হৃদপিন্ড ২ পর্ব ৩৯+৪০+৪১

#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_২৫
#জান্নাতুল_নাঈমা
____________________
বাড়ির সবাই ব্রেকফাস্ট করে যে যার মতো রেষ্ট নিচ্ছে। ইরাবতী খেতে বসবে বসবে করেও বসতে পারছে না। কারণ ইমন পুরান বাড়ি থেকে এখনো আসেনি। তাই মুসকান খাচ্ছে না, মুসকানকে রেখে তারও খেতে ইচ্ছে করছে না। শাশুড়ি, বউয়ের এমন কাণ্ড দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো সায়রীর। সোফায় বসে ছিলো মুসকান, ইরাবতী ছেলেকে ফোন করে যাচ্ছে। এমন সময় সায়রী গিয়ে মুসকানের পাশে বসলো। বললো,

“তুই অনেক ভাগ্যবতীরে মুসু ইরা আন্টির মতো শাশুড়ি পেয়েছিস। দোয়া করি সারাজীবন এই সম্পর্ক অটুট থাকুক। ”

মুসকান মৃদু হাসলো তারপর ইরাবতীর দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললো,

“হুম উপরওয়ালার কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া আপু আমি এমন একটা শাশুড়ি মা পেয়েছি। ”

মুসকান, সায়রী টুকটাক কথা বলছিলো এমন সময় ইরাবতীর ফোন রিসিভ করলো ইমন এবং জানালো তার আসতে আরো আধাঘন্টা দেরি হবে। তাই সে আর মুসকান যেনো খেয়ে নেয় নয়তো ভীষণ রাগ করবে। সকালের ওষুধটাও খাওয়া হয়নি ইরাবতীর। এখন যদি সে না খায় ছেলে তার সত্যি ভীষণ রিয়্যাক্ট করবে। তাই ফোন রেখে মুসকানকে তাগাদা দিলো খাওয়ার জন্য। মুসকান ইরাবতী’কে বোঝানোর জন্য বললো,

” তুমি খেয়ে নাও প্লিজ আমার খিদে পায়নি আমি নানাভাই এলেই খাবোনি। ”

সায়রী বউ শাশুড়ির কাণ্ড দেখতে থাকলো আর মিটিমিটি হাসতে লাগলো। কিন্তু ইমনের দাদি এসে ফোঁড়ন দিয়ে বললো,

“নানাভাই মানে কি বউ মা তোমার ছেলের বউ এসব কি কয়? শরম, লজ্জা কি কিছুই নাই,স্বামীরে কয় নানাভাই! ”

ইরাবতী আঁতকে ওঠে ফুপু শাশুড়ির দিকে তাকালেন। বললেন,

“ফুপু ছেলেমানুষ তো আগে থেকেই নানাভাই বলে ডাকে বুঝতে পারেনি। কিছু মনে করবেন না। ”

দাদি সে কোথায় কান দিলো না। নানারকম ভাবে মুসকানকে দোষারোপ দিতে শুরু করলো। বললো,

“এই হয়, এই মেয়ে যদি এতোই ছেলে মানুষ হয় স্বামী কি জিনিস তাই যদি না বুঝে তাহলে ভালোবাসা বাসি করতে কে বলছিলো বিয়েই বা বসতে কে বলছিলো? ”

দাদির প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো ইরাবতী। সায়রী বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে রইলো। আর মুসকান মুখে সুন্দরতম হাসি বজায় রেখে সুবোধ্য গলায় উত্তর দিলো,

“আপনার নাতিই বলেছিলো দাদি। ”

বড়ো বড়ো করে তাকালো দাদি। ইরাবতী ইশারায় চুপ করতে বললো, সায়রীও মুসুর বাহুতে চিমটি কাটলো। কিন্তু মুসকান চুপ রইলো না মিষ্টি ভাষায় তীক্ষ্ণ করে বললো,

“স্বামী কি জিনিস খুব ভালো করেই জানি দাদি। কিন্তু কি বলুন তো আর সবার থেকে আমাদের সম্পর্ক টা তো ভিন্ন তাই সব কিছুতেই ভিন্নতা দেখতে পাচ্ছেন। এই ধরুন বর্তমানে সব স্ত্রীরাই কিন্তু স্বামীদের নাম ধরে ডাকে। তারা বয়সে যতোই সিনিয়র হোক না কেন। আমিও কিন্তু চাইলে আমার বর’কে নাম ধরে ডাকতে পারবো কিন্তু বয়সে সে আমার থেকে বেশ বড়ো, তার থেকে বড়ো কথা তাকে আমি সীমাহীন সম্মান করি তাই নাম উচ্চারণ না করে কিছু একটা সম্বোধন করি ‘নানাভাই’ কি মধুর না সম্বোধন টা?? ”

দাদি তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে ইরাবতীর দিকে তাকালো। ইরাবতী এক ঢোক গিললো, জোর পূর্বক হেসে দাদি’কে কিছু বোঝাতে যাবে তার পূর্বেই দাদি বললো,

“থাক বউ মা আর কিছু বোঝাতে হবে না। আজকালকার মেয়েদের ঢের চেনা আছে। ভাবছিলাম ইমন দাদু ভাই যখন পছন্দ করছে তাহলে মেয়েটা সিজিলের আছে। কিন্তু আমিতো দেখছি এই মেয়েটা পুরা বেয়াদব! ”

সকলের মুখই ছোট হয়ে গেলো। মুসকানের চোখদুটোও জলে পূর্ণ হলো। সে বেয়াদব এই কথাটা তার বুকে গিয়ে বিঁধল তবুও নিজেকে সংযত করে কাঁপা কন্ঠে বললো,

“আপনি কি আপনার নাতির নাম ধরে ডাকলে খুব খুশি হবেন? নাকি মা’কে বলবো তোমার ছেলে এটা করেছে আপনাকে বলবো আপনার নাতি ওটা করেছে এভাবে সম্বোধন করলে খুশি হবেন? কোনটা বেশি সম্মানের একটু চিন্তা করুন তো? ”

“চুপ আর একটা কথাও বলবে না। তোমার মতো বেয়াদবের থেকে একটা কথাও শুনবো না। এই শিখছো পরিবার থেকে? তোমার মা, চাচিরা এইগুলা শিখিয়ে পাঠাইছে যে শ্বশুর ঘরে গিয়ে কিভাবে মুরুব্বিদের মুখে মুখে তর্ক করতে হয়? বাপ তো নাই বাপের শিক্ষা পাও নাই, ভাই তো দরদে দরদে মাথা বিগরাইছে আর মহিলাগোর শিক্ষা পাইয়া আজ এই অবস্থা হইছে তাইনা? ”

দুচোখ ভর্তি অশ্রুকণাগুলো এবার ঝড়তে শুরু করলো মুসকানের। এভাবে ধমক আর কড়া কড়া কথা শুনে তার আপনাআপনিই কান্না চলে এলো। নিজেকে শক্ত রাখতে চেয়েও পারলো না। এদিকে সায়রীর মাথা এমন গরম হলো যে সে বললো,

“দাদি কিছু মনে করবেন না মহিলা শিক্ষা মানে আপনি কি বোঝাতে চাইলেন? নারী হয়ে নারীদের এতো ছোট করে দেখছেন বিষয়টা বুঝলাম না। আর মুসকান স্পষ্টভাষী বলে ওকে বেয়াদব উপাধি দিচ্ছেন। কিন্তু আমরা তো ওর ভুল খুঁজে পাচ্ছি না। ”

ইরাবতী পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বললো,

“মুসকান আমার খুব খিদে পেয়েছে তুমি কি আমাকে খাবার বেড়ে দেবে? ”

ক্রন্দনরত মুখশ্রীতে ইরাবতীর দিকে তাকিয়ে চোখ মুছলো মুসকান। মাথা নাড়িয়ে ওঠে চলেও গেলো। কিন্তু দাদি ঠাঁই বসে অপেক্ষা করতে লাগলো ইমনের জন্য। সায়রীর কথারও একটি উত্তর দিলো না সে। সায়রীও বিরক্ত হয়ে ওঠে চলে গেলো।
.
ইরাবতী খেতে বসেছে মুসকান তার পাশেই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। মুসকানের রাগ,জেদ সম্পর্কে মোটামুটি সকলেরই ধারণা রয়েছে। তাই ইরাবতী মুসকান’কে অনেক কিছু বোঝালো। বললো,

