অনুভূতি,পর্ব-১৪+১৫

অনুভূতি
পর্ব ১৪
মিশু মনি
.
২৩.
মেঘালয় আর বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। এবার ঘুমানো দরকার। জেগে থাকলে মাথায় ভূত চাপবে এসে।
কিন্তু ঘুমানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। কিছুতেই ঘুম আসছে না। বারবার চোখ খুলে যাচ্ছে আপনা আপনি। খুলে অন্যদিকে না তাকিয়ে সোজা মিশুর দিকে চলে যাচ্ছে। মিশুও বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে মেঘালয়ের দিকে। এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়? কেমন যেন অসহ্য লাগছে। একদিকে বুকের ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে নিজেকে নিয়ে ভয় হচ্ছে। একবার ইচ্ছে করছে মিশুকে ভালোবাসি বলতে, একবার মন সায় দিচ্ছে না। খুব খারাপ একটা অবস্থায় পড়ে গেছে মেঘালয়।
মেঘালয়ের হঠাৎ কি হলো নিজেই জানেনা। ঘোর ঘোর লাগছে বড্ড। ঘোরের মাঝেই মিশুকে জিজ্ঞেস করে বসলো, “আমি কি তোমার কোলে মাথা রেখে শুতে পারি?”
অদ্ভুত প্রস্তাব! এরকম প্রস্তাব জীবনেও কখনো শোনেনি মিশু। আর মেঘালয়ের মুখ থেকে এটা শুনছে সেটাও আশ্চর্যের ব্যাপার। কিন্তু না বলতে পারলো না। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “আচ্ছা।”
মেঘালয় অপ্রকৃতস্থের মত উঠে মিশুর সিটে গিয়ে বসলো। বেশ লম্বা সিট। অনায়াসে শোয়া যায়। যদিও সিটের উপরে বালিশ রাখা তবুও মেঘালয় মিশুর কোলেই মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। কোনোদিনো কেউ এভাবে কোলে মাথা রেখে শোয় নি, মিশুর কেমন যেন অপ্রস্তুত লাগছে।
মেঘালয়ের এখন একটু শান্তি লাগছে ভেতরে। মিশু আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মিশুর হাতের স্পর্শে ঘুম এসে যাচ্ছে। চোখ বুজতেই ঘুমিয়ে পড়লো মেঘালয়।
জোরে জোরে নিশ্বাস পড়ছে দেখে মিশুর বুঝতে অসুবিধা হলোনা যে মেঘ ঘুমিয়ে পড়েছে। ও আস্তে আস্তে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অনেক সুন্দর মেঘালয়ের চুলগুলো। যেমনি সিল্কি, তেমনি সুন্দর ঘ্রাণ! মিশুর হঠাৎ চোখ চলে গেলো মেঘালয়ের বুকের দিকে। শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা। সেখান দিয়ে ওর ফর্সা বুকে কিছু লোম উঁকি দিচ্ছে। এত সুন্দর লোভনীয় কারো বুক হতে পারে সেটা ভাবতেও পারছে না মিশু। কেমন ঘোরের মাঝে চলে যাচ্ছে। ছেলেদের বুকের লোম এত সুন্দর হয়? মেঘালয়ের হাতের লোমগুলোও ভারী সুন্দর দেখতে। মিশু একবার ওর হাতের দিকে তাকাচ্ছে, একবার বুকের দিকে তাকাচ্ছে। মাঝেমাঝে পলকহীন ভাবে ওর মুখের দিক তাকিয়ে থাকে। কেমন ঘোর ঘোর লাগে, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আর ওর মুখটা সবসময় ই হাসি হাসি জন্য একটা অন্যরকম স্নিগ্ধতা ছেঁয়ে থাকে। সত্যিই মেঘ অনেক বেশি সুন্দর!
