আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে পর্ব -২৪

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(24)

একহাতে শাড়ির কুঁচি উঁচু করে সাবধানে ছাদে উঠছে নূর। আদিলের কাজিনরা আজ হুট করেই এসে উপস্থিত হয়েছে সবাই। উদ্দেশ্য ডিসেম্বরের ছুটিতে সবাই একসাথে সময় কাটানো। বিকেল থেকেই বেশ ব্যস্ত হাতে সবটা সামলাচ্ছে নূর। সন্ধ্যে হতেই সবার জোরাজোরিতে ছাদের আড্ডায় শামিল হতে হয় নূরকে। ছাদের কাছাকাছি আসতেই হটাৎ শাড়িতে টান অনুভব করে নূর। টাল সামলাতে গিয়ে আছড়ে পরে কারোর বুকে।

জোরে জোরে শ্বাস টানার মাঝে অনুভব করলো চেনা এক পারফিউমের ঘ্রান। হৃদ গতি কয়েকগুণ বেড়েই গেলো তার। ভয়ের তীব্রতা এত প্রখর ছিলো যে নূর এখনও দুই হাতে আদিলের বুকের দিকের শার্ট খাঁমচে ধরে আছে। খোলা চুল দিয়ে ঢেকে আছে পুরো মুখ। অনুভূতির তীব্র আনাগোনার মাঝে অনুভব হলো কোমরের দুইপাশে শীতল কিছুর। মুহুর্তেই মস্তিষ্ক হতে জানান দিলো সেই শীতল ছোঁয়ার মালিক তার সামনেই। লজ্জায় কোনোকিছু না ভেবেই নূর দৌড় দিলো ছাদের দিকে।

“তুমি ঠিক আ……..
এই যাহ চলে গেলো”

হতাশার নিশ্বাস ফেলে সেদিকে এগিয়ে গেলো আদিলও। মুখে লেগে থাকা হাসির রেশ জানান দিচ্ছে বেশ কিছু কথার, কিছু না বোঝা অনুভূতির।

“যদি বৃষ্টি হতাম, তোমার দৃষ্টি ছুয়ে দিতাম,
চোখে জমা বিষাদ টুকু, এক নিমিষেই ধুয়ে দিতাম,
মেঘলা বড়ন অঙ্গ জুড়ে, তুুমি আমায় জড়িয়ে নিতে.!
কষ্ট আর পারতো না, তোমাকে অকারণে কষ্ট দিতে।”

প্রেম হল এমন একটি সুন্দর অনুভূতি যা চোখে দেখা যায় না বা কথায় প্রকাশ করা যায় না। প্রেম হলো কারো প্রতি ভালো লাগার অনুভূতি। ভালোবাসা ও প্রেম কাছাকাছি শব্দ হলেও এর মধ্যে পার্থক্য বিশাল। মানুষ প্রথমে প্রেমে পড়ে তারপর সেটা ভালোবাসায় রূপ নেয়। প্রেম হয় বহুবার। এক জনমে বহুবার প্রেমে পড়া যায়, তবে ভালোবাসা! সেটা একজনেই সীমাবদ্ধ।

ডিসেম্বরের ঠাণ্ডায় সবার প্রায় কাহিল দশা। তারপরও আড্ডা থেমে থাকার নাম নেই। চাদর গায়ে দিয়ে বনফায়ারের সামনে বসে মেতে উঠেছে সবাই বিভিন্ন কথোপকথনে। দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে, গায়ে চাদর জড়িয়ে বসে সবার কার্যকলাপ লক্ষ্য করে যাচ্ছে নূর। ঠান্ডার ফলে আদিলের বেশ গা ঘেঁষেই বসেছে সে। আড্ডার মাঝে সকলে আবদার করে উঠলো আদিলকে একটা গান গাওয়ার জন্য। বেশ কয়েকবার বারণ করার পরেও সবাই নাছোড়বান্দা। সবার কথার মাঝে হার স্বীকার করে গায়ের চাদরটা আরো আঁটোসাঁটো করে খালি গলায় কেশে উঠলো আদিল। সবার দৃষ্টি বর্তমানে আদিলেই নিবদ্ধ। মূখে মুচকি হাঁসি ফুটিয়ে তুলে একপলক নূরের দিকে তাকালো আদিল, অতঃপর…..

