#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_১৬
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
হিম বাতাসে নিমজ্জিত পরিবেশ। ছাত্রছাত্রীদের পদচারণা আর কোলাহলে সেই নিমজ্জিত পরিবেশে খানিকটা উষ্ণতা ঢেলে দিল বন্ধুমহল। নিখিলের নিত্যদিনের সঙ্গী, পুরোনো অবহেলিত গিটারটা । জং ধরে গেছে অনেক তারে। কোনোমতে টেনেটুনে চলা। নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় আপন জিনিসগুলো বোধহয় বরাবরই অবহেলিত থাকে। তার সেই গিটারের সুরে থেমে যায় পথিক। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বিষণ্ম প্রেমিক।
আহিরের হাতের ডিবি ফোরকে একশন ক্যামেরাটিতে বন্দী হয় বন্ধুমহলের কয়েকটা ছবি আর জায়িনের কবি গলার সেই কবিতা সবাইকে করে মন্ত্রমুগ্ধ।
আকাশের রঙধনু জানে বন্ধুত্ব আমাদের
একই রোডে আঁকিবুঁকি করে হেটে যাই,
চায়ের কাপে চুমুকে বিল নিয়ে হুটোপুটি
রয়ে গেছে বছরঘুরে একই সবটাই,
টং এর বেঞ্চের বৃষ্টির ছিটে আসা পানি
ভিজেয়েছিস সবাইকে করে,লুটোপুটি
বন্ধু বন্ধুর বন্ধুত্বের বাধনে সবটা সুন্দর খুনসুটি।
আর তিন বান্ধবীর টুকটাক কিছু মন ভালো করে দেয়া গল্প। হাসাহাসি মাতামাতি একে অপরের পিছু লাগা। ব্যস্ত কল্লোলময় ক্যাম্পাসের তারাও একটি অংশ।
আড্ডা শেষে ক্লাসের সময় হওয়ায় ক্লাসের দিকে ছুটলো সবাই। গিয়ে দেখতে পেল সবাই একজোট মিলে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। শুধুমাত্র নিহাত একপাশে বসে বইয়ে মুখ গুঁজে রয়েছে। শান্তা বাকিদের উদ্দেশ্য বলল
কি দেখছিস রে সবাই মিলে।
গলা বাড়িয়ে উঁকি দিতেই দেখলো মোবাইলে কিছু দেখছে তারা। মেহুল সুজানাকে বলল
সবদিকে ওর কৌতূহল।
শান্তা ওদের ফোনটা কেড়ে নিয়ে নিল। সবাই একসাথে হাঁকিয়ে উঠে বলল
এত কাড়াকাড়ি করিস কেন?
শান্তা ফোনটা চোখের সামনে ধরে বলল
বয়ফ্রেন্ডকে দেখছিস? বাহ তোদের বয়ফ্রেন্ড তো হেব্বি আছে।
বলেই নিজে নিজেই চোখ ঢলা মারলো। দেখলো ফোনের স্ক্রীনে অভিক স্যার হাতনেড়ে লেকচার দিচ্ছে।
ও মেহু এটা তো দেখি স্যার।
শান্তা ফোনটা নিয়ে বসতেই ছোঁ মেরে নিয়ে গেল ফোনের মালিক। বলল
স্যারের পেজে গিয়ে দেখ। আমার এমবি শেষ।
শান্তা সুজানার ফোন কেড়ে নিল। বলল
এমবি আছে?
সুজানা বইয়ে মুখ গুঁজে জবাব দিল।
হুমম।
শান্তা ফেসবুকে “Abhik Fardin ” লিখতেই যে পেজটি সামনে এল ওটাতে প্রবেশ করলো। 4.7M Follower দেখা যাচ্ছে। শুরুতেই অনেক গুলো ভিডিও। যেগুলোতে এলইডি স্ক্রীনের সামনে পড়াচ্ছে অভিক। শান্তা ভিডিওগুলো স্ক্রল করতে করতে নীচে নেমে এল।
সুজানা বইয়ের পাতা উল্টে বলল
কি দেখছিস আমাকেও দেখা।
শান্তা ঝামটি মেরে বলল
আরেহ চুপ থাক। মেহুলও উৎসুক হয়ে দেখছে। সুজানা মুখ তুলে এবার ফোন কেড়ে নিল। বলল
আমাকে না দেখালে চলবে না।
ফোনটা সম্মুখে তুলতেই কালো জ্যাকেট পরিহিত পরিচিত মুখটা দেখতেই অদ্ভুত দুন্দুভিধ্বনি টের পেল অন্তঃকরণে। লাল মার্সিডিজে বসে আছে সৌম্যদর্শন লোকটি। চোখে রোদচশমা। নিশ্চয়ই বিদেশের মাটিতে।
মুখে সেই চিরাচরিত ঘায়েল করা সরল হাসিটি। ক্যাপশনে লেখা
The real beauty is being able to hold on to your own individuality🫶
সুজানা কম্পিত হাতে ফোনটা উপুড় করে রেখে বলল
মানে কি আমার ফোনে উনার ছবি কেন?
