অনুভুতির অন্তরালে পর্ব -২৬+২৭

#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৬

তাপমাত্রা কমে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গভীর রাতের দিকে তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দূর থেকে অস্ফুট ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। অন্ধকারে ফোনের টর্চের আলোয় মৃদু দেখা যাচ্ছে। তার মাঝে আরশি এদিক ওদিক নড়াচড়া করে চলেছে। অপূর্ব বিরাগী হয়ে একবার আরশির মুখপানে চায়, পুনরায় নিজের কাজে ব্যস্ত হচ্ছে। আরশির সিল্কের ওরনাটা ঘাসের উপর বিছিয়ে দিল। টান টান করে কুঁচকানো জায়গা গুলো ঠিক করে নিল। পরপর কয়েকটা ওরনা গিট দিয়ে চারপাশের চারটে গাছ পেঁচিয়ে বেড়ার ন্যায় করলো। উপরে শূন্য মেঘহীন অন্তরিক্ষ। একটু আগে প্রবল বৃষ্টি হয়েছে, তবে পাহাড়ের অন্য প্রান্তে। এখানে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। কাঁধ থেকে ব্যাগটা বের করে ওরনার উপরে রাখল। আরশির দিকে না চেয়ে ইশারায় বলল,

-” এখানে শুয়ে শাল জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়।”
আরশি চুপ করে ওরনার উপরে গিয়ে বসল। নিচের দিকে চেয়ে বলল,
-” অনেকটাই জায়গা আছে, অন্য কেউ চাইলে শুতে পারে।”

অপূর্ব ফোন রেখে আড়চোখে আরশির দিকে অবলোকন করলো। বুঝতে অসুবিধে হলো না, এখনো রেগে আছে। এখন অবধি টু শব্দটি করে নি। ধপ করে বসে পড়লো ঘাসের উপরে। বেড়া দেওয়া ঘাসের উপরে বসে বলল,-” প্রয়োজন নেই।”

-“ডং!” মৃদু শব্দে বলে উঠলো সে। অপূর্বের শ্রবণ গোচর হলো সেই শব্দ। বেশ মিষ্টি ঠেকলো তার নিকট। আরশি ব্যাগের উপরে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। অপূর্ব ফোন রেখে বসে রইল। চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। বোনকে না পাওয়া অবধি তার ঘুম অনিশ্চিত। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে অর্ধ খাওয়া সিগারেট টা আবার ধরালো। খক খক করে কেশে উঠলো আরশি। সাথে সাথে নিভিয়ে দিলো। মাটির সাথে পিষে জলন্ত আগুন নিভিয়ে ফেললো।
আরশি অপূর্বকে পিঠ দেখিয়ে শুয়ে আছে। না ফিরে পশ্চাৎ থেকে বলে,

-” ভাইয়া আর তরী কখন আসবে?”

অপূর্ব জবার দিলো না। আরশি আরো একবার একই প্রশ্ন করল। এবারও জবার মিললো না। অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে চাইলো। জায়গাটা ফাঁকা। উঠে বসলো সে। আশে পাশে গভীর ভাবে অপূর্বকে খুঁজতে লাগলো, কিন্তু পেল না। কাতর হয়ে হাঁটা ধরলো। চারপাশ আরশির কাছে ভয়ংকর হয়ে উঠলো। সবকিছু ফেলে রেখে অগ্ৰসর হলো সামনের দিকে।

অপূর্ব তদানীং শুকনো খড় পাতা, ডাল খুঁজতে গিয়েছিল। রাত গভীর হওয়ার সাথে শীতলতা বাড়তে লাগছিলো। তাপ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেরিয়েছে সে। দুহাতে আষ্ঠে পিষ্ঠে মুড়িয়ে নিয়ে এলো ডাল পালা। আরশি ঝড়ের গতিতে এসে ধাক্কা খেল অপূর্বের বুকে। অপূর্বের এতোক্ষণ কুড়িয়ে কুড়িয়ে আনা খড় কুটো গুলো নিচে পড়ে গেল। অপূর্ব চমকে উঠলো। আবার সেই মাতাল করা নিদ্রা কেড়ে নেওয়া গন্ধ। কম্পিত হলো দেহ। সেই হরিণী নয়ন জোড়া দিয়ে চাইলো একবার। আজ তার চোখে ভীতি। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল বাঁকা চাঁদের ফালি। যেন এতোক্ষণ তার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। পুনরায় ঝাঁপিয়ে পড়লো বুকে। তোতলাতে তোতলাতে বলে,

-” কোথায় গিয়েছিলে তুমি? আমার ভয় করছিলো।”

অপূর্ব তার কাঁপা কাঁপা হাতটা আরশির মাথায় ঠেকালো। আশ্বাসের স্বরে বলল,

-” কি হয়েছে আরু? ভয় নেই, এই তো আমি। চোখ মেলে ভয়কে জয় করো।”
আরশি একবার ভালো করে চেয়ে দূরত্বকে প্রাধান্য দিয়ে সরে গেল। ঘন ঘন পলক ফেলে আমতা আমতা করে বলে,

-” স্যরি আসলে..

