#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১৬|
সাদিয়া মেহরুজ
তন্ময়! নামটার সাথে জুড়ে আছে একবুক দীর্ঘ নিঃশ্বাস, হতাশা আর মলিনতা। নিঃসন্দেহে এই নামটার সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে মেহতিশার জীবনের সবথেকে বে দ না দায়ক মূর্হত। তন্ময়ের প্রতি তার ভালোলাগা আছে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চিত মেহতিশা। তবে অবিরাম মায়া আছে ছেলেটার প্রতি ওর। এই মায়াটাই বোধহয় আজও পীড়া দেয়, দেয় ভীষণ ভীষণ য ন্ত্র ণা! তন্ময় আলাদা ছিল। নিজের মাঝে আকাশসম মায়া নিয়ে ঘুরত ছেলেটা। তার আচরণ ছিলো মুগ্ধ হওয়ার মতো। এইযে তন্ময় হুট করে মা রা গেল। তারপর কিভাবে যেন একের পর এক বি প দ এসে ঝুটল মেহতিশার কাঁধে। বন্ধ হলো তার পড়াশোনা। মাটি চাপা পড়লো তার স্বপ্ন।
-” মেহতিশা বাড়ি যাবে না? ”
মাথা ঝাঁকাল মেহতিশা। উঠে দাঁড়াল ব্যাগ হাতে। অতীতের পৃষ্ঠা বন্ধ করে রেখে দিল ধূলি জমা মনের কোণে পড়ে থাকা বাক্সটায়। আয়েশার দৃষ্টিপাত স্বাভাবিক নয়। সে চিন্তিত! তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার জন্য চিন্তিত। মেহতিশাকে তার বেশ ভালো লাগে। মেয়েটা কি সুন্দর করে যে কথা বলে! শুধুমাত্র এই চমৎকার ভঙ্গিতে কথা বলা আর বাবা মা বাদে নিজের ছোট্ট জীবনটার খুঁটি ধরে কিভাবে সামনে অকপট ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এই দু’টো জিনিস কতোটা দারুণ ভাবে যে পারে তা গহীন মনে চিন্তা না করলে বোঝাই যাবে না।
-” তুমি কি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত মেহতিশা? কন্ঠে দুশ্চিন্তা ঝাড়ল আয়েশা।
আয়েশার নম্র হাতটা আঁকড়ে ধরে সামনে এগোতে এগোতে কিয়ৎ হাসল মেহতিশা। মাথা নাড়াল। যার অর্থ না! তবে আয়েশার সন্দেহের বরফ পাহাড় এই ক্ষুদ্র প্রতিক্রিয়ায় কিছুতেই গললো না। সে পুনরায় প্রশ্ন করলো,
-” তোমাকে ইদানীং খুব টেন্স’ড দেখায়। তোমাকে আজকাল দেখে মনে হয় যেন কতো দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরছো। কোনো সমস্যা হলে আমায় বলতে পারো। ”
মেহতিশা মৃদু কন্ঠে জবাব দিলো, ” তেমন কিছুই না আয়েশা। ঐ টাকা পয়সার হিসেব করছিলাম আর কি। এই টাকায় আসলে আজকের যুগে সংসার চালানো কষ্টকর। সবকিছু ঠিকভাবে সামলে উঠতে বেগ পেতে হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম এতোটা বেশি যা বলার বাইরে। আমার মতো নিম্নবিত্তের খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই অল্প টাকায় জীবন পরিচালনা করা।”
আয়েশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঘন ঘন মাথা নাড়ল। নত মস্তকে সে মেঝেতে তাকিয়ে হাঁটছে। তার স্বাভাবিক মুখোশ্রীতে হুট করে ফুটে উঠল আশঙ্কা!
