‘বিয়ের কয়েকদিন পর পরই স্বামীকে খুশি করতে তার জন্য অফিসে দুপুরের খাবার নিয়ে গেলাম। অফিস কেবিনের দরজা খুলতেই দেখলাম আমার স্বামী তার কোনো সুন্দরী কলিগকে অত্যন্ত গভীর ভাবে চুম্বন করছে। আমি ছিলাম নির্বিকার। বিশ্বাস করুন আমার একটুও কষ্ট হয়নি। ওঁরা ওঁদের কাজে এতোটাই মত্ত ছিলো যে আমার উপস্থিতি টের পায়নি। আমি কিছুটা হেসে নির্লজ্জের মতো ঐ মেয়েটাকে আমার স্বামীর থেকে আলাদা করে দিয়েছিলাম। আমার কান্ডে ওঁরা হতবাক, হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে ছিলো নত মস্তকে। আমার স্বামীকে শুধু বললাম,
“আপনার দুপুরের খাবার দিতে এসেছিলাম রাশেদ। খেয়ে নেবেন!”
আসার আগে তার কপালে একটা চুমু দিলাম,চোখে চোখ রাখলাম,মৃদুস্বরে বললাম,’আমার প্রাণের স্বামী,এমন কোনো কাজ করবেন না, যে কাজের জন্য স্বীয় স্ত্রীর সামনে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়!খুব যত্ন করে রেঁধেছি অবশ্যই খাবেন! এই দেখুন হাত কেমন পুঁড়ে গেছে! আগে কখনো রান্না করিনি তো তাই। আশা করি সবকিছুর অভ্যাস হয়ে যাবে! আসি হ্যাঁ?লাভ ইউ!’
আমার কথাতে, আমার ব্যবহারে আমার স্বামী আরও হতভম্ব হয়ে গেছিলো। ওঁ ভেবেছিলো ওঁকে আমি থা’প্প’ড় দিবো৷ ঐ মেয়েটার চুলের মুঠি ধরে অফিস থেকে বের করে দিবো। কিন্তু আমার নির্লিপ্ততা আমার স্বামীকে ভাবিয়ে তুলেছিলো।’
‘মিস সুসমা, আপনি আপনার স্বামীর এসব সহ্য করেছেন কিভাবে? ওতোটা স্বাভাবিক কি কেউ থাকতে পারে? তারপর দশটা বছর সংসার করেছেন শুনলাম।’
‘সত্যি কথা কি জানেন? আমার সত্যিই ইচ্ছে করছিলো আমার স্বামীকে ঠাটিয়ে চ’ড় বসাতে! চ’ড়ের পর চ’ড় দিয়ে গাল ফাঁটিয়ে দিতে। অনেক গুলো বি’শ্রি কথা শুনাতে! ঐ যে মেয়েটা, ওঁকেও চুলের মুঠি ধরে হির হির করে টানতে টানতে রাস্তায় ছুড়ে ফেলতে। অত্যন্ত নোংরা ভাবে বলতে, “এতো যখন শ’খ রাস্তায় যা না, অন্যের স্বামীর সাথে কি এতো ঢলাঢলি!” ভেতরে ভেতরে রাগটাকে আমি উপরন্ত নরম ব্যবহারে ঢেঁকে ফেলেছিলাম। আমি তো অনূসুয়া নয় তাই না? কোনো নারীই স্বামীকে ভাগ করার ক্ষেত্রে অনূসুয়া হতে পারে না।’
সুসমা লম্বা দম ছেড়ে বলা থামালো তার জীবন কাহিনীর অর্ধাংশকাল। রিক্তা সুসমার গল্পে প্রায় বুদ হয়ে গেছিলো। সে মন প্রাণ দিয়ে সুসমার জীবন কাহিনী শুনতে শুনতে কষ্টে বিভোর হয়ে গেছিলো।
‘আজ তবে আসি? বাস থেমেছে আমার স্ট্যান্ডে!’ বললো সুসমা।
‘আর তোমার বাকি গল্পটা শুনতে পারবো? এই যাহ, তুমি বললে ফেললাম কিছু মনে করো না হ্যাঁ?’
