গল্প – অতঃপর তুমি আমি
রেশমী রফিক
পর্ব – ১২
গত কয়েকমাস যাবত পিউয়ের অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা ছিল লক্ষণীয়। সারাক্ষণ অভিযোগ করেছে, জুনায়েদ পালটে গেছে। এখন আর আগের মতো ওকে সময় দেয় না। ওর প্রতি তার কোনো মনোযোগ নেই। জুনায়েদ নিজেও জানত, পিউয়ের এই অভিযোগ অমূলক নয়। সত্যিকার অর্থেই সে পিউকে একা ছেড়ে দিয়েছিল। পিউকে তার মতো চলতে দিয়ে চাকরির প্রতি মনোনিবেশ করেছিল। পিউ কদিনের জন্য দূরে কোথাও ঘুরতে যেতে চেয়েছিল। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও জুনায়েদ সেই সময়টুকু বের করতে পারেনি। প্রথমত নতুন চাকরি তার। ছয় মাস প্রবেশনারি পিরিয়ডে কোনোরকম ছুটি নেবার নিয়ম নেই। দ্বিতীয়ত সাইকোলজিস্ট অনুরোধ করেছিল কোথাও না যেতে। পিউয়ের মানসিক চিকিৎসা চলছে। ডিভোর্স ক্যানসেল হবার পর কনজুগাল কাউন্সেলিংয়ের জন্য ওদের দুজনকেই রেফার করা হয়েছিল সাইকোলজিস্টের কাছে। তখনই জুনায়েদ প্রথমবারের মতো জানতে পেরেছিল, পিউ সুস্থ-স্বাভাবিক নয়। তার বয়স অনুসারে মনমানসিকতা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বয়স বাড়লেও মনের দিক থেকে চৌদ্দ-পনের বছরের ছোট্ট কিশোরী রয়ে গেছে সে। সেকারণেই বনিবনা না হওয়াতে এত ঝামেলা ছিল। জুনায়েদের চাওয়া-পাওয়ার সাথে পিউয়ের চাওয়া-পাওয়াগুলো মিলত না কখনো। মানসিক মিলটাও কখনো হয়নি ওদের। তবু, এতগুলো বছর ধরে এরকম অসম একটা সম্পর্ক বয়ে বেড়িয়েছে দুজনই। কীসের টানে, কে জানে। পিউয়ের তো কেবল একটাই যুক্তি, ভালোবাসি। আর জুনায়েদের যুক্তিটা সম্ভবত কঠিন অপরাধবোধ। পিউ তার অতীত ভুলতে পারলেও জুনায়েদ পারেনি। বরং যতবারই পিউকে দেখে চোখের সামনে, ততবারই পুরনো কাহিনি মনে পড়ে তার। সেসব কথা সাইকোলজিস্টকে বলতে গিয়েও থেমে গিয়েছে সে। কিছুতেই মুখে আনতে পারেনি কথাগুলো। আর পিউ মুখস্ত কিছু বুলি আউড়ে গেছে। যেমন, বাংলাদেশে অসম বিয়ে হওয়াটা স্বাভাবিক পর্যায়ে পড়ে। ওদের বয়সের মধ্যেকার পার্থক্য মাত্র ষোল বছর। এরকম অনেক অসম সম্পর্ক বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে খুঁজলে ঢের পাওয়া যাবে। এও বলেছিল, ওদের বিয়েটা পারিবারিকভাবে ঠিক করা হয়েছিল। এই মিথ্যেগুলো জুনায়েদই ওকে শিখিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, কেউ ওদের পরিচয় বা প্রথম দেখার কথা, কিংবা এতটা বয়সের পার্থক্যে বিয়েটা কেন হলো ইত্যাদি জানতে চাইলে যেন এটাই বলে। অথচ সে নিজে কখনো মিথ্যে বলেনি। মিথ্যে বলাটা তার ধাতে নেই। একারণে একই প্রশ্ন যখন আলাদাভাবে ওকে জিজ্ঞেস করেছিলেন সাইকোলজিস্ট, তখন সে মাথা নিচু করে রেখেছিল। সাইকোলজিস্ট প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করেননি। হয়তোবা পিউয়ের দেয়া উত্তরটাই তার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। অথবা এই প্রশ্নের উত্তরটা জানা জরুরী মনে করেননি। আবার এমনও হতে পারে, পেশেন্ট বা তার সাথে থাকা কাউকে জোরজবরদস্তি করে কোনো প্রশ্নের উত্তর জেনে নেয়াটা মানসিক চিকিৎসার নিয়মনীতির মধ্যে পড়ে না।