“ইমনের বংশের একমাত্র মুরুব্বি সেই। আগের মানুষ তো চিন্তা ভাবনাও আগের মতো। আর কি জানো বাড়ির মুরুব্বিরা ভুল করলে শাসন করা যায় না। ভুল ধরিয়ে দিতে হয় তবুও যদি তারা ভুল করে তাহলে সেগুলো এড়িয়ে চলতে হয়। উনার কথায় কিছু মনে করো না মা। ইমনকেও এসব নিয়ে কিছু বলো না। অশান্তি হবে খুব রাগ করেনা মা মাথা ঠান্ডা করো। এইতো আর কটা দিন তারপর তো ফুপু চলেই যাবে। ”

নাক টেনে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছলো মুসকান। সায়রী আর আলিয়া এসে মুসকানের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। কিছুক্ষণ পর ইমনের ফুপুও এলো। সেও অনেক কিছু বোঝালো স্বান্তনা দিলো। সকলেরই একটা ভয় হচ্ছে মুসকান যদি ইমন’কে কিছু বলে না জানি ইমন কি কাণ্ড ঘটায়। কিন্তু সায়রী যে সমস্ত কথাই ইয়া বড়ো করে ম্যাসেজের মাধ্যমে ইমনকে জানিয়েছে তা কেউই জানতে পারলো না৷ মুসকান নিজেও না।
.
ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো ইমন। তখনি দাদি সটান হয়ে ওঠে দাঁড়ালো। চোখ,মুখে কাতরতা ফুটিয়ে তুলে ইমনকে বললো,

“দাদু ভাই এসেছিস তোর জন্যই অপেক্ষা করছি। ”

ইমন ধীরপায়ে এগিয়ে এসে সোফায় গা এলিয়ে বসলো। তারপর দাদিকে ইশারা করলো তার পাশে বসতে। দাদি বিনাবাক্যে খুশি মনে বসে পড়লো। ইমন গলা উঁচিয়ে পারুলকে পানি আনতে বলে দাদির দিকে রহস্যময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। বললো,

“আমার সদ্য বিবাহিত পিচ্চি বউ’টা তোমার কোন পাকা ধানে মই দিছে দাদি? ”

“হায় হায় রে এরই মধ্যে নালিশ করাও শেষ? তোর বউ যে তোর বয়স নিয়া ঠাট্টা করে সেই খবর কি তুই জানোস? ”

পারুল এসে পানি দিতেই ইমন পানিটা নিয়ে ঢকঢক করে গিললো। তারপর গ্লাস ফেরত দিয়ে ইশারায় চলে যেতেও বললো। পারুল চলে যেতেই ইমন লম্বা এক শ্বাস ছেড়ে শান্ত গলায় দাদিকে বললো,

“আমার বউ আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করুক মশকরা করুক যাই করুক তোমার এতো জ্বলে কেন? নাকি আমাদের দাম্পত্য জীবনের সুখ তোমার সহ্য হচ্ছে না? ”

“তোর বউ যে আমার মুখে মুখে তর্ক করছে তা তুই জানোস? নতুন বউ তার মুখে যেনো খই ফুটে । ”

“বাহ তাই নাকি তাহলে খই কেনার টাকা টা আমার বেঁচে গেলো বলছো? ”

“তুই আমার সাথে ঠাট্টা করস। ”

“আরে দাদি ক্ষেপছো কেন তোমার কি ঠাট্টা রোগে ধরলো নাকি? আমার বউ আমাকে ভালোবেসে আহ্লাদ করে, সম্মান দিয়ে নানাভাই ডাকে তুমি বলো ঠাট্টা। আমার বউয়ের মুখে খই ফুটে জানতাম না তুমি জানালে ভাবলাম যাক টাকা বেঁচে গেলো এটাকেও বলছো ঠাট্টা। তোমাকে কি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে হবে দাদি? মানে মানসিক ব্যাধিতে ভুগছো না তো? ”

প্রচন্ড ক্ষেপে গেলো দাদি৷ চোখ,মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়লো। বললো,

“আমি বাপু তোদের সংসারে দু’দিনের অতিথি মাত্র। তোর বউ যা ইচ্ছা করুক তাতে আমার কি। ভালো মন্দ শেখাতে আসলে যদি দোষ হয় আমি কিছুই বলবো না। তোর বউ যে বেয়াদবি করছে এই কথাও তোরে বলবো না। আমার আগেই মনে রাখা উচিৎ ছিলো তুই কচি বউ বিয়ে করছোস। তাই তার জন্য সাতখুন মাপ। ”

হেসে ফেললো ইমন দাদির হাত টেনে পাশে বসিয়ে বললো,

” সঠিক বলছো দাদি বউটা আমার একেবারেই কচি। কিন্তু বেঠিকও বলছো তা হলো আমার বউ বেয়াদব। দুনিয়া উলটপালট হয়ে গেলেও এই কথা আমি বিশ্বাস করতে পারবো না। ইমন চৌধুরী এতো কাঁচা কাজ করে না দাদি যে বেয়াদব বউ ঘরে তুলবে। ”

“তাহলে আমার হাত ছাড় আমারে ধরস কেন বউ ধর গা যা। ”

“বউ ধরার সময় হোক তোমার বলার অপেক্ষা রাখবো না। এখন যা বলি মনোযোগ দিয়ে শুনো। মুসকানের পিছে লাগা একদম ছেড়ে দাও। যে কটা দিন আছো নিজে শান্তিতে থাকো সবাইকে শান্তিতে থাকতে দাও তোমার কোন অসম্মান হবে না। কিন্তু অশান্তি করে যদি আর একবার আমার কচি বউয়ের চোখে পানি এনেছো তো চৌধুরী বাড়ির একমাত্র বংশধরের মাথা কতোখানি বিগরে যাবে তখন টের পাবে। ”

দাদি থতমত খেয়ে ইমনের থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। ইমন মুচকি হেসে দাদির হাত ছেড়ে বললো,

“বংশের একমাত্র মুরুব্বি সাহেবা কথা কি মাথায় ঢুকেছে? ”

দাদি এক ঢোক গিললো আশেপাশে তাকিয়ে মনে মনে বিরবির করে বললো,

“আকরামের পোলাডা এক্কেরে বদমাইশ হইছে। আজই আকরামের সাথে কথা বলতে হবে। নয়তো শেষ বয়সে ছেলে,ছেলের বউ না খাওয়াই মারবো আকরাম আর আকরামের বউরে। এই পোলা এখনি যা বউ ভক্ত না জানি আর কয়দিন পর বাপ,মা ত্যাগ করে! ”
.
পারুল প্লেটে কিছু ফল কেটে রুমে এসে ইমন’কে দিয়ে গেলো। ইমন প্লেট হাতে নিয়ে বিছানায় মুসকানের পাশে গিয়ে বসলো। অপেক্ষা করত লাগলো কখন মুসকানের কথা বলা শেষ হয়। মায়ের সাথে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে কথা বলছে মুসকান। তার অভিযোগ সবাই দুপুরে আসবে তাহলে তার মা কেন আসবে না? মরিয়ম আক্তার যতোই বোঝাচ্ছে সে তোতোই বলছে,

” সবাই যা করবে তোমারও তাই কেন করতে হবে? তুমি দাদাভাই কে দাও আমি দাদাভাই কে বলবো যেনো তোমাকে নিয়ে আসে। ”

মরিয়ম আক্তার মেয়েকে বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত হয়ে গেলো। মুসকান দাদির বলা কথাটির জন্য তখন শান্তিপূর্ণ ভাবে কাঁদতে পারেনি তাই এই সুযোগে এই ইস্যু ধরেই কাঁদতে শুরু করলো। ইমন বেশ বুঝলো মুসকান আসলে কেন কাঁদছে? তাই সে পিছন থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে টুশ করে ফোনটা কেটে দিলো। মুসকান একহাতে চোখের পানি মুছে ইমনের দিকে অভিমানী চোখে তাকালো। বললো,

“ফোন কেন কাটলে আমি আম্মুর সাথে কথা বলবো।”

“সন্ধ্যায় তো যাবেই এখন কসের কথা এগুলো খেয়ে নাও। তারপর শাওয়ার নাও একটু পরই রিক্তা আসবে তোমাকে সাজাতে। ”

ইমনের হাতের দিকে তাকিয়ে মুসকান বললো,

“আমার খিদে নেই। ”

“মুসু আমি কিন্তু রেগে যাবো তখন বমি পায় বলে খেলে না এখন এটুকু না খেলে এই শরীর নিয়ে অনুষ্ঠানে ঠিক থাকতে পারবে না। ”

“আমি বললাম না খাবো না? বিরক্ত করছো কেন? ”

