পর্ব-৯
#সাদা_ফুল
#ফারিয়া_আক্তার_নূপুর
১২.
সময় পার হয়। বছর যায়। শুভ্রতার এসএসসি পরীক্ষা আর একটি বাকি। এতদিনেও নিজের মনের কথা জানাতে পারেনি তীব্র। একতরফা ভালোবাসা নিয়ে প্রতিটা প্রহর কাটাচ্ছে সে। আজ শুভ্রতার শেষ পরীক্ষা হওয়াই রহমান মিয়া আজ পরীক্ষা হলে যাননি তাই শুভই শুভ্রতাকে নিয়ে যায়। পরীক্ষা শেষে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরতে আটো তে উঠে শুভ্রতা। এক অজানা কারনেই তার মনে বিস্বাদ ছেয়ে গেছে। কাচা রাস্তায় গাড়ি থামে। সামনের পথ হেঁটেই যেতে হবে। শুভ্রতা অটো থেকে নেমে হাটতে থাকে। গত দুদিন তীব্রর কোনো দেখা পায়নি সে। আজ পরীক্ষা শেষ। আর ঠিক কবে দেখা হবে তাও জানা নেই। বক্ষস্থলে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করে সে। হাটতে হাটতে বটগাছের সামনে এসে দাঁড়ায়। শুভ পেছন থেকে বলে,
“শুভ্র একটু থাম তো। আমার মানিব্যাগ টা পাচ্ছি না। কোথাও নাকি পরল আবার। তুই এখানে দাঁড়া আমি খুঁজে আসি”।
এই বলেই শুভ দ্রুত আবার আগের পথে কিছু খোঁজার ভান ধরে চলে যায়। শুভ্রতা বটগাছের মোটা শিখরের উপর বসে। পুরো জায়গাটায় একবার চোখ দিয়ে বুলিয়ে নেয়। কত স্মৃতি এই গাছের নিচে তার। চোখ থেকে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে মাটিতে পরতেই মুখে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে। খানিকক্ষণ পর পায়ের কাছে নরম কিছুর স্পর্শ পেয়ে ঠোটের কোণে হাসি ফুঠে উঠে। মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে ক্যামেলিয়া পাশে দাঁড়িয়ে গা ঘেঁষছে। ক্যামেলিয়াকে কোলে তুলে আদর করতে থাকে। তার ঠিক কিছু দূরে দাঁড়িয়ে তীব্র অপলক দৃষ্টিতে শুভ্রতার পানে তাকিয়ে। শুভ্রতা তীব্রের দিকে তাকায়। মূহুর্তেই অভিমানের পাল্লা তরতর করে ভেরে যায়। বেশ খানিক সময় পার হয়। কারো মুখে কথা নেই। শুভ্রতা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ভিতর থেকে তার ভীষন কষ্ট হচ্ছে। কেনো হচ্ছে তার কারণ আজানা। ফাইল হাতে নিয়ে বাড়িতে যেতে পা বাড়াতেই তীব্র করুণ কন্ঠে বলল,
“তুমি কি আমার অনূভুতিগুলো সত্যি বুঝো না শুভ্রতা”?
শুভ্রতা থমকে দাঁড়ায়। তীব্রের গলার স্বর আজ ভিন্ন,কান্না ভেজা কন্ঠ। পেছন ফিরে সরাসরি তীব্রের দিকে তাকাতেই বুকের বা পাশটা ধক করে উঠে। দুদিনে কি অবস্থা হয়ছে ছেলেটার! আচ্ছা তীব্র কি কেদেঁছে? না কাঁদলে চোখ এত লাল কেনো? ফর্সা মুখশ্রীতে চোখের সামান্য কালো দাগটাও স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। শুভ্রতার ভীষণ ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করতে আপনি কি রাতে ঘুমান না তীব্র সাহেব। তবে প্রশ্নটা নিজের ভিতরই সীমাবদ্ধ রাখলো। তীব্র অসহায়ের ন্যায় শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে থাকে উত্তরের আশায়। শুভ্রতা খুব বেশি সময় না নিয়ে তীব্রের দিকে তাকিয়ে বলে,
“১৬ বছরের কিশোরী তার সামনে থাকা খুলা বইয়ের ন্যায় অনূভুতিকে বুঝবে না? ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত না তীব্র সাহেব!”
