সম্পর্ক,পর্ব-২৩

#সম্পর্ক
#২৩ (শেষ পর্ব)

বিল্ডিংটি চারতলা। নুসরাত বলেছিলেন, উনার বাবার ফ্ল্যাট, অর্থাৎ যেটিতে এখন মফিজুল থাকেন, সেটি দুই তলায়। পশ্চিম মুখী, অর্থাৎ পেছনের দিকে। প্রতিটি তলায় দুটো করে ইউনিট।
আহ্নি আর প্রান্ত বিল্ডিংয়ের পেছনের রাস্তায় ঘুর ঘুর করছে। কীভাবে ওই ফ্ল্যাটে ঢুকবে, সেটি নিয়েই চিন্তিত আহ্নি। দারোয়ান কে ফাঁকি দিয়ে ঢোকা অসম্ভব, আবার বলেও যাওয়া যাবে না। আগে মিলাকে ফোন দিয়ে জানাবে যে কেউ একজন দেখা করতে এসেছে। তখন মিলা সাবধান হয়ে যেতে পারে, যদি সেই কালপ্রিট হয়ে থাকে তো। আবার একা একা কোনো উপায়ে উপরে যাওয়াও রিস্কের। ওই ফ্ল্যাটে কে কে আছে, মিলা একাই নাকি সঙ্গে আরও কোনো সহযোগী আছে কে জানে। আহ্নিকে ধরে ফেললে বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে। রতি কে বাঁচাতে তো পারবেই না, উল্টো আহ্নি নিজেও ফেঁসে যাবে।

প্রান্ত মুখ খুলল, ‘তুমি শিউর আহ্নি? ওই মহিলা এসবের পেছনে আছে?’
আহ্নি জোরালো কণ্ঠে জবাব দিল, ‘শতভাগ শিউর না তবে নব্বই ভাগ শিউর। আমার মন বলছে, রতি ভাবির গায়েবের পেছনে মফিজুল শয়তান টা আছে, আর এই বাঁদর মহিলাও আছে।’
‘কিন্তু এখন শিউর হবা কেমনে যে রতি ভাবি এই ফ্ল্যাটে আছে নাকি?’
‘সেটাই তো ভাবছি!’

প্রান্তও চিন্তা করতে শুরু করল। একবার ভাবল, পুলিশের কাছে যাবে। হেল্প চাবে। কিন্তু যদি রতি ভাবি না থাকে এখানে? তখন তো পুলিশ ক্ষেপে যাবে। উফ! এ কী যন্ত্রণা, কোনো বুদ্ধিরা কেন এসে ধরা দেয় না ঘটে?
ঠিক এমন সময়, আহ্নি হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘পেয়েছি, পেয়েছি বুদ্ধি প্রান্ত।’
প্রান্ত আহ্নির দিকে উৎসুক চোখে তাকাল, ‘কী? বলো আমাকে।’
‘বুদ্ধিটা সফল করতে মোটামুটি ঝামেলা হবে আমাদের। কিন্তু এর থেকে ভালো আর কোনো উপায় দেখছি না।’
‘যত ঝামেলাই হোক, যদি এটাই একমাত্র এবং শেষ উপায় হয়, তাহলে সফল করার হান্ড্রেড পারসেন্ট চেষ্টা করব, প্রমিস।’

_________
মিলা চোখা চোখে বিছানার উপর তাকাল। রতি শুয়ে আছে, নিথর দেহ তার। যে কেউ প্রাথমিক ভাবে ভাববে, মেয়েটা মৃত বুঝি। শুধু ফ্যালফ্যাল করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর কী যেন ভাবে। ভাবে? কী ভাববে? – নিজের মনে নিজেকেই প্রশ্ন করে মিলা। নাকি মানসিক ভাবে পুরোপুরি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে বলে এভাবে তাকিয়ে থাকে বাইরে?
মিলা ভাবনা থামিয়ে নাকে ওড়নার আঁচল চেপে ঘরে ঢুকল। একটা বালতিতে পানি নিয়ে আসে, আনে সাবান, গা মোছার জন্য ছোট্ট কাপড়ের টুকরো। রতিকে উদম করে দিল। তারপর রতির পুরো শরীর মুছে দিয়ে বিছানা থেকে চাদর সরিয়ে নিল। মেঝে মুছতে মুছতে মিলার কপালের চামড়া কুঁচকে আসে। এই বিরক্তিকর কাজ করতে মোটেও ইচ্ছে করে না তার। শুধুমাত্র টাকার জন্য…
মফিজুল ভালোই টাকা ঢালছেন মিলার পেছনে। মিলার বুঝে আসে না, কী দরকার এত টাকা নষ্ট করে, এত রিস্ক নিয়ে এই মেয়েকে ধরে বেধে শারীরিক সুখ মেটানো? চাইলেই তো পতিতা পাড়ায় যাওয়া যায়। কম পয়সায় এর চেয়েও সুন্দরী পাবে সেখানে। আবার জোরাজুরি থাকবে না কোনো। পাখিরা নিজে থেকে এসে ধরা দিতে প্রস্তুত সর্বদা…
নেই কোনো রিস্ক!
মিলা দম ফেলে। হাতের উল্টোপাশ দিয়ে কপালের ঘাম ফোঁটা মুছে নিতে নিতে বিড়বিড় করে বলল, ‘পুরুষ মাইনষের মন বোজা বড় দায় গো বাবা!’

ঘরদোর পরিষ্কার শেষে একটা প্লেটে কয়টা গরম ভাত আর একটু ডাল নিয়ে আসলো মিলা। রতির পাশে বিছানায় বসল। ভাত চটকে রতির মুখের সামনে এক লোকমা ধরলো। বিরক্তি স্বরে বলল, ‘হা করো।’

রতি আকাশের দিক থেকে মুখ ঘোরায়। ফ্যালফ্যাল চোখে মিলার দিকে তাকায়, মিলার বুক কাঁপে। খারাপ লাগে আচমকা। না জানি কার মেয়ে, কোন মায়ের বুক খালি হয়ে গেছে! নিশ্চয়ই মেয়েটি বিবাহিতা,স্বামী কী পাগলের মতোন খুঁজছে? নাকি ভেবে নিয়েছে আর ফিরবে না সে,তাকে নিয়ে না পড়ে থেকে অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলা উচিত! কম দিন তো হলো না!
এতদিন ভোগের বস্তু হয়ে ছিল, আজ রাতে হয়তো জীবনের শেষটুকুও শেষ হয়ে যাবে।
ইশ! মিলা চোখ ফিরিয়ে নিল। কোনোরকমে পুনরায় বলল, ‘হা করো না ক্যান? চাইয়া রইছ ক্যান?’
‘একটু পানি দিবেন? খুব তৃষ্ণা পেয়েছে।’ ভারী জিভ টাকে বহু কষ্টে নেড়ে এই কয়টা শব্দ উচ্চারণ করল রতি।
মিলা ব্যতিব্যস্ত হাতে দ্রুত পানি খাওয়ালো রতিকে। রতির স্বাদ নেই মুখে, গন্ধও পায় না ভালো। পেটে রাজ্যের ক্ষিদে, অথচ মুখে অরুচি। দুই লোকমা খেয়ে আর খেতে চাইলো না। মিলাও জোর করল না। পানি খাইয়ে, মুখ মুছিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।

