তাহারেই পড়ে মনে পর্ব ১০

#তাহারেই_পড়ে_মনে
পর্ব দশ
একে নাচুনি বুড়ি তার উপর ঢোলের বাড়ি! প্রিন্স মুখিয়ে ছিলো, উদগ্রীব হয়ে ছিলো মিষ্টির কাছে ফিরতে আর তখনই ডাকলো মিষ্টি ওকে। ওর কান্নাভেজা কথাগুলো যেন সুধা ঢাললো কর্নকুহরে!
প্রিন্সের জন্য মিষ্টি অন্য কিছু, সেই অন্যকিছু যে কী তা ও জানে না, নিজেও বোঝেনা- প্রকাশ করা তো আরও অসম্ভব। মিষ্টির আহবান এড়িয়ে যাওয়াও ওর পক্ষে অসম্ভব। এদিকে কী কান্ড ঘটিয়ে রেখেছে তা ওর মাথা থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে গেছে- ও সকালের অপেক্ষা করছে, কখন মিষ্টির কাছে যাবে। এমনিতেই এতোদিনের অদেখা, মনের ভেতর জ্বালাপোড়া করছিলো – তায় মিষ্টি কেঁদে সারা হয়েছে আজ – শুধু ওরই জন্য! নিজেকে নিজেই বললো ‘আমি আসছি, বিবিজান।’

খুব সকালে রওনা করে ও যখন এসে পৌঁছেছে ঢাকায়, মিষ্টি তখন ক্লাসে। ও চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলো। কখনো কখনো অপেক্ষা বড় মধুর হয়, আনন্দের হয় – ও হাসতে থাকলো মনে মনে, পৃথিবী ওলোট-পালোট হয়ে গেলেও মনে হয় মিষ্টিকে ক্লাস, পড়াশুনা থেকে দূরে সরানো যাবে না। মাঝে মাঝেই প্রিন্সের মনে হয় ও নিজে আরেকটু পড়াশুনা করলে কী হতো? নিজেকে মিষ্টির তুলনায় খুব ছোট মনে হয় – ওর জন্য মিষ্টির মনে কোনো খেদ নেইতো, কোনো আক্ষেপ! যোগ্যতার বিচারে নিজেকে অনেক তুচ্ছ লাগে, ভালোবাসেতো মিষ্টি নাকি করুণা করে? আরেকবার যদি সুযোগ পাওয়া যেতো ও নিশ্চয়ই খুব ভালো করে পড়াশুনা করতো! স্কুলজীবনে শিক্ষকেরা তো ওর মেধার খুব প্রশংসাই করতো, ভালো রেজাল্টও হতো নিচু ক্লাসগুলোতে। কিন্তু বড় হতে হতে নিয়ম করে পড়তে বসার চাইতে আড্ডা, বেড়ানো, বন্ধুবান্ধবই ভালো লাগা শুরু হলো। দিন দিন বইয়ের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকলো। আনন্দ মাস্টার বাঁধা ছিলো বাড়িতে – সবভাইবোনকে এক সাথে করে পড়তে বসাতো। প্রতিদিনই সেখানে একটা ঝামেলা লাগিয়ে দিতো ও। বিনিময়ে জালি বেতের বাড়ি শপাং শপাং করে পিঠে পড়তো। প্রথম দিকে সাবিহা এসে রক্ষাকর্ত্রি হয়ে দাঁড়াতো – কেঁদে চোখ ফুলে যাওয়া ছেলেকে পড়া থেকে উঠিয়ে নিয়ে যেতো। দিন দিন বড় হতে থাকলো আর মার খেয়ে কাঁদতে লজ্জা হলো। তারচেয়ে পড়ার সময়টা বাড়ির বাইরে কাটানোই শ্রেয়তর ছিলো ওর জন্য। প্রায়ই ধরেবেঁধে আনতো মাস্টার কিন্তু আরও বড় হলে, যখন গোঁফ -দাঁড়ির রেখা দেখা গেলো তখন থেকে মাস্টারও সমীহ করে চলতেই শুরু করলো। কোনরকম ডানপিটে, অমনোযোগী মাথায় হাত বুলিয়ে যদি বোর্ড পরীক্ষার বৈতরণি পার করিয়ে নেওয়া যায় তাই ঢের!
পরীক্ষার আগের কয়টা রাত বইখাতার পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে হাঁসফাস লাগতো ওর, কালো কালো অক্ষরগুলোকে অত্যাচারের মতো মনে হতো! নতুন বাইক পাওয়ার লোভে উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পার হতেই তাই ওই বইখাতার জঞ্জালের সাথে সবরকম সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ও।

