#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৭|
গ্রীষ্মের চটচটে গরমের আরেক সকাল। স্মৃতি কফির গ্লাস টা বেড সাইড টেবিলের উপর রেখে জুভান কে দু’বার ডাকল। কিন্তু জুভানের কর্ণকুহুরে সেই ডাক পৌঁছাল বলে মনে হলো না। স্মৃতি তাই তার পিঠের উপর হাত রেখে বললো,
‘জুভান, উঠুন। কফি টা ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।’
ঘুমঘুম চোখে জুভান স্মৃতির দিকে তাকাল। ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে হেসে বললো,
‘পাঁচ বছর পর আবার একটা সুন্দর সকাল দেখলাম।’
স্মৃতি বললো,
‘উঠে পড়ুন। ফ্রেশ হয়ে কফি টা খেয়ে নিচে আসুন, আমি নাস্তা তৈরি করছি।’
জুভান চোখের ইশারায় সম্মতি জানাল। স্মৃতি তখন চলে গেল নাস্তা বানাতে।
খাবার টেবিলে খেতে বসে জুভান স্মৃতি কে জিজ্ঞেস করলো,
‘তুমি বাবার কাছে কখন যাবে স্মৃতি?’
‘এই যে একটু পর।’
‘ঠিক আছে, আমিও যাবো তোমার সাথে।’
স্মৃতি চমকে বললো,
‘আপনি?’
‘হ্যাঁ। এতদিন পর আসলাম, মা বাবার সাথেও তো একবার দেখা করতে হবে তাই না।’
স্মৃতি মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘আচ্ছা।’
মারিয়াম আহমেদ তখন রুটি চিবুতে চিবুতে বললেন,
‘বুঝিনা বাপু, এই লোকের পেছনে আমার ছেলে কে আরো কত টাকা দিতে হবে আল্লাহ মালুম। এতদিন যাবত ঝুলে আছে, না পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছে আর না ম/রছে। এভাবে আর কতদিন তুই টাকা দিয়ে যাবি বলতো বাবা?’
কথাটা প্রচন্ড গায়ে লাগল স্মৃতির। সে আর সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে সোজা রান্নাঘরে চলে গেল। জুভান এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বললো,
‘মা, সবসময় স্মৃতি কে কথা না শুনালে তোমার হয় না, না? টাকা তো যাচ্ছে আমার, আমার তো এতে কোনো অসুবিধা নেই, তাহলে তুমি কেন এমন করছো? সবসময় অযথা খালি অশান্তি করো।’
ব্যস এইটুকুতেই হয়ে গেল। মারিয়াম আহমেদ খাওয়া ছেড়ে বিলাপ করতে শুরু করলেন। ছেলেকে তার বউ এক রাতেই হাত করে নিয়েছে। এখন আর ছেলে তার হয়ে কথা বলবে না। এখন বউই তার সব। উনি একটানা অনেকক্ষণ চিল্লাফাল্লা করলেন। মজুমদার সাহেব তার মধ্যে নাস্তে খেয়ে অফিসে বেরিয়ে গেলেন। জারাও তার তার কলেজে চলে গেল। জুভান বেশিক্ষণ বসে না থেকে মা’কে চুপ করতে বলে নিজের রুমে চলে গেল। কিন্তু তাতেও মারিয়াম আহমেদের মাঝে কোনো ফারাক দেখা গেল না। তিনি আগের মতোই বসে বসে বিলাপ ছাড়ছেন। স্মৃতি সেই রুমে এলো। সে এসে তার শাশুড়ি মা’কে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘মা, আপনার বয়স হচ্ছে। এবার এসব বন্ধ করুন প্লিজ। যা করছেন ক’দিন পর তো অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়বেন। তখন তো সেই আমার সেবা’ই নিতে হবে। আর সেটা যদি না চান তাহলে সুন্দর ভাবে থাকুন। দয়া করে সারাদিন এত চিল্লা ফাল্লা করবেন না, তাতে আপনারই ক্ষতি হবে।’
মারিয়াম আহমেদ মুখ বাঁকিয়ে ভেংচি কেটে হনহন করে সেখান থেকে চলে গেলেন। তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে স্মৃতি ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে টেবিলের পড়ে থাকা প্লেটগুলো গুছাতে লাগল।
রান্নাবান্না সব সেরে স্মৃতি তার রুমে গেল। গিয়ে দেখল জুভান রুমে নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে তার মানে সে ওয়াশরুমেই। এই সুযোগ, স্মৃতি তাড়াহুড়ো করে জুভানের ব্যাগ ঘেটে কিছু খুঁজতে লাগল। তার পেন্টের পকেট, শার্টের পকেট সব তন্নতন্ন করে খুঁজল। কিন্তু কিছুই পেল না। জুভানের ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল, সেটা লক করা। আর সে সেটার পাসওয়ার্ড ও জানে না। আন্দাজে দু’বার দিল। আর দু’বারই সেটা ভুল দেখাল। বিরক্ত হয়ে ফোনটা সে জায়গায় রেখে বিছানায় গিয়ে বসলো। এভাবে চলতে থাকলে সে কিছুই খুঁজে বের করতে পারবে না। তার একবার জুভানের সাথে সরাসরি কথা বলা উচিত। এই ভেবে মনস্থির করলো, জুভান ওয়াশরুম থেকে বের হলে সে তার সাথে কথা বলবে।
খানিক পরে জুভান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এল। গোসল সেরেছে সবে। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে স্মৃতির কাছে গিয়ে বললো,
‘গোসল করবে না?’
