অঙ্গনে হৃদরঙ্গন পর্ব ১৯

“অঙ্গনে হৃদরঙ্গন”
পর্ব- ১৯
(নূর নাফিসা)
.
.
শ্রাবণকে ডিসপেনসারিতে বসিয়ে চলে গেলো সাদাফ। কখনো দৌড়ে, কখনো দ্রুত বেগে হেটে অতিক্রম করছে পথ। মোটা রাস্তায় এসে সিএনজিতে উঠে গেলো। কিন্তু নেমে গেলো হায়দারের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই। সামনে ভীড়, সারি সারি দেখা যাচ্ছে পুলিশের গাড়ি। সাদাফ দূরে দাঁড়িয়ে থেকেই ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করলো। মিনিটের মধ্যেই গাড়িগুলো ছেড়ে দিলো। লোকজন জড়োসড়ো হয়ে আলোচনা সমালোচনা করে যাচ্ছে। সাদাফ এগিয়ে এসে শুনতে পেলো হায়দার ও তার দলবলকে অবৈধ অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য সহিত আটক করেছে পুলিশ। মুহুর্তেই ভেতরের উথাল-পাথাল যন্ত্রণা শান্তিরূপে পরিণত হলো। মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো সে। লাভটা কি হলো কেড়ে নিয়ে, মিনিট পর্যন্তও তো শান্তিতে ভোগ করতে পারলো না। অযথা লড়াই করতে আসে লোকগুলো। অন্যের সম্পদ হাতিয়ে না নিলে যেন তৃপ্তি মেটে না। এবার ভালো করে হাতিয়ে নে। মনে মনে হাজারো উপহাস করতে করতে নিশ্চিন্তে পথ পেরিয়ে ফিরে এলো সে। ডিসপেনসারিতে এসে বললো,
“শেষ হয়েছে?”
শ্রাবণ মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালো। সাদাফ বিল প্রদান করতে থাকলে শ্রাবণ বললো,
“আপনার না কাশি। ওষুধ নিয়ে নিন।”
“না, কাশি সেড়ে গেছে। চলো।”
“জ্বরও তো আছে একটু একটু।”
সাদাফ তার হাত টেনে এনে নিজ কপালে ছুঁয়িয়ে দিয়ে বললো,
“নেই।”
শরীর ঠান্ডাই আছে তাই শ্রাবণ চুপচাপ বাড়ি ফিরলো তার সাথে। সাদাফ নিশ্চুপ। মনের আনন্দে সে ঘরের অবস্থা ঠিক করতে লাগলো। যেন কিছুই হয়নি এখানে৷ শ্রাবণ প্রশ্ন করলো তারা কারা ছিলো। উত্তরে সে জানালো ডাকাত। আর কোনো কথাই বাড়তে দিলো না এ নিয়ে। একটা কথাই বললো,
“যা হয়েছে, হয়েছেই। তা নিয়ে আফসোস করার দরকার নেই। যা হয়, ভালোর জন্যই হয়। আর হয়েছেও ভালোটাই।”
যদিও তার কথাবার্তা কিছুই ধরেনি শ্রাবণের মাথায়। তবুও আর প্রশ্ন করলো না কোনো। জীবনে প্রথমবার ডাকাতি দেখলো, সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে পা বাড়ালো ভাত রান্নার জন্য। সাদাফ নিষেধ করলো তাকে রান্না করতে। হোটেল থেকে ভাত নিয়ে আসবে সে। ঘর গুছাতে শ্রাবণও একটু আধটু সহযোগিতা করলো তাকে। ভেবেছিলো মাথার যন্ত্রণায় আজ ঘুম হবে না তার। কিন্তু ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে সাদাফ। সকালে উঠে ব্যাথাও কম অনুভব করতে লাগলো। ওষুধেও কাজ হয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যা হতেই আরেকটা ভয় থেকে যাবে, ডাকাত দল আবার আসবে না তো!
দুদিন পর সকালে এক মহিলা এসে হাজির হয়েছে বাড়িতে। সুঠাম গড়নের সুন্দরী মহিলা। পরনে সুন্দর শাড়ি, দামী জুতা, দামী পার্স। বেশেবুশেই বুঝা যাচ্ছে বেশ ধনী ঘরের মেয়ে। যদিও সময়টা খুব সকাল নয়, নয়টার বেশি হবে৷ কিন্তু এখনো সাদাফ ঘুমাচ্ছে। শ্রাবণ সেই সকালে উঠে নামাজ পড়ে রান্নাবান্না শেষ করে নিয়েছে। ঘর দুয়ার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে গুছিয়ে ফেলেছে। সকাল সকাল এতো কাজ করে ঘেমে একাকার। তাই গোসলে যাচ্ছিলো। কিন্তু সে আর যাওয়া হলো না। কাপড়চোপড় নিয়ে বের হতেই মহিলার আগমন। শ্রাবণকে দেখেই বললো,
“এখানে সাদাফের ঘর কোনটা?”