আর বলতে হলো না। অপূর্ব হাতের ইশারায় থামিয়ে দিল। ফোনটা আরশির দিকে এগিয়ে দিল। আরশি ফোনটা স্পর্শ করতেই অপূর্ব পুরো ছেড়ে দিলো। পড়ে যাওয়া খড় কুটো গুলো গুছিয়ে আরশির পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে সামনের দিকে হাঁটা দিলো।

পূর্বের স্থানে এসে ধড়াম করে ফেলে দিলো। একে একে সাজিয়ে গুছিয়ে লাইটারের সাহায্য কে আগুন ধরিয়ে দিলো। হলদেটে আলোয় চারপাশ আলোকিত হলো। সর্ব প্রথম অপূর্ব নিজের শীতল হাতটা আগুনের তাপে উষ্ণ করে নিল। তার দেখাদেখি আরশিও গিয়ে বসে তাপ পোহাতে লাগলো। অপূর্ব তার ব্যাগের জিনিস পত্র গুলো চেইন খুলে উল্টো করে ধরলো। সবগুলো জিনিস নিচে পড়ে গেল। অপূর্ব হাতিয়ে হাতিয়ে নিজের কাঙ্খিত জিনিসটা পেল। আসার আগে চারটা কাপ নুডুলস এনেছিলো সে। নুডুলস খাবার টা অপূর্ব আর তরী, দুজনেরই খুব পছন্দের খাবার। আসার সময় নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু সবকিছুর ব্যস্ততায় ভুলে গেছিলো। পাহাড়ি পথে আসার সময় সাথে ফ্লাক্স নিয়ে এসেছিলো।

ফ্লাক্সের পুরোনো পানিগুলো ফেলে দিয়ে বোতলের পানিতে হাফ ভরে নিলো। অতঃপর আগুনে জলন্ত ডালের উপর রেখে দিলো।

প্রয়োজনীয় পানি দিয়ে দুই কাপ পূর্ণ করে নিলো। একটা কাপ আরশির দিয়ে এগিয়ে দিয়ে বলল,

-” ইচ্ছে হলে খেয়ে নিও‌। কতোদিন না খেয়ে থাকতে হবে, জানা নেই।

বলেই অপূর্ব নিজের হাতে, নিজের মতো খেতে লাগল। দুপুরে খেয়েছে, এখন না খেলে থাকতে পারবে না। আরশিও বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিল।
.
.
চোখের পাতা জ্বলছে। বড্ড ভারী ভারী ঠেকছে। গাছের সাথে হেলান দেওয়া অপূর্ব। আরশি গুটি শুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। বন জঙ্গলের রাত, বোঝা যাচ্ছে না কয়টা বাজে। অপূর্বের ফোন বন্ধ করে রেখেছে। চার্জের অভাবে লো হয়ে আছে। আরশির দিকে চাইলো। মেয়েটা শীতে ঠকঠক করে কাপছে। তাদের সব প্রয়োজনীয় জিনিস রিসোর্টে রেখে এসেছিল। আগুনের শিখার মাঝে আরো একটা ডাল দিয়ে দিলো। আরশির পাশে ফাঁকা জায়গা গিয়ে শুয়ে পড়লো। শালের কিছুটা অংশ নিজের শরীরে পেঁচিয়ে নিল। বিনিময়ে শো শো করে বাতাস অন্তর্ভাগে প্রবেশ করতে লাগলো। অপূর্ব অসন্তোষ প্রকাশ করলো। নিজের শরীরের সবটুকু ভার আরশির শরীরে দিলো। উপর থেকে শালটা পেঁচিয়ে নিলো। ধীরে ধীরে ঝটফটানি কমে এলো তার। অপূর্ব মাথা তুলে হাত বুলিয়ে সরে আসতে চাইলো। হাত গিয়ে ঠেকলো আরশির গলায়। খানিকটা জায়গা ফুলে আছে। অপূর্ব স্লাইড করলো জায়গাটা। জলন্ত আগুনের দন্ডা নিয়ে আরশির উপরে দেখলো। গলার জখম টা মারাত্মক ছিল। কালো হয়ে ফুলে গেছে বেশ। অনুসূচনায় পূর্ণ হয়ে উঠল অপূর্ব। অপূর্ব ঝুঁকে পড়লো। সময় নিয়ে দৃঢ় করে অধর ছুঁয়ে দিলো আরশির গলায়। আরশি নড়েচড়ে উঠলো। অপূর্ব সরলো নয়। বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে ধরে নয়ন যুগল গ্ৰথণ করে নিলো। মনে মনে নিজেকে দোষারোপ করে,

