#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৩৬
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
সকাল সকাল বাড়িতে খুশির খবর এল। মমতাজ বেগমের একমাত্র কন্যা ইন্ডিয়া থেকে ফিরছেন। বাড়িতে তুমুল উত্তেজনা সবার মধ্যে। রান্নাবান্নার বেশ আয়োজন চলছে সকাল থেকে।
এদিকে বাচ্চাদের খাওয়াতে গিয়ে আনিকার নাজেহাল অবস্থা। দুজনেই খাবে না বলে ছুটছে এদিক-ওদিক। শুক্রবার হওয়ায় আজ বাড়িতে সবাই উপস্থিত।
আনিকা বাচ্চাদের পেছন ছুটতে ছুটতে খাওয়াচ্ছে। দুজনেই মহাবিরক্ত মায়ের উপর।
অনা বলল,
আন খাবু না আম্মু। আন না। আন না।
আর দুটো মা। আবিসোনা আর দুটো।
আবিদ একদম লুকিয়ে গেল। আনিকা বিরক্ত হয়ে
সোফায় বসে রইলো।
হাতের কব্জিতে পড়া ঘড়ির বেল্ট ঠিক করতে করতে অভিক নিচে এসে আনিকাকে হতাশাগ্রস্ত দেখে বলল
কি হয়েছে?
দেখ না। দু’টো বাচ্চা যদি এ কয়টা ভাত খেতে না পারে। আমাকে ক্লান্ত বানিয়ে ফেললো দৌড়াতে দৌড়াতে।
ওদের চিপস চকলেট কম দেবে। সারাক্ষণ ওসব খেতে থাকলে ভাত খাবে কি করে?
তুই ওসব আমাকে বলছিস কেন? তোর ভাইকে বল। সেই তো আদর করে বাচ্চাদের জন্য এসব নিয়ে আসে। সে কি দেখছে যে ওরা খাওয়ানোর সময় আমাকে কত জ্বালায়।
অভিকের পেছন পেছন আহনাফ নেমে এল। বলল
কি হলো?
এইতো এসেছেন মহাপুরুষ। আপনার বাচ্চাদের খাওয়ান। আমি আর পারছিনা।
অভিক বলল
প্লেটটা ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দাও।
আহনাফ হেসে বলল
কোনো সমস্যা না। আমি খাইয়ে দিতে পারি। প্লেট নিয়ে সে দু’জনকে ডাক দিতেই বাবার ডাক শুনে দুজনেই হাজির। একেবারে কোলে উঠে গলা জড়িয়ে বসলো।
আহনাফ বলল
এবার খাইয়ে দাও। আনিকা বাড়িয়ে দিতেই ওরা মুখ ফিরিয়ে নিল। আহনাফ বলল
কাল সবাই মেলায় যাব। না খেলে নিয়ে যাব না।
অভি যাবে?
হুম।
আম্মু যাবে?
সবাই যাবে।
ওহ ওহ পাপা গুড বয়।
আহনাফ গালে ঠেসে চুমু দিয়ে বলল,
এবার খান।
ওরা এবার খেতে খেতে হাজারও প্রশ্নের ঝুলি মেলে ধরলো বাবার সামনে।
আহনাফ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ফাঁকে অভিককে ডেকে বলল
তুই কোথাও বেরোচ্ছিস?
আনিকা বলল
হ্যা, ও শপে যাবে। নাহিদ আর তার বউকে আজ দাওয়াত দিল না। বউকে তো নতুন জামাকাপড় দিতে হবে। ওটা কিনবে। হ্যা রে অভি তুই শাড়ি চিনবি তো?
হুমম।
তাহলে তো ভালো। শোন আমার ফেইস ওয়াশটা শেষের দিকে। নিয়ে আসবি।
ওকে।
আবিদ বলল,
অভি চকলেট আনিবে। এত্ত বড় বড়। কেমন?
অভিক আনিকার দিকে তাকিয়ে হাসলো। আনিকা বলল
ওদের সাথে বেঁধে তোকেও পিঠাবো।
অভি তুমাকে ডিসুম ডিসুম মাববে।
সবাই হেসে উঠলো।
সালমা বেগম শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এলেন। বললেন
বেরোচ্ছিস অভি?
হ্যা। তোমার জন্য কিছু লাগবে?
না। তোর জেম্মা বলছে যে শাড়ির রঙ যাতে উজ্জ্বল রঙের হয়। নতুন বউ তো তাই।
হুম।
অনেকগুলো দেখবি। তারপর কিনবি। ঠিক আছে?