ফ্যালফ্যাল করে ওর ঘুমন্ত মুখের দিয়ে চেয়ে চেয়ে নানান আঁকিবুঁকি স্বপ্ন দেখছে মিশু। নিজেও ঘুমিয়ে পড়তে ঘুম বেশি সময় লাগলো না। চেয়ে থাকতে থাকতে চোখ দুটো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
কতক্ষণ ঘুমালো বলতে পারেনা কেউ। ট্রেন স্টেশনে দাঁড়ানোর আগ মুহুর্তে ট্রেন থামার ধাক্কায় মিশুর মাথাটা ঢলে পড়ে গেলো মেঘালয়ের মুখের উপর। ঠক করে দুজনের কপালের সাথে কপাল লেগে একটা আওয়াজ হলো। আঁৎকে উঠে ঘুম ভেঙে গেলো মেঘালয়ের। মিশু নিচু হয়েই আছে। একদম কাছাকাছি চলে এসেছে দুটো মুখ। একে অপরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। এত কাছ থেকে কখনোই কোনো পুরুষের চোখ দেখেনি মিশু। হার্টবিট রকেট গতিতে ছোটার মত দ্রুত বেড়ে গেলো। ঘনঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো। দৃষ্টি যত গভীর হচ্ছে হার্টবিট তত বেশি বাড়ছে। মিশুর সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মেঘালয়ের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। এ কেমন অনুভূতি! মিশু ওর মুখের কাছে ঝুঁকে চোখে চোখ রেখে চেয়ে আছে। মাথা তুলতেই ভূলে গেছে কিছুক্ষণের জন্য। এভাবে কতক্ষণ সময় অতিবাহিত হয়ে গেলো বোঝা গেলো না। মিশু মেঘের চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকিয়ে আছে, আর মেঘ ও। দৃষ্টির গভীরতা বাড়ছে, যেন একে অপরের ভেতরটাও পরিষ্কার বুঝতে পারছে। মিশু অনুধাবন করতে পারছে মেঘের ভেতরে কি তুমুল ঝড় চলছে। ও ধীরেধীরে একদম ঝুঁকে পড়লো মেঘের মুখের কাছে। দুজনের নাকের সাথে নাক লেগে গেলো। ঘোরের মধ্যে চলে গেছে দুজনেই। মেঘালয় মিশুর মাথাটা চেপে ধরে ওর ঠোঁট স্পর্শ করলো।
কেঁপে উঠলো মিশু। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। বুক ফেটে কান্না এসে যাচ্ছে ওর। এটা কি হয়ে গেলো? চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। মেঘালয় মিশুর মাথাটা ছেড়ে দিতেই ও সোজা হয়ে বসলো। কিন্তু চোখ খুলতে পারলো না। মেঘালয় ও উঠে ওর পাশে বসে বিভ্রান্তের মত ভাবতে লাগলো শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে ও? মিশুর কোলে মাথা রেখে শুয়েছে কখন? ও তো পাশের সিটে বসে ছিলো। এখানে কখন আর কিভাবেই বা এলো? কি থেকে কি হয়ে গেলো মাথায় ঢুকছে না।
মিশুর দিকে তাকিয়ে দেখলো ও একদম সোজা হয়ে বসে আছে। চোখ বন্ধ কিন্তু দুই গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে মেঘালয়ের। মেয়েটাকে শেষ পর্যন্ত কষ্ট দিয়ে ফেললো? ওর জন্য এতকিছু ভেবেও শেষ রক্ষা হলো না? মেয়েটা যে বড্ড ইনোসেন্ট, ওকে কিভাবে কি বোঝাবে মেঘালয়? মাথায় কিছুই আসছে না।
মেঘ একবার ডাকলো, “মিশু।”
মিশু চোখ খুললো না। নিচের ঠোঁট দাঁত দিয়ে চেপে ধরলো আর কান্নার গতিটা আরো বেড়ে গেলো। মেঘালয় আবারো বললো, “মিশু, আমি সরি।”
মিশু কোনো সাড়াশব্দ নেই। মেঘালয় কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। নিজের মাথার চুল নিজেরই টেনে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। তবুও হয়ত রাগ কমবে না।