-” হ্যাঁ! ঠিক বলেছিলে তুমি, আমি পাষান, অমানুষ, জানোয়ার, স্বার্থপর। আমি তোকে এভাবে আঘাত করেছি। আ’ম স্যরি আরু। আমি অন্যায় করেছি। এভাবে মতো আমাকে গ্ৰহন করে নে। তুই কথা না বললে, কেমন অন্ধকার লাগে সবকিছু। প্লীজ!”

বলতে চাইলো অনেক কিছু, কিন্তু বলা হয়ে উঠলো না। রাতের আঁধারে, মনে গহীনে চাপা পড়ে গেল সবকিছু। সে উচ্চারণ করেছি ঠিকই কিন্তু সবকিছু অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। তবে এই রাতের পর আরশিকে আর কোনো কষ্ট পেতে দিবে না,কখনো দিবে না।
_____________
অরিশ ভাইয়া টান টান হয়ে শুয়ে আছে দুজনের উপযোগী চৌকিতে। টুলে বসে দাঁতের সাহায্য নক কেটে চলেছি আমি। ভাইয়াকে দেনমোহর রেখে আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।
টুলের উপরে খাবারের ফাঁকা থালা ঢেকে রাখা। ভাইয়া আর আমি খেয়ে নিয়েছি। কিন্তু সে আমার সাথে একটাও কথা বলেনি। ল্যাম্পের আরো নিভে নিভে আসছে। তেল ফুরিয়ে এসেছে। পিনপিনে নিরবতা ভেঙ্গে বললাম,

-” ভাইয়া, কি হয়েছে তোমার? আমার সাথে কথা কেন বলছো না?”

কোনো উত্তর দিলেন না তিনি। আরো একটা ডাক দিলাম। উঠে বসলেন তিনি। হাঁটুতে একহাত রেখে তীক্ষ্ম দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন,

-” কি হই আমি তোর?”

কিছু না ভেবে ফট করে উত্তর দিলাম,-” কেন ভাইয়া!”

-” আজ পর্যন্ত কোনো বউকে শুনছিস, ভাইয়া ডাকতে ডাফার। আমি তোর ভাই হই? এদিকে আয়, চড়িয়ে তোর দাঁত গুলো ফেলে দেই।”

ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে উঠলাম,
-” কি করব, আমি! তুমি তো আমার ভাইয়া ছিলে। এখন তাহলে কি ডাকব?”

-” তারমানে তুই আমাদের বিয়েটা মানিস না। মানিস আর না মানিস, বিয়েটা হয়ে গেছে। সম্মান দিয়ে এবং ওগো, শুনছো প্রতিটি লাইনে ব্যবহার করবি।”

বলেই উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। আমিও সংকোচ নিয়ে তার পাশে শুয়ে পড়লাম। আমার উপস্থিতি অনুভব করে ফিরলেন আমার দিকে। দু আঙুলের সাহায্যে আলো নিভিয়ে দিলেন। হাত ধরে টেনে তার বুকে নিয়ে নিলেন। নেশালো মানুষের ন্যায় টেনে টেনে বললেন,

-” এই বুকটা সহ আমি শুধু তোর। আগেও ছিলাম, এখন লিখিতভাবে তোর। কখনো সরে যাস না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে।”#অনুভূতির_অন্তরালে ❤️‍🔥
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৭

