আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে পর্ব -৪৬+৪৭

#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৪৬
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

সুজানা বাসায় পৌঁছে দেখলো সবাই ড্রয়িংরুমে বসে সাজিয়া বেগম আর রাশেদা বেগমের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে।

সুজানাকে ফিরতে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে পড়লো। ঈদ মোবারক বলে কুশল বিনিময় আদানপ্রদান শেষে সুজানা বলল

আমি খুব খুশি হয়েছি সবাই এসেছেন বলে। তরী খড়ি কখন এল?

চারটের দিকে এসেছি আপু। আম্মু ও এসেছে। মামীও এসেছে। আর বলেছে যাওয়ার সময় তোমাকে নিয়ে যেতে।

সুজানা অভিকের দিকে ফিরে তাকালো। অভিক মাথা দুলিয়ে তরীর কথায় সম্মতি জানালো।

সাজিয়া বেগম বললেন

সবাই বসো। আমি চা টা নিয়ে আসি।

সাইফের সাথে সিজান আর রিছান প্রবেশ করলো। সুজানা বলল

আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।

ওয়ালাইকুমুস সালাম। বেড়ানো শেষ?

চলে এসেছি আপনারা এসেছেন শুনে।

রেডি হয়ে নাও। বেরোতে হবে তো।

সুজানা আমতাআমতা করে বলল

কিন্তু…

অভিক সোফায় বসে পড়ে বলল

আমরা কোনো কিন্তু শুনতে আসিনি।

অনা আবিদ এসে সুজানার হাঁটু জড়িয়ে ধরলো।

সুজান আম্মু ভালো।

সুজানা তাদের চুলে হাত বুলিয়ে হাসলো। নীচু হয়ে আদর করে দিল। বলল

তাই? আপনাদের ঈদের ড্রেস তো সুন্দর হয়েছে। দুটো পুতুল।

জিনিয়া বলল

আপু তুমি রেডি হয়ে নাও। আমরা বেরোবো।

সুজানা বলল

আচ্ছা আম্মার সাথে কথা বলি।

ওকে।

*******

সাজিয়া বেগম চায়ে চিনি হয়েছে কিনা চেক করতে করতে সুজানাকে বললেন

হাত মুখ ধুঁয়ে নে। ওরা যে ড্রেসটা দিয়েছে ওটা পড়ে নে। ওটা না পড়লে আবার অন্য কিছু মনে করবে।

সুজানা মাথা নাড়ালো। সাজিয়া বেগম ট্রে হাতে তুলে নিলেন। বললেন

আর ওইরকম কিছু জানতে চাইলে যেটা বলেছি সেটা বলবি।

আমি কি ছোট। কি বলতে হবে আমি জানি আম্মা।

ঠিক আছে। রেডি হয়ে নে।

সাজিয়া বেগম চায়ের ট্রে নিয়ে রান্নাঘর পার হতে যাবে তখনি অভিককে দেখতে পেল। সে এসে চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে নিল। বলল

শুনতে চলে এসেছি কি শলাপরামর্শ চলছে। সুজানা যাচ্ছে?

সাজিয়া বেগম হাসলেন। বললেন

হ্যা।

গুড। না গেলে কিন্তু সুজানারই লস।

কিসের লস?

সালামি পাবে না।

সাজিয়া বেগম হেসে বললেন

ওহহ।

অভিক সুজানার দিকে তাকালো। বলল

তাহলে রেডি হয়ে নিন?

সুজানা মাথা নাড়ালো। বলল

আপনি চা খান?

সাজিয়া বেগম বললেন

ওমা চা খায় না? তো কি খায়? কফি ? জানা ছিল না তো।

অভিক বলল

কে বলেছে খায় না। যেটা যেখানে ভালো। হতে পারে করিমের আন্টি চা খুব ভালো বানায়। না খেলে তো লস খাব। তাই না?

সাজিয়া বেগম হেসে উঠলেন।
সুজানাও হাসলো। কাকে কিভাবে বুঝ দিতে হয় তাতে একদম ওস্তাদ।

——–

সুজানা অভিকের দেয়া সেলোয়ার-কামিজটা পড়ে নিল। ড্রেসটা মেরুন আর সোনালী রঙের। ওড়নায় ভারী কাজ। কামিজের বুকে আর নীচে হাতে কাজ। সুজানার ভারী পছন্দ হয়েছে। মাস্টারমশাইয়ের পছন্দ তার অপছন্দ হবে না কভু।
সে ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে খানিকটা সাজুগুজু করে ঘর থেকে বেরুতে যাবে তখনি জিনিয়া আর তরী চলে এল। বলল

রেডি?