মেঘালয় আরেকবার বললো, “মিশু সরি, বুঝতে পারিনি এমন হবে। তুমি প্লিজ…”
আর কিছু বলতে পারলো না।মিশু ওর বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠলো। দুহাতে খামচে ধরলো মেঘালয়ের শার্ট। ওর কান্নার গতি যত বাড়ছে, হাতের শক্তিও যেন তত বাড়ছে। দুহাতে গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে মেঘালয়ের বুকে খামচে ধরছে ও। মেঘালয়ের খুব লাগছে কিন্তু টু শব্দটিও করলো না। মিশুকে ছুঁয়ে ও দেখলো না। মিশু একাই ওর বুকে মাথা রেখে অঝোরে কেঁদে চলেছে আর সমানে খামচে যাচ্ছে ওর বুক আর গলা। হাতটা উপরে তুলে গলায় কতগুলা যে খামচি দিলো কোনো হিসেব নেই। গলা থেকে কাঁধে, ঘাড়েও অজস্র আচড় দিয়ে তারপর ক্ষান্ত হয়ে ওর গলা জরিয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
যেসব জায়গায় ও খামচি দিয়েছে কয়েক জায়গায় বোধহয় ক্ষত হয়ে গেছে। জ্বালা করছে অনেক। তবুও কোনো শব্দ করলো না মেঘ। এমনকি একটু নড়লো ও না। মিশু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে একসময় সেটাও থেমে গেলো। স্তব্ধ হয়ে রইলো একদম। মেঘালয় নিজেও স্তব্ধ। নিশ্বাস পড়ছে খুবই আস্তে। মিশুর কান্না থেমেছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। চোখের পানিতে বুক ভিজে একাকার হয়ে গেছে। মিশুর কোনো নড়াচড়া নেই। মেঘালয় ডাকতে গিয়েও গলায় জোর পাচ্ছেনা। চুপ করে রইল একদম, যতক্ষণ খুশি এভাবেই থাকুক মেয়েটা।
বেশ কিছুক্ষণ পর হাতটা মেঘের গলা থেকে সরিয়ে সামনে নিয়ে এলো মিশু। চোখ মুছলো এক হাতে। তারপর উঠে বসলো। দুহাতে বারকয়েক চোখ ও গাল মুছলো। তারপর একবার আড়চোখে মেঘালয়ের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। মিশু আচমকা ওর গলা টিপে ধরে বললো, “খুন করে ফেলবো, খুন করে ফেলবো। এভাবে তাকান কেন? মেরে ফেলবো আপনাকে।”
মেঘালয় অনেক চেষ্টা করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দুহাতে মিশুর মুখটা ধরে ফেললো। মিশু চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। চোখে পানি। মেঘালয় এক হাতে মুছে দিয়ে আলতো করে ওর মুখটা ধরলো দুহাত দিয়ে। তারপর খুব নরম গলায় বললো, “বিয়ে করবা আমায়?”
২৪.
খুব তাড়াতাড়ি ই বিছানা ছেড়ে নিচে নামলো দুপুর ও অরণ্য। দুজনের মাঝে এখন অনেকটাই সহজ ভাব চলে এসেছে। দুপুর ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে চুল আড়চাচ্ছে। হঠাৎ বাথরুমের খোলা দরজার দিকে চোখ চলে যাওয়ায় দেখলো অরণ্য ওর ব্রাশ টা দিয়েই দাঁত মাজছে। আশ্চর্য হওয়ার মত ব্যাপার! একজনের ব্রাশ অন্যজন কখনো ব্যবহার করে?
ছুটে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে দুপুর বললো, “আপনি আমার ব্রাশ নিয়েছেন কেন? আপনার ব্রাশ নেই?”
– “নাহ নেই।”
– “আপনার গায়ে হলুদের তত্ত্বের সাথে ব্রাশ পাঠিয়েছিলো আমাদের বাড়ি থেকে। সেটা কি করেছেন?”
– “জানিনা, কোথায় যে রেখেছে।”
– “আপনার আগে ব্রাশ ছিলোনা? সেটা?”
– “হারিয়ে গেছে।”
– “বিয়েতে আপনাকে নতুন ব্রাশ কিনে দেয়নি?”
