#অনুভূতির_অন্বেষণ
#চন্দ্রিকা_চক্রবর্তী
#পর্বঃ১৫
(৪৭)
শোয়েব রহমান আজকে বাসায় আসবেন। প্রায় দীর্ঘ পাঁচ মাস পরে আসছেন। সেই কারণেই খুশির অন্ত নেই উনার দুই মেয়ে আর স্ত্রীর মনে। আজকে বিকেলে উনার আসার কথা। পারভীন সুলতানা আগেই রেণু আক্তারকে বলে রেখেছিলেন শোয়েব রহমান যখন আসবে তখন যাতে উনাকে জানানো হয় সেই ব্যাপারে। তাই দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে ইশরাত গেল সাদমানের বাসার উদ্দেশ্যে। কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুললো স্বয়ং সাদমান। ইশরাতকে দেখে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে সে।
—-এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন আমার দিকে? মনে হচ্ছে চোর ডাকাত দেখছেন? দেখি সরুন সামনে থেকে। ভেতরে যাওয়ার জন্য তো বলছেই না, উল্টো খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছে!
—-এই আমি খাম্বা?
—-শুধু খাম্বা না, আপনি হাম্বা!
—-হাম্বা আবার কী?
—-যারা হাম্বা হাম্বা বলে ডাকে তারা, মানে বলদ!
সাদমানকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল ইশরাত। মুখ হা করে সেদিকে তাকিয়ে আছে সাদমান। এই তো কয়েকদিন আগেই মেয়েটা কতো নম্র ভদ্র হয়ে কথা বলতো, কতোটা সমীহ করে চলতো তাকে। আর এখন? তাকে মুখের উপর বলদ বলে দিলো! এতো বড় অপমান! মেয়েটা কী তবে এখন তাকে একটুও ভয় পায় না? হায় হায়! এমনটা হলে তো সর্বনাশ! এখনও বয়সের তুলনায় যথেষ্ট ছোট। এখনই এরকম হলে ভবিষ্যতে তাকে সামলাতে তো হিমশিম খেতে হবে!
এটা সেটা ভাবতে ভাবতে দরজা বন্ধ করে মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভেতরে গেল সাদমান। গিয়ে দেখলো তার আম্মুর সাথে কথা বলছে ইশরাত। তার আব্বুও বাসায় আছে। যেহেতু আজকে শুক্রবার, তাই সকলেই আছে। সাদমান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলো ইশরাতের কথা
—-ওহ, আমি আসলে জানতাম না আন্টি তোমরা যে জানো কথাটা।
—-হ্যাঁ, সাদমানই বলে দিয়েছে। সাদমানকে নাকী রেণু আপা জানিয়েছেন কথাটা।
—-আম্মু? কই আমাকে তো কিছু বলেনি। আমাকে তো উল্টো বললো তোমাদের জানিয়ে আসতে আজকে আব্বু যে আসছে।
কথাটা বলেই ইশরাতের মনে পড়লো সে নিজেই তো সাদমানকে সেদিন সকালে বলেছিলো তার আব্বু সামনের সপ্তাহে আসবে। অথচ এখন নিজেই ভুলে গেল। হয়তো সেদিন রাগের মাত্রা এতো বেশি ছিলো যে সব কথা গিলে ফেলেছিলো সে!
—-হয়তো খেয়াল নেই। আচ্ছা, এসেছিস ভালো হয়েছে। আজকে বন্ধের দিন। সবাই একসাথে আছি। চল দু’টো কথা বলি।
—-আন্টি, বলছিলাম কী, আমি আগামীকাল যদি তোমাদের সাথে কথা বলি তাহলে চলবে? রাতে আসবো না হয়? আসলে আব্বু আমার হাতের বানানো চিকেন মোমো আর ভেজিটেবল স্যুপ খেতে ভীষণ ভালোবাসে। ভেবেছিলাম সেগুলো এখন বানাবো আর কী। আব্বু আসলে খেতে দিবো। চলে আসবে হয়তো দুই-আড়াই ঘন্টার মধ্যে।
—-বাব্বাহ্! তুই এতোকিছু বানাতে পারিস?
—-পারি, পারি। সব পারি। শুধু একটু ইউটিউব দেখে নিতে হয় আর কী। হি হি!