ভোরের আভা চারদিকে আলোড়ন সৃষ্টি করার পূর্বেই বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়েছি আমরা। বৃদ্ধ লোকটি আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন হলেও দায়িত্বে কোনো রুপ ত্রুটি রাখে নি। ভোর ভোর আমাদের জন্য গাড়ি ভাড়া করে এনেছে। দেরী না করে আমরা বেড়িয়ে পড়েছি। সকাল সকাল ফোন করে জানতে পেরেছি, টুর শেষ করে ফিরে গেছে সকলে। তাই থানচি শহর হয়ে বাসে চড়ে নিজেদের শহরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ব। যেই ভাবা সেই কাজ।
ভাইয়ার হাত জড়িয়ে বাহুতে মাথা দিয়ে আছি। তখন তিনি নির্বিকার ভাবে বলে উঠে,

-” আমার পিচ্চিটা এখন আর পিচ্চি নেই। কাল রাতে থেকে আমার রাজ্যের রানী হয়ে উঠেছে। কিছুদিন পর আমার পিচ্চির মা হয়ে উঠবে। তবে আফসোস বাসর টা এখন করা হয়নি। চিন্তা করিস না, ধুমধাম করে তোরে নতুন ভাবে নতুন রুপ আবার বিয়ে করব। বাসর না করাতে তুই কি রাগ করেছিস, তরী?”

বলেই ভ্রু নাচালেন তিনি। আমাকে লজ্জায় ফেলতে তিনি এমন কথা বলেছেন, তার কোনো দ্বিমত নেই। আমিও লজ্জা পেয়েছি, তবে লজ্জা না পাওয়ার ভঙ্গিমা দেখালাম। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলাম। আমাদের এই সম্পর্কে আদোও কি কোনো ভিত্তি আছে মামুনির কাছে? তবুও আমি চাই, তিনি মেনে নিক আমায়‌।
তবে লুকাতে পারলাম বলে, মনে হলো না। আমার চিবুক ধরে আলতো উপরে তুলে বললেন,

-” হয়েছে, আর লজ্জা পেতে হবে না। তুই জানিস না, লজ্জা পেলে তোর গাল দুটো গাল থাকে না। একদম বেদানার দানার মতো টুকটুকে লাল হয়ে যায়। ইচ্ছে করে, টুস টুস করে চিবিয়ে খেয়ে..

আর কিছু উচ্চারণ করতে পারলেন না তিনি। আঙুল ছুঁইয়ে দিলাম তার অধরের উপরে। কিয়ৎক্ষণ নির্বাক চেয়ে থেকে হুট করেই হাত টেনে উল্টো পিঠ অধর ছুয়ে দিলেন।

তার কাঁটা কাঁটা কথার মাঝে আমরা এসে পৌঁছালাম থানচি। সেখানে আগে থেকেই আরশি আর অপূর্ব আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছিলাম, অপূর্বের ব্যবহারে।
আমাদের এগিয়ে আসতে দেখেই অপূর্ব ভাইয়া নিজের মধ্যে মুড়িয়ে নিয়েছিল আমায়। একদম ছোট্ট বাচ্চাদের ন্যায়। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন আমায়। চোখের কোণের অশ্রু ধারা গড়িয়ে পড়েছিল আমার চোখে। তবু তার ঠোঁটের কোণে ছিলো, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুগ্ধ করা হাসি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শুধালো,
-” খুকি, তোর কিছু হয় নি তো!”

হুট করে তিনি আমাকে ছেড়ে দাঁড়াতেই আরশি এসে ধরলো আমায়। জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে আওড়ালো,

-” কতোটা ভয় পেয়েছি, তোরে বলে বুঝাতে পারব না। ভাইয়া আর তুই স্ব শরীরে ফিরে এসেছিস, আমার আর কিছু চাই না!”

-” মানে কি আরশি, আমরা ফিরে এসেছি। তুই কি খুশি হয়নি?”

মাথা নাড়িয়ে মৃদু শব্দে হ্যাঁ বললো সে। আমি গড়িয়ে পড়া পানিটুকু মুছে দিলাম। নাক ধরে টেনে বললাম,

-” পাগলি, তাহলে কেন কাদছিস?”

অতঃপর আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত সাতটা বেজে গেল। বাড়িতে ফিরতেই সম্মুখীন হতে হলো মামুনির।
সকলের সামনে পরপর কয়েকটা চড় বসিয়ে দিলেন গালে। গালে হাত দিয়ে নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলাম তার দিকে। তীক্ষ্ম দৃষ্টি আকর্ষণ করে রইলেন তিনি। নিজের ভেতরের ক্ষোভ সংযত করতে ব্যর্থ হয়ে চুল চেপে ধরলেন আমার। আমাদের পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনা হয়তো ভার্সিটির কেউ জানিয়েছে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,

-” তোর মতো অপয়া, অলক্ষী মেয়েকে আমি যেতে বারণ করেছিলাম। কিন্তু আমার কথা শুনলি না। মরতে গেছি, সেই পাহাড়ে। তোর মরার শখ হয়েছে, মরতে গেছিস। আমার অরিকে কেন মারতে নিয়ে গেছিলি। তোকে তো আমি..