– “না, দেয়নি।”
দুপুর বিরক্ত হয়ে বললো, “সেজন্য আপনি আমার ব্রাশ ব্যবহার করবেন?”
– “হুম, এ যাবত চারবার এটা দিয়েই দাঁত মেজেছি। তুমি ব্রাশ করার পর।”
– “ছি, এটা কেমন বিশ্রী ব্যাপার।”
– “বিশ্রী মনে হবে কেন? যদি একটা ব্রাশই দুজনে শেয়ার করতে না পারি তাহলে কিসের স্বামী স্ত্রী?”
প্রশ্নটা যথাযথ ছিলো। এর কোনো উত্তর দুপুরের জানা নেই। নিখিলের সাথে কথা হয়েছিলো, বিয়ের পর দুজনের একটাই ব্রাশ থাকবে। অরণ্য’র ক্ষেত্রে এর উলটা হবে কেন?
ও আর কিছু না বলে সেখান থেকে চলে এলো।
শাড়ি বদলে সুন্দর একটা শাড়ি পড়ে নিলো। চোখে কাজল ও কপালে একটা কালো টিপ দিলো। অরণ্য বাইরে আসার পর কেউ কারো সাথে কোনো কথাই বললো না।
আজ বাসায় তেমন কোনো কাজ নেই। বিয়েতে আসা অতিথি রা সবাই চলে যাচ্ছেন। সকালের নাস্তা খাওয়ার পর ব্যাগ গুছিয়ে নিতে আরম্ভ করলো ওরা। অরণ্য নিজেই ব্যাগ গুছাচ্ছে আর দুপুর বসে আছে। একটুও দেরি করতে চায়না ছেলেটা। ব্যাগ গুছানো শেষ হতেই দুপুরকে রেডি হতে বলে সে বাবাকে বলতে গেলো যে এখনি বেড়িয়ে পড়তে চায়। দুপুর থতমত খেয়ে রেডি হতে লাগলো। ছেলেটার সবকিছু তে এত চঞ্চলতা কেন বোঝেনা ও। মাঝেমাঝে খুব বিরক্ত লাগে ওকে। কিছু বলাও যায়না।
রেডি হতে হতে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠলো দুপুরের। এখন একটা লম্বা জার্নি দেয়া হবে। সুন্দর করে সেজেগুজে বসে রইলো। অরণ্য আসলেই বেড়িয়ে পড়তে হবে।
এমন সময় দুপুরের ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো নিখিলের নাম্বার থেকে কল। বুকটা কেমন ধক করে উঠলো ওর।
চলবে..

অনুভূতি
পর্ব ১৫
মিশু মনি
.
২৫.
-“বিয়ে করবা আমায়?”
নিঃসংকোচ প্রস্তাব! কোনো কথাবার্তা ছাড়াই কেউ এভাবে বিয়ে করতে বললে সত্যিই আশ্চর্য হতেই হয়। তার উপর মেঘালয়ের মত একজন মানুষ এ কথা বলছে এটাও অবিশ্বাস্য। ঢোক গিলে মিশু তাকিয়ে রইলো ওর দিকে।
মেঘালয় খুব নরম গলায় বললো, “আমাকে বিশ্বাস করতে পারো?”
– “হুম পারি। কিন্তু আপনি কেন এরকম প্রস্তাব দিচ্ছেন আমি বুঝতে পারছি না।”
মেঘালয় একটু নড়ে বসলো। তারপর মিশুর মুখোমুখি হয়ে বসে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমাকে কতদিন ধরে চেনো তুমি? প্রথম দেখা কোথায় হয়েছিলো?”
– “রাস্তায়, বৃষ্টির দিনে। আপনার রেইনকোট চেয়ে নিয়েছিলাম আমি।”
মেঘালয় বললো, “এটাই পয়েন্ট। তুমি যখন আচমকা এসে বললে, ‘আপনার রেইনকোট টা একটু দেবেন? আমার বৃষ্টি সহ্য হয়না’ কথাটা চুড়ির মিষ্টি রিনিঝিনির মত এখনো কানে বাজে আমার। আমি একদম অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়েছিলাম তোমার দিকে। তুমি ব্যস্ত হয়ে বারবার চাইলে, আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম তোমার আচরণে। বিশ্বাস করো, সেদিন ই অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করতে শুরু করে ছিলো। তারপর তোমার শপে গিয়ে যখন তোমাকে কষ্ট করে ডিউটি করতে দেখি,বুকের ভেতরে কেমন কষ্ট অনুভূত হচ্ছিলো। তোমার জন্য কিছু করার ইচ্ছে অনুভব করছিলাম।”
মিশু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। বললো, “তারপর?”