ইশরাতের কথায় সাদমানের আব্বু আম্মু দু’জনেই হেসে উঠলেন। পারভীন সুলতানা বললেন
—-সে যাই হোক, করতে তো পারিস। তোকে তো এখনই বিয়ে দিয়ে দেওয়া যাবে। পাঁকা বুড়ি একটা হয়েছিস!
—-কষ্ট লাগে ভীষণ বুঝলে? তোমরা সবাই আমাকে চিনতে পারলে। শুধু আমার আম্মুটাই পারলো না। শুধু শুধু বকে আমাকে। জানো এবার বলেছে আব্বুকে বলবে যাতে আমাকে আব্বুর কাছে নিয়ে যায়? বা বিয়ে-শাদি দিয়ে যাতে স্বামীর উপর দায়িত্ব দিয়ে দিবে? বলো, আমি কী এতোটাই পঁচা?
পারভীন সুলতানা দ্রুত মাথা নেড়ে কিছু একটা বলতে নিবেন, তার আগেই সাদমানের কণ্ঠ কানে এলো সবার
—-কোনটা বেহুদা প্রশংসা আর কোনটা বাস্তবিক সত্য, সেটার ফারাক আসলে কয়জনই বা করতে পারে বলো আম্মু? নিজের প্রশংসা শুনলেই গা ভাসিয়ে দেয়। অথচ নিজের থেকে বড় গর্দভ যে পৃথিবীতে আর একটাও নেই, সেটা স্বীকার করতে রাজি হয় না। অকর্মণ্য হলেও নিজেকে নিজেই বাহবা দিয়ে উপরে তুলে নিয়ে যায়। এসব মানুষের সাথে কথা বলে লাভ আছে কোনো? তার চেয়ে বরং একটু আমার চুল টেনে দাও আলতো করে। তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি।
পারভীন সুলতানা মুখ হা করে একবার সাদমানের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার ইশরাতের দিকে। বেচারি ইশরাতের গাল, নাক এমনকি পুরো মুখ রাগে লাল হয়ে গিয়েছে। শুধু রাগ নয়, লজ্জাও করছে ভীষণ। নিজে তো অপমান করে করে, তার উপর এখন নিজের বাবা মায়ের সামনেও এভাবে অপমান করলো? রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ইশরাত দাঁত কিড়মিড় করে বললো
—-আন্টি, এতোদিন শুধু ভেবেছিলাম যে আব্বুকে বলবো এই ফ্ল্যাট ছাড়ার জন্য। তবে এবার ডিসিশন ফাইনাল।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাদমানকে একটা ধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল ইশরাত।
—-এটা কী হলো বাবু? কাজটা তুই ঠিক করিসনি।
আতিক হাসানও পারভীন সুলতানার কথায় সমর্থন জানালেন। শুধু মনে খুশিখুশি লাগছে সাদমানের। যখন তখনই অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে নিয়েছে বলে কথা!
(৪৮)
টেবিলে বসে খাবার শেষ করে পানির গ্লাসে চুমুক দিলেন শোয়েব রহমান।
—-মাশা-আল্লাহ! আমার আম্মু দু’জনের হাতের রান্না মুখে লেগে থাকার মতো! তবে খুব বেশিই খেয়ে ফেলেছি এখন। রাতে আর ভাত খেতে পারবো বলে মনে হয় না। এতোকিছু কখন রান্না করলি তোরা দু’জন?
—-পারবে, পারবে। তোমার জন্য তোমার মেয়েরা সব করতে পারবে। আমাকে তো চুলোর দুয়ারে যেতে পর্যন্ত দেয়নি। দু’বোন সব করেছে। বাপ সোহাগী মেয়ে কীনা দু’জন!
—-কী রে মিশু ইশু? কোথাও কী পোড়ার গন্ধ পাচ্ছিস তোরা আম্মু? আমি তো পাচ্ছি।
ইশরাত আর মিশরাত দু’জনেই হেসে উঠলো। তার সাথে কিঞ্চিৎ হাসলেন রেণু আক্তারও।
—-সত্যিই বলছি। মেয়ে দু’টো আব্বু বলতেই জান দিয়ে দেয়। আমার আর কী! আমাকে তো শুধু জ্বালাতন করার উপরই রাখে। তবে মিশু এখন তেমন একটা করে না। বরং কখনো কখনো নিজের মায়ের মতো আমাকে এবং আমাদের আগলে রাখে। অনেকটা বুঝদার হয়ে গিয়েছে তোমার এই মেয়ে। কিন্তু এই যে তোমার ছোট মেয়ে। আচ্ছা, এটা যখন আমার পেটে ছিলো, তখন কী এমন খেয়েছিলাম বলো তো? না মানে এভাবে শুধু তিড়িং বিড়িং করতে থাকে কেন? কতো কী কান্ড করে যে বসে তোমার এই মেয়ে জানো? এইতো কয়েকদিন আগের কথাই তো বলেছিলাম না তোমায়?