তীব্র শান্ত হয়। এই একটা উত্তর তার ছটফট করা সত্তাকে নিশ্চুপ করে ফেলে। কিন্তু মন সে যে বড় চঞ্চল। মনকে থামিয়ে না রাখতে পেরে তীব্র আবারও বলল,
“তাহলে কেনো কখনো তা প্রকাশ করলে না?”
“আপনি তো এখনো প্রকাশ করেননি আপনার অনূভুতি সেখানে আমি তো খুবই ক্ষুদ্র “।
তীব্র সামান্য এগিয়ে এসে শুভ্রতার সামনে দাঁড়ায়। শুভ্রতা সাথে সাথেই দৃষ্টি নত করে ফেলল। হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক উঠা নামা ঘটছে।
“গ্রহন করবে কি আমার আর্জি?” অনুনয়ের স্বরে বলল তীব্র।
” কি রকম আর্জি?” অকপটে উত্তর দেয় শুভ্রতা।
“আমার বাগানের সবথেকে দামি শুভ্র ফুল হওয়ার আবেদন! আমার সাদা ফুল হবে কি শুভ্রতা?”
শুভ্রতা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সোজাসাপ্টা আর কোনো প্রকার কৃত্রিমতা ছাড়াই কত সাবলীলভাবে প্রেম নিবেদন করল তীব্র। শুভ্রতা পেছন ফিরে দাঁড়ায়। মন খুশিতে নেচে উঠে।এই প্রশ্নের জবাব কি সাধারন ভাবে দেওয়া যায়। শুভ্রতার চুপ থাকা দেখে আকাশচুম্বী ভয় এসে গ্রাস করে তীব্রকে। শুভ্রতা কি তবে তাকে ফিরিয়ে দিবে? শুভ্রতা এবার কোমল কন্ঠে উত্তর দেয়,
“তীব্র সাহেব! একদিন আপনি বলেছিলেন না ভালোবাসা পাপ নয় বরং তা শুভ্র,নির্মল। আমরা মানুষরাই তা কলঙ্কিত করি। আমার আবদারটা আগে রাখবেন?”
তীব্রের ভাবনার মাঝে শুভ্রতা কথাটি বলে থামে। তীব্র খানিক ঘাবড়ে যায় শুভ্রতার আবেদনের কথা শুনে। তবে আবদার যাই হোক তীব্র তা রাখতে সব করতে পারবে এমনকি নিজেকে মৃত্যু সমতুল্য কষ্ট দিতেও। তীব্র জানতে চায় শুভ্রতার আবদারটা। শুভতা জবাবে বলে,
“আমাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব ঘুচিয়ে এই অনূভুতিগুলোকেও শুভ্র পবিত্র নামক সম্পর্কে পরিণত করবেন? আমিও সাদোরে তীব্রের বাগানের সাদা ফুল হবো “!
শুভ্রতা আর দাঁড়ায় না বাড়ির পথে হাঁটতে থাকে। তীব্র সেখানেই ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। সবকিছুই তার স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। খুশিতে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে যেন সে। শুভ্রতাকে পেলেই যেন তার দুনিয়া জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হবে তার।
–
“আব্বা রহমান চাচার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যান”।
সবার সামনে ছেলের নিজের মুখে নিজের বিয়ের কথা শুনে সামান্য লজ্জা পান তালহা রহমান। নিজেকে একটু ঠিক রেখে বলেন,
“মেয়েটা সবেমাত্র এসএসসি দিলো বিয়ের বয়স কি এখন হয়েছে?”
“বিয়ে না হোক আকদ করে রাখবেন”!, সাবলীলভাবে জবাব তীব্রের।
তালহা রহমান একবার তিথি রহমানের দিকে তাকালেন। তিথি রহমান মুচকি মুচকি হাসছেন। তালহা রহমানও আর না করলেন না। ছেলে যাতে খুশি হয় তাই করবেন তিনি।
পরেরদিন বিকেল বেলা রেণু রহমান,তিথি রহমান,তালহা রহমান আর তীব্রের চাচা ইকবাল রহমান শুভ্রতাদের বাড়িতে আসে। বিকেল হওয়াতে রহমান মিয়া বাড়িতেই ছিলেন। চেয়ারম্যান বাড়ির সদস্যদের নিজ বাড়ির উঠানে দেখে সামান্য অবাক হন তিনি। দ্রুত উঠানে এসে সালাম জানায় তারপর শুহানা বেগমকে ডাক দেন। শুহানা বেগম কলপার থেকে এসে সবাইকে দেখে একটু চমকে যান। তিথি রহমান মুচকি হেসে শুহানা বেগমের কাছে গিয়ে বললেন,
“বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবেন ভাবি?”
