তাহারেই পড়ে মনে পর্ব ১১

#তাহারেই_পড়ে_মনে
পর্ব এগারো
পার্লারে বউসাজের জন্য বসে মিষ্টি। চোখের পানিতে সাজ ধুয়ে যাচ্ছে বারবার। মেকআপ আর্টিস্ট মেয়েটা শেষমেশ বলেই ফেললো ‘ম্যাম, এভাবে কাঁদলে তো কাজল ছড়িয়ে খুব বিশ্রি হয়ে যাবে। আপনি আগে কিছুটা সময় কাঁদুন তারপরে না হয় সাজাই। মেয়েটা মিষ্টির পূর্বপরিচিত। মিঠির স্কুলের নীচতলায় পার্লার তাই হয়তো কনসিডার করছে এইটুকু। শুক্রবার এমনিতেই অনেকগুলো পার্টি থাকে, অনেকগুলো বউসাজ, পার্টি মেকওভার থাকে, অনেক ব্যস্ত সময় – তার ভেতর কোনো একজনের জন্য আলাদা করে বেশি সময় দেওয়া ঝামেলার তো বটেই। সব বোঝে মিষ্টি কিন্তু কেন যে পোড়া চোখ কথা শোনেনা! দুবার ফাউন্ডেশন লাগিয়ে তুলে ফেলতে হয়েছে ইতোমধ্যে। ওর খুব মনে চায় একবার প্রিন্সকে ফোন করতে। প্রতিদিন একবার করে ইচ্ছে করে। ৪৪৩৬২১ নাম্বারটা কয়েকবার করে ডায়ালপ্যাডে টাইপ করে মুছে ফেলে। খুব সাহসী হতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝেই, খারাপ মেয়ে হতে ইচ্ছে করে – সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ছুঁড়ে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে ‘প্রিন্সভাই আমি মরে যাচ্ছি।’ কথার পিঠে প্রিন্সের কথাগুলোও মনে মনে সাজিয়ে নেয়। কী বলবে প্রিন্স ‘তুই মরে যা, মিষ্টি’ নাকি ফিসফিস করে বলবে ‘আমি আসছি, বিবিজান।’

আবার চোখের পানিতে ভিজে আসে চোখদুটো। টিস্যুতে চোখ চেপে ধরে বসে থাকে ও। চাপা কান্নায় সমস্ত শরীরে ঝাঁকুনি আসছে। ওর একটু হাউমাউ করেই কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ও জানে ইচ্ছে করলেই সব করা যায়না। ইচ্ছে করলেই মিষ্টির কাছে প্রিন্স ফিরতে পারে না আর মিষ্টিও ফিরিয়ে নিতে পারে না।

মাঝখানে তুলি নামটা থেকেই যায়। কিন্তু ওই মেয়েটা যদি নিজের থেকে সরে যেতো, চলে যেতো প্রিন্সের জীবন থেকে? মেয়েটা খুব বুদ্ধিমতি! তুলি খুব ভালো করেই জানে প্রিন্সের জীবন থেকে ও সরে গেলেও আরেক কোনো তুলি আসবে – সাবিহার শর্তের শিকল থেকে প্রিন্স কখনোই বেরুতে পারবে না! শুধু শুধু টানাহেঁচড়াই হবে খানিক। তাই মেয়েটি ওই অদ্ভুত অনুরোধ করেছিলো। মিষ্টি রেগে গিয়েছিলো ওর উপরে, উপহাসও তো করেছিলো শাবানা বলে! এখন অবাক লাগে কতটা পাথর চাপা ওইটুকু মেয়ের বুকে। তুলি কেনো জোর করে না প্রিন্সকে – নিজের অধিকার কেন কেড়ে নেয় না, তাই ভাবতে বসে নিজেকেও ওইরকমই অসহায় আবিষ্কার করে মিষ্টি। সব জেনেও যখন কিছুই করার থাকে না।