হঠাৎ চিৎকার করে ওঠলো মুসকান। পরোক্ষণেই চমকে ওঠে শান্ত হয়ে মাথা নিচু করে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়তে শুরু করলো। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেলো ইমনেরও চোখ,মুখ শক্ত হয়ে গেলো তার। চোয়ালজোড়া দৃঢ় করে দৃঢ় কন্ঠে প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললো,

” এটা তুমি খাবে, খাবে মানে খাবে আর একটা টু শব্দ যদি এখানে হয় তাহলে আজ বাড়ি ফেরার কথা, মায়ের কাছে ফেরার কথা ভুলে যাও। ”

কথাগুলো বলেই ফলের প্লেটটি মুসকানের সম্মুখে রেখে চলে গেলো ইমন। মুসকানের দুচোখ ভরে আবারও অশ্রুপাত হতে শুরু করলো। অভিমানে আড়ষ্ট হয়ে একহাত বাড়িয়ে একটি আপেলের টুকরো মুখে দিলো। জোর পূর্বক কিছুক্ষণ চিবিয়ে আবরো মুখ বুজে বসে অশ্রু ফেলতে লাগলো। ইমন বাইরে গিয়ে নিজের রাগটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনে আবারও রুমে ঢুকলো। মুসকান বেশ অনিহা নিয়েই ফল মুখে দিচ্ছে দেখে কিছু টা স্বস্তি নিয়ে দরজা আঁটকে দিলো তারপর আবারও বিছানায় এসে বসলো। বললো,

“দাদি’কে যা বলার বলে দিয়েছি আমি এরপর আর পিছু লাগবে না মুসু। ”

“আমি কোন বেয়াদবি করিনি নানাভাই”

বলেই ফুঁপিয়ে উঠলো মুসকান ইমনের দিকে ফিরে আচমকাই ইমনকে জড়িয়েও ধরলো। বুকে মুখ গুঁজে শার্ট খামচে ধরে অনেকটা সময় কাঁদলো। বললো,

“দাদাভাই কখন আসবে? ”

ইমন বুঝলো মুসকানের মন খারাপ লাগছে। মা আর ভাইয়ের জন্য মনটা তার খুব কাঁদছে। তাই মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো চুমু খেলো। তারপর দু’হাতের আঁজলে মুখ ওঠিয়ে কপালে চুমু খেলো। গাল দু’টো মুছে দুগালেও চুমু খেলো। তারপর শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওষ্ঠজোড়ায় আঙুল বুলাতে বুলাতে শান্ত কন্ঠে বললো,

“এইতো কিছুক্ষণ পরই এসে যাবে তুমি রেডি হতে হতেই সবাই এসে পড়বে। সে অবদি তুমি নানি আর সায়রীর সাথে সময় কাটাও কেমন? ”

“এ্যাহ নানি ভাবির নানি সকালে একবার দেখা দিয়ে নাস্তা করে আবার ঘুমাচ্ছে। আমার সাথে তাকে পাঠানো হয়েছে কই আমার সাথে সাথে থাকবে তা না৷ তোমার দাদি কতোগুলো কথা শোনালো সে থাকলে একটু কিছু বললে কি আমি বেয়াদব উপাধি পেতাম বলো? ”

স্মিথ হাসলো ইমন মুসকানের দিকে প্রগাঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাথা এদিক ওদিক নাড়িয়ে বোঝালো না। মুসকান ইমনের চোখের ভাষা বুঝতেই চুপ হয়ে গেলো। ইমনের দৃষ্টি জোড়া যে এখন তার ওষ্ঠজোড়ায় আঁটকে আছে তা বুঝতেই লজ্জায় মাথা নুইয়ে বললো,

“তাহলে আমি শাওয়ার নিয়ে আসি নাকি তুমি আগে যাবে? ”

“দু’জন একসাথে যাবো। ”

চটপট উত্তর ইমনের। মুসকান লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেলো। ইমন মুচকি হেসে ফলের প্লেট সামনে ধরে নিজ হাতে পুরো ফলটাই ওকে খাওয়ালো। খাওয়া শেষে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কোলে তুলে সোজা বাথরুমে ঢুকে পড়লো।
__________________
কনেপক্ষের সকলেই বউভাতের অনুষ্ঠানে হাজির। তারা উপস্থিত হওয়ার মিনিট কয়েকের মধ্যে ইমন মুসকানও হাজির হলো। মুরাদ বোন আর বোন জামাইকে দেখে খুশিতে আত্মহারাই হয়ে গেলো। নজরকারা সাজে বর বউ’কে দেখা মাত্রই রিমি সহ মুসকানের কাজিন ব্রাদার্স, সিস্টার্সরা চিল্লিয়ে ওঠলো। পারপেল কালারের বেনারসি শাড়ি বাঙালি ভাবে পরেছে মুসকান। সাথে গা ভর্তি গহনা…ব্রাইডাল লুকে একদমই অন্যরকম লাগছে আজ মুসকানকে। বিয়ের দিন থেকে আজ যেনো তার রূপ চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। ইমনও কিন্তু কম নয় পারপেল কালারের শার্টের ওপর সাদা স্যুট, প্যান্ট,কালো সুজ’তে অসাধারণ লাগছে তাকে। এ মূহুর্তে ওদের দু’জনকে দেখলে যে কারোরি মনে হবে এরা কেবল একে অপরের জন্যই তৈরি৷ ইমন ছাড়া মুসকানের পাশে যেমন ভিন্ন কোন পুরুষ’কে একটুও মানাবে না তেমনি ইমনের পাশেও অন্য কোন নারী’কে প্রচন্ড বিদঘুটে লাগবে!
.
স্টেজে বর কনে নিজ আসনে বসে আছে। কনে পক্ষের সকল আত্মীয় স্বজনরা বর পক্ষের সকল আত্মীয় স্বজনদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। বরপক্ষের দূরান্তের আত্মীয় স্বজন এসে মুসকানের হাতে উপহার স্বরূপ কিছু দিচ্ছে যা অভ্র আর আলিয়া দায়িত্ব সহকারে মুসকানের থেকে নিয়ে পিছনের একটি ঘরে রেখে আসছে। সময় বেশ গড়িয়ে যায়। কনে পক্ষের সকলেই তখন খাওয়া দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। মুসকান চুপচাপ বসে আছে টুকটাক কথা বলছে ইমনের বন্ধু বান্ধব দের সাথে। যাদের সঙ্গে ইতিপূর্বে তার পরিচয় ছিলো না। এক পর্যায়ে হঠাৎই ইমন বলে কেউ ডেকে ওঠলো। মুসকান সহ ইমনও তাকালো সিঁড়ির দিকে। সাদা ল্যাহেঙ্গা পরিহিতা একটি মেয়ে এক গাল হাসি নিয়ে হাত উঁচিয়ে ইশারা করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। মুসকান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েই রইলো। মৃদু হেসে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো ইমন। মেয়েটি প্রায় দৌড়ে এসেই ইমন’কে জড়িয়ে ধরলো। গালে গাল ছুঁইয়ে ঠোঁট চৌকা করে চুমুর ভঙ্গিও করলো। আচমকাই এমন কাণ্ড ঘটাবে পৃথা একটুর জন্যও টের পায়নি ইমন। মস্তিষ্কে কেবল মুসকান মুসকান স্মরণ হতেই দুহাতে কিছুটা কঠোরতা এনেই পৃথার হাত ছাড়িয়ে দিলো। ঘাড় বাঁকিয়ে মুসকানের দৃষ্টিজোড়া পরখ করতেই “ড্যাম ইট!” বলেই পৃথার দিকে রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। পৃথাও ঘাড় বাঁকিয়ে মুসকান’কে এক পলক দেখে “সরি ” বললো। তারপর মুচকি হেসে ইমনকে বললো,

“কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? ”

“অনেক বেশিই সারপ্রাইজ দিয়ে ফেলেছিস এবার কিভাবে এই সারপ্রাইজের ধকল সামলাবো! ”
#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_২৬
#জান্নাতুল_নাঈমা
____________________
অনুষ্ঠানের যাবতীয় কার্যক্রম শেষে এবার কনে পক্ষ বর কনে সহ ফিরবে নিজ বাড়ি। কিন্তু ইমন সেই যে তার বন্ধু বান্ধব নিয়ে বাড়ির সামনে গেলো আর ফেরার নাম নেই। কোন রকমে নিজের চোখের পানিগুলো আটকানোর চেষ্টা করছে মুসকান। মুরাদ মুসকান’কে দেখে কিছু একটা আঁচ করে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

“মুসু শরীর খারাপ লাগছে? ”

