#রিপোস্ট
#অন্তরালের_কথা
লেখা – জান্নাতুল ফেরদৌস মাটি
পর্ব – ১২
.
.
রুমে ঢুকে তিহানকে খালি গায়ে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় দেখে অতল তিহানের পা ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
” কি ব্যাপার তিহান? এভাবে শুয়ে আছিস যে! বিছানায় পা তুলে ঠিকভাবে শুয়ে বিশ্রাম নিলে কি এমন হয়! ”
অতলকে পায়ে হাত দিতে দেখে তিহান উঠে বসতে নিল কিন্তু শরীরের দূর্বলতার জন্য তৎক্ষনাৎ উঠে বসতে পারলো না। কিছুটা সময় নিয়ে উঠে বসতে বসতে বলল,
” তুমি যে কী করো না ভাইয়া! তুমি কি জানো না আমি পায়ে হাত দেয়াটা পছন্দ করি না? তারউপর তুমি আমার বড় ভাই। এটা কিন্তু মোটেও ঠিক কাজ করোনি তুমি। ”
” কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল সেটা অন্তত আমাকে শিখাতে আসিস না। তোর বড় ভাই আমি তাহলে জ্ঞানটা অবশ্যই তোর থেকে ক্ষানিকটা হলেও বেশি রাখি।”
” হুম ৷ ”
তিহানের পা ঠিক করে বিছানায় বসতে বসতে অতল বলল,
” তো হসপিটাল থেকে যে এসে পড়লি আসার সময় আমাকে কী কী বলেছিলি মনে আছে কি? ”
” সবই মনে আছে। ”
” আমার কিন্তু মনে হচ্ছে না। কারণ মনে থাকলে অবশ্যই তুই এভাবে শুয়ে পড়তি না। গোসল করে, খাওয়া-দাওয়া করে সোজা ঘুম দিতি। ”
” চাইলেই তো ঘুমানো যায় না ভাইয়া। তবে চেষ্টা করবো। ”
” আচ্ছা তিহান, তুই ওইরকম একটি বাজে কাজ…..”
তিহান বিছানায় বসা ছিল কিন্তু অতলের কথার প্রসঙ্গ শুনে বলল,
” দেখি ভাইয়া একটু সরে বসতো। বিছানা থেকে নামবো। শরীরটা ভালো লাগছে না।গোসল করে দেখি স্বস্তি ফিরে পাই কি-না।”
অতলের প্রতিউত্তরের অপেক্ষা না করে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আলমারি খুলে সেন্টু গেঞ্জি আর লুঙ্গি কাঁধে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো তিহান। অতল বেশ বুঝতে পেরেছে তিহান এই ব্যাপারে তার সাথে কথা বলতে মোটেও ইচ্ছুক নয়। আর অতলও চায় তিহানকে কিছুটা সময় দিতে। তাই সেও আর বিষয়টিকে নিয়ে ঘাটাঘাটি করল না। আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিজের ঘরের কাছে গিয়ে দরজা খুলে দেখে তানহা তোয়ালে দিয়ে হাত মুখ মুছছে। চোখ দুটো বেশ ভারী দেখাচ্ছে। কেঁদেছে যে স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে। অতল ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে তানহার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
” কাঁদছিলে বুঝি? ”
” উ হুম। ”
” মিথ্যে বলছ কেন? আমার সাথে কি মিথ্যে বলার সম্পর্ক তোমার? ”
তানহা চুপ করে রয়েছে। কোনো কথা বলতে পারছে না সে। অতল এবার তানহার দু’কাঁধে হাত রেখে বলল,
” বাড়ির জন্য মন খারাপ তাই তো? আর মন খারাপ হওয়াটাও স্বাভাবিক। জন্মের পর যে ঘরে থেকে বড় হয়েছ, যে মানুষ জনের সাথে থেকে জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময় পার করেছ তাদের ছেড়ে নতুন ঘর, নতুন মানুষ জনকে মেনে নেয়া এতটাও সহজ কথা নয়। কিছুদিন সময় তো লাগবেই। সে ক’টা দিন না-হয় একটু কষ্ট করে মানিয়ে নাও। এটাই যে মেয়েদের ভাগ্য। জীবনের অর্ধেকটা বয়স বাবার বাড়ি আর বাকি অর্ধেকটা বয়স শ্বশুর বাড়ি। এই নিয়েই তাদের জীবন। ”
” হুম। ”
” মাত্র তো কালই এলে এ বাড়িতে আমি তো চাইলেও আজ তোমাকে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারব না। তাই বৌ-ভাত একটু না-হয় কষ্ট করো বউ। তারপর থেকে তোমার যখনি খারাপ লাগবে আমার যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন তোমাকে নিয়ে যাবো। আর একান্তই সময় না করতে পারলে তোমাকে গাড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দিব। ”
” হুম। ”
” কী হুম? এত হুম কোথা থেকে আসে তোমার? মুখে কিছু বলো। ”
” জ্বি। ”
” আবার জ্বি বলে। আচ্ছা, তোমার গলা দিয়ে কি হ্যাঁ, হুম, জ্বি এই তিনটা শব্দ ছাড়া কি কিছুই বের হয় না? ”
তানহা চুপ করে আছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে কি বলবে যে, তার কথা বলতে ভালো লাগে না, নাকি বলবে সে কথাই কম বলে। কি বলবে সে?