শান্তা ফোনটা নিল ছোঁ মেরে।
গা*ধী পেজে ঢুকেছি তাই। আমার ফোনে উনার ছবি কেন? ঢং।
শান্তা ভেঙচি কাটা দেখে সুজানা তোতলে বলল
তো আমি জানি নাকি?
মেহুল বলল
আরেহ দেখতে দে।
শান্তা চোখ সরু করে চেয়ে ছোট করে বলল
কেন কেন? সাইফ ওয়াহিদ কি জানে?
সাইফ ওয়াহিদ তার জায়গায় সেরা। আর অভিক ফারদিন তার জায়গায় সেরা। সো নো কম্পেয়ার। সাইফ ওয়াহিদ মানেই লাভ । আর অভিক ফারদিন মানেই রেসপেক্ট। বুঝেছিস?
শান্তা ঠোঁট উল্টে বলল
ব্র্যাভো ডিয়ার।
মেহুল হাসলো।
সুজানা বলল
আচ্ছা ফোনটা দিবি?
শান্তা বলল
ধুরর দাঁড়া। কমেন্ট পড়তেছি। শালার লুইচ্চা মাইয়্যাগুলোর দেখতেছি এই ছবির কমেন্টে ঝাঁপায় পড়ছে। শান্তা কমেন্টগুলো জোরে জোরে পড়লো…
স্যার ডুবেছি আপনার হাসির অনন্ত মায়ায়।
স্যার কেরেশ খেইয়্যা গেলুম।
ওই ফর্সা গালে কালো দাঁড়ি ভাল্লাগে 🙈
স্যার আমি রস আপনি মালাই চলেন দুজন বিয়ে করে পালাই🙈
সুজানা আর মেহুল হেসে উঠলো। শান্তা বলল
এসব কোনো কথা? আর স্যার এগুলার একটারেও রিপ্লাই দিল না। বাকিদের দিল। হা হা স্যার লজ্জা পেল নাকি?
সুজানা বলল
ধুরর আর পড়িস না। অসভ্য মেয়ে মানুষ।
শান্তা আর মেহুল হো হো করে হেসে উঠলো। শান্তা বলল
হাহ তোর জ্বলে কেন?
সুজানা বইয়ে মুখ গুঁজে বলল
ফালতু কাজ করার সময় নেই। এমবি কম ভিডিও দেখবি না।
বলেই সে বইয়ে মুখ গুঁজলো। মেহুলও বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল
মানে এরা আমাদের ভার্সিটির স্টুডেন্ট হবে সুজু।
বাদ দে।
শান্তা ছোট্ট করে কমেন্ট করলো
Looking Gorgeous🔥
তারপরেই ফোনটা দিয়ে দিল সুজানাকে।
মোর্শেদ স্যার ক্লাসে এসে জানালেন আজকের ক্লাসটি উনি নেবেন। ফারদিন স্যার আসবেন না।
সুজানা স্বস্তি পেল। ভালোই হয়েছে। কোথাও এখনো ধুকপুক ধুকপুক করছে। কি আজব ব্যাপার স্যাপার ঘটছে আজকাল।
_____
কাট পাহাড়ের রাস্তা আর সবুজ পাহাড়িয়া পথ পেরিয়ে রঙিন শাটলে করে তারা ফিরে এল নিজের শহরে। নিখিল আবারও জানিয়ে দিল সবাইকে তার ভাইয়ের আগত বিয়ের উপলক্ষ সম্পর্কে।
সুজানা, মেহুল আর শান্তা অভয় দিয়ে জানালো যেখানে একজন গিটারিস্ট একজন কবি আরেকজন ক্যামেরা ম্যান থাকে সেখানে তাদের তিনজনের উপস্থিতি থাকবে না এটা কখনো মানা যায় না। তারা অবশ্যই যাচ্ছে।
_______________________
ল্যাপটপে মুখ গুঁজে ইলাস্ট্রেটর দিয়ে ডিজাইন এবং ফটোশপে মকআপ করে ডিজাইন রেডি করতে গিয়ে ঘড়ির কাঁটা সাড়ে তিনটার ঘরে কখন যে চলে গেল খেয়ালই নেই সুজানার। টেবিলের মোটা বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে রাখা যুবককে ডেকে বলল
বলবে না সাড়ে তিনটা বেজে গেল।
সাইফ চোখ তুলে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো।
ডিজাইন কয়টা হলো তোর?