ক্লাস শেষে দূর থেকে প্রিন্সকে দেখে চপলা কিশোরীর মতো মন নেচে উঠলো মিষ্টির। একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে, পালিশ করা গেটআপ। হালকা গোলাপি রঙের ফুলস্লিভ ফরমাল শার্টের হাতা দুটো করে ভাঁজ দেওয়া, গাঢ় ছাই রঙের প্যান্টের ভিতর ইন করে রাখা। দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে, পেছনে লাল রঙের বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, মাথাটা একটু সামনে ঝুঁকে এসেছে। মিষ্টিকে দেখেনি, চোখ দুটো নীচের দিকে তাকানো। বাউন্ডুলে প্রিন্সের এমন শান্ত, সৌম্য অবতার দেখে মিষ্টি অবাকও হলো, ভালো লাগায় মন ভরেও উঠলো। গোলাপি রঙে প্রিন্সের দুর্বলতা আছে। বেশিরভাগ সময়েই মিষ্টি ওকে এই রঙেই দেখেছে। ও কাছে এসে নিজেও প্রিন্সের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।

‘তুমি কী ঘুমাচ্ছ?’

প্রিন্স চমকে তাকালো। মিষ্টিকে দেখেই সহজ হাসি ফুটলো মুখে। ‘রাতে কি ঘুমাতে দিস তুই আমাকে? কিজন্যে ডেকেছিস, তাড়াতাড়ি বল।’ চোখে আনন্দ নিয়েও এমনভাবে বললো যেন নেহায়েতই মিষ্টি আসতে বলেছে তাই ও এসেছে। ওর কোনো ইচ্ছাই ছিলো না দেখা করার!

মিষ্টি সব বুঝলো। এদিক ওদিক তাকাতে থাকলো। ‘একটা কুকুর খুঁজছি, জানো? পাওয়া গেলে সেটাকে প্রিন্স নামে ডাকা যায় কীনা ভাবছি!’

‘তুই সবসময়ই এইগুলো করিস। আমাকে রাগিয়ে দিস আর ঝগড়া হয়। সবাই আমার রাগটা দেখে, তুই যে উষ্কে দিস সেটা কেউ দেখে না। তারপর রাগের মাথায় আমি কিসব করে ফেলি, উল্টোপাল্টা।’

‘কি করেছো এবার?’

প্রিন্স চুপ হয়ে যায়। মিষ্টিকে কিছুতেই বলা যাবে না ও কী করেছে আর কী করেনি! মিষ্টি ওকে খেয়েই ফেলবে সম্ভাবনা আছে। ‘ঝগড়াই করবি, বিবিজান?’ ও তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে নেয়।

‘না আজকে কানে ধরলাম, এখুনি। আজকে আমি একদম ভালো মেয়ে।’ দুহাতে দুইকান ধরে মাথা নাড়ে মিষ্টি।

‘তো? আমার বাপের টাকায় কেনা বাইক, উঠবি?’

প্রিন্সের খোঁচা গায়ে মাখে না মিষ্টি। চিন্তিত হওয়ার ভান করে বলে ‘ভাবছি, ঠিকঠাক চালাতে পারবে তো? এখুনি তো দেখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাচ্ছিলে। পরে দেখা যাবে এমন মরা মরলাম যে হাত একদিকে, মাথা আরেকদিকে – ঝুড়িতে করে লাশ দিতে হবে মিঠির মায়ের কাছে, আস্ত মিষ্টিকে পাওয়া যাবে না!’

‘শোন, আমি প্রিন্স, আমি যদি চোখ বন্ধ করেও বাইক চালাই তো রাস্তা নিজেই পথ বানিয়ে দেবে। তুই উঠবি কীনা বল?’

‘প্রিন্স ভাই, আমার না বাইকে ভয় করে, যদি ফেলে দাও বা আমি পড়ে যাই!’ মিষ্টিকে বিপদগ্রস্ত দেখা গেলো।

‘মুশকিলে ফেললি দেখছি, আজকে তো আমি কাউকে সাথে আনিনি, তোর ফোন পেয়ে, না পারতে তখনি ছুটে আসিনি। কাউকে আনলে তো সেই দেখতো। এখন এভাবে ফেলে যাবো?’