তারপর পিউয়ের মানসিক চিকিৎসা শুরু হলো। নিয়মিত কাউন্সেলিং করতে হতো ওকে। সাথে কিছু মেডিসিন প্রেসক্রাইব করেছিলেন ডাক্তার। জুনায়েদকেও কিছু দরকারী নির্দেশনা দিয়েছিলেন। যেমন, পিউকে শাসন করা যাবে না। তাকে ছাড় দিতে হবে। তার মনমতো চলতে দিতে হবে। ছোটখাট ব্যাপারে নিজে সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা তার থাকবে। ভুল করবে সে। কিন্তু সেই ভুলের জন্য তাকে কোনোরকম তিরস্কার বা বকাঝকা করা যাবে না। বড়জোর মাথা ঠান্ডা রেখে, ধীরেসুস্থে ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে ভুলটা কোথায় ছিল এবং কী করলে এই ভুলটা হতো না। এভাবেই একের পর এক ভুল থেকে শিক্ষা নেবে পিউ। ভবিষ্যতে একই ভুল সে দ্বিতীয়বার করবে না। এসব ছোটখাট ভুলের জন্য কোনো মাশুল দিতে হলে সেটা হজম করতে হবে চুপচাপ। ওর ভুলের কারণে এই হয়েছে, সেই হয়েছে এমন কিছু বলা যাবে না। “পিউ আমার বিয়ে করা বউ” এরকম মনোভাব দূর করতে হবে। সে নিজেকে সিঙ্গেল ভাবুক, তাতে কোনো সমস্যা নেই। একটা সিঙ্গেল মেয়ে যেভাবে চলে-ফিরে, সেভাবেই চলতে দিতে হবে তাকে। কোনো কাজ না করলে বা উল্টাপাল্টা কিছু করলে তার কাছে কৈফিয়ত চাওয়া যাবে না। সে নিজে থেকে ব্যাখ্যা দেয় কীনা সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তার সাথে কথা বলতে হবে নরম সুরে। কোনোরকম উচ্চবাচ্য করা যাবে না। পিউ কখনো রাগের মাথায় চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও জুনায়েদকে শান্ত থাকতে হবে। পিউ কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলে যাবে। দরকার পড়লে কিছুদিন বাসার বাইরে থাকুক। দূরে কোথাও ট্যুরে যেতে চাইলে যাক। তাতে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। মোট কথা, এই বয়সে ওর যতটুকু স্বাধীনতা আর চাওয়া-পাওয়া আছে, তার উপর অগ্রাধিকার দিতে হবে। এভাবেই ধীরে ধীরে বুঝাতে হবে, সে এখন আর ছোট্ট মেয়েটি নেই, একুশ বছরের পুর্ণ যুবতী। তার এখন নিজের পায়ে দাঁড়াবার সময় হয়েছে। বয়স অনুসারে ওকে বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব দিতে হবে অল্পসল্প। এতে করে সে নিজেই তার কাজগুলো করতে শিখবে। এভাবে শারীরিক বয়স আর মনের বয়স যতই কাছাকাছি চলে আসবে, ততই সে পূর্ণ যুবতী হয়ে উঠবে মনের দিক থেকে। আর তখন আপনাতেই পুরোদস্তুর বউ আর গৃহিনী হয়ে উঠবে। স্বামীর চাওয়া-পাওয়াগুলো নিজ থেকেই বুঝে নিবে। সংসারের প্রতি দায়-দায়িত্বও ঠিকমতো পালন করবে। এই সময়টুকু জুনায়েদকে কিছুটা দুরত্ব বজায় রাখতে হবে পিউয়ের সাথে।