মেঘালয় বললো, “আমি সেদিন রাতেই অনেক জায়গায় ফোন দিয়ে কথা বলে রেখেছিলাম তোমার চাকরীর জন্য। মাঝরাতে তোমাকে রাস্তায় ছুটতে দেখে গিয়ে যখন বাইকে তুললাম, কেবলই মনে হচ্ছিলো তোমার জন্য একমাত্র ভরসার হাতটা হয়ত আমার ই। তখন বুঝিনি ধীরেধীরে তোমার প্রতি একটু একটু করে মায়া বাড়ছে আমার। এই মায়াটার নামই হয়ত ভালোবাসা।”
মিশু মুগ্ধ হয়ে শুনছে। ভালো লাগছে ওর। মেঘালয় সেইদিন থেকেই ওকে নিয়ে এত ভাবে ব্যাপার টা ভালো লাগার মত। কিন্তু কিছু না ভেবেই প্রশ্ন করে বসলো, “আপনি দেখতে অনেক সুন্দর, আমার মত কুৎসিত একটা মেয়ের মাঝে কি পেলেন শুনি?”
মেঘালয় মিশুর দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে হাসলো। তারপর বললো, “তুমি মোটেও কুৎসিত নও। তোমার দেহের গাঁথুনি একদম আকর্ষণীয়,যদি ঠিকঠাক কেয়ার করতে পারো তবে আর দু তিন বছর পর তোমার চেহারা দেখলে যে কোনো পুরুষের রাতের ঘুম হারাম হবে।”
মিশু লজ্জায় নীল হয়ে গেলো একেবারে। এসব আবার কেমন কথা! লজ্জায় মাথাই তুলতে পারছে না। মাথা নিচু করেই বললো, “আমার দেহের গাঁথুনি মানে! আপনি এসবের দিকেও নজর দেন?”
– “উহু, রাগ করোনা। তুমি নিজেকে কুৎসিত বললা সে জন্যই বললাম। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, যদি টানা ছয় মাস আসন করো, তুমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ছেলেরা একবার তাকাতে বাধ্য।”
– “বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। ছি, এসব… ”
মিশু লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে একদম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো ও। ওর লজ্জানত মুখের দিকে তাকিয়ে মেঘালয় বললো, “এটা গেলো দৈহিক সৌন্দর্য, আর মানসিক সৌন্দর্যের কথা বলতে গেলে বলবো, তোমার রুচিবোধ অনেক উন্নতমানের। আর তোমার মাঝে একটা ইনোসেন্ট ভাব আছে, তুমি নিজের ইচ্ছেকে সবসময় প্রায়োরিটি দাও। কাজের পরিণতি নিয়ে ভাবো না। ব্যাপার টা ভালো লাগে আমার।”
মিশু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো, “আমাকে নিয়ে এতকিছু গবেষণা করা হয়ে গেছে আপনার?”
মেঘালয় মধুর ভঙ্গিতে হাসলো। এরকম করে মিশুকে বলতে পেরেছে দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে। সাধারণত এরকম কথাবার্তা কাউকে বলে না ও, সবার সাথে সবকিছু শেয়ার করতেও পারেনা। সত্যিই মিশু অনেক আপন হয়ে গেছে, যার দরুন অনায়াসে ওকে এসব বলা যাচ্ছে।
মেঘালয় বললো, “কি হলো মিশু? কিছু বলবে না?”
মিশু ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, “যা যা বললেন সব সত্যিই?”
– “হুম সত্যি। আমি কিছুতেই আর তোমাকে দূরে রাখতে পারছি না, আমরা বিয়ে করে ফেলবো।”
– “সরাসরি বিয়ে?”