সুজানা মাথা নাড়ালো।

**

সাজিয়া বেগম সবাইকে সালামি দিলেন। সবাই নিতে না চাইলেও জোর করে দিলেন। অনা আবিদ বখশিশ পেয়ে সে কি খুশি।

অভিককে বলল, সুজান আম্মু বখশিশ দিচে।

অভিক রিছান আর সিজানকে রুমালের ভেতরে করে বখশিশ দিলেন। অভিক বলল

কি এগুলো?

সামান্য বখশিশ। এসব নিতে হয়। খুশি হয়ে দেয় তাই খুশি হয়ে নিতে হয়।

অভিক তাই আর কিছু বলল না।

তারপর সবাই একসাথে বেরিয়ে পড়লো।

______________

নবকুঠিরে পৌঁছুতেই গাড়ি থেকে নেমে সবাই সুজানাকে রেখে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। জিনিয়া সবাইকে ডেকে বলল

বউ চলে এসেছে। বড় মামী ছোট মামী মিষ্টি নিয়ে আসো।

আনিকা চলে গেল সুজানার কাছে। সালমা বেগমের পেছন পেছন আনজুমা বেগম আর অভিকের ফুপী মামী খালামণি সবাই গেল। সুজানাকে তখনো দরজার কাছে দাঁড় করিয়ে রেখেছে সবাই।

সবার সাথে কুশল বিনিময় পর্ব শেষ হলো। সবার সাথে সুজানার পরিচয় করিয়ে দিলেন সালমা বেগম। প্রথম দেখা হওয়ায় সবাই মিষ্টিমুখ করিয়ে ঘরে নিয়ে এল।

আজীম সাহেব এসে বলল

সুজানা চলে এসেছে?

সুজানা সালাম করতেই উনি মাথায় হাত রেখে দোয়া করে দিয়ে বললেন

ঈদ মোবারক সুইটি।

সুজানা হেসে বলল,

ঈদ মোবারক আঙ্কেল।

অভিক ফারদিন আজকাল কাজের কাজ করছে সব। গুড জব মিস্টার।

অভিক মাথার পেছনে চুলকে বলল

থ্যাংকস বাবা।

তারপরেই দাদু এলেন। বললেন

আমার নাতিবউ এসেছে?

সুজানা উনাকে সালাম করে বলল

ঈদ মোবারক দাদু।

ঈদ মোবারক বোন আমার। তুমি ভালো আছ তো? তোমার মা ভাই ভালো আছে?

আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো।

এই দেখ আমার ভাইয়ের পছন্দ কত সুন্দর। যেমন পোশাক তেমন মানুষ।

একথা শুনে ভরা মজলিশে সুজানা ভারী লজ্জা পেল। অভিক বলল

ওকে আমি এখন ঘরে যাই। প্রচুর টায়ার্ড।

সে চলে গেল।

সুজানা সবার সাথে বসে কিছু সেমাই মিষ্টি খেল। মামী আর খালামণিদের সাথে কথা বলতে অনেকটা সময় পার হয়ে গেল।

আবিদ এসে বলল

সুজান অভি ডাকে।

সুজানা সবার দিকে তাকালো। অভিকের খালামণি বললেন

যাও।

সুজানা চলে গেল। অভিকের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিতেই অভিকও উঁকি দিয়ে তাকালো। বলল

আমার ঘরে কি?

সুজানা হাসলো। বলল

তাহলে চলে যাই?

কি আজব! বলবেন এটা আমার ঘর। এটাও শিখিয়ে দিতে হবে?

সুজানা মাথা নামিয়ে হাসলো। ঘরে ঢুকে পার্সটা বিছানায় রেখে বুক সেলফের কাছে গিয়ে বইগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলো। বলল

আপনি মাসে কয়টা বই কিনেন?

হিসেব থাকেনা। যখন যেটা পাই।

সুজানা একপাশে অনেকগুলো নতুন বই দেখলো। বলল

এগুলো নতুন কিনেছেন মনে হচ্ছে।

আপনাকে নিয়ে পড়ব বলে কিনেছি। আপনি কখন আসছেন?