‘হ্যাঁ, গোসল করেই বের হবো।’
‘আচ্ছা, যাও।’
টাওয়াল টা বারান্দায় রেখে জুভান তার ল্যাপটপ টা নিয়ে গিয়ে ডিভাইনে বসলো। স্মৃতি কাঁচুমাচু করছে তাকে কিছু বলার জন্য। আবার সাহসও পাচ্ছে না। কারণ এই লোকটার সামনে মুখ ফসকে ভুল ভাল কিছু বেরিয়ে গেলেই সে ফেঁসে যাবে। তাই সবকিছু খুব সাবধানে বলতে হবে, যেন এতটুকুও সন্দেহ না করতে পারে।
মনে একরাশ সাহস সঞ্চয় করে স্মৃতি তখন জুভান কে বললো,
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল জুভান?’
জুভান তার দিকে না তাকিয়েই বললো,
‘বলো।’
স্মৃতি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। হালকা গলা ঝেরে বললো,
‘আপনি কি জিহাদ নামের কাউকে চিনেন?’
জুভান ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ উঠিয়ে স্মৃতির দিকে চাইল। চোখের সেই চাহনি ভীষণ তীক্ষ্ণ। আর এই তীক্ষ্ণ চাহনিতে স্মৃতির অস্বস্তি শুরু হয়ে গেল। সে তখন হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘না, আসলে আমি শুনেছিলাম উনি নাকি আপনার কম্পানিতেই চাকরি করতো। উনি আমার বাবার পরিচিত ছিলেন। কিন্তু অনেক বছর যাবত উনার কোনো খোঁজ নেই। তাই আপনার কাছে জানতে চাইলাম আরকি।’
জুভান মৃদু সুরে বললো,
‘আমাদের অফিসে সে আগে কাজ করতো। এখন আর করে না। আর সে এখন কোথায় আছে তাও আমি জানি না।’
স্মৃতি তার কথার পিঠে ছোট্ট করে বললো,
‘ওহহ।’
তারপর আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল ফ্রেশ হতে।
.
স্মৃতি আর জুভান বেরিয়েছে, স্মৃতির বাবাকে দেখতে। পথিমধ্যে স্মৃতি কাউকে একটা কল দিয়ে বললো,
‘আমরা আসছি, মানে আমি আর জুভান। আর মা’কেও চলে আসতে বলিস।’
কল রেখে স্মৃতি হেলান দিয়ে সিটে বসলো। জুভান তার দিকে একপলক চেয়ে বললো,
‘কী ব্যাপার স্মৃতি, তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?’
স্মৃতি হেসে বলে,
‘কই না তো, কিছু হয়নি। ঐ বাবাকে নিয়ে একটু চিন্তা করছিলাম। মানুষ টা আবার কবে যানি সুস্থ হয়ে উঠে!’
জুভান স্মৃতির হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
‘টেনশন নিও না। খুব তাড়াতাড়িই বাবা সুস্থ হয়ে উঠবেন।’
স্মৃতি তখন মনে মনে বললো,
‘হ্যাঁ, সুস্থ হয়ে উঠুক। নিজের বাবাকে তো আর বাঁচাতে পারলাম না, অন্তত অন্যের বাবাই সুস্থ হয়ে উঠুক। তাতেও অন্তত মনে একটু শান্তি পাওয়া যাবে।’
চলবে…