আবার প্রিন্সের উপরেও রাগ হয় কখনো সখনো – কেন ওই শর্ত মেনে নিতে হলো, কিইবা ক্ষতি হতো? তার চেয়ে এই যে নীরবে কতগুলো মানুষ পুড়ছে – এটা কি কম খারাপ? ওরকম মূর্খ, একগুঁয়ে, গন্ডারবুদ্ধির মানুষ আর কিইবা করতে পারতো? প্রিন্সকে গালিগুলো দিয়ে হেসে ফেললো মিষ্টি।
বড় আদরের জায়গা ওর – ওই খারাপ বিশেষনগুলোও ও খুব ভালোবাসে। নিজেকে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করতেও সুখ হয়! ওর মানুষটা ওরই আছে, ওকে ভেবেই তার রাত সকাল হয় – ভাবলেই আনন্দে মন পরিপূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু আনন্দে থাকার অধিকার তো তারও আছে। তবে? তুলি বলেছিলো মিষ্টি বিয়ে করলে, সুখি হলে প্রিন্সও সুখি হবে। এই কথার মানে তখন বোঝেনি মিষ্টি। পরে তুলির প্রতিটি কথা ও একটা একটা করে এনালাইসিস করেছে। সাবিহা খালার ভয়ে ও কথা সম্পূর্ণ করতে পারেনি কিন্তু যা বলেছে তার অর্থ পরিষ্কার কিন্তু অর্থহীন! মিষ্টির কষ্টের অভিশাপ ও কোনোদিন প্রিন্সকে দেয়নি যে সেই অভিশাপের কষ্ট মিষ্টি সুখি না হওয়া পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হবে প্রিন্সকে। মেয়েটা বোকা বোকা কথাই বলেছিলো। তবুও ওর কথাগুলো মিষ্টিকে মুচড়ে দিয়েছিলো – ভেতরের কোনো এক জায়গাতে তীব্র কিন্তু চিকন সুরে আঘাত করেছিলো! কয়েকটাদিন স্বাভাবিক চিন্তার শক্তি ছিল না ওর। ইশ, বাচ্চা একটা মেয়ে, খুব বেশি রুড হয়ে গিয়েছিলো ওর সাথে মিষ্টি। ‘প্রিন্সের বউ’ শব্দদুটোতে একদম দাউদাউ হুতাশনে পুড়ছিলো ও, সেই আগুনে সবকিছু পুড়িয়ে দিতেও ইচ্ছে করেছিলো তখন! মেয়েটাকে একটু আদর করে দেওয়া হলো না!

পার্লারের মেয়েটা আবার এলো। ‘এইবার আর কাঁদবেন না আপু। সব মেয়েদের জীবনেই এমন গোপন কান্না আছে। কান্না পেলে হা করে কয়েকবার শ্বাস নেবেন, দেখবেন কান্না কোথায় পালাবে!’

হুহ, মিষ্টিকে শেখাচ্ছে ও এইসব, এইসব ট্রিক্স মিষ্টির চাইতে ভালো কে জানে আর! আজ যে কান্নাটাকে রুখে দিতে ইচ্ছে করছে না, তা কি কেউ বুঝবে। একটু গলা ছেড়ে কাঁদবার স্বাধীনতাও কি নেই কোথাও? এতো এতো শিকল-বেড়ি কেন চারিদিকে? এতো এতো মন খারাপের গল্প কেন সবখানে? কেউ ভালো নেই। কেন কেউ ভালো থাকে না!

অনেক কসরত করে তবে সাজ কমপ্লিট হলো। নিজেকে দেখার জন্য চশমাটা চোখে নিতেই লোপা হাহা করে উঠলো। লোপা মিষ্টির চাচার মেয়ে। ‘এই তুই লেন্স পরতে পারিসনি? ইশ চোখের সাজের কিছুই তো দেখা যাবে না এখন। খুলে ফেল বলছি।’

‘কিন্তু আপা, আমি তো চশমা ছাড়া কিছুই দেখব না।’ অসহায় দেখাল মিষ্টিকে।

‘আচ্ছা বেশ, স্টেজে বসলে তখন খুলে দেব। কাউকে তোর দেখার দরকার নেই। যাকেই সামনে দেখবি, চিনতে না পারলে শুধু একটু হেসে দিবি। চলবে।’ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মিষ্টিকে দেখে বলল ‘বেশ দেখাচ্ছে, শুধু চশমাটাই মেরে দিলো সব!’