“আমিতো বললাম দাদাভাই আমার খারাপ লাগছে তবুও ভাবির সাথে যেতে দিলেনা। ”

“আরে রাগ করস কেন বর ছাড়া নাকি একা ফিরতে হয়না এটা নিয়ম। ”

“বর যদি তার বন্ধু বান্ধবদের মাঝে বিভোর থাকে ছ্যাঁচড়ার মতো ঘন্টার পর ঘণ্টা আমাকে এখানে অপেক্ষা করতে হবে! ”

সায়রী মুসকানের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো,

“দাঁড়া আমি ডেকে আনছি ওকে।”

“একদম যাবে না আপু আমি দেখতে চাই ঠিক কতোক্ষণ পর তার আসার সময় হয়। ”

মুসকানের রাগের মাত্রা বুঝতেই মুরাদ দ্রুত ফোন বের করে ইমনকে কল দিলো। এদিকে বরের বাড়ির সকলেই ঘিরে আছে মুসকানকে। সকলের থেকে বিদায় নিলেও সকলে অপেক্ষা করছে ওদের গাড়ি অবদি ওঠিয়ে দেওয়ার জন্য। ঠিক পনেরো মিনিট বাদে এলো ইমন। তার পিছনে অভ্র একটি ট্রলি নিয়ে এলো। যেখানে ইরাবতী ইমন মুসকান দু’জনেরই দুদিনের পোশাক সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে দিয়েছে। ইমন আসতেই মুসকান মুরাদকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“দাদা ভাই আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে আমি কি গাড়িতে বসতে পারি? ”

মুরাদ আতঙ্কিত হয়ে মুসকান’কে ধরে সিটে বসিয়ে দিলো। সায়রীও ওঠে পড়লো তারপর ইমনও কোন বাক্য ব্যয় না করে গাড়িতে ওঠে বসলো। মুসকান সায়রীর দিকে কিছুটা চেপে বসে নিচু স্বরে প্রশ্ন করলো,

“দিহুভাই কোথায় আপু সারাদিনে একবারো নজরে পড়েনি। ভাইয়া কি আসেনি? ”

থতমত খেয়ে গেলো সায়রী জোর পূর্বক কিঞ্চিৎ হেসে জবাব দিলো,

“তুই ভালো করেই জানিস মুসু আমি ওর ব্যাপারে কিছু জানিনা। ”

ছোট্ট একটি শ্বাস ছাড়লো মুসকান। সায়রী নিশ্চুপ হয়ে কাঁচ নামিয়ে রাস্তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো, বিষণ্ন মনে রাতের শহর দেখতে বিভোর হয়ে গেলো সে। ড্রাইভার মনোযোগ সহকারে গাড়ি চালাচ্ছে, মুরাদ বসে ফোন ঘাটছে মুসকান তীব্র অস্বস্তি নিয়ে সায়রী আর ইমনের মাঝখানে বসে আছে। হঠাৎ করেই ইমন মুরাদের সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে শুরু করলো। টপিক ছিলো গুটিকয়েক বন্ধু বান্ধবদের কিছু হাস্যরসাত্মক কাণ্ড। আলোচনার এক পর্যায়ে মুরাদ উচ্চস্বরে হেসে ওঠলো। হাসলো ইমনও। ওদের দুজনের হাসিতেই প্রচন্ড বিরক্ত বোধ করলো সায়রী এবং মুসকান। সায়রীর মনটা খুব ছটফট করছে দিহানের জন্য। সেই যে রাগ করে ছাদ থেকে নিচে নেমে গেলো তারপর না দেখা আর না কোন কথা হয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ইমন, মুরাদ বা অন্য কেউ দিহানকে নিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। আলিয়া একবার জিজ্ঞেস করেছিলো কিন্তু কিভাবে যেনো কথায় কথায় বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে গেলো। এদিকে মুসকান বিরক্ত হচ্ছে এতো বড়ো অপরাধ করেও ইমনের কোন হেলদোল নেই। দিব্যি খুশিতে গদগদ করে কথা বলছে। বেশ শব্দ করেই নিঃশ্বাস ছাড়লো মুসকান। তার নিঃশ্বাসের তীক্ষ্ণ শব্দটা ইমনের কানে বারি খেতেই আড়চোখে মুসকানের দিকে তাকালো সে। মুখ টিপে গেসে মুসকানের পিছন দিয়ে একহাত ঢুকিয়ে একদম নিজের দিকে চেপে বসালো। মুসকান চমকে ওঠে খানিকটা রেগেও গেলো মৃদু আর্তনাদ করে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে একবার সায়রী একবার মুরাদের দিকে তাকালো। ইমন সেসবে পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো মুসকানকে নিজের দিকে চাপতে লাগলো। মুসকান এবার রাগি লুকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললো,

“এটা কি হচ্ছে নানাভাই? ”

ইমন মুচকি হেসে ফিসফিস করে বললো,

“একটু রোমান্টিক হওয়ার জন্য মন আনচান করছে ডিয়ার। ”

“মানে! দাদাভাই আছে প্লিজ ছাড়ো। ”

“কিচ্ছু হবে না। ”

ইমন ফিসফিস করে এটুকু বলতে বলতেই মুসকানের শাড়ি ভেদ করে উন্মুক্ত পেটটায় হাত বিচরণ শুরু করলো। পুরো শরীর শিরশির করে ওঠলো ওর। আবেশে চোখ বুজে আসলো নিঃশ্বাস হয়ে গেলো ভারী। এমন সময় মুরাদ কিছুটা পিছনে তাকিয়ে বললো,

” তোর দাদিটা নাকি খুব প্যাঁচাল পারে? ”

অতিকৌশলে মুরাদের দিকে স্বাভাবিক ভণিতায় তাকিয়ে উত্তর দিলো ইমন,

“মাঝে মাঝে প্যাঁচাইলা মানুষও ভাল্লাগে। ”

সামনে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো মুরাদ বললো,

“আমার বোনকে বেশি ঘাটতে আসলে গুষ্টি উদ্ধার করে দিমু। ”

কিছু বললো না ইমন কারণ তার মনোযোগ এখন মুসকানের দিকে। তাকে থামানোর জন্য নিজের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে হাতে নখ ডাবিয়ে দিচ্ছে মুসকান। তবুও কিঞ্চিৎও হাত সরেনি ইমনের। ওষ্ঠকোণে ঝুলানো ছিলো প্রশস্ত হাসি। ইমনকে কোনভাবেই শাস্তি দিতে না পেরে টলমল চোখে বড়ো বড়ো করে তাকালো মুসকান। মুসকান সিরিয়াস হয়ে গেছে বুঝতেই আলগোছে হাত সরিয়ে নিলো ইমন। সায়রীকে ডেকে প্রশ্ন করলো,

“কিরে মন খারাপ। তোদের মেয়েদের মুড অফ অন হতে একটুও সময় লাগে না তাইনা? ”

চমকিত ভঙ্গিতে ফিরে তাকালো সায়রী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

“ফিরে এসে ডক্টর দেখাতে হবে ইমন আমি খুবই টেনশনে আছি। ”

“চিন্তা করিস না আমরা আছি তো। ”

অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সায়রী। বুকের ভেতর টা কাঁপছে তার এই বাক্যটা যদি আজ দিহান বলতো খুব শান্তি পেতো সে। তার যে দিহান’কে প্রয়োজন।
.
ইমন মুসকানকে নিয়ম অনুসারে ঘরে তোলা হলো। রিমির মা বড়ো বাটি করে দুধ চিতই আরেকটি বড়ো প্লেটে পায়েস নিয়ে এলো। তারপর ইমন মুসকানকে পাটিতে বসিয়ে পিঠা আর পায়েস খাওয়ালো বাকি সবাইও ওদের সঙ্গে যোগ দিলো। কিছু সময় গল্পস্বল্প করে সবাই চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ইমন আর মুসকান’কেও বলা হলো পোশাক পাল্টাতে।
.
ইমন আর মুরাদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছু একটা আলোচনা করছে। ক্লান্ত মুসকান রুম থেকে উঁকি দিয়ে ইমনকে মুরাদের সঙ্গে দেখে ছোট্ট একটি শ্বাস ছেড়ে রুমের ভিতরে চলে গেলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে এক একে সেফটিপিন গুলো খুলতে শুরু করলো। শেষ একটি সেফটিপিন খোলার চেষ্টা করেও বার বার ব্যর্থ হলো তাই নিজে আর চেষ্টা না করে রুমের বাইরে উঁকি দিলো। ইমন তখনি দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করলো,

“কি সমস্যা? ”