শোনো, আমি স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি। এই মেয়েকে কিছু বলে যাও, ঠিকভাবে যাতে চলাফেরা করে তা বুঝিয়ে যাও। এতোটা চঞ্চল হলে হয় নাকী? বয়স তো একেবারে কম না। আঠারো তে পড়লো বলে। আর না হয় এক কাজ করো। বিয়ে দিয়ে স্বামীর হাতে তুলে দাও। এরপর দেখবো আমি এই মা কে যতোটা জ্বালাতন করে ততোটা শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে জ্বালাতে পারে কীনা?
হেসে উঠলেন শোয়েব রহমান।
—-বড় মেয়ের বিয়ে না দিয়ে ছোট মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবে?
—-দরকার পড়লে তো দিতেই হবে। তুমি ছেলে খোঁজো। পেলেই দিয়ে দিবো ধরে বেঁধে এর বিয়ে।
—-আমার ছোট আম্মুর জন্য ছেলে খুঁজতে কোনো সমস্যা হবে না। তবে কথাটা ভেবে চিন্তে বলো কিন্তু! আসলেই দিয়ে দিবে ছোট মেয়ের বিয়ে?
শোয়েব রহমানের কথায় কেমন যেন একটা খটকা লাগলো রেণু আক্তারের। এতোটা নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে উনি ছেলে নিয়ে?
—-ভালোই। তোমরা তোমরা ছেলে ঠিক করে বিয়েও দিয়ে দিচ্ছো। বাহ্! চমৎকার! আব্বু, তোমাকে অন্তত আমি আমার পক্ষে পাবো ভেবেছিলাম। তুমিও আম্মুর সুরে তাল মেলাচ্ছো? আমাকে তাড়ানোর এতো তাড়া তোমাদের?
—-আরে ধুর! তোর আম্মুর টিমে আবার যায় কে? আমি তো তোর সাথেই ছিলাম, আছি আর থাকবো। আমার দুই মেয়ে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তাদের তাড়ানোর তাড়া থাকবে কেন আমার? আর তোর কথা যদি বিশেষভাবে বলি, তাহলে তোর তো আবার পরীক্ষা চলে। সামনে বোর্ড ফাইনাল। এখন তো বিয়ের প্রশ্নই আসে না। তবে মিশু আম্মুর জন্য আমি ছেলে খুঁজছি।
চিকেন লেগপিছে কামড় দিতে গিয়েও থেমে গেল মিশরাত। এতোক্ষণ যাবত বিনাবাক্যে সকলের কথা শুনছিলো হাসিমুখে। কিন্তু কেন জানি এই কথাটা শুনে তার মুখের হাসি উবে গেল। লেগপিছ প্লেটে রেখে মাথা নিচু করে বসে রইলো।
—-আম্মু?
শোয়েব রহমানের কন্ঠ শুনে মাথা উঁচু করলো মিশরাত।
—-তুই বিয়ে করতে চাস না এখন?
—-না আব্বু, এমন কিছু না।
—-তোর নিজস্ব কোনো পছন্দ আছে?
—-না আব্বু। আমার কোনো পছন্দ নেই। তোমরা যা বলো তাই হবে।
—-বেশ, তবে বিয়েটা সত্যিই এখন করতে চাস তো?
—-বললাম তো আব্বু। আমার কোনোকিছুই বলার নেই এই ব্যাপারে। তোমরা যা ভালো বোঝো তাই।
—-আব্বুর কাছে কখনো কিছু বলতে দ্বিধাবোধ করবি না। সত্যি করে বল, এখন বিয়ে করতে চাস না? আর বছর দুয়েক পরে ধরবো?