শ্রাবণ পেছনে ইশারা করে বললো,
“এইটা।”
ঠিক এই ঘর থেকেই শ্রাবণকে বের হতে দেখেছে তাই বললো,
“তোমার কে হয় সাদাফ?”
“স্বামী।”
“ওহ্। সাদাফ বাসায় আছে?”
“ঘুমাচ্ছে।”
“ডেকে দিতে পারবে?”
শ্রাবণ আরও একবার মহিলাকে পর্যবেক্ষণ করে চলে গেলো সাদাফকে ডেকে দিতে। দিশা বুঝতে পারলো, এটাই হয়তো সেই মেয়েটা। বিয়ে করে নিয়েছে তাহলে। ভালোই হয়েছে। বেশ মায়া আছে মেয়েটার চেহারায়। সহজ সরল মুখভঙ্গি, যে কেউ মায়ায় জড়িয়ে যাবে। শ্রাবণের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছোটখাটো নিশ্বাস ফেললো সে। সে ঠিক রান্নাঘরের দরজা বরাবর দাঁড়িয়ে আছে, তাই রুমের ভেতরটা দেখতে পাচ্ছে না। দেখার ইচ্ছেও নেই। এদিক সেদিক ঘাড় ঘুরিয়ে শুধু বাইরের পরিবেশটা দেখে নিলো।
শ্রাবণ এসে সাদাফের কাধে হাত রেখে ঠেলে যাচ্ছে আর ডাকছে, সাদাফ ঘুম ঘুম কণ্ঠে সাড়া দিচ্ছে।
“এই, উঠুন না।”
“কেন?”
“এক ভদ্রমহিলা এসেছে। আপনাকে খুঁজে।”
“কে?”
“চিনি না।”
“ঘুমে ডিস্টার্ব করতে সকাল সকালই কেন তাদের আসতে হবে!”
দশটা বাজতে চলেছে, এখনো নাকি সকাল সকাল! শ্রাবণ বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“আর কত ঘুমাবেন!”
সাদাফ বিরক্তি নিয়ে উঠতে উঠতে বললো,
“কেন? খুব বেলা হয়ে গেছে?”
শ্রাবণ বিড়বিড়িয়ে বললো,
“কিছুক্ষণ বাকি যোহরের আজান পড়বে।”
সাদাফ পিঠ চুলকাতে চুলকাতে যেতে লাগলে শ্রাবণ সেন্টু গেঞ্জি এগিয়ে দিয়ে বললো,
“একটা গেঞ্জি পরে যান অন্তত।”
তার মুখে হঠাৎ এমন আপত্তিকর কথা শুনে সাদাফ তাকালো তার দিকে। কিন্তু কিছু না বলে গেঞ্জি পরতে পরতে বেরিয়ে এলো। দিশাকে দেখে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে গেলো সে! তাকে অন্তত এবাড়িতে প্রত্যাশা করেনি কখনো৷ সেই যে হলুদের সন্ধ্যায় দেখা হয়েছে, এরপর আর দেখাও হয়নি। সে হঠাৎ এখানে কেন! আশ্রয় চাইতে এসেছে নাকি হায়দারের ব্যাপারে কিছু বলতে? কারণ দুইটা ঘুরপাক খাচ্ছে তার মাথায়। দিশা তাকে দেখে দুকদম এগিয়ে এলো। চোখেমুখে রাগ, অভিমান স্পষ্ট ভেসে উঠেছে তার। শান্ত কিন্তু জিদ্দি কণ্ঠে বললো,
“কেমন আছেন আপনি?”