মুসকান উত্তর না দিয়ে ইমনকে পাশ কাটিয়ে রিমির রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। তখনি ইমন ওর আঁচল টেনে ধরলো। চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেলো মুসকানের আশেপাশে তাকিয়ে চট করে রুমে ঢুকে বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,

“তোমার সমস্যা কি? টানছো কেন? ”

“প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চলে যাওয়া কোন ধরনের বেয়াদবি। ”

অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো মুসকান অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আঙুল তুলে বললো,

“কোনটা বেয়াদবি কোনটা আদবি সেটা তোমার থেকে শুনতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছুক নই আমি। ”

ঠাশ করে দরজা লাগিয়ে দিলো ইমন। মুসকানের দিকে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

“আঙুল নামাও। ”

“নামাবো না আপনার কথা শুনতে আমি বাধ্য নই। সরেন, সামনে থেকে সরেন আপনাকে দেখলেই আমার গা জ্বালা করছে। ”

বলেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলো মুসকান। ইমনের মেজাজও খারাপ হয়ে গেলো কথা শুনে। আবার এই রাগের পেছনে কারণও টের পেলো। কিন্তু কিভাবে সবটা ম্যানেজ করবে তাই মাথায় ধরলো না। তবুও চেষ্টায় কমতি রাখলো না। আঁচল ধরতে গিয়েও পারলোনা মুসকান আগেই আঁচল দু’হাতে বন্দি করে নিয়েছে। অবাক হয়ে হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়ে পিছন থেকে ব্লাউজের ফিতায় টান দিলো ইমন। দরজার সিটকেরি খোলার শব্দ হতেই দ্রুত ওকে টেনে বুকে পুরে নিয়ে দরজা আবার ঠাশ করে লাগিয়ে দিলো। মুসকান ‘ উম উম’ শব্দ করে ইমন থেকে সরে যেতেই ইমন ওকে পাঁজা কোল করে নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলো। বাচ্চাদের মতো মুড়িয়ে বুকে নিয়ে বসেই বললো,

“আমাকে দেখলেই গা জ্বালা করছে? এবার স্পর্শে যন্ত্রণা করবে। ”

বলেই ওকে মুড়িয়ে নিয়ে পিঠের কাছের সেফটিপিন খুলে আঁচল খুলে ফেললো। মুসকান আঁতকে ওঠে খামচে ধরলো ইমনের হাত। হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে করতে বললো,

“তুমি আমাকে একটুও ছুঁবে না, প্লিজ না আমি সহ্য করতে পারছিনা। ঐ মেয়েটা তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো, তোমরা একে অপরের গালে গাল ছুঁইয়েছো ছিঃ ছাড়ো আমায়। ”

কথাগুলো বলতে বলতেই ইমনের দুগাল খামচে ধরলো। অসাবধানতাবশত চোখেও লেগে যায়। চোখে লাগতেই আর্তনাদ করে মুসকান’কে ছেড়ে দেয় ইমন। মুসকান ছাড় পেয়ে দ্রুত ওঠে দাঁড়ায় রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দু’পা বাড়িয়েও থেমে যায়৷ পিছন ঘুরে দেখে একহাতে ইমন নিজের চোখ চেপে ধরে আছে। আরেকটু সুক্ষ্ম ভাবে তাকিয়ে বুঝলো চোখ দিয়ে পানিও বের হচ্ছে। তা দেখে বুকটা কেঁপে ওঠলো। ভয়ার্ত মুখশ্রী’তে কাছে গিয়ে ইমনের হাত ধরে ব্যস্ত গলায় বললো,

” কি হয়েছে চোখে লেগেছে আমি বুঝতে পারিনি সরি, দেখি আমাকে দেখতে দাও। ”

ইমনের হাত সরানোর চেষ্টা করলো মুসকান কিন্তু সে হাত চেপে ধরে রইলো। মুসকান ভয় পেয়ে ব্যাথাতুর দৃষ্টি তে তাকিয়ে হালকা ফুঁ দিতে শুরু করলো। অনেকটা সময় এমন করার পর অপরাধীর ন্যায় মুখ করে ইমনের পাশে চুপটি করে বসলো মুসকান। ইমন দীর্ঘসময় চোখ ধরে চুপ মেরে বসে থাকার পর গম্ভীর গলায় উত্তর দিলো,

“বসে আছো কেন পোশাক পাল্টাও যাও। ”

“আমি সরি আমি বুঝতে পারিনি। ”

“হ্যাঁ আজ রাতে আমিও কিছু বুঝবো না এবার যাও পোশাল ছাড়ো। ”

বুকের ভিতর ধক করে ওঠলো মুসকানের। ইমনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরে বললো,

“দেখি কতোটা লেগেছে? ”

ইমন হাত সরিয়ে ওঠে দাঁড়ালো বললো,

“একটুও লাগেনি পোশাক চেঞ্জ করো মুসকান,ভালো লাগছে না এসব। ”

বলেই রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ইমন৷ মুসকানও মুখ ভাড় করে পোশাক পাল্টে নিলো। সকলের সঙ্গে মিলে রাতের খাবারও খেয়ে নিলো। যদিও মুসকান বরাবরের মতো খুবই অল্প খেলো। তবুও খেয়েছে এই অনেক সকলের কাছে।
.
রাত তখন সাড়ে এগারোটা বাজে। মুরাদের সাথে একাকী কথা বলে ছাদ থেকে নিচে নেমে এলো ইমন। মুসকানের রুমের পাশেই মরিয়ম আক্তারের রুম। কিন্তু আজ সে রুমে সায়রী আর মুসকানের মামাতো বোন মারুফা ঘুমিয়েছে। ইমন সবটা বুঝেই মুসকানের রুমে প্রবেশ করলো। মুসকান ঘুমিয়ে পড়েছে দেখতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। গালের দিকে জ্বালা করছে ভীষণ। ছোট ছোট খোঁচা দাঁড়ির জন্য নখের আঁচ গুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। ভাগ্যিস তার বউয়ের হাতে জোর কম তাই তেমন দাগ পড়েনি জোর থাকলে আর উপায় ছিলো না। ভেবেই মৃদু হেসে বিছানায় গিয়ে বসলো। দু’বার মুসকান বলে ডাকতেই মুসকান নড়েচড়ে ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসলো৷ কিছুক্ষণ সময়ে আবার শান্তও হয়ে গেলো। ইমন তার দিকে কিছুক্ষণ নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,

“মাথা যন্ত্রণা করছে মাথাটা টিপে দাও তো। ”

একবার হাই তুলে ঘুম ছাড়ানোর চেষ্টা করলো মুসকান তারপর ইশারা করলো শুয়ে পড়তে৷ ইমন চুপচাপ শুয়ে পড়লো। মুসকান ওর দিকে চেপে বসে কোমলীয় হাতজোড়া দিয়ে মাথা টিপে দিতে শুরু করলো। ইমন চোখ বুজে ফেললো ঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে বললো,

“মুসু পৃথা আমার বন্ধু। বাংলাদেশী হলেও জার্মানেই বেড়ে ওঠা ওর। কিছু বন্ধু থাকেই গায়ে পড়া স্বভাবের এদের ভদ্র ভাবে এড়িয়ে চলতে হয়৷ আজ যা হয়েছে হুট করেই হয়েছে আমি বুঝেও ওঠতে পারিনি৷ এটাকে এতোটা সিরিয়াস নেওয়ার কিছু নেই। ”

“মাথা ব্যাথাটা সিরিয়াস নাকি এসব বলার জন্য সিচুয়েশন মাত্র? ”

এমন একটি প্রশ্নে আচমকাই মুসকান’কে টেনে শুইয়িয়ে বিছানার সঙ্গে চেপে ধরলো ইমন। দু’হাতের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে শক্তভাবে চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে বললো,

“এতো বুদ্ধিমতী হতে কে বলেছে? ”

“ছাড়ো সব বোঝা শেষ আমার যাও না যাও ওর কাছে যাও। ”

“এতো সুখ ছেড়ে ওখানে মরতে যাবো কেন? ”

বলেই মুসকানের গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো ইমন। কয়েকপল ধস্তাধস্তি করে মুসকানকে কন্ট্রোলে সর্বোচ্চ বেহায়ার মতো আচরণও করে ফেললো। লজ্জায় খিঁচ মেরে গেলো মুসকান। ইমনের থেকে ছাড় পাওয়ার জন্য কান্না করেও দিলো। এক পর্যায়ে মেজাজ বিগরে গেলো ইমনের। অসহ্য হয়ে রাগের সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়াতে কামড় বসিয়ে দিলো গলায় আর থুতনিতে। বেশ ব্যাথা দিয়ে রাগে ফোঁসতে ফোঁসতে ছেড়েও দিলো অতঃপর বিছানা ছেড়ে রুম থেকেও বেরিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে বললো,