রতি আবার আকাশের দিকে চাইলো। এই আকাশই এখন তার একমাত্র সঙ্গী। আকাশের সাথে এটা সেটা নানানসব গল্পে মজে থাকে রতি সারাদিন, তবে সবটাই মনে মনে। সেই সব গল্পের বেশিরভাগই দুঃখের গল্প আর স্বপ্নের গল্প! জীবনে কিছু কিছু স্বপ্ন দেখেছিল সে, যেগুলো কোনোদিন পূরণ হয়নি, হবেও না….!

রতির চোখের কোল ঘেঁষে কয়েকটা পানি পড়ে। সে চোখ বুজে কয়েক মিনিট স্থির রইল, এরপর ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই, একটা খুব পরিচিত, চেনা, প্রিয় মুখ চোখের রেটিনায় গিয়ে ধাক্কা মারল। রতির দুই ঠোঁট আলগা হয়ে গেল অজান্তেই। শ্বাস নিতে ভুলে গেল রতি। সে তাকিয়ে আছে, তাকিয়ে আছে নির্নিমেষ… এ কাকে দেখছে সে? এটা কী স্বপ্ন? সে কী ঘুমে? জাগরণ অবস্থায় কোনোদিন আহ্নির মুখটা সে দেখতে পারবে, ভাবেইনি….
রতির দুই চোখের বাঁধ ভেঙে যায়। মনটা হু হু করে উঠল। চোখ ছাপিয়ে নামল জলের ধারা।

কাঁদছে আহ্নিও… জানালার ওপাশে রতির আদুরে মুখটা,তবে এখন বড্ড বেশি ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ঠোঁট দুটো শুষ্ক ছিল, এখন চোখের জলে ভিজে গেছে। ডান গালে বড় কাটার দাগ, এখনো শুকায়নি ভালো করে। জ্বলজ্বল করছে দাগটি, রতির হাত যে বাধা, আহ্নি বুঝতে পারল। দ্রুত চোখের জল হাতের ডানায় মুছে নিল। সতর্ক চোখে পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখল, কেউ নেই। দরজা বন্ধ।

আহ্নি অস্ফুটস্বরে ডাকল, ‘ভাবি…’
গলা কাঁপছে তার। কাঁপছে পুরো শরীর। আল্লাহ পাকের দরবারে লক্ষ কোটি বার শুকরিয়া জানিয়েছে ইতিমধ্যেই মনে মনে। এবার রতিকে উদ্ধার করতে পারলেই হলো।

আহ্নি চাপা গলায় আবার ডাকল, ‘ভাবি.. ভাবি শুনতে পাচ্ছো?’
শরীরে জোর ফিরে পেয়েছে রতি। আহ্নিকে দেখামাত্র তার সমস্ত ভয় চলে গেছে। একটু আগেও নিজের মৃত্যু কামনা করছিল ও, আর এখন সব ভাবনা পাল্টে যাচ্ছে।
রতি ফিসফিসিয়ে জবাব দিল, ‘আহ্নি.. তুমি এখানে কীভাবে? কীভাবে উঠলে এত উপরে?’
‘পাইপ দিয়ে ভাবি। সেটা বাদ দাও। এই বাসায় কয়জন আছে? বলতে পারবে?’
‘একজন।’
‘মিলা নাম করে, উনি?’
‘হুম।’
‘আচ্ছা, ভাবি তুমি চিন্তা করো না। আমি আসছি ভাবি। তোমাকে আমি বাঁচাবোই।’
রতি কেঁদে ফেলল। গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে লাগল। আহ্নির বুক খামচে ধরছে নাম না জানা এক ব্যথা। সেই ব্যথার তীব্রতায় শ্বাস নেওয়া কষ্টকর হয়ে উঠছে আহ্নির জন্য। সে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আহ্নি বলল, ‘কান্না থামাও ভাবি। তুমি এভাবে কাঁদলে আমার কী অবস্থা হবে? আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি তো। আমি দুর্বল হলে তোমাকে বাঁচাবো কীভাবে ভাবি? তুমি প্লীজ কান্না থামাও।’
রতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। কথা দিল, আর কাঁদবে না। অবশ্য সেই কথা, খুব বেশিক্ষণ রক্ষা করতে পারল না রতি।

আহ্নি নিচে নেমে এলো। স্কুল লাইফ থেকে সে স্কাউটিং করছে, কলেজে উঠে রোভার স্কাউটিং-এ ভর্তি হয়েছে। সেই জন্যে এসবের ছোটখাটো ট্রেনিং আছে তার।রতির জন্য এর চেয়েও বড় বিপদে যদি ঝাঁপ দিতে হতো তাকে, সে অনায়াসে চোখ বুঝে ঝাঁপ দিতো।

প্রান্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে, মুখ থমথম করছে তার। সে চেয়েছিল উঠতে, আহ্নি ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়েছে। নিজে উঠেছে। নিজে যে পারে, সেটাই কী প্রমাণ করতে চাইছে? এই ঝামেলা শেষ হোক, সে অতি অবশ্যই পানিশমেন্ট দিবে আহ্নিকে, মনে মনে ঠিক করল প্রান্ত। আহ্নি এসে তাকে সব বলতেই, প্রান্ত বলল, ‘পুলিশকে গিয়ে জানাই চলো। ওরাই উদ্ধার করতে পারবে ভাবি কে।’
আহ্নি বাধা দিল, ‘উঁহু, না। আমি পুলিশকে জানাতে চাচ্ছি না।’
‘কেন?’ প্রান্ত অবাক।
আহ্নি কুটিল করে হাসল, তারপর প্রান্তের হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো বিল্ডিংয়ের পাশে। রাস্তাটা পেছনের দিকে বলে, লোক চলাচল খুব কম। তার উপর দুপুর, তাই রাস্তা আরও খালি।

আহ্নি বলল, ‘তুমি উপরে উঠতে পারবা তো?’
প্রান্ত এক সেকেন্ড সময় নিয়ে বলল, ‘পারব।’

‘তাহলে যাও, ওঠো। একদম ছাদে চলে যাবা ওকে?’

