মেঘের পরে মেঘ -১৯
“রুপসা আমি যাচ্ছি। দরজা টা লাগিয়ে দে।”
শায়েরী স্কুলে যাওয়ার জন্য একেবারে তৈরি হয়ে নিয়েছে।আজ থেকে স্কুলে প্রি-টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে।তাই একটু আগেই রওনা হওয়া দরকার।কিছু ফর্মালিটিজ আছে তা সারতে হবে।প্রতিদিন এ সময়ে রুপসা কলেজে গেলেও আজ যায় নি।শরীর না কি ভালো লাগছে না।শায়েরীও জোর করেনি।সেই এক্সিডেন্ট এর পর থেকে মাঝে মাঝেই এমন করে রুপসা।কিছুই যেন ভালো লাগে না ওর।
শায়েরী বুঝতে পারে।যদি এ সময়টাতে মেয়ে টাকে একটু বেশি সময় দেয়া যেতো তবে ভালো হতো।
কিন্তু সে উপায় নেই একদমই।জীবনযুদ্ধে নেমে এরকম চাহিদার বিলাসিতা একদমই মানায় না।
পরের চাকুরী করে নিজের মনমতো চলা অসম্ভব।
এই তো কিছুদিন আগেই প্রায় দিন বিশেকের ছুটি কাটিয়েছে।এখন তো কোনক্রমেই ছুটি পাওয়া যাবে না।যে সমস্ত কাজ পেন্ডিং ছিলো সেগুলোকেও কমপ্লিট করতে হচ্ছে। সবমিলিয়ে দম ছাড়বারও ফুরসত নেই।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে,বেরিয়ে গেলো শায়েরী।
শায়েরী বেরিয়ে যেতেই রুপসা ফোঁস করে দম ছাড়লো।
যাক বাবা, বাঁচা গেছে।এখন একটু নিজের মতো করে সময় কাটানো যাবে।মায়ের সামনে মন খারাপ করেও থাকা যায় না।এটা সেটা জিজ্ঞেস করতেই থাকে।তাই শরীর খারাপের কথা বলে কাটিয়ে নিয়েছে। শরীর খারাপ তো একটা নিছক অজুহাত। আসল কথা হলো,কাল কলেজ থেকে ফেরার সময় প্রলয় কে দেখেছে ওদের বারান্দায়।
তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওর সামনে পরবে না।দরকার হলে কয়েকদিন কলেজেই যাবে না।নিজের মনে যে ওর জন্য জায়গা তৈরি হয়েছে সেটা এখনি বুঝতে দেয়া যাবে না।
তাহলে হয়তো ওকে খারাপ মেয়েও ভাবতে পারে।ভাবতে পারে এক চুমুতেই ফিদা হয়ে গেছে রুপসা।
না, রুপসা এতো সস্তা না।প্রলয় তো বলে গেছে ও আর আসবে না।
যদি ও নিজে থেকে না আগায় তবে রুপসাও এগোবে না।থাক না, কিছু অনুভূতি মনের কোনের গহীন ঘরে।
একদমই নিজের হয়ে।
বারান্দার গাছ গুলোকে পানি দিয়ে ঘরটাকে গুছিয়ে নিলো রুপসা।গ্যাসের চুলায় চায়ের পানি চড়িয়ে ধুয়ে রাখা কাপড় গুলোকে ছাঁদে শুকোতে দিয়ে আসলো।বেশিসময় থাকলো না, যদি প্রলয় চলে আসে এই ভয়ে কোনরকমে চলে আসলো।
চা টা বানিয়ে কাপ নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো রুপসা।চা খেতে খেতেই আনমনে নিচের দিকে তাকালো। আর তাতেই চমকে উঠলো,প্রলয় দাঁড়িয়ে আছে। কালো জিন্স আর সাদা শার্ট গায়ে।একদম ফর্মাল লুক।কোথাও যাচ্ছে বোধহয়। সাথে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। দুজন কথা বলতে বলতেই একটা রিকশায় উঠলো।রিকশা চলতে শুরু করলো আর তখনি প্রলয় উপরে তাকালো।
যেন ও জানতো সেখানে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।
রুপসা দ্রুত নিজেকে আড়াল করে ফেললো।
হঠাৎ নড়েচড়ে উঠার কারনে কাপের চা ছলকে ওর জামায় পরে গেলো বেশ খানিকটা জুড়ে।
কাপটা এক পাশে রেখে রুপসা ওয়াশরুমে দৌড় দিলো। এখনি ধুয়ে ফেলতে হবে নাহয় দাগ লেগে থাকবে।
জামাটা ধুয়ে দিয়ে অন্য জামা পরতে গিয়ে মনে হলো,
একবারেই গোসল করে নেয়।ভিজেই যখন গেছে, তখন গোসল করলেই ভালো হবে।
ভাবনা মতোই কাজ করলো রুপসা।গোসল সেড়ে ভিজে চুল ঝাড়তে গিয়ে শুনলো দরজায় টোকা পরছে।রুপসা তোয়ালে টা মেলে দিয়ে দরজার দিকে এগুলো।কে এলো এ সময়?