সাইকোলজিস্টের পরামর্শ শুনে জুনায়েদ পুরোটা মনোযোগ ঢেলে দিয়েছে অফিসের কাজে। এমডির সাথে কথা বলে অফিসের সময়টা বাড়িয়েছে। ওভারটাইম করতে শুরু করেছে। পিউয়ের কোনো ব্যাপারেই মাথা ঘামায়নি। যা খুশি তাই করতে দিয়েছে। কখনো বন্ধুবান্ধবদের সাথে হৈ-হুল্লোড় করলেও টু শব্দ করেনি। উলটো বন্ধুদের সাথে মিশতে উৎসাহ দিয়েছে। জুনায়েদের জন্য ব্যাপারটা অত সহজ ছিল না। পিউকে সবসময় তার অধীনস্থ দেখেই অভ্যস্ত সে। পিউকে সে আগলে রাখত অন্য সবকিছু থেকে দূরে। পিউ ছিল শুধুমাত্র তার একার। আর কারো কোনোরকম অধিকার নেই পিউয়ের উপর, থাকতে পারে না। এরকম একটা মনোভাব থেকে সরে আসতে কষ্ট হয়েছে। মন বিদ্রোহ করেছে। পিউ তার হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে, এমন একটা আতঙ্ক ওকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। তবু সে স্থির-শান্ত ছিল। তার ভেতরকার তোলপাড় এতটুকু প্রকাশ করেনি। কিন্তু পিউ তাতে সন্তুষ্ট ছিল না। দিনকে দিন অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। প্রায়ই জড়িয়ে ধরে কারণে-অকারণে কান্নাকাটি করত। হাজার রকমের অভিযোগ করত। জুনায়েদের তখন খুব ইচ্ছে করত, ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে। বলতে ইচ্ছে করত, তুমি আমার, আর কারো নও। আমি চাই না, তোমার আশপাশে আমি ছাড়া আর কেউ থাকুক। তোমার জগতে শুধুমাত্র আমার উপস্থিতি থাকবে। জুনায়েদ কিছুই বলেনি ওসব। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে। অফিসে থাকাকালীন সময়ে বারবার বাসায় ফোন করতে মন চাইত। পিউ কী করছে, কেন করছে সেসব জানতে ইচ্ছে করত। পিউয়ের জন্য সারাক্ষণ টেনশন থাকতই তার মাথায়। অনেকবার লাঞ্চটাইমে বা কাজের ব্রেকে সময় পেলেই মোবাইলে পিউয়ের নাম্বার ডায়াল করেছে। কিন্তু কল বাটনে চাপ দেয়া হয়নি। কখনোবা মেসেজ লিখেছে পিউয়ের উদ্দেশ্যে। সেন্ড বাটনে চাপ দেয়নি। মেসেজগুলো আজ অব্দি ড্রাফট ফোল্ডারে জমা হয়ে আছে। পিউয়ের অস্থিরতা ওকে স্পর্শ করত ভালোভাবেই। সাইকোলজিস্টকে সে পিউয়ের সমস্ত আপডেট খবরাখবর জানিয়েছে। কয়েকমাস যাবত পিউকে খুব বেশি অস্থির দেখাচ্ছে, তাও বলেছে। সাইকোলজিস্ট বলেছেন, এগুলো উপসর্গ মাত্র। মেডিসিনের প্রভাবে এমন হচ্ছে। তাছাড়া, যে পাখিটা জন্ম বা ছোটবেলা থেকে খাঁচায় বন্দি থেকেছে, বন্দিজীবনের সাথে সখ্যতা হয়েছে, অভ্যস্ত হয়ে গেছে। একটা সময় পর সেই পাখির খাঁচার দরজা খুলে রাখলেও সে ফুরুত করে উড়াল দেবে না। দরজা যেমনই থাকুক, সে ভেতরে থাকবে। ভেতরে থাকতেই আরামদায়ক বোধ করবে। কারণ সে জানে বাইরের জগতে পা দেবার সাথে সাথেই তার নতুন জীবন শুরু হবে, যেটা কীনা আদতে অনিশ্চয়তায় ভরপুর। শ্বাপদসংকুল একটা পথে অনিশ্চিয়তার পানে ছুটতে হবে তাকে। এরকম একটা ভয় থেকেও পাখি মনে করে খাঁচাটা তার জন্য নিরাপদ জায়গা। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিও ঠিক একইরকম। একটা মানুষ যখন অনেকটা সময় ধরে বন্দি থাকার পর আচমকা মুক্তি পায়, স্বাধীনতা চলে আসে তার হাতের মুঠোয়, তখন সবকিছু বিস্বাদ লাগতে শুরু করে। স্বাধীনতাটাকে উপভোগ করতে পারে না। বন্দিত্বের শৃংখল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। কারণ, বন্দি থাকাটা ততদিনে তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। পিউয়ের অবস্থাও সেরকম। সে জানেই না, পৃথিবীটা কত বড়। সে জানে না, জুনায়েদই তার একমাত্র পৃথিবী নয়। তাই জুনায়েদকে ছাড়া একটা মুহূর্ত একাকী কাটাবার কথা ভুল করেও ভাবতে পারছে না। আচমকা এই পরিবর্তনটাই তাকে অস্থির করে তুলেছে। মেডিকেশন আর কাউন্সেলিং ঠিকমত চলতে থাকলে দ্রুতই এসব উপসর্গ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে।
জুনায়েদের সাথে দেখা করতে পুলিশ কাস্টডি সেন্টারে এসেছেন ম্যাকক্লেয়ার। পেশায় একজন সাইকোলজিস্ট তিনি। পিউয়ের মানসিক চিকিৎসা তিনিই করছিলেন। পিউয়ের সুইসাইড অ্যাটেম্পটের খোঁজ নিয়ে প্রথমে হাসপাতালে গিয়েছেন। সেখান থেকে পিউয়ের খোঁজখবর নিয়ে, এরপর পুলিশ স্টেশনে গিয়েছিলেন জুনায়েদের সাথে দেখা করতে। ওখান থেকে জানিয়েছে, জুনায়েদের জামিনের জন্য কেউ না আসায় আজ তিন দিন হলো তাকে পুলিশ কাস্টডিতে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো আইন ভঙ্গের অভিযোগ এনেছে পুলিশ। মামলা করা হয়েছে কোর্টে। সময়মতো সেই মামলার শুনানির দিনক্ষণ ধার্য হবে। তার আগে সে জামিন নিতে পারে। কিন্তু জুনায়েদ কোনো লইয়ারের সাথে কথা বলতে রাজি হয়নি। পুলিশ স্টেশন থেকে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল কোনো লইয়ার নিযুক্ত করবে কীনা তার পক্ষে। সে ডানে-বায়ে মাথা নেড়েছে। এবং পুলিশ সেটাকে না-সূচক উত্তর হিসেবে নিয়েছে।
জুনায়েদ যখন শুনল তার সাথে কেউ একজন দেখা করতে এসেছে তখন সে খুব শান্তভাবেই বের হয়ে এলো সেল থেকে। একজন অফিসার ওকে নিয়ে গেলেন কাস্টডির ইন্টারোগেশন রুমে। সেখানে রুমের মাঝখানে একটা টেবিল রাখা। তার দুইপাশে দুটো চেয়ার। একটায় বসে আছেন ম্যাকক্লেয়ার। জুনায়েদ রুমে ঢুকতেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। আর জুনায়েদ তাকে দেখামাত্রই বেদম ক্ষেপে গেল। এই কয়টা দিন কাস্টডিতে বসে এই লোকটার পিন্ডি চটকেছে সে। মাথার মধ্যে আবোলতাবোল সব চিন্তাভাবনা ঘুরঘুর করেছে, যার মধ্যে অন্যতম, কাস্টডি থেকে ছাড়া পাবার পর এই লোকটার উপর চড়াও হওয়া। যত্তসবের মূলে এই সাইকোলজিস্ট। এর বুদ্ধিমতো চলতে গিয়েই আজকে পিউয়ের এই পরিণতি। এই লোকটা নিজেই পাগল, নিজেই একটা মানসিক রোগী। সে আবার কী চিকিৎসা করবে পিউয়ের? উলটো সুস্থ-স্বাভাবিক পিউকে এই লোকটাই মানসিক রোগী বানিয়ে ফেলেছে।
– তুমি… তুমিই এসবের জন্য রেস্পনসিবল। ইউ আর দ্য ব্লাডি মার্ডারার। ইউ কিল দ্য পেশেন্টস ইনস্টিড অফ কিউর দেম। ব্লাডি…
সাইকোলজিস্টের দিকে তেড়ে যেতেই পেছন থেকে পুলিশ ওর হাত চেপে ধরল। আরো একবার হাত পিছমোড়া করে হ্যান্ডকাফ পরাবার উদ্যোগ নিল। তাকে থামালেন ম্যাকক্লেয়ার। বেশ শান্ত ভঙ্গিতে বললেন,
– কুড ইউ প্লিজ লিভ আস অ্যালোন ফর সামটাইম?