“একটু ছুঁতেই যদি এই অবস্থা হয় আর জীবনে বাচ্চার মুখ দেখতে হবে না আমার! ”
#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_২৭
#জান্নাতুল_নাঈমা
____________________
মেঘাচ্ছন্ন আকাশটার দিকে নিশ্চুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুসকান৷ আধঘন্টা হয়েছে বাবার বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়িতে পদার্পণ করেছে সে। ঐ আকাশটার মতোই তার মনেও মেঘ জমে আছে খুব। কতো করে বোঝালো ইমন’কে, বোঝালো নিজের ভাই’কে, মা’কে। কেউ তার কথা শুনলো না। সবাই তাকে নিয়ে নয় বরং নিয়মকানুন পালনে ব্যস্ত। এমন ধরাবাঁধা নিয়মে তার মনের ওপর দিয়ে যে কি যাচ্ছে তা কেউ বোঝার চেষ্টাই করছে না। শুধু কি মন শরীরের ওপর কি কম ধকল যাচ্ছে? কিন্তু কাকে বোঝাবে এসব, কেউ যে বোঝার চেষ্টাই করছে না। গতরাতে ইমন রাগ করে সারারাত ঘরে ফেরেনি। সকালে যাও ফিরলো একটি শব্দও উচ্চারণ করলো না তার সাথে। আসার সময় গম্ভীর কন্ঠে শুধু বললো,তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। পিছন পিছন কিছু সময় ঘ্যান ঘ্যান করেও লাভ হলো না অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভষ্মই করে দিলো তাকে। সবটা ভাবতেই আবারো বুক ভারী হয়ে ওঠলো মুসকানের। এমন সময় পারুল রুমে এলো বললো,

“ভাবি আপনাকে মা ডাকছে পাশের বাসার চাচি আর তার ছেলের বউ এসেছে চা দিতে হবে। ”

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বারান্দা থেকে সরে এলো মুসকান। চোখের জল চিকচিক করছে তা মূহুর্তেই লুকিয়ে মিষ্টি হেসে জবাব দিলো,

“তুমি যাও আমি এখুনি আসছি। ”
.
রাত আটটার দিকে আলটাসনোগ্রাফির রিপোর্ট ডক্টর’কে দেখিয়ে ডক্টরের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু মেডিসিন নিয়ে গাড়িতে ওঠলো সায়রী, ইমন৷ ড্রাইভিং সিটে বসলো ইমন তার পাশে নিচের দিকে তাকিয়ে রোবটের ন্যায় বসে আছে সায়রী। দু’চোখ ভরা জলগুলো টপটপ করে গড়িয়েও পড়তে শুরু করলো। ইমন ধীর গতিতে ড্রাইভিং করছে। কারণ সে সায়রীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলবে। যা আজ এ মূহুর্তে সায়রীর জানাটা খুব দরকার।

“আমি তোকে কিছু বলতে চাচ্ছি আশা করি মনোযোগ দিয়ে শুনবি এবং বোঝার চেষ্টা করবি। ”

দৃঢ়ভাবে কথাটি বলতেই সায়রী দ্রুত হস্তে অশ্রুকণাগুলো মুছে নিয়ে স্বাভাবিক ভণিতায় বললো,

“বল।”

“মেয়েরা বুঝে কম অভিমান করে বেশি এটাতো বিশ্বাস করিস নাকি? ”

আড়চোখে ইমনের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো সায়রী। নিজেকে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে বললো,

“কি বলতে চাচ্ছিস? ”

“আমি বলতে চাচ্ছি প্রতিটি মানুষের মাঝেই বোঝার ক্ষমতা বেশি থাকা উচিৎ৷ আর অভিমানও বুঝে শুনে করা উচিৎ। একটা ড্রেস কিনলাম লাল কালার দেখে। পরেরদিন সকালে সেই ড্রো সাদা হয়ে গেলো বলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া উচিৎ নয়৷ বরং সাদা কেন হলো এর পিছনে যৌক্তিক কারণ কি? তা সম্পর্কে অবগত হয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ আমি সে ড্রেসটা পরবো নাকি পরবো না। ”

“তুই ওর হয়ে একটা কথাও বলবি না ইমন। ”

“শাট আপ আমি কারো হয়ে কথা বলি না, এটা তুই ভালো করেই জানিস। ”

চুপ হয়ে গেলো সায়রী। ইমন লম্বা এক শ্বাস ছেড়ে আচমকাই গাড়ির ব্রেক কষলো। ফোন বাজছে তার। পকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো বারোটা মিসড কল। তৎক্ষনাৎ আবারো বেজে ওঠলো ফোন। মুসকান ফোন করেছে দ্রুত রিসিভ করে ঝাড়ি মেরে বললো,

“একবার ফোন করে পাওনি মানে অবশ্যই বিজি আছি। এতো বার বার ফোন করছো কেন? কোন কাজ না থাকলে ঘুমিয়ে পড়ো। ”

মুসকানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোন কেটে দিলো ইমন। সায়রী বিরক্ত হয়ে বললো,

“ওকে ধমকাচ্ছিস কেন ওর কি দোষ? ”

“চুপ তোরা প্রত্যেকেই দোষী তোদের নাকের ডগায় রাগ থাকে এই মাথায় কিচ্ছু নেই। ”

“ইমন…”

“কি ইমন? কি বোঝাবি তুই আমাকে, আমি ভাবতে পারিনি তোর মতো বুদ্ধিমতী মেয়ে এমন করবে। তুই যদি এমন করিস তাহলে আমাদের পজিশন তো খুবই ডেঞ্জারাস হয়ে যাবে। ”

“আমি কোন ভুল করিনি। ”

“ভুল তো তোরা দুটোই করেছিস বাট স্টার্ট করেছিস তুই। তাই আগে তোকে থাপড়াবো তারপর ঐ গর্দব টাকে। ”

“আমি প্র্যাগনেন্ট ইমন! ”

“তো কি? ডেলিভারি হওয়ার দুমিনিট পর থেকেই থাপড়ানো শুরু করবো। ”

ক্লেশমিশ্রিত হাসলো সায়রী। মাথা দুলিয়ে বললো,

“আচ্ছা যা মারিস। ”

“তার আগে অপরাধটি বলে নেই? ”

“সিওর। ”

দুরুদুরু বুকে এক ঢোক গিলে ইমনের দিকে ভয় ভয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সায়রী। ইমন বললো,

“তুই সেদিন ডক্টর দেখালি ভালো কথা তোর সমস্যা নেই বেশ। বাড়ি এসে দিহান’কে সবটা জানালি। তারপর হুট করেই দিহানের মন চেঞ্জ হয়ে গেলো! ”

সায়রীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলতেই থাকলো ইমন,

“তোর সাথে বাজে আচরণ করলো অন্যায় করেছে। দিহান কেমন আমি তুই খুব ভালো করেই জানি৷ কিন্তু যে দিহান তোকে এতোটা ভালোবাসে সে দিহান কি করে অমন আচরণ করতে পারে? একবারো মনে প্রশ্ন জাগেনি যদি জাগেই তাহলে এভাবে আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিলি? সেদিন যখন দিহান তোকে ফিরিয়ে নিতে চাইলো তুই একবারো প্রশ্ন করিস নি আজ কেন? দিহান লুকাতে চেয়েছে কিন্তু সেই লুকিয়ে থাকা অনেক বড়ো সত্যিটা তুই খোঁজার চেষ্টাই করিসনি। আর সেদিন ছাদের ঘটনা! ইচ্ছে করছে এখনি কয়েকটা লাগাই গালে বেয়াদব মেয়ে। বাচ্চা নাকি নষ্ট করে দিবি, মেরে ফেলবি তো এখন দেখি কিভাবে তুই কি করিস। দিহান তো তোকে বাঁচিয়ে রেখেছে এমন কথা মুসকান যদি ওর ভাবনাতেও কখনো আনতো একদম পুঁতে ফেলতাম।”

পুরো শরীর মৃদু কাঁপছে সায়রীর। গলা শুকিয়ে কাঠ। শরীরটাও খারাপ লাগছে ভীষণ। ইমন ওয়াটার বোতল এগিয়ে দিয়ে বললো,

“পানিটা খেয়ে নে, এতো ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তুই এখন একা নেই তোর মাঝে যে ছোট্ট প্রাণ টা আছে তার জন্য এই ঘাবড়ানোটা বর্জন করতে হবে। ”

