আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে পর্ব -২৯

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(29)

দীর্ঘ সাত বছর পর রোজকে দেখে চমকে ওঠে অরুনিকা। সুন্দর এক মুহুর্তে হঠাৎ করেই অতীত হানা দেয় যেনো। খুশিতে ভরপুর মুখ চুপসে কেমন এক আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।

দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী হিসেবে একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজনে হঠাৎ করে রোজের আগমন থমথমে এক পরিবেশের সৃষ্টি করে। রুবিনা বেগম আর তাহসান সাহেবও বেশ হতবাক। সবারকে স্বাভাবিক করতে আদাভান হালকা কেঁসে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। থমথমে পরিবেশে হালকা কাশির শব্দও যেনো বিকট ঠেকে অরুনিকার কানে।

“মিট টু মায় ফ্রেণ্ড, আমার অনেকবছর আগের ফ্রেন্ড রোজেলা মাহমুদ।”

“রোজি আপু”

ছলছলে দৃষ্টিতে রোজের দিকে তাকিয়ে আছে অরুনিকা। বহুবছর পরে মনে পড়ে যাচ্ছে বর্ষার কথা। মনের ক্যানভাসে ছবির আকারে ভেসে উঠছে রোজ, বর্ষা আর অরুর একসাথে কাটানো সময়গুলো। অনেকগুলো বছর পর আবারও দুচোখ ভিজে উঠছে বর্ষার স্মৃতিতে। উষ্ণ শুষ্ক মরুভূমির ন্যায় খা খা করছে বুকটা। বুকের বামপাশে ব্যাথা অনুভূত হতেই একহাত বুকে রেখে সামান্য পিছিয়ে যায় অরুনিকা। পিছাতে পিছাতে অবশেষে পিছনে দাড়ানো পুরুষটার বুকে গিয়ে ঠেকেছে অরুনিকার পিঠ। খানিক মুহূর্তও ব্যয় না করে পিছন ঘুরে জাপ্টে ধরে আদাভানকে।

“আদাভান, ব ব বর্ষা আপু! আমার বর্ষা আপু, আমার চাই। আপুকে চাই।”

“শান্ত হও অরু। এভাবে কান্না করেনা। দেখি আমার দিকে তাকাও।”

আদাভানের কোমল কণ্ঠের আদরে বোধহয় কাজ হলো। নিষ্প্রাণ চোখে তাকালো অরুনিকা।

“আমি জানি তুমি বর্ষাকে অনেক ভালোবাসো। আর এটাও জানি তোমার রোজি আপুকেও অনেক ভালোবাসো। যারা চলে যায় তাদেরকে তো ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা আমাদের নেই, তবে যারা আছে তাদের কষ্ট কেনো দিই?”

” রোজ যেদিন থেকে তোমার কথা শুনেছে বারবার ছটফট করেছে তোমাকে দেখার জন্য। আমার কথামতো আজকে বিশেষ দিনে এসেছে অনেক দূর থেকে শুধু তোমার জন্য অরু।”

আদাভানের কথায় মাথা নীচু করে পিছন ঘুরে একবার তাকালো অরুনিকা রোজের দিকে।

“আই অ্যাম সরি রোজ আপু। অনেক মিস করেছি আমি তোমাকে। আপু চলে যাওয়ার পর আর কখনো কারোর সাথে যোগাযোগ করতে ইচ্ছে করেনি, তবে আমার মনে সবসময় বর্ষা আপুর পরে তোমার স্থান ছিলো, আছে আর থাকবে সারাজীবন।”

“পুষি এটা কিন্তু ঠিক না, আমি তোর রোজি আপু, একদম রোজ বলবিনা। এইটুকু এক পিচ্চি, সেদিনই তো আমার কোলে চড়ে এটা ওটা বায়না করতো, কেঁদে কেটে ভাসিয়ে ফেলেছে দেখো। এজন্য পিচ্চি মেয়েকে বিয়ে করতে নেই বুঝলি আদাভান।”

“তো তোর মতো বুড়া বেটাকে বিয়ে করতাম নাকি?”