‘আমার চাইতে বাইক বড় হলো তোমার কাছে?’ মিষ্টি গাল ফুলোলো।

‘নাটক করবি না। এতো ভয় পাওয়া মেয়ে তুই না। বিরক্ত করিস না। আমি আস্তে চালাবো, তোর ভয় লাগবে না।’

‘তথাস্তু, বাপ অফ শাহেনশাহ!’

‘ছিঃ কী বিশ্রী নাম।’ প্রিন্স বিরক্ত হয়। ‘তোর মনে হয়না, তুই আজকে অনেক বেশি কথা বলছিস। সমস্যা কী তোর?’

‘তুমি জানো না গো, আমার খুশিতে আজকে লাফাতে ইচ্ছে করছে, সিনেমার নায়িকাদের মতো কোমর দুলিয়ে নাচতে ইচ্ছে করছে। পুরো শহরে মাইক লাগিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, আমার ভালোবাসার কথা, বলতে ইচ্ছে করছে ‘যাহা চাইয়াছি, তাহাই পাইয়াছি!’

প্রিন্স মুগ্ধতায় বিভোর হয় ওর দিকে তাকিয়ে। মেয়েটাকে এতোটা স্বতঃস্ফূর্ত আগে কখনো দেখেনি ও। ওকে চমকে দিয়ে আবার বলে ওঠে মিষ্টি ‘তোমাকে এমন চোরচোর লাগছে কেন আজকে প্রিন্সভাই? কিছু কি লুকোচ্ছো? অন্য কোনো মেয়েটেয়ে আসেনি তো মাঝখানে? বলো, বলো! চেহারা, লুকেও তো বিস্তর চেঞ্জ! কেমন গ্লো করছো। বলো?’

প্রিন্স অবাক হয়। ও কি মনের ভেতরটাও দেখতে পায়? ‘অনেক বেশি বেশি হচ্ছে না, মিষ্টি?’ ওর একগাছি চুলে টান দেয় প্রিন্স। হঠাৎই মনে পড়লো এমন ভঙ্গিতে বললো ‘তুই মোবাইল নিয়েছিস?’

‘না তো। কিনে দেবে তুমি?’

প্রিন্স যেন আশ্বস্ত হলো মনে মনে। ও যে ঝামেলা পাকিয়ে রেখেছে সেই খবর এখনো পায়নি মিষ্টি। ফোন থাকলে গোপন করা সম্ভব হতো না। কাজিনদের সাথে দুজনেরই খুব ভালো সম্পর্ক। প্রিন্সের বিয়ের খবর যেমন সবাই জানবে তেমনি সেই গল্প মিষ্টির কানে পৌঁছাতেও দেরি লাগবে না। আর সেই তুলি নামের মেয়েটাও বারদুয়েক ফোন করেছে। ও রাজুকে মোবাইল পাস করলে মেয়েটা প্রিন্স ভেবেই রাজুর সাথে কথা বলে গেছে। আবার যদি ফোন করে? ও নিজের ফোনটাও বন্ধ করে নিলো আর মিষ্টিকে বললো ‘দরকার নেই, এমনিতেও তুই তোর ওই বিদ্যার্জনের মাঝে কতটুকুই বা কথা বলবি আমার সাথে।’

‘তুমি হেলমেট পরো না কেন? আমি মোটেও তোমার সাথে উঠবো না। আইন কানুন কিছু মানোনা দেখছি! মিনিমাম প্রটেকশন তো দরকার আছে। ভাবো কি নিজেকে, সুপারম্যান?’ হেলমেট ছাড়া বাইকে উঠতে আপত্তি করে মিষ্টি, এমনিতেই যাবতীয় দুইচাকার যানে ভয় আছে ওর।

প্রিন্স বিরক্ত হয় ‘তুই জানিস কি, ন্যাকামি জিনিসটা তোর সাথে যায় না?’

‘এটা ন্যাকামি নয়, সচেতনতা। এই প্রথম, এই শেষ – আর কখনো এইরকম হেলমেট ছাড়া তোমার বাইকের পেছনে আমাকে পাবা না।’

‘চুলগুলো আটকে নে না?’

‘কেন, আমার চুলে তোমার কী ক্ষতি হচ্ছে?’