সায়রী দেরী করলো না এক নিমিষেই পানি নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটাই শেষ করলো। তারপর উত্তেজিত হয়ে বললো,

“আমাকে সবটা বল ইমন আমি জানতে চাই সবটা। ”

“এতো উত্তেজিতও হওয়া যাবে না সবটাই বলবো তুই শান্ত হয়ে বোস। ”

সায়রী কিঞ্চিৎ শান্ত হয়ে বোসলো। ইমন আর সময় নিলো না চাইলো না সায়রীকে আর উত্তেজিত করতে। তাই বললো,

” তুই যখন তোর রিপোর্ট গুলো দিহানকে দেখালি দিহানের মাথা খারাপ হয়ে যায়। কারণ তোর কোন সমস্যা নেই,তবুও তুই কনসিভ করতে পারছিস না। তার মানে সমস্যা টা ওরই৷ যদি তোর সমস্যা থাকতো ওর বিন্দু জায় আসতো না। সারাজীবন তোকে নিয়ে সুখেই কাটিয়ে দিতো৷ কিন্তু সমস্যা যেখানে তোর না সেখানে ওরই সমস্যা তাহলে ওর জন্য তোর জীবন নষ্ট হচ্ছে! ওর জন্য শুধুমাত্র ওর জন্য তুই মা হতে পারছিস না, কখনো মা হতে পারবিনা? এটা ভাবতেই ও পাগল হয়ে যায়। আর যাইহোক তোর থেকে বাচ্চা সুখ কেড়ে নিতে চায় না৷ বোকার মতো ভাবতে থাকে সমস্যা টা ওরই। ভয়ে পরীক্ষা নিরিক্ষাও করাতে চায় না। তাই যখন তুই বললো ডক্টর দেখাতে জ্ঞানহীন হয়ে গেলো। কিভাবে কি করবে বুঝে ওঠতে না পেরে ঐসব আচরণ করলো। তোকে ও খুব ভালো করেই চেনে ঠিক জানে যে কি ধরনের আচরণ করলে তুই ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবি। তাই সে ধরনের আচরণ করেই সাকসেসফুল হলো। তুই চলেও এলি বাড়ি থেকে। ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিলি। কিন্তু কিছু দিন পর মুরাদ আর আমি ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে যখন ডক্টরের কাছে পাঠালাম। সমস্ত রিপোর্ট স্বাভাবিক এলো তখন ও উন্মাদের মতো তোর কাছে ছুটে এলো। তুই অভিমান কিছু সময়ের খারাপ আচরণ কে গুরুত্ব দিয়ে তোদের এতো বছরের ভালোবাসা এতো বছরের বৈবাহিক সম্পর্কের থেকে আস্থা হারিয়ে ফেললি। ও তোকে আহত করেছে আর তুই ওকে নিহত হয়ে যাওয়ার পথ খুলে দিলি! ”

দুচোখ দিয়ে ঝরঝরিয়ে অশ্রু পড়তে শুরু করলো সায়রীর। ইমন গভীর এক শ্বাস ছেড়ে বললো,

” কাঁদছিস কেন? এতো বছরের ভালোবাসা গুটিকয়েক দিনের আচরণে শেষ করে দেওয়া কি ঠিক হতো? পান থেকে চুন খসলেই ডিভোর্স আর ডিভোর্স উচ্চারণ করবি তোরা। বছরের পর বছর স্ট্রাগল করে একে অপরকে পাবি আবার ঠুনকো কিছু বিষয় নিয়েই ডিভোর্স দিবি সমাজ টা কি হয়ে গেলো সায়রী, কি হয়ে গেলো তাইনা? যেদিকে তাকাই শুধু বিচ্ছেদ আর বিচ্ছেদ। আজ কাল প্রেম, ভালোবাসার মতোই বিয়েটাও সহজলভ্য হয়ে গেছে।”

“ইমন আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তুই বিশ্বাস কর আমি জানতাম অনেক বড়ো কোন কারণ আছে এর পিছনে৷ কিন্তু অসভ্যটা এমন কিছুর জন্য এমন করবে আমি ভাবতেও পারিনিরে। ”

বাঁকা হাসলো ইমন গাড়ির ডোর খুলে বের হতে হতে বললো,

“অসভ্যটাকে পাঠাচ্ছি ভালো একটা রেষ্টুরেন্টে গিয়প ডিনার সেরে নিস। ”

চমকে ওঠলো সায়রী উৎকন্ঠা হয়ে বললো,

” তুই কোথায় যাচ্ছিস গাড়ি নিবি না? ”

“না তোরা একটু রিল্যাক্স হয়ে ঘুরাঘুরি কর। আমি রিকশা করে বাড়ি চলে যাচ্ছি। ”

ইমন বের হওয়ার সাথে সাথে ঝড়ের গতিতে গাড়িতে ওঠে বসলো দিহান। হকচকিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলো সায়রী। দিহান ডোর লক করে গাড়ি স্টার্ট করতে করতে তার তৃষ্ণার্থ দৃষ্টিজোড়া এক বার মেলে ধরলো সায়রীর দিকে। মুখশ্রী থেকে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে উদরের দিকে গভীর চাহনী নিক্ষেপ করলো। সায়রী এক ঢোক গিলে ওড়না দিয়ে উদর ঢেকে ফেলে দিহানের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিরবতা পালন করতে শুরু করলো।
___________________
প্রেয়সীর মনে মেঘ জমেছে বহুক্ষণ। সেই মেঘ গুলো এবার অজস্র ক্ষুদ্র কণার ন্যায় বৃষ্টি হয়ে ঝড়তে শুরু করেছে। সে কেবল ঝড়েনি বরং প্রিয়তম’কে হাহাকার করে জানান দিয়ে নিজের বাঁধ ভাঙা কান্না দিয়ে ভিজিয়েও গেছে। বারান্দা ঘেষে উদাস মনে দাঁড়িয়ে ইমনেরই অপেক্ষা করছে মুসকান। ভারী বর্ষণ হওয়ার ফলে রিকশায় অবস্থানরত হয়েও ভিজে চুপচপে হয়ে গেছে ইমন। এক প্রকার ইচ্ছে করেই তার এই গা ভিজানো। কিন্তু কেন এর কারণ তার জানা নেই…

যে কোন মানব-মানবীর ওপরই বর্ষার প্রভাব খুবই প্রখর হয়। কখনো কখনো প্রেমিক -প্রেমিকারা গভীর নয়নে বৃষ্টি বর্ষণ দেখে। এতে কখনো তাদের মন হয়ে যায় উদাস বা কখনো হয়ে ওঠে রোমাঞ্চকর। মুসকানের মন উদাস হলেও ইমনের মন রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠেছে কিন্তু আজ এই রোমাঞ্চকর অনুভূতির প্রকায় হবে খুবই কঠিন। এ’কথা ভাবতেই কুটিল হাসলো ইমন। তার ভেজা প্রশস্ত বুকটা যেনো মাত্রাতিরিক্ত শীতল হয়ে ওঠলো।
.
বিদ্যাপতির লেখায় ছিল ‘এ ভরা বাদর,এ মাহ ভাদর,শূন্য মন্দির মোর’ ,তেমনি কালিদাসের মেঘদূত কাব্যে বর্ষার মেঘ আর শুধু মেঘ থাকেনা,তাতে প্রেমিক প্রেমিকার মনের আকুতিতে ভরা প্রানের সঞ্চার হয়,এছাড়া রবীন্দ্রনাথ তো আছেনই তার বর্ষার গানের অজস্র সম্ভার নিয়ে , অর্থাৎ মানুষ এবং তদুপরি যারা শিল্পী মনের অধিকারী তাদের ক্ষেত্রে বর্ষার প্রভাব গুরুতর ! এটা অবশ্য ফাল্গুন চৈত্রের ক্ষেত্রেও বলা যায় ,রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ফাল্গুনের কোনো এক সময় ‘এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে’,বা শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত যেমন চৈত্রের চাঁচলে উদাস পথের ডাকে নিশিপাওয়ার মতো বেরিয়েপড়ে পাতাঝরা বনের রাস্তায় । যাই হোক,বর্ষায় মন উদাস বা বিষন্নতা বা মন কেমন করার সাথে হয়তো মেঘের একটা সম্পর্ক আছে । সাধারনত খেয়াল করলে দেখবেন প্রতিদিন যখন সন্ধ্যা হয়ে আসে আমাদের মনটা একটু বিষন্ন হয়ে পড়ে,অর্থাৎ বিকেলের আলো পড়ে এলেই আসন্ন আলো আঁধারি মনকে প্রভাবিত করে।
.
উপর থেকে ইমনকে ভিজে চুপেচুপে হয়ে নামতে দেখেই ছুটে নিচে যায় মুসকান। কিন্তু তার পূর্বেই পারুল দরজা খুলে দেয়৷ ইমন মুসকান’কে উদগ্রীব হয়ে আসতে দেখে পারুলকে গম্ভীর গলায় বলে খাবার রেডি করতে তা শুনে মুসকান তৎপর হয়ে বলে,