-” হুম। এটা নিয়ে চিন্তা আমারও হচ্ছে। দেশে তো এখন দুর্ভিক্ষ চলছে তাই দ্রব্যমূল্যের দাম এতোটা বেশি। চিন্তা করো না। দুর্ভিক্ষ কে টে গেলে এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি শান্ত হবে ইনশাআল্লাহ। ”
-” ইনশাআল্লাহ। ”
তারা দু’জন রাস্তায় নেমে এলো। হেঁটেই যাবে। দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে স্বাভাবিক জীবন চালনা করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। টাকা বাঁচাতে এখন অনেক গণমান্য ব্যাক্তিরাই পথে হেঁটে নিজ গন্তব্যে পৌঁছায়।
-” মেহতিশা একটু দাঁড়ান। ”
দূর থেকে চেঁচাল কেও! মেহতিশা, আয়েশা দু’জনেই ফিরে তাকাল। সারতাজ সাইকেল দ্রুত গতীতে চালিয়ে এদিকেই আসছে।সারতাজকে এই অসময়ে এখানে দেখে মেহতিশা ভীষণ বিরক্ত! অধর যুগল প্রসারিত হয়ে চ’কারান্ত শব্দ বেড়িয়ে এলো তার। অন্যদিকে আয়েশা নির্বাক, বিমূর্ত! উত্তেজনার বশে মেহতিশার ডান হাতটা খা ব লে ধরে সে বিড়বিড়িয়ে বলল,
-” আরেহ ইনি সারতাজ শাহরিয়ার না মেহতিশা?”
মেহতিশা উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,
-” তুমি চেনো এনাকে? ”
-” হু চিনব না কেন?বাংলাদেশের বিখ্যাত, খ্যাতিমান ফটোগ্রাফারদের মধ্যে একজন। কয়েকদিন আগেই তো পুরো বিশ্বের মধ্যে ফটো কনটেন্স প্রতিযোগিতা যখন হলো তখন তিনি প্রথম হয়েছিলেন। ”
সারতাজের সাথে মেহতিশার দেখা সাক্ষাৎ নেই এক মাস যাবৎ। ঐযে সেদিন চট্টগ্রাম থেকে এলো সকল ঝুট – ঝামেলা শেষে করে তারপর থেকেই এই ব্যাক্তি উধাও। মেহতিশা অবশ্য স্বস্তি পেয়েছিল সারতাজের নিরুদ্দেশ হওয়াতে। তবে অন্তরালে কোথাও না কোথাও সে অসন্তুষ্ট ছিল। সারতাজ কোথায় গেল হুট করে? আগে তো মেহজার সাথে দেখা করার চক্করে সপ্তাহে একবার প্রায়ই আসতো। শাহরিয়ার ভিলাতেও ছিল না ও। সাবিনা খালার থেকে জানা গেছে সারতাজ সবকিছু তার ভাই দু’টোর নামে করে দিয়ে চলে গিয়েছে শাহরিয়ার ভিলা ছেড়ে। আজ এতোদিন পর সারতাজের দর্শন আর মাঝে উধাও হওয়ার কারণটা মেহতিশা বুঝল। সারতাজ তার সাথে দেখা করবেই বা কি করে? সে তো গিয়েছিল নিউইয়র্ক।
-” জলদি সাইকেলের পিছনে উঠে বসুন মেহতিশা। ”
মেহতিশা যারপরনাই কপাল কুচকাল! সুক্ষ্ম ভাজ ফেলল ললাট জুড়ে। বলে উঠলো,
-” কেন? ”
-” প্রয়োজন আছে বলেই বলছি। উঠে বসুন এখন। আপনাকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক কাজে যেতে হবে। ”
-” কি কাজ তা নির্দিষ্ট করে না বললে আমি যাব না কিছুতেই। ”
সারতাজ ভয়াবহ বিরক্ত হলো। অতিষ্ঠ, বিতৃষ্ণা ভাব তার চেহারায় দেয়া দিল। ডান হাতের দুই আঙুল দিয়ে কপাল ঘসতে ঘসতে ভাবল, মেয়েটা এতো প্রশ্ন করে কেন? তার ওপর কি বিশ্বাস নেই? সে কি আর ওকে মেরে ফেলতে নিয়ে যাচ্ছে নাকি আশ্চর্য!
-” এখন কি মাস চলছে? মার্চ মাস! আজ কত তারিখ মনে আছে তো? মনে না থাকলে ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন আজ ১৭ তারিখ আর পরশু শুনানির চূড়ান্ত দিন। আপনাকে র্যাব – ০৭ এর অফিসে যেতে হবে জরুরি প্রয়োজনে। ”
তারিখটা মনে করে চোখ মুদে নিল মেহতিশা। সে কি দিনকে দিন ভুলোমনা হয়ে যাচ্ছে না? এইযে শাকিব আজ সকালেও তাকে ফোন দিয়ে তলব করেছিল র্যাব অফিসে। আর ও কি উত্তর দিয়েছিল? পাঁচটা বাজে পৌঁছে যাবে অথচ এখন বাজে সন্ধ্যা সাতটা। এতোটা বেখেয়াল তো ছিলনা মেহতিশা। হচ্ছেটা কি তবে?