“ফাইভ মিনিটস অনলি” বলেই অফিসার চলে গেলেন ওয়েটিং রুমের বাইরে। যাবার আগে জুনায়েদকে সাবধান করে গেলেন, কোনোরকম ঝামেলা যেন না করে। জুনায়েদ তখনো জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ম্যাকক্লেয়ারের দিকে। ম্যাকক্লেয়ার বললেন,
– কুল ডাউন, জুনায়েদ। উই নিড টু টক।
– আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই না। তুমি চলে যাও এখান থেকে।
– আমি চলে গেলেই কী প্রবলেম সলভ হয়ে যাবে?
– আর কী বাকি আছে? সবকিছু তো সলভ হয়েই গেছে।
– পিউ ইজ স্টিল অ্যালাইভ!
– অ্যান্ড স্টিল ইন দ্য আইসিইউ। তুমি কী আমাকে গাধা ভাব? নাকি আমি ডাক্তার নই বলে আমাকে যাচ্ছেতাই বুঝ দেবে?
– পিউ ইজ রিকভারিং, জুনায়েদ।
– হোয়াট রিকভারিং? সুইসাইড করতে গিয়েছিল সে। আজকে তিন দিন হয়ে গেল। এখনো আইসিইউতে। আমাকে কী বুঝাও তুমি?
– জুনায়েদ, প্লিজ। বি কোয়াইট।
– আমার বউ মরে যাচ্ছে আর তুমি এক্সপেক্ট করো আমি চুপচাপ বসে থাকব। শান্তশিষ্ট হয়ে থাকব। তোমার সাথে হ্যান্ডশেক করব। হাসিমুখে কথা বলব, হ্যালো ডক্টর!
– আই আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট ইউ আর গোয়িং থ্রু…
– নো, ইউ ডোন্ট। বুঝলে আমার এতবড় ক্ষতি তুমি করতে না।
– আমি তোমার ক্ষতি করেছি?
– হ্যাঁ তুমিই করেছ। হাজারবার বলেছি, পিউ ছাড়া আর কেউ নেই আমার লাইফে। এই একটামাত্র মানুষ আমার দুনিয়া জুড়ে। আর আজ আমি তাকে হারাতে বসছি কেবলমাত্র তোমার জন্য। তোমার কথা না শুনলে আজকে এই অবস্থা হতো না।
– হ্যাঁ, তবে পিউও সুস্থ হতো না।
– কী সুস্থ হয়েছে পিউ? বরং আমি বলব, আগের তুলনায় ওর অবস্থা আরো বেশি খারাপ হয়েছে। আমি তোমাকে অনেকবার বলেছি পিউকে টেনসড দেখাচ্ছে। অকারণে কান্নাকাটি করে সে। সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। আমার অ্যাটেনশন চায়। তুমি বললে, এগুলো ওর মেডিসিনের কারণে হচ্ছে। কদিন পর এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। আমার সাথে ঘুরতে যেতে চাইল দূরে কোথাও। তুমি নিষেধ করলে। বললে, কোথাও ঘুরতে গেলে একা যাক, বন্ধুদের সাথে যাক। আমার সাথে গেলেই তার প্রবলেম হয়ে যাবে! কেন? আর আমিও গাধা একটা। তোমার কথা মেনে নিয়েছি। আমার ধারণা ছিল, তুমি পিউকে সুস্থ করে তুলবে।
– পিউ এইটি পার্সেন্ট সুস্থ হয়ে গেছে, জুনায়েদ!