সুজানা একটা বই নিল হাতে। সবসময় তাকে লজ্জায় ফেলার ধান্ধা।

বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল

এই বইটার অর্ধেক আমার পড়া হয়েছে।

অভিক তার পেছনে এসে দাঁড়ালো। বলল

আমার তিনটে প্রশ্নের উত্তর দেয়া বাকি। মনে আছে?

সুজানা বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।

হ্যা। খুব মনে আছে।

কয়টার উত্তর পারবেন?

তিনোটার।

সিরিয়াসলি?

সুজানা মাথা দুলালো।

কিন্তু এখন জানতে চাইবেন না।

কেন?

সুজানা বইটা দিয়ে মুখ ঢেকে হাসলো। অভিক বইয়ের অপর পাশে তার কপাল ঠেকিয়ে বলল

ঠিক আছে। আপনার সালামিটা নিন এবার।

সুজানা বইটা ধীরে ধীরে নামালো। দেখলো একটা চকচকে হাজার টাকার নোট।

নিন।

সুজানা নিল। বলল

আম্মা দিয়েছে বলে শোধ দিচ্ছেন?

অভিক অবাক চোখে তাকালো।

কি আজব ব্যাপার! আমি আমার বউকে সালামি দেব না? যতই হবু হোক।
আপনার আম্মা কি দিল সেটা তো আমি খুলেও দেখিনি। এখন দেখি। ওয়েট।

অভিক তার পাঞ্জাবিটা নিল। পকেটে হাত ঢুকিয়ে রুমালটা বের করে সুজানার কাছে চলে এল। রুমালের ভাঁজ খুলতেই দেখলো

দুটো পাঁচশ টাকার নোট।

তারপর রুমালে হাতের কাজ করা তোলা ফুল আর সুঁতো দিয়ে লেখা “জামাইরাজা”।

অভিক হাসলো। সুজানাকে দেখিয়ে বলল

কি সুন্দর! এটা আমি খুব যত্নে রাখব।

আম্মা এটা রমজানে বসে বসে তুলেছে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম। দেখাইনি। আম্মা করিমকে খুব ভালোবাসে।

জরিনার মতো?

সুজানা বই দিয়ে মুখটা আবারও ঢেকে নিল।

বাইরে থেকে হাসাহাসির আওয়াজ ভেসে এল। আনিকা বলল

আসা যাবে?

সুজানা অপ্রস্তুত হয়ে অভিকের দিকে তাকালো।

অভিক বলল

আসা যাবে না কেন?

না মানে আমরা ভুল সময়ে টময়ে এসে পড়িনি তো।

সব বাজে কথা।

ওরা ঘরে ঢুকলো মিটিমিটি হেসে। সুজানা বলল

আপনারা হাসছেন কেন?

এমনি এমনি।

সিজানের বউ তানিয়া বলল

নতুন বউ কোথায়?

আনিকা সুজানাকে দেখিয়ে বলল

এইটা।

সুজানা সালাম দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। কোলের বাবুকে দেখে বলল

বাবু তো ঘুম।

হ্যা আমি বাবুর সাথে রুমে ছিলাম। ঘুম চলে এসেছিল। আপনি এসেছেন শুনে চলে এসেছি।

তরী আর খড়ি বিছানায় উঠে বসলো অভিকের ফোন নিয়ে। অভিক বলল

ফোনের চার্জ শেষের দিকে।

শেষ হলে দেখা যাবে।

সবাই বিছানায় গিয়ে বসলো। সুজানা বইটা সেলফে রেখে তাদের সাথে বসলো। দরজা ঠেলে অনা আবিদ চলে এল। সেন্টু গেঞ্জি গায়ে। গরমের কারণে ঈদের জামাকাপড় খুলে ছুঁড়ে ফেলেছে।

দু’জনেই বিছানায় উঠে সুজানার পাশ ঘেঁষে বলল। আনিকা সুজানাকে দেখিয়ে জানতে চাইলো।

কে এটা?

সুজান।

আর কি?

টিচার।

আর?

অভির বউ।

সবাই একসাথে হেসে উঠলো।

অভিক বলল

এসব ট্রেনিং দেয়াও হয়ে গিয়েছে? ব্র্যাভো!