‘কেন?’

‘সেটা পড়ে জানতে পারবা। যেটা বলছি করো।’

প্রান্ত আহ্নির কথা আগামাথা কিছুই বুঝতে পারল না। এখন গিয়ে পুলিশকে ডেকে নিয়ে আসলেই তো হয়। ভাবিকেও বাঁচানো যাবে, আবার হাতেনাতে ধরা যাবে মফিজুল কে। প্রান্ত এই অতি সাহসী আহ্নি মেয়েটাকে বোঝার চেষ্টাও করল না। একবার রাস্তার এদিক ওদিক দেখে নিল, কেউ নেই কোথাও। ভাগ্য আজ খুব বেশিই প্রসন্ন বুঝি তাদের উপর।
প্রান্ত ‘বিসমিল্লাহ’ বলে পাইপ বেয়ে উঠতে শুরু করল। দোতালায়, পাইপের পাশেই জানালা, সেই জানালায় একবার উঁকি দিয়ে দেখল, বিবর্ণ রতি উৎসুক চোখে এদিকেই তাকিয়ে। প্রান্ত চমকে উঠল, কী অবস্থা উনার! উজ্জ্বল চামড়া এখন মৃত প্রায়। গাল দুটো বসে গেছে। চোখ কোটরে, শুকিয়ে গলার হাড্ডি ভেসে উঠেছে। উনাকে কী ধর্ষণ করা হয়েছে? ভাবতেই প্রান্তের ব্রক্ষ্মতালু রাগের উত্তাপে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। রতির সঙ্গে একটি কথাও বলল না, অতি দ্রুত সাবধানে উঠতে উঠতে ছাদের দেয়াল ধরতে পারল। তারপর ছাদে উঠে এলো। প্রান্ত যখন ছাদে উঠতে সফল হয়েছে, আহ্নি তখন পাইপ বেয়ে দোতালা অবধি উঠে গেছে। রতির সাথে দু-চারটা কী যেন বলল, তারপর আবার উঠতে শুরু করেছে।

প্রান্ত অবাক, অবাক এই ভেবে যে কীভাবে পারল পাইপ বেয়ে এতটা উপরে উঠতে! চারতলা… কম না তো। আবার আহ্নিও উঠে আসছে। পরিস্থিতি মানুষ কে কত শক্তিশালী, সাহসী বানিয়ে দিতে পারে, আজ সেটার স্বচক্ষে প্রমাণ মিললো তার।
আহ্নিকে ধরে টেনে ছাদে তুললো প্রান্ত। ছাদে পা রেখে দম ফেলার সুযোগ পেল না, আহ্নি শীতল কণ্ঠে বলল, ‘শোনো, আমরা দু’জনে ডোরবেল বাজাবো। কিন্তু লুকিয়ে থাকবো। ওই মহিলা যেই না দরজা খুলবে, ওমনি হামলা করব, বুঝছো?’
‘কিন্তু এত কষ্টের কী দরকার? চাইলেই তো পুলিশের হেল্প নেওয়া যায়। ফ্ল্যাটের অন্য মানুষদের বললে তারাও হেল্প করবে আমাদের।’
‘সবাই কে জানালে যেটা আমি করতে চাই, সেটা যে করা সম্ভব না প্রান্ত।’

প্রান্ত অনেকটাক্ষণ আহ্নির দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইল। তারপর একসময় নির্লিপ্ত কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘কী চাও তুমি?’
প্রত্যুত্তরে হাসি ছুঁড়ে দিল আহ্নি, ধারালো, তীক্ষ্ণ, ফলার মতো হাসি। প্রান্তের বুক এফোঁড়ওফোঁড় করে দিল। প্রান্ত ধক করে উঠল। আহ্নির মনের কথা পড়তে পেরেছে সে। না, না, এটা কোনোভাবেই হতে পারে না। আহ্নির হাতে হাতকড়া পরিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ…
দৃশ্যটি প্রান্ত কোনোভাবেই সহ্য করতে পারবে না। কল্পনায় দৃশ্যটি চোখের সামনে ভাসতেই, প্রান্তের হাত-পা কাঁপতে লাগল। আহ্নিকে অনেক কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারল না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।

আহ্নি যেন বুঝল, প্রান্তের বুকের উপর, ঠিক যেখানে হৃদপিন্ডের অবস্থান, সেই জায়গার উপর হাত রেখে, ধীরস্থির গলায় আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘কিচ্ছু হবে না। আই হ্যাভ মাই প্ল্যান।’
এরপর আর প্রান্ত কিচ্ছুটি বলতে পারল না। অদ্ভুত জট তাকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে থাকল।
আহ্নি প্রান্তকে নিয়ে দ্রুত নিচে নেমে আসে। প্রতিটি ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ, কেউ তাদের দেখলে সমস্যা, তাই এক প্রকার দৌড়ে দোতলার ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়াল। বুকে মৃদু কাঁপন। হঠাৎই সাহস হারিয়ে ফেলেছে আহ্নি। দরজায় শব্দ করতেও ভয় লাগছে তার। কিন্তু কীসের ভয়? কেন হচ্ছে? আহ্নি বুঝতে পারল না।

সে চোখ বুজলো। চোখের পর্দায় ভেসে উঠল রতির বিধ্বস্ত মুখখানা। একটা বিছানায় অবহেলায় পড়ে থাকা কাপড়ের মতোন পড়ে রয়েছে সে,আজ কতদিন হলো! হাত-পায়ে শিকল… রতি বলল, ওকে নাকি খেতে দেয় না ঠিকঠাক। আর যা দেয়, তা ভালো লাগে না। পানিও খেতে দেয় না ঠিক মতোন। কতদিন ধরে নাকি বাথরুমের চেহারাও দেখে না। যা হয়, সব শুয়ে বসেই করতে হয়।

যখন দ্বিতীয়বার পাইপ বেয়ে দোতালায় উঠছিল, তখন এসব বলছিল রতি। সে ওয়াদা করেছে কাঁদবে না, তাই কাঁদেনি, কিন্তু তার লাল টকটকে চোখ দুটো বলে দিয়েছে অনেক কথা….!
সব কথা ব্যথার, সব উক্তি কষ্টের৷
নিঃশ্বাসটাও নাকি যন্ত্রণা দেয় রতিকে।