– তাহলে সুইসাইড করল কেন? আমার সাথে না কোনোরকম ঝগড়া হয়েছে, না কোনো কথা কাটাকাটি। আজকাল সে যা কিছু বলে, আমি চুপচাপ মেনে নিই। হ্যাঁ হ্যাঁ করি। কখনো কোনো ব্যাপার আমার পছন্দ না হলেও ওর সাথে সায় দিই। কিছুদিন আগেও একদল ফ্রেন্ড আসছিল বাসায়। ছেলে-মেয়ে সবাই মিলে গেট টুগেদার করছে। অনলাইনে খাবার অর্ডার করছে। আমি তো কিচ্ছু বলি নাই। তারপরেও শুনি, সে সারাদিন বন্ধুদের সাথে ছিল ঠিকই। কিন্তু লাঞ্চ করেনি। সকালে ব্রেকফাস্ট করেনি। রাতে ডিনার না করেই ঘুমিয়েছে। ও কাঁদছিল, জান? আমি বাসায় ফিরে ওকে সিটিং রুমের সোফায় পেয়েছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলছে। ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ওই রাতেই আমি তোমাকে কল করেছিলাম।
– আমার মনে আছে।
– তুমি আমাকে বলো। পিউ যদি সুস্থ হয়েই থাকে, তাহলে সুইসাইড করল কেন? কেন?
– সেটা ইনভেস্টিগেট করতেই এসেছি। আমাকে কো-অপারেট করো প্লিজ। তোমার সাথে কথা বলা খুব দরকার।
– কো-অপারেট তো করলাম এতদিন। আর কত করব? তুমি জান, আমার বউ কতটা চঞ্চল ছিল? সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি, হুড়াহুড়ি করত। একটা সেকেন্ড কোথাও চুপ করে বসে থাকতে পারত না। আর এখন সে মুর্তির মতো চুপচাপ বসে থাকে। কথা বলে না। দুই-চারটা কথা বলেই কাঁদতে শুরু করে। সে তো আগে এমন ছিল না।
ম্যাকক্লেয়ার হতাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন জুনায়েদের দিকে। এখানে এসেছিলেন কথা বলতে। সুইসাইড করার আগে পিউয়ের শেষ কদিনের ব্যাপারে খুঁটিনাটি জানতে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, জুনায়েদ কথা বলার মুডে নেই। তার মেজাজ গরম। চিৎকার না করে কোনো কথাই সে বলতে পারছে না। অফিসার রুমের দরজা খুলে বললেন,
– টাইমস আপ!
ম্যাকক্লেয়ার তাকে অনুরোধ করলেন,
– টু মিনিটস মোর, প্লিজ
– নো মোর দ্যান টু মিনিটস।
অফিসার চলে যেতেই আবার জুনায়েদের দিকে ঘুরলেন ম্যাকক্লেয়ার। বললেন,
– শুনলে তো, আর মাত্র দুই মিনিট কথা বলতে পারব।
– আমি কোনো কথা বলব না তোমার সাথে। তুমি চলে যাও।
– জুনায়েদ, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি। একটু বুঝার চেষ্টা করো।
– আগে তো পিউ বাঁচুক। তারপর বাকি কথা।
– বিলিভ মি, শি উইল সারভাইভ! সে এখনো আইসিইউতে, তার মানে এই নয় যে, সে বাঁচবে না। আমি এখানে আসার আগে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ওর খবর জেনে এসেছি। ওখানের ইনচার্জ ডক্টর আমাকে জানিয়েছে, অনেক রক্ত দিতে হয়েছে পিউয়ের শরীরে। তবু সে এখনো অনেকটাই দুর্বল। এমনিতেও সে কান্নাকাটি করছে খুব। চিৎকার করে কেঁদেছে। যার কারণে তার বিপি, হার্টবিট নরমালে আসতে সময় নিচ্ছে। তাছাড়া তুমি হয়তো জান না, সুইসাইড করার আগে সে প্রেসক্রাইবড মেডিসিন খেয়েছিল। হাই ডোজ ছিল সেটা। দুর্ভাগ্যবশত, সেটাও এফেক্ট করেছে। ওকে এখনো আইসিইউতে রাখা হয়েছে শুধুমাত্র অবজারভেশনের জন্য। এখন তুমি আমাকে বলো, ওর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ করেছিলে?