হুমম।
আনিকা বলল
উফ ছোটমা ওর উপর ছেড়ে দাও। এটা ভালো একটা প্র্যাক্টিস ওর জন্য। কিছুদিন পর বউয়ের জন্য তো কেনাকাটা করতেই হবে।
সালমা বেগম হাসলেন। অভিক বলল
আচ্ছা আসি মা।
সাবধানে যাস। ফি আমানিল্লাহ।
________________
নিউমার্কেটে এসে অভিকের সাথে কয়েকজন স্টুডেন্টদের দেখা হলো। তাদের সবাইকে চিনতে অভিকের বিন্দুমাত্র ভুল হলো না। তারা সবাই সুজানার বন্ধু। দেখামাত্র স্যার স্যার বলে ছুটে এল। অভিক বলল
পরীক্ষা তো শেষ!
হ্যা স্যার। আপনাকে এখানে দেখতে পাব ভাবিনি।
কি হচ্ছে এইখানে?
এমনি ঘুরছিলাম সবাই মিলে। আপনি কেন এসেছেন?
কিছু কেনাকাটা করব।
স্যার আমরা একটা কিছু অফার করতে পারি?
এখন না। সন্ধ্যা বেলায় স্কুল মাঠে যাওয়া হয়?
নিখিল বলল,
ক্যান্টেন্টমেন্ট?
হ্যা।
অফকোর্স। আপনি ওখানে আসবেন?
আজ যেতে পারি।
তাহলে জমবে ভালো। দুটো ছক্কা-ফোর হবে স্যার? আহিরের বল দারুণ ।
অভিক ভুরু উঁচালো আহিরের দিকে তাকিয়ে।
তাই?
ইয়েস স্যার।
দেখা যাক।
ওকে স্যার আমরা রেডি থাকব। আপনার সাথে যাই?
চলো। শাড়ি কিনবো।
কার জন্য?
বন্ধুর বউ।
নিখিল মাথার পেছনে হাত বুলিয়ে বলল
ভাবির জন্য হলুদই বেস্ট।
অভিক সরু চোখে তাকিয়ে বলল
এরেহ দেবরের সামনে ভাবির জন্য শাড়ির কথা বলছি। তাহলে তো ভালোই। চলো তোমরা চুজ করে দেবে।
জায়িন বলল
আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সুজানার কালার চয়জটা খুব ভালো।
বাকিরা মৃদু হাসলো। অভিক হেসে যেতে যেতে বলল
তাই? তাহলে তো সুজানার থাকাটা দরকার ছিল।
তারা মজা করে জানতে চাইলো।
আপনি সুজানাকে চেনেন স্যার?
চিনি। একটুখানি।
______
ইতোমধ্যে অনেকগুলো শাড়ি দেখা হয়ে গিয়েছে। অভিক মেরুন রঙের একটা শাড়ি বাছাই করেছে। সাথে গোল্ডেন রঙের পাড়। শাড়িটা বাকিরাও পছন্দ করেছে। পাশেই একটা শাড়ি পড়েছিল। কালো পাড়ের লাল শাড়ি। শাড়ির গায়ে কাজ ভারী সুন্দর।
অভিক সেটা নেড়েচেড়ে দেখে বলল
এটাও প্যাক করা যাবে?
দোকানদার ফোকলা হেসে বলল
কেন নয়?
আহির জানতে চাইলো।
স্যার দুটো নিচ্ছেন?
অভিক উত্তর দিল।
একটা বন্ধুর বউয়ের জন্য। অন্যটা তার বন্ধুর বউয়ের জন্য।
বেচারা ছাত্রগুলো এর মাথামুন্ডু না বুঝে ভ্যাবলার মতো মাথা নাড়ালো।
তারা সবাই শপ থেকে বেরোতেই একজন বোরকা পড়া মহিলা তাদের দিকে এগিয়ে গেল। মহিলার পেছনে সায়েমকে দেখা গেল। তারা সবাই সালাম দিতেই সাজিয়া বেগম সালামের উত্তর দিয়ে বলল
ভালো আছ সবাই?
হ্যা আন্টি। আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?
একটু ডাক্তারের কাছে এলাম। কোমর ব্যাথাটা বেড়েছে তো।
ওহ আচ্ছা। অভিকও চোখ সরু করে চেয়ে আছে। ওরা পরিচয় করিয়ে দিল।
আন্টি উনি আমাদের স্যার।
অভিক সালাম দিতেই সাজিয়া বেগম সালাম নিয়ে বললেন
ওয়ালাইকুমুস সালাম। ভালো আছেন?