“আমি করছি তুমি এভাবে ভিজে আসলে কেন? গাড়ি কোথায় তোমার আর সায়রী আপু? ”

“দিহানের সাথে আছে। ”

কেবল এটুকু বাক্য ব্যয় করেই দ্রুত স্থান ত্যাগ করে উপরে চলে গেলো ইমন। মুসকান পারুলের দিকে তাকিয়ে বললো,

“খাবারটা গরম করতে থাকো আমি এখুনি আসছি। ”

উপরে গিয়ে ইমন কাবার্ড খুলতে নিলেই মুসকান বললো,

“আমি বের করে দিচ্ছি তোমার শরীর ভেজা। ”

ইমন থেমে গেলো। মুসকান গিয়ে তার টিশার্ট আর ট্রাওজার বের করে দিয়ে বললো,

“চেয়ারে বসো চুল মুছে দেই। ”

ইমন কোন কথা না বলে হাত থেকে টান দিয়ে সব নিয়ে বাথরুমে ঢুকে ঠাশ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠলো মুসকানের। গতরাতের পর থেকে মানুষ টা একটা বাক্যও উচ্চারণ করেনি তার সাথে। বুকের ভিতর টা কেমন খাঁ খাঁ করছে। কান্নাগুলো চেপেই নিচে খাবার রেডি করতে শুরু করলো। ঠিক বিশ মিনিট পর নিচে এলো ইমন। তার আগে বাবা,মায়ের ঘর পরিদর্শন করে এসেছে। ফুপু সহ ফুফাতো ভাইবোনরা চলে গেছে। দাদিকেও সন্ধ্যায় তার ছেলে এসে নিয়ে গেছে। সায়রীও বোধ হয় আর বেশিদিন থাকবে না। পুরো বাড়িটাই জনমানব শূন্য প্রায় হয়ে গেলো।

পারুল রান্নাঘরে বাসন ধৌত করছে। মুসকান খাবার গুছিয়ে বসলো মাত্র। ইমন গিয়ে চেয়ার টেনে বসতেই মুসকান তাকে খাবার বেড়ে দিলো। কিন্তু ইমন খাবারে ততোক্ষণ খাবার মুখে তুললো না যতোক্ষণ না মুসকান নিজের খাবার বাড়লো। তার পূর্বে শক্ত পাথরের ন্যায় বসেই ছিলো। দৃষ্টিতে ছিলো সীমাহীন ক্রোধ। যা বুঝা মাত্রই বিনা ভণিতায় নিজের প্লেটে খাবার বেড়ে হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকলো। আর মনে মনে বিরবির করলো,

“এতো কঠোরতায় তো আমি অভ্যস্ত নই আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কেন এমন করছো? ”

দুচোখ ভরে গেলো তার জোর পূর্বক খাবার গুলো শুধু গিলতে থাকলো। এক পর্যায়ে বমি হয়ে বের হওয়ার উপক্রমও হলো। মুখ চেপে ধরে ভয় ভয়ে ইমনের মুখপানে তাকালেই দেখলো সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উপায় না পেয়ে আবারো খাবার খেতে লাগলো কিন্তু ইমন ওর অবস্থা বুঝতে পেরে চাপা রাগ দেখিয়ে চাপা স্বরে বললো,

“জোর করে খেতে হবে না যেটুকু খেয়েছো এটুকু বের হলে আজ কপালে ডাবল দুঃখ আছে। ”

থমথমে মুখে তাকিয়ে রইলো মুসকান। ইমনও অর্ধেক খাওয়া প্লেট টা রেখে ওঠে দাঁড়ালো। বললো,

“জাষ্ট পনেরো মিনিট এর ভেতরে উপরে আসা চাই। ”
.
সব কিছু গুছিয়ে মুসকান উপরে গিয়ে দেখলো সোফায় বসে কোলে ল্যাপটব নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ঘাটাঘাটি করছে ইমন৷ সে দরজা অবদি গিয়েছে মাত্র চোখ তুলে তাকায়ও নি ইমন ল্যাপটবে দৃষ্টি স্থির রেখেই গম্ভীর গলায় বললো,

“দরজা লক করো। ”

বুকের ভিতর যেনো একের পর এক সুঁচ ফোটানো হচ্ছে ঠিক এমন একটিই অনুভূতি হচ্ছে মুসকানের। সে এক ঢোক গিলে দরজা লক করে যেই পিছনে ঘুরেছে অমনি ইমনের রাগান্বিত প্রশ্ন,

“বিয়ে হয়েছে কদিন হলো? ”

কেঁপে ওঠলো মুসকান। পুরো শরীর ভয়ে শিউরে ওঠেছে। ইমনের আচরণ গুলো খুবই ভয়ার্ত লাগছে আজ। হঠাৎ এমন করছে কেন? এ কোন রূপের সম্মুখীন হচ্ছে সে? প্রশ্নগুলো বুকে চেপে এক ঢোক গিলে বললো,

” দু,দুদিন। ”

“আজ এসব পরার অনুমতি কে দিলো? ”

শাড়ি নয় সেলোয়ার-কামিজ পরাতেই এই রাগ! বিস্মিত হয়ে কাঁপা কন্ঠে মুসকান বললো,

” মা,মা’কে বলেছিলাম। ”

“আমার থেকে পারমিশন নিয়েছো? আমি বলেছি? ”

চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করলো ইমন। কাঁদো কাঁদো মুখশ্রী তে ইমনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মুসকান। ইমন ল্যাপটব অফ করে সোফার এক কোণায় রেখে শাহাদাৎ আঙুলটি ঠোঁটে ঘষতে ঘষতে বললো,

“পাঁচ মিনিটে শাড়ি পরা চাই। ”

মুসকানের মাথা ঘুরছে। তার সাথে এসব কি হচ্ছে সে কি কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে? ইমন তার সাথে এতো কঠোর হতে পারে? মনে মনে অজস্র ভাবনা ভাবতে থাকলো সে। ইমন এবার আরো চটে গেলো। ধমকে ওঠে বললো,

“কথা কানে যায়নি? ”

ভয়ংকর মাত্রায় কেঁপে ওঠলো মুসকান৷ হাত, পা কাঁপতে থাকলো অবিরত। বুকের ভিতর ধড়াস ধড়াস শব্দগুলো মুখরিত হয়ে ওঠলো। কোনক্রমে ইমনের সম্মুখ থেকে মুখ ঘুরিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো কাবার্ডের দিকে। একটি সুতি শাড়ি,ব্লাউজ,পেটিকোট বের করে বাথরুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। তখনি আবারো সুঁচ বিঁধানো বাক্যগুলো শুনতে পেলো,

“আমি কি বলেছি বাথরুম গিয়ে শাড়ি পরতে? ”

শরীরটা অসাড় হয়ে এলো মুসকানের। ক্রন্দনরত গলায় বললো,

“মরে যাবো আমি। ”

“মেরেই ফেলবো আমি। ”

বলেই বসা থেকে ওঠে এসে পুরো রুমের বাতি অফ করে দিলো ইমন। তারপর ধীরপায়ে মুসকানের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর পিছন বরাবর দাঁড়ালো। একহাতে জামার পিছনের চেইন খুলে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

” কি মনে হচ্ছে ছিপ ফেলে মাছ ধরেছি তাই তো? ”

মুসকান পিছন ঘুুরার জন্য উদ্যত হতেই ইমন ওর বলিষ্ঠ উষ্ণময় হাতটি দ্বারা পিঠ আঁকড়ে ধরলো। শিউরে ওঠে চোখ বুজে ফেললো মুসকান৷ ইমন এবার কথার তীক্ষ্ণ আঘাত না দিয়ে মুসকানের ঘাড়ে ওষ্ঠজোড়ার তীক্ষ্ণ আঘাত দিতে শুরু করলো। সহ্যের সীমানা অতিক্রম করে ইমনের দিক ফিরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মুসকান। ফুঁপিয়ে ওঠে বললো,

“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ”

চলবে…
রিচেক দেইনি জানিনা কেমন হলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here