জিনিয়া ওর ড্রয়ার থেকে লুডু বোর্ড করে বলল
ব্রোহ চলো লুডু খেলি। আমি, তুমি, ভাবী আর তোমার বউ।

কি একটা অবস্থা! এখনো বউ হয়নি বউ বউ শুরু করে দিয়েছ। বউ হয়ে গেলে তখন কি বলবে?

জিনিয়া খিক করে হেসে বলল

ইসতিরি।

সবাই আবারও হেসে উঠলো।

তানিয়া বাচ্চা নিয়ে বসে থাকলো।

জিনিয়া কাগজে এক, দুই, তিন চার লিখে লটারি দিল। এক আর দুই এক পক্ষে থাকবে, তিন চার অন্য পক্ষে। লটারিতে সুজানা আনিকার সাথে পড়লো। অভিক আর জিনিয়া অন্য পক্ষে।

তরী ফোনে মনোযোগ রেখে বলল

এর পরের বার আমরাও খেলব।

ওকে।

খেলা শুরু হলো। শুরুতেই স্বাভাবিক খেলে যাচ্ছিলো সবাই। সুজানার সব গুটি ছক্কা দিয়ে উঠে গিয়েছে। অভিকের একটাও না। সে মন খারাপ করে বলল

এটা কোনো কথা?

আনিকা বলল

আজ তোরা হারবি। দেখে নিস।

খেলার মাঝপথে জিনিয়ার গুটি কেটে দিল আনিকা তারপর পরপর সুজানাও কেটে দিল। সে অভিককে বলল

ধ্যাত তুমি কোনো খেলাই পারো না।

অভিক বলল

তুই খুব পারছ দেখতেই পাচ্ছি।

একদম ওরকম বলবে না। আজ হারলে তোমার জন্য হারবো।

আনিকা খিকখিক করে হেসে বলল

আহ মাথা নষ্ট হয়ে গেল দু’জনের। সুজানা হারলে চলবে না।

অভিক চুপচাপ খেলছে। তার হার জিত নিয়ে সমস্যা নেই। জিতলেও সে জিতবে, হারলেও সুজানা জিতবে। সমস্যা কোথায়? কই বাত নেহি।

তারপর ঘ্যাচাং করে সুজানার তার একটা পাকা গুটি কেটে দিল। অভিক হা করে তাকালো। বলল

হাউ সেলফিশ ইউ আর সুজানা! আমি আপনার একটা গুটি কাটিনি কিছু আগে।

সুজানা বলল

কি?

জিনিয়া বলল

কিহ? গুটি কাটোনি?

বলেই ঠাস ঠাস অভিকের বাহুতে মেরে দিল।

অভিক বলল

সুজানা এটা কি করলেন? আপনার জন্য কতগুলো মার খেলাম।

সুজানা হাসলো। বলল

আমি কি বলেছি আমার দিকে টানতে।

জিনিয়া নাকিসুরে কেঁদে বলল

বউয়ের দিকে টানছে। অসভ্য ছেলে। তুমি আর একটা গুটিও সরাবে না। তোমার গুটি আমি চালাবো।

অভিক গালে হাত দিয়ে

ওকে ফাইন।

শেষমেশ সুজানা আর আনিকাই জিতলো। আনিকা সুজানাকে জড়িয়ে ধরে বলল

ভালো মেয়ে।

অভিক বলল

আমি গুটি কাটিনি বলে জিতেছেন।

সুজানা বলল

কাটেননি কেন? আমি বলেছি?

কি আশ্চর্য! যার জন্য চুরি করি সেই বলে চোর।

সবাই একসাথে হেসে উঠলো।

চলবে……..

এবার বিয়ে বিয়ে। পাঠক গল্প শেষের দিকে।#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_৪৭
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা

খাওয়া দাওয়া শেষে সুজানা বেরোনোর জন্য তৈরি। সবাই একে একে বখশিশ দিল। সুজানা লজ্জা পেলে সালমা বেগম ধমক দিয়ে বললেন

আনিকা নিতে ভাঁড়ামো করেছে? তোমার এত সমস্যা কেন? খুশি হয়ে দিচ্ছে। নাও।

সুজানা ভয়ের চোটে নিঃশব্দে নিয়ে নিল। বখশিশ না নিতে কে চায়? একদম ফ্রেশ নতুন টাকা।

মমতাজ বেগম সুতির রুমালে করে সুজানাকে বখশিশ দিয়ে বলল

তিন নাতি বউয়ের জন্য বখশিশ রেখেছিলাম। দুটোকে দিয়ে দিয়েছি সকালে। তোমাকে দেয়ার জন্য আঁচলো বেঁধে রেখেছি। এই নাও। আগামী বছর আমার ভাইয়ের পকেট থেকে চুরি করে হলেও বেশি করে দেব।

সুজানা হাসলো।

আমার ভাই তোমাকে বখশিশ দিয়েছে তো?