“অবাক চাঁদের আলোয় দেখো
ভেসে যায় আমাদের পৃথিবী
আড়াল হতে দেখেছি তোমার
নিষ্পাপ মুখখানি

অবাক চাঁদের আলোয় দেখো
ভেসে যায় আমাদের পৃথিবী
আড়াল হতে দেখেছি তোমার
নিষ্পাপ মুখখানি

ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়
বুঝিনি কভু সেই মায়াতো আমার তরে নয়
ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়
বুঝিনি কভু সেই মায়াতো আমার তরে নয়

ভুলগুলো জমিয়ে রেখে বুকের মণিকোঠায়
আপন মনের আড়াল থেকে
ভালবাসবো তোমায়
ভালবাসবো তোমায়

তোমার চিরচেনা পথের ঐ সীমা ছাড়িয়ে

এই প্রেম বুকে ধরে আমি হয়তো যাবো হারিয়ে
চোখের গভীরে তবু মিছে ইচ্ছে জড়িয়ে
একবার শুধু একটিবার হাতটা দাও বাড়িয়ে
তোমার চিরচেনা পথের ঐ সীমা ছাড়িয়ে
এই প্রেম বুকে ধরে আমি হয়তো যাবো হারিয়ে
চোখের গভীরে তবু মিছে ইচ্ছে জড়িয়ে
একবার শুধু একটিবার হাতটা দাও বাড়িয়ে

ডাকবেনা তুমি আমায় জানি কোনোদিন
তবু প্রার্থনা তোমার জন্য হবেনা মলিন
হবেনা মলিন……

ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়
বুঝিনি কভু সেই মায়াতো আমার তরে নয়
ভুলগুলো জমিয়ে রেখে বুকের মণিকোঠায়
আপন মনের আড়াল থেকে
ভালবাসবো তোমায়
ভালবাসবো তোমায়

হাজার বছর এমনি করে
আকাশের চাঁদটা আলো দেবে
আমার পাশে ক্লান্ত ছায়া
আজীবন রয়ে যাবে
তবু এই অসহায় আমি
ভালবাসবো তোমাকে
শুধু যে তোমাকে
ভালবাসবো তোমাকে”
________________

বারবার ফোন হাতে নিয়ে অরুনিকাকে কিছু লিখচে আবারো মুছে ফেলছে আদাভান। গত ত্রিশ মিনিট ধরে একই কাজ করে যাচ্ছে। শেষে নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হয়ে বেডের উপড় ছুঁড়ে মারলো ফোনটা। রাগ, কষ্ট, অভিমান সব মিলিয়ে যেনো পাগল পাগল লাগছে আদাভানের। অনেক চেষ্টা করেও অরুনিকাকে আসল সত্যিটা জানাতে পারছেনা সে। এদিকে দিনের পর দিন ভুল বুঝে দূরে সরে যাচ্ছে অরুনিকা।

কাব্যের জোরাজোরিতে বেশ কিছুদিন পর আজ বাইরে বেরিয়েছে অরুনিকা। পার্কের একটা বেঞ্চে দুজনে বসে থাকা অবস্থায় কাব্যকে কিছু না বলেই কিছু একটা লক্ষ্য করে সামনে এগিয়ে যায় অরুনিকা। হটাত করে আবহাওয়ার বদলে অসময়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে আসে ধরনীর বুকে। কিছুদূর এগিয়ে কয়েকটা বাচ্চাকে দেখে তাদের সাথে বৃষ্টিবিলাস করতে নেমে পড়ে অরুনিকা। কয়েকমুহূর্তের মধ্যেই তারাও বেশ আপন করে নিয়েছে অরুনিকাকে। দুই থেকে এই দৃশ্য দেখে ব্যাস্ত পায়ে এগিয়ে এসে তাদের সাথে যোগ দেয় কাব্যও। বৃষ্টির তালে তালে ছন্দহীনভাবে নেচে চলেছে সবাই। বাচ্চাদের সান্নিধ্যে এসে এতক্ষনের মন খারাপ গায়েব হয়ে মনের মাঝে জমা হয় ভালোলাগার স্রোত।

দূর থেকে কাব্য আর অরুনিকাকে একসাথে এতো কাছাকছি দেখে চোখ লাল হয়ে আদাভানের। রাগে শরীর জ্বলে উঠছে আদাভানের। একটা কাজে এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় হটাত বৃষ্টির কারনে দাড়িয়ে পড়ে আদাভান। পাশের কোথাও থেকে হইহট্টগোলের শব্দে সেদিকে তাকিয়ে অরুনিকাকে দেখে অবাক হয়। এতদিনের তৃষ্ণার্ত প্রেমীক দুচোখের তৃষ্ণা মেটায় নির্নিমেষে। একবারও চোখের পলক ফেলেনি আদাভান। অরুনিকার হাঁসির ঝঙ্কার বুকে গিয়ে বিঁধে তার। আশেপাশে খেয়াল হতেই কাব্যকে দেখে এতক্ষনের ভালোলাগা এক ভয়ঙ্কর প্রলয়ের রুপ নেয়।

“সুযোগ এসেছে আজ, শেষবার আকাশ দেখার
দেহের কী দাম আর। সে তো শুধু মালিক, ছায়ার।”

আড়াল হতেই আড়ালে চলে গেলো আদাভান। একবারের জন্যও দেখা দিলোনা অরুনিকাকে। হাহাকার করা দুই চোখের তৃপ্তি নিয়েই ফিরে গেলো সেখান হতে। সাথে নিয়ে গেলো এক বুক বেদনা। প্রিয় মানুষকে একটু একটু করে হারিয়ে ফেলার বেদনা দুর্বিষহ। ডান হাতের তালু দিয়ে বুকের বামপাশটা হালকা মালিশ করতে মাথা নিচু করে রাস্তায় হাঁটছে আদাভান। বুকের বাম পাশের চিন চিন করা ব্যাথাটা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