আয়েশা নির্লিপ্ত। নত মস্তকে সে। দু’জনের কথাবার্তা মৌন রূপে কেবল শুনে যাচ্ছিল। তবে ক্ষণে ক্ষণে মৌন থাকার ধৈর্যটা ভে ঙে গুঁড়িয়ে আসতে চাইছে কৌতূহলে। তার নির্লিপ্ততা চুরমার হলো ভে ঙে! প্রশ্ন করল,
-” র্যাব অফিসে তোমার কি কাজ মেহতিশা? ”
-” তোমাকে আমি কাল বলবো সব। আজ যেতে হবে। সময় নেই। ”
নির্বাক আয়েশাকে হাত দিয়ে বিদায় জানানো শেষে মেহতিশা চড়ে বসল সাইকেলে। নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে সে চেপে ধরল সাইকেলের সিটের একাংশ। সারতাজ মিষ্টি হেঁসে আয়েশাকে ” বায় ” বলে টান দিল সাইকেল। পড়ন্ত সায়াহ্নের আধো আধো রশ্মিতে নির্বাক আয়েশা মিলিয়ে গেল লহমায়। দৃষ্টি সরাল মেহতিশা। দেহে প্রাণ থাকতে সে কখনোই এই ঘাড়ত্যাড়া ছেলেটার সাইকেলে উঠত না। তবে এখন যে হাত শূন্য! শরীর দূর্বল। হেঁটে যেতে সায় দিচ্ছে না মস্তিষ্ক। কখনো নিজের স্বার্থে পৃথিবীর সবথেকে অপছন্দনীয় কাজ গুলোও করতে হয় আমাদের।
সাইকেল চলছে ধীর গতীতে। মৃদুমন্দ হাওয়ার তোড়ে মেহতিশার চুল গুলো উড়ছে তখন শূন্য। ঘাড় বাঁকিয়ে একবার মেহতিশাকে দেখল সারতাজ। পরক্ষণেই মন দিল সামনে। খোলা চুল, বন্ধ নেত্র যুগল সাথে অধর কোণে মৃদু হাসি! এই তিনটে সাধারণ জিনিস তার বুকে কেমন কম্পন ধরিয়ে দিল। নিউইয়র্ক থাকাকালীন এই মেয়েটা তাকে বেশ জ্বালিয়েছে! য ন্ত্র ণা দিয়েছে! সারতাজ জানে, তার সাথে এক অঘটন ঘটে গেছে। সে অঘটন তার তিল তিল করে গড়া শক্তপোক্ত মনটাকে ভেঙে চুড়ে খান খান করে ফেলেছে। তাকে বানিয়ে দিয়েছে অবিন্যস্ত। সারতাজের ঠোঁট দু’টো কাঁপছে। ও কাঁপা ঠোঁটে নিম্ন স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলে,
-” আমার বি ষ ন্ন শহরে আপনাকে স্বাগতম বি ষ ন্ন কন্যা। ”
_
-” তোমার জন্য আমি আর্মির চাকরি ছেড়ে র্যাবে এসেছি প্রান্তিকা। আর কি চাও তুমি? র্যাবের চাকরি ছাড়লে আমার মায়ের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাবে। তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি ১৯ বছর বয়সে আর্মিতে এসেছি। ইন্টার পাশ করা ছেলে আমি। এখন র্যাবের চাকরি ছাড়লে আমি ঠিক কোথায় চাকরি পাবো বলতে পারো? ”
রূঢ় গলা! নিস্তব্ধ কামড়াটা আচানক আছড়ে পড়া হুংকারে কেঁপে উঠল যেন। কেঁপে উঠল প্রান্তিকাও। শাকিবের লাল লাল চোখ দু’টোতে চেয়ে তার বুকে ভীতির কম্পন উঠল। শাকিবকে স্বাভাবিক লাগছে না। অবশ্য স্বাভাবিক লাগারই – বা কথা কি? উঁহু ! প্রান্তিকা মিনমিন করে নিজের অসহায়ত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করল শাকিবের নিকট।
-” আমি এখন কি করব বলো তো? বাবা বেঁকে বসেছেন ডিফেন্সে জব করা কোনো ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন না। তোমাকে বাবা বলেছে চাকরি খুঁজে দিবে তো। ”
পুনরায় গর্জে উঠল শাকিব, ” চাকরি খুঁজে দেবে? কিসের চাকরি দেবে জানো? পিয়নের! আমাকে হেনস্তা করার একটা উপায়ও এই লোক ছাড়ে না। তোমার বাবাকে এদিক থেকে তুমি না চিনলেও আমি খুন ভালো করেই তাকে চিনি। ”