—-মিশু, তোর আব্বু কিন্তু সবটা বুঝে শুনেই বলছে কথাটা। দেখ আম্মু, তোর এখন বয়স প্রায় পঁচিশ। পড়াশোনা শেষ করেই চাকরী পেয়ে গিয়েছিস আলহামদুলিল্লাহ! কিন্তু মেয়েদের তো একটা নির্দিষ্ট বিয়ের বয়সও আছে বল। আর ছেলে দেখা মানেই তো বিয়ে হয়ে যাওয়া না। দশটা দেখে আমরা একটা নিয়ে ভাববো। তাই ছেলে দেখতেও তো সময় লাগবে।
—-আম্মু, আমার কোনো সমস্যা নেই। সত্যি বলছি। তোমরা ছেলে দেখতে পারো।
(৪৯)
—-আপু, তুই ঘুমিয়ে পড়, আমি একটু রাত জেগে পড়বো।
—-কালকে সকালে কলেজ যাওয়া লাগবে না?
—-না আপু, আজকেই শেষ ছিলো। এখন শুধু পরীক্ষার জন্য পড়তে হবে। ডেইট তো দিয়েই দিয়েছে।
ইশরাতের সাথে কথা বলে বিছানায় শুয়ে থাকা অবস্থায়ই অপর পাশে ফিরলো মিশরাত। চোখ বন্ধ করতে নিয়েছিলো কেবল৷ এরমধ্যেই ফোন বাজলো। ফোন হাতে না নিয়েই মিশরাত বুঝতে পারলো কে ফোন করছে। কারণ আজকে সকাল থেকে এই নাম্বার একাধিকবার ফোন দিয়েছে। হ্যাঁ, আরিয়ানের নাম্বার থেকে ফোন আসছে ক্রমাগত।
বেশ কয়েকবার নাম্বারটা ব্লক লিস্টে ফেলতে গিয়েও কোথায় জানি বাঁধা পাচ্ছিলো মিশরাত। ফলশ্রুতিতে প্রত্যেকবার ফোন কেটেই ক্ষান্ত হতে হচ্ছে তাকে।
—-আপু, ফোন কে করছে বারেবারে? ধরছিস না কেন?
—-কেউ না, তুই মনোযোগ দিয়ে পড়। এতো কিছু কানে গেলে পড়া হয় কী করে?
ফোন বন্ধ করে দিলো মিশরাত। ল্যাম্পসেডের দিকে তাকালো সে। ফিরে গেল আবারও সেই অতীতে
***
—-মিশরাত, তোমার সাহায্য লাগবে আমার। করবে আমার সাহায্য?
বাড়ির পেছন দিকে ইশতিয়াক সাথে দেখা করতে বলেছিলো মিশরাতকে। সে অনুযায়ী মিশরাত গিয়েছেও। ইশতিয়াকের সাথে তার এর আগেও কয়েকবার কথাবার্তা হয়েছে। বেশ খোশমেজাজের মানুষ। প্রাণ খুলে কথা বলতে জানে, হাসতে জানে, হাসাতেও জানে। বেশ ভালোই লাগে মিশরাতের এই মানুষটাকে।
—-বলুন না ভাইয়া?
—-আসলে… তোমাকে কীভাবে বলি তাও বুঝতে পারছি না। আবার তোমাকে না বললে কাকে বলবো তাও খুঁজে পাচ্ছি না। তোমার সাথেই তো মোটামুটি সখ্যতা আছে হক পরিবারের।
—-ভাইয়া, ঘুড়িয়ে প্যাঁচিয়ে না বলে বলুন কী বলবেন?
—-আমি…আমি নুজহাতকে আসলে…
—-আপনি নুজহাত আপুকে কী?
—-আমি নুজহাতকে পছন্দ করি মিশরাত। শুধু পছন্দ বললে হয়তো ভুল হবে। একটু বেশিই পছন্দ করি। আসলে তাকে খুব ভালো লাগে আমার। তাকে দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। তার সাথে কথা বললে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। আমি আসলে তাকে…
—-থামুন, থামুন। আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কী বলতে চাইছেন। আপনাদের ছেলেদের হাবভাবে বোঝা খুব মুশকিল। আরে বাবা আপুকে পছন্দ করেন সেটা সরাসরি বললেই তো হয়। এতো কথা টানার তো মানে দেখছি না। তাছাড়া আপনি তো কথাটা আপুকে বলছেন না। আমাকে বলছেন। তাহলে এতো নার্ভাস হওয়ার কী আছে?