অভিক নির্মল হেসে বলল
জ্বি।
সাজিয়া বেগম আরও কাউকে খুঁজে বলল
করিম নামের ছেলেটা নেই?
সবাই কপাল ভাঁজ করে একে অপরের দিকে তাকালো। বলল
কোন করিমের কথা বলছেন আন্টি?
ওই যে তোমাদের বন্ধু। ও তোমাদের সাথে থাকে না?
আমাদের ওই নামে কোনো বন্ধুই নেই আন্টি।
সায়েম বলল
আম্মা তোমার ভুল হচ্ছে। আপার ওরকম কোনো বন্ধু নেই।
সাজিয়া বেগম বলল
ওহ আমার ভুল? কিন্তু তোর আপাই তো বললো করিম নামে ওর বন্ধু আছে। আচ্ছা বাসায় গিয়ে জিজ্ঞেস করব।
আহির বলল
সায়েম আজ মাঠে আসবি। দারুণ খেলা হবে কিন্তু।
সায়েম মাথা নেড়ে হাসলো। অভিকের দিকে তাকাতেই অভিক চোখ পিটপিট করতেই সে লজ্জা পেয়ে মাথা নামিয়ে হাসলো।
ভাইবোনের এই এক অবস্থা!
সাজিয়া বেগম বলে উঠলেন।
আচ্ছা আসি। কেমন? ভালো থেকো সবাই।
নিখিল গাড়িতে তুলে দিতে গেল সাজিয়া বেগমের পিছু পিছু। উনি যেতে যেতে ফিরে তাকিয়ে দেখলেন সবার পেছনের মাস্টারমশাইয়ের ঠোঁটের হাসি। কি নির্মল! অথচ কত রহস্য লুকোনো তার হাসিতে!
________
কম সময় নয়। সুজানার পরীক্ষা শেষ হয়ে ইতোমধ্যে তিনদিন গড়িয়ে গিয়েছে।
গত তিন মাসে তার আর মাস্টারমশাইয়ের পরীক্ষার হলে দেখা হয়েছিল। কথা বলার প্রয়োজন পড়েনি অবশ্য। কারণ এক দেখায় তো কতশত কথা হয়ে যায় তাদের।
অভিক ফোন করে বিরক্ত করতে চাইনি আর অন্যদিকে বাড়াবাড়িটা কম হওয়ায় সুজানার ব্যাকুল মন খানিকটা অভিমানী হয়ে উঠেছিল এই তিনমাসে।
কিন্তু হঠাৎ করে সন্ধ্যায় বেশ ভালো একটা খবর বয়ে নিয়ে এল সায়েম। এসেই বললো
আপা তোদের স্যার আছে না? আজকে মাঠে আমরা একসাথে খেলেছি। নিখিল ভাই, আহির ভাই, আর জায়িন ভাইও ছিল। আমিও খেললাম।
একসাথে আইসক্রিমও খেয়েছি। তোদের স্যার দারুণ ব্যাট চালাতে পারে।
অভিক স্যার?
হ্যা।
ওহহহ।
খানিকটা জিরোলো সুজানা। ওই নামটা শুনলেই ঝিমঝিম করে উঠে সারা শরীর। উত্তেজিত হয়ে পড়ে সে। কিছু নিজ থেকে জানতে চেয়েও চাইলো না।
সায়েম নিজেই বলল,
তুই নাকি উনার একটা ট্র্যাকস্যুট নিয়ে এসেছিস কয়েকমাস হয়েছে। ফেরত দিসনি।
ও আল্লাহ খেয়ালই ছিল না। সেলাই করাও হয়নি।
সায়েম পকেট থেকে টিস্যু প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল
এটা দিয়েছে।
এটা কি?
টিস্যু প্যাকেট।
টিস্যু? কেন দিয়েছে?
আমি কি জানি? আমাকে বললো খোলা চলবে না। সোজা আপুর হাতে।
সুজানা সেটা নিয়ে চলে গেল। পিছু ফিরে ভাইয়ের সন্দিগ্ধ চাহনি দেখে বলল
আম্মাকে কিছু বলিস না।
সায়েমের কপালের ভাঁজ আরও গভীর হলো। কিছুটা সে ধারণা করতে পারে।
সুজানা ঘরে গিয়ে ট্র্যাকস্যুটটা খুঁজে নিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে টিস্যু প্যাকেটটা খুললো। এক এক করে টিস্যুর ভাঁজ মেলতেই মধ্যিখান থেকে একটা কাগজ বের হয়ে এল যাতে এবড়োখেবড়ো ভাবে লেখা।
সু —- জা —- না!