মাত্র সাতটা। রাতে এসে বাকিগুলো করব।
রাতে পড়া। আজ বাদ দে। রেডি হয়ে চলে যাহ।
সুজানা ল্যাপটপ চার্জে লাগাতে যাবে তখুনি সাজিয়া বেগম এলেন। বললেন
কি রে যাচ্ছিস না দেখে ডাকতে এলাম। যাবি কখন?
এই তো হয়ে গেছে আম্মা।
রাশেদা বেগম চায়ের কাপ নিয়ে এসে বলল
চা খাবি না?
সাজিয়া বেগম বারণ করলেন।
না আপা ওর দেরী হয়ে গেছে। টিউশনি থেকে ফিরতে দেরী হবে। চা এসে খাবে।
____________
সুজানাকে আজ একটু দেরীতে আসতে দেখে নাকমুখ কুঁচকে তাকালো মর্জিনা। বলল,,
তোমার কি সঠিক কোনো সময় নাই গো? একেক বার একেক সময়ে আসো।
সুজানা মিষ্টি হাসলো শুধু। মর্জিনা বিড়বিড়িয়ে ভেতরে চলে গেল।
খেলতে থাকা অনা আর আবিদ সুজানাকে দেখে ছুটে এল। আবিদের হাতে পানির প্লাস্টিক টিউব । আবিদ টিউব দেখিয়ে বলল
সুজান পানি দিবি?
অনা তার মাথায় চড় মেরে বলল
চোপপ চোপপ আবি। বুলো দিবে। সুজান পানি দিবে। দিবি বুলেচো কেন?
আবিদ টিউব দিয়ে অনাকে ধপাস করে মেরে বলল
শাতাপ পোঁচা মিয়ে।
সুজানা টিউবটা কেড়ে নিয়ে বলল
স্টপ। দু’জন ঝগড়া শুরু করে দিয়েছেন? কারো সাথে কথা বলব না আমি।
দুজনেই ঠোঁট বেঁকিয়ে তাকালো। অনা মাথায় হাত চেপে বলল
আবি মাচচে।
আবিদ বলল
অনা চোপ চোপ বুলচে। পোঁচা মিয়ে।
সুজানা বলল
আবিদ সাহেব কানে ধরুন। বোনকে আদর করে দিন। সরি বলুন।
অভিক সদর দরজার ভেতর থেকে গলা বাড়িয়ে উঁকি দিল।
জুনিয়র ঝগড়া করছেন আপনারা?
সুজানাকে দেখে ভুরু উঁচালো। সুজানা চোখ সরিয়ে ছোট করে বলল
আবিসোনা কানে ধরো আর সরি বলো বোনকে। বলো।
আবিদ ঠোঁট টেনে চেয়ে রইলো সুজানার দিকে। সুজানা টিউবটি দেখিয়ে বলল
এটা দিয়ে খুব মারব সরি না বললে। হুম।
অভিক ততক্ষণে কিছুটা পাশেই এসে দাঁড়ালো। সুজানা টের পায়নি। আবিদ অভিককে দেখে ঠোঁট টেনে কেঁদে উঠে বলল
সুজান পোঁচা মিয়ে।
সুজানা হেসে উঠতে যাবে তার আগেই ঘটে গেল দুর্ঘটনা। টিউব থেকে গলগলিয়ে পানি বেরোতে থাকলো। অভিক ততক্ষণে ভিজে চুপসে গেছে। সুজানা জিভে দাঁত বসিয়ে টিউব সরাতে সরাতে পানির তোড়ে অভিক জবজবে। সুজানা টিউব সরিয়ে অভিককে পিছু করে দাঁড়িয়ে চোখবন্ধ করে দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে ধরে হাতের মুঠোয় ওড়না চেপে দাঁড়িয়ে রইলো।
অনা আর আবিদ লাফাতে লাফাতে হাত তালি দিল।
ওহ ওহ অভি ভিজি গিছে। সুজান ভিজি দিছে।
একচোখ মেলে সুজানা অভিকের দিকে ফিরলো। অভিক চুল থেকে পানি চেপে ফেলে দিল। হাত দিয়ে মুখ থেকে পানি ঝেড়ে গালের পানি পাশেই কুলি করে সুজানার দিকে তাকালো। সুজানা শুকনো ঢোক গিলে বলল
আমি সরি। দেখতে পাইনি।
টিউবটি থেকে এখনো পানি পড়ছে নীচে। মর্জিনা ছুটে এসে বলল
হায়হায় এটা কি হলো? আমি তো ড্রামে রাখছিলাম নলটা। এখানে কি করে এল? বাবু তুমি ভিজছো কেমনে?