ময়লাওয়ালা হবে হয়তো।লোকটা বেশিরভাগই এ সময়টাতে আসে।
রুপসা দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে গেলো। প্রলয় দাঁড়িয়ে আছে।রুপসা হা হয়ে তাকিয়ে রইলো।প্রলয় এখানে কিভাবে? ও না কোথায় গেলো একটু আগে?না কি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে ওর?হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না।এখন তো প্রায় সব জায়গায়, সব চিন্তায় এই লোক টা মাথা চেপে বসে আছে।চোখ কচলে আরও একটু ভালো করে তাকালো রুপসা।
রুপসার এমন ছেলেমানুষী দেখে হেসে ফেললো প্রলয়।ভেজা চুলে মারাত্নক লাগছে মেয়েটাকে।একটুখানি ছুয়ে দিতে মন চাইছে। কিন্তু সাথে সাথেই মনকে রাশ টানলো প্রলয়।এমন ভয়ংকর ইচ্ছে জাগাও ভয়ংকর।
শান্ত চোখে রুপসার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভেতরে আসতে বলবে না?না বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে?”
“আপনি সত্যিই এসেছেন?”
হালকা আওয়াজে বললো রুপসা।
“সত্যিই এসেছি।মিথ্যে মিথ্যে আবার আসা যায় না কি?এবার একটু সরো তো, ভেতরে ঢুকবো।”
রুপসা পুতুলের মতো একপাশে সরে গেলো। প্রলয় চির পরিচিতের মতো ঘরে ঢুকলো।চারপাশে নজর বুলাতে থাকলো।এরপর সোফায় বসে রুপসার কাছে এক গ্লাস পানি চাইলো।এতক্ষনে রুপসার মনে হলো সে যা দেখছে সত্যিই দেখছে।কোন ভ্রম নয়।প্রলয় ওর ঘরে বসে আছে আর ওর কাছে পানি চাইছে।
বুকে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেলো রুপসার।নিজের জায়গা থেকে নড়ার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললো মুহূর্তেই।
প্রলয় নির্বিকার ভাবে আবার বললো,
“এক গ্লাস পানি কি পাবো না?কখন চাইলাম।”
“আনছি।”
শরীরের সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে বললো রুপসা।জগ থেকে পানি ঢেলে গ্লাস টা প্রলয়ের সামনে বাড়িয়ে দিলো।হাত কাঁপছে ঠকঠক করে সাথে পানির গ্লাসও।
প্রলয় হাত বাড়িয়ে গ্লাস টা নিলো।সেই সাথে রুপসার আঙুলগুলোকেও একটু ছুয়ে দিলো আলতো করে। রুপসা এতেও কেঁপে উঠলো।
পানি টুকু পান করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো প্রলয়।
“যাক,এতোক্ষনে মন টা ঠান্ডা হলো।”
রুপসা ধীরে ধীরে নিজের রুমের দিকে এগুতে গেলে ধমকে উঠলো প্রলয়।
“কোথায় যাও ওদিকে?”
