছি। কিন্তু এখন তুমি বলছো সম্ভব না? কেন? তারমানে তোমার মূল উদ্দেশ্য আমাকে এখান থেকে বের করা নয়? আমাকে নিজের করে পাওয়া? ‘
আশরাফি বুঝলো তাঁর কথার জালে তাকে ফাঁসিয়েছে মধু। হতাশ কন্ঠে বললো,’কেন আমার ভালোবাসার কোন মূল্য তোমার কাছে নেই মেহের? কেন তুমি বারবার আমাকে এভাবে অপমান করো?’
মনে মনে সব বুঝলেও কৃত্রিম রেগে যাওয়ার ভান করলো মধু। গম্ভীর গলায় বললো,’সব তো তোমার ইচ্ছেমত হতে পারে না। কেন তোমার জন্য সারাজীবন লোকের কাছে আমাকে খোঁটা শুনবো? এখানে সবাই পতিতা কেউ কাউকে ছোট করে না। কিন্তু বাইরের জগৎ। আলাদা। সেখানে সবাই প্রতিনিয়ত তোমার সঙ্গে আমার তুলনা করবে। পদে পদে আমাকে শুনতে হবে তুমি বড়! তুমি মহান। আমি তোমার চাইতে অনেক বেশি নীচ, হীন। কেন আমি এসব সহ্য করবো? নিজের ইচ্ছেতে তো আমি এখান থেকে যেতে চাইছি না? তুমি বাধ্য করছো। তাই আমি চাইনা কেউ তোমার জন্য আমাকে কথা শোনাক।’
-‘কেউ তোমাকে কথা শোনাবে না মেহের। আমি তোমাকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাবো।’
-‘কেন? কেন আমি সারাজীবন এভাবে পালিয়ে পালিয়ে বাঁচবো?’
আশরাফি এগিয়ে গেলো মধুর কাছে। বললো,’তবে তুমিই বলে দাও আমি কি করবো?’
-‘নীলাকে বিয়ে করো। তুমিও শান্তিতে থাকতে পারবে। আমিও নিজের মত করে থাকতে পারবো।’
তাঁকে ছেড়ে দিলো আশরাফি। অভিমানী কন্ঠে বললো,’তুমি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছো মেহের। এরজন্য হয়ত একদিন তোমাকে পস্তাতে হবে।’ কথা শেষ করে আর একমুহূর্তও দাঁড়ালো না সে। গটগট করে বেরিয়ে গেলো। মধু মূর্তির মতন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এরপর আর কি দিয়ে আশরাফিকে বোঝাবে সে? এতকিছুর পরেও ঘুরেফিরে বারবার তাঁর কাছে আসে মানুষটা। আর কতদুঃখ দেওয়া যায় একটা মানুষকে! এবার না ফিরলে যে অন্যায় হয়ে যাবে!
★
বসে বসে পুরোনো কথাগুলো ভাবছিলো আশরাফি। তাঁকে নিরুত্তর দেখে পুনরায় প্রশ্ন করলো নীলা,’কি হলো চুপ করে আছেন যে? কেন আপনার মনে হচ্ছে বিয়েটা ভেঙ্গে দিলেই উনি আপনার কাছে ফিরবেন?’
-‘কারণ শেষবার তাঁর সঙ্গে যখন দেখা করতে গিয়েছিলাম ও আমাকে খুব ফোর্স করেছিলো তোমাকে বিয়ে করার জন্য। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করেছিলো। ‘
-‘তাতে কি হয়েছে? এতে কি কোনভাবে প্রমাণ হয় যে উনি এখনো আপনাকে ভালোবাসেন ? শুধুমাত্র অনুমানের ওপর ভিত্তি করে আপনি বিয়ে ভাংতে চলে এলেন? কেন? হতেও তো পারে সত্যিই আপনার প্রতি উনার আর কোন ফিলিংস নেই? আপনি না বুঝে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছেন?’
-‘তুমিও তো অনুমান করেই বলছো নীলা? এও তো হতে পারে তোমার কথা গুলো ভুল। আমার ধারণাটাই সঠিক?’
নীলা সম্মতিসূচক মাথা দোলালো। সে জানে তাঁর কথাগুলো সত্যি মিনতিভরা কণ্ঠে বললো,’কিন্তু আমরা কেন এসব হতে পারে নিয়ে বসে আছি বলুন তো? যে আপনাকে চায় না আপনি কেন তাঁর পিছনে পড়ে আছেন? যে আপনাকে চায় আপনি তাঁকে গ্রহণ করুন!’ বলতে বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো নীলা। ইউনিভার্সিটির গুরুগম্ভীর প্রকৃতির স্যারের তাঁর প্রতি ক্ষনিকের ভালোলাগাটুকু যে দিনে দিনে এতটা কঠিন ভালোবাসায় রূপ নেবে সে নিজেও বুঝতে পারে নি। কিন্তু এখন আর ফিরে আসার পথ নেই। মনপ্রাণ দিয়ে মানুষটাকে ভালোবাসে সে। তাই নিজের আসন্ন দুরবস্থার কথা ভেবে কিছুতেই কান্না চেপে রাখতে পারলো না সে। ছোট শিশুদের মত কান্না জুড়ে দিলো।
আশরাফির দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কষ্ট হচ্ছে তাঁর। মেয়েটাকে অনেক বেশি দুঃখ দিচ্ছে সে। নরম গলায় বললো,’আমি তোমার ভালোবাসাকে শ্রদ্ধা করি নীলা। আমি এও জানি তোমার চাওয়াটা ভুল নয়। কিন্তু আমি নিরুপায়! সব দোষ আমার। আমি অক্ষম। আমি মতিচ্ছন্ন নতুবা তোমার পাহাড়সম ভালোবাসা কেন আমি গ্রহণ করতে পারছি না। মেহের সত্যিই আমার বুদ্ধিভ্রষ্ট করে দিয়েছে। নিজেকে সত্যিই খুব নগণ্য মনে হচ্ছে!’