‘চুল খুলে রাখতে নেই, পাগল। কেমন জানি নেশা নেশা লাগে, জানিস?’

‘উঁহু, জানিনা তো। নেশা করে দেখেছ কখনো?’ প্রিন্সের পিঠে নাক ঘষতে থাকে মিষ্টি! ‘তোমার ঘ্রাণ নিয়ে নিচ্ছি, বুঝেছ? কখন ঝগড়া করবা আর কয়েকমাস লাপাত্তা হয়ে যাবা, তার তো ঠিক নেই – তোমার গায়ের ঘ্রাণ মুখস্থ করে রাখি, ওইসময়ে কাজে দেবে।’

সারাদিন এলোমেলো ঘুরলো দুজন, সারাশহরে। বিকেলে যখন হলের সামনে মিষ্টিকে নামিয়ে দিতে এলো, তখন হারানোর ভয় জেঁকে বসলো প্রিন্সের মনে। ও আঁকড়ে ধরলো মিষ্টিকে ‘চলনা, বিয়ে করে ফেলি, বিবিজান।’
মিষ্টি ওর হাতটা ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। প্রিন্স এবার কাতর হলো, নিজের কথা চেপে গিয়ে বললো ‘মনে কর জাফরিন খালা এখন তোকে বিয়ে করার চাপ দিলো, কী করবি তখন তুই? তার চেয়ে আমরা বিয়ে করে ফেলি, তাহলে আর কোনো টেনশন নেই। বিশ্বাস কর আমি তোকে এক লাইনও বিরক্ত করবো না। তুই না ডাকলে আসব না, তোকে এক ইঞ্চি ছুঁয়ে দেখব না।’

মিষ্টি হাসলো। আলতো করে চেপে ধরলো ওর হাত, যেন আশ্বস্ত করলো ‘আগামি আড়াই বছরের জন্য নিশ্চিত থাকো প্রিন্সভাই। আর ততদিনে আমি আব্বু আম্মুকে ঠিক রাজি করিয়ে ফেলবো। তুমি শুধু মাথা ঠান্ডা রেখো।’

প্রিন্স নিজেও জানে এইদিকে ওর আসলেই ভয় নেই। ভয় তো নিজেকে নিয়েই। মিষ্টিকে ছেড়ে আসতে আজকে অনেক কষ্ট হলো ওর। সারারাস্তা উপায় খুঁজতে লাগলো। যে পাঁক নিজে ঘুলিয়ে ঘোলা করেছে তার থেকে পরিত্রানের বুদ্ধি কী ভাবলো শুধু। কী হবে কী হবে ভাবলো কিছুক্ষণ তারপর নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দিলো, কী আর হবে- গন্ডগোল লাগবে একটা, খুব চিল্লাপাল্লা হবে, মা কান্নাকাটি করবে, খুব বেশি হলে বাড়ি থেকে বের করে দেবে বাবা! বাড়ি থেকে বের হলে কোথায় যেতে হবে আর কী করতে হবে তার প্ল্যানও সেট করলো অনেক ভেবে ভেবে। শুধু মিষ্টিকে এর থেকে দূরে রাখতে হবে। এমনিতেই কাজ করো, কাজ করো বলে মাথা খেয়ে ফেলে মেয়েটা! তবে মাকে ঠিক করতেই পারলে সব মুশকিলই আসান! এমনিতেই প্রথম সন্তান, একমাত্র পুত্র বলে ওকে চোখে হারায় সাবিহা! মায়ের কাছে চেয়েছে কিছু অথচ পায়নি এমন কোনোদিন হয়নি। আজকে মিষ্টিকেই চাইবে, মনে মনে ঠিক করে নিলো প্রিন্স!

কিন্তু বিধাতা যে কপালে অন্য কিছু লিখছিলো তা কি কেউ জানে?