মিষ্টি হেসে ফেললো।

‘হাসছিস ভালো। আর যেনো কাঁদিস না। তুই এতো কাঁদলি কেন? কোনো সমস্যা? এখনো সময় আছে কিন্তু।’ চিন্তিতই দেখা গেল লোপাকে।

মিষ্টি চোখ নামিয়ে নিলো। মনে মনে বললো ‘সময় নেই গো, সময় কোনোদিন আসেই নি।’

‘ওই গোঁয়ারগোবিন্দ, গান্ডু ছেলেটা আজ যদি আমায় দেখতো, কত খুশি হতো।’ আনমনেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো ও। ও জানে পাঁচমনিটও যদি বেকার মাথায় বসে থাকে ও সাড়ে চারমিনিট প্রিন্সকেই ভাবে। সেই কল্পনার গল্পে ওরা ঠিক আগের মতোই থাকে। ওদের বয়স বাড়ে না, সাংসারিক জটিলতাগুলো কলুষিত করে দেয় না কোনো আনন্দকেই! কাল্পনিক কিছু সংলাপ বানিয়ে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে। নিজে কিছু বলে, প্রিন্স কি বলতে পারে জবাবে তাও ভেবে নেয়। এই এখন মিষ্টিকে দেখলে হয়তো আস্তে করে বলতো ‘তোকে খুব সুন্দর লাগছে, বিবিজান।’
ওর ছলছল চোখ দেখে পার্লারের মেয়েটি ট্যিস্যুপেপার এগিয়ে দেয় ‘চোখ খুলে চোখে চেপে ধরুন ম্যাম, ওয়াটার বেজড ম্যাটেরিয়াল ইউজ করা হয়েছে, স্মাজ হবে না। তবে কিছুক্ষণ একটু কান্নাটা আটকে রাখুন, মেকআপটা ততক্ষণে বসে যাবে পুরোপুরি।’
নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে মিষ্টি। কি নিষ্পৃহ গলা মেয়েটির। না জানি কতশত কান্নার স্বাক্ষী এরা! এরকম কান্না দেখতে দেখতে সহানুভূতির মনটাই মরে গেছে এদের।

কুমিল্লা ক্লাবে অনুষ্ঠান রাখা হয়েছে। মিষ্টির পৌঁছাতে পৌঁছাতে আটটা বেজে গেলো। অথচ পার্লারে গিয়েছিলো তিনটায়। ওর জন্যই দেরিটা হলো। বর এসে গেছে আরও আগেই। বাবার দিক থেকে, মায়ের দিক থেকে সব রিলেটিভরা দুদিন আগেই এসে পড়েছে। বার্ড হোস্টেলে সবার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। বড়রা সেখানে থাকলেও কাজিনরা সব ডেইজি হাউসের ছাদেই আনন্দ করেছে রাতভোর আর সকালের দিকে ফ্লোরের যেখানে যে জায়গা পেয়েছে শুয়ে পড়েছে। এক একটা বিয়ে মানেই এদের আনন্দের মৌসুম! তাছাড়া ব্যস্ত জীবনযাত্রার মাঝে এক হওয়ার, একটু খুলে হাসার সময় তো কারোই হয় না।
পলা, কান্তা আপা, জলি, সায়নী মিলে ওকে স্টেজে নিয়ে যেতে যেতেই যে কতরকম পোজে কতরকম ছবি তুললো ফটোগ্রাফার যে ওইটুকু সময়েই বিরক্তি ধরে গেল ওর! তার উপরর ভারি শাড়ি-গয়না আর চড়া সাজে মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়েই রাখতে হচ্ছে। এই পার্ট শেষ হয়ে লম্বা একটা ব্রাইড এন্ট্রি পার্ট শেষ হয়ে যখন স্টেজে উঠে ডিভানের এক কোনে গিয়ে বসলো, তার অনেক আগেই বরের জায়গায় আসিন সাজিদ। মিষ্টিকে দেখেই চওড়া হাসি ফুটলো মুখে ‘ভেবেছিলাম পালিয়ে গেছ, অন্য কিছু বাদ দাও, গেইটের দশ হাজারের জন্যও আফসোস হচ্ছিলো।’

