ল্যাম্পপোস্ট পর্ব -০৯

#ল্যাম্পপোস্ট ( ৯ )

কানাডার অবস্থা এখন শিথিল। বরফ সরিয়ে রাস্তা ঘাট সব পরিষ্কার। ফ্লাইট ও চালু হয়েছে। সকাল থেকে কোথাও একটা বেরিয়েছে অ্যাড। ঘুম থেকে উঠে সেটাই জানতে পেরেছে বিভা। মিসেস হাডসনের ভীষন মন খারাপ। বিভার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মেয়েটার আদুরে কণ্ঠ যে কাউকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। এই প্রথম কোনো গেস্ট এর জন্য নিজ হাতে রান্না করেছেন মিসেস হাডসন। সেটাও হালাল ফুড! বিভার কোনো রকম অসুবিধা যেন না হয় তার জন্য ১৫ দিন যাবত হালাল ফুড ই খাচ্ছেন সকলে। যদি ও থিওডোর হুইস্কি ছাড়া থাকতে পারে না তাই সে বাইরে থেকে খেয়ে আসে। মিসেস হাডসনের ডাকে নিচে নেমে আসে বিভা। ড্রয়িং রুমে অ্যাড এর সাথে কেউ একজন বসে আছে। অ্যাড লোকটাকে দেখিয়ে বলে
“ওহ হচ্ছে নোলান। আমার বন্ধু মহলের সব থেকে কাছের একজন। ফরেন্সিক ডিপার্টমেন্ট এর বেশ বড়ো সড়ো কর্মকর্তা।”

“হ্যালো নোলান। পরিচয় হয়ে ভালো লাগল।”

“হ্যালো সুইট গার্ল। তোমার অনেক প্রশংসা শুনেছি আমি। আসলে আমি ও সেদিন আয়াল্যান্ড এ ছিলাম। বিশেষ প্রয়োজনে চলে আসতে হয়। তাই তোমার সাথে পরিচয় হয় নি আমার।”

মৃদু হাসে বিভা। অ্যাডের দিকে তাকাতেই বলে
“আমরা তিন জন ই অস্ট্রিয়া যাচ্ছি। আই উইস তোমার উডবি কে খুঁজে পাব।”

“ইয়েস। ব্রিভা ডোন্ট ওরি , আমরা তোমার বিশেষ মানুষ টিকে খুঁজে বের করবই। বাই দ্যা ওয়ে তোমার কাছে তো ওর ছবি আছে তাই না?”

দু দিকে মাথা নাড়িয়ে বিভা বলে
“এক্সচুয়ালি আমার সমস্ত কার্ড এমনকি সোশ্যাল সাইড ও লক করা হয়েছে। কোনো কিছু ই নেই। তবে লাস্ট ডে আরাজের একটা হাফ ছবি ডাউনলোড করেছিলাম আমি। আজ দেখলাম সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সেটা ও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।”

“ওহ গ্রেট। সেই ছবি টা তুমি অ্যাড কে পাঠিয়ে দিও। আমি দেখছি তোমার জন্য কি করা যায়।”

“ওকে।”

“আজ রাত নয়টায় ফ্লাইট কিন্তু অ্যাড। রবার্ট কে ও সাথে নিতে পারিস। ইস্টন না হয় এদিক টা সামলাবে।”

“ওকে। আমি রবার্ট কে ম্যাসেজ করে দিব। তুই নাস্তা করে যা।”

ঘড়িতে টাইম দেখে নোলান। কানে হাত দিয়ে বলে
“একদম ই মনে নেই। তুই তো আরেক টু পর লাঞ্চ ই করবি।”

আসি , সবাই কে নিয়ে একদিন জমিয়ে আড্ডা হবে।”

“ইয়াহ সিউর।”

নোলান চলে যায়। যাওয়ার পূর্বে বিভার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি তে তাকায়। বিভা সে দৃষ্টি লক্ষ্য করে না। তবে অ্যাড কে চোখের ইশারায় কিছু একটা বলে বাসা থেকে বেরিয়ে আসে।