লালদীঘির পাড়ে সেগুন কাঠের ঝড়া পাতা বিছানো টুলটাতে অনেকদিন কেউ বসে না। আপনি আমি বসতে পারি।
যদি নীল শাড়ি পড়ে আসেন লাল শাড়ি ফ্রি!
সাদা ফুল গুঁজে এলে একটা ফুলের বাগানের মালিকানা ফ্রি!
বুদ্ধিমতীরা এমন অফার সহজেই অগ্রাহ্য করেনা। আপনি আসবেন আমার জানা আছে।
সুজানা কাগজটা মুঠো করে মুখ লুকোলো ট্র্যাকস্যুটের মাঝে। খানিকটা পরেই মায়ের প্রশ্ন ভেসে এল।
করিমের নাম্বার ‘এ’ দিয়ে সেভ করেছিস কেন?
চলবে…..#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৩৭
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
সুজানা দ্রুত শোয়া থেকে উঠে পড়লো। ট্র্যাকস্যুটটা পেছনে লুকিয়ে বলল
করিম?
সাজিয়া বেগম সরু চোখে চেয়ে বললেন
হ্যা।
সুজানা ট্র্যাকস্যুটটা নিয়ে ওয়ারড্রবে খুলতে খুলতে বলল
অতকিছু ভেবে সেভ করিনি আম্মা। মাঝেমাঝে অদ্ভুত প্রশ্ন করো তুমি।
করিমের বাড়ি তো ষোল শহরেই। তাহলে ও বাকিদের সাথে থাকে না কেন?
কাদের সাথে?
আহিরদের সাথে?
ওদের সাথে তোমার দেখা হয়েছে?
হ্যা। সাথে ওই স্যারটাও ছিল।
কোন স্যার?
নামটা ভুলে গিয়েছি। যেই বাড়িতে পড়াতে যেতি।
অভিক স্যার?
হ্যা হ্যা।
সুজানা ঢোক গিলে বলল
তুমি কথা বলার সময় উনিও পাশে ছিল?
থাকলে কি হবে?
না আম্মা এমনি জিজ্ঞেস করছি। আচ্ছা আমি চা বসায় গিয়ে।
সুজানা চলে গেল। সাজিয়া বেগম বালিশের উপর থেকে ফোন নিয়ে ‘এ’ দিয়ে সেভ করা নাম্বারটা ঠুকে নিলেন নিজের ফোনে।
_____________
নবকুঠিরের গেইট পার হয়ে উঠোনে প্রবেশ করলো গাড়িটা। সদর দরজার বাইরে ইতোমধ্যে বাড়ির সব সদস্য দাঁড়ানো। মালী গামছা কাঁধে দৌড় দিল গাড়ির কাছে। বাচ্চারাও উনার পিছু। মমতাজ বেগম খুশিতে আত্মহারা। অনেকগুলো বছর পর একমাত্র বাপের ভিটায় পা রাখছে উনার মেয়েটা । অভিক আর আহনাফ গাড়ির কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছে । গাড়ির দরজা খুলতেই বেরিয়ে এল একজন পৌঢ় মহিলা। একজনের কোলে বাচ্চা। অন্যজন যুবতী। অন্য দুজন পুরুষ মানুষ। একজন অভিকের ফুপা অন্যজন ফুপাতো ভাই সিজান।
বাচ্চার মায়ের কোল থেকে বাচ্চাটা কেড়ে নিয়ে ইতোমধ্যে বাড়ির ভেতরে চলে গিয়েছে মর্জিনা। সবাই সবাইকে দেখে খুশিতে আত্মহারা। একে অপরের সাথে বহুদিনের এই দূরত্ব কাটিয়ে কয়েক মিনিটের গল্পসল্প সেই দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় চুকে গেল।
সবার সাথে ভালো কুশলাদি বিনিময় করা শেষে অভিকের চোখ গেল গাড়ির ভেতর। সেখানে বসা যুবতী মেয়েটা মাথা এলিয়ে বসে আছে। অভিক দরজা খুলে মাথা নামিয়ে বলল
গাড়িতে আরও চড়ার শখ?