আহ্নি চোখ খুললো। তার চোখে জ্বলজ্বল করছে ধিকি ধিকি আগুন। প্রান্ত অবাক হয়ে দেখলোই…
আহ্নি ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি এই দেয়ালে চুপচাপ হেলান দিয়ে দাঁড়াও। আমি বেল বাজিয়ে ওই টবের পেছনে গিয়ে লুকাবো। ও দরজা খুললেই তুমি সর্বপ্রথম ওর মুখ চেপে ধরবে। তারপর সেকেন্ডের মধ্যে ওকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে নিয়ে যাবে। ওকে?’
প্রান্ত বুক ধড়ফড়ানি নিয়ে বলল, ‘ওকে।’

দরজার পাশে যে দেয়াল, সেখানে মিশে দাঁড়াল প্রান্ত। ভেতর থেকে ম্যাজিক আই-এ চোখ দিয়েও দেখতে পারবে না মিলা। আহ্নি বড় করে দম টানলো। একবার প্রান্তের দিকে তাকাল। প্রান্ত চোখ ইশারায় আশ্বস্ত করল। আহ্নি কলিং বেল টিপ দিয়ে প্রায় নিঃশব্দে দৌড়ে গিয়ে বড় পাতাবাহারের টব টার পেছনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল।
মিনিট গড়ায়, এক, দুই, তিন… খুলল না।

মিলা বাথরুমে বসে শুনতে পেল, কলিং বেল বাজছে। এই অসময়ে কে আসবে? ভেবে পেল না মিলা। এদিকে পেটটা বড্ড ব্যথা, বাথরুম ফেলে যাওয়ার উপায় নেই। তিন মিনিট পর বাথরুম থেকে বের হয় মিলা। মনে মনে হিসেব কষে, যেহেতু আজকে ওই মেয়েকে হত্যা করা হবে, তাই হয়ত হাফ বেলা কাজ করেই বাসায় ফিরে এসেছে মফিজুল। একটা পিপারেশনের ব্যাপার আছে তো নাকি?

মিলা দরজার ম্যাজিক আই-এ চোখ রাখল। কেউ নেই…
অবাক মিলা। চোখে সরিয়ে নিল, ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবছে সে, তখন আবার বেল বেজে উঠল। মিলা সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিক আই-এ তাকাল, এবারও কাউকে দেখতে পেল না। কোনো ছোট বাচ্চা না তো?
হয়তো ছোট বলে দেখা যাচ্ছে না।
মাথামোটা মিলার গোবর মার্কা মাথায় একবারও এই ভাবনা এলো না যে, একটা বাচ্চা যদি খুব ছোটোই হয়, তাহলে সে কলিং বেল বাজাবে কী করে? কলিং বেল তো অনেক উঁচুতে….

দরজা খুললো মিলা। কাউকে দেখতে না পেয়ে তার কোঁচকানো ভ্রু আরও কুঁচকে গেছে। এক পা বাইরে ফেলতে ফেলতে বলল, ‘কে?’
চোখের পলকে ঘটে গেল কয়েকটা কান্ড।
দেয়ালের সামনে থেকে সরে এলো প্রান্ত। হিংস্র বাঘের মতো ঝাপিয়ে পড়ল মিলার উপর। মিলা যখন বুঝতে পারল, বেগতিক ঘটনা, সে চেঁচাতে চাইল। ততক্ষণে প্রান্ত হাত দিয়ে তার মুখ চেপে ধরেছে। মিলা ছটফট করতে লাগল। প্রান্ত একটা ধাক্কার মতো দিয়েই মিলাকে ফ্লোরে ধপাশ করে ফেলে দিল। ঘরে ঢুকলো আহ্নি, দরজা আঁটকে দিল। নিজের ওড়না খুলে দ্রুত মিলার হাত জোড়া বেধে দিল। প্রান্ত তখনো মুখ ধরেই রেখেছে।
আহ্নি দৌড়ে দৌড়ে খুঁজতে লাগল। টিভি আছে ঘরে। টিভির পাশেই কালো কস্টেপ পেল। সেটা এনে মিলার মুখে লাগিয়ে দিল। তারপর মিলার গা থেকে ওড়না নিয়ে পা-জোড়া বেধে ফেলল। মিলা অবাক চোখে চেয়ে.. আহ্নির মতো এরকম পুঁচকে একটা মেয়ে যে এত দুঃসাহসিক কান্ড করে ফেলতে পারবে, সে না দেখলে বিশ্বাসই করত না।

এরপর শুরু হলো আসল তান্ডব। মিলাকে ইচ্ছেমতো মারতে শুরু করল আহ্নি। প্রান্ত হাত লাগাল না, সে দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। চুল গুলো মুঠি পাঁকিয়ে ধরে হ্যাঁচকা টানে ফ্লোরের কাছে মাথা নিয়ে গেল, তারপর অবিরত মাথা ঠুকতে লাগল। মুখ দিয়ে একটাই কথা বের হচ্ছে, ‘আমার ভাবিকে তোরা কেন মারলি… কেন এত কষ্ট দিলি উনাকে… তোদের আমি ছাড়ব না। আমার কলিজায় হাত দিছোস। তোদের দুইটাকে আমি খুন করব, খুন…’

মিলার মাথা ফেটে গেছে। রক্তে সাদা ফ্লোর লাল হয়ে উঠেছে। তবুও থামাথামি নেই আহ্নির। ও পাগল হয়ে গেছে। প্রতিশোধের আগুন ওর রক্তে রক্তে ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রান্ত আহ্নিকে ঝাপটে ধরে দূরে সরিয়ে আনলো। অজ্ঞান, অচেতন মিলা পড়ে রইল রক্তের উপর। আহ্নি কাঁদছে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, প্রান্তের বুকের মধ্যে ঘুষি মেরে বলল, ‘আনলে কেন? ওকে আমি কোপাবো…’
‘একদম না আহ্নি। তুমি পাগল হয়ে গেছ। তোমার পাগল হওয়াটা স্বাভাবিক জানি, কিন্তু তাই বলে কোনো হত্যা তুমি করতে পারো না। এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। তুমি রতি ভাবির কাছে যাও। আমি পুলিশে ফোন দেই।’