“মেরে একদম চেহারা বিগড়ে দেবো তোর, আয়ুশ যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। অন্তত তোর থেকে তো বেশিই, হুহ।”

“যা যা দূর হ। তোর ওই লাল হনুমানকে নিয়ে বিদেশেই ঠিক আছিস তুই। এদেশে আসলে সবাই তোদের দেখে বাপ মেয়ে বলবে।”

“আদাভান। ভালো হচ্ছেনা কিন্তু। মানছি ও একটু বেশি ফর্সা তাই এমন লাগে, তাই বলে তুই বুড়া বলবিনা একদম আয়ুশকে। নাহলে তোর একদিন কি আমার মুখে একদিন।”

“ভূরা মিনস খি রোজ?”

দুজনের খুনসুটি দেখে অরুনিকার মন কিছুটা ভালো হয়ে যায়। সত্যি তো যারা চলে গেছে তাদের জন্য বর্তমানে যারা আছে তাদের কষ্ট দেওয়া উচিত নয় একদম। সবার মিটিমিটি হাঁসির মাঝে হঠাৎ উপস্থিত হয় এক মাঝবয়সী ধবধবে ফর্সা লোক। পরনে ফর্মাল ড্রেস।

“আরে আয়ুশ তোমার বয়স অনেক বেশী বলছে আদাভান।”

“হোয়াট? হামার এজ বেশি? আই অ্যাম টু ইয়াং হানি।”

“আমি জানি তো, কিন্তু এই বাঁদরটা মানতে চাইছেনা।”

“হেয় আড্ডাভ্যান, ব্রো…….”

আদাভানের নামের বিকৃতি দেখে হা হা করে হেঁসে ওঠে অরুনিকা। হাঁসতে হাঁসতে পেটে ব্যাথা শুরু হলে, পেট চেপে ধরেই হাঁসতে থাকে।

“আড্ডাভ্যান, বাহ দারুন নাম দিয়েছে আপনার আদাভান।” বলেই আবারো হাসতে থাকে। সাথে যোগ দেয় বাড়ির সবাই।

অসহায় চোখে একবার অরুনিকার দিকে তাকায় আদাভান। কিছুক্ষন আগের অরুনিকার কান্না ভেজা চোখের বদলে এখনকার হাঁসির ঝিলিক দেখে নিজেও হেঁসে ওঠে।

“তোমার এই হাঁসির জন্য আমি সবার কাছে জোকারও হয়ে যেতে পারি প্রিয়।” বিড়বিড় করে কথাটা বলে রোজের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায় আদাভান। আদাভানের তাকানোর ভাষা বুঝে শুকনো ঢোক গেলে রোজ। যার অর্থ, এবার তুই শেষ রোজ।

বেশ জাকজমকের মধ্যেই অনুষ্ঠান শেষ হয়। অনুষ্ঠান শেষে রোজ চলে যেতে নিলে দুজনের অনুরোধে আদাভানের বাড়িতেই থেকে যেতে হয় তাদের।
_________________

বন্ধুদের সাথে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রেস্টুরেন্টে এসেছে আজ অরুনিকা। মূলত আদাভানের নতুন কলেজের কাছে রেস্টুরেন্টটা হওয়ায় প্ল্যান করে বোরখা পড়েছে। সবাই মিলে বেশ হাসি ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে লাঞ্চ কমপ্লিট করে বেরিয়ে যেতে গিয়ে আদভানকে সেখানে দেখে বেশ খুশি হয়ে যায় অরুনিকা। সবাইকে বিদায় জানিয়ে আদাভানের উদ্দেশ্যে আসতেই রোজকে দেখে অবাক হয়ে যায়। দুজনে একই বাড়ীতে থাকার সত্ত্বেও আলাদা করে এভাবে একসাথে আসাটা কেমন যেনো দৃষ্টিকটু ঠেকে অরুনিকার কাছে। কোনো বিশেষ দরকার হলে সেটা তো বাড়িতেও করা যেত, তবে আলাদা করে সবার আড়ালে কি কাজ!