নীলা চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললো,’আপনার কোন দোষ নেই জেনেও শুধুমাত্র আমার কাছ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কেন নিজের ঘাড়ে সব দোষ চাপাচ্ছেন বলুন তো? আপনি নিজেও জানেন দোষটা আসলে কার।আমার ভালোবাসাটা কতটা একতরফা। কোনদিন, কোন একমুহূর্তের জন্যেও আপনি আমাকে ভালোবাসেন নি। আমার ভালোবাসায় সাড়া দেন নি। অথচ তারপরেও আমি নিষ্ঠার সাথে ভালোবেসে গেছি আপনাকে। আমিই ভুল!’ ফের কেঁদে ফেললো নীলা। কষ্টে তাঁর বুকটা ফেটে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটা মানুষ কি করে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে?
নীলার চোখের পানি বাস্তবিক বড় পীড়া দিচ্ছিলো আশরাফিকে। কোথাও যেন মনে হচ্ছিলো মেয়েটার সাথে অন্যায় করছে সে। নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। বললো,’আমি আসি নীলা। ভালো থেকো তুমি!’
নীলা জবাব দিলো না। যেমনি বসে ছিলো তেমনি বসে রইলো। আশরাফি বেরিয়ে যাচ্ছিলো, ঠিক তখনি সিংহের ন্যায় গর্জন করে উঠলেন রায়হান সাহেব। বাসার ভৃত্যকে নির্দেশ দিলেন গেটে তালা দেওয়ার জন্য। আজ! এইমুহূর্তেই আশরাফির সঙ্গে নীলার বিয়ে দেবেন তিনি। কারো কথা শুনবেন না।
নির্দেশ দেওয়ার পর আর একমুহূর্তও দেরী হলো না। সঙ্গে সঙ্গেই তালা পড়ে গেলো গেটে। আশরাফি বিস্ফোরিত নয়নে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। রায়হান সাহেব কাজি ডাকতে লোক পাঠিয়েছেন। তার মেয়েকে তিনি কিছুতেই কষ্ট পেতে দেবেন না। বুঝিয়ে কাজ না হলে বলপ্রয়োগ আসল অস্ত্র!
নীলা মেঝেতে বসে সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে মূর্তির মত বসে ছিলো। আশরাফির তারপাশে গিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বললো,’তোমার বাবা এসব কি করছেন নীলা? তুমি উনাকে বারণ করো। আমি কিছুতেই তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না।’
নীলা টুঁশব্দটিও করলো না। মাথা নিচু করে রাখায় তাঁর মুখ দেখতে পাচ্ছেনা আশরাফি। পুনরায় অসহায় কন্ঠে বললো,’প্লিজ নীলা। তুমি তোমার বাবাকে বোঝাও। তিনি আমাকে যা শাস্তি দেবেন আমি মাথা পেতে নেবো কিন্তু বিয়ে আমি করতে পারবো না।’ তথাপি কোন জবাব এলো না নীলার। উপুড় হয়ে পড়ে রইলো সে। রায়হান সাহেব আড়চোখে সবই দেখছিলেন। কাছে এসে মেয়ের মাথা হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বললেন,’ওঠ মা তৈরী হয়ে নে। আমি কাজি ডাকতে লোক পাঠিয়েছি।’
অনেকক্ষণ বাদে ধীরে ধীরে মাথা তুললো নীলা। করুণমুখে বাবার দিকে চাইলো। রায়হান সাহেব হাসলেন। বললেন,’আমার মেয়ের খুশির জন্য আমি সব করতে পারি। তোর কোন ভয় নেই মা!’ বাবা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো নীলা। পাশে বসে থাকা আশরাফির উপস্থিতি যেন সম্পূর্ণ উপেক্ষিত! অতঃপর আশরাফিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তৈরী হতে চলে গেলো সে। অবাক হয়ে চেয়ে রইলো আশরাফির। উত্তেজনায় মাথা কাজ করছে না তাঁর। কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে। নীলা কি করে এমন করতে পারে? তাঁর কেবলই মনে হচ্ছিলো স্বপ্ন দেখছে সে! দুঃস্বপ্ন! ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন।
মিনিট দশেক বাদেই উপরতলা থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা গেলো। রায়হান সাহেব এবং তাঁর স্ত্রীর নীলার নাম ধরে চিৎকার করে কাঁদছেন। ভৃত্যরা সব দৌড়াদৌড়ি করছে। ঘাবড়ে গেলো আশরাফি! বুকের ভেতর অশনি সংকেত বেজে উঠলো! নীলা কিছু করে বসে নি তো? কি হয়েছে সেটা দেখার জন্য দ্রুত উপরে গেলো সে।
.
.
.
চলবে
(আর দুতিনটা পর্বেই শেষ করে দেবো ইনশাল্লাহ।
.
চলবে