রতি উৎসুক হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে। আহ্নিরা যে ঘরে ঢুকেছে সে বুঝতে পেরেছে। যখন কলিং বেল বেজে উঠেছিল, তখনি বুঝতে পেরেছে এটা আহ্নির কাজ। বাইরে ধুপধাপ শব্দ, তারপর কারও গোঙানি, আর আহ্নির রেগে রেগে কথা বলা, সবটাই রতির কর্ণকুহরে এসেছে। যখন আহ্নি বলল, ‘তুই আমার কলিজায় হাত দিছোস’ তখন রতি থমকে গেছিল একেবারে। তার হাত-পায়ের শিরায় শিরায়, রগে রগে, মিশে গেল প্রশান্তি। নাহ, সে জিতে গেছে। এত এত দুঃখ, কষ্টের পরেও তার নিজেকেই বিজয়ী মনে হচ্ছে। কারণ কেউ একজন আছে, যে তাকে বুকের মধ্যিখানে স্থান দিয়েছে….
রতি নিজের ওয়াদা রাখতে পারল না আর। কেঁদে ফেলল। আহ্নি ঘরে ঢুকলো। দৌড়ে এসে রতির হাত-পা বাধন মুক্ত করে রতিকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
ক্ষতবিক্ষত,বিষের জ্বালায় জর্জরিত শরীর মুহূর্তেই প্রশান্তিতে ভরে উঠল। একটা স্নিগ্ধ সুখ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল।
রতির বুকে থামা রাখল আহ্নি। ওই ধুকপুকানি তার হৃদয়ের ধুকপুকানি কমিয়ে দিল একেবারে। এভাবে কতক্ষণ দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে ছিল জানা নেই।

একসময় প্রান্ত এসে বলল, ‘পুলিশ এসেছে।’
দু’জনের ধ্যান ভাঙল তখন। রতিকে ধরে ধরে দাঁড়া করাতে চাইল আহ্নি, মাটিতে পা ফেলতেই রতি বসে পড়ল আবার। পায়ের পাতা সিগারেটের আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল মফিজুল। ব্যথায় পা রাখা দায়।
আহ্নির চোখ বেয়ে থেমে যাওয়া জল আবার গড়িয়ে পড়ল।

পুলিশরা ফ্ল্যাটে ঢোকে। আহ্নি, প্রান্তের মুখ থেকে সব শোনার পর, ক্ষণকাল আহ্নির দিকেই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারা।সিনেমায় ঘটা কান্ড যে বাস্তবেও ঘটতে পারে, তাদের বিশ্বাস করতে সময় লাগে ব্যাপারটা।
একসময় আহ্নির মাথার উপর একটা হাত রাখে দারোগা, খুশি খুশি গলায় বললেন, ‘বড় হয়ে এই সেক্টরে এসো। ক্রিমিনালরা তোমার ভয়ে সিধিয়ে থাকবে।’
আহ্নি হাসল, সেই হাসির কোথাও কোনো মন খারাপের গল্প নেই। সেই হাসি চমৎকার হাসি।

এম্বুলেন্স ডাকা হয়। রতিকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় পর্যাপ্ত চিকিৎসার জন্য।রতির সাথে আহ্নিও গেল। লেডি কন্সটেবল এসে মিলাকে তুলে নিয়ে গেল। ঘর তল্লাশি করে কয়টা মদের বোতল,অসংখ্য সিগারেটের প্যাকেট, আর এক প্যাকেট মাদক পেল পুলিশ। আরও পেল রামদা, ছুরি…
প্রান্তকে নিয়ে তারা রতির অফিসে গেল। প্রান্ত চিনিয়ে দিল, মফিজুল আলমকে। আলম সাহেব কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে গ্রেফতার করল পুলিশ। পুলিশ আশ্বস্ত করল, সে যেই অপরাধ করেছে তার যথোপযুক্ত শাস্তি তাকে দেওয়া হবেই হবে…

কাহিনী এখানেই শেষ? না, শেষ না। আর একটু আছে…

__________
ঝুম বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট সব তলিয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় কাঁদা। ঝিল পাড়ের সব বাড়ি ঘুমিয়ে আছে। ঠান্ডা পরিবেশ, শীত শীত আবহাওয়া। শুধু ঘুমিয়ে নেই রতির বাড়ি….
আজ আহ্নির গায়ে হলুদ হবার কথা। আত্মীয় স্বজন তেমন নেই, আবার আছেও! আহ্নির, প্রান্তের বন্ধু-বান্ধবী, দুপুর ও এসেছে। নাছির মাহতাব ও এসেছেন। লিলি বেগম আর আরাফ আসেনি। ওরা এই বিয়েতে মোটেও রাজী নয়। রাজী না হওয়ার কারণ, প্রান্ত এতিম ছেলে…
কিন্তু রতির মনে হয়,প্রান্তের চেয়ে চমৎকার বর আর হতেই পারে না আহ্নির জন্য। আহ্নির মত দুঃসাহসী, আর পাগলি মেয়েকে একমাত্র প্রান্তই হ্যান্ডেল করতে পারবে।

রতি রান্নাঘরে কাজ করছিল, তখন গন্ডগোল শোনা গেল। রতি বের হবে, তখনি দুপুর ঢুকল। বলল, ‘আহ্নি গায়ে হলুদ লাগাতে দিচ্ছে না ভাবি।’
‘কেন?’
‘বলছে তুমি সবার আগে হলুদ লাগাবা তারপর বাকি সবাই।’

রতির বুক ভরে গেল।
সে প্রশান্তি সমেত রান্নাঘর ছাড়ে। ছেলে-মেয়েদের হৈ-হুল্লোড়ে ছাদে কান ফাটার অবস্থা। এক কোণে একটুখানি আসন আহ্নির জন্য, ছোট করে সাদামাটা ভাবে দু’জনের গায়ে হলুদ হচ্ছে। প্রান্তকে বসানো হয়েছে ছাদের অন্য কোণায়…

রতিকে দেখামাত্র গালটাকে আরও ফুলিয়ে ফেলল আহ্নি। রতি ছদ্ম গম্ভীর ভাবে বলল, ‘প্যাচার মত মুখ করে থাকিস না। লোকে ভাববে বিয়ে ভেঙে গেছে।’
‘যে বিয়েতে তুমি নেই, সেটা এমনিতেও করব না আমি।’
‘আমি কই নেই? আছি তো।’
‘কচু আছো। খালি এদিক সেদিক, আমার ধারে এসে দুই মিনিট বসেছো?’