– “হুম বিয়ে। তারপর চুটিয়ে প্রেম করবো।”
মিশু উঠে দাঁড়িয়ে এসে মেঘালয়ের সামনে দাঁড়ালো। তারপর ওর চোখের দিকে চোখ রেখে বললো, “আপনি কি সিরিয়াস?”
– “হুম একদম সিরিয়াস। আমি এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিলাম আমি কাল পরশুর মধ্যেই তোমাকে বিয়ে করবো।”
– “কিহ! এত দ্রুত? কিভাবে সম্ভব এটা?”
চোখ দুটো স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড় আকার ধারণ করেছে মিশুর। সবই কেমন স্বপ্নের মত লাগছে। মেঘালয় ঠিক আছে তো?
মেঘ বললো, “তুমি করতে পারবা কিনা সেটা বলো?”
– “আচমকা বিয়ের কথা শুনে আমার মুখ এমনিতেই হা হয়ে গেছে,তার উপর কাল পরশুর মধ্যে বিয়ে হবে শুনে আর গলা দিয়ে শব্দই বের হচ্ছে না।”
মেঘালয় হেসে বললো, “শুধুমাত্র কথার উপর নির্ভর করে আজকাল বিশ্বাস করা যায়না। এজন্যই বিয়ে করে ফেললে তোমার তো আর ভয় থাকবে না। বিয়ে করে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে তোমাকে রেখে দিবো, সেখানে থেকে পড়াশোনা করবা। সময় হলে বাসায় জানাবো আমি।”
মিশুর মাথা ঘুরছে। এই ছেলেটা এলিয়েনের মতন দুম করে নেমে এসে এসব কি বলছে? আকাশ থেকে নেমে আসেনি তো?
মেঘালয় উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছে। মিশু একটু ভেবে বেশ জোড়ালো ভঙ্গিতে জবাব দিলো, “এত তাড়াতাড়ি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়াটা কি ঠিক? দুজন দুজনকে জানার অনেক বাকি, একসাথে বাকি জীবন থাকতে পারবো কিনা সবই তো বুঝতে হবে। তারপর না হয় বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। এজন্য অনেক সময় দরকার।”
মেঘালয় একটু নিশ্চুপ হয়ে ভাবলো। মিশু যা বলেছে সবই সত্য। কিন্তু মিশুর জন্য যেটুকু জানে,এর বেশি কিছু জানার প্রয়োজন মনে করছে না ও। মিশুকে এভাবেই ভালোবাসতে, বিয়ে করতে আর সারাজীবন আগলে রাখতে ওর কোনো সমস্যাই হবেনা। কিন্তু মেঘালয়ের সম্পর্কে জানতে মিশুর হয়ত একটু সময়ের প্রয়োজন।
ও বললো, “তুমি এখন কি চাইছো? সময় নিতে?”
মিশু দুম করেই বললো, “আমার খুব বিয়ে নামক পাগলামি টা করতে ইচ্ছে করছে।”
– “সিরিয়াসলি?”
– “হুম, আমার তো আর কেউ নেই। একটা ছোট্ট ঘর,আর ঘরভর্তি ভালোবাসা থাকলে ব্যাপার টা মন্দ হয়না।”
বলেই হাসলো। মেঘালয় ওর গাল টেনে দিয়ে বললো, “ওরে আমার দুষ্টু টা রে। বিয়ে করার এত ইচ্ছে? অনেক যন্ত্রণা সইতে হবে কিন্তু।”
– “কি যন্ত্রণা?”
– “প্রচণ্ড জ্বালাবো, একটা রাতও ঘুমাতে দিবো না।”
– “সারা রাত কি রাস্তায় হাঁটবেন?”
– “হ্যা, হাঁটবো, ঘুরবো, আর বিয়ের পর বর কনেরা যা যা করে আর কি।”
– “কি কি করে?”