-” তো এখন কি করতে চাচ্ছো তুমি? ”
শাকিব চুপ রইল কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর অধর জোড়া প্রসারিত করে বলে দিল নি ষ্ঠু র কিছু কথা,
-” যেভাবে তিন শব্দের মাধ্যমে আমরা নতুন জীবন শুরু করেছিলাম ঠিক সেভাবেই তিন শব্দ বলার মাধ্যমে নাহয় আমাদের পথচলা শেষ হোক! আমি কিছুতেই চাকরি ছাড়ব না প্রান্তিকা। একবার সেক্রিফাইস করেছি আর সম্ভব না। তোমার বাবা যে তোমাকে আমার হতে দেবে না তা খুব ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছি আমি। ”
প্রান্তিকা কিংকর্তব্যবিমুঢ়! সে টলমলে চোখে বিমূর্ত হয়ে চেয়ে রইল কেবল শাকিবের পানে।
চলবে~
| রি-চেইক দিইনি। রেসপন্স করবেন সকলে। |#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১৭|
সাদিয়া মেহরুজ
নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। গরম কফির কাপ থেকে বাষ্প উড়ে সমীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। নৈঃশব্দের রাজ্য এখন ব্যাস্ততম অফিস কক্ষটা। ঘড়ির টিকটিক শব্দ কানে বি শ্রীভাবে এসে লাগল। হাত বাড়িয়ে গরম কাপটা হাতে তুলে নিল সারতাজ। স্থির মূর্তির মতো বসে থাকা শাকিবকে দেখতে দেখতে কাপে ঠোঁট ছোঁয়াল। বিরক্তিতে তার অন্তরাল এখন বি ষি য়ে রয়েছে। শাকিব যদিও তার বড়, গুরুজন হয় তবুও ইচ্ছে করছে এই গর্দভ ছেলেটাকে চটপট কয়েকটা চড় লাগাতে। স্বেচ্ছায় ভুল করা শেষে, সে ভুলের সমাধান না করে এভাবে মূর্তির মতো বসে থাকার কি কোনো মানে হয়?
-” ভাই তোমার যদি স্ট্যাচু সাজার এতোটাই ইচ্ছে থাকে তাহলে বাহিরে গিয়ে এভাবে স্ট্যাচু হয়ে বসে থাকো। দেখা যেতে পারে মানুষ তোমাকে পাগল, টাগল ভেবে দুই – চারটা টাকা ভিক্ষাও দিয়ে যেতে পারে। এখানে বসে তো লাভ নেই। আমার পকেট এমনিতে খালি। তোমাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া হিসেবে ভিক্ষা তো আর দিতে পারছি না। ”
শাকিব রুষ্ট দৃষ্টে চাইল। হাতের কাপটা টেবিলে রেখে সারতাজ শাকিবের মুখাবয়ব দেখল। তারপর সে হাসল মৃদু, আড়ালে। গলা ঝেড়ে বলে উঠলো,
-” এভাবে তাকাচ্ছো কেন? আমার পকেট সত্যিই ফাঁকা ভাই। নাহলে অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম। তবে যদি তোমার এতোটাই ইচ্ছে থাকে আমার থেকে সাহায্য নেয়ার তাহলে দুই টাকা দিতে পারি। নিবে নাকি? ”
-” তুই কি তোর ফালতু কথাবার্তা বন্ধ করবি নাকি কানের নিচে লাগাব চ ড়? ” শাকিব হুংকার দিয়ে উঠল।
দু’পাশে মাথা নাড়াল সারতাজ। ঠোঁট দিয়ে অদ্ভুত দু’টো শব্দ করল। হতাশ কন্ঠে শুধাল,
-” তোমার এই ঢঙ আমি মানতে পারছিনা ভাই সিরিয়াসলি! মানে নিজে ভুল করলা এখন রাগ ঝাড়ছ আমার ওপর? ”
শাকিব দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ” রাগ ঝাড়ছি না আমি। জাস্ট তোর ফালতু কথার লাগাম টানতে বলেছি। ”