“মন ভাঙ্গলে চোখের কোনে আছড়ে পড়ে ঢেউ,
বুকে কতটা কান্না চাপা থাকে, জানতে পারেনা কেউ।”

অভিমানে সিক্ত পাহাড় বুকে চেপে নিয়ে রূমে প্রবেশ করলো আদাভান। বহুদিন পর ধপ করে শুয়ে পড়লো খাটের মাঝে। মাথার নীচে বাম হাত ঠেস দিয়ে মগ্ন হয়ে গেলো প্রাণপ্রিয়ার চিন্তায়।

“আমাকে পুড়িয়ে বেশ সুখেই তো আছো প্রাণপাখি। ভালোবাসার অঙ্গারে জ্বলে পুড়ে ছারখার তবে শুধু আমিই হলাম।”

আদাভান চলে যেতেই ফিচেল হাঁসি হাসে কাব্য। মূলত আদাভানকে দেখেই ব্যাস্ত পায়ে এগিয়ে এসেছিলো অরুনিকার কাছে। সাথে ইচ্ছেকৃত ঘটানো কিছু ঘটনার শিকারে দুজনের মাঝে ভুলবোঝাবুঝির সময় দীর্ঘায়িত করাই ছিলো কাব্যের মূল উদ্দেশ্য। নিজের উদ্দেশ্য সফল করে বিজয়ীর হাঁসি হাসলো সে।

বাচচাদের সাথে সময় কাটানোর মুহূর্তে কাব্যের পা বেঁধে পড়ে যেতে গিয়ে তার শার্ট খাঁমচে ধরে অরুনিকা। সুযোগের সদব্যাবহার করার উদ্দেশ্যে আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনার রেশ ধরে অরুনিকার কোমর আঁকড়ে ধরে কাব্য। এটাকে সামান্য অ্যাকসিডেন্ট ভেবে মুচকি হেঁসে আবারো নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে অরুনিকা। খানিকটা দূরত্ব থাকায় আদাভানের চোখে দুজনের দুজনকে আঁকড়ে ধরার মুহূর্ত ছাড়া আর কিছুই বোঝা সম্ভব হয়নি। দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ঘটে যাওয়া ভুলবোঝাবুঝির রেশ ধরেই রাগের মাত্রা নিদারুণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিলো আদাভানের।

“কেনো বারবার আমাকে আঘাত দাও প্রেয়সী। খুঁতটা আমার ভালোবাসায় নাকি ভালোবাসার মানুষে!”

“আঘাতে আঘাতে জর্জরিত এই জীবনে একটু সুখের নেশায় তোমাকে চেয়েছিলাম। একটু সুখের নেশায় আমি যে দুঃখের অতলে তলিয়ে গেলাম প্রাণপাখি। এই দুঃখের শেষ কোথায়? লড়াই করে বাঁচতে বাঁচতে আমি ক্লান্ত। এই ক্লান্ত পথিকের দিন শেষে বাড়ী ফেরার ঠিকানা হিসেবে খুঁজে নিয়েছিলাম তোমায়। তবে তুমিও কি ঘরহারা করলে? কেনো সবাই আমার থেকে দূরে চলে যায়? কেনো বারবার হারানোর যন্ত্রনা দাগ কেটে যায় আমার মনে? আমাকে নিঃস্ব করার কেনো এত আয়োজন সবার? প্রাণপাখি, তোমাকে ভালো রাখতে গিয়েই যে আমি তোমার থেকে এত দূরে। আমার সংস্পর্শ তোমার জীবন সংকটের জন্য দায়ী হয় তবে দূরে থাকাই শ্রেয়। কোনোকিছুই তোমার জীবনের চেয়ে দামী তো নয়। শুধু মনে রেখো আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমি শুধু তোমার। আমার দেহের শেষ র*ক্তবিন্দু দিয়েও পারলে আমি তোমার জন্য সুখ কিনে রেখে যাবো। ”

ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিয়েই ঘুমের নগরীতে পাড়ি জমালো আদাভান। এই শান্তির নগরীতে একটু সুখ আর শান্তির খোঁজে বেরিয়ে পড়লো সে। সাথে বিড়বিড় করে আওড়ালো হতাশামিশ্রিত কিছু শব্দ।

“বেঁচে থাকাটাই আজ উৎসব।”

চলবে?
#Fiza_Siddique

রাগ করেছেন কি সবাই? এই পর্যন্ত গল্পটা কেমন লাগলো জানাবেন। আর গল্পের মধ্যে কি কিছু রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন নাকি? আমার ঠান্ডায় আবার নাক বন্ধ, আপনারা গন্ধ পেলে একটু জানিয়েন আমাকে🤧

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here