– সব তো তোমাকে বলেছিই। কান্নাকাটি করত আর মনমরা হয়ে থাকত। আর আমি তো সারাদিন বাসায়ও থাকি না। একদিকে নতুন জব, অফিসের সবথেকে টাফ জবটা এমডি আমার জন্য তুলে রাখে। অন্যদিকে পিউ আমার অ্যাটেনশন চাচ্ছিল বারবার। ও চাচ্ছিল আমি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরি। ওকে সময় দিই। কিন্তু আমি সময় বের করতে পারিনি। আর তুমিও নিষেধ করেছিলে।
– সে ক্লাসে যায় রেগুলার?
– ইচ্ছে হলে যায়, নইলে যায় না।
– ফ্রেন্ডদের সাথে বন্ডিং কেমন?
– জানি না।
– ওর ফ্রেন্ডরা কোনো আপডেট দিয়েছে?
– গতকাল থমাস এসেছিল এখানে। ওর কাছে শুনলাম, পিউ এখন আর ওদের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায় না।। এড়িয়ে চলে সবসময়। ক্লাসে গেলে আলাদা বসে। কথা বলে না ভালোভাবে। ওদের সাথে গল্পগুজবও করে না। ক্লাস শেষ হলেই ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে যায়। ফোন করলেও কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দেয়।
ম্যাকক্লেয়ার চিন্তিত সুরে বললেন,
– দেখ জুনায়েদ, পিউয়ের সুইসাইড নিউজ শুনে আমি নিজেও শকড। সে প্রায় সুস্থই হয়ে গেছিল। অন্তত সুইসাইড করার মতো অবস্থায় ছিল না, সেটা নিশ্চিত।
– তাহলে কী ভুত ওকে হিপনোটাইজ করে সুইসাইড করিয়েছে? আমি যদি ঘুর্ণাক্ষরেও টের পেতাম আমার বউ এমন কান্ড করবে, আমি… আমি…
– রিল্যাক্স, জুনায়েদ।
– আমার বউয়ের কিছু হয়ে গেলে আমি কী করব? কী নিয়ে বাঁচব? ও ছাড়া আমার আর কেউ নেই!
– ধৈর্য ধরো।
– ওর সুস্থ হবার কোনো দরকার ছিল না। যেমন ছিল, তেমনই নাহয় থাকত। ওর ছেলেমানুষীর সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। সবসময় তো লাইফ, টাইম, সংসার এগুলো নিয়ে ভাবলে চলে না। কখনো-সখনো মানুষটাকে প্রায়োরিটি দিতে হয়। একেবারেই তো পাগল না আমার বউ। মেন্টালি ইমব্যালেন্সড সে। সেটুকু নাহয় আমিই মানিয়ে নিতাম। এতগুলো বছর মানিয়ে চলতে পেরেছি। আর বাকিটা জীবন কি পারতাম না? অবশ্যই পারতাম।
অফিসার দরজায় নক করলেন। শেষ দুই মিনিটও শেষ হয়ে গিয়েছে। ম্যাকক্লেয়ার সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
– তুমি নাকি জামিনের জন্য রাজি হওনি।
– হ্যাঁ, রাজি হইনি। কাল থমাস এসেছিল আমার জামিনের ব্যবস্থা করতে। আমি ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি।
– কেন?
– কী হবে জামিন দিয়ে?
উত্তর না দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন ম্যাকক্লেয়ার। সময় শেষ, এক্ষুণি বের হতে হবে। রুম থেকে বেরিয়ে যাবার সময় দরজার কাছে গিয়ে থামলেন ক্ষণিকের জন্য। পেছন ফিরে বললেন,
– আমি তোমার জামিনের ব্যবস্থা করছি। রিফিউজ কোরো না, প্লিজ। ইটস অ্যা হাম্বল রিকুয়েস্ট। পিউয়ের এখন তোমাকে সবথেকে বেশি দরকার। ফর হার সেক, প্লিজ। (চলবে)