সুজানা নিজের দোষ ঢাকতে দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। অভিক নলটা ড্রামের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখলো। বলল
নলটা ওদের দিয়েছ কেন আন্টি? ওরা এটা নিয়ে মারামারি করছে। সুজানা ওটা মেবি কেড়ে নিয়েছে। আর আমার এই অবস্থা।
মর্জিনা গালে হাত দিল।
ওমাগো সুজানা ভিজায় দিছে?
অভিক মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে ভেতরে যেতেই সালমা বেগম ছুটে এলেন।
এমা অভি কোথায় ভিজেছিস? এসময় কোথায় ভিজতে গিয়েছিস? তুই এখনো বড় হলিনা?
মা মা প্লিজ। আমাকে বলতে দাও। আমি ইচ্ছে করে ভিজিনি। ইনসিডেন্টলি হয়ে গেছে টিউবের পানি পড়ে। আমি এক্ষুণি চেঞ্জ করে আসছি।
পেছন থেকে মর্জিনা বলল
ভাবিজান বাবুরে ওই মেয়েটা ভিজায় দিছে। সুজানা না কিজানা মেয়েটা।
অভিক শুধরে দিল।
কিজানা নয় ওটা সুজানাই হবে।
হ্যা ওটাই।
সালমা বেগম কোমরে হাত দিয়ে বললেন
কেন? ওই মেয়ে না স্যারকে এত লজ্জা পায়। আজ ভিজিয়ে দিতে লজ্জা পেল না?
মমতাজ বেগম আনিকার সাথে এসে পড়লেন তক্ষুণি। বললেন
আহা ছোটবৌমা কেন সবসময় ওই মেয়েটাকে নিয়ে পড়ো তুমি? যাকে ভিজিয়ে দিল তার তো কোনো অভিযোগ নেই। দাদুভাই তোমার কোনো অভিযোগ আছে?
অভিক হ্যা না উভয় জাতীয় ইঙ্গিত ইশারা করে মাথা দুলিয়ে যেতে যেতে বলল
মা কফি চাই।
সালমা বেগম কফি বানাতে ছুটলেন। ছেলেটার ঠান্ডা লেগে যাবে। মেয়েটাকে দেখতে তো অত বোকা-সোকা মনে হয় না তারপর একেকটা অপছন্দের কাজ করে বসবে। অসহ্য।
________________
অনা আর আবিদের সাথে আজ ভারী চেঁচাতে হচ্ছে সুজানাকে। দুজনেই দু’জনের উপর রেগেমেগে তাকাচ্ছে শুধু। পড়ায় মনোযোগ নেই। অনার চাইতে আবিদ বেশি দুষ্টু। বোনকে ঠাসস ঠাসস মারতে তার দ্বিধা নেই। সুজানা গালে হাত রেখে বলল
আপনি যদি বোনকে সরি না বলেন আদর না করেন তাহলে কাল থেকে সুজান আর আসবে না। কখনোই না। বুঝেছেন? সুজানকে আর কখনো দেখবেন না।
আবিদ এবার অনার দিকে তাকালো। আবারও কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। সুজানা বলল
ওকে আমি তাহলে চলে যাই।
চেয়ার নড়ার সাথে সাথে আবিদ অনার কপালের একপাশে লালা লাগিয়ে আদর করলো। বলল
চরি চরি পোঁচা মিয়ে। সুজান আন যাবেনা কেমন?
সুজানা মিষ্টি হেসে বলল
ওয়াও গুড। এভাবে আদর করবেন। বোনকে কেউ মারে?
তন্মধ্যেই সুজানার ফোন বেজে উঠলো। কোনো মেসেজ এসেছে বোধহয়। সুজানা ফোন তুলে নিতেই দেখলো নোটিফিকেশন। নোটিফিকেশনে ট্যাপ করতেই ফেসবুকে নিয়ে গেল। সেখানে নোটিফিকেশনে লেখা আছে ‘ Abhik Fardin replied to your comment “.
মাত্রই দিল। সুজানা কমেন্টটা চেক করতে গিয়ে দেখলো সুজানার কমেন্টের উত্তর দিয়েছে অভিক।
সুজানার আইডি থেকে লিখা
Looking Gorgeous 🔥
আর তাতে অভিক উত্তর দিয়েছে।
Really ! 😒
সুজানার মাথা হেট। উফফ শান্তনি বজ্জা*ত এটা করলো কি?