কৌতুহলবশত দুজনের পিছনের টেবিলে গিয়ে বসে অরুনিকা। আদাভান দুজনের জন্য কফি অর্ডার করে আশেপাশে তাকিয়ে রোজকে বলে,

“অরুকে এসব ব্যাপারে কিছু জানাবোনা বলে আমি এখানে আসতে বললাম। ওকে বলেছি আমার জরুরি কিছু কাজ আছে, ফিরতে দেরি হবে।”

“ভালই করেছিস। অরু এগুলো জানলে অনেক কষ্ট পাবে।”

” বর্ষার মৃত্যুর ব্যাপারে আজ পর্যন্ত আমি কিছু জানতে দিয়নি। ওর সামনে এভাবেই থেকেছি যেনো বর্ষাকে আমি চিনিনা। একমাত্র তুই জানিস এসব কিছুর মধ্যে আমি কিভাবে জড়িত। এতগুলো বছরের অপেক্ষা শুধু বর্ষার বোকামির জন্য ভেস্তে গেছিলো। অনেক কষ্টে নিজের করেছি অরুকে। বর্ষা এভাবে হেরে গিয়ে চলে যাবে আমি বুঝিনি, নাহলে শেষ করে ফেলতাম ওই শয়তানকে যেভাবে হোক।”

ব্যাস এটুকু শুনেই সেখান থেকে বেরিয়ে যায় অরুনিকা। চারিদিকের সবকিছু অন্ধকার লাগছে অরুনিকার কাছে। মনের মাঝে একটা জিনিস বারবার উঁকি দিচ্ছে, “বিশ্বাসঘাতক”।

দুজনে বেশ কিছুক্ষন কথা বলে বেরিয়ে যায় একসাথে। এদিক অরুনিকাকে এতো তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে দেখে এগিয়ে এলেন আনিকা আহসান। ঠিক আছে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই কোনরকমে হ্যাঁসূচক উত্তর দিয়েই নিজের রুমে চলে যায় অরুনিকা। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছেনা। একটা মানুষ এতটা নিখুঁত অভিনয় কিভাবে করতে পারে? দুটো বছর এক রুমের মধ্যে একই বিছানায় থেকেও কি মানুষের চরিত্র বোঝা যায়না? দুজনের মধ্যে কিয়ৎ পরিমাণ দূরত্ব ছিলোনা কখনও, তারপরও কিভাবে চিনতে পারলোনা আদভানকে?

“ভুলটা আমার নাকি আপনার আদাভান? ভুলটা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাসের নাকি পিছন থেকে ছুরি চালানো মানুষের? আমার কোন ভুলের শাস্তি দিলেন আপনি? নিঃস্বার্থ ভালোবাসার নাকি অতিরিক্ত বিশ্বাসের, কোনটার শাস্তি আপনি দিলেন? ঠিক এতগুলো টুকরোতে ভেঙ্গে ফেলার জন্যই কি এতদিন সামলে রাখতেন? আপনার আসল চেহারা যে আজ আমি দেখে ফেললাম। দেখে ফেললাম মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হিংস্র মনোভাব। কেনো আদভান কেনো? আমাকে কি মানুষ মনে হয়না আপনার, কেনো এতোটা আঘাত দিলেন আমাকে? বিয়ের পর থেকে মনে প্রাণে চেয়ে এসেছি আপনি যেনো সেই মানুষটা না হন। ভীষণ ভালোবাসি যে আপনাকে, খুনটাও শান্তিমতো করতে পারবোনা। আপনাকে মেরে ফেললে জিতে গিয়েও হেরে যাবো যে আমি। হারাবো আমার অস্তিত্ব। কেনো আপনাকে একবুক ভালোবাসার পরিবর্তে আমাকে এক আকাশ সমান হাহাকার দিলেন? কেনো চিরতরে নিঃস্ব করে দিলেন আমাকে? আমি কি আজ জিতলাম নাকি হেরে গেলাম নিজের কাছেই!”

“মুক্তি আনন্দে আমিও হাঁসবো আমার সে হাঁসিতে থাকবে শুধু সুখের প্রলেপ ।আমি উড়বো আনমনে, আমি গাইবো প্রাণ খুলে, আমি তাকাবো অপলক নেত্রে, হাঁ ! এমনিভাবে আমি মরবো অকাতরে”

চলবে?
#Fiza_Siddique

আজকে পর্বটা কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেননা, সাথে আপনাদের ব্যাক্তিগত মতামতও প্রকাশ করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here