“কোথাও না।”
মাথানিচু করে বললো রুপসা।
“এদিকে এসে এখানে বসো।”
রুপসা কথা বাড়ালো না।একটু দুরত্ব নিয়ে পাশের সোফাটায় গিয়ে বসলো। বসেও যেন নিস্তার নেই রুপসার।প্রলয় যে ওর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেটা ও না তাকিয়েও বুঝতে পারছে।বুকে কাঁপন ধরে যাচ্ছে।সেই কাঁপন শরীরেও স্থানান্তরিত হচ্ছে। বারেবারে শুধু সেদিনের কথাই মনে হচ্ছে। আর লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে।
“থ্যাংক ইউ রুপসা।”
রুপসা অবাক হলো।হঠাৎ ধন্যবাদ কিসের জন্য?
“কেন?”
“তুমি যে আমাকে নিয়ে ভেবেছো এবং আলটিমেটলি আমাকে ভালোবেসেছো সে জন্য। ”
রুপসা হতবাক।এ কথা তো উনার জানার কথা না।মুখে বললো,
“কি বলছেন আবোলতাবোল? আমি কেন….
” আমাকে ভালোবাসবে।তাই না?”
রুপসার কথা শেষ করার আগে প্রলয়ই বলে দিলো।
“তুমি স্বীকার করছো না তো এখন? ঠিক আছে।করাচ্ছি। ”
মোবাইলটা হাতে নিয়ে একটা অডিও ক্লিপ চালু করলো প্রলয়।অডিও টা সেদিনকার রুপসা আর মনিকার কথোপকথন। রুপসা হা হয়ে গেলো। পরমুহূর্তেই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। নিজের দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে যাওয়াতে কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো।
অডিও টা বন্ধ করে রুপসার কাছে আসলো প্রলয়।একটু দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো।
“লজ্জা পাচ্ছো কেন?এতে লজ্জার কিছু নেই।কাউকে ভালোবাসা তো অপরাধ না।আর আমি খুব খুশি এটা জেনে।”
রুপসার মনে হলো এই লোকটা ওকে লজ্জায় পুড়িয়েই মারবে।দু’হাতে মুখ ঢেকে নিলো রুপসা।কেন যেন কেঁদেই দিলো।ঝরঝর করে চোখের পানিরা পরতে লাগলো।কোন রকমে বললো,
“খুশি হয়েছেন।এবার যান প্লিজ। ”
“যাবো তো।”
বলেই খেয়াল হলো রুপসার কন্ঠ বদলে গেছে।কাঁদছে না কি?হ্যাঁ কাঁদছেই তো।
“তুমি কাঁদছো কেন?”
“কাঁদবো কেন?”
“কাঁদছোই তো।আবার বলছো কাঁদছো না।”
আসলে রুপসা কাঁদছে ধরা পরে গিয়েছে বলে।এভাবে হাঁটে হাড়ি ভেঙে দিবে প্রলয় তা তো ও ভাবতেই পারেনি।লজ্জায় লুকোনোর পথ না পেয়ে কেঁদেই ফেলেছে।
“আচ্ছা কাঁদছি।সুখে কাঁদছি।আনন্দে কাঁদছি।হয়েছে? এবার যান।”
“আর কখনো কাঁদবে না।তুমি আবার আমার সামনে কাঁদলে কিন্তু সেদিনের মতো খবর নেবো।”
ওয়ার্নিং দিয়ে বললো প্রলয়।
প্রলয়ের কথায় আরো কুঁকড়ে গেলো রুপসা।
নিজের চোখ মুছে বললো,
“দেখুন আমি কাঁদছি না।এবার যান প্লিজ। কেউ দেখে ফেললে কি ভাববে?”
“আমি কি নতুন এলাম তোমাদের এখানে?তুমি যখন অসুস্থ ছিলে, তখন তো কতো এসেছি।অনেকেই দেখেছে।তো কি হয়েছে? ”
“তখনকার কথা আর এখনকার কথা এক না।তখন একজন রোগী কে দেখতে এসেছেন।আর এখন আমি সুস্থ। বুঝতে চেষ্টা করুন।”
রুপসার এতো কাকুতি মিনতিতে প্রলয়ের মাথায় দুস্টুবুদ্ধি খেলে গেলো।ইচ্ছে করেই আর একটু জালালো রুপসাকে।
“ঠিক আছে চলে যাবো এখনি।কিন্তু তার আগে একবার সরাসরি শুনতে চাই।”
“কি?”