আর কেমন একটা প্রতিক্রিয়া দিলেন উনি। সুজানা দ্রুত রিমুভ করলো তার কমেন্টটা।
দরজা ঠেলে কফির নিয়ে প্রবেশ করলো অভিক। সুজানার পাশের চেয়ার টেনে নিয়ে বসতেই সুজানা ভীতসন্ত্রস্ত লজ্জিত হয়ে একপলক তাকাতেই অভিক একগাল হাসলো। পকেট থেকে ফোন বের করে মগে চকলেট রঙা আর সাদা মিশেল কফি দেখিয়ে বলল
লুকিং গর্জেস!
সুজানা মাথা নামিয়ে ছোট করেই বলল
আমি বলিনি।
হ্যা জানি। ভূতে বলেছে।
সুজানা জোর দিয়ে বলল
বললাম তো আমি বলিনি।
আমি বললাম তো ভূতে বলেছে।
সুজানা গালফুলা চোখমুখে আঁড়চোখে তাকালো।
অভিক হাসলো আবারও। বলল,,
আমি রস আপনি মালাই চলেন দুজন বিয়ে করে পালাই।
সুজানা চমকে উঠে বললো
অ্যাহ????
অভিক হো হো করে হেসে উঠলো ঘর কাঁপিয়ে। বলল
এটা কমেন্ট ছিল সুজানা।
চলবে,,#আমায়_রেখো_প্রিয়_প্রহরে
#পর্ব_১৭
Writer #পুষ্পিতা_প্রিমা
অভিক উচ্চস্বরে হো হো করে হেসে উঠলো ঘর কাঁপিয়ে। বলল
এটা কমেন্ট ছিল সুজানা।
সুজানা লজ্জিত মুখ ফিরিয়ে নিল। দরজা ঠেলে আনিকা ভেতরে এল। অভিক আর সুজানা দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। আনিকা বলল
সুজানা যাওয়ার সময় ছোটমা আপনাকে দেখা করে যেতে বলেছে। আপনার মা তো অনেক ভালো টেইলারিং জানে। ফুল হাতা ব্লাউজ সেলাই করাতে দেবে নাকি। আমারও কিছু থ্রিপিছ আছে। ওগুলোও নিয়ে যাবেন। কোনো সমস্যা হবে?
সুজানা মাথা দুলিয়ে বলল
না সমস্যা হবে কেন? নিয়ে যাব।
অভিককে মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনতে দেখে আনিকা বলল
হা করে কি দেখছিস? তোকে তোর ভাই ডাকছে।
কেন? কখন ডেকেছে?
আমি কি জানি? বলল অভিকে ডেকে দাও।
অভিক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। যেতে যেতে বলল
সুজানা যাওয়ার আগে আমার সাথে দেখা করে যাবেন।
ও চলে যেতেই আনিকা চেয়ারটা টেনে বসে বলল
ওরা মা ছেলে পেয়েছে আপনাকে।
সুজানা হাসলো। অনা আর আবিদ একবার আনিকা আরেকবার সুজানার দিকে তাকালো। বলল
আম্মু সুজান অভি বুন্ধু বুন্ধু?
আনিকা ফিক করে হেসে উঠলো। বলল
অভি সুজানের টিচার।
দুজনেই ঠোঁট গোল চোখ গোলগোল করে বলল
ওহহহহহহ টিচাররর?
হুমম।
অনা বলল
অভি সুজানকি মারে?
সুজানা হেসে উঠলো। আনিকা গাল টেনে দিয়ে বলল
সুজান দুষ্টুমি করেনা তাই মারেনা।
সুজানা বলল
কেন আমি কি আপনাদেরকে মারি?
আবিদ পেন্সিল থামিয়ে বলল
সুজান বোকা দাও।
আমি বকা দিই?