“ভালো।”
“হুম, ভালো থাকারই কথা। নিজ বাড়ি, নিজের অবস্থানে ঠিক আছেন ভালো তো থাকবেনই।”
বলতে বলতে ফোনে ছবি বের করে সাদাফের সামনে তুলে ধরে বললো,
“এনাকে চিনেন? ইনি কিন্তু একদমই ভালো নেই। আর কোনো না কোনোভাবে উনার ভালো না থাকার পেছনে আপনিও দায়ী।”
শ্রাবণ সাদাফের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো। ফোনের স্ক্রিনে দুজনেই তাকালো। একজন বয়স্ক মহিলা হসপিটালের বেডে পড়ে আছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো। নিভু নিভু তার চোখ জোড়া। সাদাফ চিনতে পেরেছে তাকে। তিনি হায়দারের স্ত্রী। দিশার মা। যদিও কথা হয়নি কখনো, ওবাড়িতে আসা-যাওয়ার সূত্রে চোখে পড়েছে মহিলাটিকে৷ দিশা গলা ধরানো কণ্ঠে বললো,
“আজ জীবন মরণের সাথে লড়াই করছেন তিনি। স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া অপ্রীতিকর শোকে তিনি আজ এ অবস্থায়। এসব কাজের জন্যই যেতন আপনি আমাদের বাসায়। এজন্যই বাবা চাইতেন না, আপনার সাথে কথা বলার সময় আশেপাশে কেউ থাকুক। আমার সন্দেহ ঠিক ছিলো। কিন্তু সন্দেহের কেন্দ্রস্থলটা ঠিক খুঁজে পাইনি আমি। ছি! ঘৃণা হচ্ছে আপনার প্রতি। মনে আছে, আমি জিজ্ঞাসা করতাম আপনাকে? কত অনুরোধ পর্যন্ত করতাম কারণটা জানার জন্য। সেদিন যদি আপনি এই মায়ের কথা কিংবা এই পরিবারের কথা ভেবে একটু… একটু সহযোগিতাও করতেন তাহলে আজ হয়তো এই মায়ের অবস্থা এমন করুণ হয় না। আজ হয়তো এই বয়সে ওই লোকটাকে কারাগারে বন্দী অবস্থায় থাকতে হয় না। চেষ্টা করে হয়তো পারতাম তাকে বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু আপনি একটা পশু। একটা পরিবারকে ধ্বংস করার পেছনে কোনো একটা দিক থেকে আপনি দায়ী। কি এমন আপনার প্রয়োজন ছিলো, একবার বলেই দেখতেন আপনি। কি দরকার ছিলো আমাদের পরিবারটাকে চোখের সামনে ধ্বংস হতে দেখার?”
কথার সাথে সাথে গাল গড়িয়ে যাচ্ছে কষ্টের অশ্রু। সাদাফ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। শ্রাবণ শুনছে কিন্তু কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। দিশা একটু থেমে চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিলো। এরপর কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে কড়া কণ্ঠে বললো,
“তিনি কারাগারে, সে নিয়ে আমি মোটেও আফসোস করি না৷ যার যার কর্মের ফল তার ভোগ করাই প্রয়োজন। কিন্তু আমার মা কেন সেই ফলের ভোগান্তি! একটা সময় আপনাকে পছন্দ করতাম, আজ ঠিক তার চেয়েও হাজার গুণে ঘৃণা হচ্ছে আপনার প্রতি। আপনি জানেন, আমি এখন আপনাকেও ঠিক সেই অবস্থায় পৌঁছে দিতে পারি। আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আপনাকেও আপনার সেই বিজনেস পার্টনারের সাথে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আপনাদের মতো লোকের এই সমাজে ঘুরাফেরা করার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু তা করলাম না। কারণ আপনার মতো পশুত্ব আমার মাঝে নেই। সেদিন আপনার প্রতি মায়া হতো, আজ সেটা মোটেও নেই। তবে আজ এই মেয়েটার প্রতি মায়া হচ্ছে। তার মাথার ছায়া এখন আপনি। সে একটা পরিবার খুঁজে পেয়েছে আপনার মাঝে। সে তো আর আমি ধ্বংস করে দিয়ে পাপ করতে পারি না। শুধুমাত্র তার জন্য আপনাকে আমি ছেড়ে দিয়ে গেলাম। অন্যথায় আপনি আগের মতো একা হলে ঠিকই আপনার মুখোশ আমি আইনের সম্মুখে খুলে দিতাম। ভালো থাকুন, এই মেয়েটাকে ভালো রাখার জন্য ভালো থাকুন।”
দিশা কষ্ট গুচিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো। এসেছিলো আরও অনেক কথা বলতে, আরও অনেক রাগ নিয়ে তাকে হুমকির সম্মুখে ফেলে যেতে। কিন্তু পারলো না। কোথায় যেন একটা বাধা পড়ে গেলো। হয়তো সেই মেয়েটার মায়াই বাধা দিয়েছে তাকে। যাওয়ার আগে মায়াবী চোখে একপলক তাকিয়ে গেলো শ্রাবণের মুখের দিকে। শ্রাবণ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে। দিশার কথাবার্তায় বুঝতে পারলো বেশ কষ্টে আছে সে, তাই সমব্যথী হলো মনে মনে। সাদাফ পুরোটা সময় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে শুনে যাচ্ছিলো তার কথা। তাকিয়ে দেখেছিলো তাকে, সুখী একটা রমনী। বুঝতে পেরেছে স্বামীর সংসারে সুখেই আছে। কিন্তু সেসব কিছু নিয়ে তার কোনই মাথাব্যথা নেই। যদিও তার মায়ের জন্য একটু কষ্ট হয়েছিলো মাত্র। এর বেশি আর কিছুই না। সে চুপচাপ বাথরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। শ্রাবণও এতোসব না ভেবে কাপড়চোপড় রেখে আগে তার নাস্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করলো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here