শক্ত লোপ পেল আমায়। চুলে ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। আরশি মামুনিকে থামানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হচ্ছে। অরিশ ভাইয়া অপূর্ব ভাইয়াকে বিদায় দিয়ে আসবে।
ততক্ষণে চলে এলেন তিনি। মামুনির থেকে ছাড়িয়ে নিলেন আমায়। আমি পেছনে থেকে ভাইয়ার শার্ট আঁকড়ে ধরে গুটিয়ে রইলাম। ভাইয়া মামুনির ব্যবহারে অধ্যর্য হয়ে উঠলেন,

-” মা, থামবে তুমি? এমন করছো কেন?”

-” যতদিন পর্যন্ত এই অপয়া অলক্ষী মেয়েটা আমার বাড়ি থাকবে, ততদিন আমি শান্ত হবো না। বাড়িতে শান্তি আসবে না। বুঝেছিস তুই?”

মামুনির একরোখা জবারে অরিশ ভাইয়া নীরবে সবকিছু সহ্য করার চেষ্টা করলো। কিয়ৎক্ষণ দম মেরে বসে থাকার পরে ফোন বের করে কাউকে একটা ফোন করলেন। বললেন,
-” কোথায় তুই অপু? ৫ মিনিটের মধ্যে বাড়ির সামনে আয়!”

ভাইয়ার কথার ধরন শুনে বুঝতে সক্ষম হলাম, এটা অপূর্ব ভাইয়া। স্পিকারে না থাকার কারণে ওপাশে মানুষটির প্রত্যুত্তর কি ছিলো, জানা হয়নি। অরিশ ভাইয়া এবার ঝাঁঝালো কন্ঠে বললেন,

-” তুই যদি এখন না আসতে পারিস, বলে দে! আমি তোর বোনকে নিয়ে বহুদূরে চলে যাচ্ছি। তুই চাইলেও খুঁজে পাবি না।”

বলেই ফোন রেখে দিল। শীতলতার মাঝেও তার ললাটে লবনাক্ত জলকণা। উপরের অধর চেপে চোখ গ্ৰথণ করে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছেন‌। ফুঁ দিয়ে নিজের চুলগুলো উড়িয়ে দিলেন। আমাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে শব্দ করে উপরে চলে গেলেন। মিনিট পাঁচেক পেরুবার আগেই ফিরে এলেন তিনি। দুহাতে দুটো লাকেজ। রাখলেন আমার সামনে।

অপূর্ব ভাইয়া প্রবেশ করেই বিচলিত হয়ে পড়লেন। ভাঙা স্বরে হাহাকার করে বললেন,-” কি হয়েছে অরি? কোনো সমস্যা হয়েছে? এভাবে ডাকলি কেন?”

অরিশ ভাইয়া টু শব্দটি করলেন না। হাতের তর্জনী আঙুল তুলে আমার দিকে ইশারা করলেন। মিনিট খানেক চেয়ে করলেন আমার দিকে। আমার এলোমেলো চুল, ফোলা ফোলা চোখ মুখ, আর্তনাদ। তিনি ছুটে এলেন আমার সম্মুখে। স্বযত্নে চোখ মুছিয়ে দিলে বললেন,

-” কি হয়েছে তোর? বল আমাকে?”

আমার কান্নার স্বর আড়ষ্ট হয়ে এলো। জড়িয়ে গেল গলা। হেঁচকি উঠে গেল। শব্দ উচ্চারণ করতে কষ্ট পেতে হচ্ছে। তিনি স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
-” যা! রাস্তায় গাড়ি রাখা আছে, ওখানে গিয়ে বস।”

অরিশ ভাইয়ার মুখশ্রীর দিকে অবলোকন করতে তিনিও সায় দিলেন। দ্বিমত পোষণ না করে ছোট ছোট চরণ দুটি ফেলে বেরিয়ে এলাম।