হু সুজান বোকা দিছে।
আনিকা বলল
বাবারে বাবা আমি যাই। আমি থাকলে একটা পড়াও পড়বে না।
চলে যেতে গিয়ে আবারও একটু থামলো আনিকা। বলল
সুজানা আপনাকে থ্যাংকস। খুব ঠান্ডা মাথার একটা টিউটর খুঁজছিলাম আপনার মতো। অভি সত্যি মানুষ চেনে।
সুজানা হাসলো। আনিকা চলে গেল। আবিদ বলল
সুজান টু নাই।
সুজানা তার খাতা দেখলো। ঘোড়ার ডিমের মতো লেখাগুলো দেখে হেসে বলল
টু লিখলেই তো থাকবে। লিখুন।
আচচা নিখি ।
সুজানা গালে হাত দিয়ে দু’জনের দিকে তাকিয়ে ভাবলো তার কাছেও দুটো প্রশ্নের উত্তর নেই। আম্মা সেলাই কাজ করে উনাদের কে বললো? সে তো বলেনি। তাহলে সাইফ ভাইয়ের সাথে কি স্যারের ডিল হয়েছিল? বাপরে বাপ তাকে আগে থেকে চিনে এই লোক আর সে শাড়ি পড়ে সেগুনবাগিচায় ঢং করতে গিয়েছিল। ছিঃ ছিঃ।
পড়ানো শেষে নীচে গেল সে। আজ দু ছেলের সাথে আজাদ সাহেব আর আজীম সাহেব দুই ভাইয়ের দেখা পেল সুজানা। দু ছেলের সাথে জমিয়ে চায়ের আড্ডা দিচ্ছে। সাথে উনাদের মা জননী তো আছেনই। সুজানাকে দেখে উনাদের খোশগল্পে ভাটা পড়লো। অনা আর আবিদ সুজানার পেছন থেকে দৌড়ে এসে উনাদের কোলে গিয়ে বসলেন। সুজানাকে বলল
সুজান সুজান আসো আসো চা খিতে আসো।
বৃদ্ধা মমতাজ বেগম শুরুতেই হাসলেন সুজানার সাথে।
সুজানাও প্রত্যুত্তরে হাসলো।
এসো এসো বোন। বসো।
না দাদু। আন্টি আমাকে দেখা করতে বলেছেন তাই।
অভিক মনোযোগ দিয়ে ফোন টিপছে।
সালমা বেগম একটা চায়ের কাপ নিয়ে এলেন। আজাদ সাহেবের দিকে কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন
দাদা আপনার চিনি ছাড়া।
আজাদ সাহেব কাপটা নিতেই উনি শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে সুজানার দিকে এগিয়ে এলেন। বললেন
চলো আমার ঘরে। তোমার মাকে বলবে ভালো করে সেলাই করতে ঠিক আছে? তোমার মা তো ভালো কেকও বানাতে জানে। তোমার মাকে বলো কেকের দোকান দিতে।
সুজানা ভারী অবাক হলো। সালমা বেগমের পেছনে যেতে যেতে বলল
আম্মা কেক মাঝেমধ্যে বানায়। ওটা তো আপনিও বানাতে পারেন।
আমার কেক খেয়ে অত প্রশংসা কেউ করবেনা।
কেউ আম্মার প্রশংসা করেছে?
শুনেছি বলেই তো বলছি।
সুজানা নিজেও বুঝে উঠতে পারছেনা কি হচ্ছে তার সাথে। এসব উনাদের কে বলেছে? প্রশ্নটা সরাসরি করাটা কি বেয়াদবি হবে? যে মহিলা বাবা! থাক আবিদের আম্মুর কাছ থেকে জেনে নেবে সে।
সালমা বেগমের পেছন পেছন উনার ঘরে গেল সুজানা। কি গোছানো রুমটা! ফ্লোরটা ঝকঝকে তকতকে। বিছানার চাদরটা একটুও কুঁচকানো নেই। ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটাও পরিষ্কার। পাপশটাও অমলিন। আম্মা তাকে বলেছে ঘরের এই জিনিসগুলো যাদের পরিষ্কার তাকে তারা খুবই শুচিসুদ্ধ। এই মহিলাও তেমন।
সুজানাকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সালমা বেগম বললেন
কি হলো আসো।
সুজানা জুতো খুলে রুমে পা রাখলো। সালমা বেগম আলমিরা থেকে দুটো ব্যাগ বের করলেন। বিছানার উপর রেখে বললেন
বসো। সব বলে বলে করাতে হয় কেন?
সুজানা মাথা নামিয়ে নিল। ওকে এক নজর দেখে শপিং ব্যাগ থেকে ব্লাউজের কাপড় গুলো বের করলেন সালমা বেগম। বললেন
এখানে চারটা ব্লাউজের কাপড় আছে। একটা আস্তর দিয়ে আর তিনটা সুতির। দুটো ফুল হাতা আর দুটো ত্রি কোয়াটার। বুঝেছ? সেলাই করা একটা দিলাম ওটা থেকে মাফ নিতে বলবে। বেশি লুজ না বেশি টাইট না। সেম এই মাফের।
সুজানা মাথা দুলালো। উনি বললেন
তুমিও তোমার মা থেকে শিখে নিলে তো পারো।
আমি পারি আন্টি। পড়াশোনা আর এদিকওদিক দৌড়াদৌড়ির জন্য হয়ে উঠেনা।
বাহ তাহলে ভালোই। কেকও বানাতে পারো?