মিশু হা করে মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলো। পরক্ষণেই আবার নিজেই লজ্জায় কুকড়ে যেতে লাগলো। অনেক্ষণ লজ্জানত হয়ে মাথা নিচু করে মেঘালয়ের পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। খুব সুন্দর পা দুটো ওর। তারপর হঠাৎ মুখ টিপে বললো, “একটা জিনিস দেখবো তারপর বিয়েতে মত দিবো।”
মেঘালয় ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো, “কি জিনিস?”
– “শার্ট খুলুন।”
– “মানে!”
চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো মেঘালয়ের। শার্ট খুলবো মানে কি?
মিশু নির্লজ্জের মত বললো, “আপনার রোমশ বুকটা একবার দেখবো। ওখানে বাস করতে পারবো কিনা না দেখে কিভাবে বিয়ে করি?”
মেঘালয় হতভম্ব! এ কেমন অত্যাচার? আজ অব্দি জগতে কোনো মেয়ে পাত্রের জামা খুলে বডি দেখতে চেয়েছে নাকি? আজব মাইরি।
ও আস্তে আস্তে সব বোতাম খুলে শার্টটা খুলে ফেললো। একান্তই নির্জনে এভাবে মেঘালয়ের প্রশস্ত বুকটা দেখতে পেয়ে লজ্জায় গাল লাল হতে শুরু করেছে মিশুর। অন্যদিকে একটা ভালোলাগায় বিভোর হয়ে রইলো ও। ফর্সা বুকে ঘন ঘন লোম দেখে একবার নাক ডুবাতে ইচ্ছে করছে। আর গলার দিকে এতবেশি সুন্দর যা দেখলে শরীরে শিহরণ বয়ে যায়। একটা ছেলের গলা এত সুন্দর হতে পারে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি মিশু। মেঘালয়ের কাঁধ, গলা সত্যিই ভয়ংকর সুন্দর! একদম খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। মিশুর ইচ্ছে করছে ওর ভেজা পা একবার দেখতে। কিন্তু সেটা সবচেয়ে নির্লজ্জ ব্যাপার হয়ে যাবে, থাক ওসব বলা যাবেনা।
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “আরো কিছু দেখাবো?”
মিশু জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললো, “না না। আমি আর কিছু দেখবো না।”
মেঘালয় শব্দ করে হেসে উঠলো। কি পরিমাণ ইনোসেন্ট হলে এভাবে শার্ট খুলতে বলা যায়? মেঘালয়ের জায়গায় অন্য কোনো ছেলে থাকলে আজকে মিশুর এই হাসিমাখা সুন্দর মুখটা আর থাকতো না। কয়জন ছেলেই বা আজকাল বিশ্বাসযোগ্য আছে? মেঘালয় নিজেই কন্ট্রোল হারাতে বসেছিলো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ও। যা হয়েছে ভেবে আর কি হবে, বিয়েটা তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। বাচ্চাটাকে বুকে চেপে ধরতে না পারলে শান্তি হচ্ছেনা কিছুতেই।
মিশু জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছেন?”
– “এখানে নাক ডুবিয়ে শরীরের গন্ধ নিবা না?”
মেঘালয় নিজের বুকের দিকে দেখিয়ে এ কথা বলেছে। মিশুর পুরো শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। ছেলেটাকে যতটা ভালো মনেহয়,ততটা নয়। দুষ্টুও আছে। ইচ্ছেটা হচ্ছিলো ঠিকই, কিন্তু ইচ্ছে হলেই তো আর করা যায়না। ভাবতে ভাবতে মিশু এগিয়ে এসে সত্যিই ওর বুকে মাথা রাখলো। মানব মন বড়ই অদ্ভুত, মেয়েদের মন আরো বেশি অদ্ভুত। মেয়েরা যা ভাবে,তা করেনা। আর যা করে, তা ভাবেনা।
২৬.