‘আরে কোনো ব্যাপার না। আমিও তো তুমি বলছি। আর হ্যাঁ রিক্তা, একই অফিসে তো চাকরি করছি! আসার সময় রোজ বাসে বসে তোমায় আমার জিজীবিষা হওয়ার গল্প খানা শোনাবো কেমন?’
সুসমার কথায় রিক্তা শুকনো হাসি হাসলো৷ সুসমা কিভাবে সহ্য করেছে এসব? সে হলে তো পারতো না! কোনো ভাবেই না। ওতোটা উদার সে নয়! দশ বছর তো দূর দশ সেকেন্ড ঐ রকম চরিত্রহীন মানুষের সঙ্গ নিতো না।
বাড়ি এসে সুসমা মায়ের রুমে গেলো। ধীর কন্ঠে বলল, ‘মা, বাবার ওষুধ! বাবা খেয়েছে?’
কারিমা বেগম ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এলেন৷ বললেন, ‘হ্যাঁ খাইয়ে দিলাম। হাত মুখ ধুয়ে আয়, খাবার দিচ্ছি।’
তারপর কতক্ষণ মৌন রইলেন কারিমা বেগম। মেয়ের মাথায় হাত রেখে নরম সুরে বললেন, ‘জীবন টা কি একা এভাবে নিঃস্বঙ্গতায় কাটিয়ে দিবি? আরেকবার নিজের জীবনটাকে সুযোগ দে না মা!’
‘কি বলবে, একটু পরিষ্কার করে বলবে? মাত্র অফিস থেকে বাড়িতে পা রেখেছি। আসার পর ই শুরু করে দিয়েছো? আমাকে কি একটু শান্তি দেবে না তোমরা? কি পেয়েছো আমাকে? মানুষ মনে হয় না? রোবট আমি?’
সুসমা লম্বা কদম ফেলে নিজের ঘরে গিয়ে শব্দ করে দরজা আটকে দিলো। কারিমা বেগম মাথায় হাত দিয়ে শয্যাশায়ী স্বামীর পাশে বসে পরলেন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
‘আপনি দেখলেন? মেয়ের ব্যবহার দেখলেন? আমি তো ওঁর মা। আমি কি ওঁকে এভাবে সারাজীবন একা একা থাকতে দেখতে পারি? আমার বুকে কি ব্যথা হয় না? এভাবে আর কতদিন বলতে পারেন? আমরা না থাকলে ওঁ একা একা কিভাবে থাকবে? দুনিয়ার সব মানুষ কি এক হয়?’
রহিম মিয়া নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়েছেন। তার তো মুখে কথা নেই। সম্পুর্ণ অকেঁজো তিনি। কথা বলতে পারেন না। হাত পা নড়াতে পারেন না। শুধুই সব কথা শুনতে পারেন। চোখের কার্ণিশ বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। সুসমা চট করে দরজা খুলে এসে তার বাবার চোখ মুছে দিয়ে বললো, ‘চোখে পানি কেন? হা করো বাবা, ওষুধ সময় মতো না খেলে শরীর ঠিক হবে কিভাবে?’
কারিমা বেগম মেয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। একটু চেপে বসে মেয়েকে বসার জায়গা করে দিলেন। সুসমা বসে শান্ত ভাবে বললো,
‘মা, আমি সারাজীবন একাই থাকতে চাই। তোমাদের মেয়ে নিজের ক্ষ’ত নিজে সারাতে জানে। তার জন্য কোনো পুরুষ মানুষের আমার জীবনে আগমনের প্রয়োজন নেই। আমি তোমাদেরকে ছেড়ে আর কোথাও যাবো না। আমি চলে গেলে তোমাদের দেখবে কে? আর যেনো আমাকে এসব বলতে না শুনি! তোমাদের জন্যই তো নিঃশ্বাস নিতে পারছি এখনো! সেই তোমাদেরকে ছেড়ে গেলে দম বন্ধ হয়ে যাবে না আমার?’