এদিকে অতল বলে উঠলো,
” জানো তানহা আমি কিন্তু আগে এরকম ছিলাম না মানে বাচাল ছিলাম না। ঠিক এখন যতটা বাচলামো করি তোমার সাথে। ”
” হুম। ”
” কী হুম? জিজ্ঞেস করবে না কেন এখন এরকম করি! ”
” হুম বলুন, কেন? ”
” আসলে আমি কিন্তু ভীষণ কথা বলতে পছন্দ করি। বলতে পারো মিশুক টাইপের। তবে সবার জন্য নয় শুধুমাত্র নিজের আপনজনদের জন্য। যার তালিকায় এতদিন ছিল বাবা, মা আর ছোট ভাই। কিন্তু সেই আপনজনদের তালিকায় কাল থেকে যুক্ত হলে তুমি। তুমি হয়তো ভাবতে পারো কাল এসে আজই এতো আপন আবার হয় নাকি! আসলে কি জানো এই ব্যাপারটি অনেকের কাছে ভীষণ কষ্টের আবার অসাধ্য রকম একটি কাজ। কিন্তু আবার এই ব্যাপারটি কিছু মানুষের জন্য খুব সাধনার এক কথায় বলতে পারো বহু কাঙ্ক্ষিত। তাই সেই মানুষগুলো খুব সহজেই এই সম্পর্কটিকে আপন করে মানুষটিকে নিজের করে নিতে পারে। ”
” আমি হচ্ছি ১ম উদাহরণ আর আপনি ২য়। তাই তো? ”
” একদম তাই। তুমি কি জানো তানহা, তুমি আমার কাছে কেন এতো কাঙ্ক্ষিত? জানো না আর এটা জানার কথাও না। কারণ বর্তমানের ছেলেদের যেই অবস্থা যুবকদের কথা বাদই দিলাম। কিশোর দের কথাতেই আসো ৯ পেরিয়ে ১০ বছর হলেই গার্লফ্রেন্ডের হাত বুকের মাঝে নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তাই আজকাল সব ছেলেদের সবাই এক ক্যাটাগরিতে মূল্যায়ন করে। কিন্তু আসলে যে সব এক ধাতুর তৈরী না এটা কেউ বুঝে না। কেউ আছে নাক টিপ দিলে দুধ বের হবে সেই অবস্থায় প্রেমে লেগে পড়ে। আবার কেউ আছে তার প্রেয়সীর অপেক্ষায় বছরের পর বছর পার করে দেয় তারপরও প্রেম নামক সম্পর্কে নিজেকে জড়ায় না। ”
তানহা চুপ করে চোখের দৃষ্টি অন্যদিক করে তাকিয়ে আছে। অতল তানহার কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে থুতনিতে আলতো করে স্পর্শ করে মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
” চুপ করে আছো যে? আচ্ছা, তোমার কি আমার সাথে বলার মতো কোনো কথাই নেই? এই যে এত কথা বলছি আমি তুমি কি পালটা কোনো প্রশ্ন করেছ? জানতে কি চেয়েছ আমি কেমন? তোমার কি কোনো আগ্রহ নেই আমার প্রতি? আমি কি এতটাই ফেলনা তানহা? যে ছেলে জীবনের অর্ধেকটা সময় পার করে এসেছে তবুও প্রয়োজন ছাড়া একের অধিক কথা কোনো মেয়ের সাথে বলেনি, সেই ছেলে তোমার সাথে দুটো মন খুলে কথা বলার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে তুমি কি বুঝ না? তুমি হয়তো ভাবতে পারো, তুমি সুন্দর তাই আমি এরকম করি কিন্তু আমি বলব তুমি যদি এটা ভেবে থাকো জীবনের বড় একটি ভুল ধারণা মনের ভেতর পোষণ করবে। তোমার জায়গায় যদি অন্য কোনো কুৎসিত অর্থাৎ কালো মেয়ে থাকতো তারপরও আমি ঠিক এইরকমই করতাম। কারণ আমার মনে এই বউটাকে নিয়েই হাজারো স্বপ্ন বুনা। সে হোক সুন্দর কিংবা কুৎসিত। আমার চোখে তো সে সবচেয়ে সুন্দরী নারী। তাকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে যেন কোনো কমতি না থাকে তাই আজ অবধি কোনো সম্পর্কে নিজেকে জড়াইনি। কারণ আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা আর জীবনের শেষ ভালোবাসা সবটা জুড়েই আমার বউটারই বিচরণ অনুভব করতে চাই। ”