মেয়েটা ফিরে চাইলো। চোখমুখ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অবসন্ন গলায় বলল
এখানে যে কেউ বসে আছে সেটা এতক্ষণ পর কারো চোখে পড়লো।
অভিক হেসে বলল
ইঁদুরের মতো ঘাপটি মেরে বসে থাকলে সবাই দেখবে কি করে?
আমি ইঁদুর? হাউ ডেয়ার ইউ? তুমি আমাকে ইঁদুর বললে?
সবাই তাদের দিকে ফিরে তাকালো।
কি হচ্ছে জিনি? আসামাত্রই ঝগড়া। বড়জনদের যে সালাম করতে হয় সেটা জানোনা? আজব!
মায়ের ডাকে জিনিয়া জবুথুবু হয়ে গেল।
সালমা বেগম বললেন
অভি মেয়েটাকে আসামাত্রই পঁচানো শুরু করে দিয়েছিস?
আমি এখন ভিডিও কলে নেই ছোট মামী। চুল ছিঁড়ে নেব একটা একটা।
সবাই হেসে উঠলো। জিনিয়া গাড়ি থেকে নেমে বলল
কোমরটা ব্যাথা হয়ে গেল বসতে বসতে। নীচু হতেই সালমা বেগম আটকে বলল
থাক নীচু হয়ে সালাম করতে হবে না। অনেকদিন বেঁচে থাকো।
মমতাজ বেগম বললেন
এই দেখ আমার বোনটাও বড় হয়ে গেল চোখের পলকে।
হাহ, বাদ দাও আমার কথা । তোমার ছোট নাতির চুল সাদা হতে যাচ্ছে এখনো বিয়ে করাতে পারোনি আবার আমাকে নিয়ে টানাটানি লাগিয়েছ?
অভিক চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল
আমার চুল সাদা?
ভাগ্যিস সাদা হয়েছে টাক হয়নি এই বেশি।
সবাই হেসে উঠলো। অভিক চুলে হাত বুলাতে বুলাতে হেসে আওড়ালো।
সো স্যাড। সুজানা শেষমেশ বুড়ো বর পাবে।
******
সবাই জার্নি করে আসায় বিশ্রাম নিচ্ছে। কিছুপরেই অভিকের বন্ধু নাহিদের পরিবার এল নতুন বউ নিয়ে দাওয়াত খেতে। পুরো বাড়িটা জমে উঠেছে। অভিক কিছুক্ষণ পর পর ফোন চেক করছে। যদি হুট করে একটা মেসেজ এসে বসে যেখানে লেখা থাকবে কাল সেগুনবাগিচায় সে আসছে। মেয়েটা তাকে ভীষণ জ্বালায় রেখেছে।
ওদিকে গালের লাল-কালো ব্রণের দাগ নিয়ে ভীষণ চিন্তিত সুজানার এখনো নীল শাড়ি যোগাড় করা হয়নি। সে কিভাবে ওই পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে ভেবে পেল না। তাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে নাকানিচুবানি না খাওয়ালে লোকটার শান্তি হচ্ছে না। এদিকে আম্মাকে কি বলে ম্যানেজ করাবে?
*****
সবার খাওয়াদাওয়া আর গল্পে অনেক সময় কেটে গেল। আনজুমা বেগম সবাইকে খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিল। অনা আবিদ নতুন ছোট একটা বেবি পেয়ে মহাখুশি।
জিনিয়া ভাইয়ের বউ তানিয়া আর নাহিদের বউ আছমার সাথে গল্প জুড়েছে সেই আসার পর থেকে। গল্পের এক ফাঁকে অভিককে ডেকে বলল
ব্রো এইখানে আরও একটা বউয়ের অভাব। আরেকটা হলে খাপে খাপ।
অভিক বলল,
আরেহ রাখো । সারাক্ষণ বউ আর বউ। এমনিতে যন্ত্রণার শেষ নেই।
কে জ্বালাচ্ছে তোমাকে? তোমার কপালে বজ্জাত বউ জুটবে। দেখো। হুম।
অভিক হেসে অন্যপথে হাঁটা ধরলো। মোটেওনা। সুজানা তো ভারী মিষ্টি!
সালমা বেগম এসে বলল
তোমরা থাকতেই ওর বউ নিয়ে আসব।
জিনিয়া চোখ কপালে তুলে চাইলো। বলল
সত্যি?
হুম।
আনিকা এসে সেখানে যোগ দিয়ে বলল
ছোটমা এত কনফিডেন্স কি করে?