সুজানা মাথা দুলালো।

বাহ! কিছু শিখিয়ে দিতে হয় না আমার ভাইটাকে। মসজিদ থেকে ফিরে আমার ভাইগুলো আমাকে বখশিশ দিয়েছে। তাদের তো আমার বখশিশের প্রয়োজন নেই। সেই ছোটবেলায় দিতাম। আমার বখশিশ পেয়ে কত খুশি হতো। এখন দিলেও নেয় না। তবে বৌমাদের দিই। আমি ছাড়া ওদের বখশিশ দেয়ার কেউ আছে? সে যাহোক এই বাড়িতে কবে আসছ? তোমাকে আনার তোড়জোড় তো শুরু করে দিয়েছে তোমার শ্বাশুড়ি।

কি?

ওই যে ফার্নিচার টার্নিচার বানাতে দিল না। ছেলের ঘর থেকে এখন সেটা ছেলের বউয়ের ঘর বানাতে হবে তো।

ছেলের ঘর আর মেয়ের ঘর আলাদা হয়?

হয় তো। মেয়েদের কত কিছু লাগে। ওই ঘরে শোকেস নেই, ড্রেসিং টেবিল নেই। ওই বড় বড় শেলফে কিসব বই রাখা আছে। আর তার যত সরঞ্জাম, লতাপাতা দিয়ে কেমন করেছে তুমি দেখোনি?

ওটুকুতে অনেকটা সুন্দর।

এই দেখো! মেয়ে কি বলে? বরের দিকে টেনে কথা বলছে। বৌমা তুমি কার জন্য এসব করছ বলোতো?

সালমা বেগম জানতে চাইলেন

কি হয়েছে?

দাদুভাইয়ের ঘর নাকি এটুকুতেই ভালো। সুজানাই বলছে।

সে তো দেখার মুখে আমিও বলেছি। তারপর এই বাড়িতে এসে দেখি আপনার খোকার ঘর তার ফুটবল আর ক্রিকেট খেলার মাঠের মতো ফাঁকা । আমি তার মায়ের মতো নই তাই ছেলে বউয়ের কথা ভাবতে হয় আমাকে। আপনার নাতি তার বাবার মতো ফাঁকা করে রাখেনি। সেই গাদাগাদা বই আর লতাপাতা দিয়ে ঘরটা ভর্তি করে রেখেছে। যেন বই আর সবজির দোকান। বাপ ছেলে দুটোই এক। এক পাগলের সাথে সংসার করে এখন আরেক পাগলের সংসার গুছিয়ে দিতে হচ্ছে।

সবাই মিটমিট করে হাসলো।

মমতাজ বেগম ফিসফিস করে বললেন

দেখেছ তোমার শ্বাশুড়ির কথা? এভাবেই আমাকে খোঁচা মারে। আমার খোকা নাকি পাগল?

সুজানাও হাসলো। বলল

আপনারা এভাবে ঝগড়া করেন?

দেখছ না? কিন্তু দেখো তুমি ঝগড়া করার সাহসটুকু পাবেনা শ্বাশুড়ির সাথে। আমাকে তো যা তা শুনিয়ে দেই কিছু বলিনা দেখে।

সুজানা খিক করে হেসে উঠে বলল

হায় আল্লাহ!

তাদের হাসাহাসির মধ্যে ভাটা পড়লো অভিক আসায়। সে বলল

সুজানা রেডি?

জ্বি।

ওকে চলুন।

মমতাজ বেগম বললেন,

এত তাড়া কেন ভাই? একটু বসুক আমার সাথে।

না অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। রাত বাড়ছে। সুজানা উঠুন।

মামী বলে উঠলেন

আজ রাতটা থেকে যাক না। কত ভালো লাগছে!