মিস্টার হাডসন আজ অফিস গেলেন না। মুখের অবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি ব্যথিত। যে মেয়েটার আগমন সহ্য হচ্ছিল না আজ সেই মেয়েটার চলে যাওয়াই যেন মন কে কাঁদাচ্ছে।

থিওডোর এর মন টা ও ভার। কয়েক দিন পর বিয়ে তার। হবু স্ত্রী ঘুরতে যেতে চেয়েছিল। সোজা সাপটা নাকোচ করে দিয়েছে ছেলেটা। ভিনদেশী মেয়েটা সকল কে এভাবে মায়ায় জড়িয়ে নিবে বিষয় টা ছিল পুরোই কল্পনা। মিসেস হাডসন যত্ন নিয়ে সব কিছু গুছিয়ে দিচ্ছেন। এটা ওটা উপদেশ দিচ্ছেন। মায়ের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে অ্যাড। বিভার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ সকলের। এক মুহূর্তের জন্য হিংসা হয় খুব। বিভার পাশাপাশি এসে কাউচে বসে। ঢিভি তে কার্টুন দেখছিল বিভা। আচানাক সে বলে
“এই মুহূর্তে প্রচন্ড জেলাস হচ্ছি আমি। তুমি আমার পুরো পরিবার কে এমন ভাবে নিজের দিকে নিয়ে নিয়েছ যে আমাকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না।”

“সুন্দর মানুষদের হিংসে বেশি যার জলজ্যান্ত প্রমান তুমি।”

“আর মায়াবিনীদের মায়া বেশি তারা এক হাতে সব সামলে নেয়।”

অ্যাড এর কথা শুনে পেটে হাত চেপে হাসে বিভা। সেই হাসির শব্দে ছুটে আসেন মিসেস হাডসন। তিনি বলেন
“কি হয়েছে বেভা , তুমি এমন করে হাসছ কেন?”

মিসেস হাডসন এর মুখে বেভা নাম শুনে মুখ টা কুমড়োর মতো ফুলে যায়। একটা নাম কে কত ভাবে শুনতে হবে কে জানে। এই নাম টাই পরিবর্তন করতে হবে। সত্যিই তো বিভা শব্দের অর্থ আলো অথচ ওর সব টাই অন্ধকার।

ককপিট উপর থেকে নিচে নামার সময় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নামে। যদি ও ককপিটে চলা ফেরার অভ্যাস রয়েছে তবু ও আজ মাথা ঘুরে গেল বিভার। প্রচন্ড রকমের ঘূর্ণনে অ্যাডের গায়ে এসে পড়ল। দু হাতে বিভার মাথাটা উঁচু করে অ্যাড। গালে হালকা করে থাপ্পড় মেরে বলে
“বিইইভা , উঠ শরীর খারাপ লাগছে তোমার। বিইইভা? ”

“আমার মাথা ঘুরছে অ্যাড। আমি এক জায়গায় দাঁড়াতে পারছি না।”

চিন্তা গ্রস্ত হয় অ্যাড। একজন কেবিন ক্রু কে ডেকে উঠে।
“জুসের মধ্য কি ওয়াইন ছিল?”

“নো স্যার ইটস ম্যাপল জুস।”

“ওকে আপনি যেতে পারেন।”

মাথা নিচু করে সম্মান প্রদর্শন করে চলে যায় কেবিন ক্রু। পাশেই রয়েছে ম্যাপল জুস এর গ্লাস। কিছু টা জুস এখনো আছে। গ্লাস হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে সে। নাক দিয়ে ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করে ও তেমন কিছু ই বুঝতে পারে না। পরিশেষে একটু খানি জুস মুখে তুলে নেয়। অদ্ভুত তেঁতো এক স্বাদ অনুভব হয়। এ স্বাদ টা আরো একবার পেয়েছিল ছেলেটা। মনে পড়তেই বুক কেঁপে উঠে। কারণ এটা তে প য় জ ন মেশানো হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী প য় জ ন। একটু একটু করে মে রে ফেলে যা। বিভার শরীর অসুস্থ তার উপর প য় জ ন! সব মিলিয়ে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বিভা কে কোলে তুলে নেয় অ্যাড। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে রবার্ট। পুরো ককপিটে এক প্রকার হট্টগোল লেগে যায়।
“রবার্ট নোলান কে খরব দাও। আর দ্রুত একটা ওটির ব্যবস্থা করতে বলো। কেউ বিইভার জুসে প য় জ ন দিয়েছে। আর পুরো ককপিট সিল করে দাও। একজন লোক ও যেন বের না হতে পারে।”