রৌদ্রময়ী কোথায় যাবে নিজের ও অজানা। কোনো গন্তব্য নেই ওর। কিন্তু এরকম বিয়ের সাজে কতক্ষণ ই বা থাকা যায়? লোকজন তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। মাত্র কিছু টাকা আছে, সেটা নিয়ে কোনো ড্রেস কিনে নষ্ট করে ফেলা যাবেনা। যেকোনো মুহুর্তে টাকাটা লাগতে পারে।
এসব ভাবছে আর হাঁটছে রোদ। শরীর টা টলছে ওর। একদিকে খুব খিদে পেয়েছে,অন্যদিকে একটানা কয়েক ঘন্টা ধরে কাঁদছে। আর শরীর চলছে না, কিছু খেয়ে নেয়া দরকার। কিন্তু খাওয়ার রুচি টুকুও নেই। যশোর স্টেশন থেকে বেড়িয়ে এদিক সেদিক ঘুরছে ও। মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠলো। ধপ করে পড়ে গেলো মাটিতে।
নিখিল এখানে বোনের বাসায় বেড়াতে এসেছিলো। দুপুরের হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে সারারাত বাইরে বাইরে ঘুরছিলো। শেষরাতে ও ফুটপাত ধরে হাঁটছে আর সিগারেট টানছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। বুক ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। এমন সময় রাস্তায় একটা কনের সাজে পড়ে থাকা মেয়েকে দেখে থমকে দাঁড়ালো সে। এখনো ভোর হতে অনেক বাকি। এত রাতে রাস্তায় একটা মেয়ে এভাবে পড়ে আছে কেন! তাও আবার বিয়ের সাজে।
ছুটে গিয়ে মেয়েটিকে সোজা করে দিতেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো নিখিলের। এটা তো রোদ! রোদ এখানে এভাবে পড়ে আছে? এই মেয়ে পালিয়ে যাওয়ার কারণে নিখিল তার প্রিয়তমাকে হারিয়েছে। এখন রাস্তায় পড়ে থাকা কি কারণে? নিখিলের রাগে শরীর গর্জে উঠছে। আজকে রোদের কপালে চরম দুঃখ আছে। যে যন্ত্রণা টা ও নিখিলকে দিয়েছে সেটার পরিমাপ অনুযায়ী আজকে কষ্ট পাবে ও। নিখিলের যে কি ইচ্ছে করছে,রাগে ফুঁসছে ও। এই মুহুর্তে রোদের ওর সামনে পড়ে একদম ঠিক কাজটাই হয়েছে। আজ ওকে ইচ্ছেমত কয়েকটা থাপ্পড় লাগাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু মেয়েদেরকে খুব সম্মান করে নিখিল তাই কিছু বলতে পারবে না হয়ত।
স্টেশনের দিক থেকে একটা রিক্সা ডেকে এনে সেটায় রোদকে তুলে নিলো নিখিল। তারপর শক্ত করে ধরে রইল। রিক্সাওয়ালাকে বাসার ঠিকানা জানিয়ে দিলো। আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ। সুন্দর জোৎস্না ছড়িয়েছে চারিদিকে। বেহুশ হয়ে পড়ে থাকা রোদের মুখের দিকে তাকিয়ে এক ধরণের মায়া অনুভব করলো নিখিল। মেয়েটাকে খুব অসহায় দেখাচ্ছে। একটু সুস্থ স্বাভাবিক হোক,ওর কাছে পালানোর আসল ঘটনাটা জেনে নিতে হবে। কোনো একটা বড় কারণ নিশ্চয় ই আছে। নয়ত রোদের মত মেয়ে বাসা থেকে কখনোই পালাবে না।
বোনের বাসায় পৌছে ধরাধরি করে রিক্সা থেকে নামালো রোদকে। দরজায় নক করতেই আপু এসে খুলে দিয়ে হা করে চেয়ে রইলো। বললো, “কিরে নিখিল। সারারাত বাইরে ছিলি এখন আবার একটা মেয়েকে নিয়ে ফিরলি। তাও আবার অজ্ঞান! বিয়ে বাড়ি থেকে তুলে এনেছিস নাকি?”
– “আপু,তোকে পরে সব বলছি। আগে একে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে একটু সেবা যত্ন কর।”
নিখিলের বড় বোন যথেষ্ট আন্তরিক আর খুবই ভালো একটা মেয়ে। ও রোদকে ভেতরে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে সেবা যত্ন করতে লাগলো।
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here