সুজানা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল

না মামিমা । আম্মা চলে যেতে বলেছে। অন্য একদিন।

আনজুমা বেগম বললেন

অন্য একদিন আবার কবে? সেই অন্য একদিন তুমিই মামিকে এবাড়িতে থেকে যেতে আবদার করবে।

সবাই হাসলো।

সুজানাও মৃদু হাসলো। সবার কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পথে সালমা বেগম বললেন

তোমার মা সময় চেয়েছিল। সময় দিয়েছি। তুমিও নাকি বলেছ বিয়েশাদির কথা পড়াশোনা শেষ করার পর ভেবে দেখবে?

সুজানা বিস্ময় নিয়ে তাকালো। উনি স্বাভাবিক ভাবে বললেন

আমাকে সব বলেছে তোমার মা। আমি এসব কথা অভিকে বলিনি। শোনো মেয়ে আমি গত ঈদের পর থেকে মেয়ে খুঁজে চলেছি। এখন যখন পেয়ে গেছি আর অপেক্ষা করব না। বিয়ের পর তুমি যা মন চায় করো। বিয়ের আগে আমি যা বলছি তাই করো। ঠিক আছে?

সুজানা মিনমিন করে জানতে চাইলো।

আমি একটা চাকরি করি আন্টি।

তোমাকে আমি কখনও বলেছি চাকরি ছেড়ে দিতে হবে?

না।

তাহলে চাকরির কথা উঠছে কেন? তোমরা বর বউয়ের সম্পর্ক ঠিক রেখে যা করার করো। এই একটা বছর কি তোমার কম মনে হচ্ছে? ততদিন আমি অপেক্ষা করতে পারব না বাপু। যা বলার তোমার মাকে বলে দিয়েছি। এবার তোমার মায়ের সিদ্ধান্ত।

অভিক এসে বলল

মা কি কথা বলছ এত? এবার ছাড়ো। সুজানা চলুন।

সুজানা সবার কাছ থেকে আবারও বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। সবাই সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তার যাওয়া দেখলো।

**

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অভিক জানতে চাইলো

মা কি বলছিল?

অনেক কিছু।

কি কি?

বলেছে আপনার ঘরটা বই আর সবজির দোকান।

অভিক হেসে উঠলো। বলল

মা ওসব প্রায়ই বলে। আর কি বলেছে?

বলেছে উনার ছেলেটা একদম বাপের মতো।

বাবা মায়ের প্রতি খুবই যত্নশীল। ছেলেটা অবশ্যই বাবার মতো।

সুজানা হাসলো। মৃদু তালে পা ফেলতে ফেলতে বলল

গত ঈদে আমি আপনাকে চিনতাম না।

আর আমি ঈদের পরের দিন একটা মেয়ে দেখতে গিয়েছি।

সুজানা কপাল কুঁচকে তাকালো।

মেয়েটা কেমন?

দেখার চোখে সবাই সুন্দর। কিন্তু তাদের অনুভব করতে না পারাটা আমার আনন্দের ছিল।

কেন?

আমি আমার মতো কাউকে অনুভবে রাখতে চেয়েছিলাম।

আপনার মতো?

মনের মতো।

সুজানা নির্মল হাসলো। অভিক তার হাতটা ধরে এপাশ ওপাশে রাস্তা পার হলো। সুজানা বলল

কি করছেন?

আপনি সাথে থাকলে দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করে। অন্য দুষ্টুমি এখন বারণ তাই কি আর করার?

কান গরম হয়ে এল সুজানার। নিত্যনতুন আবিষ্কার করছে সে এই মানুষকে। এত ঠোঁটকাঁটা তো কভু ছিল না।

তারপর অনেক দূর হেঁটে আসার পর রিকশা পেল তারা। সরিষাবাড়ির গেইটের কাছাকাছি এসে সুজানা রিকশা থেকে নেমে এল।

অভিক বলল

এত তাড়াতাড়ি পথটা ফুরিয়ে যায়।

সুজানা হাসলো। বলল

অনেক টাকা বখশিশ পেয়েছি। ভাড়াটা আমি দেই?

ফাইন।

সুজানা হেসে ভাড়াটা দিয়ে বলল

আসি? সাবধানে যাবেন। হুম?

অসাবধানে গেলে যদি আপনি সাথে আসেন তাহলে সাবধানে যেতে রাজী নই।

সুজানা হেসে বলল

সবসময় মজা। আসি। আল্লাহ হাফেজ।

অভিক তাকে আবারও ডাকলো।

সুজানা!