পুরো বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় বেশ জোরেশোরেই শুরু হয়েছে। সাবিহা, জিনিয়া, পরিবারের আরও মেয়েসদস্যরা মিলে শপিং করে ঘর ভরিয়ে দিয়েছে। অর্ধেকের বেশি দাওয়াত পৌঁছে গেছে। প্রিন্সের আনপ্রেডিক্টেবল ন্যাচারের সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত। ওর মতিভ্রম হওয়ার আগেই বিয়েটা সেরে ফেলতে চায় সাবিহা তাও ধুমধামের সাথে। কাজিন গ্রুপেও প্রিন্স খুবই পপুলার – তারাও নানারকম প্ল্যানিং করছে। প্রিন্সের বন্ধুরাও খুব উৎসাহী – এর ভিতর প্রিন্সই শুধু মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে! নিজের পাতা ফাঁদে পড়ে গিয়ে নিজেই কুপোকাত, বেচারা! মিষ্টির রুমমেটের ফোন দিয়ে মাঝেমাঝেই ওর সাথে কথা হয়। মিষ্টি বাড়ি যাবে শুনে ওর কলিজার ধরফড়ানি বেড়ে গেছে- বাড়ি গেলেই তো ও শুনতে পাবে প্রিন্সের বিয়ের খবর। গাঁয়ে হলুদে যে ম্যাচিং শাড়ি পরা হবে তাও হয়তো কেউ পৌঁছে দেবে মিষ্টিকে! মিষ্টি তখন কী করবে? ভেবে ভেবে কোনো তল খুঁজে পায়না ও। বাবাকেই ভয় হয় বেশি- যে বজ্রকন্ঠ, তার উপরে বদনামও আছে এলাকা জুড়ে। লোকে আড়ালে ‘জালিম খাঁ’ বলে ডাকে ওর বাবাকে। প্রিন্স আস্তে আস্তে মায়ের কাছে গেলো। ঝুট-ঝামেলায় মাথা গরম সাবিহার। কদুর তেলে মাথা চুপচুপা করে, ঘুমানোর জন্য বাতি বন্ধ করে একটু শুয়েছে – প্রিন্স গিয়ে মায়ের পায়ের কাছে বসলো। ‘কীরে বাপ, সারাদিন কই কই টো টো করিস? তোর জন্য ঐ ‘জালিম খাঁর গালাগালি খাই আমি। লায়েক ছেলে, বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, বাপের হাত বাটা উচিত না?’

‘বিয়ে করবো না, মা।’

সাবিহা উঠে বসে। এই ভয়টাই তার ছিলো। ‘কেন বাপ, কী হইছে? কেউ কিছু কইছে? কিছু লাগবে তোমার? নতুন গাড়ি না সেইদিন নিলা? যা চাও, একটু কথা শুনাইলেও তো তোমার বাপে সবই দেয়। তোমার মতো কপাল কয়টা ছেলের কও? সব বাপে কইরা দিয়ে যাইতেছে। যা করছে সারাজীবন পোলাপাইন নিয়ে বইসা খাইয়া যাইতে পারবা। তাইলে কী চাও আর?’

‘বিয়ে করবো না মা।’

‘কেন? তুমি বললা বইলাই তো আমরা আগাইলাম। এখন বিয়ে করবা না বললে চলে? তোমার কোনো পছন্দ আছে? সেওতো আমি জিগাইছি তোমারে। তুমিই তো না কইছো।’

‘ভুল হয়ে গেছে মা।’

‘কি ভুল হইছে? মাইয়ারে আংটি পরায়ে আইছি। বিয়ার দিন পড়ছে। কেনাকাটা হয়ে গেছে। গয়না গড়ানি শেষ। দাওয়াত দেওয়া শেষ। এখন আর এইসব বইলো না। তোমার বাপ একদম গাঁইড়া দেবে। মনে অশান্তি করে, বাপ? বিয়ের আগে ওইরকম অশান্তি সবার হয়। বৌয়ের মুখ দেখলে, দুইদিন -পাঁচদিন একসাথে কাটালে দেখবা সবঠিক হয়ে গেছে।’

এবার মরিয়া হয় প্রিন্স ‘এই বিয়ে কোনোভাবেই সম্ভব না, মা।’

এবারে সাবিহার অন্যরকম লাগে। ‘তোমার কি কাউরে পছন্দ, বাপ?’