আম্মার মতো করে ডেকোরেশন করতে পারিনা। বেকিং করতে পারি।
আচ্ছা। অভির বিয়ের কেকটা তোমার মাকে দিয়ে করাবো আমি।
সুজানা মাথা নাড়ালো।
আচ্ছা।
আনিকা চলে এল কয়েকটা ব্যাগ নিয়ে। তার সাথে অনা আবিদও এসেছে। আনিকা ব্যাগগুলো বিছানায় রেখে বলল
ওমা এতগুলো ব্যাগ সুজানা নিয়ে যাবে কি করে?
কেন ও তো গাড়ি করে যাবে। এই মেয়ে পারবেনা নিয়ে যেতে?
পারব।
আনিকা ব্যাগটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
তিনটা লিনেন ত্রিপিছ আছে এখানে। এগুলো বাসায় পড়ব। মাপেরটাও দিয়েছি। ওটার মতো করে সেলাই করলে হয়ে যাবে। আর সেলোয়ারের মুহুরী ৬ ইঞ্চি। ব্যস।
আচ্ছা।
আর শোনেন অভি কিছুদিন আগে কতগুলো লেইস কিনে নিয়ে এল। এগুলো আপনি নিয়ে যান আপনার মায়ের কাজে লাগবে।
সুজানা সেগুলো দেখে বলল
স্যার এগুলো অনার জন্য কিনেছে।
তো? এগুলো কি খেলনার জিনিস যে অনা এগুলো নিয়ে খেলবে।
সালমা বেগম কপাল চাপড়ে বললেন
দেখেছ, কিছুদিন পর নিজেই বাচ্চার বাপ হবে আমার এই ছেলেটার কান্ডজ্ঞান কখন হবে কে আল্লাহ মালুম। এগুলো খেলনার জিনিস!
সুজানা বলল
না, এগুলো তো কাপড়ে লাগানোর জন্য কিনে…
তুমি তোমার স্যারের হয়ে কথা বলোনা মেয়ে। ও আমার ছেলে বুঝেছ? ওকে আমি হাড়েহাড়ে চিনি। আমার কাছ থেকে দূরে ছিল তো। তাই এরকম হয়েছে। বাপে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে সুশিক্ষিত করছে। আর এদিকে মায়ের কাছ থেকে দূরে থেকে আমার ছেলেটা হাবাগোবা হয়ে ফিরে এসেছে।
সুজানার হাসি পেলেও সে হাসলো না। তবে আনিকা হেসে উঠে বলল
ছোটমা তোমার ছেলেকে দেখতে অমন লাগে। ও আসলে তেমনটা নয়।
কি বলতে চাইছো আমি ওকে বুঝিনা?
না না ছোটমা সেটা বলতে চাইনি। অভি যথেষ্ট চালাক কেন হাবাগোবা বলো আমি সেটাই বুঝিনা। তুমি মা তো মায়ের কাছে সব ছেলেমেয়েই হাবাগোবা বোকা এটা ওটা। আম্মাও তো আমাকে বলতো আমি কাজ পারিনা, করিনা, কথা শুনিনা। কিন্তু তুমি বলো আমি কি কাজ পারিনা? করিনা? কথা শুনিনা?
শুনো শুনো। তো? তোমার মা ভুল বলে আমিও ভুল বলব নাকি?
আনিকা এবার হতাশ হলো। বলল
আচ্ছা আচ্ছা তুমি ঠিক।
হ্যা। ভুল হব কেন? নইলে তোমার কাকার মতো বজ্জাত লোকের সাথে সংসার করতে পেরেছি?
হুমম বুঝতে পেরেছি।
আর শোনো আমার অভি অতটা হাবাগোবা নয়, আমি ওগুলো এমনিই বলি। ওগুলো শুনলে আমার ছেলে কষ্ট পাবে। ভাববে মা আমাকে এসব ভাবে!
বলেই উনি চলে গেলেন। উনি যেতেই সুজানা আর আনিকা হাঁফ ছাড়লো।
ছোটমার কথা বলবেন না সুজানা। সারাক্ষণ এভাবেই বলে। কিন্তু কাকাই এই পাগল মহিলাটাকে কতটা চোখে হারায় জানেন? ঘরও নাকি ছেড়েছিল। উনাদের বিয়ের আগে নাকি কি যুদ্ধ বাড়িতে।
কি বলেন?