সুজানা ফিরলো।

অভিক মন খারাপ করে বলল

এসব আর ভালো লাগে না।

সে হেসে চালককে বলল

মামা যাওয়ার পথে উনাকে একটা ভালো লাগার ঔষধ কিনে দিয়েন তো।

অভিক চালককে বিল্ডিংয়ের তিন তলায় আঙুল ইশারা করে বলল

ঔষধের দোকানটা ওইখানে মামা।

সুজানার সাথে সাথে চালকও হেসে উঠলো।

_______________

ঈদ উপলক্ষ কেটে যাওয়ার পর বিয়ের ধুম নেমে এল। নবকুঠিরে বাড়ির বড়রা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল বিয়ের দিন সুজানার মায়ের উপর অত চাপ দেয়াটা খারাপ দেখায়। সুজানা বাবা আর বড় ভাই থাকলে একটা কথা ছিল। কয়েকজন গিয়ে মেয়ে তুলে আনবেন তারপর বিয়ের পরের দিন নবকুঠিরে বড় করে ওয়ালিমায় আত্নীয় স্বজনের মেহমানদারির ব্যবস্থা করবেন।

সাজিয়া বেগমকে তা জানালে উনি বেকায়দায় পড়ে যান। উনার একটামাত্র মেয়ে। বাবা নেই এই কারণে মেয়েকে কোনো কথা শুনতে দিতে রাজী নন উনি। উনি একাই সুজানার মা আর বাবা।

আশেপাশের প্রতিবেশী এসে বলে গেল যে না খাইয়ে দাইয়ে মেয়ে বিয়ে দিলে মেয়েকে পরে কথা শুনতে হয়। যেখানে উনারা অন্য কোনো পণ দাবি করছেনা সেখানে বিয়েতে ভালো আয়োজন না করলে মানুষে কথা শোনাবে মেয়েকে।

সাজিয়া বেগম সেসব শুনে একেবারেই মত দিলেন না। উনার সাধ্যমত আয়োজন করেই উনি মেয়ে দেবেন এমন পণ করলেন।
উনার সিদ্ধান্তঃ শুনে ও-ই বাড়ির লোক কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে সাজিয়া বেগম কি ভাবছেন সেটা।

তাই সবটা উনার উপর ছেড়ে দিলেন। উনার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো উচিত। উনি সুজানার একমাত্র অভিভাবক।

টাকা পয়সা হাতে আসামাত্রই সাজিয়া বেগম জানালেন আগামী বৃহস্পতিবারে মেহেদী সন্ধ্যা আর শুক্রবারেই বিয়ের দিন তারিখ ফেলতে। সালমা বেগম ভীষণ খুশি হলেন। বিলম্ব হওয়ায় উনি খুব টেনশনে ছিলেন এতদিন। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত দিনটা এল। বিয়ের কার্ড ছাপিয়ে বিলি করা হলো তিন চারদিনের মধ্যে।

তারপর বিয়ের বাজার সাজার।

সুজানার ভীষণ সর্দি কাশি হওয়ায় সে বলে দিয়েছে সবকিছু যাতে অভিকের পছন্দ মতো কিনে নেয়। তাছাড়া আনিকা জিনিয়া ওরা তো সবাই আছেই। কিন্তু অভিক নাছোড়বান্দা। সে ফোনে ফোনে জানালো। টিস্যু বস্তা করে নিয়ে যাব। তাও সর্দি-কাশি নিয়ে আপনাকে যেতে হবে।

সুজানা এমন নাছোড়বান্দা মানুষ আর দেখেনি। অগত্যা তাকে যেতে হলো।

__

ভালো জানাশোনা একটা ব্রাইডাল শপিংমল বেছে নিয়ে ওখানে কেনাকাটা করবে মনস্থির করেছে অভিক। গতরাতেই সবাই মিলে, ফোনের অপর পাশে সুজানাকে রেখে ফর্দ রেডি করেছে । সুজানা ফোনের ওপাশে বসে মাঝেমধ্যে হাঁচি-কাশি দিচ্ছিল। আর একেক জনের একেক মতামত শুনে হেসে কুটিকুটি হচ্ছিল। কেউ বলছে বিয়ের দিন শাড়ি পড়বে, কেউ বলছে লেহেঙ্গা। অনেক কথা-কাটাকাটি পরে সিদ্ধান্তে এল বিয়ের জন্য শাড়ি আর ওয়ালিমার দিন লেহেঙ্গাটা পড়বে। মেহেদীর শাড়ি, বিয়ের শাড়ি,লেহেঙ্গা,বিয়ের পরের শাড়ি, সুতি শাড়ি, ত্রিপিছ, বউয়ের মা ভাইয়ের জন্য কাপড়চোপড়, ফুলের গয়না, আর বউয়ের সাজগোজের জিনিস। আরও কতকিছু। বাড়ির সবার কেনাকেটা তো আছেই।