দুপুর হাসতে হাসতে বলল, ‘ভাবি ওর কাছে বসো তো। ওর সঙ্গে তোমারও হলুদ করে ফেলি আবার। ওর কলিজাও ঠান্ডা হোক।’
আহ্নি চোখ বড় বড় করে ফেলল, ‘দারুন আইডিয়া আপা। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার সঙ্গে ভাবিরও হলুদ করা হোক।’
‘মারব এক চড়…’ ঠোঁটের হাসি দ্বিগুণ হয়ে গেছে রতির, ‘উল্টাপাল্টা আর একটাও কথা না। চুপ করে বয়।’

ধমক খেয়ে মুখ ফুলালো আহ্নি। রতি বাটি থেকে একটুখানি হলুদ তুলে নিল, তার হাত কাঁপছে। প্রাণের চেয়েও প্রিয় এই বোনটির কাল বিয়ে হয়ে যাবে…
ভাবছে আর বুক মোচড় দিচ্ছে।
রতি আহ্নির কপালে ধীর হাতে হলুদ ছোঁয়ালো, বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘ওদের বিবাহিত জীবন সুন্দর হোক, সুখের হোক, চমৎকার হোক।’
‘আর আমার ভাবিও আমার সাথেই থাকুক..’ বলে উঠল আহ্নি।
রতি চোখ গরম করে তাকাল, আহ্নি জিভ বের করে ভেঙচালো।

কেউ একজন এসে বলল, ‘প্রান্ত হলুদ মাখাচ্ছে না। ও বলছে, আগে রতি ভাবির হাতে মাখবে।’
আহ্নি কাটাকাটা গলায় জবাব দিয়ে দিল, ‘ওকে গিয়ে বলো, আমার সুখে ভাগ না বসাতে। হলুদ না লাগালে নাই, বিয়েও হবে না। তাও আমার ভাবি কোত্থাও যাবে না।’
রতি সত্যি সত্যি আহ্নির গালে একটা চড় দিয়ে বসল। আহ্নি থমকে গেল, চোখ বড় বড় করে তাকাল। রতির দুঃখ হলো, কেন মারতে গেল আচমকা! রতি ভাবল, সরি বলবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বেহায়া আহ্নি অপর গাল পেতে বলল, ‘এখানেও মারো ভাবি। নইলে বিয়ে হবে না আমার।’
উপস্থিত সবাই আকাশ কাঁপিয়ে হেসে উঠল। বৃষ্টি ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে। এই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির মধ্যে একদম অন্যরকম ভাবে আহ্নি-প্রান্ত’র গায়ে হলুদ সম্পন্ন হলো।

সন্ধ্যার পর শুরু হলো নাচ-গান। আহ্নির জনাকয়েক বান্ধবী নেচে নেচে ছেলেদের মনোযোগ আকর্ষণ করছে। তিশা নামের যে মেয়েটা ওর তো ইতিমধ্যেই শিহাব নামের একটা ছেলের সাথে ভাব জমে গেছে। রতি সবদিকেই চোখা চোখ রাখে, তাই কোনকিছু তার দৃষ্টির বাইরে হতে পারে না।
আবির আর ওর পরিবার এসেছে। আবির দুইদিন আগে সৌদি থেকে এসেছে, একদম পাঁচটি বছর পর!
আরও দুই বছর থেকে আসতে চাইছিল,আহ্নির জোরাজুরিতে পারল না। আহ্নি সাফ সাফ বলে দিয়েছে, আবির না আসলে সে কোনোভাবেই বিয়ে করবে না। এই খবর শুনে প্রান্তের খাওয়া দাওয়া আঁটকে গেছিল। রোজ দুই বেলা নিয়ম করে আবিরকে কল করত, আর বলত, ‘ভাই, পায়ে পড়ি ভাই৷ আসেন বাংলাদেশে। আপনার জন্য আমি বউ পাচ্ছি না মিয়া। গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আর কতকাল? বুড়ো হয়ে গেলাম তো।’

শেষমেশ আবিরকে আসতেই হলো এই দুই বিচ্ছুর তোপে পড়ে।
শিমি টা কত বড় হয়ে গেছে! আর কয়মাস পর শিমি আর দুলাভাই বিদেশ চলে যাবে, শিমির মায়ের কাছে। ওখানেই পারমানেন্টলি থাকার কথোপকথন চলছে তাদের।

রাত নয়টার দিকে সবাই হলুদের বিরিয়ানি খেতে বসল।খাওয়ার সময়েও মানুষের চেঁচামেচি কমল না। আবিরের মাথা ধরে গেছে এত কোলাহলে। বিদেশে তো সবসময় নিরিবিলিই থাকা হতো।

আবির নিজের প্লেটটা নিয়ে প্যান্ডেলের বাইরে এসে বসে। ছাদের পেছন দিকে, ওখানে ভীড় নেই তেমন। মুক্ত বাতাসে আবিরের মন ভালো হয়ে যায়। খাওয়ার সময় হেঁচকি উঠে আবিরের, পানি কই? পানি তো নিয়ে আসেনি। এখন আবার পানি আনতে যাও! উফ!
আবির উঠবে, এমন সময় কেউ একজন তার দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘পানি।’
আবির তাকাল, দুপুর দাঁড়িয়ে। লাল-হলুদের মিশেলে শাড়ি পরনে,লম্বা চুলগুলো খোলাই রেখেছে, হাত কাঁপছে তার। কাঁপছে পানির গ্লাসটাও। আবির অপ্রস্তুত হয়ে গ্লাস নিল, তারপর দুই নিঃশ্বাসে সব পানি শেষ করে।

দুপুর বলল, ‘গ্লাসটা দিন।’
‘কেন?’
‘রেখে আসি।’
‘দরকার নেই, আমি পারব।’

দুপুর কথা বাড়ায় না, চুপ হয়ে থাকে। চেয়ে থাকে দূরে কোথাও, অজানা গন্তব্যে..
আবিরের অস্বস্তি হয়। কেন যাচ্ছে না ও? খেতে পারছে না আবির।
ক্ষণকাল দু’জনের মাঝেই নিরবতা বিরাজ করে। টিকতে না পেরে একসময় গম্ভীর গলায় আবির বলল, ‘কিছু বলবে?’
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় দুপুর, ‘হুঁ।’
‘কী?’
‘লাইফে মুভ অন করছেন না কেন?’
‘তা দিয়ে তোমার কী দরকার? তুমিও তো লাইফে মুভ অন করছ না।’
‘আমার লাইফ একটা জায়গায় থেমে গেছে। বলে না, সব চেয়ে বড় পাপীরও বিনাশ হয়। আমারও বিনাশ হয়ে গেছে।’

আবির তাকাল, দুপুরও তাকিয়ে। দুই জোড়া চোখ এক হলো। এদিকটায় আলো কম, লাইটিং করা হয়েছে প্যান্ডেলের মধ্যে। আবছা আলো, আবছা অন্ধকার, এই আলো-আঁধারির খেলার মাঝে আবির দেখল, দুপুরের চোখ জোড়া পানিতে টলমল, যেন এক গুচ্ছ সচ্ছ পানির দীঘি বয়ে বেড়াচ্ছে তার চোখে দুপুর।
আবিরের কেমন যেন লাগল, সে সাথে সাথে নিজের চোখ সরিয়ে নেয়। দুপুরের বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। সেও চোখ সরায়।