জেনে যাবে।
কি লুকচ্ছ জানিনা বাপু।
কিছু লুকচ্ছি না। সময়মতো সব জেনে যাবে বউ।
নিজের ছেলের বউ পেলে আমাকে আদরের ভাগ কম দেবে না তো?
সালমা বেগম ওর থুঁতনি ছুঁয়ে বলল
আমার দুটো ছেলে। দুটো বউ। তোর আদরে কোনোদিনও কম পড়বে না। তুই বড় তাই তোর আদর আরও বেশি।
আনিকা হাসলো।
*******
ঠিক তার পরের দিন। রোদে পুড়ে গেল আর বৃষ্টি ভিজে ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরলো সুজানা। গতরাতেই মেহুলকে ফোন করে বলে দিয়েছে যাতে ভার্সিটিতে আসার সময় নীল শাড়িটা নিয়ে আসে। সে ব্যাগে করে শাড়ি নিয়ে এসেছে। শান্তা সাদা ফুল। বান্ধবীদের সাথে সবকিছু শেয়ার না করলে নিজেই সাহস পায় না সুজানা। তার বন্ধুগুলোর সাথে আত্মিক সম্পর্কটা খুবই মজবুত।
মাস্টারমশাইকে ও আজ আশেপাশে কোথাও দেখতে পায়নি। ভালো হয়েছে আসেনি। সুজানা তে দূর থেকে দেখলে লজ্জা ম*রতে ম*রতে বাঁচে। উফ কি করে যে সামনে গিয়ে দাঁড়াবে!
দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে বসে বসে হাত রাঙিয়েছে সে কলমের ঝুড়িতে পড়ে থাকা মেহেদীটা দিয়ে। গত বছর ঈদের সময় কিনেছে। আরেক ঈদ এসেই পড়লো সামনে। এত ছোটাছুটির ভীড়ে নিজের জন্য সময় খুঁজে বের করাটা দারুণ কঠিন।
মা তখন থেকেই সবকিছু সূক্ষ্ম নজরে পরখ করে যাচ্ছে। একটা প্রশ্নও করেনি। মেয়ে বড় হওয়ার পর থেকে মেয়েকে জেরা করার ধরণটা বদলেছেন শুধু, জেরা করাটা কমাননি তাই ইনিয়েবিনিয়ে জানতে চাইলেন,
আজ অফিসে কোনো অনুষ্ঠান?
সুজানা বাম হাত মেহেদীতে রাঙিয়ে বললেন
হুমম। আজ বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাব। একটা দিন।
কখন ফিরবি?
বেরোবোই তো সন্ধ্যায়।
সন্ধ্যায় কেউ ঘুরতে যায়?
খুব তাড়াতাড়ি ফিরব আম্মা।
ঠিক আছে।
_________
বৃষ্টিভেজা শেষ বিকেলে লাল দিঘীর পাড়ে গিয়ে অভিক দেখলো সেগুন কাঠের টুলে অসংখ্য ভেজা পাতা লেপ্টে আছে। শেষ বিকেলের পাখিরা ক্লান্তদেহে নীড়ে ফিরছে। বৃষ্টি থামার পরেই আবার রোদ উঠেছে। সেই রোদ বিসর্জনের পূর্বেই পুব আকাশটাকে থমথমে গাঢ় লাল রঙে ছেয়ে দিয়েছে। অভিক টুলের পাতাগুলো ঝেড়ে বসলো চুপচাপ। এক সেকেন্ড এক মিনিট এক ঘন্টা তারপর দু ঘন্টা পার হওয়ার পর নীল শাড়িতে মুড়িয়ে এল সুজানা চুপিসারে হেঁটে । সে দেখলো সেগুন কাঠের টুলে চুপচাপ বসে দিঘীর পানিতে ঢিল ছুঁড়ছে অভিক।
কাছাকাছি যেতেই আপাদমস্তক কেঁপে উঠলো তার সারা শরীর। বুকের ভেতর অদ্ভুত দুন্দুভিধ্বনি টের পেল। উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে এল তার। অভিক ফিরছে মনে হতেই পিছু ফিরে গেল সে। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে রইলো শাঁড়ির আঁচল চেপে ধরে। পেছন থেকে গলা খাঁকারি ভেসে এল। তারপর গলার স্বরটি আরও নিকটে এল। কানে এল
আজও কি কারো বিয়ে ভাঙতে এসেছেন ?
চলবে…….