আফসোস আর কৌতুকের ঢঙে বললেও সাজিদের চোখে একরাশ ভরসা, আস্থা আর দায়িত্বের পরশ। কিন্তু এই ভরসা তো চায়নি মিষ্টি। বরং অস্তিত্বের অনেকখানিতে প্রিন্সকে জড়িয়ে ও ভালোই ছিলো। শান্ত, ধীর, প্রশান্তির একটা নতুন জীবনের চাইতেও খানিক এলোমেলো বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে থাকতেই বেশ লাগতো – পরিস্কার করেই জানিয়েছিলো ও সাজিদকে। বিয়েটা সম্বন্ধ করেই – মিষ্টির বাবার কলিগের ছেলে সাজিদ। ছোটবেলায় টুকটাক অকেশনে দেখা হলেও বড় হবার পরে একেবারে বিয়ের কথা উঠলেই ফরমাল দেখাদেখি হয়েছিলো ওদের। ততদিনে মিষ্টি প্রিন্সে বিলীন! নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বে জাফরিনের চাপাচাপিতে কয়েকবার সামনাসামনি দেখা হয়েছে আর ফোনেই টুকটাক কথা।

মিষ্টি বেশ অধীর হয়েই, জাফরিনের নিষেধ সত্ত্বেও নিজের মনের অধিকার যে অন্য কারো দখলে জানিয়েছিলো সাজিদকে। বেশ ব্যক্তিত্ববান পুরুষ হয়েও ও যখন উত্তর দিয়েছিলো ‘অতীত থাকা মেয়েরা লয়াল হয়, অনেক। আমার কোনো সমস্যা নেই।’

মিষ্টির রাগ হয়েছিলো, অনিশ্চিতও।

নিস্প্রভ গলায় হাই তুলতে তুলতে সাজিদ বলেছিলো ‘দেখো মিষ্টি, প্রেম একতরফা হতে পারে কিন্তু বিয়ে না। বিয়েটা একটা পার্টনারশিপ, সেখানে দুজনেরই অংশিদারীত্ব থাকে, লায়াবিলিটিজও। ফিফটি ফিফটি আরকী! আমার অংশের পুরোটাই আমি এই সম্পর্কে দিব, তুমি হালকা পাতলা পাঁচ/দশ পার্সেন্ট দিলেই হয়ে যাবে সিক্সটি পার্সেন্ট। স্ট্যাটিসটিক্যালি অনেক কনযুগ্যাল রিলেশনশিপেই বিলো পার্সেন্টেজ থাকে দেন ফিফটি। আমাদের হয়ে যাবে সিক্সটি। গুড কেমিস্ট্রি, বলো? চালিয়ে নিবো।’ বলতে বলতে চোখ চকচক করে উঠেছিলো ওর।

সব গল্প জেনেও লোকটার কোনো হেলদোল নেই দেখে অবাক হয়েছিলো মিষ্টি। বিস্ময় গোপন না করেই জানতে চেয়েছিলো ‘হ্যাভিং সামওয়ান ইন মাই মাইন্ড আই উইল নট বি ইয়োরস হোলহার্টেডলি, নেভার! ইউ ডিজার্ভ সামওয়ান বেটার, সামওয়ান ভেরি স্পেশাল ওয়ান। দেন হোয়াই মি?’

সাজিদ উদাস জানিয়েছিলো ‘জানি না।’

মিষ্টি বুঝেছিলো মরেছে সাজিদ – যেভাবে মিষ্টি মরেছে প্রিন্সে, প্রিন্স মরেছে মিষ্টির জন্য, আর তুলি নিঃস্ব হয়ে আছে প্রিন্সের জন্য! আর যা বলছে সবই কথার কথা! ধামাচাপা দেওয়া বুলি!

বিয়ের শপিংয়েও খুব অনাগ্রহ নিয়েই গিয়েছিলো মিষ্টি। আর সব কিছুই অন্যদের পছন্দমতো ছেড়ে দিলেও বিয়ের শাড়ি কিনতে গিয়ে গোল করেছিলো ও। সবকিছু বাদ দিয়ে একটা হালকা গোলাপি নেটের শাড়ি টেনে নিয়েছিলো। কুন্দনের কাজ করা শাড়িটা পার্টিতে পরার জন্য চললেও বিয়ের কনের জন্য একেবারেই যুৎসই না। জাফরিনের চোখরাঙানি আর সাজিদের বোনেদের অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করেই শুধুমাত্র ওই শাড়িটার জন্যই একগুঁয়ে জেদ নিয়ে বসেছিলো ও। কতটা ছেলেমানুষী হচ্ছে সেটা ওর মাথাতেই আসেনি! সাজিদ নিঃশব্দে সাপোর্ট করে গিয়েছিলো ওকে। ফলাফল পুরো বিয়ের ভেন্যু, অতিথিরা সবাই গোলাপিতে সেজেছে! মিঠিকে সাটিন গজ কাপড় কিনে লেহেঙ্গা বানিয়ে দিয়ে হয়েছে। তাই পরে ও নেচে নেচে উড়ে বেড়াচ্ছে। মিষ্টি খুব চাইছিলো মিঠি ওর আশেপাশেই থাকুক, কিন্তু সবাই এতো আনন্দ করছে, পার্টি গানে ডান্স করছে এর ভিতর ওকে খুঁজেও পাচ্ছে না মিষ্টি।
কবুল বলার সময় পলা খুব শক্ত করে ওর হাতদুটো ধরে রেখেছিলো, একটু গলাটা কেঁপে উঠেছিলো শুধু। এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে জাফরিনকে খুঁজেছিলো কয়েকবার, না পেয়ে মন খারাপ করেছিলো। হয়তো কোথাও গোপনে চোখের পানি ফেলছে – মিষ্টির মনের খবর মাইতো সবচেয়ে ভালো জানে। গোটা গোটা শব্দে রেজিস্ট্রি কাগজেও সই করে দিলো মিষ্টি কোনো ঝামেলা না করেই। আনন্দে হৈচৈ করে উঠলো সবভাইবোন।