ছেলের বউয়ের গয়না সালমা বেগম আগে থেকে জুড়ে রেখেছেন। তাই সেসব নিয়ে চিন্তা নেই।

—–

সর্দি-কাশি নিয়েই সুজানা বিয়ের বাজারে যাওয়ার জন্য সরিষাবাড়ির গেইটে দাঁড়িয়েছে। অভিক বলেছিল তাকে গাড়িতে তুলে নেবে। সুজানা প্রায় সাত আট মিনিটের মতো দাঁড়ানোর পর গাড়িটা এসে থামলো তার সামনে । সেখানে সালমা বেগম, আনিকা আর জিনিয়া বসা। সুজানা সবার সাথে কুশল বিনিময় শেষে ড্রাইভারের দিকে তাকালো। অভিককে দেখলো না।
এমা, উনি কোথায়?
সালমা বেগম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল

অভি ওখানে আছে। তুমি উঠে বসো।

সুজানা আনিকার পাশে গিয়ে বসলো। আনিকা বলল

শরীর এখন কেমন আপনার?

মোটামুটি।

তারা গল্প করতে করতে নিউমার্কেটে চলে আসলো। সালমা বেগম ছেলের সাথে ফোনে ফোনে চিল্লাচিল্লি করছেন। আজব ছেলে সবাইকে এখানে রেখে বন্ধু নিয়ে ঘুরছে। বাপের মতো আক্কেল হয়নি ছেলেটার।

সবার প্রথমে সবাই শাড়ির দোকানে চলে গেল। মেহেদীর শাড়ি আর আরও কয়েকটা শাড়ি দেখার পরে বিয়ের শাড়ির দেখা শুরু হলো। সালমা বেগম শাড়ি দেখতে দেখতে সুজানাকে বললেন

আমার পছন্দ তোমার অপছন্দ হলে বলবে। ঠিক আছে?

সুজানা মাথা দুলালো।

পুরো শাড়ির মেলা বসে গেল চারপাশে। সালমা বেগম অনেকক্ষণ দেখার পর একটা বেনারসি আনিকাকে দিয়ে বললেন

এটা দেখো তো।

আনিকা সুজানার পেছনে এসে বেনারসিটা মেলে সুজানার গায়ের উপর দিয়ে বলল

দেখুন তো এটা পছন্দ হয়েছে কিনা। ছোটমার পছন্দ আছে।

সুজানায় আয়নায় চোখ রাখলো। আনিকা অন্য শাড়িগুলো দেখায় মনোযোগ দিয়ে বলল

ভালো করে দেখুন।

সুজানা আয়নায় চোখ রেখে বেনারসিটা আরেকটু ভালো করে মেলে মাথায় তুলে ঘোমটা দিল।

আয়নায় নিজেকে দেখলো অনেকক্ষণ। জীবনটা হুট করে এত রঙিন মনে হলো। অথচ কেমন ছিল এই বিয়ে বিয়ে শব্দগুলো তার কাছে। কত ভয়ের ছিল। কত আশংকার।

আয়নায় নিজেকে দেখার সময় অনেক হলো। তারপর দেখতে পেল ওই দূরে দোকানের ভেতরের কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়া মানুষটাকে। তার দিকে চোখ পড়ায় চোখেমুখে দারুণ পুলক। মুগ্ধতা। এভাবে কখনো তাকানো হয়নি।

সুজানা ওই চাহনি দেখে লজ্জায় রাঙা হলো।
অভিক ভুরু নাচাতেই সুজানা মৃদু হেসে মুখটা পুরো ঢেকে নিল শাড়ির আড়ালে।

অভিক তা দেখে হাসলো। মেয়েটা নাতিপুতির নানী হলেও তাকে লজ্জা পাবে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here