—-বোঝো তাহলে এখন? নুজহাতের সামনে এই ব্যাপারে কিছু বলা দূরে থাক, তার সাথে সাধারণ কথা বলতে গেলেই তো আমার কন্ঠ কাঁপে। আগে কাঁপতো না জানো? এখন কেন জানি কাঁপে!
—-কারণ আপনার মনে আপুকে নিয়ে অনুভূতি সদ্য জন্মেছে তাই। এতোদিন অনুভূতি ছিলো না, তাই কাঁপা-কাঁপিও ছিলো না। এখন অনুভূতির কারণেই কাঁপা-কাঁপি শুরু হচ্ছে।
—-আসলেই তাই? আচ্ছা, তুমি কখনো কাউকে পছন্দ করেছো? তোমার ক্ষেত্রেও কী এমনটাই হয়েছে?
মুখের হাসি মিলিয়ে গেল মিশরাতের। কাঁটা জায়গায় মনে হলো নুনের ছিটা দিয়ে দিলো কেউ। এখনো আরিয়ানের আশায় সে বসে আছে। তবে নিজে থেকে যেচে আরিয়ানের সাথে সে কোনো কথা বলতে যায় না। সেদিনের পর থেকেই সে আরিয়ানের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। মিশরাতের মতে, সে অনেক চেষ্টা করেছে আরিয়ানকে নিজের দিকে ফেরানোর। একাধিকবার তার মনের কথা একাধিক ভাবে প্রকাশ করেছে। এরপরেও যদি আরিয়ান নিজে থেকে এখন আর তার কাছে না ফেরে, তবে সে ধরেই নেবে আরিয়ান তার ভাগ্যে নেই। আরিয়ানকে নিজের আশেপাশে দেখলে এখনও নিজেকে সামলাতে কষ্ট হয় তার। তবে সে একটু একটু করে চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে ভেতর থেকে শক্ত করে তোলার। কিন্তু এই কথাটা যেন আবারও তার মনের পুরোনো ক্ষতকে খুঁচিয়ে তুলছে!
—-কী হলো মিশরাত? চুপ করে গেলে যে? এতোক্ষণ যাবত তো বেশ অভিজ্ঞের মতো কথা বলছিলে। তো বলো কেউ এমন আছে কীনা তোমার জীবনে?
—-না ভাইয়া, কেউ নেই। আমার কথা বাদ দিন। শুনুন, নুজহাত আপুর কাছে মনের কথা প্রকাশ করতে হলে এসব কাঁপা-কাঁপি বন্ধ করতে হবে। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়া তো এতো সোজা না ভাইয়া। তার জন্য ভয়ডর সব বিসর্জন দিতে হবে।
—-যাক, তুমি কথাটা শুনে তেমন একটা রিয়েক্ট করোনি।
—-কীসের কথা?
—-এই যে, আমি নুজহাতকে ভালেবেসে ফেলেছি, সেই কথা।
মুচকি মুচকি হাসছে মিশরাত। কারণ নুজহাত তো আরও আগেই মিশরাতকে বলে দিয়েছে তার মনের অনুভূতির কথা ইশতিয়াককে নিয়ে। মিশরাত চাইলেই ইশতিয়াককে বলে দিতে পারতো সেই কথা। কিন্তু সে বলেনি। কারণ নুজহাত চায় ইশতিয়াক যাতে তার পক্ষ থেকে প্রথম পদক্ষেপ নেয় এই সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে। অবশ্য শুধু একা নুজহাত কেন, সব মেয়েই বোধহয় তাদের পছন্দের পুরুষ থেকে এটাই চায় চেতন কিংবা অবচেতন মনে। সবার তো আর মিশরাতের মতো কপাল না! কথাটা ভাবতেই আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মিশরাত।
—-মিশরাত, আবার কোথায় হারিয়ে গেলে?
—-হ্যাঁ? না ভাইয়া কিছু না। বলুন কী বলবেন?
—-তোমার আমাকে সাহায্য করতে হবে নুজহাতের কাছে নিজের ভালোবাসা ব্যক্ত করার জন্য। তুমি হবে আমাদের কবুতর।
—-হ্যাঁ? কবুতর?