শুহানা বেগম আথিবিথি করে তাদের সবাইকে বসার ঘরে নিয়ে যান। রহমান মিয়া শুভকে দ্রুত দোকানে পাঠান ফলমূল আনার জন্য। শুহানা বেগম শুভ্রতাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে তাদের আপ্যায়ন করতে। জাহানারা বেগম রেণু বেগমের পাশে বেতের চেয়ারে বসেন। একসময় তাদের মধ্যে ছিলো গলায় গলায় ভাব। পাশাপাশি বাড়িতেই থাকতেন উনারা। তারপর তীব্রের দাদা চেয়ারম্যান হলেন সেই সুবাদেই বাজারের দিকে জমি কিনে সেখানেই বাড়ি করে থাকা শুরু করলেন। বহুদিন পর কাছের
বান্ধবীকে পেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে যান জাহানারা বেগম। দুজনেই এখন বয়সের ভারে কাবু। রেণু রহমান জাহানারা বেগমের হাতে হাত রেখে বলেন,
“তোমায় অনেকদিন পর দেখলাম জাহানারা। কেমন আছো?”
“আল্লাহ রাখছে ভালো। সেই যে ওপার গেলেন আর একবারও এই পাড়ার কথা মনেই করলেন না।”
“সংসারে বাধা পরে গেলাম। তারপর ছেলে হলো নাতি হলো বয়স বাড়লো। আর আসা হলো না পশ্চিমপাড়ায়।”
তাদের দুজনের দিকে সবাই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রক্তের টান ছাড়াও কিছু সম্পর্কের মাঝে থাকে অটুট ভালোবাসা আর মায়া। তিথি রহমান বসা থেকে উঠে শুহানা বেগমের কাছে যান। তার হাত ধরে পাশে বসিয়ে বলেন,
“আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হবেন না এত ভাবি। আল্লাহ্ চাইলে আরও কত আসবো। তখন না হয় সমাদর করবেন। এখন আমাদের আবদারটা শুনুন”।
শুহানা বেগম রহমান মিয়ার দিকে তাকান। শুভ্রতা পাশের ঘরে বসা আর শুভ দরজা দিয়ে উকি মেরে তাকিয়ে বাইরের কথা শুনে। তালহা রহমান হেসে বললেন,
“রহমান ভাই আমার ছেলেকে তো চিনেনই। কেমন লাগে আপনার?”
“তা আর কইতে হয় চেয়ারম্যান সাহেব। লাখে একখান পোলা। আমাগো গ্রামের গর্ব তীব্র বাবা”।
“ভালো কোনো মেয়ে পাবো তো?
“অবশ্যই অনেক ভালা মাইয়া পাইবেন”। নিচু স্বরে বললেন রহমান মিয়া।
তিথি রহমান এবার হাসিমুখে বললেন,
“তাহলে আপনাদের রাজকন্যাকে দিবেন আমাদের ঘরে”?
শুহানা বেগম অবাক হয়ে তিথি রহমানের দিকে তাকালেন। রহমান মিয়াও চমকে গেলেন। তালহা রহমান তাদের অবস্থা বুঝে রহমান মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
” কি রহমান ভাই দিবেন না? আমার ছেলে কি যোগ্য হবে না শুভ্রতা মায়ের জন্য”।
রহমান সাহেব দ্রুত উত্তর দিলেন,
“না না অযোগ্য হবে কেনো?”
“তাহলে?”
” এটডা কি সম্ভব চেয়ারম্যান সাহেব! কই আমরা আর আপনারা বরং আমাদের মাইয়াই তীব্র বাবার যোগ্য না”। নিচু কন্ঠে বললেন রহমান মিয়া।
“ভাই আমরা মেয়ে চাচ্ছি ছেলের বউ হিসেবে
বংশ গৌরবের সম্পর্ক বানাতে নয়। সত্যি কথা বলি আমার ছেলেটা শুভ্রতা মাকে ভীষন পছন্দ করে। আমাদেরও শুভ্রতাকে খুব ভালো লেগেছে। তবু যদি মনে হয় আমার ছেলে শুভ্রতার জন্য সঠিক নয় তবে আমরা জোর করবো না”, তিথি রহমান বললেন।
চলবে…..
[গত কয়েকদিন গল্প না দেওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত। দয়া করে কেউ রাগ করবেন না। ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কারনে লিখতে পারেনি। হ্যাপি রিডিং ]