‘আমি তিন তিনটে বিয়ে করলাম, লাস্টিং করলো না’ গানে নাচছে জহির। সবগুলো আলো ওর সাথে নাচছে। হাতেতালি দিয়ে ওকে উৎসাহ দিচ্ছে সবাই। একপর্যায়ে সবাই উঠে গেলো স্টেজে। কে নাচছে আর কে লাফাচ্ছে বলা মুশকিল! ডিভান নীচে নামিয়ে মিষ্টি আর সাজিদ পাশাপাশি বসেছে। মিষ্টির হাত সাজিদের হাতের মুঠোয়। মিষ্টির খুব একটা খারাপ লাগছে না। একটা নতুন পরিচয়, নতুন সম্পর্কের শুরু এতো আনন্দ দিয়ে – ওর বরং বেশ ভালোই লাগছে। সাজিদের চোখে আনন্দ, লজ্জা, ভালোবাসা সব একসাথেই দেখা যাচ্ছে। ওর আনন্দ দেখে মনে হচ্ছে রূপকথার রাজকন্যাকে যুদ্ধজয়ের পুরষ্কার পেয়েছে ও! বিস্ময় জাগে মিষ্টির। এই মানুষটার আশ্রয়ে জীবনটা খুব একটা কঠিন হবে না – খুব অল্পতেই হয়তো অনেকটা খুশি করা যাবে সাজিদকে। নিজেকে মনে মনে প্রবোধ দিলো ও, গুছিয়ে নিলো মনে মনেই। যেমন পড়াশোনা করেছে মন দিয়ে সবকিছু ভুলে তেমনি সব ভুলে কোমর বেঁধে সংসারও করবে!

পলা, হাসনা আর মিঠি স্টেজে উঠেছে ‘সুন্দরী কমলা’ গানের সাথে নাচবে বলে কিন্তু মিউজিক সিস্টেম ক্যাঁক্যাঁ করে উঠলো গানের বদলে। এলোমেলো কয়েকটা স্টেপ নিয়ে ক্ষেপে লাল হতে হতে পাপ্পু আর মিঠির চাচতো ভাই সায়মনকে মারার জন্য দৌঁড়ঝাপে শুরু হয়ে গেলো! যাই হচ্ছে তাতেই আনন্দ পাচ্ছে সবাই!

এতো আলোর মাঝে কেমন একেকজন ফোনে কথা বলতে বলতে নিভে যেতে লাগলো হঠাৎই খেয়াল হলো মিষ্টির। থমথমে চারিদিক ঝুপ করেই। যে যেখানে আছে সেখানেই ধপ করে বসে পড়ছে। মুখগুলোতে রাজ্যের অন্ধকার জড়ো হচ্ছে। রাজ্যের অবিশ্বাস ঠিকরে বেরুচ্ছে একেক জোড়া চোখ ভেঙে। ফোনে তুমুল চেঁচামেচি করতে করতে একেকটা হাসিমাখা মুখ বিকট কান্নায় ভেঙে পড়ছে। একেকজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরছে। কি হলো হঠাৎ – উৎকন্ঠিত হলো মিষ্টি। এখনো তো ওকে বিদায় দেওয়ার সময় হয়নি। আর বিদায়ের সময় এমন শোকের কান্নাও তো ও কাউকে কাঁদতে দেখেনি কোনোদিন। এতোগুলো মানুষের কী হলো? এমন আকুল হলো কেন? কোনসে প্রিয়জন যার ব্যথায় এমন ব্যথাতুর সবগুলো প্রাণ?