‘তুমি এখন যাও দুপুর। তোমার উপস্থিতিতে আমি খেতে পারছি না। আমার পেটে অনেক ক্ষুধা।’
‘আপনার আম্মা আমাকে ফোন করে প্রায়শই।’ আবির ভ্রু কুঁচকে তাকাল কথাটি শুনে। দুপুর একটু থেমে বলল, ‘আপনি নাকি আর কোনোদিন বিয়ে করবেন না, সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই নিয়ে সে অনেক আপসেট। আমাকে ফোন দিয়ে এটাসেটা অনেক কিছু বলে। আমিই নাকি আপনার জীবন ধ্বংসের পেছনে দায়ী। তাই অনুরোধ করব, লাইফে আগান। আমাদের সম্পর্ক খুব বেশিদিন ছিল না। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ পাঁচটি বছর। আমার বিশ্বাস, এতগুলো দিনে আমি আপনার মন থেকে পুরোপুরি ভাবে মুছে গেছি। তাই এখন অন্য কাউকে গ্রহণ করতে গেলে আপনার কোনো প্রবলেমই হবে না আশা করি।’

নিশ্চুপ আবির একসময় মুখ খুলে বলল, ‘হুম, দেখি…’
‘তাহলে আমি ধরে নিলাম, আপনি সেকেন্ড বিয়ে করছেন৷ তাই তো?’
‘দেখা যাক…’
বুক মোচড় দিয়ে উঠলেও ঠোঁটে হাসি এঁকে।নিরবে প্রস্থান করে দুপুর। আবিরের অনুপস্থিতি তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়েছে, ভালোবাসা কী, ভালো মানুষের মর্যাদা কতখানি, জীবনের আসল সুখ কোথায়….

রতির পাশ কাটিয়ে প্যান্ডেলে গিয়ে ঢুকল দুপুর। রতি দূর থেকে দেখছিল দু’জনকে। কথাবার্তা শোনেনি, কিন্তু দুপুরের মুখ দেখেই বুঝে নিয়েছে অনেক কিছু….
রতি ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে আবিরের পেছনে গিয়ে উপস্থিত হয়। আবির চমকে উঠল। পরমুহূর্তেই নিজেকে ধাতস্থ করে বলল, ‘ওহ ভাবি আপনি! আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম।’
ভণিতা করে না র‍তি। সোজাসুজি বলল, ‘জীবন যদি হাজার বার চান্স দিতে পারে একটা মানুষকে, তারপরও মানুষ কেন থেমে থাকে বলবেন ভাইয়া? জীবন যা দেয়, তাই কুড়িয়ে নেওয়া উচিত। লাইফ কত ছোট শব্দ!’
আবির চুপ করে রইল।
রতি বলল, ‘তাকে ভালোবাসুন, যে আপনাকে ভালোবাসে। যে আপনাকে ভালো বাসা তো দূর, আপনাকে নিয়ে কোনোকিছু কল্পনাও করে না, তাকে ভালোবাসার কোনো প্রশ্নই আসে না। আমি যখন মফিজুলের হাতে বন্দী ছিলাম, আকাশের দিকে তাকালেই আপনাদের সবার মুখ ভেসে উঠতো চোখের পর্দায়। তখনো আপনাকে ভাই হিসেবে দেখতাম, আজও দেখি। আশা করি বুঝবেন, কী বুঝাচ্ছি।’

আড়ষ্টতায় জমে গেছে আবির। মাথা তুলে রতির চোখে চোখ রাখার মতো সাহস পাচ্ছে না।
রতি বলে চলে, ‘আহ্নি আমাকে যতটা ভালোবাসে, ততটা দুপুরও আমাকে ভালবাসে। আরাফ দ্বিতীয় বিয়ে করেছে আরও দুই বছর আগে। যেদিন বিয়ে করেছে, তার আগের দিনই দুপুর সব ছেড়ে আমার কাছে চলে এসেছে। আমি ওর কে? কেউ না কিন্তু। যারা ওর রক্তের, তাদের ফেলে আমাকে বেছে নিয়েছে।তাহলে বুঝুন, ওর কতটা পরিবর্তন হয়েছে। আমি দেখেছি,ওর চোখে আপনার জন্য কিছু একটা দেখেছি। আপনার নাম ওকে লজ্জা দেয়, আপনার উপস্থিতি ওকে অস্বস্তিতে ফেলে। আপনাকে দেখলে ওর হৃদ স্পন্দন যে বেড়ে যায়, আমি বাহির থেকে দেখলেই বুঝি। আপনিও দেখুন, বুঝুন, চোখ থাকতেই চোখ মেলে তাকান। নইলে আজীবন অন্ধই থাকবেন। জোর করছি না। জীবনে এগিয়ে যান, দোয়া করি। মরিচীকার পেছনে ছুঁটবেন না দয়া করে।’

রতি চলে আসে। কথাগুলো অনেক রুড হয়ে গেছে, সে জানে। কিন্তু এই কয়টা কথা শোনা খুব বেশি দরকার ছিল আবিরের জন্য। এই ছেলে যেভাবে তার অপেক্ষায় বসে ছিল, নির্ঘাত চিরকুমার থাকতে হতো আজীবন। রতি তাকে ভাইয়ের চোখে, সেই নজর কোনোদিন স্বামী বা প্রেমিকের নজরে রূপান্তরিত হবে না….

রাত গভীর, বাজে বোধহয় দুইটা-তিনটা! সবাই ঘুমিয়ে গেছে। কেউ কেউ স্টেজের উপরেই ঘুউউউম…
ভোরে উঠে কত কাজ করতে হবে! একটা বিয়ে মানে কম না,সে যতই কম মানুষ থাকুক। আহ্নি ছাদের পেছন দিকে, টাংকির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। তার গায়ে হলুদের শাড়ি, সাজটাও নষ্ট হয়নি এখনো। প্রান্ত ভ্রু কুঁচকে তার দিকে এগিয়ে গেল।

‘এত রাতে ডাকলে যে ম্যাসেজ দিয়ে? কোনো সমস্যা?’