হুমম। লাভ ম্যারেজ।
বলেই ফিক করে হাসলো আনিকা।
সুজানা লজ্জা পেয়ে গেল।
এমা আপনি লজ্জা পাচ্ছেন, এই যা আর বলব না। আপনি এখনো আমার সাথে ফ্রি হতে পারেননি।
তেমনটা না।
আচ্ছা বাদ। লেইসগুলো নিয়ে যান। আন্টিকে দিয়ে দেবেন। দেখবেন উনি কাজে লাগিয়ে নেবেন।
সুজানা মাথা নাড়িয়ে বলল
আচ্ছা উঠি। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
হ্যা।
________________
রাত দশটার ঘরে ঘড়ির কাঁটা। ভেতর রুম থেকে হৈচৈ আসতেই সাজিয়া বেগম কাপড় কাটা বাদ রেখে সেদিকে গেলেন। সুজানা রোজা আর সায়েম লুডু খেলছে। সুজানাকেও বাচ্চাদের মতো খেলতে দেখে সাজিয়া বেগম হাসলেন। সুজানা দরজার কাছাকাছি মাকে দাঁড়াতে দেখে বলল
কিছু বলবে আম্মা?
উনি মাথা নাড়ালেন দু’পাশে।
সুজানা হাসলো। বলল
আজ বকোনা। আর সাইফ ভাইকে বলোনা। শুধু আজকে খেলছি। নইলে ওদের পিটাবে।
ঠিক আছে। রুজু আজকে তোর আপার সাথে খেয়ে যাস। চিংড়ি রেঁধেছি।
সত্যি! উফ ভাইয়া আর মায়ের জন্য বাসায় চিংড়ি ও আনেনা আব্বা।
সায়েম বলল
তোর লালা পড়া শুরু হয়ে গেছে না? রাক্ষসী।
রোজা গাল ফুলিয়ে তাকালো। সুজানা বলল
এই চুপ। তোদের সারাক্ষণ ঝগড়া!
সাজিয়া বেগম বললেন
ওর সাথে ঝামেলা না করতে কতবার বারণ করেছি বাবু?
সায়েম মাথা নামিয়ে খেলায় মনোযোগ দিল।
খেলা শেষ হলে এদিক আসিস সুজু।
ওকে আম্মা। যাচ্ছি এক্ষুণি।
খেলা শেষ হতেই সুজানা মায়ের কাছে গেল। উনি কাপড় কাটছেন। সুজানা কুঁচকে যাওয়া কাপড়টা মেলে দিয়ে বলল
যার ব্লাউজ এনেছি উনি কি বললেন জানো আম্মা? বলেছেন তোমাকে কেকের দোকান দিতে।
সাজিয়া বেগম হাসলেন। সুজানা বলল
আচ্ছা আরেকটা কথা আম্মা। উনারা কি করে তোমার সম্বন্ধে এতকিছু জানেন? উফফ আমি এত কথা ভুলে যাই কেমনে। ওই বাড়ি থেকে জপে জপে আসছিলাম এই প্রশ্নটা। কেমনে চেনে আম্মা?
তোর খাতিরে চেনে।
আমার খাতিরে? কিভাবে? আমি তো বলিনি কিছু।
কেন বলিসনি। খারাপ লাগে?
মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো সুজানা।
কিসব বলো আম্মা। তুমি আমার চোখে সেরার সেরা। আমি তো গর্ব করি তোমাকে নিয়ে।
উনি হাসলেন মেয়ের কথায়। হাত বুলিয়ে চুলে চুমু খেলেন। বললেন
হয়েছে।
না বলো কেমনে চেনে।
সময় হলে বলব।
কেন এমন করছ আম্মা। বলোনা বলোনা।
সুজানা অধৈর্য মানুষ আমার পছন্দ না।
এবার মাকে ছেড়ে দিল সে। পাণ্ডুর মুখটা দেখে মায়ের মন ব্যাথিত হলো বোধহয়। তাই বললেন
তুই যাদের পড়াস, ওদের মামার বাড়ি থেকে তোর জন্য সম্বন্ধ এসেছে।
সুজানা রুষ্ট ক্ষিপ্ত কান্নামুখর চোখে মায়ের দিকে চাইলো।
কি হয়েছে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?
সম্বন্ধ এল আর হ্যা বলে দিলে? ভালো। খুব ভালো। কাল থেকে পড়াশোনা চাকরি টিউশনি সব বাদ। শুধু বিয়ের পিঁড়িতে বসব আমি।
মায়ের কথা না শুনে হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো সুজানা।
চলবে…
রেগুলার হওয়ার চেষ্টায় আছি
ছোট হলেও রেগুলার পাবেন।
পরে রিচেক করব পাঠক।
ভালোবাসা ❤️❤️❤️