মিষ্টি মনের ভিতর অজানা আশংকা, ভয়, আতঙ্ক জেঁকে বসলো। ওর ঠিক সাহস হচ্ছে না কিছু জানার। স্টেজের নীচের দিকে পাপ্পু বসে বসে নিজের চুল দুইমুঠোতে টানছে আর ঠোঁট টিপে কাঁদছে – ওর পাশে বসে কান্তা আপা দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁপে কেঁপে উঠছে।

‘পাপ্পু ভাই, কি হয়েছে?’ কোমল সুরে প্রশ্ন করলো মিষ্টি, জড়োয়া গয়না আর ভারি শাড়িতে জড়ভরত হওয়া শরীর নিয়ে নিজেও বসলো ওদের পাশে। ওকে সহই উঠে দাঁড়ালো পাপ্পু। বাকরুদ্ধ ওর। হাত দিয়ে কি ইশারা করলো কে জানে! জাফরিন এসে মিষ্টিকে থামালো ‘তুমি চলে যাচ্ছ তো, তাই সবার মন খারাপ হচ্ছে মা। আবার কবে দেখা হবে তোমার সাথে তাই ভাবছে।’

মিষ্টি বুঝলো এটা সত্যি না। এভাবে কেউ একারণে কাঁদে না। জাফরিন একরকম জোর করিয়েই সরিয়ে নিলো ওকে। মিষ্টিও জেদ করলো না। পিছনে ফিরে আসতে শুধু কানে বাজলো একটা শব্দ ‘প্রিন্স’। ঝট করে আবার ফিরলো ও। পাপ্পুর সামনে গিয়ে চিৎকার করে জানতে চাইলো ‘কি হয়েছে, বলো, বলো আমাকে?’ জোরে ধাক্কাই দিলো মিষ্টি ওকে। গোঙাতে গোঙাতে পাপ্পু শুধু এইটুকুই বললো ‘প্রিন্সভাই’।

‘প্রিন্সভাই? কি হয়েছে প্রিন্সভাইর?’ মিষ্টির বুক কাঁপছে।

পাপ্পু বসে পড়লো আবার উত্তর না দিয়েই। কান্তা নিজেকে সামলে নিয়েছে অনেকটা। ও আস্তে আস্তে বললো ‘প্রিন্স একসিডেন্ট করেছে, মিষ্টি।’ কান্তা জানেনা কতখানি দুঃসহ দুঃসংবাদ ও দিতে চলেছে এই নবপরিণীতাকে। জানলে মুখে রক্ত উঠে মরে গেলেও ওর মুখ থেকে বেরুতো না এই ভয়ংকর বাক্যগুলো। ‘অস্থির ছিলো নাকি আজকে খুব। বারবার বাইক নিয়ে এরাস্তা ওরাস্তা দৌঁড়েছে। শেষে আর ব্যালেন্স রাখতে পারেনি। খুব স্পিডে ছিলো বাইক। রাস্তার পাশের বড় গাছের সাথে লেগে ছিটকে পড়েছে অনেক দূরে। স্পটডেড। শরীরের সব অংশ একসাথে পাওয়াও যায়নি। ঝুঁড়িতে করে খুঁজে আনতে হয়েছে! প্রিন্স আর নেই, মিষ্টি।’

এই নেই যে কতবড় না থাকা মিষ্টি যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। পুরো পৃথিবীই তো মিথ্যে হয়ে গেলো ওর! আজকে বাঁধ ভেঙে গেলো ওর। আজকে অসময়ে পাগলপারা হলো ও। বহুদিন নিজেকে চেপে রেখে আজ অস্থির, বেসামাল, অধীর হলো মিষ্টি। নিজেকে হারালো, বুদ্ধি লোপ পেলো, সংযম খোয়ালো, হাউমাউ করে কাঁদলো ও আজ! পায়ের নীচের মাটি সরে যাওয়া কি একেই বলে? ভারহীন মনে হলো নিজেকে – আজকে জ্ঞান হারালো মিষ্টি….

চলবে…

Afsana Asha

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here