—-হ্যাঁ, আগেকার সময়ে যেমন কপোত-কপোতীর মাঝে ভাবের আদান-প্রদান কবুতরের বহন করা চিঠির মাধ্যমে হতো, এখন ঠিক সেভাবে আমাদের মাঝখানে ভাবের আদান-প্রদান তোমার মাধ্যমে হবে।
—-শুনুন, চিঠির কাহিনী বাদ দিয়ে সরাসরি মনের কথা বলুন। তাতে মেয়েরা খুশি হয় বেশি।
—-কিন্তু রিজেক্ট করে দিলে?
—-সে তো চিঠির মাধ্যমেও রিজেক্ট করতে পারে। সেটা কথা না, কথা হলো আপনার সরাসরি কথা বলতে হবে আপুর সাথে। বলতে পারেন যে আপুকে প্রপোজ করতে হবে।
বাম হাত থুতনিতে ঠেকিয়ে কী যেন কতক্ষণ ভাবলো ইশতিয়াক। এরপর আমতা আমতা করে বললো
—-সে ক্ষেত্রেও আমার তোমার সাহায্যই লাগবে।
—-আরে ব্যাপার না। আপনার সামনে আপুকে এনে দাঁড় করাতে হবে তো সকলের অগোচরে? আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি ঠিকই কায়দা করে আপুকে আপনার কাছে নিয়ে আসবো। শুধু তাই নয়, আপনাদের মতবিনিময় যাতে সুষ্ঠুভাবে হয় তার দায়িত্বও আমার।
—-সে তো করবেই। কিন্তু আরও যে একটা কাজ করতে হবে?
—-কী কাজ?
—-জানোই তো আমি নুজহাতের সাথে কথা বলতে গেলেও এখন কাঁপতে থাকি। সরাসরি যদি এক লাফে এখন প্রপোজ করতে যাই, তাহলে সেটা কখনোই সম্ভব হবে না আমি জানি। কিছু না কিছু একটা তালগোল পাকাবোই। এজন্য প্র্যাকটিস করতে হবে আমার।
—-তো করুন?
—-আমি তোমাকে এখন করে দেখাচ্ছি। মানে তোমার সামনে। তুমি দেখে বলবে যে আমার প্রপোজ করা ঠিক আছে কীনা। কিংবা কোথায় ভুল আছে সেগুলো শুধরে দেবে। পাশাপাশি নুজহাত কীভাবে প্রপোজ করলে আরও বেশি খুশি হবে সেই ধারণাও দিতো পারো।
মিশরাতকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে ইশতিয়াক চলে গেল। ফিরলো মিনিট ছয়েক পর। ইশতিয়াক কী করতে গিয়েছিলো সেটা মিশরাত এখন বুঝতে পারছে। তার হাতে গোলাপ ফুলের তোড়া। হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মিশরাতের সামনে।
—-মিশরাত, এভাবেই তো বসতে হবে তাই না? ঠিক আছে তো? এভাবেই ফুল ধরতে হয় না?
—-হ্যাঁ, হ্যাঁ ভাইয়া। একদম পারফেক্ট হয়েছে। এবার বলুন কী বলবেন।
ইশতিয়াক এটা সেটা বলছে আর মিশরাতও কিছু ভুল থাকলে ঠিক করে দিচ্ছে। কখনো কখনো ইশতিয়াকের কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে মিশরাত হেসে ফেলছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে অবশেষে ইশতিয়াককে প্রপোজ করার কৌশল শিখিয়ে দিলো মিশরাত।
***
—-কী রে আপু? আমি পড়াশোনা শেষ করে ঘুমোতে চলে আসলাম। আর তুই এখনো চোখ খুলে রেখেছিস? সেই কখন ঘুমাতে আসলি!
ইশরাতের কথা কানে যাওয়ায় দ্রুত স্মৃতিচারণ শেষ করলো মিশরাত। মাথা নেড়ে জানালো তার ঘুম আসছে না। ইশরাত পাশে এসে শুয়ে পড়লে তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগলো মিশরাত। এটাই দু’বোনের ঘুমানোর সময় চিরাচরিত নিয়ম। ইশরাত সাথে সাথেই চোখ বুজে ফেললেও মিশরাত এখনো চোখের পাতা এক করতে পারেনি। অতীত না চাইলেও মনে পড়ে যায়। আর এই অতীতটাই তাকে আরিয়ানকে মেনে নিতে বারংবার বাঁধা দেয়।
চলবে…
(