অপূর্ব তরীকে দরজার আড়াল হয়ে যেতে দেখে অনিতার দিকে ভয়ঙ্কর চাওনি দিলো। অনিমা অপূর্বের এই দৃষ্টি সাথে বেশ অপরিচিত। আগে সে ছিলো তারুণ্য, এখন অপূর্ব।
দাঁতের সাথে দাঁতের অদ্ভুত ঘর্ষণ সৃষ্টি করল। তার চোখ দুটি আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় ফুটছে। চোখ দুটি স্বাভাবিক তবুও তাকে ভয়ঙ্কর লাগছে। টেনে টেনে বললেন,
-” তুমি আমার মামুনি! মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের মতো করে মানুষ করেছ। তোমার কাছ থেকে ভালোবাসা আশা করা যায়, অত্যাচার নয়। আমার, আমার মায়ের দেওয়া আমানত তোমার কাছে রেখে গেছিলাম। কিন্তু তুমি যত্নে রাখতে পারলে না। তাই সাথে নিয়ে গেলাম। ভবিষ্যতে যাতে আর তোমাকে আমার বোনের আশে পাশে না দেখি। (অরিশের কাঁধে হাত রেখে)
তোর ইচ্ছে হলে দেখে আসিস। আসছি! পাগলিটা হয়তো কাঁদছে।”

বলেই লাকেজগুলো দুইহাতে নিয়ে নিল। কর্ণার তাকে রাখা সো পিচটা মাটিতে ফেলে দিল। দুই টুকরো হয়ে গেল। অপূর্ব প্রস্থান করলো। একটা তার মামুনির। নিজের পছন্দের জিনিস গুলো ভেঙে গেলে কতোটা কষ্ট হয় বুঝাতে চাইলো।
লাকেজ গুলো সে চাইলে ফেলে দিতে পারত, কিন্তু এগুলো তার বোনের পছন্দের। তাই সাথে করে নিয়ে গেল।
অরিশ শব্দ হীন উপরে চলে গেল। আরশি নিজের জিনিস পত্র নিয়ে প্রস্থান করলো। অনিমা সোফায় বসে পড়লেন। পিচ্ছিল ফ্লোর গড়িয়ে গড়িয়ে তার পায়ের কাছে এসে থামলো সো-পিচ টা। এক খন্ড হাতে তুলে নির্বাক হয়ে রইলেন। খুব পছন্দের। অপূর্ব তারুণ্য হলেও, সে অপূর্ব। কতো কতো মানুষকে খুন করেছে তার হিসেব নেই।
____________
অপূর্বের বাড়িতে এসে পৌঁছেছি আমরা। পুরো রাস্তা আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছে কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে। মাঝে মাঝেই ভেবে অবাক হয়ে যাই, এতো বড় একটা গ্যাং স্টার আমার জন্য সবকিছু করতে পারে। কিন্তু কেন?

আমাকে ফাঁকা একটা ঘরে বসে আছি। অপূর্ব ভাইয়া নিচে গেছে। রুমটা একদম পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ব্লু এন্ড ওয়ার্ট কালারের দেয়ার। জানালায় বিশাল বিশাল ধবধবে সাদা রঙের পর্দা টানা। ছোট বাচ্চাদের খেলনায় সাজানো। বেডের পাশ ঘেঁষে দুটো ফুলদানি। সাদা এবং লাল টুকটুকে দুটো গোলাপ। আমি যখন কক্ষ দেখতে ব্যস্ত তদানীং প্রবেশ ঘটলো কারো। পেছন ফিরে দেখলাম অপূর্ব ভাইয়া। হাতে তার খাবারের ট্রে। ট্রে টা সেন্টার টেবিলের উপর রাখলেন। আমাকে টেনে বসিয়ে দিলেন বেডে। ইলিশ মাছ আর আলু কুচি ফ্রাই। আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই খাবার মেখে খাইয়ে দিলেন আমায়। শেষ লোকমা মুখে দিয়ে বললেন,

-” কেমন লেগেছে খুকি? পছন্দ হয়েছে এই ঘরটা?”

-” জ্বি খুব ভালো! এই ঘরটা একদম আমার মনের মতো, আর খাবারটাও টেস্টি!

-” তাই বুঝি!”

নাক টেনে বললেন তিনি। আমি মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেই রুমের আলো নিভিয়ে দিলেন তিনি। হাতে দুটো ট্যাবলেট আর পানি খেতে দিল। বালিশ ঠিক করে বেডের উপর শুইয়ে দিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
নিরবতার মাঝে সময় পেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমি হারিয়ে গেলাম নিদ্রার অতলে।
চলবে

(চলবে.. ইনশাআল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here