সারতাজ তার নজর এলিয়ে দিল কাঁচের ওপাশে। কিয়ৎ দূরে মেহতিশা বসে চেয়ারে। তার সামনে এক বয়স্ক অফিসার। কিছু প্রশ্ন করা হচ্ছে মেহতিশাকে। তার উত্তর তোতাপাখির মতো ফটাফট দিয়ে যাচ্ছে সে। আশপাশ কোন দিকে তার ধ্যান নেই। সারতাজ সেদিকে নজর রুখে বলল,
-” দো ষ টা তোমার ভাই তোমার। অনন্তপক্ষে এই মূর্হতে। নারীর মন তুলোর মতো কোমল হয়। তুমি এই কোমল মনে আ ঘা ত দিয়েছে। কি দরকার ছিল প্রান্তিকা আপুকে তালাকের কথা বলার? কষ্টটা এখন কে পাচ্ছে বেশি? তুমিই তো! আপুকে কষ্ট দিয়ে কষ্ট পাচ্ছো, তালাকের কথা বলে কষ্ট পাচ্ছো। অযথা এমন কথা বলো কেন যাতে নিজেকে ক ষ্ট পেতে হয়? রাগ নিয়ন্ত্রণ করো ভাইয়া। তুমি ডিফেন্স এ জব করো। এতো রাগ নিয়ে এই চাকরিতে টিকবে কি করে? ”
শাকিব তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে উঠলো,
-” আমার দো ষ টাই দেখছিস। প্রান্তিকার বাবা? উনি তো দুধে ধোঁয়া তুলসি পাতা না? অতিরিক্ত করছেন উনি। ইচ্ছে করে র্যাবে এনে স্পেশাল আপ্যায়ন করি। ”
-” আরেহ ঐ মীর জাফর লোকের কথা বাদ দাও তো। নিজের স্বার্থের জন্য এখন মেয়ের সুখে থাকাটা নষ্ট করার জন্য ম রি য়া হয়ে উঠেছে। মীর জাফর চলে গেছে ঠিকই কিন্তু নিজের বংশধরকে পৃথিবীতে রেখে গিয়েছে। ” হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করল সারতাজ।
শাকিব মাথায় চেপে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। তার অনুশোচনা হচ্ছে। প্রান্তিকার সাথে একটু বেশিই রেগে গিয়েছিল। এতোদিনের ধৈর্যের পাহাড়টা আজ কিভাবে যে ভে ঙে গেল! প্রতেকটা কঠিন মূর্হত সে সামলাতে পারদর্শী ছিল। অথচ আজ? আজ যেন লহমায় সে অন্য এক শাকিবে রূপান্তর হয়েছিল, হয়েছিল অবিন্যস্ত।
_
ফুটপাতে এক আ হ ত বিড়াল আ র্ত না দ করছে। ঝড়ের গতীতে সাইকেল চালালেও সেই আ হ ত বিড়ালের আ র্ত না দ সারতাজের কর্ণগোচর হলো না। ঝট করে ব্রেক মা র ল ও। মেহতিশা তৎক্ষনাৎ মুখ থুবড়ে বাড়ি খেল সারতাজের পিঠে। সাইকেল থেকে নেমে সারতাজ ব্যাস্ত হয়ে উঠল।
-” ব্যা থা পেয়েছেন মেহতিশা? ”
সারতাজের দেহের গড়ন বর্তমানে কিছুটা রোগাটে বলা চলে। হাড্ডি ব্যাতীত কিছুই নেই শরীরে। সেই হাড্ডিসার পিঠে থুবড়ে পড়ে মেহতিশা ভালোই চোট পেয়েছে। ব্যা থা র দরুন অক্ষিগোলকে অশ্রুকণা এসে ভীড় জমিয়েছে। ব্যা থা চেপে রেখে তেতেঁ উঠল মেহতিশা,
-” সাইকেল চালাতে পারেন না তো চালান কেন? কোথাও, কখন, কিভাবে ব্রেক করতে হয় সেটাও জানা নেই। ”
সারতাজ অন্তঃকরণে দুঃখ বোধ করল। তবে বাহিরে সে নিজের ঠাটঁ বজায় রেখে বলল,
-” সাইকেল আমি ভালোই চালাতে পারি। কোথায়, কখন, কিভাবে ব্রেক কষতে হয় তাও জানি আমি। এখানে কিন্তু দো ষ টা আপনার। বুঝে শুনে ধ্যান রেখে শক্ত হয়ে বসা উচিত ছিল। কখন কি হয় সেটা তো আর বলা যায় না। ”