কারিমা বেগম হুহু করে কাঁন্না করে দিলেন মেয়েক ধরে। সুসমা স্বাভাবিক। এখন আর কান্না আসে না। কারোর চোখে পানি দেখলে বুকে ব্যথার উপদ্রব হয় না। আচ্ছা, সে কি পাথর হয়ে গেছে? যাকে ইংরেজি তে হার্টলেস বলে! সে কি সত্যিই হার্টলেস হয়ে গেলো? না হলে নিজের জন্ম দাত্রী কে কাঁদতে দেখেও তার কষ্ট কেন হচ্ছে না?
রাতের খাবার খেয়ে রুমে বসে সুসমা ল্যাপটপ নিয়ে বসলো৷ অফিসের কাজ করতেই টুং করে ম্যাসেজ এলো। রিক্তা ম্যাসেজ করেছে! লিখেছে,
‘কি করছো? খেয়েছো! কাল অফিস বাদ রেস্টুরেন্টে বসবে? চা কফি খেতে খেতে কথা বলবো না হয়!’
সুসমা হাসলো। ম্যাসেজের রিপ্লাই করলো, ‘সবকিছুর ক্ষেত্রেই অতিব আগ্রহ থাকা ভালো না। যদি কাল আমি বেঁচে না থাকি তখন কিন্তু তোমার আগ্রহ আফসোসে পরিণত হবে।’
‘তুমি কিন্তু খুব জটিলতায় ফেলছো আমায়!’
‘কোথায়, সহজ করেই তো বললাম। নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নেই জানো তো?’
‘আচ্ছা, আমার স্বামী অফিস থেকে ফিরেছে। ওঁকে সময় দিচ্ছি। না হলে আবার মহাশয় গাল ফুলাবে।’
শেষ ম্যাসেজটা পড়ে হাসলো সুসমা। রাশেদ যখন অফিস থেকে ফিরতো তখন সেও সব কাজ ফেলে দিয়ে ছুটে যেতো। যদি রাশেদ রাগ করে। স্বামীর মন পেতে যা কিছু করতে হয় সব করতো সুসমা। সে দেখতো সুস্পষ্ট ভাবে তার স্বামীর মুখে তার জন্য বিরক্তি। তবুও সে হাসি মুখে সবকিছু করে নিতো। স্বামীর সাথে সাথে সংসারের প্রতিটি সদস্যের মন জুগিয়ে চলাটা চারটি খানি কথা না৷ শাশুড়ী, শশুর, ননদ, ছোট দেবরটা। সবার টাইমে টাইমে নাশতা, জামা কাপড় কেচে ইস্ত্রি করে রাখা। অনেক সময় ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়তো সে। আচ্ছা তার এতো কাজের মধ্যে কখনোই কি ঐ বাড়ির কেউ-ই তার ক্লান্তি লক্ষ্য করতো না?আচ্ছা ওঁকে ওঁরা মানুষ মনে করতো তো আদৌ?
জীবনে কিছু কিছু ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি বহন করার সক্ষমতা সবার থাকে না! তারও ছিলো না। শেষ টাইম টা সে অতিষ্ঠ হয়ে গেছিলো।তবে পৃথিবী চলবে তার নিজস্ব নিয়মে। কোনো কিছুই থেমে থাকবে না,তারপরেও বলি কিছু সময়ের জন্য আবেগ ধাঁমাচাপা দিয়ে নিজের পথ চলতে হবে। বেঁচে থাকতে হবে নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য।
একটা মানুষ যদি সত্যিই বদলাতে চাই তবে তাকে কি একটা সুযোগ দেওয়া উচিত নয়? সেও রাশেদকে সুযোগ দিয়েছিলো। তবে এটাই ছিলো তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত!
#অনূসুয়া
#পর্ব১
#রাউফুন
#চলবে