“ওকে স্যার।”

রবার্ট চলে যায়। বিভা কে কোলে নিয়ে এক প্রকার ছুটতে থাকে অ্যাড। তাকে ভীষণ বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। এক একটা সেকেন্ড যেন মৃ ত্যু কে কাছে টেনে নিচ্ছে। অ্যাডের বুকের মধ্য স্থানে চিন চিন ব্যথা অনুভব হয়। যে ব্যথার হেতু জানা নেই। চোখ দুটো ছলছল করছে। বিভার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে একটু একটু থু থু। এক মুহূর্তের জন্য সব কিছু এলোমেলো করে দিতে ইচ্ছে হয়।পুরো পৃথিবী এফোর ওফোর করতে ইচ্ছে হয়। বিভার জীবনে ল্যাম্পপোস্ট হওয়ার কথা ছিল। তাহলে সে কেনো আলোহীন এক অন্ধকার পথ হতে চলেছে?

দুই ঘন্টা পর চারজন ডাক্তার ওটি থেকে বের হয়। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে অ্যাড। পাগলামির চরম শীর্ষে পৌছে গিয়ে ডাক্তার এর কলার চেপে ধরে। চোখ হয়ে গেছে র ক্ত লাল। বাদামি চুল গুলো এলোমেলো। নীল মনি তে পানি চিক চিক করছে। দাঁত কিরমির করে উঠে সে। কলার চেপে ধরেই বলে
“ওর কিছু হলে আমি পুরো হসপিটাল জ্বালিয়ে দিব। সুস্থ অবস্থায় ওকে আমার চাই ই চাই।”

“মিস্টার অ্যাড কি করছেন কি? আমরা চেষ্টা করেছি। আর সী ইজ আউট অফ ডেন্জার। এখন শুধুই জ্ঞান ফেরার পালা।”

“সী ইজ ফাইন?”

“ইয়েস।”

ডাক্তারের কলার ছেড়ে দেয় অ্যাড। ছুটে যায় বিভার কাছে। হসপিটালের পোশাকে একদম ই ভালো লাগছে না মেয়েটা কে। সে চিৎকার করে উঠে। দুটো নার্স কাঁপা শরীরে প্রবেশ করে।
“ইয়েস স্যার।”

“ওর ড্রেস চেঞ্জ করে দিন।”

“কিন্তু স্যার ম্যাম তো।”

“নো মোর ওয়ার্ড। এখনি চেঞ্জ করাবেন। ইটস মাই অর্ডার।”

কথা টা বলেই বেরিয়ে আসে সে। তীক্ষ্ম দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে নোলান। রবার্ট অবাকের চরম পর্যায়ে অবস্থান করছে। অ্যাডের কাঁধে হাত রাখে নোলান। বিস্ময় নিয়ে বলে
“আর ইউ ইন আ লাভ?”

“নোলান ! এটা কি বলছিস তুই ?”

“তোর চোখ মুখ কিন্তু তাই বলছে। বিষয় টা ভেবে দেখ। সময় নে।”

নোলান চলে যায়। নিজের সিল্কি চুল গুলো মুঠো করে ধরে অ্যাড। সত্যি ই কি সে প্রেমে মজেছে? ল্যাম্পপোস্ট হয়ে সারা জীবন পাশে থাকার ইচ্ছে জেগেছে। কিন্তু বিভা যে অন্য কাউকে পছন্দ করে। অ্যাড এর ভাগ্যে কি তবে না হওয়া প্রেমের করুণ বিচ্ছেদ রয়েছে?

চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here