মুখের দিকে না তাকিয়েই বললো রুপসা।
“তুমি আমাকে ভালোবাসো।”
“আমি পারবো না।”
“একবার বলো, শুধু একবার।”
“প্লিজ, প্লিজ, জোর করবেন না।আমি পারবো না।”
দুহাতে মুখ ঢেকে রেখেই বললো রুপসা।
প্রলয় আর জোর করলো না।
“ঠিক আছে বলতে হবে না।আমি এমনিতেই বুঝে নিয়েছি।যাচ্ছি।”
দরজা পর্যন্ত গিয়েও আবার ফিরে আসলো প্রলয়।
“কলেজে যাও নি কেন আজ?আমি গিয়ে খুঁজে এলাম।”
“এমনি।”
“এখন থেকে আর কলেজ মিস করবে না।প্রতিদিন দেখা হওয়া চাই আমার।নইলে তোমার বাসায় চলে আসবো সরাসরি।বাড়িই ভালো।সুবিধা বেশি।”
রুপসা প্রায় চিৎকার করে বললো,
“না না না।দরকার নেই ঘরে আসার।আমি প্রতিদিনই যাবো।”
“গুড গার্ল।আসি।”
বলেই ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে চলে গেলো প্রলয়।
আর রুপসা ভাবতে লাগলো কে দিলো অডিও ক্লিপ।
মনিকা?হ্যাঁ,এটা মনিকারই কাজ।কারন ও ছাড়া তখন আর কেউ ছিলো না সেখানে। আর ওই তো কাকে যেন মোবাইলে এই ক্লিপ পাঠানোর কথা বলেছিলো
আমি আসি শুধু কলেজে আর তোকে পাই একবার।খবর আছে তোর।বিশ্বাসঘাতক।
মনে মনে বিরবির করতে লাগলো রুপসা।
_______
পরদিন কলেজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে একটা রিকশাও পেলো না রুপসা।এদিকে ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। তাই হাঁটতে শুরু করলো।প্রায় চল্লিশ মিনিটের হাঁটা পথ।
মোটামুটি দশ মিনিট হাঁটতেই ওর সামনে একটা রিকশা এসে হাজির।প্রলয় বসে আছে সেই রিকশায়।
“উঠে পরো।”
“না না।আমি উঠবো না।আপনি যান।”
সংকোচ নিয়ে বলে উঠলো রুপসা।
“এমন করছো কেন?উঠে পরো।তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।”
“হোক।আপনি যান।”
প্রলয় বুঝতে পারলো রুপসা এই ছোট রিকশায় ওর সাথে উঠতে লজ্জা পাচ্ছে। একসাথে খুব পাশাপাশি বসতে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।গতকাল ই যে রিলেশনের শুরু সেখানে আজই একসাথে এতো পাশাপাশি বসে যেতে লজ্জা পাওয়াই স্বাভাবিক।
প্রলয় নেমে পরলো রিকশা থেকে।
“যাও উঠো এবার।”
“আপনি নামলেন কেন?”
“কি আজব?আমি থাকলে উনি উঠবেন না।আবার নামলেও সমস্যা।”
“আমি কখন বললাম এ কথা? ”
“বলোনি বুঝে নিয়েছি।আর আমি থাকতে আমার বৌ হেঁটে কলেজে যাবে এটা কি হয়?যাও উঠো।আমি এমনিতেও ওদিকে এখন যেতাম না।আমার একটু কাজ আছে। কলেজ শেষে দেখা হবে।কেমন?”
রুপসা কে একটু সহজ করতেই কথাগুলো বললো প্রলয়।কিন্তু রুপসা প্রলয়ের কথার কোন উত্তর দিলো না। ধীর পায়ে রিকশায় উঠে বসলো।রিকশা ছাড়ার আগে রিকশাওয়ালাকেও কি যেন বললো প্রলয়।হয়তো কোন উপদেশ বাক্য।রুপসার কানে কিছুই ঢুকছে না।মুখ,নাক এবং কান লজ্জায় লাল হয়ে আছে।
ওর মন মস্তিক আটকে আছে একটি শব্দে।
“বৌ”। কি মারাত্মক শিহরন জাগানো একটি শব্দ!
চলবে..….
মুনিরা মেহজাবিন।