মায়ের কোলে মুখ ডুবিয়ে দেয় প্রিন্স। আস্তে করে বলে ‘মিষ্টি, মা।’

‘মিষ্টি? কোন মিষ্টি। জাফরিনের মাইয়া? ও তো কালো!’ আঁতকে ওঠে সাবিহা। ‘ওগো সাথে আমাগো আত্মীয়তা সম্ভব না, বাপ।’

‘আমি মিষ্টি ছাড়া কাউকে বিয়ে করবো না, মা।’ এবারে জেদ দেখায় প্রিন্স।

‘আচ্ছা, আমি দেখতেছি কী করা যায়। তুমি ঘরে যাইয়া ঘুমাও।’

মা এতো তাড়াতাড়ি মেনে যাবে প্রিন্স ভাবেইনি। এবার মাই সামলে নেবে বাবাকে, এই বিয়েটাকেও! সাবিহা ভালোমতোই সামলে নিলো, তবে অন্যভাবে। ও জাফরিনকে ফোন দিলো। বেশ কুশলাদি বিনিময় হলো, প্রিন্সের বিয়ে কোথায়, কেমন মেয়ে এসব জানতে চেয়ে বিয়েতে আসার আগ্রহও প্রকাশ করলো জাফরিন। তখনই টেনে টেনে হেসে হেসে আর বিদ্রুপ করে সাবিহা বললো ‘মেয়েরে তো পড়াশুনা করাই বিরাট চাকরি করাবা শুনছিলাম, বিরাট বিরাট নাকি পাশ দেয় মাইয়া! তো বাজারে উঠায় দিবা তাতো ভাবিনি কোনোদিন। এতো খয়রাতি আর অভাইব্যা নাকি তুমি?’

জাফরিনের জন্য এই বিশ্রী আক্রমন অপ্রত্যাশিত। কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না ও। তারপর আস্তে করে বললো ‘ কেন, সাবিহা বু, আমার মেয়ে কী করছে?’

‘কী আবার করবে, যা শিখাইছো তাই করছে। বড়লোকের পোলাগো মাথা খাওয়া শিখছে। কাইল বিয়া, পোলায় আজ কয়, মিষ্টিরে বিয়া করবে। আচ্ছা, ওইতো মাইয়ার চেহারা, আমার পোলারে ভুলাইলো কেমনে? তাবিজ – টাবিজ জানো নাকি তোমরা? নিজের মাইয়ারে সামলা, জাফরিন। আমার পোলার বিয়েতে আমি কোনো কেচরমেচর চাই না।’

‘আমার মেয়ে আসলেই কিছু করেছে কীনা আমি জানিনা সাবিহা বু। তবে তুমি নিশ্চিত থাকো তোমার ওই অশিক্ষিত, গুন্ডা, লোফার ছেলেকে পাত্তা দেওয়া মেয়ে আমি পেটে ধরিনি। তোমাদের কাহিনি তো আর কম জানা নেই। বাজারের বেটির কাছে কে যায়? তোমার জামাইতো নাকী? সাত মাসের বাচ্চা পেটে মহিলারে পেটে লাথি দিয়ে মেরে ফেলা জল্লাদওতো তোমার স্বামিই নাকী? ওই নোংরা আস্তাকুঁড়ে আমার মেয়েরে আমি জান থাকতে থুথুও ফেলতে দেবো না, জেনে রাখো তুমি!’

মিষ্টি ভেবে রেখেছিলো অনার্সের রেজাল্ট এসে গেলে ও নিজেই বাবা-মাকে প্রিন্সের কথা জানাবে। এইভাবে এইদিক থেকে এতো নোংরাভাবে আঘাত আসবে ওর চিন্তারও বাইরে ছিলো। প্রিন্সও কোনো আভাস দেয়নি ওকে একবারও। জাফরিন এসে কথ্য অকথ্য ভাষায় ওকে বকলো। রাগে, দুঃখে জাফরিনের ভাষা শিষ্টাচারের বেড়া অতিক্রম করে গেলো। মিষ্টির চুলের মুঠো ধরে ফ্লোরে ফেলে লাথি মেরে মেরে গায়ের ঝাল ঝাড়লো ‘পড়াশুনা বাদ দিয়ে নাঙ ধরার সখ হইছে আমাদের বলতি, খুঁজে এনে বিয়ে দিয়ে দিতাম, বাপের মানসম্মান রাস্তায় ঢাললি? ওই বদমায়েশ প্রিন্স রুচিতে এলো তোর?’ মিষ্টি শুধু অঝোরে কাঁদলো – এ কী হলো!

সব ঘটনার নাটের গুরু প্রিন্স এসবের খবর পেলো না। ওকে বাড়ির ভেতর আটকে ফেলা হয়েছে টের পেলো না, পাহারাদার বসানো হয়েছে তাও বুঝলো না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here