নিরুত্তর, নিশ্চুপ মেহতিশা। ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখ মুদে নিল। তার অক্ষিপটে ঝট করে ভেসে উঠল মা বাবার চেহারা। কতোটা বাজে ভাবে থে ত লে গিয়েছিল তাদের দুজনের চেহারা সড়ক দুর্ঘটনায় তা মনে করে শিউরে উঠল একবার, দু’বার।
সারতাজ আ হ ত বিড়াল ছানার কাছে এসেছে। ও হাত বাড়িয়ে কোলে তুলল বিড়ালটাকে। ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে মেহতিশাও। বিড়ালটাকে খেয়াল করলে আঁতকে উঠে বলল,
-” ও তো অনেক ব্যা থা পেয়েছে। ”
-” হ্যা। ওকে হাসপাতালে নিতে হবে। ”
-” তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? জলদি চলুন। ” তাড়া দিল মেহতিশা।
সারতাজ মাথা তুলল। প্রশ্ন করে বসল,
-” আপনার দেরী হয়ে যাচ্ছে না? আপনাকে আগে বাসায় দিয়ে আসি। ”
-” পাগল নাকি! বাসায় দিতে গেলে বাচ্চাটা বাঁচবে নাকি? জলদি চলুন। ”
প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বিড়ালটাকে আনা হলো মেহতিশার বাসায়। সারতাজ রাখতে চাইলেও তা সম্ভব নয় কারণ তার এপার্টমেন্টে ‘ ক্যাট নট এলাউড ‘ সাইনবোর্ডটা একদম তার ফ্লাটের সামনে টানিয় দেয়া। শুধু তার ফ্লাট নয় এপার্টমেন্টের প্রতিটা ফ্লাটের সামনে একই লেখা রয়েছে। বাড়ির মালিকের বিড়াল অত্যান্ত অপছন্দের তাই তিনি এ কাজ করে রেখেছেন।
-” বিড়ালের নাম কি রাখবে আপা? ” মেহজার চঞ্চল গলা।
সারতাজ, মেহতিশা দু’জন ভাবল কিছুক্ষণ। কিয়ৎ পর দু’জন এক সঙ্গে বলে উঠলো, ” নিলি। ”
মেহজা চোখ বড় বড় করে তাকাল। জিজ্ঞেস করলো,
-” একসাথে বললে কিভাবে? তোমরা কি ওর নাম আগের থেকেই ঠিক করে রেখেছিলে? ”
দু’জন মেহজার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে একে অপরের মাঝে দৃষ্টি বিনিময় করল। তাদের দৃষ্টে ঝড়ল অপ্রস্তুত ভাব।
-” নাহ্। কিভাবে যেন কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। আমরা আগে থেকে নাম ঠিক করিনি। ” মেহতিশা জবাব দিল নিম্ন স্বরে।
সারতাজ উঠে দাঁড়াল। হাত ঘড়িতে সময় দেখে অস্থির হয়ে উঠল। দশটার বেশি বাজে। আর সে কিনা এখনো বেকুবের মতো মেহতিশার বাসায় পড়ে আছে! অস্বস্তিতে গাঁট হলো অন্তরাল। তাড়া দিয়ে বলল,
-” মেহতিশা যেতে হবে আমাকে। ”
-” আসুন। গেট বন্ধ এখন। আমি চাবি নিয়ে আসছি। ”
নিচে নেমে এলো দ্রুত সারতাজ। মেহতিশা এলো বাদে চাবি হাতে। তালা খুলে সরে দাঁড়াল। সারতাজ বেড়িয়ে গেল লহমায়। জায়গাটা ছাড়ার পূর্বে ও নিম্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” আপনাকে তো কালই চট্টগ্রাম যেতে হবে। একা যেতে পারবেন? ”
-” কেনো পারব না? এতদিন বুঝি আমার চলাচলের সময় আমার ভূত সঙ্গ দিত যে এখন বলছেন একা যেতে পারব কিনা। ” মেহতিশার কাঠ কাঠ গলা।
সারতাজ হতাশ কন্ঠে বলল, ” আপনার ত্যাড়ামো কখনোই যাবে না? যাইহোক হ্যাভ এ সেইফ জার্নি।”
কথার ইতি টেনে পিছন ফিরল সারতাজ। অমনি পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাক্তিটাকে দেখে সে চমকাল, থমকাল! বিষ্ময়ে কথা বলার শক্তি লোপ পেল।
চলবে~