অতলের গলা ভারী হয়ে আসছে। চোখের কোণে চিকচিক করা জলের কণাগুলো মুহুর্তের মাঝে বেরিয়ে আসার ফন্দি আঁটছে। তাই অতল সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পাচ্ছে না। তানহা যদি দেখে ফেলে সেই ভয়ে! তানহাকে ছেড়ে কিছুটা দূরে দাঁড়ালো অতল। তানহার চোখের দিকে যে তাকাবে সেই অবস্থা টুকুতেও যে নেই অতল। তাই পেছনে ফিরে সোজা বেরিয়ে যেতে লাগল ঘর ছেড়ে কিন্তু বেড়িয়ে যাবার আগে ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে তানহার দিকে না ফিরেই ধীর গলায় বলল,
” যত পারো অবহেলা করো সমস্যা নেই। একা থাকার অভ্যাস আছে আমার কিন্তু নিজেকে আর আমার পরিবারকে হাসি খুশি রাখার চেষ্টা করো প্লিজ। ”
কথাটি বলে অতল আর এক মিনিটও দাঁড়ালো না। সোজা বাড়ির বাহিরে চলে গেল। কিন্তু এতকিছু করেও সে লুকাতে পারেনি তার চোখের জল তানহার কাছ থেকে। তানহা যে প্রথমেই দেখেছিল অতলের টলটলে চোখের জল। তবুও সে অতলকে আটকায়নি। তানহা যে এক ঘোরে পড়ে গিয়েছে। অতলের কথার ঘোরে। অতলের বলা প্রতিটি কথা তানহার কানে বাজছে। এমন সময় কারো গলার আওয়াজ পেয়ে তানহার ঘোর ভাঙলো। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে এক মধ্যবয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে হয়তো তানহার হুকুমের জন্যই ঘরে ঢুকার অপেক্ষা। তানহা মুচকি হাসি দিয়ে বলল,
” কিছু বলবেন? ”
” হুম খালা। কিছু কথা ছিল।”
” বাহিরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন, ভেতরে আসুন। ”
মহিলাটি ভেতরে এসে বলল,
” খালা আপনি আমারে চিনবেন না। তাই আমি নিজেই আমার পরিচয়টা দিয়া দেই? ”
” জ্বি বলুন। ”
” আমি এ বাড়ির বুয়া । এই বাড়িতে গত ৩ বছর ধইরা কাজ করি। ঘর গুছানো থেকা শুরু কইরা রান্নাবান্না সবকিছু আমিই করি। মাঝেমাঝে আফা আসে আমারে সাহায্য করতে কিন্তু আমিই দিই না। ”
” ওহ্! কিন্তু এই আপা কে? ”
” কে আবার? আপনের শাশুড়ি। ”
” ওহ্! ”
” হুম, এতদিন তো আফা সব বইলা দিতো কী কী রান্না হইব, কী কী কাজ করতে হইব। কিন্তু আজকে যখন আফারে জিগাইলাম রান্নার কথা সে কইল আপনারে জিগাইতে। আর শুধু আজকের জন্য না এখন থেকে আপনারে জিগাইয়াই কাজ করতে কইসে। ”
” ওহ্! ”
” কিন্তু, আপনি কোনো কাজ করতে পারবেন না। শুধু মুখে কইবেন আর আমি করমু। এমনকি রান্নাঘরেও আপনার জাইতে হইব না। ঘরে থাইকাই মুখে কইয়া দিবেন আমি ওই অনুযায়ী কাজ করমু। ”
” হুম, বুঝলাম। ”
” তো এখন বলেন দুপুরে কি রান্না করমু?”
” দুপুরের রান্নার কথাতো পরে আসবে আগে সকালের জন্য তো কিছু করতে হবে।”
” বেলা কয়টা বাজে দেখছেন? সকালের নাস্তা অনেক আগেই বানানো শেষ। আপনে ঘুমাইতে ছিলেন তাই সকালে ডাক দিই নাই। ”
” ও… ”
” দুপুরে কী রানমু তাইলে? ”
” আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। কারণ কার কি পছন্দ আমিতো কিছুই জানি না।”
” ওইটা নিয়া আপনে চিন্তা কইরেন না। আমি সবকিছুই জানি। কম দিন তো হয় নাই এই বাড়িতে আছি। ”
” তাহলে তো ভালোই হলো। আপনি রান্নাঘরে গিয়ে সবকিছু গুছানো শুরু করে দিন। আমি মায়ের ঘর থেকে ঘুরে রান্নাঘরে আসছি। ”
” আচ্ছা খালা। আমি তাইলে যাই। ”
” জ্বি, আচ্ছা। ”
বুয়া তানহার কথামতো চলে গেল রান্নাঘরে।
.
বিষন্ন মন নিয়ে বাড়ির সামনের বাগানটিতে মুখ ভার করে হাঁটছিল অতল।
.
.
চলবে…..