দুষ্টু আহ্নি, প্রান্তের গলা জড়িয়ে ধরে নিজের শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিল, বলল, ‘হুঁ, অনেক জটিল সমস্যা…’
ওর চোখে মুখে মাদকতা…
প্রান্তের বুক কাঁপছে। এখনি যদি কিছু ঘটে যায়? যাক,তাতে কী? কাল তো বিয়েই…
কাল বিয়ে, কথাটি মনে পড়তেই প্রান্ত ঠেলে সোজা করে আহ্নিকে। কটকট করে বলল, ‘আগামীকাল বিয়ে। একটু ধৈর্য্য ধরেন ম্যাডাম। আমি চাই না, বিয়ের আগে কোনো অপবিত্র স্পর্শ করি আপনাকে…’
আহ্নির বুক ঠান্ডা হয়। সে জীবনসঙ্গী বাছতে কোনো ভুল করেনি।

‘পাশ..’ বলে আহ্নি
‘কী পাশ?’
‘তুমি পাশ। এক্সাম নিচ্ছিলাম। নাহ, আসলেই তুমি ভালো মানুষ।’

‘তাই? ভালো মানুষ কিন্তু খারাপ খারাপ কাজও করতে পারে। কঠিন খারাপ কাজ। করব?’ চোখেমুখে দুষ্টুমি, প্রান্ত এক পা বাড়াতেই আহ্নি চাপা চিৎকারে বলে, ‘ছাদ থেকে ফেলে দিব একদম।’
প্রান্ত হেসে উঠল, আহ্নি মুখ বাঁকায়।

‘তোমার ঐ এক্স স্টুডেন্টকে দাওয়াত দিছো?’ প্রশ্ন করে আহ্নি।
প্রান্ত কপাল কুঁচকে বলল, ‘কোন এক্স স্টুডেন্ট?’
‘ওই যে… কী যেন নাম, যে মেয়েটা তোমার উপর পাগল ছিল।’
‘মৌনি..’ গম্ভীর মুখে প্রান্তের জবাব।
‘হ্যাঁ, ওই ওর কথাই বলছি।’ আহ্নির ঠোঁটে বিদ্রুপ, প্রান্তকে বিব্রত করতে তার ভীষণ ভাল লাগে।
প্রান্ত গমগম স্বরে বলল, ‘ভাবিকে খুঁজে পাওয়ার পর আমি যে ওই বাসা ছেড়ে তোমাদের সাথে উঠলাম, এরপর আর ওই দিকে পা মাড়ায়নি। আর না ওর সাথে আমার দেখা হইছে। ভার্সিটিতে মঈনুল স্যারের সাথে কয়েকবার দেখা হলেও, তিনি আমাকে এড়িয়ে গেছেন। আমার উপর রাগ ছিলেন। পরে আমি উনার টাকা শোধ করে দেই। চার বছর হবে, আর উনাকে দেখিনি। ভার্সিটিতেও না। আর যোগাযোগ থাকলেও আমি দাওয়াত দিতাম না। ইউ নো মী…’

‘আচ্ছা বাবা, সরি। চেইতো না। মজা করছিলাম।’ বলে প্রান্তের গাল দুটো ছুঁয়ে দিল আহ্নি। তখনি কর্কশ কণ্ঠে রতির বাক্যবাণ, ‘এই বান্দর দুইটা, এখানে কী তোদের?’
আহ্নি কেঁপে উঠে। প্রান্ত চোখ গরম করে তাকাল আহ্নির দিকে। এই মেয়ের জন্যেই সে এসেছে আর ধরা পড়ল, উফ! এখন কী ভাববে ভাবি?

দু’জনেই কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ায়, রতি ঠোঁট টিপে হাসি আঁটকালো। ছদ্ম গম্ভীর স্বরে আদেশ দিল, ‘প্রান্ত, নিচে যাও।’
‘আ-আচ্ছা।’ বলে কেটে পড়ে প্রান্ত।
আহ্নি হাসার চেষ্টা করে রতির দিকে তাকিয়ে। কিন্তু রতির আগুন গরম চোখ দেখে সব হাসি উধাও…
আহ্নির কাঁদোকাঁদো মুখ দেখে রতি আর থামাতে পারে না নিজেকে। হেসে ফেলে। আহ্নি স্বস্তি পায়।

মাথা থেকে পা পর্যন্ত, পুরো বিল্ডিং ঝাড়বাতি দিয়ে সাজানো। ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে দু’জনে। আহ্নি ঝাড়বাতি গুলো দেখতে দেখতে বলল,’সুন্দর না?’
‘তোর চেয়ে কম।’
আহ্নি কেঁপে উঠে তাকাল, পরক্ষণেই হাসল।
‘ভাবি, এবার তোমার জীবনটাও গুছিয়ে নাও না।’
‘আমার জীবন কী এলোমেলো নাকি?’
‘না মানে, একটা স্বামী, সংসার…
আরাফ ভাইয়া তো ঠিকই তোমাকে ভুলে অন্য বিয়ে করে নিয়েছে। জমিয়ে সংসার করছে।’
রতির বুক চিঁড়ে যে দীর্ঘশ্বাস বেরোলো, সেটা শুনতে পেল না আহ্নি।
রতি মলিন হাসি হাসল, বলল, ‘করুক। ওর ভালবাসায় খাঁদ ছিল রে আহ্নি…’
‘জানি, তোমার ভালোবাসা নিখাঁদ, তবুও বলছি নিজের জীবনটা গুছাও ভাবি।’
রতি একহাতে আহ্নিকে আরও কাছে টানে। আহ্নির কপালের টিকলিটা জায়গা থেকে সরে গেছে। সেটা ঠিক করে দেয়। তারপর আহ্নির কপালে চুমু এঁকে বলল, ‘স্বামী, সংসার, সন্তান হলেই সবার জীবন পরিপূর্ণ হয় না আহ্নি। আমার ওসব কিছুই নেই, তবুও আমি সুখী। আমি খুব খুব খুউউউউব সুখী… কারণ আমার তুই আছিস। একটা ছোট্ট,দুষ্টু,মিষ্টি, আহ্নি আছে।’

আহ্নির চোখ ভিজে যায়। রতির বুকে মাথা রেখে ফোঁপায় সে। জল ছাপায় রতির চোখেও। কেউ কোনো কথা বলল না। দু’জন নিরবে দু’জনার হৃদ স্পন্দন অনুভব করতে লাগল। একসময় আহ্নির কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘ইউ আর দ্য বেস্ট সিস্টার-ইন-ল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড… আই লাভ ইউ রতি ভাবি, আই লাভ ইউ…’
বুক ভরে যায় প্রশান্তিতে, হালকা গলায় ফিসফিসিয়ে রতি উত্তর দেয়, ‘আই লাভ ইউ ঠু আহ্নি…’

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here